সংবাদপত্র হাতে নিয়ে বসে আছে মতিয়া। সংবাদপত্রের ভেতর থেকে বেশকিছু উকুন বেরিয়ে মতিয়ার মাথার দিকে হাঁটা ধরে। হাঁটার সময়ই কয়েকটি উকুন নিহত হয় মতিয়ার সুন্দর নখযুক্ত আঙুলের আঘাতে। বেশির ভাগ উকুন নিহত হয় না। বেঁচে থাকা উকুনগুলো মতিয়ার মস্তকভূ’র গভীর চুলের ভেতর অবস্থান নেয়। সংবাদপত্রের পাতা উল্টায় মতিয়া। এমন সময় মহামন্ত্রী বরিদুর আসেন, মতিয়া যেখানে বসে সংবাদপত্রকে হাতের আর মনের তাপ দিচ্ছে সেখানে। তার একটু হিংসা হয় সংবাদপত্রকে। তিনি হেসে-হেসে বসে পড়েন মতিয়ার পাশে। ঘুম ঘুম চোখ। মতিয়া তার দিকে বিষণ্ন তাকিয়ে সংবাদপত্রের দিকে চোখ ফেরালো। বরিদুর বললেন, ‘আমার কী ইচ্ছে করে জানো?’ মতিয়া তার দিকে তাকায়। ঘুমের কয়েকটা চানাচুর দানা বরিদুরের চোখ থেকে ঝরে পড়ল। চোখদুটো আরও উজ্জ্বল হলো। তিনি বললেন, ‘আমার ইচ্ছে করে, তোমার হাতের সংবাদপত্র হতে যা তুমি রোজ ভোরে পড়ো। আমার ইচ্ছে করে, তোমার শাড়ি আর চুড়ি আর অন্তর্বাস হতে। আমার ইচ্ছে করে তোমার সব গয়না হতে।’ মতিয়া বলে, ‘আমি হতে ইচ্ছে করে না? মানে, তোমার ইচ্ছে করে না মতিয়াই হয়ে যেতে? মানে, সবসুদ্ধ আমি হতে?’ ভেতর-ভেতর চমকে বরিদুর মতিয়ার চোখের দিকে তাকান। একধরনের বিহ্বলতা তার ভেতর কাজ করে। চঞ্চলতার একটা ঘোড়া তার বুকের ভেতর দাপাতে শুরু করে। তার হাঁচি আসে। ঘোড়াটি হাঁচির সঙ্গে বেশ বেগে বেরিয়ে আসে আর সামনে থাকা কাঁচের টেবিলের ওপর আছড়ে পড়ে। ঘোড়াটি নাক মুখ ফেটে মারা যায়। মরা ঘোড়ার রক্ত ছিটকে এসে তার সাদা পোশাকে লাগার আগেই আস্তে করে সরে যান। রক্তগুলো মতিয়ার শাড়ির ওপর পড়ে। রক্তগুলো কান্না শুরু করে। বরিদুর মরা ঘোড়াকে বাইরে ফেলে এসে আবার বসেন। মহমন্ত্রী স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তুমি কি বিষণ্ন প্রিয়তমা?’ সে বিষণ্ন কিনা সেটা বলতে যাওয়ার সময় ‘বিষণ্নতাটা’ গলার কাছে আঁটকে যায়। মতিয়া বাথরুমে গিয়ে গলায় আটকানো ‘বিষণ্নতাটা’ বের করে বেসিনের পানিতে ভালো করে ধুয়ে আবার গিলে ফেলে। ফিরে এসে মহামন্ত্রীর কাছে বসে। মহামন্ত্রী বলেন, ‘গতরাতে আমি খুব চমৎকার একটা স্বপ্ন দেখেছি। খুব আনন্দ পেয়েছি। স্বপ্নে দেখেছি, জনগণ আমাকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে, ফুলের মালা আমার গলায় পরিয়ে দিচ্ছে।’ এ সময় মতিয়ার শাড়িতে লেগে থাকা মৃতঘোড়ার রক্তরা আরও জোরে কেঁদে ওঠে। মতিয়া সংবাদপত্রের প্রথম পাতা বের করে দেখায়, ‘এগুলো কী লেখা আছে পেপারে?’ মহামন্ত্রী পেপারের দিকে তাকায়, লেখা আছে, ‘মহামন্ত্রীর লোকেরা বারো বছরের এক কন্যাকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে।’ মতিয়া বলে, ‘তুমি কি জানো, তোমার লোকেরা কী করেছে?’ বরিদুর বললেন, ‘আরে কী বলো, আমাকে না জানিয়ে কোনো কাজ করতে পারে আমার লোকে?’ এ সময় মাথার মাঝখানে অবস্থান নেওয়া উকুনগুলো যে কথা বলছিল, তা মতিয়ার কানে প্রবেশ করে। মতিয়া অবাক হয়ে বলে, ‘তুমি সবই জানো!’ মহামন্ত্রী বললেন, ‘তুমি এসব বুঝবে না প্রিয়তমা। মেয়েটার বাপকে পোষ মানাতে গেলে এর চেয়ে কম কিছু করার ছিল না। আর পেপারে এসব লিখলেও কিছুই হবে না। আমার তুমি ভেবো না’। ‘তুমি ভেবো না’—বাক্যটিকে একটা ফ্রিজের ভেতর থেকে এনে তাকে দান করল বলে মনে হলো মতিয়ার। ‘তুমি ভেব না’—কথাটি সত্যি ফ্রিজ থেকে এনে দিয়েছে কি না—দেখার জন্য মতিয়া ফ্রিজের রুমে ঢুকে ফ্রিজ খুলে দেখে। অজস্র ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ‘তুমি ভেবো না’ রাখা আছে এখানে। এতগুলো ‘তুমি ভেব না’ কখন কখন নিয়ে এসে রেখেছেন বুঝতে পারেনি। বিভিন্ন ফাইলে বিভিন্ন সারিতে এসব ‘তুমি ভেবো না’ সাজানো আছে। একটা সারির শিরোনাম ‘জনজনের জন্য’, একটা সারির শিরোনাম ‘নিজ দলের লোকের জন্য’, একটা শিরোনাম ‘চাকর বাকরদের জন্য’। এভাবে কোনোটা সরকারি কর্মচারীর জন্য, কোনোটা এনজিওগুলোর জন্য। মতিয়া তার নাম লেখা একটা সারিও দেখতে পেল। আরো একটা সারি দেখল যেটাতে একটামাত্র অক্ষর ‘র’ লেখা আছে। হতে পারে কোনো মানুষের নামের প্রথম অক্ষর। হতে পারে ‘র’ মানে রহিম বা রহিমা। ফ্রিজের ঘর থেকে মতিয়া ফিরে এসে বসলে, মহামন্ত্রী বললেন, ‘আমার স্বপ্নটা মজার না? এমন স্বপ্ন প্রায়ই দেখি আমি।’
০২.
ভোর। মতিয়া ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। সংবাদপত্র এখনো আসেনি। মতিয়া একটু দূরে দেখতে পেল, বিরাট একটা গরুর পাল এগিয়ে আসছে রাস্তা ধরে। সে খেয়াল করল গরুর পালটার বেশ খানিকটা সামনে সংবাদপত্রের হকার বেশ জোরে সাইকেল চালিয়ে আসছে। ‘এখন তবে সংবাদপত্র পড়া যাবে’—এই ভাবনাটা তার ভেতরে আসার পরপরই আর একটা ভাবনা আসে, ‘এতবড় গরুর পাল এই শহরের ভেতর কোথা থেকে এলো?’ পালটা আরও কিছুটা এগিয়ে এলে মতিয়া বড়ই লজ্জিত হয়। গরুর পাল নয়, মানুষের পাল। একটা বিরাট মিছিল। মানুষের মিছিল। তাদের হাতে ফুল আর ফুলের মালা। মহামন্ত্রীকে তারা ফুল আর ফুলের মালা দেওয়ার জন্য আসছে। এর মধ্যেই মহামন্ত্রী খবর পেয়ে ঘুম থেকে উঠে ব্যালকনির দিকে গজ-গজ করতে করতে এলেন—‘শালা গরুগুলো এত সকালে চলে এলো? একটু ঘুমাতেও দেবে না দেখছি’। কতদূরে মিছিলটা আছে দেখে মহামন্ত্রী ওয়াশরুমে গেলেন। এর মধ্যেই মিছিলটা পৌঁছে গেছে বাড়ির সামনে। দারোয়ানরা তাদের কাছে থেকে ফুলের মালা আর ফুলের তোড়া সংগ্রহ করে নিয়ে বাসায় ঢোকে। মহামন্ত্রী ফুলের মালা গলায় দিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। মতিয়া ততক্ষণে ব্যালকনি ছেড়ে বসার ঘরে সংবাদপত্র পাঠের উদ্যোগ করছে। মহামন্ত্রী ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে হাত নাড়ে মানুষগুলোর উদ্দেশে। ভাষণ দেয়—‘আপনারা এসেছেন কষ্ট করে। আমার খুব ভালো লাগছে। যদিও আপনাদের আসার দরকার ছিল না। আমি তো আপনাদেরই গোলাম। আমিই যাব আপনাদের কাছে। যে ব্রিজ হয়েছে তার জন্য আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন, এতে আমি খুশি। যদিও এটা আমার দায়িত্ব। আপনারা ভাববেন না। আমাদের উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে।’ এই ‘ভাববেন না’টা উচ্চারণের সঙ্গে-সঙ্গে মতিয়া ফ্রিজের ঘরের দিকে যায়। সে দেখে জনগণের সারি থেকে ‘ভাববেন না’র একটা শিশি নেই।
গতকাল ব্রিজ উদ্বোধন হয়েছে। লোকজনের উপকার হয়েছে। তারা ফুল দিয়ে গেল। মতিয়া পেপারটি কোলের ওপর নিয়ে বসে। সে সংবাদপত্রের ভেতর ঢোকে। এটা একটা সমুদ্র। সে হাঁসফাঁস করতে থাকে। দুর্ঘটনা-দুর্ঘটনা। ধর্ষণ-ধর্ষণ। খুন-খুনি। চুরি-ডাকাতি। সংবাদপত্রের ভেতর ঢুকে তার মাথা গুলিয়ে ওঠে, বুক ধড়ফড় করে। লোকজন বিদায় করে মহামন্ত্রী এসে মতিয়ার কাছে বসেন। মহামন্ত্রী মতিয়ার দিকে তাকিয়ে একটু হাসেন। তার হাসির ভেতর থেকে গরুর চামড়ার তৈরি কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র বেরিয়ে এসে মতিয়ার কানের কাছে গিয়ে স্থির হয়। মতিয়ার কানের হাত বাদ্যযন্ত্রগুলোকে কানের ভেতর নিয়ে যাওয়ার জন্য ধরতেই, মতিয়া এক ঝটকায় কানের হাতটাকে ধরে ফেলে। কানের হাত থেকে বাদ্যযন্ত্রগুলো খুলে পড়ে যায় মেঝেতে। ব্যাপারটা মহামন্ত্রী খেয়াল করলেন না। তিনি তার গলা থেকে কয়েকগাছি মালা মতিয়ার গলায় পরাতে চাইলে, মতিয়া বলে, ‘আমি সংবাদপত্র পড়ছি।’ সংবাদপত্র থেকে একটা শেয়াল বেরিয়ে মহামন্ত্রীর গলা খামচে ধরতে যাওয়ার সময় মতিয়া সংবাদপত্র বন্ধ করে মহামন্ত্রীর দিকে তাকায়। শেয়ালটা ছাড়বে কি না, বুঝতে পারে না। মহামন্ত্রী বলেন, ‘আজকে রাতেও খুব মজার স্বপ্ন দেখেছি। বেশ আনন্দ পেয়েছি।’ তিনি স্বপ্নটি হাতের ওপর নিয়ে মতিয়াকে দেখাতে গেলে মতিয়া সংবাদপত্রের শেয়ালটা ছেড়ে দেয় মহামন্ত্রীর দিকে। মহামন্ত্রী সংবাদপত্রটির পাতা দেখে, যেখানে মতিয়া আঙুল দিয়ে আছে, ‘ব্রিজে কয়েক কোটি টাকার দুর্নীতি।’ মহামন্ত্রী হেসে ওঠেন—‘আরে তুমি এগুলো কী দেখো! পেপারওয়ালাদের কাজ!’ সে আবার হাসে। টাকা আমি লোপাট করেছি ঠিকই কিন্তু তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। আমার কিছুই হবে না।’ মহামন্ত্রী কিছুটা বিরক্ত হয়ে উঠে গেলেন।
