কী বললেন? অফিসে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র!
জ্বী স্যার, ঘাড় চুলকে কণ্ঠ নামিয়ে জবাব দেয় হাবিব আহমেদ, বুঝতেই পারছেন স্যার, সবাই আমার কলিগ। ওদের বিরুদ্ধে আপনার সঙ্গে গোপনে কাজ করছি আমি। আমাকে যেন ঢাকার বাইরে ট্রান্সফার করা না হয়, একটু দেখবেন প্লিজ স্যার।
টেবিলের ওপরের পেপারওয়েট নাড়াতে নাড়াতে জবাব দেয় ডেপুটি ডিরেক্টর মুন্সি আহসান কবির, এই অফিসের কোথায়, কখন কী হয় আমি সব জানি। আপনি চিন্তা করবেন না হাবিব। আমি সব ব্যাটাকে ঢাকার বাইরে ট্রান্সফার করার ব্যবস্থা করছি। আমাকে তো চেনে না। জনপ্রশাসন সচিব ইকরামুল হক আমার ব্যাচমেট। একটা ফোন করলেই কর্ম সাবাড়। কিন্তু আমি ক্ষমতা দেখাতে চাই না। সেটাকে ওরা আমার দুর্বলতা মনে করছে, তাই না? মোটা কালো গর্দান সামনে এনে জিজ্ঞেস করে মুন্সি, বলুনতো আমার বিরুদ্ধে কে বেশি ঘোট পাকায়?
অনন্য মামুন।
জুনিয়র ছেলেটা? চোখ কপালে মুন্সি আহসান কবিরের। বলেন কী? এত সাহস ও কোথায় পায়? আমার ক্ষমতা সর্ম্পকে ও জানে না?
জানে স্যার, আমি নিজে বলেছি ওকে।
কী বলেছেন?
বলেছি, আমাদের ডেপুটি ডিরেক্টর মুন্সি আহসান কবিরের হাত অনেক বড়। সচিবালয়ের অর্ধেক সচিব স্যারের বন্ধু। ডিডি স্যারের বিরুদ্ধে কেউ কাজ করছে, জানতে পারলে একেবারে ঢাকার বাইরে ট্রান্সফার চব্বিশ ঘণ্টায়।
কী বলল শুনে?
খুব গ্রাহ্য করেনি।
দেখাচ্ছি ওকে। বলতে বলতে সেল ফোন হাতে নিয়ে বাটন টিপে কানে নেন মুন্সি। সামনে বসে আছে হাবিব, অফিসের কর্মকর্তা। কয়েক সেকেন্ড যাওয়ার পর কথা বলে মুন্সি, হ্যাঁ দোস্ত আমি কবির। মিটিংয়ে আছিস? ঠিক আছে, মিটিং শেষ হলে আমাকে ফোন দিস, জরুরি কথা আছে। রাখি, বাই। উজ্জ্বল চোখে তাকায় হাবিবের দিকে মুন্সি, বলেন তো কার সঙ্গে কথা বললাম?
জনপ্রশাসন সচিবের সঙ্গে স্যার?
না, আমার মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট সেক্রেটারির সঙ্গে। ও আমার গ্রামের ছেলে। এক সঙ্গে আমরা খেলাধূলা করেছি। ও আমার চেয়ে দুই বছরের ছোট। কিন্তু আমি বিসিএস দেইনি। ও দিয়েছে। ওর নাম কাশেম। সে এখন জয়েন্ট সেক্রেটারি। আর আমি? একেই বলে কপাল! আপনাদের অফিসে ডেপুটি ডিরেক্টর। যাইহোক, কাশেম ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে আমি বলব, মামুনকে ট্রান্সফার করে ঢাকা থেকে বান্দরবান পাঠাতে।
ওকে বান্দরবান পাঠাতে পারলে খুব ভালো হয়, স্যার।
চেয়ারে হেলান দিয়ে উদার হাসে মুন্সি, দেখুন না চব্বিশ ঘণ্টার পরে ঘটনা কোন দিকে মোড় নেয়। ট্রান্সফারের চিঠি হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে আমার কাছেই আসবে। কান্নাকাটি করবে। বলবে, স্যার নতুন বিয়ে করেছি। বৌ থাকবে ঢাকায়, আমি থাকব বান্দরবান, খুব কষ্ট পাবে নতুন বৌ। আমার ট্রান্সফারটা ফেরানোর ব্যবস্থা করুন।
আঁতকে ওঠে হাবিব, খবরদার স্যার এমন কাজও করবেন না।
শরীরের আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে জবাব দেয় মুন্সি আহসান করিব, আপনার মাথা খারাপ হয়েছে হাবিব? আমার শত্রুকে আমি দয়া দেখাব? এমন মহৎ মানুষ আমি নই। আমি মুখে বলব, দেখি, দেখছি। আপনাকে ঢাকায় খুব প্রয়োজন। কে যে এসব ট্রান্সফার করে আমাকে না জানিয়ে, বুঝতে পারছি না। আমি দেখছি মামুন। আপনি কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। কিন্তু কিছুই দেখব না। কয়েক দিন পরে আমি বলব, সচিব মহোদয়ের সঙ্গে আপনার বিষয়ে আমার কথা হয়েছে। সচিব মহোদয় বলেছেন, অর্ডার যখন হয়েছে, তখন যাও। তিন মাসের মধ্যে ঢাকায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা হবে।
ও চলে যাবে বান্দরবান কয়েক বছরের জন্য। মুন্সি আহসান কবির শরীর চেয়ারে গা ছড়িয়ে দিয়ে হো হো করে হাসতে থাকে। সঙ্গে হাসে হাবিব আহমেদ।
দুই.
