সাগরিকা ফিরে এসেছে!কয়েক মিনিটের মধ্যে গ্রামময় এ খবর রটে গেল।খালের পাড়ের মুদির দোকানদার নরেন লাফ দিয়ে উঠে দোকানের ঝাঁপ ফেলে বললেন,‘এর একটা বিহিত করতেই হবে।’ গৌতম তার লুঙ্গির এক মাথা বাঁ হাত দিয়ে ধরে দ্রুত পায়ে মেম্বারের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
ধীরেন সাধু গান বন্ধ করে দিয়ে বললেন, হায়!হায়!হায়! সব অলক্ষ্মীর কারবার!এহোন গঙ্গাজল পাই কই!
সুখদেব পাল প্রতিমার ওপর থেকে তুলির আঁচড় থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কার মাইয়া গো!
নগেন হালদারের বউ উঠোনে ঝাড়ু দেওয়া রেখে কোমরে হাত দেওয়াপূর্বক মাথা ঝুলিয়ে বললেন, হায়!ভগবান! জাতকূল,মান সবই গেলো!
গোপালের বৃদ্ধা মা কুঁজো দেহে লাঠি ভর দিয়ে হালদার বাড়িতে উঠতে উঠতে বললেন, কই! কই, ঢ্যামনি ডা!
সুবল বাবুর মেয়ে সাগরিকা। শহরে পড়াশোনা করতে গিয়েছিল। কয়েক মাস আগে এক মুসলিম ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করে। গত সপ্তাহে ছেলেটি রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। যার স্বামী-সন্তান না থাকে শ্বশুরালয়ও তার ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সাগরিকার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বিধর্মী বলে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে বাড়িতে আশ্রয় দেয়নি। অনেক কান্নাকাটি করে স্বামীর বাড়িতে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেছিল সে। কিন্তু তারা তার অনুরোধকে পাত্তা দেয়নি। মালাউন জাত, মুসলমানের চিরশত্রু! শূকরখোর কাফের! মুসলিম পরিবারে তাদের ঠাঁই হতে পারে না। তাই কোনো উপায় না পেয়ে সাগরিকা আবার পিতৃগৃহে ফিরে আসে।
কিরন মেম্বার তখন ভাত খাচ্ছিলেন। গৌতম দ্রুত নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বললেন, কাগা, ঘটনা তো অ্যাকখান ঘইটগা গ্যাছে।
কিরণ মেম্বার খাওয়া থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আবার তোরা কী ঘটনা ঘটাইলি?
কাগা, আমরা ঘটাইনি। ঘটাইছে হালদাররা।
ক্যান, ওরা আবার কী করল?
গৌতম কিছুটা দম নিয়ে বলল, সুবল হালদারের মাইয়া আবার ফিরগা আইসছে যে।
কিরন মেম্বার বিস্ময়াপন্ন হয়ে মাথা ঝাঁকি দিয়ে বললেন, কী কইতেছস! দু’দিন বাদে পূজা যে!
হয় কাগা। ঠিকই কইতাছি। আপনি তাড়াতাড়ি চলেন।
কিরন মেম্বার থালে জল ঢালতে ঢালতে বললেন, খাড়া! দেহিসখানে ওয়াগো কী করি! এই বলে তিনি ঝাড়া দিয়ে উঠে বড় ঘরে চলে গেলেন।
মেম্বারের মেয়ে অনিতা পাতিল থেকে ভাত বাড়তে বাড়তে বলল, হায়!ভগবান!হতভাগিডার এবার কী যে অইবে!
গৌতম বলল, কী আর অইবে! ওয়াগো সপরিবারে সমাজচ্যুত করব।এ গেরামেও আর থাকতে দেওয়া অইবে না।
তাইলে ওরা যাবে কই?
তা নিয়া তোমার অত চিন্তা ক্যান? তুমি-আমি তো ঠিকই আছি। লক্ষ্মীপূজায় কিন্তু সারারাত আমাগো বাড়িতে থাকবা। তোমার সঙ্গে কতা আছে।
অনিতা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, দেহি।
ঠিক এ সময় মেম্বার হাঁকিয়ে বললেন, গৌতম!
