অপরাধ স্বীকার মানুষ কখন করে, সে এক আশ্চর্য ব্যাপার! অপরাধ না করেও কখনো কখনো স্বীকার করে নিতে হয়। ক্ষমতার কাছে কিংবা আধিপত্যবাদী শক্তির কাছে সবকিছুই ঠুনকো। ক্ষমতা কখনো কখনো এমন এক আদর্শিক নমুনা তৈরি করে যাতে সাধারণ লোকজন নিষ্পেষিত হলেও স্বতঃস্ফুর্তভাবে সে ক্ষমতারই জয়গান করে। সোহান তা জানে। জেলখানার কামরায় বসে বসে এমন ভাবনা তাকে আজ আচ্ছন্ন করে রাখে। আজ প্রায় ছয় বছর হলো সোহান জেলখানায় বন্দি। সোহান জানে সে কোনো অপরাধ করেনি। কিন্তু তাকে শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। আসলে সমস্যাটা ভিন্ন। যখন অন্যজনের কাছে বলতে চায় তখন মুখ দিয়ে নিজের নিরাপরাধের কথা সে বলতে পারে না। যা বলে তা শেষ পর্যন্ত নিজেই অপরাধী হিসেবে প্রতিপন্ন হয়। মনের অজান্তেই সে এমন কথা বলে ফেলে, যাতে সে নিজেই দোষী হয়ে ওঠে। মনের এ অবস্থা থেকে সে বের হয়ে আসতে পারে না। সোহান এ থেকে বেরুনোর কোনো পথও খুঁজে পায় না। জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে বসে আজ নিজেকে বড় অসহায় লাগে তার। এমন সময় বয়োজ্যেষ্ঠ কয়েদি শাকিল এসে সোহানকে খোঁচা মারে।
কিরে সোহান? ধ্যান ধরছস কেন?
সোহান কিছু বলে না।
কী হইছে তোর? এটা তোর শ্বশুর বাড়ি না। শালা সমন্ধি তোরে তেল মাখবো না।
এমন করছেন কেন। সোহান সম্বিৎ ফিরে পায়।
খাবারের সময় যায়। তোর খাবার কেডা আনবো শালা?
সোহান কিছু না বলে চুপচাপ থাকে। সোহান আগে খুব ভীতু ছিল। আজ কয়েকদিন হলো সে ভয় পায় না। তবে নতুন একটা সমস্যায় সে ভুগছে। কথা বলতে গেলে সে যা বলে লোকজন তার ভিন্ন অর্থ বুঝে।
সোহানকে নির্বিকার দেখে শাকিল চুপসে যায়। শাকিল দীর্ঘদিন ধরে সোহানকে জেলখানায় দেখছে। সবাই হুলস্থুল করে। মারামারি করে। হাতাহাতি-ধাক্কাধাক্কি করে কিন্তু সোহান সব সময়ই চুপসে থাকে। কারণটা কী। শাকিল কোনো কিছু বুঝে উঠতে পারেনি।
পরদিন সকালে সবাই যখন ইট ভাঙতে চলে গেছে তখন শাকিল সোহানের কাছাকাছি এসে বসে। জেলখানার মধ্যে সিগারেট খুব দামী। কয়েকদিন আগে এক কয়েদিকে পাঠানো টাকার বড় অংশ সে ছিনতাই করে নিয়েছে। সে টাকা দিয়েই সিগারেট কিনে কয়েকদিন ধরে খাচ্ছে। সিগারেট ধরিয়ে সুখ টান দিতে দিতে সোহানের কাছে ঘেঁষে বসে। শাকিলের স্বরে কোনো আবেগ অনুভূতি নেই। কর্কশ ও রূঢ় বাস্তবতা তার কণ্ঠস্বরে। সোহানকে নানা কিছু জিজ্ঞাস করতে যায়। সোহান সব সময়ই চুপচাপ থাকে। কখনো কাউকে কিছু বলে না। আজ যখন শাকিল জিজ্ঞাস করছে তখন সে মুখ খোলে, আমার বড় সমস্যা শাকিল ভাই। আমি অপরাধ না করলেও অপরাধী সেজে যাই। নিজেই নিজেকে অপরাধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলি। যা বলা উচিত সেটা না বলে উল্টোটা বলে ফেলি।
আরে এটা একটা মানসিক অসুখ।
এটা মানসিক ব্যাধি বলে আমার মনে হয় না। এটা আধ্যাত্মিক কোনো সমস্যা। আত্মাটা কে যেন চালায়। তাই আমি যা বলতে চাই তা বলতে পারি না। আত্মা উল্টোটা বলায়।
তুই কবে থেকে বুঝলি?
