ঘরের দুয়ারে শেকল টেনে পুকুর ঘাটায় জল আনতে গিয়েছিল আজিজারের বউ। খেজুর গাছের ঘাটলা শ্যাওলা জমে সবুজ হয়ে আছে। পা টিপে টিপে নামতে হয়। আঙুলগুলো কুচকে আঁকড়ে ধরতে হয় গাছটা। তা না হলে পা হড়কে সোজা পুকুরে। রোজিনা সতর্ক-পা ফেলে। পুকুরে পাড়ের কলমির ঝোপ। তার দুটো ডাল ধরে ঘাটে বসে। পানিতে দুলিয়ে দুলিয়ে ধুয়ে নেয় কলসির শরীর। গলাটা হাত দিয়ে ডলে ডলে পরিষ্কার করে। ভেতরে দু-একবার তুলে নেয় খানিক জল। ঝাঁকিয়ে ফেলে দেয়। কাত করে ডুবিয়ে পানি ভরে কলসিটা তুলে কাঁখে। তারপর আবারও সেই কলমির ঝোপ ধরে উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে ধাপ ভেঙে উঠে আসে ওপরে।
এইটুকু কাজ করতে যে সময়। ভরা কলসি নিয়ে উঠোনে পা ফেলতেই যেন বাজ পড়রো মাথায়। জং-ধরা টিনের চাল আর কড়ি বরগার ফাঁক দিয়ে লতার মতো বাইছে কালো ধোঁয়া। উঠোনে ঠা-ঠা রোদ। রোজিনা ‘আগুন আগুন’ বলে চিৎকার করে দুটো ধাপ একসঙ্গে লাফিয়ে ওঠে দাওয়ায়। দুয়ারের শেকলটা ঝুলছে তখনো। ধোঁয়ায় ভেসে যাচ্ছে ঘর। অন্ধকার হয়ে পড়েছে চারপাশ। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। রোজিনা ভালো করে তাকিয়ে দেখে, আলনার কাপড়গুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে। কোমরের কলসিটা পুরো ঢেলে দিলো আগুনে। না, তাতেও নেভে না।
‘ওই কে কুন্টি গেলুরে, হামার সব তো পুড়্যা ছাঁই হয়া গ্যালো। সগলি কুন্টি গেলারে।’ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে রান্না ঘরের ভরা কলসিটাও এনে ঢেলে দেয় আগুনে।
এবার আগুন নিস্তেজ হয়ে এলেও ধোঁয়া কমেনি। এদিকে যা হওয়ার হয়ে গেছে। রোজিনার ঘটিহাতা দুটো ব্লাউজ, কমলা ও খয়েরি পেটিকোট, দুটো ডুরে শাড়ি, বাটিকের ওড়না, আজিজারের বেপারি ফতুয়া, চিকন সুতার লুঙ্গি, নতুন পাঁচহাতি গামছাটা পুড়ে ছাই। রোজিনা পোড়া কাপড়গুলোর চাপা আগুন যতটা সম্ভব হাতের তেলোয় চাপ দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করে। একটা একটা করে মেঝেতে টেনে ফেলতে ফেলতে দেখে কাপড়ের ভাঁজে থাকা লাল রঙের ব্রেসিয়ারের একটা ফিতে গুটিয়ে গেছে পুড়ে। কাঁদতে কাঁদতে পোড়া কাপড়ের স্তূপ থেকে ব্রেসিয়ারটা তুলে চোখের সামনে তুলে ধরে রোজিনা। এই লাল ব্রেসিয়ারটা এলো কোথা থেকে? তার তো কোনো নতুন ব্রেসিয়ার নেই। তাহলে কি তার স্বামীই এনেছে? তাকে বলতে ভুলে গেছে?
বাইরে থেকে কেউ একজন দৌড়ে আসছে ঘরের দিকে। পায়ের আওয়াজ পেয়ে জিনিসটা কোমরে কাপড়ের নিচে লুকিয়ে ফেলে সে। যেন কোনো গুপ্তধন লুটের ভয়।
ফজিলা ঢুকলো ঘরে। প্রতিবেশী। ‘ও ফজিলারে হামার একন কী হবিরে! কেংকা করে আগুন লাগলোরে, ও বুরে,’ কাঁদতে কাঁদতে ফজিলার বুকের ওপরে মাথা রাখে রোজিনা।
মেঝেতে ফেলা কাপড়গুলো থেকে তখনো হালকা হালকা ধোঁয়া উঠে আসছে লকলকে লাউ লতার মতো। ‘কেংকা কর্যা আগুন লাগলো? বুঝলু কিছু?’ ফজিলা প্রশ্ন করে রোজিনাকে।
রোজিনা ফজিলার বুক থেকে মাথা তুলে আঁচলের খোটে নাক মুছতে মুছতে ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ে। ‘পুকুরেত গেনু পানি অ্যানবার। অ্যাস্যা দেকি বুনুরে আগুনেত পুড়্যা সব ছাঁই হয়া গেচ্ছে। আর অল্পেনা যুদি দেরি করনুনি, সব শ্যাষ হয়া গ্যালোনি, সব শ্যাষ হয়ে গ্যালোনি।’
