থেকে থেকে ভেসে আসা চিৎকারে মাহুতটুলি গ্রামের দিন শুরু হয় আজ আকস্মিক কোলাহলে। নির্দিষ্ট গন্তব্যমুখী কতিপয় কেজো মানুষ অনির্দিষ্ট আবেগে পুনঃপুন জড়ো হয় কাঁচাপাকা চুলের এক মাঝবয়সী নারীকে ঘিরে। তার খড়িওঠা হাত, খড়িওঠা পা আর আকাশকাঁপানো মাতম—এই নাটকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টিতে যথেষ্ট ভূমিরা রেখেছে। জনতার মনোযোগ ও ক্রমবর্ধমান ভিড় বিক্ষিপ্ত হতে হতে একবিন্দুতে এসে কেন্দ্রীভূত হয়। ‘মরবো গো মাইয়াডা এইবার মরবো, পুলিশে ধরবো, দারোগায় নিবো। ওরে তোরা কেউ আইসা মাইয়াডারে একটু থামা! একটু বাঁচা ওরে।’
যে মেয়েটিকে বাঁচিয়ে তোলার আহ্বানে সকাল কম্পমান, মাহুতটুলি গ্রামের মানুষের মনোযোগ এবার সেদিকে। এসব হই-হট্টোগেলের মাঝেও একটা মেয়ে নিজের মনে মাটি খুঁড়ছে। একটা হাত, দুটো পা আর মাথা পাওয়া গেছে খুঁড়ে, কখন থেকে সে এই খোঁড়াখুঁড়িতে আছে কারও জানা নেই, পাশে দাঁড়িয়ে এ গাঁয়ের বুড়ো তবারক মাটি থেকে বেছে বেছে সরিয়ে রাখছে পিঠের হাড়, হাঁটু, হাতের আঙুল, আর খুলি। ডান অথবা বায়ের কবজি পর্যন্ত পাওয়া যায়নি এখনো! মেয়েটার কপাল কুচকে আছে, শরীরটা তো আস্ত থাকার কথা! গেলো কোথায় বাকি সব হাড়? মাতম করার ফাঁকে কামালের মা কয়েকবার চেষ্টা করেছে শানু নামের এই ক্ষ্যাপাটে মেয়েটাকে থামাতে, শানুর সঙ্গে সে খালা সম্পর্ক পাতিয়েছে, তাই চিৎকার করে লোক জড়ো করার বা শানুকে বাধা দেওয়ার অধিকার তার বেশি, কিন্তু কে শোনে কার কথা! সব কিছুতেই মেয়েটার বাড়াবাড়ি! লতিফ সর্দার শানুর কথা উঠলেই বলে, ‘ছাল নাই কুত্তার বাঘা ফাল! পিঁ০পড়ার পাখনা হইলো মইরবার তাল’!
একই ঘটনা গড়িয়ে গড়িয়ে দুপুর হয়। কোনো দিকে হুঁশ নেই শানুর! ভূতে পেয়েছে তাকে! সূর্য সাধ্যমতো তাপ ছড়িয়ে যাচ্ছে, শানুর চামড়া পুড়ে যায়। গা দরদর করে ঘামে। কেউ একজন তার মাথার ওপর একটা বড় মানকচুর পাতা ধরে, যদি মেয়েটার আরাম হয়! শানু থামে না, কাজ চালায় দ্রুত! একজন/দুজন করে এখন পুরো গ্রাম উপস্থিত! মাঝি পাড়ার আছিয়া কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘোরাফেরা করে শেষকালে সেও একটা শাবল নিয়ে হাত লাগায়। উপস্থিত জনতার কেউ কেউ আছিয়ার দেখাদেখি লেগে যায় মাটি খুঁড়তে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আানুপাতিক হারে বাড়ে কোদাল। এখন যে যার মতো কাটছে মাটি! কেন কাটছে সে হিসাব না মিলিয়ে তারা এটাকে উৎসব হিসাবই নেয়, তাদের উত্তেজনায় মনে হচ্ছে আজ তারা এই নির্দিষ্ট স্থানটা ছাড়িয়ে এ গ্রামের সমস্ত মাঠ-ঘাট জঙ্গল সাফ করে দেবে। ইতোমধ্যে লতিফ সর্দারের কানেও গেছে খবরটা, ঘুরে গেছেন বেশ কবার! অবস্থা বেগতিক দেখে বাধা তো দূরে থাক, কাছে ভেড়ার সাহসও করেননি। মাটিতে একদলা পানের পিক ফেলে শানুও তার প্রেমিকের গোপনাঙ্গবিষয়ক কিছু কুৎসিত গালি দিতে দিতে স্থান ছেড়েছে।
এ জায়গাটা একসময় হিন্দুদের শ্মশান ছিল, লোকে বলতো চিতাখোলা। এখন ঘন জঙ্গল আর আগাছার ঝোঁপ ভূতুড়ে বানিয়ে রেখেছে এর চারপাশ। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে সাপ-খোপের ভয়ে এদিকটায় কেউ আসে না এখন!