গৌতম উত্তর দিল, এই যে কাগা।
হারামজাদা, তুই ওই ঘরে এহনো কী করোস!
গৌতম দ্রুত খাবার ঘর থেকে বের হয়ে বলল, চলেন কাগা। ইস, সন্ধা হইয়া আসল। খালের চার ঠিক মতো পার অইতে পারবেন তো!
মেম্বার ধমকের সুরে বললেন, আরে থাম তুই! মুই কী বুড়া হয়ে গেছি না কি!
সুবল বাবুর ঘরের সামনের উঠোনে ছেলে-বুড়ো-বউয়েরা জড়ো হয়েছে।সাগরিকা ঘরের মধ্যে খাটের ওপর বসা। ঘরের বারান্দায়ও দুটো বড় চৌকি পাতা। মাঝে টেবিল ও তিনটা চেয়ার আছে। সুবল বাবু পূর্বপাশের চৌকির ওপর মাথা নিচু করে বসে রয়েছেন। নরেন দোকানদার পশ্চিম পাশের চেয়ারে বসে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন আর পা দোলাচ্ছেন। সুনীল মৃধা পূর্বপাশের শেষ চেয়ারটিতে বসে হুক্কায় করে তামুক খাচ্ছেন। রঞ্জিত হালদার তার পাশের চেয়ারে বসে গা চুলকাচ্ছেন। গোপালের মা পশ্চিম পাশের খাটের ওপর বসে জপমালা টিপছেন। মালা টিপতে টিপতে তিনি হাঁক পাড়লেন, কই রে সাগইররার মা। ঘরের আলোডা এট্টু জ্বালাও। অলক্ষ্মীডারে দেহি! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! গুষ্টিসুদ্ধা নরকে যাবি গো, গুষ্টিসুদ্ধা নরকে যাবি!
সুনীল মৃধা বললেন, কই, মেম্বারের কাছে গ্যাছে কেডা?
নরেন দোকানদার উত্তর দিলেন, ওই বাড়ির গৌতম। গ্যাছে অনেকক্ষণ অইছে। এহোনি আইসা যাবে।
ইতোমধ্যেই গৌতম ও কিরন মেম্বার ঘরে প্রবেশ করলেন। নরেন দোকানদার লাফ দিয়ে উঠে বললেন, আইসা পরছেন! বসেন মেম্বার সাব, এই চেয়ারে
বসেন। আপনার জন্যই অপেক্ষা করতেছি।
মেম্বার চোখের চশমাটা ঠিক করে ঘরের ভেতরের দিকটায় সামান্য উঁকি মেরে চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ঘরে আলো নেই ক্যান?
নরেন চৌকিতে বসে বললেন, বৌদি, হেরিকেন কি আর নাই!
ঘরের ভেতর থেকে সাগরিকার মা অস্পষ্ট স্বরে উত্তর দিলেন, জ্বালাইতেছি।
কিছুক্ষণ পরই হারিকেন জ্বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকে কয়েকজন স্ত্রীলোক ঘরে প্রবেশ করতে উদ্যত হলেন। মেম্বার তাদের ধমকের সুরে বললেন, খাড়াও। কেউ ঢুকবা না। মনে রাখবা, ওকে ছুঁইলেও পাপ!
গোপালের মা মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, হ, তবে দূরের তা দ্যাখা যাইতে পারে।
চৌকির ওপর পা তুলতে তুলতে গৌতম বলল, ঠাইরামা, তুমি দ্যাখবা নাকি?
হ, এট্টু মাইয়াডারে দ্যাহার তো ইচ্ছা ছিল।
গৌতম বৃদ্ধাকে ধরে উঠল। তারপর ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল।
কই, সব কিছু ঝাপছা দ্যাখাচ্ছে। গৌতম, আলোডা এট্টু বাড়াইয়া দ্যাও দেহিনি। গোপালের মা বললেন।
সলতে বাড়িয়ে গৌতম হারিকেনটা মেয়েটার কাছাকাছি ধরল। বৃদ্ধা বললেন, দেখিস আবার। গাঁয় ছায়া যেন না পরে। বুড়া বয়সে নরকের ভাগী হব নাকি!