আপনারা ওনাকে ভয় পাচ্ছেন কেন? প্রশ্ন করে অনন্য মামুন।
আপনি নতুন এসেছেন, ডিডি স্যার সম্পর্কে জানেন না। জানলে এমন করে বলতে পারতেন না, মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে জেসমিন আরা বেগম। ডিডি স্যারের বন্ধুরা সব সচিব, জয়েন্ট সেক্রেটারি।
অবাক মামুন পাল্টা প্রশ্ন করে, বুঝলাম ডিডি স্যারের বন্ধুরা খুব পাওয়ারফুল সেক্রেটারি। তার সঙ্গে আমাদের অফিসের কর্মকাণ্ডের কী সর্ম্পক? আমরা এখানে বিসিএস দিয়ে, সরকারি অফিসে যথাযথভাবে চাকরি করতে এসেছি এবং মনে রাখবেন, এই চাকরি কেউ দয়া করে দেয়নি। পেয়েছি যোগ্যতার ভিত্তিতে। অফিসের করণীয় করব, তাতে ডিডি স্যার মানে মুন্সি আহসান কবিরকে এত ভয় পাওয়ার কী আছে? কেন ভয় পাচ্ছেন?
সিক্রেট আলোচনা হচ্ছে জয়ন্ত রায়ের রুমে। জয়ন্ত অফিসের সহকারী পরিচালক। আরও যোগ দিয়েছে মান্নান সরকার, হামিদুল হক ও আবদুল বাতেন। হাবিব বৈঠকের খবর এখনও পায়নি।
দেখো মামুন, তুমি আমার ছোট ভাইয়ের মতো, তোমাকে খুলে বলা যায়। আমার একটা সংসার আছে। দুটো মেয়ে ঢাকার দুটো স্কুলে পড়ে। তোমার ভাই আর একটা অফিসে কাজ করেন। বাসা পাইকপাড়ায়। মোটামুটি একটা গোছানো সংসার। ভেবে দেখো- আমাকে যদি চিটাগাং বা খুলনা ট্রান্সফার করে, আমার সংসারটার কী হবে? অনেক ভেবে দেখেছি, জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লাগতে যাব না, থেতলে যাওয়া কণ্ঠস্বরে কথাগুলো বলে জেসমিন আরা বেগম।
মাইক নেয় মান্নান সরকার, আমার অবস্থাও অনেকটা জেসমিনের মতো। শুরু থেকে ঢাকার বাইরে এগারো বছর চাকরি করেছি। বছর তিনেক হলো ঢাকায় এসে সবে ছেলে-মেয়ে-বৌ নিয়ে সেটেল করেছি কোনোভাবে, এখন আবার ঢাকার বাইরে যেতে হলে আমি শেষ হয়ে যাব।
উনি তো এই অফিসের ডিরেক্টর নন, ডিডি মাত্র। আমাদের ওপর এই অত্যাচার করছেন, ক্ষমতার ভয় দেখাচ্ছেন, এসব তো আমরা ডিরেক্টরকে বলতে পারি, মামুন তাকায় সবার মুখের দিকে।
উত্তর দেয় আবদুল বাতেন, শোনো ছোটভাই আমরা যে সে চেষ্টা করিনি তা নয়। করেছি। আমরা কয়েকজন গিয়ে ডিরেক্টর আপাকে সব খুলে বলেছিলাম ছয় সাত মাস আগে।
ডিরেক্টর কী করলেন?
দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে আবদুল বাতেন, ভাইরে ডিরেক্টর করলেন যেই লাউ সেই কদুর অবস্থা।
মানে?
আমাদের বললেন, তিনি ব্যাপারটা দেখবেন। আমরা খুশিতে আটখানা হয়ে গেলাম। কিন্তু তার পরের দিনই দেখলাম গোটা ঘটনা উল্টে গেছে।
তীর্যক চোখে বাতেনের দিকে তাকিয়ে আছে মামুন। লোকগুলোতে ওর কাছে গিনিপিগ মনে হচ্ছে। সবাই মানুষ কিন্তু ভেতরে ভেতরে বহন করছে, হীনমন্যতার দাসত্ব। দুশো বছরের বৃটিশ গোলামি, চব্বিশ বছরের পাকিস্তানি গোলামি আমাদের সকল অস্থিমজ্জা আর মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙ্গে দিয়েছে। মামুন আরও ভাবে, আমার সামনে এই যে কোটস্যুটটাই আর শাড়ি পরিহিত মানুষগুলো বসে আছে, প্রত্যেকে মননে মেজাজে খুব নিন্মশ্রেণীর প্রাণী। যুদ্ধ করার আগেই হেরে বসে থাকে। হেরে যেতেই যত আনন্দ।
হাসে হামিদুল হক, মামুন বোধহয় ঘটনা বুঝতে পারনি?
না। মাথা নাড়ে ও। পরে কী ঘটলো?
পরের মিটিংয়ে কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের যাচ্ছেতাইভাবে ধমকালেন ডিডি স্যার। বললেন, আমাদের কোনো কাজই হয় না। আমরা কিচ্ছু জানি না। এমনকি যারা আমাদের চাকরি দিয়েছেন, ইন্টারভিউ নিয়েছেন, তাদের যোগ্যাতাও নিয়ে প্রশ্ন তুলে বললেন, আমরা নাকি ঘুষ দিয়ে চাকরিতে এসেছি, হামিদুলের গলা ধরে আসে। রুমের সবার চোখ মুখ বিষণ্ন। মনে হচ্ছে শোক নেমে এসেছে কক্ষে।
এসব বলল মুন্সি স্যার?