ছয় বছর আগে হঠাৎ করে এ জায়গাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বছরের প্রথম দিনের ঘটনা ছিল, নতুন বছর উপলক্ষে মাহুতটুলিতে গলিয়া উৎসব হয় প্রতিবার। দিনটা ছিল গলিয়ার দিন। মুন্সী বাড়ির ভিটা লেপার কাজে গিয়েছিল শানু, পথের মধ্যে খবর পায় দিনে দুপুরে আজরফ তার ঘরের সিঁদ কাটছে। শানু হাতের কাজ ফেলে দৌঁড়ে আসে বাসায়, গিয়ে দেখে ঘর হা করে খোলা, মাটির ব্যাংকের জমানো কয়টা টাকা ছিল, ভেবেছিল এভাবে একটু-একটু করে জমিয়ে একটা দোচালা টিনের ঘর তুলবে, আজরফ সেটা নিয়ে ভেগেছে! একটা বিষাক্ত রাগ শানুর ভেতরটা কামড়ে খায়। আজ আজরফের একদিন কি তার একদিন! আফসোস আজরফ সেই যে গেলো, ফিরে এলো অনেক রাতে। লাশ হয়ে। গ্রামবাসী ভালো করে কিছু বোঝার আগেই তাকে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল ঘন জঙ্গলের এই চিতাখোলায়।
আজরফের সঙ্গে এই নিয়ে শানুর চার-পাঁচ বার বিয়ে ঠিক হয়েছিল, প্রতিবারই বিয়ে ভেঙেছে শানু। আজরফ চোর, মাতাল! আজরফের ঘ্যানর ঘ্যানরে শেষতক আবার কথা পাকা হয় আশ্বিনের ষোলো তারিখ শুক্রবার। উপজেলা সমিতির তিন বছরের কিস্তি দেওয়ার পরও বাজারের শেষ মাথায় শানুর আর দোকান তোলা হয় না। মাহুতটুলির মানুষ এরপর থেকে সবসময় শানুকে এক কাপড়ে দেখেছে।
পরদিন নানা কিসিমের মানুষে ভরে যায় গ্রাম, ফিসফাস হয় কত! আজরফের লাশ কয়েকবার তোলা হয় আবার পুঁতে ফেলা হয়। কি হয় কেউ কিছু বোঝে না। লতিফ সরদার পানের পিক ফেলে সামলে ফেলেন সব! গাড়ি করে আসা থানা পুলিশ সাংবাদিক সবাই বলল আজরফ ভিড়ের কারণে দম আটকে মরেছে। আজরফের মৃগী রোগ ছিল! মন না মানলেও লতিফ সর্দারের ভয়ে গ্রামবাসী এ অন্যায়ের বুঝ মেনে যায়। মানে না শুধু শানু। ওই তো অবুঝ মেয়েটা এখনও একমনে মাটি খুঁড়ছে। পেছন থেকেও বোঝা যায় ওর শিঁরদাড়া শক্ত।
আজরফের মৃত্যুর রাত ছিল অদ্ভুত। শানু হ্যারিকেনের আবছা আলোয় নাটকের দৃশ্য দেখার মতো দেখেছে কিছু শক্তপোক্ত হাত অবিশ্বাস্য দ্রুততায় পুঁতে রাখছে আজরফের শরীর। চাক চাক জমাট বাঁধা কালো রক্ত লেগে ছিল আজরফের গলায়, হাতে, পায়ে আরও অনেক প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য অঙ্গে। কালসিটে হয়েছিল ত্বক। শানু নিজেকে বুঝিয়েছে, তার চোখের সামনে অভিনীত এ দৃশ্যপট বাস্তব নয়, দৃশ্যটা মুন্সীবাড়ির টিভিতে দেখা কোনো সিনেমার অংশ! রাত ফুরালেই শেষ হবে সব। দিনের আলোয় আবার তার শুরু হবে আজরফের সঙ্গে নিত্যনৈমিত্তিক বিষাক্ত প্রেম।
