নাম তার আজাদ। সবাই বলে, আজাদ অতি কোমল প্রকৃতির ছেলে। সত্যি সবার থেকে আলাদা। সে আসলে নিজের মাঝে নিজের ধর্মকে গড়ে নিতে পছন্দ করে। সে কিছু বিশ্বাস নিয়ে বাঁচতে চায়। সে মনে করে জীবন ও মৃত্যুর ঠিক মাঝামাঝি বড় শূন্যতার বসবাস রয়েছে। যা জীবন মৃত্যুর অনুভূতি দেয়। জোনাকির মতো সে কখনো আঁধার কখনো আলো। কেনু মাঝির উঠোন যখন সজনে ফুলে ভরে যায়, কেনু মাঝি আর তার বউয়ের মুখে সুখের হাসি হেমন্তের সকালে হিম-হিম আদরের মতো ছড়িয়ে যায়। আবার মাঝির নাও যখন রাতের আঁধারে মহানন্দা পাড়ি দেয় একা একা! ঘুমের ভেতর সে আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে ওঠে, আমার নাও! আমার নাও! ওই হাসিটা, ওই আতঙ্ক উভয়ই জীবন। উভয়ই জীবনকে অনুভব করায়। সে হাসি—সে চিৎকার; দুয়ের মাঝে আছে একটি শূন্যতার অস্তিত্ব।
ছাগল ছানাটার চিৎকার শোনা যাচ্ছে। আজ সারাটা দিন সে চিৎকার করে চলেছে—ম্যা,ম্যা,ম্যা…। মাকে হারানোর ভয় ওকে আতঙ্কিত করে রেখেছে। এখনো সে নিজ চোখে পৃথিবীকে দেখতে শিখেনি। কেনু মাঝির মতো ওর মাও হারিয়ে গেছে। এসব যখন হাসপাতালের বারান্দায় বসে আজাদ ভাবছিল, কলি এসে বলল, ভাইয়া এ ওষুধটা আনতে হবে, কুইক।
আজাদের পা দুটো কেন জানি পাথর হয়ে ছিল। কলি তার ছোট বোন। মায়ের অসুখ নিয়ে ভীষণ এলোমেলো সে কদিন। বেশি স্ট্রেস সহ্য করতে পারে না ও।
কী হলো? যাও। টাকা দিচ্ছি তো। কলির কথার মাঝে একটা অনুযোগ লুকিয়ে আছে।
প্রেসক্রিপশনের সঙ্গে টাকাটাও নিতে হলো। হাসপাতালের পেছনে ময়লার স্তূপের মধ্য থেকে ছেলে-মেয়েরা ব্যবহৃত সিরিজ, সেলাইন সেট, পানীয়, জলের বোতল কুড়াচ্ছে। আজাদের মনে হয়, ওরা আসলে জীবন কুড়াচ্ছে। অন্ধকারের ওসব উচ্ছিষ্টের মাঝে আজাদ বার বার নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিল। বার বার টোকাইগুলো তাকে তুলে বস্তায় পুরছে। আজাদ মাঝে মাঝে প্রাণহীন বস্তুর মধ্যে নিজেকে অনুভব করে। তার জীবন জোনাকি টোকাইগুলোর বস্তায় কখনো জ্বলছে কখনো নিভছে। কোনো কোনো সময় মানুষের মনে হয় মাধ্যাকর্ষণ ওকে ছেড়ে দিয়েছে। সে উড়ছে আকাশে। আজাদেরও এমন হয়। তখন নিজেকে জীবন আর মৃত্যুর অনেক ঊর্ধ্বে মনে হয়। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের মোড়ে অসংখ্য মেডিসিনের দোকান। প্রেসক্রিপশন দেখালে দোকানি বলে, আছে দেব?
দাম কত আসবে?
হাজার/বার শ। কলি দিয়েছে এক হাজার। লোকটি ক্যালকুলেশন করে আরও নব্বই টাকা বেশি বললো।
এত!