জেসমিন মাথা দোলায়, হ্যাঁ আমাদের সামনেই তার মোটা গলায় কর্কশ কণ্ঠেই বলল। মিটিংরুমে তখন ছিল পিওন আলী হোসেন।
জীবনে এত অপমানিত কখনো হয়নি, বেদনার সঙ্গে বলে আবদুল বাতেন। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির প্রতিটি জায়গায় আমি ভালো রেজাল্ট করেছি, কোথাও দ্বিতীয় হইনি।
উনি এইসব জঘন্য কথা বললেন, আপনারা চুপচাপ মেনে নিলেন? কান পেতে শুনলেন? কিচ্ছু বললেন না? উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে যায় মামুন।
কী করব ভাই, আমরা চাকরি করতে এসেছি। কারও সঙ্গে ক্ষমতার বাহাস করতে আসিনি, দাঁড়ায় মান্নান সরকার, আমার একটা জরুরি কাজ আছে, যাই। মান্নান সরকার জানে, জয়ন্ত রায়ের রুমের এই বৈঠকের খবর ঠিকই পৌঁছে যাবে ডিডি মুন্সি আহসান কবিরের কানে। কানে গেলেই ডিডি একজন একজন করে ডেকে পাঠাবে। জানতে চাইবে, তার সম্পর্কে কে কী বলেছে। মনে হচ্ছে অফিসে গোপন কোনো অ্যাসাইনমেন্ট চলছে। অন্যকানো সরকারি অফিসে এরকম ঠাণ্ডা লড়াই চলে কি না জানে না।
মান্নান ভাই?
দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়, বলুন।
যাচ্ছেন কেন? চা দিতে বলছি।
না আমি চা খাব না। যাই, দ্রুত চলে যায় মান্নান সরকার।
জয়ন্ত দা? মামুনের ডাকে তাকায় জয়ন্ত।
বলো।
ডিডি যে এভাবে গোটা অফিসটাকে নাচাচ্ছেন, ডিরেক্টর জানেন না?
জানবেন না কেন? জানেন।
তিনি অ্যাকশনে যাচ্ছেন না কেন?
মামুন, মুন্সি আহসান কবির আর ডিরেক্টর ফরিদা বেগম একই উপজেলার মানুষ। এটাই একমাত্র ঘটনা নয়, অফিসের প্রশাসন কে দেখে? ডিডি মুন্সি আহসান কবির। কেনাকাটা টেন্ডার কে দেখে? প্রশাসন। কেনা কাটার বখরা বাসায় বসে যদি পাওয়া যায়, কে বিরুদ্ধে যায়?
কলিগদের হাতে নাজেহাল হওয়ার আশঙ্কাও আছে। কারণ, ডিডির ক্ষমতায় ভর করে সেও অনেকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। পাত্তা দেয়নি অনেককে। তারা সুযোগ পেলে কি ছাড়বে?
ছোটবেলায় শুনেছিল মামুন, চিচিংফাঁক। আলীবাবা এবং চল্লিশ ডাকাত দাঁড়িয়ে এই শব্দ দুটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে আলীবাবা ও চল্লিশ ডাকাতের সামনে পাথরের দরজা খুলে যেত। ভেতরে প্রবেশ করলে পেত অগনিত মণিমুক্তা, হীরেজহরত। সে তো ছিল গল্প। মানুষের বানানো গল্প। প্রথম চাকরি করতে এসে ধীরে ধীরে চোখের সামনে বিকৃত এবং জঘন্য মনোবিকৃতির দরজা খুলে যেতে থাকে মামুনের । দেখতে পায়, মানুষের ভেতরে বাস করে কীট, কদর্য কীট। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে বাম চিন্তার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। জড়াতে জড়াতে গভীরে প্রবেশ করার দেখতে পায়, সবই মুখোশ আটা এক একটা কিংভূত জীব। জনতার সামনে বলে একটা কিন্তু আড়ালে করে ঠিক বিপরীতটা। যখন মেলাতে পারেনি, ফিরে এসেছে রাজনীতির চোরাগলি থেকে। এসেছে জীবন ও জীবিকার কারণে চাকরিতে, কিন্তু এ কোন জগত? জগতে কি শুদ্ধ মানুষ থাকবে না?
তিন.
মুন্সি আহমান কবিরের রুমে ঢোকে আবদুল বাতেন। একটা ফাইলে সই প্রয়োজন। পিওন দিয়ে না পাঠিয়ে অফিসাররা সরাসরি গেলে খুশি হয় মুন্সি। রুমে ঢুকেই দেখতে পায় মুন্সির টেবিলের সামনে দুজন লোক বসা। একজন বয়স্ক আর একজন তরুণ। মুন্সি আহসান কবিরের চোখে মুখে বিরক্তি। আবদুল বাতেনকে দেখে মুন্সি প্রসন্নতা এনে জিজ্ঞেস করে, কী খবর বাতেন?
স্যার, ফাইলে একটা সই লাগবে।
দিন, সই করে দিই। সাধারণত এত সহজে মুন্সি ফাইল সই করে না ডিরেক্টর বা মন্ত্রণালয়ের ফাইল ছাড়া। ফাইলের পাতা উল্টে দেখতে দেখতে তাকায় বাতেনের দিকে, দাঁড়িয়ে কেন বসুন।
অগত্যা বাতেনেকে বসতে হয়। ফাইলে সিগনেচার করে বাড়িয়ে দেয়, দেখুনতো কী ঝামেলায় পড়লাম? বাতেনের দিকে তাকিয়ে খানিকটা প্রশ্রয়, খানিটা ক্ষমতার দম্ভ, সঙ্গে ঈষৎ বিরক্তির সঙ্গে নিজেকে শুনিয়ে বলে, ওনি আবুল হোসেন সমাদ্দার আমার দেশি মানুষ। আসছেন আমার কাছে ছেলের চাকরির জন্য। বলেনতো আমি এই অফিসের সামান্য একজন ডেপুটি ডিরেক্টর। আমি কেমন করে চাকরি দেই? আমার কী সেই ক্ষমতা আছে? আমার কথা বিশ্বাস করেন না। আপনি একটু বলে দেন তো বাতেন।
আবুল হোসেন সমাদ্দার হাসে, আপনে কি যে কন? এতবড় অফিস আপনের, কত্তোবড় অফিসার আপনে। গত বছর গেরামে যাইয়া তো আপনে নিজের মুখে বলে আসলেন, আমার ছেলে ইরফান হোসেন বি এ পাস করলেই আপনের লগে দেহা করতে। সরকারের বড় বড় অফিসাররা আপনার বন্ধু। ঢাকায় আসলেই আপনে আমার ইরফান হোসেনের চাকরির ব্যবস্থা করবেন। সেই আশায় বুক বাইন্ধা এসেছি আপনার কাছে।
মানচিত্রটা বুঝতে পারে আবদুল বাতেন। নিশ্চয়ই লোকটা, দেশে গিয়ে নিজের অপরিসীম ঠাটবাট প্রচার করে এসেছে। গ্রামীণ কোনো আড্ডায় চা পান করতে করতে বলেছে মন্ত্রিসভার অমুক-অমুক মিনিস্টার তো আমার সঙ্গে প্রায়ই লাঞ্চ করেন। প্রধানমন্ত্রী ফোনে আমার কাছ থেকে অনেক পরামর্শ নেন। বলার সময়ে প্রাণ খুলে বলেছে আর আরামে পা নাড়িয়েছে। ওনার গল্প মনে রেখেছে গ্রামের মানুষ সমাদ্দার, ছেলে বি এ পাস করেছে, সঙ্গে নিয়ে একেবারে অফিসে হাজির। এখন সামলাও ঠ্যালা।
মাস খানেক আগে সকালের মিটিংয়ে বলা নেই কওয়া নেই মুন্সি হঠাৎ জিঞ্জেস করলেন, আপনারা ঢাকার বাজার থেকে কতবড় কৈ মাছ কিনেছেন?