গোপালের মা কিছুক্ষণ মেয়েটির দিকে একনজরে তাকিয়ে থেকে তাকে নিরীক্ষণ করলেন। তারপর মাথা দু’দিকে ঝুলিয়ে বললেন, ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ! লক্ষ্মীর মুখে আজ অলক্ষ্মীর ছাপ!
এ কথা শুনে সাগরিকা চোখের জল আর ধরে রাখতে পারল না। এক সময় কাকা-কাকি-ঠাকুরমারা তাকে কত ভালোবাসত, রূপ-গুণের কত প্রশংসা করত; কিন্তু আজ তাকে সবাই ঘৃণা করছে। কী তার অপরাধ! ভালোবেসে একটি বিধর্মী ছেলেকে বিয়ে করেছে বলে! তাছাড়া ছেলেটি তো এখন আর পৃথিবীতে নেইও। তার এ দুঃসময়ে যাদের সমবেদনা জানানোর কথা, তারা আজ তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। বাহ্! কি বিচিত্র এ পৃথিবীর নিয়ম-কানুন! কতটা নিষ্ঠুর সামাজব্যবস্থা। সাগরিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
তা দেখে গোপালের মা বললেন, ও মাইয়া, এহোন আর কাইনগা লাভ কী লো! জাতকুল তো সবই খাইছো। মা-বাপের মুখে চুনকালি দিছো। গেরামডারে কলঙ্কিত করছো। মুসলমানের অন্ন খাইয়া অন্নপাপ করছো।বিধর্মী পুরষের সঙ্গে সহবাস করছো। ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ! তুমি তো মহাপাপ করছো মাইয়া! এ পাপের নিস্তার নাই।
সাগরিকা আর সহ্য করতে পারল না। পাশের বালিশ মুখে চেপে ধরে একেবারে হু হু করে কেঁদে উঠল। তা শুনে, মেম্বার গলায় খাক দিয়ে নরেনের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে ভ্যাংচি কেটে বললেন, সব ঢঙ বুঝেছ, সব ঢঙ! এখন তো আর এ কূলও নাই, ও কূলও নাই; কান্না ছাড়া কী আর করবে। শোনো বেটি, মায়া কান্দা কাইন্দা কোনো লাভ নাই। ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ! ওই গেরামে গিয়া আর তো মুখ দ্যাখাইতে পারবো না!
সুনীল মৃধা বললেন, তয়, ওকে অ্যাহোন কী করবেন?
মেম্বার চেঁচিয়ে বললেন, আমি আর কী করব। করবে যার মেয়ে সে। আমার মেয়ে অইলে তো কাইটা সাগরে ভাসাই দিতাম। ওতো ধর্মপাপ করেছে!এ পাপের উচিত শাস্তি এটাই।
সুবল বাবু প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। ধর্মপ্রাণ তবে কুসংস্কারাচ্ছন্ন নন। সভা-সমাজে যান। ধর্মকথা বলেন। আবার কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মানুষকে বোঝাতেও চেষ্টা করেন। কিন্তু লজ্জা-ঘৃণায় এবার আর প্রতিবাদ করতে পারলেন না। তারপরও কিছুটা নরম সুরে বললেন, এসব কী বলেন, মেম্বার সাব!
মেম্বার উত্তেজিত হয়ে বললেন, মানে! আপনার মাইয়া আকাম-কুকাম কইরা বেড়াবে; আর আমরা চাইয়া চাইয়া দ্যাখবো। এই গেরামের আর কোনো মাইয়া যেন এ কাম করার সাহস না পায়, হেই ব্যবস্থাই করা হবে, বুঝলেন মাস্টার সাব!
এ কথা শুনে সুবল বাবু মাথটা আরও নিচের দিকে ধীরে ধীরে নামিয়ে নিলেন। নরেন কৌতূহলী হয়ে বললেন, হেই ব্যবস্থডা কী!
মেম্বার বললেন, আরে খাড়াও। আগে ওর পাপ কামগুলো জাইনা লই; তারপর বিচার অইবে। দরকার অইলে সারারাত বইসা বিচার করব। কী কও তোমরা?
