গ্রামের নামটি পাগলাপাড়া। এই গ্রামের বাসিন্দা ছিল সমিরদ্দি পাগলা। সে কোনো পীর-ফকির নয়। একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ। তবু তার নামে গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে পাগলাপাড়া। কারণ গ্রামের উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখেছে সমিরদ্দি পাগলার বড় ছেলে কসিরদ্দি।
সমিরদ্দি সুখটা দেখে যেতে পারলো না। এখন পাকা ঘর উঠেছে তার ভিটায়। যদিও বাড়িতে কেউ থাকে না। শুধু দুই ঈদে বাবা-মার কবর জেয়ারাত করতে আসে ছেলেরা। ছোট ছেলেটা প্রবাসী হয়েছে বছর পাঁচেক হবে। মেজ ছেলেটা ঢাকার বড় ব্যবসায়ী হয়ে গেছে। বড় ছেলে একটা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির মালিক। চারিদিকে এখন কেবল সুখ আর সুখ। অথচ এমন একদিন ছিল, যেদিন পরের জমিতে কাজ করেই তিনবেলা খেতে হতো সমিরদ্দিকে।
বছরের ছয় মাস অসুস্থ থাকতে হতো সমিরদ্দিকে। বিশেষ করে শীতের আভাস পেলেই মাথাটা এলোমেলো হয়ে যেতো তার। হিংস্র হয়ে উঠতো সমিরদ্দি। গ্রামের সবাই বলতো, পাগল হইয়া গেছে। পরিবারের লোকজন বলতো, ব্যারাম আইছে আবার। মাথা খারাপ হওয়ার সপ্তাহখানেক আগে থেকেই এই লক্ষণ বোঝা যেতো। চোখ লাল হয়ে উঠতো। মেজাজ হতো খিটখিটে। অল্পতেই রেগে উঠতো।
পাগল হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সমিরদ্দির বউ বলতো, স্বাধীনতার পর যে বার ‘শেখসাব’ আইলো জেলা শহরে, হ্যায় গ্যালো শেখসাবরে দেখতে। শেখসাবের ভাষণ হুইন্যা বাড়ি আইয়াই আবোল-তাবোল কইতে শুরু করলো। তারপর থেইকা কত কবিরাজ দেহাইলাম। কিছুতেই কিছু হইলো না।
শীত মৌসুমে পাগলামি বেড়ে যেতো সমিরদ্দির। বাড়ির সামনে বা পেছনে গাছের সঙ্গে শেকল দিয়েও বেঁধে রাখা যেতো না। তখন গাছই হয়ে উঠতো তার ঘর। পায়খানা-প্রস্রাব, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম-জাগরণ সবই হতো গাছতলায়। শীতের প্রকোপ বাড়লে আনা হতো গাছঘরে। খুঁটির সঙ্গে শেকল দিয়ে তালা মেরে রাখা হতো। সমিরদ্দি হাতের আঙুল দিয়ে শক্ত মাটি সরিয়ে গর্ত তৈরি করতো। মল-মূত্র ত্যাগ করে আবার মাটি দিয়ে ঢেকে দিতো। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষকে ভয় দেখাতো। কখনো ভালো ভালো কথা বলে কাছে ডেকে নিয়ে মারতে শুরু করতো।
সারারাত মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে খুঁটিটাও সরিয়ে ফেলতো। তারপর রাতের অন্ধকারেই ছুটে পালাতো। সমিরদ্দিকে খুঁজতে বের হতো তার পরিবার। আশেপাশের দুই-চার গ্রামের সবাই তাকে চিনতো। দেখতে পেলে লোকজন মিলে ধরে আটকে রাখতো। হাটের দিন খবর পাঠাতো সমিরদ্দির বাড়িতে।
সমিরদ্দির নানাবিধ অত্যাচারে গ্রামের মানুষ কিছুটা অস্বস্তিতেই থাকতো বলা যায়। আতঙ্কে থাকতো সব ক’টি পরিবার। ছুটে গেলে কখন কার ঘরে হানা দেয়। শিশুরা ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠতো। তবে পারতপক্ষে কারও তেমন ক্ষতি সে করেনি। ভয় দেখিয়ে শুধু আনন্দ পেতো। এ নিয়ে অনেকেই আফসোস করতো, আহারে, এমন নরম-শরম একটা মানুষ কিনা হঠাৎ কইরা এমন হইয়া যায়?