মহামন্ত্রী উঠে যাওয়ার পর, মতিয়া পেপারটাকে হাত দিয়ে ঘষে ঘষে আগুন ধরিয়ে ফেলে। ছাই হয়ে গেল পেপার। ‘পেপারের ছাইগুলো দিয়ে কিছু একটা করতে চাই, এই যেমন, কথা বলা পুতুল বা ছারপোকার ডিম বা দূরে যাওয়ার ঘোড়া—এমন কথা মনে মনে ভাবল। ছাইগুলো দিয়ে ঠিক কী করবে, তা ঠিক করার আগেই পানি দিয়ে গাঢ় লেই তৈরি করে। পোড়ানোর সময় পেপারের ভেতর থেকে অজস্র আর্তচিৎকার ভেসে আসছিল। পানি দেওয়ার ফলে থেমে গেছে আর্তি। মতিয়া চুপ। চুপচাপ। লেইগুলো নাড়াচাড়া করতে থাকে। নাড়াচাড়া করতে থাকে। সে নাড়া চাড়া করতে থাকে অনেকক্ষণ ধরে। কারণ সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না লেই দিয়ে সে কী করবে। এ সময় আবার মহামন্ত্রী ঘরে ঢোকেন আর মতিয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘বাহ্ ছাই দিয়ে বেশ চমৎকার পুতুল তৈরি করেছ তো।’ মতিয়া তার হাতের দিকে তাকায়। মতিয়াও অবাক হয়। সত্যিই সুন্দর একটা পুতুল তার হাতে। লেই নাড়াচাড়া করতে করতে কখন তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু পুতুলটি ছাই দিয়ে তৈরি। এটা কালো হওয়ার কথা কিন্তু একেবারে ধবধবে সাদা হয়েছে। যেন দুধের তৈরি। তার হাতে যে ছাই লেগে আছে তা কালোই আছে। সে ভীষণ অবাক হয়ে ঘরের এককোণে রেখে দেয় শুকানোর জন্য। মহামন্ত্রী কোনো এক জনসভায় যাওয়ার জন্য বেরিয়ে গেলেন।
০৩.
মতিয়া খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে বসার ঘরে পেপার কোলে করে বসে। আজও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে রিপোর্ট—‘বস্তির লোকদের ঘর জ্বালিয়ে তাড়িয়ে দিয়ে মন্ত্রীর বস্তি দখল।’ হৃদপিণ্ডের ভেতর মতিয়া একটা শব্দ শুনতে পায়, যেন একটা ব্যাঙকে একটা সাপ কামড়ে ধরে আছে। সে একটা ছুরি নিয়ে আসে, বুক ফেড়ে এই সাপ আর ব্যাঙকে বের করার জন্য। সে তার শাড়ি খুলে ফেলে। ব্লাউজ খুলে ফেলে। সে ছুরিটা ঠেকিয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করে, বুকের ভেতরের কোনদিক থেকে শব্দ আসছে। যেখান থেকে ব্যাঙের করুণ শব্দ আসছে, সেখানটাতেই ছুরি দিয়ে সুন্দর করে কাটতে হবে। সে তার নিশানা ঠিক করে। ছুরি ঢুকবে এখন সুন্দর বুক চিরে। সে চোখ বন্ধ করে। ‘আজ থেকে তোমার পেপার পড়া বন্ধ’—মহামন্ত্রী বললেন। হঠাৎ করেই তিনি ঘরে ঢুকেছেন। ছুরিটা কেড়ে নিয়ে দূরে ফেলে দিলেন তিনি। তিনি মতিয়াকে জড়িয়ে ধরে বসতে বসতে বললেন, ‘পেপার পড়ে পড়ে তুমি বিষণ্নতায় ভুগতে শুরু করেছ।’ তিনি তাকে ব্লাউজ পরিয়ে দেন। শাড়ি পরতে সাহায্য করেন। তাকে সহজ করার চেষ্টা করেন। তিনি বললেন, ‘আজও একটা মজার স্বপ্ন দেখেছি। প্রতিদিন আমি মজার মজার স্বপ্ন দেখি। ঘুমুতে বেশ ভালো লাগে আর তুমি পেপার পড়ে পড়ে শুধু বিষণ্নতায় ভোগো।’ মতিয়া চিন্তা করে, এই লোকটা কিভাবে প্রতিরাতে মজার স্বপ্ন দেখে। মহামন্ত্রী বাসা থেকে বেরিয়ে গেলে মনে পড়ে তার পুতুলটির কথা। পুতুলটি সে দেখতে যায়। কিছুটা শুকিয়েছে। আরও একটু উজ্জ্বল হয়েছে। পেপার পোড়া ছাইয়ে তৈরি ধবধবে সাদা পুতুল।
০৪.
