বরকত সাহেব এসে খাবার টেবিলে বসে হঠাৎ করেই কাঁচের গ্লাসটি ঠাস করে মেঝেতে ফেলে দিলেন। চূরমার ভাঙার শব্দে খেতে বসা তার ভার্সিটিপড়ুয়া ছেলেমেয়ে দুটি ঝিনুক আর আহরাব চমকে উঠে বাবার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকল। স্ত্রী ওয়াহিদাও চমকে উঠলেন এবং নিজেকে খুব দ্রুত সামলে নিলেন। তিনি বরকত সাহেবের মতিগতি বোঝেন বলে সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সম্মত। এই মুহূর্তে বরকতের বুকের মধ্যে কিছু কথা জমা হয়েছে যা তিনি প্রকাশ করতে পারছেন না বলে গ্লাসের ওপরে আক্রমণ করেছেন। ওয়াহিদা গ্লাসের ভাঙা টুকরোগুলো গোছাতে গোছাতে মিষ্টি সুরে গান গাইতে লাগলেন।
কত যে কথা ছিল
কত যে ছিল গান
কত যে বেদনার
না বলা অভিমান।
এই রকম গান শুনে এই মুহূর্তে বরকত সাহেবের ভীষণ রাগ হওয়ার কথা এবং ধমক দিয়ে থামানোর কথা। তিনি তা না করে মৃদুস্বরে বললেন, আচ্ছা থামো। গানটি তুমি নিরিবিলি গেয়ে শোনাবে, বিছানায় বসে।
বাবার রাগ হঠাৎ পড়ে যাওয়ার কারণ না বুঝে ঝিনুক ও আহরাব ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে রইলো একইভাবে। বরকত সাহেব ওদের উদ্দেশে বললেন, তোমরা খেতে শুরু করো।
ঝিনুক ও আহরাবের মুখে এক ধরনের দুষ্টুমির হাসি। ওরা জানে, ওদের বাবার কর্মকাণ্ড—কর্মকাণ্ড না বলে পাগলামো বলা যায়। যেমন, এখন হুট করে গ্লাসটি ভেঙে ফেলা। এটা অবশ্যই পাগলামো। তবে ওরা এটাও জানে ওদের বাবা কারণ ছাড়া কোনো কাজ করেন না। আজ কী কারণে গ্লাস ভাঙলেন, তা বোঝা গেলো না। নিজ থেকে না বললে সেটা জানাও সম্ভব নয়। জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর না দেওয়া বাবার চিরন্তন স্বভাব।
এই তো, কিছুদিন আগের কথা। বরকত সাহেব খুব গম্ভীর গলায় এবং অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে আহরাবকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা বলো তো বাবা, মন্ত্রী হাসেন কেন?
মন্ত্রী হাসলো কেন, তা আহরাব কী করে বলবে? তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তাদের কত দায়িত্ব। প্রয়োজনে হাসবে, প্রয়োজনে কাঁদবে। পাদ দিলেও অসুবিধা কী? মন্ত্রীও তো মানুষ—প্রাকৃতিক সব কাজই করবে সেটাই স্বাভাবিক। আহরাব বাবার ক্ষোভের মধ্যে জড়াতে চায় না বলে চুপ করে থাকে। বরকত সাহেব আবার জিজ্ঞাসা করেন, বললে না?
আহরাব যেন বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইলো, ছোট শিশুর মতো জবাব দিলো, জানি না। বরকত সাহেব এবার ঝিনুককে প্রশ্ন করলো, আচ্ছা মা, তুমি বলো তো হাসির কারণ কী?