সমিরদ্দি যখন সুস্থ থাকতো, তখন খুব বেশি উচ্চস্বরে কথাও বলতো না। মাথা নিচু করে চলতো। আপন মনে কাজ করতো। স্ত্রী-সন্তানদের খুব ভালোবাসতো। অথচ পাগল হওয়ার পর তার চিৎকারে রাতে কেউ ঘুমাতে পারতো না। মাঝে মাঝে নিজের স্ত্রী-সন্তানকেও গালমন্দ করতো। হাতের কাছে পেলে মারতেও দ্বিধাবোধ করতো না।
বাস্তবিক অর্থে সহজ-সরল মানুষ সমিরদ্দি। বৃদ্ধ মা, স্ত্রী আর তিন ছেলে নিয়ে কায়কষ্টে দিন চলে যায়। অবস্থাসম্পন্ন আত্মীয়-স্বজনের জমিতে কাজ করেই মূলত দিন চলে। কারও সাতেও নেই-পাঁচেও নেই। শান্ত স্বভাবের এই মানুষটিই কখনো কখনো অশান্ত হয়ে উঠতো। তখন পরিবারের হাল ধরতো বড় ছেলে কসিরদ্দি। যে কারণে পড়াশোনাও আর বেশিদূর এগোয় না কসিরদ্দির। কসিরদ্দির সঙ্গে সঙ্গে অন্য দুই ভাইয়ের পড়াশোনাও আর আগায় না।
ছয় মাস ভালো থাকা, ছয় মাস মন্দ থাকা সমিরদ্দির সংসার গুটি গুটি পায়েই এগোতে থাকে। প্রতিবেশির রক্তচক্ষু, স্বজনের অবহেলা ঘিরেই সমিরদ্দি শেকলবন্দি থাকে পাগলামির সময়।
যে বার প্রতিবেশির একটি হাস সমিরদ্দিকে দেওয়া ভাতের বাসনে মুখ দিয়েছিল। রাগে সে হাসটি ধরে গাছের সঙ্গে পিটিয়ে মেরে ফেললো। হাস মেরে ফেলার অপরাধে ইচ্ছামতো পেটানো হলো সমিরদ্দিকে। সেই ঘটনা প্রতিবেশীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। কেউ এগিয়ে আসেনি। শেকলে বাঁধা একটা মানুষকে পাঁচ-সাতজন মিলে বাঁশের লাঠি দিয়ে পেটালো। শেকল থেকে ছোটার জন্য সেকি আকুতি আর চেষ্টা সমিরদ্দির। শক্ত শেকল ছিঁড়ে যখন মুক্ত হতে পারেনি, তখন অনুনয়-বিনয় করেছে হাসের মালিক চান্দু খলিফার কাছে।
চান্দু খলিফার হাস মারার অপরাধেই মার খাচ্ছে সমিরদ্দি। চান্দু খলিফার ছেলেরা মিলে সাইজ করা বাঁশের লাঠি দিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পেটাতে পেটাতে ক্লান্ত হয়ে তারপর থেমেছে। বাপের নির্দেশের যথাযথ প্রতিদান দিয়েছে তারা।
সমিরদ্দির বৃদ্ধ মা, অসহায় স্ত্রী, শক্তিহীন অবুঝ ছেলে তিনটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে আর চোখের পানি ফেলেছে। সমিরদ্দি যখন মার খেতে খেতে নিস্তেজ হয়ে গেছে, তখন বীরদর্পে বাড়ির উঠোনে গিয়েও চিৎকার-চেচামেচি করেছে চান্দু খলিফা। সমিরদ্দির পরিবার তুলে গালাগালিও করেছে।
সেদিন সন্ধ্যার পর সমিরদ্দির স্ত্রীর করুণ আকুতিতে সালিশ বসিয়েছে এলাকার ময়-মুরুব্বিরা। চান্দু খলিফার বড় ছেলে বলেছে—পাগলরে মাইরের আবার বিচার হয় নাকি? পাগলের অষুধ তো শুধু মাইর। চান্দু খলিফার জবানবন্দি শুনে হেসে উঠেছিল সবাই। হাস মারার কথা জিজ্ঞাসা করতে গেলে সমিরদ্দি নাকি তাকে ‘পোস্টঅফিস’ দেখিয়েছে। সেই পোস্টঅফিস দেখানোর অপরাধে সমিরদ্দিকে রাগের মাথায় এমনভাবে মারা হয়েছে। সালিশরা জানতে চায়, ‘এত্তগুলান সাইজ করা লাডি কই পাইলি?’ চান্দু খলিফা এর জবাবে বলেছে, ‘ওই গুলান কুডা পিডাইন্না লাডি।’