মুহূর্তের মধ্যে কী করে এমন আগুন লাগলো, রোজিনা কিছুই বুঝতে পারলো না। ঘরদোর পরিপাটি করে পুকুরে জল আনতে গেলো। এইটুকু সময়ের মধ্যে কে আগুন দিলো ঘরে? কার কী ক্ষতি করেছে সে, যে তার ঘরে আগুন দেবে? তার স্বামীও তো কোনো কিছুর সাতেপাঁচে নেই। বেপারি মানুষ। দূরদুরান্তের হাট থেকে গরু-ছাগল কিনে এনে গ্রামের হাটে বেচে। দূরের হাটে দাম কম। কম দামে না কিনলে বেচে পরতা হয় না। কখনো আবার হাটে গরু-ছাগলের ভালো আমদানি হলে কম দামেও বেচতে হয়। লাভ-লোকসান নিয়েই তো ব্যবসা। এই ব্যবসা করতে গিয়েও সবার সঙ্গে যথাসম্ভব সদ্ভাব রেখে চলে। কারও সঙ্গে এমন কিছু হয়নি যে আগুন দেবে ঘরে।
উঠোনে, দাওয়ায়, ঘরে তখন প্রতিবেশীদের ভিড়। আগুনে পোড়া কাপড়ের ছাইগুলো ফেলা হয়েছে সব উঠোনে। আলনা সরিয়ে চলছে আগুনের উৎসের সন্ধান। আলনাটা পশ্চিমের টিনের বেড়ার সঙ্গে লাগানো ছিল। আগুনের তাপে টিনের গায়ে লাগানো আম কাঠের বাতাগুলো কিছু কিছু পুড়ে গেছে। টিনের রঙটা হয়ে গেছে লালচে। লাইট, ফ্যানের সুইচ বোর্ডটা লাগানো পুবের বেড়ার কাঠের বাতার সঙ্গে। বিদ্যুৎ থেকে কাণ্ড ঘটলে আগুন লাগার কথা ছিল পুব পাশে। অথচ আগুন লেগেছে পশ্চিমে। আকাশি কাঠের খাট, কাঁঠাল কাঠের মিটসেফ, টেবিল, ইস্টিলের আলমিরা, সবই অক্ষত। পুড়লো কেবল মেহগনি কাঠের আলনাটা? বাপের বাড়ি থেকে গাছ এনে কাঠ চেরাই করে আলনাটা বানিয়ে ছিল রোজিনা। বড় সখের ছিল। আর সেটাই কয়লা হলো আগুনে। কিন্তু আগুন কী করে লাগলো, তার কোনো হদিস করতে পারলো না কেউ।
বিকেলে হাট থেকে আজিজার বাড়ি ফিরলো। সব দেখে-শুনে সেও লেগে পড়লো উৎসের সন্ধানে। কিন্তু আগুনের কোনো ছুঁতোনাতাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। রাতে স্বামীকে লাল ব্রেসিয়ারটা দেখারো রোজিনা।
‘দেকোতো এড্যা কি তুমি লিয়া আচ্ছিলা?’
ব্রেসিয়ারটা নেড়েচেড়ে দেখে আজিজার হতভম্ব হলো। ‘না, হামি কুটি থ্যাকা লিয়া আসমু? কুন্টি পালু এই জিনিস?’
রোজিনাও অবাক গলায় বলরো, ‘কে লিয়াসলো তালে? আংলার কাপড়েত পানু। সব পুড়লো এই জিনিস কেমা জিংকাসিংকাই আছে!’
জিনিসটা ভালো করে পরখ করলো আজিজার। রক্তের মতো টকটকে লাল রঙ। আগুনে পুড়ে গেছে একটা ফিতে। বাকিটা পুরো অক্ষত!
০২
খড়ের গাদা সাজাচ্ছিলেন গফুরুদ্দিন ওরফে গফুর হাজি। আমন উঠেছে ঘরে। খড়গুলো সারাবছর গরু-মহিষের জন্য পালা দিয়ে রাখতে হয়। পাহাড় সমান উঁচু দুটো খড়ের গাদা গফুরুদ্দিনের বাড়ির দুয়ারে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সারা বছর। গরু-মহিষও আছে গোয়ালভরা। গোলায় ধান, পুকুরে মাছ, গাভির ওলানে দুধ, নেকমরদ গ্রামের গফুর হাজির ভরা গেরস্থ।
পুকুরের দুপারে দুদলের মুখোমুখি বাকযুদ্ধে আচমকা ঘুম ভাঙে শ্যামল মাস্টারের। টেবিল ছেড়ে বিছানায় যান। বাতি নিভিয়ে দিতেই শিয়াল কুকুরের যুদ্ধ আরও যেন ঘিরে ধরে তাকে
গাদার ওপর পাচু রাখাল। গফুরুদ্দিন নিচে থেকে খড়ের আঁটি ছুড়ে দিচ্ছে, তা থরে থরে গাদায় সাজিয়ে দিচ্ছে পাচু। সকাল থেকে গাদা সাজানোর কাজ করছে দুজন। দুপুরের সূর্য এখন মাথার ওপর। সূর্যটা এমন তেঁতে উঠেছে, শরীর যাচ্ছে পুড়ে। গলা শুকিয়ে আসছে বারবার। পাচু ওপর থেকে বলে উঠলো, ‘এনা জল খানুনি দাদা, নামমু?’