ঝিনুক বলল, কারণ জানি না। তবে বাবা এটা ছিল অনুচিত হাসি।
বরকত সাহেব কিছুটা উৎফুল্ল হয়ে বলেন, এই তো মা, তুই আমার কথা ধরতে পেরেছিস। আমি এটাকে ঠিক অনুচিত বলব না, বলব অনৈতিক হাসি। মানুষের মৃত্যু সংবাদে যে হাসি হাসা হয় সেটাকে অনৈতিক বললেও মানায় না। আরও যুৎসই শব্দ দরকার।
ওয়াহিদা মাঝখান থেকে বললেন, শুনেছি ওই মন্ত্রীর নাকি হাসির বেরাম আছে। কথায় কথায় হাসে। এটা শুভ লক্ষণ। একটা মানুষ সারাক্ষণ হাসে এটা চাট্টিখানি কথা নয়।
বরকত সাহেব স্ত্রীর কথায় খুশি হতে পারলেন কি না, বুঝা গেলো না। তিনি উঠে গিয়ে ঘরের দেয়ালের সঙ্গে জোরে একটি ঘুষি দিয়ে হাতের ব্যথায় কোঁকাতে লাগলেন। তাড়াতাড়ি ওয়াহিদা গিয়ে হাত ধরে ডলে দিতে লাগলেন আর বলতে থাকলেন, কবে যে বুদ্ধিসুদ্ধি হবে। এতদিন যা করার করেছ, এখন ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। ওদের সামনে নিজেকে আর এত ছোট কোরো না। তোমার যা কথা থাকে, কোথাও বলতে না পারলে আমাকে বলবে।
বরকত সাহেব বললেন, তাহলে এখন হাসো। আমার হাতে ভীষণ ব্যথা লেগেছে, মনে হচ্ছে ফুলেও গেছে। এই আনন্দে হাসো।
ওয়াহিদা বললেন, কী যে সব আবোল-তাবোল বলো না তার ঠিক নেই। তোমার হাতের ব্যথায় কাতরানো দেখে আমি হাসব?
বরকত সাহেব বললেন, কেন হাসবে না? মানুষ মরে গেলে মানুষ হাসে, আর তুমি সামান্য একটু ব্যথায় হাসতে পারবে না এটা কেমন কথা?
ওয়াহিদা আর কথা বাড়ান না। ঝিনুক ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে এলে সেই বরফ বরকত সাহেবের হাতে ঠেসে ধরেন তিনি। ভাবেন, এই লোকটিকে নিয়ে আর পারা গেলো না।
বেশ আগে একটি ঘটনা ঘটেছিল। ওয়াহিদা সেটাও মনে রেখেছেন। একদিন বাসায় চুরি হলো। কিচেনের জানালার গ্রিল কেটে চোর বাসায় ঢুকে অনেক কিছু নিয়ে যায়। বেডরুমে ঢুকতে পারেনি বলে দামি জিনিসপত্র নিতে পারেনি। তবে বসার ঘর থেকে টিভিসহ লক্ষাধিক টাকার মালামাল নিয়ে বাইরের দরজা খুলে চোর পালিয়ে যায়।
শুধু ওয়াহিদা নয়, প্রতিবেশী-আত্মীয় স্বজন সবাই বরকত সাহেবকে অনুরোধ করলেন থানায় গিয়ে একটা জিডি করতে। কিন্তু তিনি কিছুতেই থানায় যাবেন না। কারণ জানতে চাইলে সেটাও বললেন না। পরে অবশ্য ওয়াহিদা কারণটা জানতে পেরেছিলেন।
পুলিশের কাছে যেতে বরকত সাহেবের ভীষণ ভয়। পুলিশ ঘুষ খায়, পুলিশ চাঁদাবাজি করে, গরুর ট্রাক থেকেও চাঁদা তোলে, ফুটপাতে দোকান বসার সুযোগ দিয়েও চাঁদা তোলে, পুলিশ মাদক ব্যবসায় জড়িত, পুলিশ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নানা অপকর্ম করে, পুলিশ নিরীহ মানুষকে হয়রানি করে টাকা আদায় করে। এককথায় যেসব কর্ম পুলিশের দমন করার কথা সেসব কর্মের সবটাই পুলিশ কর্তৃক সংঘটিত হয়ে থাকে। সুতরাং পুলিশের কাছে সহায়তার জন্যে যাওয়া মানেই হয়রানি হওয়া। শুধু হয়রানি হওয়া নয়, টাকাও গচ্ছা দেওয়া। তাই বরকত সাহেব ভেবেছেন যা চুরি গেছে যাক, চুরির মাল উদ্ধারও হবে না বরং পুলিশের কাছে গেলে আরও ‘মাল’ ঢালতে হবে।
কিন্তু বিধিবাম। বরকত সাহেবের বাসায় পুলিশ এসে হাজির। থানা থেকে একজন এস আই এসেছেন দুজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে। এসআই সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাসায় চুরি গেছে কিন্তু আপনি থানায় যাননি কেন?