লতিফ সরদারের লোক আজরফকে আচ্ছা মতো পিটিয়েছিল। টুকরো টুকরো করে খুবলে খেতে চেয়েছে আজরফের শরীর। ছোটলোকের জাত মুখে মুখে তর্ক! শানু হাঁপ ছাড়ে। যাক, মাটিচাপা দেওয়ার সময় আজরফের শরীরটা আস্ত ছিল।
দারোগা, পুলিশ, উকিল মোক্তার—সবাই এ ছ’বছরে শানুকে কতভাবে আশ্বাস দিয়েছে বিচার হবে। আর বিচার! লতিফ সর্দারের ছেলে সেই যে সে রাতে হাওয়া হলো, এখন সে দুবাই আছে।
শানুর আর বিচার চেয়ে কাজ নেই। আজরফের পুরো শরীরের খাঁচাটা পেলেই হয়। দাগহীন, রক্তহীন একটা শরীর! হোক কঙ্কাল তবু শানুতো জানবে এটাই আজরফ। আহা শরীর! কোন শৈশবে একবার তার হাত কেটেছিল, খুব রক্ত পড়ছিল আঙুল বেয়ে, আজরফ দৌড়ে এসে একগাদা পাহাড়ি লতা লাগিয়ে দিয়ে বলেছিল, শোন মাইয়া তুই খুব বেখেয়ালি। খবরদার হাত-পা কাটবি না, শইল হইলো গিয়া খোদার নিয়ামত, যত্ন কইরা রাখবি, ধুয়া মুইচ্ছা রাখবি, কষ্ট দিবি না খবরদার, শইল ঠিক তো দুনিয়া ঠিক। শানুর যখন-তখন কেমন লাগে, যাক জীবন থেকে ছ’টা আশ্বিন চলে গেছে তাতে কী! এবার শানু আজরফের এই শরীরটার খুব যত্ন করবে, আর কখনো দুচ্ছাই দুচ্ছাই করবে না। একদম না।
খুব সামান্য ঘটনায় আজরফ খুন হয়েছিল। লতিফ সরদারের বড়ছেলে মিরনের সঙ্গে বিবাদ বেধেছিল, ধুন্দুমার তর্ক হয়, শেষপর্যন্ত হাতাহাতি! বিষয়টা তেমন কিছুই না সেবারকার গলিয়া উৎসবে বড়সড় মেলা হয়েছিল, জুয়ার কোট বসিয়েছিল চেয়ারম্যানের ছেলে। রাতভর বাংলা মদ আর সস্তা হিন্দি সিনেমার গানে আসর গরম! মূল আয়োজনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন চেয়ারম্যান লতিফ সর্দার নিজেই। বাহারি অনুষ্ঠানের বিরাট বিরাট পর্ব, যাত্রা, ভেরাইটিশো, আরও কত কী! আসর গরম করতে শহর থেকে কিছু মেয়ে-ছেলেও আনা হয়েছিল। শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে চৌকিদার আনসার তো ছিলই। সঙ্গে স্থানীয় কিছু লোকও রেখেছিল সরদার। সব তার নিজস্ব চেলা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মজমা জমে ওঠে, ঘনিয়ে আসে সেই দানবীয় হত্যাকাণ্ডের কাল।
আজরফ ছিল জুয়ার আখড়ায়! খেলায় সে আনাড়ি, কিন্তু হঠাৎ সেদিন প্রথমবারের মতো হিরনের কোটে আজরফের ভাগ্য ফিরে যায়! হাতের গোলাম বিবি টেক্বা জীবন্ত হয়ে ওঠে, কথা শোনে তার, পটাপট দান পড়ে। নগদ টাকায় ভরে যায় আজরফের পকেট! হিরন তখন উন্মাদ! তার ভাড়া করা পাকা জুয়াড়িদের পকেট ফাঁকা, এটা কেমন কথা! এত এত লোকজনের মাঝে আজরফ শুরু করে ভানুমতির খেল!