গফুর হাজিরও গলা শুকিয়ে কাঠ, ‘আয় নাম, হামারও জিও বাড়ায় গেচ্ছে।’ ওপর থেকে লাফিয়ে নামলো পাচু। গফুরুদ্দিন কোমরের গামছাটা কাঁধের ওপর ফেলে হাটতে লাগলেন বাড়ির দিকে। পাচুর খালি গায়ে জড়িয়ে আছে খড়কুটু। কুটকুট করছে গা। পাচু হাত চালায় বুকে পিঠে। হাতের নখগুলো কালো হয়ে গেছে ময়লা জমে। পঞ্চাশোর্ধ্ব হলেও গফুরুদ্দিনের গায়ের বান ভালো। পেটা শরীর। মাংস পেশীগুলো টনটনে, শক্তপোক্ত। কাছারি ঘরের দাওয়ায় উঠে ছায়ায় বসলেন তিনি। পাচু বসল তার পায়ের কাছে। কাছারি আর মূল বাড়ির মাঝে লম্বা উঠোন। কটকটে রোদ পড়েছে সিদ্ধ ধানে। চকচক করছে সোনারঙ। যেন আগুন ধরেছে উঠোনজুড়ে। সেই আগুনের তাপে পুড়ে যাচ্ছে চরাচর।
‘কই গেলা সগলি, হামাকেরেক এনা পানি টানি দেও না কর্যা। ওদোত পুড়ে কয়লা হয়্যা গেনু।’ গফুর হাজি হাক ছাড়লেন।
উঠোনের ওপাশের ঘর থেকে ঘোমটা টানতে টানতে তার ছেলের বউ বের হয়ে আসে, ‘বসেন আব্বা, মুড়ি-মুরকি আনিচ্ছি।’
‘দেও মা হাশরের মাঠের ওদ উঠিছে। কারবালা হয়্যা গেলো সব।’
গফরুদ্দিন একগাল মুড়ি নিয়ে চিবুতে লাগলো। যেই না সিলভারের টোল খাওয়া মগ তুলে পানি খেতে যাবে, অমনি বাড়ির দুয়ার দিয়ে চিৎকার করতে করতে উঠোনে ঢুকলো খয়বর মুন্সী।
‘কুন্টি গেলা হে গফুর। তোমার খ্যার তো সব ছাই হয়ে গেচ্ছে। ক্যারে গফুর।’ মুড়ির ডালাটা ধপাস করে দাওয়ার রেখে ছুটে বেরিয়ে গেলো পাচু। গফুরুদ্দিনও তার পিছু পিছু নামলো দাওয়া থেকে। সন্ত্রস্ত গলায় বললো ‘কুটি? কী হছে খয়বর, কী কচ্চু তুই?’
খয়বর মুন্সী হাপধরা গলায় বললো, ‘আগুন লাগিছে।’ তার কথা শেষ হওয়ার আগেই পাচু, ‘আগুন লাগিছে, আগুন।’ বলতে বলতে ঢুকলো বাড়িতে। উঠোনে উপুড় করে রাখা মটকা মাথায় তুলে ফের বেরিয়ে গেলো। সোজা গিয়ে নামলো পুকুরের ঘাটে।
কী করবে, বুঝে উঠতে না পেরে বাড়ির ভেতর-বাহির করতে লাগলো গফুরুদ্দিন। ততক্ষণে কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে আকাশ। বেরিয়ে এলো বাড়ির সবাই। ধোঁয়া-চিৎকারে আশেপাশের মানুষও জড়ো হলো। যে যেভাবে পারলো, লেগে গেলো আগুন নেভানোর কাজে। গাদার অর্ধেকটা পুড়ে ছাই হয়ে নিভলো আগুন।
কিন্তু আগুন কিভাবে লাগলো, তার কোনো কূল খুঁজে পাওয়া গেলো না। আগুনটা লেগেছিল ওপর দিকটায়। গাদার মাঝখানে। সেই আগুন বেয়ে বেয়ে নামছিল নিচে। গফুরুদ্দিন আর পাচু বাড়িতে গিয়েছিল কিছুক্ষণ আগেই। আর মুহূর্তে আগুন লাগলো গাদায়। কেউ কি তবে আগুন দিলো? কার এমন শত্রুতা? গরু-মোষের রুজিতে আগুন দেয়? এত কম সময়ে আগুন দিয়ে দিনে দুপুরে সটকে পরাও তো সহজ কাজ নয়। প্রতিবেশীরাও যে এমন কাজ করবে, তাদের কারও সঙ্গে তো রেষারেষি নেই গফুরুদ্দিনের। তাহলে কে করলো এই কাজ? আচ্ছা খয়বর মুন্সী যে ‘আগুন, আগুন’ হাক দিয়ে বাড়িতে ঢুকলো, সেই কি তবে…?
মনে মনে তওবা পড়ে গফুরুদ্দিন। সে কী ভাবছে এসব। খয়বর মুন্সীও হাজি মানুষ। দুজন একসঙ্গে গিয়েছিল কাবাঘরে। বাল্যকালের বন্ধু। জীবনে কখনো মন কষাকষি হয়, এমন কাজ তো দূরে থাক, কথাও হয়নি। বিপদে পড়লে মানুষ ঈমান হারায়, গফুরুদ্দিনের সেই দশা হলো কি না, কে জানে। সে আরও তিনবার ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ পড়লো।
এটা আবার দুষ্টু জিনের কাজ না তো? দুষ্টু জিনের এমন উৎপাতের অনেক ঘটনা তিনি মৌলবি সাহেবের কাছে শুনেছেন। মানুষের মধ্যে যেমন ভালোমন্দ আছে, জিন জাতির মধ্যেও তাই। এ খারাপ জিনের কাজও হতে পারে। তা না হলে এই ভরদুপুরে কে আসবে খড়ের পালায় আগুন দিতে? গফুর হাজি মনে মনে আগুন লাগার একটা কারণ খুঁজে পায়।
ওদিকে আগুনের উৎস অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে পাচু। গফুরুদ্দিনের ছেলে বিল্লালও এসে জুটেছে। খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোনো আলামত পায় কি না। এমন সময় গাদার ছাইয়ের ভেতর থেকে কিছু একটা টেনে বের করল পাচু। দেখতে লাগল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। বিল্লাল খেয়াল করলো বিষয়টা।
‘এ ছোড়া এটি আয়।’ বিল্লাল ডাক দেয়।
পাচুর হাত থেকে কেড়ে নিলো জিনিসটা। বলল, ‘কী পাছুরে তুই। ইংকা করে দেকিচ্ছু ক্যা!’
নিজেও ভালো করে দেখলো বিল্লাল। বললো, ‘লেরে লটির বেটা! এটি বেসিয়ার পালু কুটি থ্যাকা?’
পাচু বললো, ‘দেকছেন ভাই, খ্যার পুড়ে ছাই হলো কিন্তু জিনিসড্যার কেমা কিচ্চুই হলো না। কিন্তু এই জিনিস এটি আসলো কেংকা কর্যা?’
বিল্লাল আর পাচুর গবেষণা দেখে কৌতূহল হলো গফুরুদ্দিনের। এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। বললো, ‘এ কী পাছুরে তোরা, ইংকা কর্যা দেখিচ্ছু ক্যা?’
