শ্বশুরের মূল বাড়িটিতে উঠোন ছোট হয়ে গেছে। জমি মাপামাপির ধার না ধেরে শরিকেরা ঘেঁষাঘেঁষি পাকা পাকা সব বাড়ি করে একটুতেই আবার গ্রাম্য খেয়োখিয়ে বাধিয়ে নেয়। শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর হওয়ার চেয়ে বাড়িটা কংক্রিটের করে জাতের পুরনো গৌরব ধরে রাখতে চায়। আর সেই পাঁকে ধারে-কাছে যারা আছে, সবাইকে নাকাল করে। তাদের অর্থহীন কূটচাল থেকে রেহাই পেতে মাথার ভেতর অন্য বুদ্ধি ঝিলিক মারে।
গ্রাম আমাকে প্রচণ্ড টানে। আমার কল্পনার বাড়িটি সবুজ কোনো গ্রামে—দুই পাশে বারান্দার মাঝারি একখানা চৌচালা টিনের ঘর। যার চালে বৃষ্টি পড়ে বুঁদ করে আনবে চৌকস চেতনা।
বারান্দা ছুঁয়ে থাকবে কিছু ফুলের ঝাড়। আঙিনায় কিছু হাঁস-মুরগির বিচরণ আর ছায়াদায়ী কিছু গাছ-গাছালি। একটু দূরে সবজির ক্ষেত ও মাচা। আরও থাকবে জলেভরা পুকুরে কচুরিতে ভাসমান ফুল। পারাপারের জন্য নয়, শহর থেকে আসা ছেলেমেয়েদের শুধু দোল খেতে ঘাটে বাঁধা থাকবে একখানা মাঝারি নৌকাও। প্রয়োজন মিটতে হবে নানান পদের মাছেরও।
তাই নতুন করে কাঠের ডুপ্লেক্স করেও, ভালো করে না বুঝে, কারও সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করে আবার দেড় কিলোমিটার দূরে শ্বশুরের আরেকটি জায়গায় আরেকটি বাড়ির আয়োজন করে ফেলি।
বাড়ি বলতে সেই টিনের ঘর। তা-ও করার আগে দেড় একর জমির প্রায় পুরোটাই সেধে উপকার করতে আসা কাছাকাছি বাড়ির একজনের দুরভিসন্ধির কবলে পড়ে, কেটে পুকুর নয় যেন খাল করা হয়েছে। কারণ মদদদাতা মনে করেছিল, এই মহিলা বাড়ি-গাড়ি আর রাজধানীর জৌলুস ফেলে কি আর গ্রামে থাকতে আসবেন! তার ওপর ছেলেমেয়ে বড় দুটি থাকে বিদেশে। অতএব, অবশেষে আমিই মৎস্য চাষ করে সুখে খাব! তাই দপদপানো উৎসাহের সঙ্গে ওরকম দুই/চার জনের আশকারা মিলিয়ে সেই খালপুকুরের পাড়ে ঘর যখন করবই, রতন মিস্ত্রি’র কথাই মনে পড়লো। ঢাকার খিলগাঁওয়ে প্রথম জীবনে যখন বাড়ি করি, তখন প্রথমে বাউন্ডারি ওয়াল করে নিতে অত টাকা ছিল না। তাই তিনকাঠা জায়গাজুড়ে টেংরাবেড়া দিয়েছিলাম। আর তাতেই পরিচয় হয়েছিল রতন মিস্ত্রি’র সঙ্গে। সেই থেকে যেখানে যত ঘর-বেড়ার কাজ, রতন মিস্ত্রিই করে।
রতন মিস্ত্রি তেচরা চোখে তাকায়। ঠোঁটের হাসিটি দুষ্টু। দুপুরের পর থেকেই তার কাজের গতি শ্লথ হতে থাকে। যেন একদিনের কাজ দু’দিনে গড়িয়ে দেওয়া যায়। তবু সে চেনা-পরিচয়ের গণ্ডিতে কাছাকাছি বলে পুরনো ক্ষোভ ভুলে বার বার তাকেই নতুন সব কাজে ডাকা হয়।
কিন্তু পুকুরপাড়ে যখন বাড়ি করতে রতন মিস্ত্রির কথা মনে পড়লো, মাঝখানে প্রায় একযুগ সময় পার হয়ে গেছে। এর ভেতর রতন মিস্ত্রি’র সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই। আমার ব্যক্তিগত সহকারী মমতাজ কাঠখড় পুড়িয়ে খবর পৌঁছানোর পর যখন রতন মিস্ত্রি †দখা করতে এলো, মুখে সমীহ কাড়া চাপদাড়ি। পরনে পা পর্যন্ত সাদা পাঞ্জাবি। কপালে সেজদার সুরমা রঙের গাঢ়ো দাগ। সেই গুজে গুজে হাঁটুর ওপর পরা লুঙ্গি, খালি গা চোখে বদ-দৃষ্টির ঝিলিক রতনকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না!