কেউ কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবার বলে উঠলেন, গতকাল আমি কাওরানবাজরে গিয়েছিলাম। বাজার প্রায় শেষ। আমি একসঙ্গে পুরো মাসের বাজারই করি। গেলাম মাছের বাজারে। গিয়ে দেখি এক মাছঅলা এক কেজি ওজনের আটটা কৈ মাছ নিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখেই বলল, স্যার আপনার জন্য মাছগুলো নিয়ে বসে আছি। সকাল থেকে প্রায় পঞ্চাশ ষাটজনে কিনতে চেয়েছে, বিক্রি করি নাই আপনার লাইগা। দেন স্যার ব্যাগ দেন।
প্রতিদিন সকাল দশটায় অফিসের মিটিং হয় ডিডির রুমে। মিটিং শুরুর আগে দশ বারোজন অফিসারের মনে ভয় ও ত্রাস থাকে। না জানি মুন্সি আহসান করিব কার কোন খামাখা ত্রুটি ধরে গালাগাল করতে থাকে। মাঝেমধ্যে কেউ নির্দিষ্ট সময়ের পর মিটিংরুমে ঢুকলে, মুন্সি সেটা নিয়েও ইঙ্গিতে বাজে কথা বলে। তার রিভলবিং চেয়ারে বসে হেলেদুলে খুব রসিয়ে রসিয়ে বলে চলেছে কৈ মাছ কেনার গল্প নাতো, রাজ্য জয়ের গল্প। আবার শুনতেও হচ্ছে মনোযোগ দিয়ে।
আমি বললাম, ব্যাগ পরে আগে বলো কেজি কত?
এক হাজার দুইশো টাকা। বুঝলেন, অতবড় কৈ মাছ কেনার জন্য বড় বুকের পাটা লাগে। আমি বললাম বাজার শেষ। পকেটে টাকা নেই তেমন। বারোশো না, এক হাজার টাকায় দিলে দে।
আপনাকে দিয়ে দিল?
হা হা করে হাসলেন মুন্সি আহসান কবির, দেবে না মানে? আমি ছাড়া কে কিনবে অত দামি কৈ মাছ?
তাহলে স্যার, আপনি এক হাজার টাকায় এক কেজি ওজনের আটটি মাছ কিনলেন? জিঞ্জেস করে মামুন।
উদারভাবে দাঁত বের করে হাসলেন ডিডি, শুনলেন না আমি বললাম। মাছঅলা আমার জন্য বসে আছে মাছ নিয়ে। কী আর করা? কিনলাম।
স্যার?
ছবিটবি তোলেননি? আবারও প্রশ্ন করে মামুন। রুমের সবাই বুঝে গেছে মামুন খেলছে ডিডি মুন্সি আহসান কবিরকে নিয়ে। কিন্তু বুঝতে পারছে না মুন্সি।
অবাক মুন্সি, ছবি? কিসের ছবি?
কিসের আবার স্যার? মাছের ছবি। আপনার কেনা কৈ মাছের ছবি তুলে রাখা উচিত ছিল। ভেবে দেখুন, এক একটি কৈ মাছের ওজন এক কেজি। এমন কৈ মাছ এক সঙ্গে আপনার একটা ছবি তুলে রাখলে আমরা জাদুঘরে পাঠাতাম।
হতবম্ভ মুন্সি, জাদুঘরে কেন?
এটা ঐতিহাসিক স্মারক না স্যার? এক একটা কৈ মাছ এক কেজি ওজনের। মামুন তাকায় আমাদের দিকে, আপনারা দেখেছেন?