সুনীল মৃধা হুক্কা টানতে টানতে মাথা ঝেঁকে বললেন, হু।
কিরন মেম্বার বললেন, বিচার করতে বইলাম; তয় বিড়ি কই? ও রঞ্জিত দা, কতা কও না কেন?
রঞ্জিত হালদার লজ্জাজনক ভঙ্গিতে বললেন, মুই আর কী কইবো। তোমরা কতা বলছো, মুই হুনতেছি। ধুতির কোচা থেকে বিড়ি বের করতে করতে তিনি আরও বললেন, বিড়ি খাবা, আগে বলবা তো! এই নেও। মেম্বার হাত বাড়িয়ে বিড়ি নিলেন।
বিড়ি টানতে টানতে মেম্বার ঘাড় কিছুটা লম্বা করে হাঁক পাড়লেন, এই বেটি; যা কব, তার ঠিক ঠিক উত্তর দিবা কইলাম!
এ কথার পর কেউ কোনো শব্দ করল না। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে মেম্বার আবার বললেন, নামাজ-টামাজ কি পড়া শুরু করছিলা!
ভেতর থেকে কোনো প্রত্যুত্তর এলো না। কোনো সাড়া না পেয়ে তিনি আবার হাঁক পাড়লেন, ওই বেটি, কতা কও না ক্যান! কয় দিন গরুর মাংস খাইছো! এবারও কোনো উত্তর এলো না।
মেম্বার ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন, দেখছনি কারবার, মাইয়ার কী সাহস! নরেন, কিছু কও না কেন?
ঘর থেকে সাগরিকার মা জবাব দিলেন, ওরা একদিন জোর করে খাওয়াইছিল। তাও বমি কইরগ্যা ফ্যালাই দিছে।
মেম্বার মাথা ঝুলিয়ে বললেন, হু! পুরা মুসলমান অইয়া গ্যাছে! প্যাটে গরু গেলে কি আর হিন্দু থাকে! মুসলমানের ঘরে কয় মাস ছিলা জানি?
তার মা জবাব দিলেন, মাস পাঁচেক হবে।
গোপালের মায়ের দিকে তাকিয়ে মেম্বার জিজ্ঞেস করলেন, ও কাকিমা, প্যাট্টা এট্টু দেখছিলেন কী?
প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, না রে বাপ্! ওইডারে কেডা ছুঁইতে যাবে! এই বয়সে জাত হারাবো নাকি!
বাইরে থেকে নগেনের বউ বললেন, মাগিডার প্যাটে, দু’মাসের বাচ্চাও আছে।
কিরন মেম্বার বিস্মিতভঙ্গিতে উত্তর দিলেন, কী কও নগেনের বউ! এইবার আর বুঝি বাঁচানো গেল না!
কয়েক মিনিট পর্যন্ত সবাই নীরব। গৌতম গলা খাকিয়ে বলল, কাগা, অনেক রাত অইছে। অ্যাহোন রায় দ্যান!
ক্ষান্ত হ বেটা। দেব, দেব। সবুর কর। দশ গেরামে মাতুব্বরি করি। বিচারের তো অ্যাট্টা নিয়ম-কানুন আছে। তোরা পোলাপান মানুষ; নিয়ম-কানুনের কী বুজবি লো! শোনেন মাস্টার সাব, আপনার কোনো কতা কওয়ার আছে না কি? কিছুটা কোমল সুরে বললেন মেম্বার।
সুবল বাবু মাথা ধীরে ধীরে তুললেন। তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। সবার দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে করুণ কণ্ঠে বললেন, পাপ করছিলাম। মহাপাপ! সেই জন্যই আমার পোলাডা মরল। মাইয়ারে নিয়া আজ এই দুর্দশা। ওয়ারে বড় ভালোবাসতাম; বিশ্বাস করতাম। ভাবছিলাম পড়াশোনা কইরগা মানুষের মতো মানুষ হবে। বড় চাকরি করবে। সব আশা-ভরসা আজ মাটি হইয়া গেল। দশ জনের সামনে আমার মাতা খাইল। আমি আর বাঁচতে চাই না মেম্বার সাব, বাঁচতে চাই না!
কিরন মেম্বার আবার বললেন, এইডাই কী শেষ কতা, আর কোনো কতা নাই?