ঘুমুতে গেলেন মহামন্ত্রী। মতিয়া মনে মনে ভেবে নিল, আজকে মহামন্ত্রীর স্বপ্ন দেখা দেখব। মহামন্ত্রী নাক ডেকে ঘুমুতে শুরু করেছেন। ডিমলাইট জ্বলছে। অন্ধকার যত বাড়ছে ডিমলাইট তত উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। মতিয়া মহামন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। মন্ত্রী স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন কি না, বুঝতে পারছে না মতিয়া। সে পায়চারী করছে আর একবার করে তাকিয়ে দেখছে বরিদুরের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল কিন্তু মন্ত্রী স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে কি না, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না মতিয়া। কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে না সে। সে ওয়াশরুমে গেল। চোখে মুখে ঠাণ্ডা জল ছিটালো। ফিরে আসার সময় তার নিজের বেডরুমের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখে। ‘মতিয়া তার বেডরুমে নাই’—মতিয়া উচ্চারণ করল। যেন সে আশা করেছিল, সে তার বেডরুমে শুয়ে থাকবে আর তার নিজের শুয়ে থাকার দৃশ্য দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে পাবে। সে তাকে তার রুমে শুয়ে থাকতে দেখতে না পেয়ে হাঁটা ধরে। পরের রুমটা তাদের মিলন কক্ষ। তারা একসঙ্গে ঘুমায় না। দুজনের দুটি বেডরুম। শুধু সঙ্গমের প্রয়োজন দেখা দিলে মহামন্ত্রী তাকে এ রুমে ডেকে নেন। সে তাদের সঙ্গম বেডের দিকে তাকালো। দুটো বিড়ালের মিলন দেখতে পেল। বিড়াল দুটোর একটা সাদা একটা কালো। বাসাতে এমন দুটো বিড়াল যে থাকে, তা তার জানা ছিল না। তাদের রুমে, তাদের সঙ্গম বেডে বিড়াল দুটোর রতিক্রিয়া দেখে ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে যায় মতিয়ার। বিড়ালদের বিরক্ত না করে সে পা বাড়ায়। এর পরেই মহামন্ত্রীর বেডরুম। মতিয়া মহামন্ত্রী বরিদুরের দিকে তাকালো। তার ঠোঁট দুটো ঈষৎ হাস্যন্মুখ। নীরব হাসি হাসছে মহামন্ত্রী। এরপর কিছুটা শব্দ করে হাসছে। মতিয়া বুঝতে পারল, মহামন্ত্রী স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন। সে তার দিকে তাকিয়েই আছে। অনেকক্ষণ পর খেয়াল করে, মহামন্ত্রীর দুচোখের কোণ বেয়ে অজস্র অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তার হাসিমাখা ঠোঁট দেখাতেই এতক্ষণ ব্যস্ত ছিল সে। লাল রঙের হাসি, কালো রঙের হাসি, হলুদ রঙের হাসি তার ঠোঁট দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। সে একটা লাল হাসির ফিতা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখছিল। হলুদরঙের হাসিটা হাতে তুলতে যাওয়ার সময় তার চোখের দিকে চোখ যায় মতিয়ার। মতিয়া ভেবে পায় না আজকে, এখন, মহামন্ত্রী মজার স্বপ্ন না ব্যথার স্বপ্ন দেখছে। তার ঠোঁট থেকে রঙবেরঙের হাসির ফিতা পড়তেই আছে। অন্যদিকে তার চোখ থেকে জলের ধারা বইতেই আছে। সে তার রুমে ফিরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায়। তার ঘুম দরকার।