সব বিদেশি ওষুধ লিখেছে, এ ডাক্তারের স্বভাব খারাপ। এসব ওষুধের প্রডাকশন দেশেও হয়। মানও ভালো, রপ্তানিও হচ্ছে।
দেশি কোম্পানিরগুলো দেন।
এ ডাক্তার এসব বিদেশি কম্পানির খরচে দুয়েক বছর পরপর ইউরোপ ট্যুরে যায়। আর নির্বিচারে এদের ওষুধ লেখে। দোকানি ওষুধ দিতে দিতে বলে।
হাসপাতালে ফিরলে কলি চিৎকার করে ওঠে, এত দেরি। অস্বাভাবিক উত্তেজনায় সে বলে, আম্মার হাইপো হয়েছে, বাঁচার চান্স কম। একটু আগে মুখ দিয়ে ফেনা উঠেছে। সাদা সাদা ফেনা।
বিলাপ করছে যেন কলি। চোখ দিয়ে জল-প্লাবনের হাহাকার। অথচ আজাদের চোখে মরুভূমির ধুলোঝড়! তার আবেগ কি নষ্ট হয়ে গেছে? মানুষ বলবে কী? সে ভাবে, মৃত্যুর চেয়ে বড় শোক কোনটা? মানে, মায়ের মৃত্যুর চেয়ে? যার অনুগ্রহে তুমি জগৎ দেখছো, যার ভালোবাসা এ নষ্ট সময়েও নির্ভেজাল, অকৃত্রিম, পবিত্র ও প্রাকৃতিক। সে চলে যাচ্ছে। এর চেয়ে বড় শোক কী হতে পারে? তবু কেন আজাদ আবেগহীন? বাবার মৃত্যুতে অনেক কেঁদেছিল সে। কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাকে হাসপাতালে পর্যন্ত ভর্তি করা হয়। সেবার আজাদ তার ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা মানুষের মৃত্যু হলে সে কোথায় যায়? বিজ্ঞান কী বলে? আমার আব্বা এখন কোথায়? পরের মাসেই ছিল আজাদের এমএ পরীক্ষা। পরীক্ষায় আর বসা হলো না। বাবার স্বপ্ন ছিল, আজাদ এমএ পাস করবে। ছোট মানুষের ছোট-ছোট স্বপ্ন। কলি চিৎকার করে কাঁদছে। হাসপাতালের বারান্দায় মানুষের ভিড়। কলি চিৎকার করে কাঁদছিল বলে ওকে ডাক্তার ওয়ার্ড থেকে বের করে দিয়েছে। এটি হৃদরোগীদের ওয়ার্ড, এখানে নীরবতা অপরিহার্য। ভিড়ের মধ্যে নানা কথা হচ্ছে। মেয়েটা এভাবে কাঁদছে কেন? কেউ মারা গেছে। না, এখনো মারা যায়নি। মৃত্যুর অপেক্ষা দুর্বিষহ—মৃত্যু নয়। মেয়েটার মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। ডায়াবেটিস থেকে হার্ট নষ্ট হয়ে গেছে। হার্ট পাম্প করতে পারে না। ওটা ছেলে। ছেলের বউ এসেছিল। ঘণ্টা খানেক থেকে বউ চলে গেছে। বউ ঢাকায় পড়াশোনা করে। ছেলেটা বেকার। সত্যি কি আজাদ বেকার? কোন অর্থে বেকার? এই যে, সে এত কিছু ভাবছে। এত সব বেদনাকে লালন-পালন করছে। জীবনে এর কোনো কর্মমূল্য নেই? নাকি থাকতে নেই! নিরাকার ঈশ্বর আর বেকার মানুষের মধ্যে একটি মিল রয়েছে—এ সমাজে উভয়ই অদৃশ্য।
আজাদের হাতের ওষুধের থলিটা তাজা একটা সুস্থ হৃৎপিণ্ডের মতো থর-থর করে নাচছিল। তার হাত দুটো ভীষণ কাঁপছে। ওষুধ নিয়ে নার্স ভেতরে গেল। আজাদ ওয়ার্ডের দরজার কাছে দাঁড়ালো। মা মৃত মানুষের মতো বেডে পড়ে আছে। স্ক্রিনে একটা নীল আলো বিন্দু এঁকেবেঁকে চলছিল। আজাদের মামাতো ভাই বকুল বারান্দায় বসে ছিল। সে তার পাশে এসে বসলো, চা নাস্তা করেছ?