বিল্লাল বাবাকে দেখে লাল ব্রেসিয়ারটা শার্টের নিচে লুকিয়ে নিতে নিতে বললো, ‘কিচ্ছু লয়, কুটিকার ব্যান কোন তেনা পাছে তাই লিয়া—’
বিল্লাল অবাক হলো মনে মনে। আগুনে খড় পুড়ে ছাই হলো। কিন্তু বেসিয়ারটার কিছুই হলো না। আচ্ছা, এই বেসিয়ারটা আসলইবা কোথা থেকে? তার বউকে সে একটা কিনে দিয়েছিল, তাও তো বেশ আগে। সেটা গোলাপি ছিল। পরে পরে পুরনো হয়ে গেছে। আর তার বউয়ের ব্রেসিয়ার এখানে আসবে কোত্থেকে?
বিল্লাল শেফালিকে রাতে দেখালো ব্রেসিয়ারটা। শেফালি এক মুহূর্তে স্বামীর হাত থেকে জিনিসটা লুফে নিলো। বললো, ‘হাটত গ্যাছলেন নাকি? কুন্টি কলেন না তো?’
বিল্লাল বললো, ‘হাটত যামু ককন? জিনিসটা পানু ওই খ্যারের পালাত।’
‘ওটি এই জিনিস কে থুলো?’
‘হামিও তো তাই কচ্চি। আগুনে খ্যার পুড়ে জারে জার। আর একনার কেমা কিছুই হলো না?’
শেফালি মেঝেতে ফেলে দিলো ব্রেসিয়ারটা। হঠাৎ তার গা ঘিন ঘিন করে উঠলো। কার না কার জিনিস! সে এতক্ষণ কিভাবে নেড়েচেড়ে দেখলো!
০৩.
দুপুর রোদ মাথায় করে ছয় ক্রোশ পথ হেঁটে স্কুল ঘরে এসে উঠলেন শ্যামল মাস্টার। হাইস্কুল ভবনের দখিন দিকের একটা ছোট ঘরে তিনি থাকেন। ঘরটির অর্ধেকটা স্কুলের লাইব্রেরি। বাকি অর্ধেকে থাকেন তিনি। লম্বা করে একটা চকি ফেলা। তার মাথায় তিন পায়া এক টেবিল। ঠেস দিয়ে রাখা দেয়ালের সঙ্গে। একটা পা কম হলেও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। হাতলঅলা একটি নড়বড়ে চেয়ার। তার পাশে বইয়ের তাক। দেয়ালের সঙ্গে পেরেক ঠোকা। ঘরের একবারে শেষ দিকটায় বাঁশের মিটসেফ। একটা কোরোসিন স্টোভ। চালের ড্রাম। তার মধ্যে পোটলায় ভাজা গম। পাশে হামান দিস্তা। তাতে গম পিষে ছাতু করে খান শ্যামল মাস্টার।
মাস্টার সাহেবের বাড়ি দূরের গ্রাম মহিষখোচায়। সপ্তাহান্তে বা পক্ষকালে একবার বাড়ি যান। এই যেমন দুদিন আগে গিয়েছিলেন। আজ ফিরেছেন। আসা-যাওয়ায় ছয় ছয় বারো ক্রোশ পথ তিনি পাড়ি দেন হেঁটে। মাঝে একবার হিদেডাঙ্গা গ্রামের বটতলা বাজারে বটু মোল্লার দোকানে বসেন। একটা সিঙ্গারা, গুনে গুনে তিন গ্লাস টিউবয়েলের জল খান। সঙ্গে এক কাপ চা। শরীরটা একটু ধাতস্থ হয়ে এলে রওনা হন ফের।
বাড়িতে শ্যামল মাস্টারের স্ত্রী, কন্যা আর এক ছেলে। নেকমরদ গ্রামের হাইস্কুলে তার শিক্ষকতার এক যুগ হচ্ছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে এই বারোটা বছর একভাবেই আছেন শ্যামল দত্ত। একবেলা ভাত ফুটিয়ে দুবেলা খান। দুপুরে একবাটি গমের ছাতুই তার আহার। সঙ্গে আখের গুড়। প্রতিবার বাড়ি গেলে ভাজা গম, গুড় আর ভাতের চাল, খেসারির ডাল আনেন ব্যাগ ভরে। সেই খাবার তুলে রাখেন লোহার ড্রামটায়। আজও রাখলেন। ভালো করে মুখ বন্ধ করলেন। এই ঘরটায় ইঁদুরের বেশ উৎপাত। পাশের লাইব্রেরিতে ইঁদুরের আখড়া। বই কেটে এদের দাঁত টক হয়ে এলে এরা আসে শ্যামল মাস্টারের আখড়ায় হানা দিতে। রাতে বাতি নিভিয়ে দিলে ঘরের কড়ি-কাঠ বেয়ে দল বেঁধে আসে সৈন্যের মতো। যা পায় তাতেই দাঁত বসায়। দাঁতে কাঁচ কাটার মতো শব্দ করে। সামনে যা পায় কুটকুট কাটে। কয়েকটা বেয়ে এসে লাফিয়ে পড়ে শ্যামল মাস্টারের মশারির ওপর। চাল-গমের ড্রামটা ভালো করে আটকে তার ওপর আধা ইটের টুকরা বসিয়ে দেন মাস্টার। হাড়িগুলো ভালো করে মুখ আটকে তুলে রাখেন মিটসেফে।
হাটতে হাটতে ঘামে জামা কাপড় ভিজে চুপচুপা। কাপড় ছেড়ে শ্যামল মাস্টার সোজা গেলেন উত্তরে, স্কুলের পেছনের পুকুরটায়। স্নান সারলেন। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। সূর্য ডুবু। কোমর পানিতে নেমে সূর্য দেবতাকে প্রণাম করে উঠে এলেন।
