কালো ধোঁয়া কুণ্ডুলী পাকিয়ে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। রোদ ঝলমলে আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘ হাসিহাসি মুখে পৃথিবীর শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান দেখছে। মেঘের গায়ে গায়ে হাজারো পরিচিত মুখের ছায়া। মিলিয়ে যাচ্ছে নাম মনে করার আগেই। বিশ্রী গন্ধে ফুসফুসটা ভরে উঠছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আজ কয়েকদিন থেকে। বিদঘুটে গন্ধেই জ্ঞান ফিরলো সিডের। কতক্ষণ যে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, মনে করতে চেষ্টা করেও পারলো না। বহুকষ্টে তাকালো। রেস্তোরাঁর কণিষ্ঠ ওয়েটারের চোখ দুটি গলে পড়তে দেখলো আগুনের তাপে। মুখ ঘুরিয়ে নিতেই পেটের সমস্তটা উল্টে গলগল করে বেরিয়ে এলো অ্যাসিড পানি। তেতো করে দিয়ে গেলো মুখটা। ক্লান্ত হয়ে ঝিমিয়ে পড়লো। শরীরটাকে টেনে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যেতে হবে মস্তিষ্ক জানান দিলেও একটুও শক্তি পাচ্ছে না সে। অপরাজিতার কথা মনে পড়তে বুনো শক্তি যেন ভর করলো শরীরে। চোখ বন্ধ করেই টানতে শুরু করলো নিজের শরীরটাকে। লাশের স্তূপ থেকে বেরিয়ে যেতে পারলেই অপরাজিতার সেই কাঁপা ঠোঁট অপেক্ষা করছে তার জন্য।
হালকা পাতলা শরীরটাও আজ বড্ড ভারী লাগছে সিডের। ধাক্কা খেলো কিছুর সঙ্গে। চোখ না খুলেই ধীরে ধীরে হাত বাড়ালো। ভেজা আঠালো পদার্থে হাত ভিজে উঠলো। তাকিয়ে যা দেখলো, তার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিল না সে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সেমিস্টারের ছাত্রী, বাঙালি ছেলদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। অপরাজিতা কত ক্ষেপাতো ওকে নিয়ে! সেই নম্রতার মাথার পেছনের অংশ উড়ে গেছে, তরল একটা কিছু গলে পড়ছে চারপাশে। চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। জ্ঞান হারলো সিড।
গরম একমগ কফি নিয়ে এগিয়ে গেলো অপরাজিতার টেবিলের দিকে। কফি এগিয়ে দিতেই সিডের হাতে আরেকটি চিরকুট এসে পৌঁছালো। আমার নিঃসঙ্গ জীবনে ধূমায়িত কফির মগ হয়ে উষ্ণতা দেবে তুমি?
প্রেমের স্নিগ্ধতায় এক অপরুপ লাবন্য তৈরি হয়েছে তোমার মুখে। প্রতিদিন ঘুম ভেঙে এই স্নিগ্ধতা আমার চোখে-মুখেও মেখে নিতে চাই। আমার হবে তুমি? রেস্তোরাঁর কোণার টেবিলের বিলের মাঝে এমন একটা চিঠি সিডের বুকের হার্টবিটকে কিছুক্ষণের জন্য আটকে দিয়েছিল। উহানের এ রেস্তোরাঁয় বাঙালিদের ভীষণ আনাগোনা। দুই তলা এই রেস্তোরাঁর গরম ঘরটার কোণার টেবিল দখল করে বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই এক সুকেশিনী। মেদহীন ঝরঝরে রেশমের মতো শরীর। চোখদুটি গাঢ় নীল। মায়ের সন্ধ্যাপুজোর ধুপকাঠির মতো তার গায়েও জুঁই ফুলের ঘ্রাণ।