সালিশের রায়ে শরীর সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসার খরচ আর সমিরদ্দির পা ধরে মাফ চেয়ে খালাস পেয়েছিল চান্দু খলিফা ও তার ছেলেরা। তখন মিডিয়ার এত ছড়াছড়ি ছিল না। ছিল না স্মার্টফোনও। যদি থাকতো, তাহলে কেউ না কেউ ভিডিও করে রাখতো। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তো। সামাজিক আন্দোলন হতো। মিডিয়ায় কভারেজ পেতো। মানবাধিকার সংস্থার সহায়তা পেতো। থানা-পুলিশ হতো। আরও কত কী!
পকেট থেকে স্মার্টফোন বের করে দু’ফোটা চোখের পানি ফেলে কসিরদ্দি। বাবার কবরের ছবি তুলে রাখে তাতে। অতীতের স্মৃতি চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চোখে সামনে ভেসে ওঠে বাবার সারা শরীরের দগদগে ঘা। সেই রাতের মধ্যেই সারা শরীর ফুলে গিয়েছিল সমিরদ্দির।
কিছুদিন পর সমিরদ্দি ভালো হয়ে গেলেও শরীর কেমন নিস্তেজ হতে থাকে। আগের সেই শক্তি পায় না শরীরে। কেমন মনমরা হয়ে বসে থাকে। তার বেশ কয়েক বছর পর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যায় সমিরদ্দি পাগলা। সমিরদ্দি পাগলা মারা যাওয়ার পর গ্রাম ছেড়ে চলে যায় তার পরিবার।
সুস্থ থাকার সময়েও তার বাড়ির নাম হয়ে ওঠে ‘সমিরদ্দি পাগলার বাড়ি’। তার দিকে আঙুল তুলে সবাই বলতো, ‘ওই যে পাগলার পোলা যায়’। আজ তার কবর দেখেও বড় ছেলের মনে হয় এটি ‘সমিরদ্দি পাগলার কবর’। ফোনটা পকেটে রেখে নতুন কেনা গাড়ি থেকে একটি সাইন বোর্ড নামায়। বেশ বড় একটা সাইন বোর্ড। সাইন বোর্ডটা নিজ হাতে পুতে দেয় কবরের বুকে। তাতে বড় করে লেখা ‘সমিরদ্দি পাগলার কবর’।
গাড়িতে ওঠার আগে একবার তাকায় কবর আর সাইন বোর্ডটার দিকে। বাড়িটা এখন শূন্য। সুনসান নীরবতা বাড়িজুড়ে। বাড়িতে কেউ থাকে না। চান্দু খলিফার পরিবারও গ্রাম ছেড়েছে সমিরদ্দি পাগলার মৃত্যুর আগেই। হয়তো অনুশোচনা অথবা পাগলার প্রতিশোধের ভয়ে। চান্দু খলিফার পরিবারের কোনো খোঁজ জানে না কসিরদ্দিরাও। জেনেও লাভ নেই। কোনো প্রতিশোধস্পৃহা নেই তাদের মনে। নিয়তির লিখন ভেবেই মেনে নিয়েছে এখনকার বিত্তশালী কসিরদ্দি।
গাড়িতে উঠতে উঠতে রুমালে দু’চোখ মোছে কসিরদ্দি। ছোট্ট মেয়েটা বাবাকে প্রশ্ন করে, ‘বাবা, পাগলা মানে কী?’ কসিরদ্দি বলে, ‘মামণি, পাগলা হচ্ছে আমাদের উপাধি। আমাদের অলঙ্কার। আমরা সবাই পাগল।’