আজরফের হুঁশ ছিল না শরীরে টাকা ঝনঝন করে নাচে! টাকায় টাকা। ঘরে তার বুড়ো বাপ, দু পা অবশ, মরেও না। জমি বেচে খেতে খেতে এখন তাদের অবস্থা তলানিতে। কী আছে ওর জীবনে! টাকা নাই, পয়সা নাই, সুখ নাই, আনন্দ নাই। থাকার মধ্যে আছে এক শানু! তাও অর্ধেক বউ, মানুষের বাসায় ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে। গা ভর্তি ওর বারুদ। আজরফ বিড়বিড় করে, কেন যে মা সেই ছোট্টবেলায় শহরে বাপ মা হারিয়ে যাওয়া এই খান্ডারনিকে কুড়িয়ে এনেছিল বাড়িতে, কে জানে! আজরফের জীবনটা নষ্ট করে দিলো এই হারামজাদি, খালি গালমন্দ। ধরতে দেয় না, ছুঁতে দেয় না, পেটে ভাত জোটে না, তবু সতীপনা খুব। আজরফ গালি দিতে চায় কিন্তু মন এগোয় না। সে জানে শানু যতই দুর্মুখ মুখরা হোক না কেন, তবু এই মেয়েকে ছাড়া তার চলবে না। কতবার ভেবেছে হাতে একটু টাকা হলেই গঞ্জে রুকসারার কাছে যাবে, আয়েশ করে প্রেম করবে, নাচ দেখবে, হয় না ছাই, ওই হাড়হাভাতে মেয়েটার জন্যই কেমন লাগে! খান্ডারনির সাফ কথা কামাই করতে না পারলে কোনো বিয়ে শাদির ধান্দা নাই! বদমাশ মেয়েছেলে! আজরফ ঠোঁট চেটে টাকা গোনে, আহ টাকা, আহ শান্তি! শানু তাকে নষ্ট বলে বলুক! নষ্ট না হলে আজ কি তার হাতে এই চকচকে নোট কথা বলতো!
আজরফ ভেবে রাখে, কাল সকালে শানুর মুখের ওপর ছুড়ে দেবে কিছু টাকা, বলবে, নে মাগি টাকা নে, টাকা নিয়ে তোর তেজ কমা! সকাল সকাল মাত্র দুই শ টাকার জন্য তুই আমারে কম দাবড়ানি দেস নাই, তোর অই দুই চার টাকায় কী হয় রে মাগি, নে কত লাগবে নে।
আজরফ ভাবে, ভাগ্যিস তার মায়ের পাকিস্তান আমলের একজোড়া রূপার বালাও সঙ্গে এনেছিল। না হলে আজ এই জুয়ার কোটে বসার উপায় ছিল না।
এত কিছু ভেবেও একফাঁকে আজরফের মন ছোট হয়। রূপার বালা জোড়া মা শানুর জন্য রেখেছিলে। ওই হাড়-হাভাতে মেয়েটা কেমন করে যেন সবাইকে বশ করে রাখে! আজরফ টাকার গায়ে থুতু লাগায়, পয়সা গোনে। যাক সস্তায় হলেও বালা বেচে কিছু নগদ টাকা পেয়েছিল, মা তো আর বেঁচে নেই! কে আর দেখবে! শানুকে নতুন করে গড়িয়ে দিলেই হবে!
আজরফের আর বালা গড়ানোর সুযোগ হয়নি। গভীর রাতে লতিফ আর দুই সহযোগী চেলা আজরফের ক্ষত-বিক্ষত শরীরটা মাটি চাপা দিয়ে রেখে গেছে এই বধ্যভূমিতে। হিরন সে রাতেই পালিয়েছে! উত্তেজনায় ভুল করে ফেলেছিল! তার কী দোষ! ছোটলোকের ওপর রাগ হলে মানুষের কী হুঁশ থাকে!
ছয় বছর হলো! পুরো অর্ধযুগ। শানুর অস্থির লাগে, আরও জোরে হাত লাগায়, আজ আর সে থামবে না। সংসার তার হয়নি। বিয়ে হওয়ার আগেই বিধবা। আজরফ তাকে কোনো কিছুই দেয়নি, এমনকি খুব একটা প্রেমও ছিল না তাদের মাঝে, না থাক। তবু বুকের ভেতরটা কেমন খালি লাগে তার। চোর বদমাশ জুয়াড়ি হোক, মানুষটা তো তার নিজের ছিল! শানু পণ করেছে, আজরফের পুরো শরীর এক করবে, বয়স বাড়ছে, ভালো লাগে না কিছু। থাকুক, মানুষটা তার কাছেই থাকুক! শানুর বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস নামে, মনে পড়ে শানুর পিছু পিছু আজরফের ছোকছোকানি! খান্ডারনি, মাগি গালাগাল!
মাটিতে চকচকে অবয়ব, বুকের খাঁচাটা উঠে আসে কোদালের মাথায়। একটা হাত এখনো বাকি। শানু জানে, সেটাও পেয়ে যাবে, অনেকগুলো হাড় জড়ো হয়েছে সঙ্গে। শানুর ক্লান্তি ঘুচেছে অনেক আগেই। মাথার ওপরে সূর্য ঢেকে রেখেছে আধপাগলা বুড়ো; শানুর আর ভয় কী!
কোদাল চলছে চলুক।