কয়েকবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয় সিড। ছুটির দিনগুলো ছাড়া শুধু কফি অর্ডার করে সুকেশিনী। ছুটির দিনে বাঙালি খাবার খায়। অদ্ভুতভাবে লক্ষ করলো সে সুকেশীনীর কোনো বন্ধু আসে না কখনো। সে আসে একা। চুপচাপ বসে থাকে। কখনো কিছু লেখে। চলে যায়। কেমন একটা রহস্যময় চরিত্র মনে হয় সিডের কাছে। রেস্তোরাঁর ম্যানেজার ও অন্যদের আলোচনা থেকে এটা বুঝতে পারে সে, সুকেশিনী লেখালেখি করে। মা-বাবা বাঙালি হলেও সুকেশিনী যায়নি কখনো বাংলাদেশে। বাংলা ভাষাটা তার বাবা মায়ের কাছ থেকেই শেখা। বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে সে। গল্প লেখে। সিডের খুব জানতে ইচ্ছে করে কী থাকে তার গল্পে? মা-বাবাকে ছেড়ে পড়তে আসা সন্তানের বুকের হাহাকার থাকে সে গল্পে? অভাবের জন্য চোখের সামনে সন্তানের মৃত্যুর যন্ত্রণা কি তুলে ধরতে পারে তার গল্প, ছুঁতে পারে হৃদয়? জারুল বনের বৃষ্টির মায়া পারে ছুঁতে? শীতের রাতে হলুদ খামে চিঠি লেখে যে শিউলি, বুকের সমস্ত গন্ধ ঢেলে দিয়ে যে বেলি খোঁপা সাজায় প্রিয়তমার জন্য তা কি ঠাঁই পায় তার গল্পে? না কি বিকিনি পরা মানুষের উল্লাস আর কালো চশমার আড়ালে চাপা পড়ে যায় বুকের দীর্ঘশ্বাস?
সিড চিঠিটা নিয়ে বারবার উল্টেপাল্টে দেখছে টেবিল ল্যাম্পের নিচে। না কোনো সম্বোধন নেই লেখাটিতে। নিচে নেই কারও নাম। সিড সম্বোধনে নিজের কথা ভেবে রোমাঞ্চিত হচ্ছ, পরক্ষণেই এটা তার কোনো গল্পের অংশ ভেবে ডুবে যেতে লাগলো আঁধারে। এভাবেই রাত হারিয়ে গেরো দিনের আলোয়। সারাদিন ঘড়ি দেখেই কাটালো সিড। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ করে ছুটে এলো রেস্তোরাঁয়। ডিউটি টাইমের এত আগে সিডকে দেখে ম্যানেজার একটু অবাক হলো। চারটা বাজার দশ মিনিট আগেই সিডের হৃদপিণ্ডের কম্পন বাড়িয়ে দিয়ে নির্ধারিত টেবিলে বসলো সে। দুধসাদা কামিজের ওপর গাঢ় নীল রঙের স্কার্ফে প্রিয় অপরাজিতা ফুলের মতো লাগছিলো তাকে। ঠোঁট দুটি কেঁপে উঠলো যেন, কিছু কি বলতে চায় আমাকে অপরাজিতা? এগিয়ে যেতে চেয়েও চোখের মায়ায় ডুবে যায় সিডের, পা আটকে যায়। রেস্তোরাঁর সবচেয়ে ছোট ছিল অসীম, মেডিক্যাল ফার্স্ট ইয়ার।
ঠাণ্ডা কফি খাওয়াবে? এই বলে ধাক্কা দিতেই লজ্জা পেয়ে সরে গেলো সিড। গরম একমগ কফি নিয়ে এগিয়ে গেলো অপরাজিতার টেবিলের দিকে। কফি এগিয়ে দিতেই সিডের হাতে আরেকটি চিরকুট এসে পৌঁছালো। আমার নিঃসঙ্গ জীবনে ধূমায়িত কফির মগ হয়ে উষ্ণতা দেবে তুমি?
রবার্টের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। হুঁইসেল বাজিয়ে উহানের রাস্তায় কোভিড-19-এর লাশ উদ্ধার করতে এলো একদল স্বেচ্ছাসেবক দল।
এরপর প্রতিদিন একটা করে চিরকুট পেতে থাকলো সিড। গল্প এগিয়ে যেতে থাকলো স্বপ্নের মতো। উহানের প্রতিটি রাস্তা, রেস্তোরা, পার্ক সব জায়গায় লেখা হলো ওদের ভালোবাসার গল্প। অপরাজিতার ফ্ল্যাটে রাতের পর রাত কাটানো দুজন নির্ঘুম মানুষ। তবু কথা শেষ হয় না দুজনের। বিয়ের পরিকল্পনা, মায়ের হাতের রান্না, তুলসিতলা, জারুলের বন, পর্তুলিকার বাগান, দেশ, রাজনীতি কি থাকতো না তাদের গল্পে?