তবে চোখের চামড়া কিছুটা ঝুলে পড়ায় দৃষ্টি সোজা হয়ে এলেও হাসিটি তেমনি রয়ে গেছে। বক্র অথবা তীর্যক। গাল বেয়ে লাল কষ গড়ানোয় বোঝা যাচ্ছে, রতন কিছুক্ষণ পরপর বিড়ি খাওয়া ছেড়ে এখন পানে আসক্ত হয়েছে।
পুকুরবাড়িতে রতনের সহকারী হয়ে কাজ করবে আমাদের চেনাজানা আরেকজন—ছগির। সে আমার বাবার বাড়ির এলাকা গোপলগঞ্জের মানুষ। বর্তমানে ছগিরই ঢাকার বাসায়ও বড় ধরনের কাজকর্মের হোতা। কাজের লোকের দরকার পড়লে ডাকলেই আসে। সেসব কাজ একটানা হলে ড্রয়িংরুমে কাঁথা-কম্বল পেঁচিয়ে সেও একটানা বাড়ির মানুষের মতো থেকে যায়।
ঢাকা থেকে তুমুল আয়োজনে ফেনী গিয়ে পুকুরপাড়ে ঘরের কাজ করি। তার আগে শ্বশুরের মূল বাড়িতে পড়ে থাকা জরাজীর্ণ ঘরখানা সংরক্ষণ করতে জোড়াতালি দিয়ে আগে ওই পুকুরপাড়ে দাঁড় করাই।
তারপর ইট-কাঠ-টিন কিনে নতুন ঘর নর্মিাণ করতে প্রতিদিন পুরনো বাড়ি থেকে সকাল হলে নতুন আমেজে আসি। সন্ধ্যা হলে তরাসে চলে যাই। আর চব্বিশ ঘণ্টা পুকুরপাড়ে থেকে যায় ছগির আর রতন মিস্ত্রি। কারণ চারপাশে হই হই রই রই ডাকাত। আর গরিব প্রতিবেশীদের ইট-কাঠের প্রতি লোভে নিশপিশে বাড়ানো লম্বা হাত। ডাকাতের দৌরাত্ম্য থামাতে প্রশাসনও ব্যর্থ। কঠিন ঘরঘোরের ভেতরও দুরুদুরু ভয় নিয়েই কাজ আগাই। বয়স সত্তর পার হওয়া রতনের শক্তি দেখে আমি আর ছগির আশ্চর্য হই। সারাদিন তার পুত্রের বয়সী ছগির তাকে ইয়ার-দোস্তের মতো ঠাট্টা-টিটিকিরি করে মাতিয়ে রাখে। তামাশায় রতন মিস্ত্রিও কম যায় না। এবার মিস্ত্রি সেই ভোরে আজান দেওয়ার পর উঠে নামাজ পড়ে, আর একদণ্ডও বসে থাকে না। কারণ হাঁস-মুরগির খামারসহ, কল্পনা থেকে নামিয়ে আনা রাজহাঁসের জন্যও দৃষ্টিনন্দন একখানা ঘরের স্বপ্ন জাঁকানো আছে। পুকুরবাড়ির কাজটি বড়। মিস্ত্রিকে আবার বাড়িতে ধান কাটতে যেতে হবে। রতন মিস্ত্রির মেয়ে নেই। তিনটিই ছেলে। তিন জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। সেই বিয়েদারী তিন ছেলের কেউ নাকি বাড়ি আনাসহ ধানকাটার কাজটি ঠিকঠাক করতে পারবে না।
‘পারবো কোম্মেরতন, হ্যারা কি কোনোকালে দ্যাশে রইছে নাহি? হ¹লব্যালা মুই হ্যাগোরে তো ঢাহাই রাখছি! যেই ব্যালা মুই এই ছৈয়লি কামও শিহিনাই, হেইব্যালা আকবর মুন্সীর ক্যালার পোজা টানতাম। একেক পোজা ক্যালা ম্যারাইদ্দার আঁটের কাছে খালের নৌকারতন বাড়িত্ লইয়া গ্যালে একটাহা হরইরা দেতে মুন্সী। দুই পোলায় যা লইতে, মুই লইতাম তারতনও বেশি। হেইকামে পোষাইত্ পারিনাই বুইল্লাই তো ছৈয়লিকাম হিগলাম। মিস্ত্রিকাম তো হিগলাম হেদিনকো।
রতন মিস্ত্রি’র দাঁড়িকমাহীন জীবনকাহনের ভেতর অতীতের আরেকটি ঘটনা মনে ঝিলিক দিয়ে উঠলে বললাম, আচ্ছা রতন ভাই, তুমি যে আমার সাভারের বাদিতে ঘর করার সময়, প্রায়-ই দিন সন্ধ্যা হলে বলতে, এইখানে ধারেকাছে শালির বাড়ি আছে। রাইতে শালির বাড়ি থাকমু। তা তোমার সে শালির বয়স কত? এখন আছে কোথায়?