আজাদের কথায় বকুল একটু অপ্রস্তুত, না ঠিক আছে।
ভাবিকে দেখছি না?
ও নেই, বেরিয়ে গেলো একটু আগে।
ডাক্তার হঠাৎ হনহনিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো, এসব কী? কলির হাতে ওষুধের প্যাকেটটা ধরিয়ে ডাক্তার প্রায় চিৎকার করে উঠলো।
কেন স্যার? কলি ভয় পেয়েছে।
আমি যেসব ওষুধ লিখেছি সেসব কই?
ঠিক আছে আমাকে দিন, বদলে এনে দিচ্ছি। কলি ওষুধগুলো আজাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে অনুযোগের সুরে কলি বলে, ভাইয়া একটা কাজও কি ঠিক মতো করা যায় না? কী উত্তর দেবে আজাদ? চুপ করে থাকলো, বিড়বিড় করে, বাইরে কী সুন্দর বাতাস অথচ এখানে দর-দর করে ঘামছি।
আজাদের কথা শুনে বকুল অবাক হয়ে তার চোখের দিকে তাকালো। হঠাৎ আজাদের মনে হলো, ছাগলছানাটি কি তার মাকে খুঁজে পেয়েছে?
কয়েক দিন আগেই তার মায়ের সঙ্গে আজাদের বেশ খানিকটা সময় কথা হয়েছিল। বিছানায় মায়ের শিয়রে বসেছিল সে। মা দুই বছর ধরে বিছানায়। অথচ শুতে পারে না। পিঠের নিচে তিন তিনটে বালিশ দিয়ে বসে থাকে, না হলে শ্বাস নিতে পারে না। মা বলে, শুলে মনে হয় নাক অবধি পানিতে ডুবে যাচ্ছি আর আমার সামনে কয়েকটা ঘড়িয়াল ঘুর ঘুর করছে।
তাহলে ভয় নেই মা ঘড়িয়াল মানুষ খেকো না।
তুই আমার যন্ত্রণা নিয়ে রসিকতা করছিস! মা জানে শত সংকটেও আজাদ রসিকতা করতে পারে। তাই মা রাগ করে না—রাগের ভান করে মাত্র। অসুস্থ হলে মানুষ এমনি খিটমিটে হয়ে যায়। আজাদের মা ভীষণ আমুদে ছিল। তার হাসির শব্দ আশেপাশের বাড়ি থেকে পর্যন্ত শোনা যেত। আজাদের বাবার মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে সে হাসি কোথায় হারিয়ে গেল! মাঝে মধ্যে হঠাৎ প্রাণ খুলে হেসে উঠলে পাড়ার বুজুর্গ মহিলারা বলে উঠত, বিধবাদের অতো হাসতে নেই। কখনো কখনো মানুষই মানুষের বাঁচার অধিকার কেড়ে নেয়। কত দিন আজাদ মায়ের ঝরনার মতো সেই হাসি শোনেনি। ঘড়িয়ালের একটা কাহিনি আছে। আজাদের নানা-বাড়ির সামনে একটা অদ্ভুতুড়ে পুকুর আছে। বাঁশঝাড়ে ঘেরা সে পুকুরে কখনো সূর্যের আলো পড়ে না। শ্যাওলা ঢাকা সবুজ পুকুর। পুকুরটি খুব বড় না হলেও তার গভীরতা অনেক বেশি। যে কেউ সেই পুকুরের সামনে দাঁড়ালে অতিপ্রাকৃত একটা শিহরণ অনুভব করবে। পুকুরটিতে কেউ গোসল করে না। তবে মাছ চাষ করা হয়। রাক্ষুসে সব মাছ—আফ্রিকান মাগুর, বোয়াল, শিং। শৈশবে তার মা একবার ওই পুকুরে নেমেছিল। একটা ঘড়িয়াল তাকে জখম করে। সে আতঙ্ক আজো তার মায়ের মধ্যে বেঁচে আছে।
শোন আজাদ।
জি?