সিডের মায়ের সঙ্গে কথা হলো এনার। ওহ, সিডের অপরাজিতার নাম এনা। তবে সিডের কাছে ও অপারাজিতাই। সিডের মা ছেলের পছন্দের প্রশংসা না করে পারলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বন্ধুবান্ধব সিড আর এনার প্রেমের গল্প জানতো, কেউ কেউ হিংসে করতো। বসন্ত এসেছিল ওদের জীবনে, ওরা সে বসন্তের দুটো রঙিন প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছিল মহা আনন্দে। পাহাড়ি ঝর্ণার মিষ্টি কুলকুল শব্দে বুঁদ হয়ে পার করছিল মধুর সময়।
সিড বাংলাদেশ থেকে শাড়ি আনালো। আসলে এনার শাড়ি পরার ইচ্ছের কথা জানতে পেরে সিডের মা-ই পছন্দ করে কিনে পাঠালেন এক ছোট ভাইয়ের মাধ্যমে।
গোধূলি লগ্নে যেন একমুঠো রাঙা আবির কেউ ছড়িয়ে দিয়েছে শাড়িটার গায়ে। তার মধ্যে মিটমিট করে লক্ষ লক্ষ তারা জ্বলজ্বল করছে। কেউ টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে সিডকে। বুঝতে পারছে। হাত-পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছে। রাস্তায় হাত-পা কেটে রক্ত বের হচ্ছে। অনেক কষ্টে চোখ মেললো সিড। রবার্টকে চিনতে একটু সময় লাগলো ওর। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই রবার্ট জিহবা দিয়ে চাটতে শুরু করলো সিডের মুখ। অপরাজিতার ফ্ল্যাটের সামনে নিজেকে আবিষ্কার করলো সে। জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো রবার্টকে। গেটের ভেতরে, সিঁড়িকোটায় লাশ দেখলো সিড। মুখ ঘুরিয়ে নিলো। মানুষ পচে গেলে এত বিভৎস গন্ধ হয় জানা ছিল না তার। অপরাজিতা দরজা খুলে রেখেছে সিডের জন্য! ড্রয়িংরুম, লাইব্রেরি পেরিয়ে বেডরুমে গিয়ে অপরাজিতাকে পেরো ও। বাংলাদেশ থেকে মায়ের পছন্দ করা শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে পড়ে আছে। শাড়ির নিচে পচে যাওয়া অপরাজিতার ঠোঁট দুটো অক্ষত! কাঁপছে। সেই প্রথম চুমু খাওয়ার সময়ের মতোই। সিডকে আইশোলেশনে নিয়ে যাওয়ার সময়ে বিদায় দিতে গিয়েও এভাবে কেঁপেছিল। ধীরে ধীরে অপারজিতার ঠোঁটের ওপরে ঠোঁট রেখে চুমু খেলো সিড। সঙ্গে সঙ্গে জুঁইফুলের ঘ্রাণে ভরে উঠলো চারপাশ। আজ জুঁইফুলের ঘ্রাণ বেশ কড়া আর ঝাঁঝালো। ফুসফুস দখল করে নিচ্ছে সে ঘ্রাণ, খুব দ্রুত। কাশতে থাকে সিড।
রান্নাঘর হাতড়ে দিয়াশলাই এনে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে শুয়ে পড়লো অপরাজিতার পাশে। শাড়িটা সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়ার আগেই শেষবারের মত জ্ঞান হারালো সে। রবার্টের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। হুঁইসেল বাজিয়ে উহানের রাস্তায় কোভিড-19-এর লাশ উদ্ধার করতে এলো একদল স্বেচ্ছাসেবক দল।
পরদিন ফ্ল্যাটে আগুন লাগার ছবির পাশাপাশি লাশের স্তূপের ওপর জীবন্ত এক কুকুরের ছবিও ছাপা হলো পত্রিকায়!