রুমের সবাই না বোধক মাথা নাড়ে জানায়, না এক কেজি ওজনের কৈ মাছ আমরা দেখিনি।
আবার হো হো হাসে মুন্সি আহাস কবির, আপনি খুব মজার মানুষ তো মামুন।
এই লোকের পক্ষে সবই বলা সম্ভব, মনে মনে বলে বাতেন। সঙ্গে ঢোলের বাড়িটা বাড়িয়ে দেয় বাতেন। তাকায় সমাদ্দারের দিকে, আপনারা সঠিক মানুষই ধরেছেন। আমাদের সৌভাগ্য, স্যারের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। উনিতো সেক্রেটারি, জয়েন সেক্রেটারির নিচে কথা বলেন না। স্যারের একটা ফোনেই আপনার ছেলের চাকরি হয়ে যেতে পারে।
আবুল হোসেন সমাদ্দার বিগলিত হয়ে যায়, সেটা জানি বলেই তো এসেছি মুন্সির সাবের কাছে। হাত ধরে মুন্সির, আমার পোলার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেন।
মুন্সি মুহূর্তে নিজেকে এক সম্রাটের আসনে দেখতে পায়। খুব বিনম্রভাবে বলে, এমন করে বললে আমি নিশ্চুপ থাকি কী করে? দেখি, কী করতে পারি। ফোন কাছে নিয়ে বাটন টিপে রিসিভার কানে নেয়, হ্যালো? আমজাদ হোসেন বলছেন? দোস্ত আমি মুন্সি আহসান কবির। ভালো আছি দোস্ত। ভাবি ব্চ্চারা কেমন আছে? ভালো? গুড। শোন দোস্ত, তোর কাছে যে কারণে ফোন করলাম, আমার গ্রাম থেকে এক মুরুব্বী এসেছেন। ভদ্রলোকের ছেলে ইরফার হোসেন বিএ পাস করেছে, একটা চাকরি দরকার। কী বললে? আগামী মাসে তোমার সঙ্গে দেখা করব? ওকে দোস্ত। থ্যাঙ্ক ইউ দোস্ত। রিসিভার নামিয়ে রেখে বিজয়ী সেনাপতির মতো তাকায় মুন্সি, চাকরি হয়ে গেল আপনার ছেলের। আমি কথা বললাম আমার দোস্ত কাম ক্লাসমেট আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে।
উনিতো স্যার এখন স্বাস্থ্যসচিব, তথ্যটা জানায় আবদুল বাতেন।
ঠিক বলেছেন। আগামী মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেশ কিছু লোক নেবে। সেই সময়ে ওকে মনে করিয়ে দিতে বলেছে। ব্যাস চাকরি হয়ে গেল!
স্যার আমি আসি? দাঁড়ায় বাতেন।
আসুন।
সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে আবদুল বাতেন। বেচারা আবুল হাসেন সমাদ্দার ও তার পুত্র ইরফান হোসেনের জন্য দুঃখ অনুভব করে। আহা সরল বাপবেটা একটা নির্দয় লোকের খোলামকুচির মধ্যে পড়ল।
চার.
অফিসের গাড়ির ড্রাইভার হুমায়ূনকে নিয়ে শাহবাগ আজিজ মার্কেটের অন্তরে রেস্টুরেন্টে বসেছে মামুন। হুমায়ূন মধ্যেবয়স্ক মানুষ। থলথলে শরীর। মুখে হালকা দাড়ি। চেহারা গম্ভীর। কিন্তু যখন কথা বলে দাঁতগুলো বেড়িয়ে পরে, হাসিটা দেখতে ভালো লাগে। মামুনের সামনে বসে আছে হুমায়ূন সংকোচের সঙ্গে। চাকরি জীবনের সতরো বছরে অফিসের কোনো বস হুমায়ূনকে সঙ্গে নিয়ে নাস্তা খায়নি। বয়সে ছোট হোক আর বড় হোক, বস মানেই বস। সারাজীবন গাড়ির ড্রাইভার।
হুমায়ূন ভাই, আপনি সহজ হয়ে বসুন।
হাসে হুমায়ূন।
শুনুন, অফিসের একজন মানুষ সম্পর্কে জানার জন্য আপনাকে এখানে এনেছি। আপনার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। ওয়েটার ভাজি লুচি দিয়ে যায়। নিন, শুরু করুন। খেতে খেতে কথা বলি।
বলেন।
আপনি আমাদের ডিডি স্যার মুন্সি আহসান কবিরের গাড়ি চালাচ্ছেন কত দিন?
হিসাব করে হুমায়ূন, ধরেন পেরায় চাইর বচ্চর ধইরা হের গাড়ি চালাইতেছি।
ডিডি স্যারের প্রাইভেট গাড়ি নেই? নাকি আছে?
নাহ।
যেখানেই মুন্সি স্যার যায় আপনিই তো তাকে নিয়ে যান?
জে স্যার।
আপনি কখনো তাকে নিয়ে কোনো মন্ত্রী, এমপি কিংবা সরকারের সচিব-টচিবদের বাসায় গেছেন?
ভ্রূ কুঁচকিয়ে ভাবে হুমায়ূন, মনে পড়ে না স্যার। তয় বছর তিন আগে একবার তেজগাঁওয়ের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অফিসে গেছিলাম স্যারের লইয়া। আমি গাড়িতে বইসা রইচি, স্যারে ভেতরে গেছে। আধ ঘণ্টা পর স্যারে ভিতর দিয়া আসলে, আমি গাড়ি ছারলাম। তহন আমারে কইছিলো, হুমায়ূন তোমার স্যাররে চিনলা না। এইহানে সহজে কেউ আইতে পারে না। আমার অফিসেরও কেউ আসত পারবে না। কিন্তু আমি যেকোনো সময়ে আসতে পারি। আমার হাত অনেক লম্বা।
লুচি আর ভাজি চিবাতে চিবাতে ভেতরে ভেতরে হাসতে থাকে অনন্য মামুন। আমার হাত অনেক লম্বা! কত লম্বা? অনন্য মনে করছে, সে সঠিক পথেই এগোচ্ছে।
আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?
লুচি আর ভাজি চিবিয়ে পানি খায় হুমায়ূন, করেন স্যার। বুঝে গেছে জটিল কোনো বিষয় না। মুন্সি স্যারের বিষয়আশয়ই মামুন স্যার জানতে চায়। বড় স্যারদের কাজকর্মই অন্যরকম।
ওনার বাসায় কখনো কোনো মন্ত্রী-এমপি-সচিব এসেছে, আপনি জানেন?
স্যার, আইলেতো আমি জানতাম। ডিডি স্যারের বৌ আমারে দিয়ে মাঝেমধ্যে বাসার বাজার করায়। ঘরের টুকটাক কতাও কয়। বাসায় ভালোমন্দ খাবার অইলে আমারে খাইতে দেয়। ডিডি স্যারের বাসায় এমন কেউ আহে নাই। আইলে আমি জানতাম স্যার।
ডিডি স্যারকে আপনার কেমন মানুষ মনে হয়?