‘হ্যায় তহন সাভারে আপনের বাড়ির কাছে এক কুডুমবাড়ি বড়োইতে আইছলে কতেকদিন থাইক্কা আবার দ্যাশে চইল্লা গ্যাছলে—বলে রতন মিস্ত্রি শালি প্রসঙ্গে ওখানেই থেমে যায়। কিন্তু আমার মনে পড়ে যায়, রতন প্রায়ই দিন বোতলে একলিটার করে দুধ নিয়ে যেতো, পরদিন ফিরে এসে বলতো, দুধটা জব্বর বালা! বিজাইন্না পিডা বানাইছেলে। বেমালা মজা অইছেলে!
পাশ থেকে পাশের বাড়ির এক মহিলা কেয়ারটেকার, মোমেনা, যার সঙ্গে রতন মিস্ত্ররি বেশ ভালোই খাতির জমে গেছে। দুজনেরই একই জেলা। ভোলা। তো সেই ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের খাতিরের মোমেনা টিপ্পনী কেটে বলেছিল, দুধ অইলেগিয়া একসার। মানু অইবে কোমপোক্ষে হাতজন, তাইলে কত্তডি পিডার কাম! একসার দুধে তাও বোলে বেমালা মজা! আফা, আপনের মিস্ত্রি দেহেনগিয়া, শালির পীরিতে পড়ছে। আর দ্যাখছেননি, পেত্যেকদিন শালির গল্প হরতে এই বুইড়া বয়সেও কেমুন লাল অইয়া উঢে।
মোবাইল ফোন তখনো এতটা সুলভ হয়ে ওঠেনি। পাশের বাড়ির এক ছেলের নাম্বার দেওয়া আছে রতনের বউ ও ছেলেদের কাছে। তারা সবাই ঢাকা থাকে বলে জানি। তবে ফেনীর পুকুরবাড়ির পাশের বাড়ির বিশ একুশ বছরের ছেলে রুস্তম আলী মাঝে মাঝে দৌড়ে এসে রতনের হাতে ফোন ধরিয়ে দিতে দিতে বলে, কাকা, আন্নের ফুন! আন্নের দ্যাশতুন কইচ্ছে। কইছি দুই মিনিট হর আবার কল দিতো!
আরেকদিন এমনি ঘটনায় আমি গিয়ে সামনে পড়ায়, ফোন নিয়ে বাড়ি থেকে দূরে নেমে গিয়ে অনেকক্ষণ কথা বললো মিস্ত্রি। মোবাইল ফোনে এতক্ষণ কথা? ফিরে এলে বললাম, কী ব্যাপার রতন ভাই। এটা কি শালির ফোন ছিল নাকি যে এত দূরে গিয়ে কথা বলতে হবে? বেলা বাজে কটা? তোমার কাজ আজ একটুও আগায় নাই। না, তোমার পুরনো অভ্যাস গেলো না ফাঁকি দেওয়ার! খালি লেবাসটাই যা পাল্টেছো!
রতন মিষ্টিমুখে সকালের রোদের মতো গলগল করে ওঠে, মুই কতা কইতে ইট্টুহানি দূরে গেছি, তাই ওনার কাজ কুইম্মা গ্যাছে! আর মুই যে হেই ফজরের ওক্তো উইড্ডা ইদিক-উদিক গাড়ও ফিরাই না, হেইডা চোউহে দ্যাহে না!