মতিয়া সকালে ঘুম থেকে জাগার পর এসে বসেছে বসার ঘরে। এখানে এখন আর পেপার আসে না। কিছুক্ষণ পর মহামন্ত্রী এলেন। তিনি শুরু করলেন তার স্বপ্ন বৃত্তান্ত। মজার স্বপ্ন বৃত্তান্ত। অবিশ্বাসের চোখে তাকায় মতিয়া—‘তুমি কাল রাতেও মজার স্বপ্ন দেখেছ?’ সে গভীরভাবে মহামন্ত্রীর চোখের দিকে তাকায়। মহামন্ত্রী বলেন, ‘হ্যাঁ, কেন?’ মতিয়া মন্ত্রীর চোখ আরও গভীর করে দেখে, যতক্ষণ কথা বলে ততক্ষণ কথার গতি পরীক্ষা করে মনে মনে। কিছু বুঝে উঠতে পারে না। মতিয়া আরও কয়েকদিন মহামন্ত্রীর স্বপ্ন দেখা দেখে, রাত জেগে জেগে। প্রায় প্রতিরাতেই একই ধরনের অভিব্যক্তি দেখা যায় বরিদুরের মুখে। প্রতিদিনই মহামন্ত্রী সকালে এসেই মতিয়ার কাছে বলতে শুরু করেন, মজার স্বপ্ন বৃত্তান্ত।
০৫.
কয়েকদিন পরের ভোর। মতিয়া বসে আছে বসার ঘরে। হঠাৎ তার চোখ যায় ঘরের কোণের দিকে। যে কোণের কাছে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট একটা পুতুল। সে সেদিকে এগিয়ে যায়। পুতুলটি একেবারে সাদা ধবধবে। এমন ধবধবে রঙ আর কোনোদিন দেখেনি বলেই মনে হলো তার। পুতুলটিকে সে হাতে নেয়। পুতুলটি হেসে জিজ্ঞাসা করে, ‘কেমন আছ তুমি?’ মতিয়া চমকে ওঠে, তার হাত থেকে পড়ে যায় পুতুল। পুতুলটা কঁকিয়ে ওঠে, ‘উহ্, কেন ফেলে দিলে আমাকে, আমাকে তোলো।’ মতিয়া অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। আবার পুতুলের দিকে তাকায়। কথা বলা পুতুল কথা বলতেই থাকে, ‘আমাকে তোলো, আমাকে তোলো।’ মতিয়া ধাতস্থ হয়ে কথা বলা পুতুলটিকে তোলে, ‘তুমি কথা বলতে পারো? তুমি আমার কথা বলা পুতুল, তোমাকে আর ফেলব না। তুমিই আমার আত্মা।’ তারা বহুক্ষণ কথাবার্তা বলে। একসময় মহামন্ত্রীর প্রসঙ্গ আসে। তার স্বপ্নের প্রসঙ্গ আসে। স্বপ্নের ব্যাপারে সে পুতুলটার কাছে জানতে চাই—‘মহামন্ত্রী সকালে যখন তার স্বপ্নের কথা বলে তখন নিশ্চয়ই মিথ্যে বলে?’ পুতুলটি বলে, ‘না, সে মিথ্যে বলে না। সে সত্যিই বলে। তার খারাপ বৈশিষ্ট্যগুলো এত প্রখর যে, সেগুলোই তাকে মজার স্বপ্ন দেখায়, আর সে হেসে ওঠে স্বপ্নের ভেতর। কিন্তু আত্মাটি তার কেঁদে ওঠে। ঘুমের ভেতর থাকে যখন, তখন তার আত্মার কান্না বেরিয়ে আসে চোখ দিয়ে। যেহেতু তার খারাপ বৈশিষ্ট্যগুলো বেশি শক্তিশালী সেহেতু আত্মার ব্যথা পাওয়াটা সকালে মনে থাকে না। এ ধরনের মানুষ তার আত্মার কান্না দেখতে পায় না।’