তোর কি আমার ওপর কোন অভিমান আছে?
কী যে বলো মা।
তোকে আমি নিজের মতো করে মানুষ করতে চেয়েছিলাম। এখন তুই বড় হয়েছিস—আমার কথা হয়তো বুঝবি। আসলে তোর বাবার মধ্যে অনেক কমতি ছিল। বলতে পারিস এক রকমের স্বপ্নভঙ্গ ছিল ওকে নিয়ে আমার। তোকে নিজের মতো করে গড়ে তুলে সে বেদনা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলাম কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তোকে তোর মতো করে গড়ে উঠতে দেইনি। এটা ছিল আমার বড় ভুল। আসলে কেউ কারও মনের মতো হয় না। আজাদের মা কথা বলতে গিয়ে হাঁফিয়ে ওঠে। এক চামুচ জল সে জিহ্বার ওপর দেয়। সারা দিনে মাকে ডাক্তার আধা লিটার পানি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। বেশি পানি খেলে তা ফুসফুসে জমে শ্বাস কষ্ট বাড়িয়ে তুলবে।
মা আর কথা বলে না। বিশ্রাম নেন।
আমাকে বলতে দে বাবা। হয়ত আর সুযোগ পাব না। তোর বাবার মৃত্যুর পর তুই ভার্সিটিতে আর ফিরে গেলি না। এমএ পরীক্ষাটাও দিলি না। আমার পাশে পাশে থাকবি বলে চাকরির জন্য চেষ্টাও করলি না। টাকার অভাবে এলাকাতেও কিছু করতে পারলি না। কোচিং সেন্টারটা দাঁড়ালো না তোর। বিয়ে দিলাম, ভাবলাম; সংসারি হলে ঘরে কাজে মন বসবে কিন্তু দায়িত্ব পালনের যোগ্য হওয়ার আগেই দায়িত্ব গেল বেড়ে। এখন মনে হচ্ছে সবই ভুল করেছি। আসলে তোকে তোর মতো করে তোর আকাশে স্বাধীনভাবে উড়তে দেওয়া উচিত ছিল। আমার আঁচলের নিচে আগলে রাখার ইচ্ছেটা তোকে শেষ করে দিল। তোর বাবার মৃত্যুর পর বড্ড স্বার্থপর হয়ে গেছিলাম। তোকে আরও বেশি আগলে রাখার চেষ্টা করেছি। তোকে ছাড়া আর কোনো অবলম্বন আমি চোখের সামনে দেখিনি।
আমরা ভাই-বোন ছাড়া কে আছে তোমার বলো? আর তুমি ছাড়া আমাদেরই বা কে আছে?
আজাদের কথায় মা কষ্ট করে একটু হাসে। যা তোকে আজ মুক্ত করে দিলাম। তোর মতো করে জীবনটা এবার গড়ে নে বাবা। তোর বাবার মৃত্যুর পর অনেক কিছু বুঝতে শিখেছি—অনুভব করতে শিখেছি। তোর বাবা, যাকে এতটা অপছন্দ করতাম আজ বুঝি সে আমাদের জীবনে কতটা জরুরি ছিল। হয়ত তার ধ্যান-ধারণাগুলো অতটা উন্নত ছিল না—শুদ্ধভাবে কথা বলতে পারত না। তার মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল। কিন্তু সে বাঁচত আমাদের জন্য। তার ধ্যান-জ্ঞান ছিল তার পরিবার। উন্নত চিকিৎসার জন্য আগ্রহ দেখায়নি বলে তাকে কত না তিরস্কার করেছি; গঞ্জনা দিয়েছি। সে শুধু বলত হায়াত না থাকলে ডাক্তার আমাকে বাঁচাতে পারবে না। কিন্তু শেষবার তোর বাবা আমাকে কী বলেছিল জানিস?