আজ আর চুলো জ্বালাতে হবে না। বাড়ি থেকে গিন্নি খাবার সাজিয়ে দিয়েছেন। তাতেই চলে যাবে রাত। এই সময়টা পড়ার টেবিলে বসতে পারবেন। দীর্ঘদিন ধরে একটা কাজ হাতে নিয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তনের সরল বাংলা অনুবাদ। স্কুল, ছেলে পড়ানো, রান্নাবাড়া করে খুব একটা সময় বের করতে পারেন না। তবে চেষ্টা করেন প্রতিদিনই নিয়ম করে টেবিলে বসতে। কখনো কখনো ঘণ্টা খানেক কাজ করার পর ক্লান্তি জেঁকে বসে শরীরে। টেবিলেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। সূর্য ডোবার পর থেকে ঝিঝি পোকারা তারস্বরে হল্লা করে। মাঝ রাতে সেই ডাক আরও ঘন হলে পুকুরের ওপারে খলভিটার শিয়ালগুলো গর্ত থেকে বেরোয়।
মাঝে মাঝে এরা পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে হুয়া হুয়া হুয়া করে ডাকতে থাকে। স্কুল মাঠ দখলে থাকে তিনটা কুকুর। শিয়ালের ডাক শুনলেই সারবেঁধে গিয়ে দাঁড়ায় পুকুরের এপারে। শিয়ালগুলো ডেকে উঠলেই ভুক ভুক করে পাড়া মাতিয়ে রাখে। পুকুরের দুপারে দুদলের মুখোমুখি বাকযুদ্ধে আচমকা ঘুম ভাঙে শ্যামল মাস্টারের। টেবিল ছেড়ে বিছানায় যান। বাতি নিভিয়ে দিতেই শিয়াল কুকুরের যুদ্ধ আরও যেন ঘিরে ধরে তাকে।
ছয় ক্রোশ পথ হেঁটে শরীরটা আজ বড় ক্লান্ত শ্যামল দত্তের। স্নানের পর গিঁটে গিঁটে খিলগুলো যেন হড়কে গেছে। গা-হাত-পায়ে বল পাচ্ছেন না। ভেবেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ কীর্ত্তন অনুবাদ নিয়ে বসবেন। অথচ মন চাইছে শরীরে গা এলিয়ে দিতে। শ্যামল ভাবলেন, কিছু সময় ঘুমিয়ে নিয়ে উঠবেন মাঝরাতে। তখনই বসবেন টেবিলে।
স্বপ্নের মেয়ে, তার রক্তাক্ত শরীর, লাল কাঁচুলি, আগুন—সব কেমন গোলমেলে লাগছে তার কাছে। মাথাটা ঝিম ধরে এলো। চারপাশ কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। শ্যামল দত্ত কখন বিছানায় লুটিয়ে পড়লেন টের পেলেন না।
দুয়ার এঁটে বিছানায় গেলেন শ্যামল দত্ত। চোখজোড়া বন্ধ করতেই রাজ্যের ঘুম ভর করলো। গরম পড়েছে খুব। ঘরের দখিন দিকের জানালাটা খোলা রাখলেন। এদিকটায় স্কুলের মাঠ শেষ। তারপরই ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা। এইপথ গিয়ে মিলেছে বাজারে। যে কারণে রাত-বিরাতেও দু-চারজনের যাতায়াত থাকে।
রাতে তখনো খলভিটার শিয়ালগুলো গর্ত ছাড়েনি। কুকুরগুলোও মাঠের মাঝে গোল হয়ে শুয়েছিল। শ্যামল দত্ত গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছেন। ধূ ধূ প্রান্তরের মাঝে মস্ত এক হিজল গাছের ছায়ায় তিনি শুয়ে আছেন। কী স্নিগ্ধ ছায়া, ফিনফিনে বাতাস। তপ্ত শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে। জায়গাটা হিজল ফুলের সুগন্ধে মাতানো। স্বর্গীয় এক সমীরণ শ্যামল মাস্টারকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। মোমের মতো গলে যাচ্ছে তিনি। তার গভীর তন্দ্রা ভাঙলো এক রমণীর ডাকে। মেয়েটা মিহি গলায় বললো, ‘শুনছেন?’ শ্যামল দত্ত প্রথমে দুবার ডাকটা শুনে চুপ হয়ে রইলো। তৃতীয়বার ডাকটা আসতেই বললেন, ‘কে?’
‘বলছি এই গ্রামের নামটা কী বলবেন?’ মিহিগলা জানতে চাইলো।
‘নেকমরদ, কেন বলুন তো?’
‘আমি হারিয়ে গেছি। পথ খুঁজে পাচ্ছি না।’
‘কোথায় যাবেন?’ শ্যামল জানতে চাইলেন।
‘কোথায় যাবো, তাও তো জানি না।’ মেয়েটি বেদনার্ত গলায় জবাব দিলো।
‘এ কেমন কথা, কোথায় যাবেন, তাও জানেন না? তবে যে বললেন পথ হারিয়ে ফেলেছেন?’
মেয়েটি কাঁদো কাঁদো গলায় বললেঅ, ‘হ্যাঁ, পথ হারিয়ে ফেলেছি তাই তো বুঝতে পারছি না কোথায় যাবো।’
শ্যামল মাস্টার মনে মনে বিরক্ত হলেন। কী সুন্দর তন্দ্রায় চোখদুটি জুড়িয়ে এসেছিল। অহেতুক ভেঙে দিলো ঘুমটা। মেয়েটা পাগল-টাগল কি না কে জানে!
‘আমার খুব বিপদ জানেন, খুব বিপদ।’ মেয়েটি কাতর গলায় ফের বলে উঠলো।
কথা শুনে শ্যামল দত্তের কেমন মায়া হলো। বললেন, ‘কী বিপদ? কী হয়েছে আপনার?’