আমি বলি, বউয়ের সাথে এই বয়সে এত দূরে যাওয়ার মতো কথা কারও থাকে না, রতন মিস্ত্রি!
আমার কথা শুনে ছগির বলে উঠলো, ও আপা, ওই যে আপনি শালির কথা কন, সেই শালি এহন উনার ছোট বউ!
আমি আশ্চর্য হলাম। বললাম, এতদিন আমার চোখে ধুলো দিয়েছ রতন মিস্ত্রি?
ক্ক্য, মুই দুলা দিমু ক্ক্য?
ওই যে এতদিন আমার কাছে যাকে শালি বলে চালিয়ে এসেছ, সে তোমার আরেকটা বউ? তোমার বড় বউ তোমার নামে মামলা করে নাই এই বিয়ের জন্য?
হ্যায়ই তো মোরে এই নিকাহ্ হরাইছে। মুই কি হরতে চাইছিলামনি? এ্যহ্, বিশটাহা স্যার চাউল খাওয়াইয়া বোলে আবারা দুইডা বিয়া হরে! ওরে মোর আল্লাহরে।
তুমি তো করলে?
অইছে কী তয় হোনেন, মোর হউরে মোর হাওড়িরে তালাক দেলে, পরে য্যার লগে আবার নিক্যা বইছে, হেই গরে হেই হউরের আগের দুই পোলাপান আছেলে, তাগো মায় মইরা গ্যালে মোর হাউড়িরে নিকা হরছে। মোর হাউরির সেই সতাই মাইয়া ইট্টুহানিকালে বিয়া অইয়া হ্যারও দুই পোলাপান অইতে না অইতে জামাই মরছে। আমার হউরির হেই সোয়ামির মেলা সুম্পত্তি। আমার হাউরির এই হতাই মাইয়াও বেশ কাত্তানি সুম্পত্তি পাইবে। আমার হাউরির আবারা হেই গরে কুনো পুলাপান অইনাই। শ্যাষে মোর পোলাগো মা কইলে, মায় মইরা গেলে তো এই বাড়িত্ আমাগো আওন-যাওন, নেওন-থোওন সব বন্দ অইয়া যাইব্যয়ানে। ছালেহারে তয় তুমি নিকা করো! পোলারাও তাগো মায়েরে কইলে, আব্বারে কও ছালেহা খালারে নিকা হরুক!
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। আমার মুখে কথা সরে না। কণ্ঠের ভেজাভাব শুকিয়ে কাঠ! সেভাবেই বললাম, তোমার বউ তোমারে নিজে আরেকটা বিয়া করতে বললো?
হয়। বুইনে বুইনে কি মিল! আপনেরা চিন্তাও তো হরতে পারবেন ন। এই যে দ্যাশতন ছালেহা যহন ডাকা আইবো, কত কিছু লইয়া আইবো! ভাতের চাউল, চিড়া, মুড়ি। গাছের লাউ, কুমড়া। আম- জাম, কাঁডল। কাঁডলের বিঁচি হুগাইয়া বালুর মইদ্দে কি যত্ন কইরা আনবো। ফল-ফলাদি। মোরা কিছু কিইন্না খাই নাহি? এই যে আহে, মোর তো খোঁজই থাহে না। বুইনে বুইনে এক বিছানায় থাহে। কত কতা তাগো! কতা আর ফুরায় না। আমার তহন খুঁজও থাহে না!
আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো, তাহলে আসে কেন, খালি ওই বালুতে ভরে কাঁঠালের বিঁচিগুলোই দিতে আসে?