বরকত সাহেব আমতা আমতা করে বললেন, যাচ্ছি-যাব করতে করতে আর যাওয়া হয়নি।
এসআই সাহেব বললেন, কিন্তু এটা তো ঠিক না। সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের ইনফর্ম করা উচিত ছিল। আমরা চোর ধরতে সাধ্যমতো চেষ্টা করতাম।
বরকত সাহেব বললেন, আমার ভুল হয়ে গেছে। তবে দুদিন অতিবাহিত হলেও এ দুদিনে চোর তো আর মরে যায়নি। নিশ্চয় ধরা যাবে যদি আপনারা চেষ্টা করেন।
এসআই সাহেব বললেন, অবশ্যই করা হবে। আপনি একবার থানায় চলুন।
এসআই সাহেবের মুখ থেকে এমন একটি কথারই আশঙ্কা করেছিলেন বরকত সাহেব। কিচ্ছু করার নেই, শুধু শুধু কিছু টাকা ঢালতে হবে।
আরও বেশ কিছু বছর আগের কথা। তখন ছেলেমেয়ে দুটি ছিল বেশ ছোট। স্কুলে পড়ত। বরকত সাহেব সবাইকে ডেকে নিজের শয়নকক্ষে হাজির করল। আহরাব আর ঝিনুক খুব মজা করে বিছানায় বসে পা দোলাতে লাগলো। বরকত সাহেব যেন ওদের আরও মজা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি আলমারি থেকে নিজের একটি প্যান্ট ও একটি শার্ট বের করলেন। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে কাপড় কাটা কাঁচি বের করে আনলেন। সাধারণত ওয়াহিদা এই কাঁচিটা ব্যবহার করেন। বরকত সাহেব কেন কাঁচি আনলেন তা কেউ বুঝতে পারল না। তিনি প্রথমে দামি প্যান্ট নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলেন বাচ্চা শোয়ানোর মতো আদুরে ভঙ্গিতে। ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে বললেন, তোমরা এখন একটা মজার খেলা দেখতে পাবে।
ঝিনুক ও আহরাব নড়েচড়ে বসে। ওয়াহিদা উৎসাহি হন তবে শঙ্কাও থাকে, না জানি আজ আবার কোনো ঝামেলার সৃষ্টি করেন বরকত।
বরকত সাহেব কাঁচিটা হাতে নিয়ে প্যান্টের হাঁটুর ওপর বরাবর ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে কেটে ফেলেন।
আহরাব ও ঝিনুক হাতে তালি দেয়। ওয়াহিদা বললেন, এটা কী হলো?