কিছু না বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো মেয়েটি।
‘আরে কাঁদছেন কেন? কী হয়েছে বলুন তো।’
মেয়েটির কান্না থামছে না। করুণ সুরে কাঁদছে।
শ্যামল মনে মনে ভাবলেন, আচ্ছা বিপদ তো। কিছু না বলে কেঁদেই যাচ্ছে। ‘আহা! কাঁদলে কি বিপদ কেটে যাবে? আগে বলুন, শুনি কী হয়েছে। তারপর দেখছি কী করা যায়।’
মেয়েটি কান্না থামিয়ে বললেঅ, ‘আমায় বাড়ি পৌঁছে দিতে পারবেন? আমি না বাড়ির পথ হারিয়ে ফেলেছি। এত করে মনে করার চেষ্টা করছি, পারছি না!’
‘আহা! অন্তত গ্রামের নামটি তো জানতে হবে। তারপর না হয় একটা ব্যবস্থা করা যাবে।’
মেয়েটি কান্না ধরা গলায় বললো, ‘আগে আমায় এখান থেকে অন্তত নিয়ে চলুন। এখানে আমার খুব ভয় করছে।’
শ্যামল হেসে বললেন, এখানে ভয়ের কী আছে? কী সুন্দর ছায়া। গা শীতল করা বাতাস। খানিকক্ষণ এখানটায় বসে দেখুন শরীর-মন দুটোই ভালো হয়ে যাবে।
মেয়েটি আতঙ্কিত গলায় বললো, না না এখানে আমি বসতে পারব না। ওইতো, ওইতো ওরা আসছে! দোহাই আপনার আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে চলুন। আমাকে পেলে ওরা…
মেয়েটি কথা শেষ করার আগেই শ্যামল দত্ত পাশ ফিরে উঠে বসলেন। এত সময় অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন।
মেয়েটির দিকে মুখ ফেরাতেই বিকট চিৎকার করে উঠলেন।
‘এ কী! আপনার চোখ দিয়ে এমন রক্ত ঝরছে কেন? ইশ্! গালে ওটা কিসের দাগ। মনে হচ্ছে কামড়ে মাংস তুলে নিয়েছে। উফ্, আমি আমি আর সহ্য করতে পারছি না। দয়া করে মুখটা ঘুরিয়ে রাখুন।’
শ্যামল দত্ত কাঁপাকাঁপা হাতে নিজেই চোখ ঢাকার চেষ্টা করলেন।
‘বললাম না আমি খুব বিপদে আছি। দেখুন আমার কী হাল করেছে!’ মেয়েটি কাতর বললো।
শ্যামল ভয়ে ভয়ে মুখ থেকে হাতটা কিঞ্চিৎ সরিয়ে ফের আঁতকে উঠলেন। ‘ইশ্ এ আমি কী দেখছি! আপনার বুকের মাংসটা এভাবে খুবলে নিলো কে?’
শ্যামল দেখলেন মেয়েটার বাম পাশের স্তনটা কেউ খামচে ছিঁড়ে নিয়েছে। এখনো সেখান থেকে তাজা রক্ত গড়াচ্ছে। সেই রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেছে মেয়েটার সাদা কাঁচুলি।
আরও খেয়াল করলেন, মেয়েটির কোমরের নিচ থেকে ছিঁড়ে ঝুলে আছে।
ঊরুসন্ধিতে জমাটবাঁধা রক্ত। তা থেকে দু-পায়ের ধার বেয়ে নেমে যাচ্ছে তরল ধারা।
শ্যামল কাঁপছেন। ঘামছেন অনবরত। বাতাস কেমন গুমোট বেঁধে আছে। গাছের ছায়াটা হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেলো। তপ্ত রোদের তাপে পুড়ে যাচ্ছে শরীর।
মানুষের হল্লায় হুড়মুড় করে বিছানার ওপর উঠে বসেন তিনি। দেখলেন ঘরের দখিন দিকটায় লকলকে আগুন ঘরের ছাদ ছুঁতে উদ্যত। দখিনের জানালাটা আড়াল হয়ে গেছে কুঁয়াশার মতো ধোঁয়ায়। কারা যেন দরজায় প্রবল আঘাত করছে।
‘ও মাস্টার মশাই। উঠুন, আগুন লেগে পুড়ে যাচ্ছে সব, ও মাস্টার মশাই!’
শ্যামল তড়িঘড়ি করে দুয়ার খুললেন। ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা আর কোনো কথা বললো না। শশব্যস্ত হয়ে পড়লো জল এনে আগুন নেভানোর কাজে। দেখে মনে হচ্ছে চালের ড্রামটার ভেতরে লেগেছে আগুন। নীলরঙের ড্রামটা পুড়ে ইস্পাত রঙ বেরিয়ে গেছে। ড্রামের সেই আগুন লেগেছে মিটসেফের পায়ায়। তা-ই আস্তে আস্তে ওপর দিকে বাইছিল সাপের মতো।
শ্যামল মাস্টার কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। তিনি তো আজ কেরোসিন স্টোভও জ্বালাননি। স্টোভটা দূরে খাটের নিচে ছিল। তেলের কাঁচের বোতলটাও তার পাশে অক্ষত। তাহলে আগুন লাগলো কিভাবে? পথের ধারে জানালা। খোলা ছিল। তাহলে কি কেউ দুষ্টুমি করে জ্বলন্ত সিগারেট ছুড়ে দিয়েছে ঘরে?