পাকা গমের মতোন গৌরবর্ণ, এখনো পেটানো শরীরের রতন মিস্ত্রির রাঙামুখে হাসিটি মুখের সমস্ত ভাঁজ নিয়ে ঈষৎ রোদের মতো ঝিলিক দিলে, মিস্ত্রি তা সমঝে গুটিয়ে নিলো। নামিয়ে নিলো ঘোলাটে চোখ দুটিও।
পনেরই অগ্রাহয়ণে মিস্ত্রিকে তার দেশের বাড়িতে থাকতেই হবে। কিন্তু কাজ তো অনেক। সে কাজ অসমাপ্ত রেখে যে আমি তাকে যেতে দেব না, তা সে জানে। তাই ইদানীং তার হাতুড়ির বাড়ি আমার কাছে একটু দায়সারা গোছের মনে হতে থাকে। যেন ভাবনা-চিন্তাহীন বাড়ি। তাই তখন আমি তীক্ষ্ণ নজরদারিতে রাখি তাকে। এর ভেতর ছগির বলে উঠলো, আফা, মিস্ত্রির ছোট বউ আজ আবার ফোন করছিলো। মিস্ত্রিরে কইছে ইবার কানের সোনার জিনিস নিতে। আর মিস্ত্রি ওইযে ধান কাটতি দ্যাশে যাবে, সে ধান ওই শালি বউয়ের ক্ষ্যাতের।
আমি বললাম, তাই নাকি রতন ভাই, তুমি সোনার জিনিস কিনবে ছোট বউয়ের জন্য? রতন মিস্ত্রি করাত না তুলেই একের পর এক সিলিংয়ের তক্তা সাইজ করতে করতে উত্তর দিলো, হেইয়া অইবে না! সোনার জিনিস কেনতেয়ারুম না কারুর জন্যিই। বাজার-সদাই যদ্দূর লাগে, হেইয়া দিমু আর জমি-জিরাত কিনুম।
তোমার এই মিস্ত্রিগিরি করে, দুই পরিবারের প্রয়োজন মিটিয়ে আবার জমিও কিনতে পারো?
অ্য, পারি না তে! আমার বাপে আমার লাইগ্যা কিচ্ছু রাইখ্যা যায় নাই! যা-ও ইট্টু আছেলে মোর বড়বাই তা ফাঁহি দিয়া নিয়া নিছে। আমি তো আপনে গো এই জমির মতো এত্ খানি জমি এল্লাহ্ কিনছি। আমার গাছ গাছালি আপনের গাছ-গাছালিরতন বড়। ঘর দিলাম এক্খান, য্যান তিন পোলা, হ্যারা যদ্দিন আলাদা ঘর হরতে না পারে, য্যান একলগে থাকতে পারে।
তো, তোমার তিনছেলের জন্য বাড়ি করো, ছোট বউয়ের…।
তার বাপের বাড়িরটুকে তার অইয়া যাইবে! হ্যারপর আগের সোয়ামিরও কত্খানি পাইছে।
তোমার ছেলেমেয়ে হয়নি শালির পেটে।
না! লাইগেশোন করাইন্না আছেলে। হ্যার আগের গরের পুলাপান দুইডা। হ্যারাও খালুরে ছাড়া কিছু বোজে না। কুনো কাম শুরু হরতে গ্যালেই পুলাপান দুইডায় তাগো মায়রে কয়, খালু আহুক, খালুরে জিগাইয়া কইবা।
তাহলে তো জীবনে তোমার অনেক সুখ!
তা কইত্পারেন! ইবার বাড়িত্ পিয়া বিদ্যুতের লাইগা চিষ্টা হরুম। অরোক বাড়িরতন্ লাইন আইন্না দুইডা বল জ্বালই, তাই তাগো বাড়ির সব বিল আমার দেওন লাগে। অথচ্ তাগো বাড়ি ফিরিজও চলে। সারা রাইত বাতি নিবায় না।
সব মানুষের মনই তোমার মতন আলোপিয়াসী রতন মিস্ত্রি। পাশের বাড়ি আলো দেখলে নিজের বাড়ি যেকোনো মূল্যে আর আন্ধার সয় না।
মোর লাই না বাবী, মোর লাই না! বালো গরেরতন মাইয়া আনতে গ্যালে, বাড়িতে বিদ্যুৎ আছেনি, হ্যাও তারা দ্যাহে। মাশাল্লা পুলাগো বিয়া করাইছি যেন, কারুরতন কারু হউরের অবস্থা খারাপ না!
পড়ন্তবেলায় টুকটাক কাজ নিয়ে ছগির একটু দূরেই ছিল। সে মিস্ত্রির কথাবার্তার শেষ পর্যায়ে এসে বলল, এই যে রতন ভাই, তোমার শালিবউয়ের এত কিছু আছে কও, তবু তারে যহন বাজার কইরে দেও, তোমার ছাওয়ালরা, তোমার আসল বউ হিংসা হরে না?