বরকত সাহেব উত্তর দেওয়ার আগেই আহরাব বললো, মা তুমি কিচ্ছু জানো না। আব্বু বোধ হয় মিস্টার বিন হতে চাচ্ছে। কেন, তুমি দেখনি মিস্টার বিন কী সুন্দর করে ফুল প্যান্ট কেটে হাফ প্যান্ট বানিয়ে ফেলে? আব্বু হাফ প্যান্ট পরবে।
আহরাব হাসতে থাকে আর সাথে ঝিনুকও হাসে। ঝিনুক বলতে থাকে, কী মজা, কী মজা, আব্বু হাফ প্যান্ট পরবে।
বরকত সাহেব বলেন, শুধু হাফ প্যান্ট নয়, এবার দেখবে কোয়াটার শার্ট বানাতে।
বলেই তিনি ফুল হাতা শার্টটি পেট বরাবর কেটে ফেলেন। আনন্দে লাফিয়ে উঠল আহরাব ও ঝিনুক। কী মজা কী মজা, আব্বু কোয়াটার শার্ট পরবে।
ওয়াহিদা ওদের থামালেন, চুপ কর তোরা? তোদের আব্বুর কেন এমন ভীমরতি ধরেছে জানা দরকার।
ওয়াহিদা তার পূর্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝে নিলেন বরকত সাহেবের এই আচরণের কারণ কী। গত কিছুদিন ধরে সংবাদ মাধ্যমে বেশ তোলপাড় চলছিল জঙ্গিবাদ নিয়ে। বাংলাভাই নামে কে একজন নাকি নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের সঙ্গে নাকি আলেমরাও জড়িত আছে। অথচ একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী বলেছেন, এদেশে বাংলাভাই নামে কেউ নেই। উই আর লুকিং শত্রুজ।
হয়তো এ কারণেই বরকত সাহেব হাফ প্যান্ট পরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। অদ্ভুত এই লোকটাকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না। একটার পর একটা ঘটনা ঘটিয়েই চলেছে। তারপরও ওয়াহিদা তৃপ্ত এই ভেবে যে, তার স্বামী আর যাই হোক কিছু সত্য আগে জেনে যায়। যেমন পরবর্তী সময়ে ঠিকই বাংলাভাই ধরা পড়লেন, শায়ক আবদুর রহমান ধরা পড়লো এবং বিচারে তাদের ফাঁসি কার্যকর হলো।
বরকত সাহেব এমনই একজন মানুষ যিনি নিজেকে নিয়ে যতটা ভাবেন তার চেয়ে বেশি দেশকে নিয়ে ভাবেন। তাই হয়তো কোনো অনিয়ম দুর্নীতি দেখলেই তার অন্তরে জ্বালা-পোড়া করে। এটা সহ্য করতে পারেন না বলেই হয়তো নিজের কিছুটা ক্ষতি সাধন করেন। ওয়াহিদা তাকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, নিজের ক্ষতি ছাড়া জীবনে তো কিছুই পেলেন না। তবু বারবার কেন এসব করেন? বরকত সাহেব হাসেন। তিনি বলেন, আমার নাম বরকত হলে কী হবে জীবনে কোনো বরকত হলো না। ক্ষতি দিয়ে যদি একটু হালকা থাকতে পারি সেটাই সান্ত্বনা। আমার হাতে তো কোনো শক্তি নেই যে কিছু করব। একটা পিস্তলও নেই। এমনকি একটা লাঠি ধরার ক্ষমতাও নেই। আমি কী বা করতে পারি?
ওয়াহিদা তখন বরকত সাহেবের দুঃখ ঘোচাতে মুখে আদর করতে করতে বুকে টেনে নেন। বলেন, আমার পাগল স্বামী, পুরোটাই পাগল। ওয়াহিদার ম্লান হাসি দূরে সরিয়ে দিতেই যেন বরকত সাহেব বলেন, পাগল তোমার জন্য নয়, বলো অন্য কারও জন্য।
ওয়াহিদা বলেন, জানি, সে তো দেশ। এই বাংলাদেশের জন্য। কিন্তু দেখতেই তো পাচ্ছ, যারা এই দেশটাকে ভালোবাসার কথা বলে ক্ষমতায় থাকে তারাই স্বার্থ খোঁজে, স্বার্থ হাসিল করে। উল্টাপাল্টা কথা বলে আর তুমি পাগলের মতো অস্থির হয়ে যাও। ঘরের মধ্যে তোমার অস্থিরতা কে দেখে?