সুবল বাবু উত্তর দিলেন, অ্যাট্টা কতা আছে। যদি আপনারা রাহেন…। জেলা হাসপাতালে গিয়া ওর বাচ্চাটা ফ্যালাই দেবো। ওরে চন্দ্রায়ন করে শুদ্ধি করব। তারপরও যদি এই গেরামে ওরে এট্টু জায়গা দেন…।
এ কথা শুনে নরেন দোকানদার উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, একি কয়, সুবলদা! পাগল অইয়া গ্যাছে নাকি! এই আজাত-কুজাতরে জায়গা দিলে গেরামে তো শনির কোপ পরবে। লক্ষ্মী ঘর ছাইরগা পালাইয়া যাবে। পাপের ঘড়া ষোলোআনা পূর্ণ অইয়া গেরামে মড়ক লাগবে মড়ক!
মেম্বার মাথাটা দু’দিকে ঝাঁকিয়ে বললেন, না রে মাস্টার সাব, আপনার এ আবদার তো রাখা যাবে না! যথার্থ শাস্তি না দিলে শেষে পাপের বোঝা যে আমার মাথায় এসেই চাপবে। এতো অইতে পারে না! সুনীল দা, তুমি কি কও?
সুনীল মৃধা মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, হ, হক কথাই কইছো। তয় মশায় বড় কামড়াইতেছে, তাড়াতাড়ি বিচারের কাজটা সাইরা ফ্যালাও।
কিরন মেম্বার এবার নড়েচড়ে বসলেন। তারপর ধীর কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন, দশ গেরামে বিচার করি। আইজ পর্যন্ত কেউ আমার মন্দ কইতে পারেনি। বিভিন্ন কামে মাঝে মইদ্যে থানায়ও যাইতে অয়। থানার বড় বাবুও আমারে বেশ সম্মান-সমীহ করে। এহোন কতা অইলো যে, আমার রায় কি তোমরা মানবা?
গৌতম, নরেন দোকানদার, সুনীল মৃধা, রঞ্জিত হালদার সবাই মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব দেয়।
মেম্বার সাহেব এবার গলা খাকিয়ে বললেন, তয় এহোন রায় জানাইতে পারি। ওই কুজাত মাইয়ারে এ গেরামে আর রাহা যাবে না। কাল সকালেই ওর মাতা ন্যাড়া কইরগা গেরাম থেকে খ্যাদাই দিতে অবে। ওরে তো আর ছোঁয়া যাবে না। হেইজন্যে সকাল বেলাই নাপিত রে খবর দিতে হবে। সঙ্গে ব্রাহ্মণরেও। গৌতম, তুই কামডা পারবি না?
গৌতম ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা ঝাঁকালো। মেম্বার আবার বলে চললেন, নাপিত বেটায় একাই মাতা ন্যাড়া করাবে। কেউ কিন্তু ওরে ছোঁবা না, কইয়া দিলাম। আর গেরাম থেকে খ্যাদানোর সময় ব্রাহ্মণের মন্ত্র পড়া শুদ্ধ জল ছিটাতে অবে। এই কামটা কেডা করবা?