শ্যামল ভাবেন, কে করবে এই কাজ? তার সঙ্গে দুষ্টুমি করার মতো কেউ তো জানাশোনায় নেই। একযুগ এই এলাকার ছেলেমেয়েদের বাংলা পড়াচ্ছেন। তরুণরা তো বটেই ছেলেমেয়ের বাপেরা অনেকে তার ছাত্র।
আগুন নিভিয়ে সবাই যে যার মতো ফিরে গেছে। রাত ভোর হবে হবে ভাব। বাতি জ্বেলে একটু একটু করে সব নেড়েচেড়ে দেখছেন শ্যামল। চালের ড্রামটা পুড়ে ঢাকনাটা বেঁকে গেছে। তার ফাঁক গলিয়ে পোড়া চালগুলো উঁকি দিচ্ছে। ঢাকনাটা ধরতেই খুলে এলো। গমের কালো পলিথিনটা পুড়ে কুণ্ডুলি পাঁকিয়ে আছে। গমগুলো পুড়ে তেলাচোরার বিষ্ঠার মতো দেখাচ্ছে।
শ্যামল মাস্টার কুণ্ডুলিটা হাতে তুলে নিতেই দেখলেন, কিছু একটা চাপা পড়েছিল তার নিচে। ড্রামটা আলোয় টেনে লাল বস্তুটা হাতে তুলে নিলেন তিনি। লালের মাঝেই লাল ফুলের নকশা তোলা। এই জিনিস এখানে এলো কোথা থেকে? কে রাখলো এটা? শ্যামলের মনে হলো জিনিসটা তিনি কোথাও দেখেছেন এর আগে। চোখে লেগে আছে। মনে পড়ছে না। বাতির আলোয় ধরে টকটকে লাল কাঁচুলিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন। এই জিনিস তার এখানে কে আনলো? শ্যামল মাস্টার বিয়ে করেও ব্যাচলরের মতো থাকেন। তার ঘরে এমন জিনিস কিভাবে আসতে পারে?
হঠাৎ কী মনে করে জিনিসটা হাতে নিয়েই জানালার দিকে সন্দিহান চোখ রাখলেন তিনি। কেউ কোথাও ওতপেঁতে নেই তো? সতর্কভাবে জানালাটা লাগিয়ে দিলেন। মনে পড়লো, এমন একটা রক্তমাখা কাঁচুলি তিনি স্বপ্নে দেখা মেয়েটির বুকে ঝুলতে দেখেছেন। কী বিভৎস সেই দৃশ্য! মনে হতেই কাঁটা দিয়ে উঠলো শরীর। লোমগুলো ধানের বিছনের মতো খাড়া হয়ে উঠল। শ্যামল কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। ভাবতে ভাবতে বিছানায় গিয়ে বসলেন। তিনি ভেবে অবাক হলেন, আগুনে চাল-গম পুড়ে কয়লা হয়ে গেলো অথচ ছাঁইয়ের মধ্যে এই কাঁচুলিটা কিভাবে অক্ষত রয়ে গেলো! স্বপ্নের মেয়ে, তার রক্তাক্ত শরীর, লাল কাঁচুলি, আগুন—সব কেমন গোলমেলে লাগছে তার কাছে। মাথাটা ঝিম ধরে এলো। চারপাশ কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। শ্যামল দত্ত কখন বিছানায় লুটিয়ে পড়লেন টের পেলেন না।
০৪.
ঘুম ভাঙতে আজ একটু দেরি হলো শ্যামল মাস্টারের। ঘরে আগুন লাগার ওই রাতের পর থেকে তিনি কেমন নির্লিপ্ত হয়ে গেছেন। সবসময় কিছু একটা আচ্ছন্ন করে রাখে তার ভাবনটার জগতটাকে। ক্লাসে আগের মতো মন দিতে পারেন না। ক্লাস নিতে নিতে হঠাৎ কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে যান। হাটতে হাটতে সোজা চলে আসেন ঘরে। দুয়ার আটকে বিছানায় শুয়ে থাকেন। স্কুলের কেউ কেউ বিষয়টা খেয়াল করেছেন। হেডমাস্টার একবার শ্যামল দত্তকে ডেকে নিয়েছিলেন।
‘শ্যামল বাবুর কি ইদানীং শরীরটা ভালো যাচ্ছে না?’
‘কেন স্যার, কিছু হয়েছে?’
শ্যামল দত্তকে ভালো করে নিরীক্ষণ করে হেডমাস্টার রনজিত সেন বললেন, ‘না, কাল দেখলাম ক্লাস থেকে বেরিয়ে সোজা পুকুর পাড়ে চলে গেলেন। একধ্যানে অনেকক্ষণ বসে রইলেন। কিছু কি হয়েছে? মন খারাপ কোনো কারণে?’
শ্যামল নিজেও বুঝতে পারছেন না ইদানীং তার আচরণ কেমন অস্বাভাবিক ঠেকছে। এই তো সেদিন চুলোয় ভাতের হাড়ি বসিয়ে কী মনে করে বেরিয়ে গেলেন। বেমালুম ভুলেই গেলেন ভাতের কথা। স্কুলের দপ্তরি সেকেন্দার না বললে তো আগুন লেগে ফের ঘরটা পুড়তো। কেন যে দিন দিন তিনি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন, নিজেও বুঝতে পারছেন না। স্বপ্নে দেখা মেয়েটার ছবি সারাক্ষণই ভাসছে চোখে। চেষ্টা করেও মুছতে পারছেন না।
প্রতিদিনের অভ্যাসে ঘুমের আগে আজও ব্রেসিয়ারটা তোষকের নিচ থেকে বের করলেন। চোখের সামনে ধরতেই সেই মেয়েটা দেখা দিলো। ক্ষতবিক্ষত চেহারাতেও আজ তাকে একটু অন্যরকম লাগছে। প্রসন্ন আনন্দ খেলা করছে তার রক্তাক্ত চেহারায়।
শ্যামল মাস্টারের মুখে কোনো কথা নেই দেখে রনজিত সেন ফের বললেন, ‘আমার মনে হয় আপনি কদিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসুন। ভালো লাগবে। কদিন যে গরম পড়েছে। ভালো মানুষও কেমন অসুস্থ হয়ে পড়ছে।’
শ্যামল বাবু উঠতে উঠতে বললেন, ‘ভেবে দেখব স্যার। তবে আশা করি, তার দরকার হবে না।’
শ্যামল মাস্টার সুযোগ পেলেই চলে আসেন ঘরে। শুয়ে পড়েন বিছানায়। ওই রাতে পাওয়া কাঁচুলিটা তিনি তোষকের নিচে রেখেছেন। সময় পেলে সেটা বের করে কিছু একটা নিরীক্ষা করার চেষ্টা করেন। কাঁচুলিটা চোখের সামনে ধরলে রক্তাক্ত ওই মেয়েটি এসে হাজির হয়। শ্যামল আর আগের মতো ভয় পান না। বরং মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার প্রবল আগ্রহ বোধ করেন।
‘আচ্ছা তোমার এই অবস্থা কে করলো?’