বরকত সাহেব বলেন, কেউ না দেখুক, দেশ ঠিকই দেখে, আমার দেশ।
অনেক আগে, বরকত সাহেব যখন ভার্সিটিতে পড়তেন তখন থেকেই তার এই দেশ-রোগে আক্রান্ত হওয়া। একজন সরকার প্রধানকে স্বৈরাচার আখ্যায়িত করে রাজপথে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে কিন্তু কর্তা ব্যক্তিটির টনক নড়ছে না। আরও মজার ব্যাপার, রাজপথে স্বৈরাচার হটাতে গিয়ে যে মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় হলো, ভালোবাসা হলো সেই মেয়েটি কিনা, গিয়ে যোগ দিলো বিপক্ষের ছাত্র সমাজে? সেখান থেকেই শুরু। দেশপ্রেম ছাড়া ভেতরে আর কোনো প্রেম দেখতে পাননি বরকত সাহেব। পাস করার পরও কোনো চাকরি হয় না। সরকারি চাকরিতে লোক নিয়োগ বন্ধ। সে দেশের উন্নতি হবে কিভাবে? আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলো। মৃত্যুকেও ভয় পেলেঅ না জনগণ। যেদিন নূর হোসেনকে হত্যা করা হলো সেদিন রাতেই বরকত সাহেব নিজের আঙুল কেটে রক্ত ঝরালেন। সেই রক্ত দিয়ে ঘরের দেয়ালে শুধু লিখলেন ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’।
সেই থেকে শুরু। রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিয়োজিত কেউ জনস্বার্থের বিপক্ষে কোনো কথা বললেই তিনি নিজের একটা ক্ষতি করে বসেন। বেকার থাকা অবস্থায়ই ওয়াহিদার সঙ্গে বরকত সাহেবের বিয়ে হয়। ওয়াহিদা তাকে সবরকমের সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন এখনো।
ওয়াহিদা আজকের গ্লাস ভাঙার ব্যাপারটি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। জিজ্ঞেস করারও সাহস হচ্ছে না। তাছাড়া জিজ্ঞেস করলেও বরকত সাহেব কিছু বলবেন না বলেই তিনি ধরে নিয়েছেন। খামাখা মন খারাপ করানোর কোনো মানে হয় না। তবু ওয়াহিদার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল। কারণ কিছুদিন আগেই তো মন্ত্রীর হাসির কারণে হাতে ব্যথা লাগিয়েছেন। এত দ্রুত আবার কে কী বললো?
ওয়াহিদাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হলো না, বরকত সাহেব নিজেই ঘটনা খুলে বললেন। তিনি ফেসবুকের ব্যবহার জানতেন না। ছেলেমেয়ে তাকে শিখিয়ে দিয়েছে। প্রথম প্রথম অস্বস্তি বোধ করলেও এখন তার বন্ধু সংখ্যাও হাজারের অধিক এবং বেশ মজাও পাচ্ছেন। তাছাড়া নিত্য নৈমক্তিক ঘটনাগুলোও দ্রুত জানা সম্ভব হয়। কে মারা গেল, কে অসুস্থ হলো—এমনকি কে কখন রেস্টুরেন্টে ভালো খাবার খাচ্ছে, কার জন্মদিন পালন হচ্ছে, সব জানা যাচ্ছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কথা হচ্ছে, মন্ত্রীকে নিয়ে কথা হচ্ছে, শিক্ষাবিদ-রাজনীতিবিদ-বুদ্ধিজীবী কেউ বাদ যাচ্ছে না।
মন্ত্রী যেদিন মৃত্যু সংবাদে হাসলেন, সেদিন ছিল একটি হৃদয় বিদারক দিন। শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের দুজন ছাত্রকে জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এমন একটি মর্মান্তিক ঘটনায় সারাদেশ স্তম্ভিত। পুরো জাতি মর্মাহত। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত দু-এক জন মন্ত্রীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথার কারণে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়। শেষপর্যন্ত স্কুল কলেজের ছাত্ররা রাস্তায় নেমে পড়ে। কয়েকদিন রাস্তায় থেকে তারা অনেক নিয়ম কানুন শিখিয়েছে। আইন সবার জন্য সমান সেটাও বলার চেষ্টা করেছে। এই শিশুরা সুন্দর করে বলেছে ‘রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে’। শুধু রাষ্ট্র কেন, শৃঙ্খলাভাবে না চললে সব কিছুরই মেরামত প্রয়োজন। ছাত্ররা ত্রুটিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। এই ব্যাপারগুলো পর্যবেক্ষণ করে বরকত সাহেবের ভীষণ ভালো লেগেছে যে, তার এতদিনের চাওয়া এবার বুঝি পূরণ হবে। কিন্তু হঠাৎ করেই রাস্তায় নেমে পড়ল কিছু সন্ত্রাসী যারা ছাত্রদের প্রতিহত করলো। ঘটনা মোড় নিল অন্যদিকে।
বরকত সাহেব তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ছোট্ট একটি স্ট্যাটাস দিলেন, ‘সতর্ক হউন’। এতেই জ্বালা ধরে গেল কত বন্ধুর। কেউ লিখলেঅ, আপনি সরকারের দালাল, সরকারের পক্ষ নিয়ে সবাইকে কেন সতর্ক করতে চাইছেন?