বাইরে থেকে ধীরেন সাধু উত্তর দিলেন, মুই করবো নে, মেম্বার! মেম্বার সাহেব এবার নিচু হয়ে জুতা তুলতে তুলতে বললেন, তয় আর কি। এই কতাই রইল। এহোন তাহলে উঠি। তোমরা যার যার ঘরে ঘুমাও গিয়া। আবার সকাল বেলাই চইলগ্যা আইসো। বাবা, গৌতম তুমি তাইলে আমারে খালের ওপার পর্যন্ত এট্টু আগাই দিয়া আসো।
গৌতম উঠে বলল, চলেন কাগা।
সবাই একে একে চলে গেলেন। চারদিকে থম থমে পরিবেশ। ঝিঁঝির পোকার আওয়াজ ক্ষাণিকটা বেড়ে গেল। লক্ষ্মী পেঁচাটা সাঁই করে রেইন্ট্রি গাছ থেকে চাম্বল গাছে উড়ে গেল। ঘুন পোকারা দুই দশকের পুরনো চেয়ারগুলো কুট কুট শব্দে কাটতে শুরু করল। ঘরে শুধু সুবল বাবু, তার স্ত্রী ও সাগরিকা। সবার চোখে অশ্রু। কী হতে কী হয়ে গেল! যেখানে মেয়েকে মহাধুমধামে বিয়ে দেওয়ার কথা; সেখানে মেয়ের করুণ বিসর্জন। যেখানে সবার সামনে মেয়ের গর্ব করার কথা; সেখানে বাবার লজ্জাজনক নীরবতা। সুবল বাবু আর ভাবতে পারছেন না। তিনি কোমল সুরে স্ত্রীকে ডাকলেন। সাগরিকার মা চোখ মুছতে মুছতে কাছে এলেন।
সুবল বাবু বললেন, ট্রাঙ্কে হাজার পাঁচেক টাকা আছে। ওইগুলা নিয়া ওয়ারে ভোর রাইতেই গেরাম ছাইর্যা যাইতে কইবা।
স্ত্রী বিস্ময়াপন্ন হয়ে বললেন, এইডা কী কও তুমি!
সুবল বাবু এবার পৌরুষোচিত কণ্ঠে ধমকের সুরে বললেন, কী কই মানে!তোমার জইন্যই তো ওইডায় এমন অইছে। অ্যাঁ, আদর দিয়া মাইয়ারে মাথায় তুইল্যা নাচাইছে। এহোন বোঝো ঠ্যালা! সকাল অইলেই তো ওয়ারে ন্যাড়া কইর্যা কুত্তার মতো গেরাম থেকে খ্যাদাইয়া দেবে নে। তাই দ্যাখবা! যা কই ভালোর জইন্যই কই। ভোর রাইতেই ওয়ারে বিদায় দেবা! মুই ওই দৃশ্য দেখতে পারব না! শিক্ষক অইয়া এ অপমান সইতে পারব না। তাইলে তার আগেই বিষ খাইয়া মইরগা যাব, কইয়া থুইলাম!
স্ত্রীও কণ্ঠ ভারী করে বললেন, হয়, মরো! মুইও মরবো! তবু মুই মাইয়ারে জলে ভাসাইয়া দিতে পারব না। সব ওই মেম্বারের ফন্দি। বোঝো না! তোমারে উনি সহ্য করতে পারেন না। হারামজাদাডায় সব সময় মোগো ক্ষতি চায়। হে ভগবান, মেম্বারের ঘরেও যেন এই দুর্দশা অয়!—এই বলতে বলতে তিনি ঘরে চলে গেলেন।
ভোর হতে আর বেশি সময় বাকি নেই। সারারাত কেউ ঘুমায়নি। সুবল বাবু ঘরের চৌকাঠে হেলান দিয়ে উদাস মনে বসে রয়েছেন। স্ত্রী মেয়ের মাথার পাশে বসে বসে অশ্রু মুছতে মুছতে চোখ লাল করে ফেলেছেন। সাগরিকা কাৎ হয়ে শুয়ে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়েছে।কেউ কারও সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেনি। ইতোমধ্যেই কয়েকটা শিয়াল হুক্কাহুয়া করে একসঙ্গে ডেকে উঠল। সাগরিকার মা কিছুটা আঁৎকে উঠলেন। কাপড়ের আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে পূর্ব পাশের জানালা দিয়ে ঘরের বাইরের দিকে ক্ষাণিকটা তাকিয়ে মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে বললেন, মা সাগরিকা!
সাগরিকা কোনো সাড়া দিল না। তারপর তিনি আরও জোরে ধাক্কা দিয়ে বললেন, মা রে…!
সাগরিকা একটু নড়ে বলল, হু।
রাত বেশি যে আর নাই রে, মা!—এই বলে তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
তারপর কয়েক মিনিট চলে গেল। কেউ কোনো কথা বলল না। কিছুক্ষণ পর সাগরিকা ধীর গলায় বলল, মা, বাইরে কি খুব আন্ধার?
মা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ধীরে ধীরে চলতি পারবি। মুই ব্যাগ গুছাই রাখছি।
সাগরিকা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, মা, আরেকটু সময় থাকি!