মৌন হয়ে বসে থাকে হুমায়ূন। চোখে চোখ পড়তেই হুমায়ূন চোখ নামিয়ে নেয়। হাত ধরে অনন্য মামুন, হুমায়ূন ভাই, আপনাকে বিপদে ফেলার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। স্যারের মানসিক অবস্থা বোঝার জন্য জানতে চাইছি। অন্য কিছু নয়।
স্যার, মানুষটা বড় মিত্যা কতা কয়।
কী রকম?
ধরেন গাড়িতে উঠেই এক একদিন না কথা বলতে থাহে। বলতে থাকে, কাল অমুক মন্ত্রীর বাসায় গেছিলাম। কাল অমুক লোক বাসায় আইচছিল আট কেজি মিষ্টি নিয়ে। আবার কয়, এইবারের কোরবানিতে গ্রামের লোকরে দশটা গরু কিইন্না দিছি। অমুক লোক আসছিল বাসায় তোমার ভাবীর জন্য এগারো ভরি ওজনের হার লইয়া। কিন্তু আমি জানি, কিছুই করে নাই। হেরপর ফোনে নানা লোকরে আচানক রহম গল্প করে। বুঝি না, বড় বড় মানুষরা ক্যান এই নহম করে? আমি গাড়ির ড্রাইভার। অতোকিছু বঝি না।
ওয়েটার বিল নিয়ে এলে বিল দিয়ে বাইরে আসে মামুন আর হুমায়ূন। দাঁড়ায় মার্কেটের দক্ষিণ দিকে, রাস্তার পাশে খোলা জায়গায়। এখানে দাঁড়ালে ভালো লাগে মামুনের। সামনে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে অনেক সবুজ গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। গাছগুলোর কারণে এলাকাটায় একটা সবুজ সৌন্দর্য বেষ্টন করে রেখেছে চারপাশটা। গাছগুলোর হিমায়িত সবুজের দিকে তাকাতে তাকাতে একটা সিগারেট ধরায় মামুন। ধোয়া ছাঁড়তে ছাড়তে তাকায় হুমায়ূনের দিকে, একটা সিগারেট টানবেন?
মাথা নিচু করে হুমায়ূন হাসে, না স্যার আমি সিগারেট খাই না।
আপনার বাসা কোথায়?
মোহাম্মাদপুর।
আপনি চলে যান। আপনার সঙ্গে আমার যে কথা হলো, আপনি আর আমি ছাড়া কেউ কোনোদিন জানবে না, ঠিক? হাত বাড়ায় মামুন।
ঠিক। হাত বাড়ায় হুমায়ূন। দুজনে হ্যান্ডশেক করে দুদিকে চলে যায়।
পাঁচ
কী বললেন? আমার বিরুদ্ধে মহাপরিচালকের কাছে অভিযোগ জানাবে? হেলান দেওয়া থেকে সোজা হয়ে চেয়ারে বসে মুন্সি আহসান কবির।
জ্বী স্যার। নিচু গলায় কথা বলছে হাবিব। কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে একটা চোখ রাখছে দরজার দিকে। যেন কেউ ঢুকলে মুহুর্তে কথা ঘুরিয়ে নিতে পারে।
ঘটনাটা সত্যি?
জ্বী স্যার, সত্যি মানে মহাসত্যি।
চেয়ারে ঝিম মেরে বসে মুন্সি আহসান কবির। সত্যি যদি তার বিরুদ্ধে দশ বারোজন অফিসার এক সঙ্গে মহাপরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ করে, খবর হয়ে যাবে। পরিচালক কিছু করতে পারবে না। জানা আছে, পরিচালক ফরিদা বেগম কাজের সময়ে একেবারে পাল্টি খাবে। ভেতরে ভেতের ঘাবড়ে গেলেও মুখে বলে, ওরা আমাকে চেনে না? আমাকে জানে না? আমি এখনই আমাদের মন্ত্রীকে ফোন করছি। বলতে বলতে রিসিভার তুলে বাটন টিপে কানে লাগায়। হাবিব আহমেদ বুভুক্ষচোখে তাকিয়ে আছে রিসিভারের দিকে। মনে হচ্ছে, এই ফোনটার ওপর তার জীবনমরণ স্থির বিন্দুতে মিলে যাচ্ছে। চল্লিশ সেকেন্ড পর ওপাশে কেউ একজন ফোন রিভিস করলে মুন্সি জিজ্ঞেস করে, এটা কী মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রীর নাম্বার?
বিশ সেকেন্ড পর নামিয়ে রেখে বিমর্ষমুখে তাকায় হাবিবের দিকে, মন্ত্রী বিদেশে গেছে।
এখন কী হবে স্যার?
চিন্তা করেন কেন? আমার কি একজন মন্ত্রী বন্ধু? মন্ত্রিপরিষদের হাফডজন মন্ত্রী আমার ঘনিষ্ঠ। তুই তোকারির সম্পর্ক। একজন পাই নাই আর একজন পাব।
স্যার, এখনই আর একজন মন্ত্রীকে ফোন করে ব্যাপারটা ফয়সালা করে ফেলুন।
হাই তোলে মুন্সি আহসান করিব, এখন ভালো লাগছে না। বাসায় বসে রাতে খাতির জমিয়ে ফোনে কথা বলব। আপনার চিন্তা করার কিছু নাই। দেখেননা, কাল ওদের কিভাবে টাইট দিই! আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসে? ঝুঁকে কাছে আসে, আচ্ছা হাবিব, বলেনতো কে ওদের নাচাচ্ছে? সেই নতুন ছেলেটা? কী যেন নাম, অনন্য মামুন?
জ্বী স্যার।
ছেলেটা এত সাহস কোত্থেকে পায়?