কেউ লিখলো, আপনার এত বড় স্পর্ধা, সরকারকে সতর্ক হতে বলছেন? সরকার তো এই ছাত্রদের রাস্তা থেকে উঠিয়ে দিতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়নি। কেউ লিখলো, আপনাদের মতো আবালেরা এসব সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেন বলেই দেশটা এগোতে পারলো না।
বরকত সাহেব রাগে-দুঃখে অপমানে নিজেকে ছিঁড়ে ফেলতে চাইলেন। কিছুক্ষণ নিজের চুলও টানলেন। তারপর ডাইনিং টেবিলে গিয়ে গ্লাসটির দিকে চোখ পড়লো।
বিছানায় বসে ল্যাপটপ ওপেন করে ফেসবুকে নিজের স্ট্যাটাসটি বের করলেন। ওয়াহিদাকে কাছে ডেকে কমেন্টগুলো দেখিয়ে জোরে জোরে পড়তে লাগলেন। ওয়াহিদার চোখ-মুখও লাল হয়ে উঠলো। বিশ্রী ভাষার কিছু কমেন্ট আছে, যা পাঠযোগ্য নয়। বরকত সাহেব স্ত্রীকে সেগুলোও শোনালেন। তার মধ্যে স্বল্প অশ্লীল শব্দে লেখা কমেন্ট এরকম—তোদের মতো শুয়োরের বাচ্চারা আস্পর্ধা দিয়ে দিয়েই সরকারকে মাথায় তুলেছে।
বরকত সাহেব ওয়াহিদাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, বিশ্বাস করো আমি কারও পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলিতে চাইনি। তুমি জানোই আমি রাজনীতি করি না। আমি শুধু বলতে চেয়েছি, যারা ঘুষ খায়, তারা সতর্ক হোক, যারা দুর্নীতি করে তারা সতর্ক হোক, যারা আইন মানে না তারা সতর্ক হোক, যারা বেপরোয়া গাড়ি চালায় তারা সতর্ক হোক, যারা সন্ত্রাসী করে তারা সতর্ক হোক, যারা চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করে তারা সতর্ক হোক, যারা মাদকদ্রব্যে দেশ সয়লাব করে দিচ্ছে তারা সতর্ক হোক। তুমি বিশ্বাস করো ওয়াহিদা, আমি এই সতর্ক বার্তা দিয়ে শুধু দেশটাকে ভালোবাসার কথা বলতে চেয়েছি। কিন্তু ওরা এই সতর্ককেও যে যার পক্ষে ব্যবহার করলো। ওরা এই ভাগাভাগি-দলাদলি থেকে কি কোনোদিন মুক্ত হতে পারবে না? এই দেশটার কী হবে? আমরা কোথায় যাব?
বরকত সাহেবের কান্নায় ওয়হিদা যেন পাথর হয়ে যান। ভেতর থেকে তার অন্তরাত্মা যেন বলে ওঠে, বরকত তুমি নিজের আরও ক্ষতি করো। যতদিন বেঁচে থাকো এভাবে ক্ষতি করে যাও, আমি আর কোনোদিন কিছু বলব না। নিজেকে ক্ষতি করে যদি দেশকে ভালোবাসা জানাতে পারো, এর চেয়ে বড় আর কী আছে?