জেলের প্রকোষ্ঠে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতে সন্ধ্যা গড়াতে থাকে। কয়েদিদের ভিড়ে সোহানের কান্না আর বোঝা যায় না।
এক আধ্যাত্মিক যাজক দীক্ষাধারীর সঙ্গে কিছুদিন ছিলাম। তারপর থেকে এমনটা হয়। অপরাধ না করেও অপরাধ স্বীকার করে ফেলি। ইদানিং আমি যা বলি লোকজন তা না বুঝে উল্টোটা বোঝে।
আরে না না। কেউ তোকে খুব ভয় দেখিয়েছে বোধহয়। সেজন্য ভয়ে অবচেতনভাবে এমন হয়।
এমন সময় রাইটার এসে উপস্থিত হয়। আগামীকাল সোহানকে কোর্টে যেতে হবে।
সেদিন এজলাসে লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠেছিল। তখনো জজ সাহেব এসে পৌঁছাননি। দুই পক্ষের উকিল পায়চারী করছিলেন। বেঞ্চে যেন জায়গা হচ্ছিল না। এত লোকের সমাগত। অবাক করার মতো। এমন সময় জজ সাহেব এসে বসেন। প্রথমেই আসামিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। সোহান কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ায়। এমন সময় পুলিশ এসে ধমক দিয়ে হাত জোড় করে রাখতে বলে। সোহান হাত জোড় করে মাথা অবনত করে দাঁড়িয়ে থাকে। সোহানের ভাগ্য ভালো। আপিলের তারিখ পড়েছে। বিচার পুনরায় সম্পন্ন হবে। উকিল এসে সোহানকে প্রশ্ন করে,
তুমি কি অপরাধ করেছ?
সোহান কিছু বলতে চায়। কিন্তু তার মুখ কে যেন আটকে ধরেছে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোয় না। অনেকক্ষণ চেষ্টা করতে থাকে। তারপরও কথা বেরুতে চায় না। কে যেন গলা টিপে ধরেছে। সোহান নিজে নিজের গলাটা হাত দিয়ে দেখে কিন্তু কোনো ত্রুটি খুঁজে পায় না। হঠাৎ তার গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে, হ্যাঁ।
বলার সঙ্গে সঙ্গে সোহান চমকে ওঠে, এ কী বললো! সোহান বলবে ‘না’। কিন্তু সে হ্যাঁ বলে ফেললো কেন। সঙ্গে সঙ্গে এজলাসের সবাই হায় হায় করে ওঠে। আসলে আদালতে প্রথমেই নাম, বয়স জিজ্ঞাসা করে শপথ পাঠ করায়। কিন্তু এ ব্যতিক্রমেই সোহান প্রায় সম্বিতহীন হয়ে পড়েছে। বাদী পক্ষের উকিল সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, ইয়োর অনার। আসামি নিজেই অপরাধ স্বীকার করছে। তারপরেও এ কেসে কিভাবে আপিলের আবেদন করে স্যার?
আসামির পক্ষের উকিল যেন হুঙ্কার দিয়ে উঠে, ইয়োর অনার। আমার মক্কেল মানসিকভাবে দুর্বল। আসামিকে প্রথাগতভাবে জিজ্ঞাস না করে আচমকা এমন উদ্ভট প্রশ্ন করেছে বলেই সে অপ্রতিভ হয়ে এমন কথা বলে ফেলেছে। তাকে স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞাস করুন, সে সবকিছুর সঠিক উত্তর দিতে পারবে।
আপনি ঘটনার দিন কোথায় ছিলেন?
অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
দেখুন দেখুন মাই লড। নিজেই বলছে সে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে বোমাটি ছুড়েছে।
সোহান বেবাচ্যাকা খেয়ে যায়। আসলে ঘটনার দিন সোহান তার বাড়িয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল। কারণ সেদিন সন্ধ্যা থেকে ওই এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। সোহান খেয়াল করে তার কথার তো ভুল ব্যাখ্যা হচ্ছে। তাই সে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ঘটনাটা তেমন না। অন্ধকার… বলতে যাবে এমন সময় উকিল বলে ওঠে, ঘটনাটা তাহলে কেমন?
না। মানে সেদিন আমার সাথে আমার এক বন্ধু ছিল…
দেখেন দেখেন এ কাজ সে একা করেনি। তার সহযোগীর নামও তালিকায় আছে।
জজ সাহেব কোনো কথা না বলেই উঠে চলে যান। কোনো মুলতবি ঘোষণাও করেন না। সবাই কানাঘুষা করতে থাকে জজ সাহেব এমন করলেন কেন। সাধারণত এমনটা তো দেখা যায় না। সবাই প্রায় দুপুর পর্যন্ত বসে থাকে। কিন্তু জজ সাহেব আর আসেন না। উকিলরাও কিছু জানে না। অফিস থেকেও কিছু জানানো হয় না। ঠিক বিকাল ৩টার দিকে চাপরাশি এসে জানায়, এজলাস আজ স্থগিত। ফলে আসামিকে আবার নিয়ে যাওয়া হয় জেলখানায়। জেলের প্রকোষ্ঠে বসে সোহানের কান্না করার ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
রাজনীতি বা ক্ষমতা যখন শক্তিশালী থাকে, তখন শাসক যা চায় জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে সে সম্মতিই দিয়ে থাকে। ক্ষমতা অন্যায় করলেও ক্ষমতার পক্ষেই কথা বলে। তাহলে সোহানও কি তাই? ক্ষমতাশীলরা নিজের পক্ষে জনমত তৈরি করার জন্য এমন কিছু কৌশল তৈরি করে যে, সাধারণ লোকজন অত্যাচারীর প্রশংসাই করে। সোহান ভাবতে থাকে, এমনটা কেন হয়। প্রয়োজনের সময় বা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে অবচেতনভাবেই সোহানের কথা উল্টে যায় কেন। সোহান কখনো কাঁদে না। কিন্তু আজ কাঁদতে ইচ্ছে করছে। জেলের প্রকোষ্ঠে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতে সন্ধ্যা গড়াতে থাকে। কয়েদিদের ভিড়ে সোহানের কান্না আর বোঝা যায় না।
অবশ্য কিছুক্ষণ পরে সোহান সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্তটি হচ্ছে, রাষ্ট্রযন্ত্র যা বলাবে সে তাই বলবে। এছাড়া সোহানের বলার আর কিছু নেই।
পরদিন সকাল ১১টায় কাকতালীয়ভাবে সোহানের জামিনের আদেশ আসে। এ এক অবিশ্বাস্য! এ এক কাকতালীয় ঘটনা। সোহান কখনো ভাবতে পারেনি সে মুক্ত হবে। কিন্তু কিভাবে ঘটলো। এ এক রহস্যের ব্যাপার। কে করলো? কেন করলো, কিভাবে করলো কিছুই বুঝতে পারে না। শেষ পর্যন্ত বুঝতেও চায় না। জামিনের আদেশ পাওয়াই তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যকিছু ভাবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু জামিন, এ যে প্রায় নিয়মবর্হিভূত কাজ-কারবার। নানা নিয়মনীতির পরে জমাদারের কাছ থেকে সবকিছু বুঝে