শুধু ছেলেটা এক না স্যার, এখন সবাই আপনার বিরুদ্ধে একাট্টা। আপনি ঢাকায় প্রায় ষোলো সতেরো বছর ধরে আছেন। আপনাকে ঢাকার বাইরে পাঠাতে চায়। আর বিসিএস অফিসারদের মন্ত্রণালযের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সব সময়ে লিয়াজোঁ থাকে। ওরা একে অপরকে খুব হেল্প করে স্যার।
ওরা যত হেল্প করার করুক, মন্ত্রীর ওপর কে আছে? আমার মন্ত্রী আছে। একটা ফোনে ওরা আসমানে চলে যাবে, বুঝলেন।
স্যার, আমার কিন্তু ঘটনাটা ভালো মনে হচ্ছে না। কণ্ঠের স্বরে বোঝা যায় হাবিব আহমেদ ভয় পেয়েছে। অফিসের সবাই জানে, হাবিব ডিডি স্যারের খয়েরখা। মুন্সির নেক নজরে কারণে অফিসে প্রায়ই লেট করে আসে। যায়ও আগে আগে। কাজও করে কম। ডিডি মুন্সি এই অফিস থেকে চলে গেলে তার অবস্থাটা গ-ও-কারে গোল হয়ে যাবে। কলিগদের হাতে নাজেহাল হওয়ার আশঙ্কাও আছে। কারণ, ডিডির ক্ষমতায় ভর করে সেও অনেকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। পাত্তা দেয়নি অনেককে। তারা সুযোগ পেলে কি ছাড়বে?
মুন্সি দরজা খুলে বেরুতেই দেখে দরজার আশেপাশে বিরাট জটলা। একবার মাত্র তাকিয়ে মাথা নিচু করে দ্রুত চলে যায়। উপস্থিত লোকগুলো দেখতে থাকে একজন শূন্য মানুষের যাত্রা।
ভাবতে ভাবতে শরীর থেকে ঘাম ছাড়ে। বিষণ্ন মনে রুম থেকে বের হয়ে যায়। মুন্সিও জটিল ভাবনায় তলিয়ে যায়। পুরো মানচিত্রটা তার সামনে বিমূর্ত মনে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তাকে এইসব পুঁচকেদের হাতে হেরে যেতে হবে? না, রুমের মধ্যে পায়চারী করতে থাকে। নিজেকে নিজে শানায়, প্রবোধ দেয়, আমি হারব না। ওদেরকে মুঠোয় ভরতে হবে। একটা প্ল্যান কষে আপন মনে হাসতে থাকে মুন্সি আহসান করিব।
ছয়.
প্রাচীন বাংলা ইতিহাস নিয়ে লেখা একটি ইংরেজি বই অনুবাদ করতে দেয় মুন্সি আহসান কবির সব অফিসারকে। সবাইকে ভাগ করে দিয়েছে। সময় তিনদিন। প্রত্যেকের ভাগে পরেছে বিশ একুশ পৃষ্ঠা। ইংরেজিটা বেশ প্রাচীন। এখনকার ইংরেজির সঙ্গে মিল নেই। হাতে পেয়ে প্রত্যেকে বিমূঢ়। কারও পক্ষে অনুবাদ করা সম্ভব নয়। ঘটনায় গোটা অফিসে তোলপাড় । জেসমিন আরা বেগম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির এক অধ্যাপককে দশ হাজার টাকা দিয়েছে অনুবাদ করার জন্য। সবার ঘুম হারাম। কিন্তু নির্বিকার মামুন। ওর র্নিলিপ্ততায় বিমূঢ় সবাই। বাতেন, জয়ন্ত ধারণা করছে, মামুনের জন্য ওরা সবাই বিপদে পড়তে পারে। প্রত্যেকে রাতের ঘুম, দিনের আরাম হারাম করে নানা লোক ধরে সব পৃষ্ঠা না হলেও অর্ধেক পৃষ্ঠা অনুবাদ করে এনেছে। মহড়া দিয়েছে সবাই, বলবে ডিডিকে, স্যার খুব কঠিন ইংরেজি। অনুবাদ করা আরও কঠিন। আমাদের আর পাঁচসাত দিন সময় দিন। আমরা করে দেব। একমাত্র মামুনই বিকল্প ধারায় চলছে। হামিদুল হক হাত ধরে রিকোয়েস্ট করেছে, আপনারটুকু আমাদের দিন। আমরা অনুবাদ করিয়ে দিচ্ছি। হামিদের কথায় মামুন মৃদু হেসেছে মাত্র। মনে হচ্ছে উপহাস করছে ও।
সকাল দশটা। ডিডি মুন্সি আহসান কবির নিজের রিভলবিং চেয়ারে বসে তালে তালে দুলছেন। প্রস্তুতি নিচ্ছেন, অনুবাদের কারণে কাকে কিভাবে ধরবেন। মনে হচ্ছে তিনি সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার। উপাদেয় মাংসের জন্য ওঁৎ পেতে আছেন। যথারীতি অফিসিয়াল বৈঠক শেষে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমার অনুবাদ এনেছেন?
সবাই এক সঙ্গে কোরাস গায়, এনেছি স্যার। নির্বিকারভাবে বসে আছে মামুন। সবাই তাড়াহুড়ো করে মুন্সিকে অনুবাদ কপি দিয়ে প্রাচীনকালের পাইক পেয়াদাদের মতো জমিদারের সামনে হাতজোড় করে দাঁড়াতো, সেভাবে দাঁড়িয়েছে। তাকায় মুন্সি। তার অসম্ভব ভালো লাগছে এগারো জন অফিসারের এই বিনীত অনুকম্পা প্রার্থনার অনুপম দৃশ্য। আহা, ব্যাপারটা আগে মনে থাকলে, একটা মুভি ক্যামেরা এনে রাখত। মামুনকে বসে থাকতে দেখে ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করে, আপনার অনুবাদ কই?
আমি অনুবাদ করিনি।
কেন?
কাজটা করতে ভালো লাগেনি, তাই করিনি।
আই সি। আপনারতো অনেক সাহস। অফিস আদেশ অমান্য করার শাস্তি জানেন তো আপনি?
মৃদু হাসে মামুন, জ্বী জানি।
জানেন?
বললাম তো, জানি।
জানার পরও আপনি অফিসে আদেশ অমান্য করলেন কেন?