কী?
সব কিছু বেচে এত ব্যয়বহুল চিকিৎসা করিয়ে যদি না বাঁচি, তোমরা তো পথে বসে যাবে। তাহলে বুঝ, কতটা ভালোবাসত আমাদের।
মায়ের কথা শুনে সেদিন আজাদের চোখে জল চলে আসে। এই প্রথম সে মায়ের মুখে বাবার প্রশংসা শুনল। আজাদের মনে পড়ে বাবার মৃত্যুর পাঁচ মিনিট আগেও তার মা বাবার সঙ্গে ঝগড়া করেছিল। কী নিয়ে ছিল সে ঝগড়া? হয়ত কোনো ছোটখাটো বিষয় নিয়ে। মা’রও হয়ত মনে নেই এখন কী নিয়ে হয়েছিল শেষ ঝগড়া। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এমনটা দেখে এসেছে আজাদ। এখন তো মনে হয় হয়ত এই ঝগড়ার মধ্যে তাদের সম্পর্কের সুতোটা বাঁধা ছিল। তার মায়ের চোখেও জল।
আজাদ এসব কথা যখন ভাবছিল, পাশে বসে থাকা বকুল বললো, ভাইয়া তোমার ঢাকায় নাকি চাকরি হয়েছে?
ওই একটা স্কুলে।
পাশে কলির স্বামী বদরুল কখন এসে দাঁড়িয়েছে আজাদ টের পায়নি। সে বলে, প্রাইভেট স্কুলের চাকরি বেতন খুবই সামান্য। ও বেতনে আপনার নিজেরই হবে না। ঢাকায় যে খরচ!
এর উত্তরে আজাদ কী আর বলবে? নীরব থাকল। চুপ থাকতে দেখে বদরুল বললো, কাল আপনার জয়েনিং ডেট। যাবেন কিভাবে? আম্মার যে অবস্থা। এসব চাকরি অনেক পাবেন। মা গেলে মা পাবেন?
জি। আজাদ অস্ফুট স্বরে উত্তর দেয়। সত্যি তো বলেছে সে। বদরুল তার পরিবারের আসন্ন বিপদ নিয়ে চিন্তিত। আজাদ যদি ঢাকায় গিয়ে চাকরি নেয় তবে অসুস্থ মায়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব গিয়ে পড়বে কলির ঘাড়ে। সেই সূত্রে কিছুটা সমস্যা তাকেও পোহাতে হবে।
গতকাল হঠাৎ করে আজাদের স্ত্রী সোনিয়া এসেছিল। আজাদের মায়ের পাশে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়েছিল। আজাদের তিন বছরের মেয়েটা অবাক হরিণের মতো তাকিয়েছিল ওর দিকে। বাবাকে নিয়ে তার ভেতরও কি কোনো প্রশ্ন দানা বেঁধেছে? আজাদ ওকে কোলে তুলে নিল, মা চলো তোমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।
বেশি দূরে যেও না। টিকিট কাটা আছে। ঘণ্টাখানেক পরেই বাস। আজাদ মেয়েকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছে দেখে সোনিয়া বললো।
হাসপাতালে জবা ফুলের আড়ালে লাল টকটকে সূর্য উঠেছিল। জবার সমস্ত রঙ যেন মেখেছিল ওই সূর্য। সেদিনের সূর্যটা আর কেউ না—আজাদের মেয়ে খুকি। পকেটের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা আজাদের সুখ দুঃখের কবিতাগুলো খুকির গাল আলতো ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছিল প্রজাপতির মতো। খুকি, তোমার বাবা তোমাকে সূর্যের তুলতুলে নরম ঊষ্ণতার আলো উপহার দিল। এটা তোমায় সূর্য হওয়ার ইচ্ছে জাগাবে। হৃদয়ের ভাষায় এমন কিছু বলেছিল আজাদ তার কন্যাকে।