এ কথার পর সাগরিকার মা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে একেবারে হু হু করে কান্না শুরু করে দিলেন।
তা শুনে সাগরিকা কাঁপুনে গলায় বলল, কাইন্দোনা, মা। তোমাগো আর দোষ কী, কও! সব মোর কঁপালের ফের। ছোট্ট ভাইডার কতা আইজ খুব মনে পড়তেছে। মনে অয়, ও মোরে দুই আত বাড়াইয়া ডাকতেছে। আর কইতেছে, দিদি; মোর কাছে চইলগ্যা আয় তুই; মোর কাছে চইলগ্যা আয়।
এ কথা শুনে মা তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে উচ্চস্বরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, এইডা কী কস মা! এইডা তুই কী কস!
কিছুক্ষণ পর সুবল বাবু বারান্দা থেকে বললেন, ওয়ারে অ্যাহোনো যাইতে বলো না ক্যান? এরপর কেউ দেইখ্যা হ্যালাবে।
বছর বিশেক আগের কথা। সুবল বাবুর স্ত্রী চাইতেন তাদের প্রথমে ছেলে হোক। কিন্তু সুবল বাবু চাইতেন মেয়ে হোক। কারণ মেয়েদের মধ্যে মাতৃশক্তি বিরজমান। ছেলেবালাতেই সুবল বাবুর মা মারা যান। তিনি নিজের মেয়ের মধ্যে মায়ের হারিয়ে যাওয়া মুখ খুঁজে পেয়েছিলেন। শিশুপুত্র মারা যাওয়ার পর ভেবেছিলেন এমন কোনো ছেলের কাছে মেয়েকে বিয়ে দিবেন, যে পিত্রালয়-শ্বশুরালয় দুই পরিবারকেই বুকে আগলে রাখবে। কিন্তু সুবল বাবুর স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। দুর্গোপূজা শেষ হওয়ার দু’তিন দিনের মধ্যেই তিনি মাকে হারিয়েছিলেন, তারপর ছেলেকে; এবার বিসর্জন দিচ্ছেন মেয়েকে। তবে বোদ্ধাদের চোখে, এতো বিসর্জন নয়; বলিদান। চিরকাল পুরুষতন্ত্রের বলির শিকার নারীরা। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এ নিয়ম কখনো জনসম্মুখে, কখনো গোপনে, কখনোবা বিবেক বোধের বিচার অক্ষমতার সুযোগে পালিত হয়ে আসছে। হায়, নারী! আধুনিক যুগে এসেও পরিবার, সমাজ, সর্বোপরি পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তোমাদের সুকৌশলে শোষণ করে চলছে। তোমরা শোষিত, লাঞ্ছিত, নিগৃহিত ও অধিকারবঞ্চিত। তবু কি তোমরা অবলা থেকেই যাবে!
সাগরিকা উঠে দাঁড়ালো। চোখ দুটো ভালো করে ওড়না দিয়ে মুছে নিল। তার মায়াবি নীলাভ নেত্রদ্বয়ের নিচে কালির রেখা জেগে উঠেছে। লক্ষ্মীর মতো গোলগাল সুশ্রী মুখটা গোড়াকাটা ফুলধরা গোলাপ গাছের বেশ ধারণ করেছে। হঠাৎ কোনো ঝড় এসে সুলম্বিত কৃষ্ণকালো কেশগুচ্ছকে যেন আলুথালু করে দিয়ে গেছে। সাগরিকা হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা তুলে নিল। তারপর নিঃশব্দ পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে চলল। পিছু পিছু এলেন মা। সাগরিকা নিজেই দরজা খুলল। আকাশে তখনো আলোর রক্তিমরেখা অঙ্কিত হয়নি। পাখিরা কূজন শুরু করেনি। ঠাণ্ডা বাতাস হু হু করে বইছে। সাগরিকা এক পা বাইরে ফেলল। তারপর কী যেন ভেবে থমকে দাঁড়ালো। হঠাৎ হাত থেকে ব্যাগ ফেলে দিয়ে ঘরের দিকে ঘুরেই মাকে জড়িয়ে ধরে আর্তচিৎকার দিয়ে বলল, মাগো! আমি এহোন কই যাব!