ওনাদের অনুবাদ দেখুন, বিচার বিশ্লেষণ করুন। আমি আমার বক্তব্য পরে দেব।
ঠিক আছে, বলতে বলতে মুন্সি ক্রুদ্ধভাবে অনুবাদের একটা প্যাকেট তোলে, দেখে দ্রুত পাতা উল্টিয়ে, এইটা কার?
জয়ন্ত রায় কম্পিত কণ্ঠে বলে স্যার, আমার।
কী হিজিবিজি অনুবাদ করছেন? একটা লাইন ঠিকমতো অনুবাদ করতে পারেন না, আপনাদের মতো ছাগলদের দিয়ে আমি অফিস চালাব কী করে? কী এগুলো? ছোড়ে জয়ন্তর দিকে, উড়ে এসে পায়ের কাছে পড়ে। দেখে জেসমিনেরটা। কলমের খোচায় কয়েকটা দাগ দেয়, চোখেমুখে আগুনের ফুলকি, কিচ্ছু হয়নি। আবার ছুড়ে মারে। উড়ে এসে পড়ার আগেই দাঁড়িয়ে ধরে মামুন। তাকায় কড়া চোখে। কেউ কিছু বোঝার আগে এগিয়ে যায় মুন্সির দিকে। মুন্সির সামনে এসে দাঁড়ায়, চোখে চোখ রাখে।
মামুন টেবিলের ওপর একটা হাত রেখে দাঁড়ায়, এটা কী আপনার ড্রয়িংরুম? আমরা কী আপনার গোলাপ বাগানের কেনা গোলাম? এখানের প্রত্যেকটা মানুষ সরকারের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা। কর্মকর্তাদের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটাও শেখেননি? এই যে আপনি প্রতিদিন আমাদের সঙ্গে ক্ষমতার বড়াই দেখান, এখন যদি আমরা আপনাকে সবাই মিলে এভাবে ধরি, বলতে বলতে কলার চেপে ধরে, মুন্সি দাঁড়িয়ে যায়, ভয়ে কোটর থেকে চোখ বের হয়ে আসতে চাইছে, মেরে আপনাকে তক্ত বানাই, আপনার প্যান্ট খুলে ন্যাংটো করে অফিস থেকে বের করে দেই, আপনার কোন সচিব বন্ধু এসে আপনাকে রক্ষা করবে? চিৎকার করে ওঠে মামুন, কেন কথায় কথায় মিথ্যা ক্ষমতার দম্ভ দেখান আমাদের? কেন?
মুন্সি ইঁদুর কলে আটকে যাওয়া ইঁদুরের মতো তোতলাতে থাকে, মামুন আমি দুঃখিত। বুঝতে পারছি আসলেই আমি খারাপ ব্যবহার করেছি তোমাদের সঙ্গে। আমি তোমার বাবার বয়সী। আমাকে ছেড়ে দাও, কথা দিচ্ছি আর কখনো করব না।
বাতেন এগিয়ে এসে হাত ধরে মামুনের, স্যারকে ছেড়ে দিন। স্যারতো ভুল বুঝতে পেরেছে।
ধাক্কা দেয় বাতেনকে, পড়ে যেতে যেত সামলে নেয় সে।
মামুন অবজ্ঞার সঙ্গে বলে, আপনাদের মতো মেরুদণ্ডহীন মানুষদের জন্য এসব অসুস্থ আর বিকারগ্রস্ত মানুষে সমাজটা ভরে গেছে। তাকায় মুন্সির দিকে, এই যে অনুবাদ দিয়েছেন, এটা অফিসের কোনো কাজ?
নাহ, আমার মেয়ের লাগবে।
আপনার মেয়ের লাগবে, আমাদের পাঁঠা পেয়েছেন। পাঁঠারা করে দেবে অনুবাদ?
মামুন, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি অফিস ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
বললেই হলো, অফিস ছেড়ে চলে যাচ্ছি! মামুন কলার ধরে টেবিল থেকে সামনে নিয়ে আসে। দাঁড় করায় সবার সামনে।
কাঁদতে শুরু করে দোদণ্ড প্রতাপশালী মুন্সি আহসান কবির, মামুন আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আমাকে মাফ করে দাও।
ঘটনার বজ্রপাতে রুমের বাকিরা পাথরের মতো স্থির। এত দ্রুত ঘটনাটা ঘটছে, কেউ কিছু বুঝতেই পারছে না। মনে হচ্ছ, সবাই মিলে দ্রুতলয়ের একটা সিনেমা দেখছে।
আপনার মতো মানুষকে একদম বিনা শাস্তিতে মাফ করলে অন্যায় হবে, মামুনের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চড় দেয় মুন্সির ডান গালে। মুন্সি হতবম্ভ। বিষণ্ন, বিপন্ন। গালে হাত দিয়ে ডলে, সবার দিকে অসহয় চোখে তাকায়, অন্যরা আঁতকে ওঠে। ভয়ে কাঁপছে। কিন্তু কল্পনার অতীত এই অতীন্দ্রীয় দৃশ্য দেখতে তাদের অসম্ভব ভালোও লাগছে।
মি. মুন্সি আহমান কবির, আপনি যদি আপনার ব্যবহার ভালো করতে পারেন, মিথ্যা ক্ষমতার দম্ভ ত্যাগ করতে পারেন, তাহলে অফিসে আসবেন। নইলে আর আসবেন না। নাউ ইউ গেট আউট, মামুন কলার ছেড়ে দেয়। দুমরানো মোচরানো মুন্সি দ্রুত সবার মাঝ দিয়ে দরজা খুলে বের হয়ে যায়, সবাই তাকায় মামুনের দিকে। মামুন স্বাভাবিকভাবে আগের জায়গায় বসেছে। মুন্সি দরজা খুলে বেরুতেই দেখে দরজার আশেপাশে বিরাট জটলা। একবার মাত্র তাকিয়ে মাথা নিচু করে দ্রুত চলে যায়। উপস্থিত লোকগুলো দেখতে থাকে একজন শূন্য মানুষের যাত্রা।