সোনিয়া বিদায় বেলায় আজাদকে বলে, কাল চাকরিতে জয়েন করবে না? চলো আমার সাথে ঢাকায়।
দেখি।
দেখি আবার কী? নিজের দায়িত্ব কবে বুঝবে? তুমি মানুষ হলে না। নিষ্প্রাণ পাথর হয়ে রইলে।
সত্যি কি আজাদ পাথর? তার কোনো অনুভূতি নেই, নাকি তার অনুভূতিগুলো সমাজের কাছে মূল্যহীন। সোনিয়ার কথার প্রতিক্রিয়ায় এসব ভাবনা আজাদের মাথায় ঘুরপাক খায়।
উ! তোমার সাথে আর সম্ভব না। দৃঢ় একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে সোনিয়া।
স্বপ্ন-সঙ্গমে মানুষ বেঁচে থাকে। এই যে আমরা বেঁচে আছি, আমাদের চেতনায় কিছু স্বপ্ন বেঁচে আছে বলে। কোনো কোনো সময় সেটা শূন্যতায় ভরে গেলে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন মনে হয়। তখন উপেক্ষার শত শত চোখ তোমার দিকে ঠিকরে পড়বে। তোমার ছায়া তোমায় ছেড়ে চলে যাবে। তুমি তখন কী করবে? আজাদ এখন কী করবে? জীবনের একটা ছক বেঁধে দেয় সমাজ। সে অনুযায়ী আমাদের চলতে হয়। আজাদ তাকে উপেক্ষা করেছে। তাই তার জন্য দণ্ড অপেক্ষা করছে। আজাদ সিদ্ধান্ত নিলো রাতটা সে হাসপাতালের বারান্দায় চাঁদের জোনাকে শরীর গলিয়ে কাটিয়ে দেবে।
আজাদের মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। সেলাইন দেওয়া প্রয়োজন অথচ দেওয়া যাচ্ছে না ফুসফুসে পানি জমে যাবে বলে। জরুরি ভিত্তিতে ফুসফুস থেকে পানি বের করা দরকার কিন্তু এই সরকারি হাসপাতালে তার ব্যবস্থা নেই। রাজশাহীর কোনো বেসরকারি হাসপাতালেও এ আধুনিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ঢাকার দুই তিনটে হাসপাতালে ব্যবস্থা রয়েছে কিন্তু এ পরিস্থিতিতে মাকে মুভ করানো সম্ভব নয়। যদি একটু স্টেবল হয় তবেই ঢাকায় নেওয়া যাবে—এমনি বলছে ডাক্তার। আজাদ জানে সব মিথ্যে আশ্বাস। তবু এ মিথ্যাকে বিশ্বাস করতে আজাদের ভালো লাগে। এখন শুধু মায়ের চোখ জুড়ে কাকের ডানায় আঁধার নামার অপেক্ষা।
মধ্যরাত। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে—এমনকি ডিউটিরত ডাক্তার-নার্সরাও ঢুলতে-ঢুলতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। পেঁচাদের সঙ্গে আজাদ জেগে আছে চাঁদের জোনাকে গলবে বলে। বারান্দার সামনে—‘পুব-পুব-পুব’ পেঁচা ডেকে চলেছে। আজাদের মা বলত, রাতে বাড়ির উঠোনে পেঁচা ডেকে উঠলে সে বাড়ির আপনজন মারা যায়। আজাদ উঠে মায়ের কাছে গেল। মায়ের পাশে চেয়ারে কলি ঘুমে বুঁদ হয়ে আছে। ক’দিনের পেরেসানিতে বড্ড ক্লান্ত সে। মায়ের শিয়র ঘেঁষে দাঁড়ালো আজাদ। হাত ছোঁয়ালো মায়ের কপালে। মায়ের শরীর জুড়ে বরফ নীরবতা। স্থির অথচ সবাক খোলা চোখ দুটো আজাদের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন বলছে, এবার তুই ডানা মেলে দে, আমিও ডানা মেলেছি আমার আকাশে।