নিয়ে সোহানের জেলখানা থেকে বের হতে হতে প্রায় বিকালই হয়ে যায়। কেনই বা গতকাল এজলাস বন্ধ করে দিয়েছিল। কেই বা তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তা কিছুই বুঝতে পারে না। শুধু ঘটনাগুলো দেখে। কে ঘটায়, তাও সে জানে না। কিভাবে ঘটে, তাও বোঝে না। জেলখানার গেটে রিকশা পাওয়া যায় না। একটু হাঁটতে হয়। কিন্তু হেঁটে এগিয়েও তার লাভ হয় না। পকেটে টাকা কোথায়? তাই বাড়ি পর্যন্তই তাকে হেঁটেই যেতে হয়। কেউ তো নিতে আসেনি।
বাড়ি পৌঁছে সোহান অবাক হয়। তাকে যেদিন থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সেদিন থেকে সরকারি এক অফিস তার পরিবারকে মাসে মাসে টাকা দিচ্ছে। এ ঘটনা জেলখানায় তাকে জানানো হয়নি। রাজধানীতে বোমা হামলায় অনেকে মারা গিয়েছিল। যদি আসামি ধরা না যায়, তাহলে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হবে। সেজন্য তদন্ত কর্মকর্তা সোহানকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিল হয়তো। বিচারেও সোহানের শাস্তি হয়েছে। সোহান বুঝতে পারে দেশের রাজনীতির ভেতরে বড় একটা পরিবর্তন হয়েছে। সম্প্রতি বলা হচ্ছে বোমা হামলার বিচার সাজানো নাটক। ঘটনা যদি ভিন্ন দিকে যায়, সেজন্যই খুব দ্রুত জামিন করে সোহানকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। ক্ষমতা কতকিছুই না করতে পারে।
সোহান এতসবের কিছুই জানতো না। ধীরে ধীরে সে ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে যায়। ড্রয়িং রুমের টেবিলে এলোমেলো সাজানো কয়েকটি পত্রিকা দেখতে পায়। পত্রিকাগুলো সম্ভবত গত দুই মাসের। হঠাৎ পত্রিকাগুলোতে আবিষ্কার করে নিজের ছবি। বিস্মিত হয় তাকে নিয়ে এত নিউজ হয়েছে তা দেখে। মানুষ ন্যাকড়ার পুতুলের মতো প্রাণহীন। আর সমাজ রাষ্ট্রের কিছু মানুষ ক্রীড়নক। ব্যক্তি চেতনা থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যন্ত সম্মতি উৎপাদনের খেলা।
নিউজগুলো দেখতে দেখতে চোখের পাতাগুলো প্রতারণার শিকারে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। ধীরে ধীরে চোখ বুঝে আসতে চায়। ঠোঁট নড়তে থাকে। সোহান বুঝতে পারে না ঠোঁটের অভ্যন্তর থেকে যে সত্য কথাটা সে বলতে চাচ্ছে, সেটা বলতে পারবে কি না। এমন সময় সোহানের তন্দ্রাভাব কেটে যায়। মনে হয় কল্পনায় কতকিছুই না কল্পনা করে ফেলেছে। নিজের শরীরের দিকে তাকায়, অস্তিমজ্জাহীন স্বাস্থ্যের দিকে তাকিয়ে তা কল্পনা মনে হয় না। তবে কি কল্পনা দিবাস্বপ্ন নয়? সোহান আরেক ঘোরের মধ্যে পড়ে। এতক্ষণের ভাবনাগুলো কি স্বপ্ন কিংবা বাস্তব? সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সোহান। ঘরে খুব জোরে ফ্যান চলছিল। হাতের কাছে পত্রিকাগুলোও দেখতে পায় না। অবশ্য কিছুক্ষণ পরে সোহান সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্তটি হচ্ছে, রাষ্ট্রযন্ত্র যা বলাবে সে তাই বলবে। এছাড়া সোহানের বলার আর কিছু নেই।