ক্ক্যা? হিংসা হরবে ক্ক্যা? মুই মরলে মোর পোলারা হ্যার সুম্পত্তি পাইবো না? ম্যালাখানি সুম্পত্তি পাইবো!
তোমার দ্বিতীয় বউয়ের সুম্পত্তি তুমার ছাওয়ালরা কিবাবে পায়, আমারে বুজাও!
ছগির বললো।
ক্ক্যা, মুই হ্যার আটআনি সুম্পত্তি পামু না? মিস্ত্রি বললো।
ছগির এবার বলে, তুমি পাবা, ঠিকাছে। কিন্তু তোমার ছাওয়ালরা কিবাবে পায়?
মুই যেডুক পামু, হেইডুক মোর পোলারা তো পাইবোই, বড়বউ, ছোডবউ মিইল্লা আবার দুইআনি পাইবো! আর আগে যে মরবো, হ্যায় আর পাইবো না। যে বাঁইচ্চা থাকপো, হ্যায় এল্লাহ্ই দুইআনি পাইবো!
মানে, তোমার শালিবউ একলা বাঁইচে থাকলি, সে দুইআনা তুমার থেইকে, মানে তুমার সম্পত্তিরতে কাইটে রাখতে পারবে, আর তোমার শালিবউয়ের মোট সম্পত্তির ছয়আনা, শালিবউ বাঁইচে থাকতি তোমার তিন ছাওয়াল নিয়া আসফে?
হয়!
ছগির আর মিস্ত্রির এইসব কথার পর আমি আর কথা খুঁজে পাই না। ছড়িরে দৃষ্টি আমার মুখে বিদ্ধ। যেন আচমকা দমকা বাতাসে মাটিতে পড়ে যাওয়া লতানো গাছের মতো তার উঠতি বয়সের বদ্ধমূল বিশ্বাস মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গেছে। তাই আমি কী বলি, তা শোনার জন্য সে ব্যাকুল অপেক্ষা করে থাকে!
কিন্তু সে বেলা আমারও কথা সরে না। পরদিন দিনের শুরুতে কাজ শুরু হতেই খেইহারা ছগির খেই ফিরে পেয়ে আমাকে বলছে, আফা, ইবার বুজলেন, ক্যান রতন মস্ত্রিরি ছাওয়ালরা কইছোলো তাগে মায়েরে, যে আব্বারে কও, খালারে নিকা করতে? বুজচ্ছনে আফা, কেন বুইনে বুইনে এত্ত মিল? আমি তো আপা সারারাইত গুমাতি পারিনাই এই পোলিটিকসরি জট খুলতি খুলতি। কিন্তু আমার কাছে রতন মিস্ত্রির বউ আর শালিবউ কোনো জট নয়, বরং তাদের ঘোরহীন জীবন যাপনের গ্লানিকর কটুস্বাদ আমাকে চরমভাবে জারিত করতে থাকে। বার বার ঘর বানানোর নেশাটা আমার টুটে যেতে থাকে আগের দিন সন্ধ্যা থেকে। সূক্ষ্ম কৌশলে, প্রণয়ের মাধুরী দিয়ে বোনা পুরুষবাবুই পাখির বাসাটা উঁচু ডাল থেকে একবার খসে পড়ে গেলে তা যেমন তাদের দু’জনের কাছেই শুধু কুটোই, মানুষের সম্পর্কও তেমনি সৌন্দর্য হারালে কি সারবত্তাহীন নয়!
ঢাকাতে আমার ঠিক সামনের ফ্ল্যাটে নামকরা একটি কলেজের শিক্ষিকা থাকতেন। কলেজে শিক্ষিকা হিসেবে ঢোকার আগে তার বিয়ে হয়। এখন তার যে ছেলেটি বুয়েটের আর্কিটেকচারের ফাইনাল ইয়ারে, তার পাঁচ বছর বয়সে একদিন ভোরে শিক্ষিকা তাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরে কী দেখে তার সন্দেহ হয়েছিল, তার স্বামী আর তার বেড়াতে আসা ছোটবোনের সঙ্গে কিছু একটা ঘটিয়েছে। আর সেদিনই তিনি ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে ওই বাসায় আর ফেরেননি।
আর আমি এই রতন মিস্ত্রির শালি-বউয়ের সঙ্গে এই কলেজ শিক্ষিকার মিল-অমিলের ফিরিস্তি মেলাতে গিয়ে অথৈ সমুদ্রে ডুবতে থাকি।