‘তা জেনে আপনি কী করবেন? আপনি তো আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারলেন না।’ মেয়েটি অভিমানী কণ্ঠে জবাব দেয়।
‘আহা! বললেই কি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া যায়? এই পৃথিবীতে মানুষের বাড়ির কি আর অভাব আছে? প্রত্যেকেরই তো আলাদা আলাদা ঠিকানা। তুমি যদি নাই বলতে পারো তোমার বাড়ি কোথায়, তাহলে কিভাবে পৌঁছে দেই?’ শ্যাম মাস্টার অসহায়ের মতো জবাব দেন।
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘আপনি চাইলে আমার একটা ব্যবস্থা করতে পারেন। আমি আর একা একা পড়ে থাকতে পারছি না। খুব ভয় করছে। আপনার ঘরে আমায় ঠাঁই দেবেন?’
শ্যামল মাস্টার অপ্রস্তুত গলায় বললেন, ‘না না লোকে কী বলবে? এই অঞ্চলের মানুষ আমায় খুব সম্মান করে। একজন অচেনা-অজানা তরুণীকে আমার ঘরে কী করে আমি ঠাঁই দেবো। তুমিই বলো?’
কথাটি শুনে মেয়েটি অসহায় মুখে চলে যেতে উদ্যত হলো। শ্যামল বাবু পেছন থেকে ডাকলেন, ‘তুমি চলে যাচ্ছো? দোহাই তোমার মন খারাপ করো না। আমার সত্যিই কিছু করার নেই। তা না হলে…’।
কথা শেষ হওয়ার আগেই মেয়েটা কেমন বাতাসের সঙ্গে মিলিয়ে গেলো।
০৫.
এভাবে কেটে গেলো আরও কয়েকটা দিন। হঠাৎ এলাকায় চাউর হয়ে গেলো নেকমরদ গ্রামের উকিল মাতব্বরের ছেলে রঞ্জু পাগল হয়ে গেছে। টানা তিনদিনের জ্বরে নাকি তার এই মস্কিষ্কবিকৃতি। লজ্জার বিষয় হচ্ছে, ছেলেটা কাপড়-চোপড় খুলে মেয়েদের ব্রেসিয়ার বুকে পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা গ্রামে। হাটবাজারও মানছে না। বাজারের মাঝে বুড়ো অশত্থ গাছটার ডালে উলঙ্গ হয়ে চড়ে বসে লাল ব্রেসিয়ারটা পতাকার মতো দোলাতে থাকে। রঞ্জুরা চার ভাইবোন। বোন তিনজন। দুই বোনের পর রঞ্জুর জন্ম। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে, তার ওপর বাবার অঢেল সহায় সম্পদ। রঞ্জু আগে থেকেই বাউণ্ডুলে। পড়াশোনায় স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। কাজে-কর্মেও মন নেই। হৈ হৈ রৈ রৈ করে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া কোনো কাজ নেই। জগতের এমন কোনো কুকর্ম নেই, যার সঙ্গে রঞ্জুর সংযোগ হয়নি। কিন্তু তারপরও জলজ্যান্ত এমন যুবক ছেলের মস্তিষ্কবিকৃতিতে উকিল মাতব্বর শয্যাশায়ী হয়েছেন। তার স্ত্রী তো আরও আগে থেকে বিছানায় পড়া। বছর দুই আগে পক্ষঘাতে অচল হয়ে গিয়েছিল ডানপাশ। একমাত্র ছেলের এই কাণ্ড তিনিও শুনেছেন। এখন কেবল শুয়ে শুয়ে চোখের পানি ফেলেন সারাদিন। কথাও বলতে পারেন না।
দিন যত যাচ্ছে রঞ্জুর পাগলামি যেন আরও মাথায় চড়ছে। এখন সে গ্রামের মেয়েদের দেখলে দৌড়ে যায়। তাদের হেনস্তা করে। অসভ্যতার চূড়ান্ত যাকে বলে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে উঠোনে শুকোতে দেওয়া মেয়েদের ব্রেসিয়ারগুলো চুরি করে দৌড়ে পালায়। হাটখোলার কাপড়ের দোকানগুলোতে হানা দিয়ে লুট করে ব্রেসিয়ারগুলো। অল্প কদিনেই রঞ্জুর এই পাগলামির খবর নেকমরদ গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। গ্রামের মেয়েরা এখন বাইরে বেরোতে ভয় পায়। কোথা থেকে রঞ্জু পাগল এসে জামাকাপড় খুলে নিয়ে পালিয়ে যায়, এই ভয়ে তটস্থ মেয়েরা। এমন পাগল কি কেউ ছেড়ে রাখে? চাইলেও তো কেউ রঞ্জুর গায়ে হাত দিতে পারে না। এলাকার জোতদারের বংশধর উকিল মাতব্বরের ছেলের গায়ে কে হাত দেবে? তাই বলে দিনের পর দিন এমন পাগলামিও তো আর সহ্য করা যায় না। থানা-পুলিশেও খবর দেওয়া হয়েছিল। পাগল ধরে থানা হাজতে আটকে রাখার চেয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকায় পুলিশও দেখি-দেখছি করে সময় কাটাচ্ছে। একটা বিষয় সবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, এতকিছু রেখে রঞ্জু পাগলা মেয়েদের ব্রেসিয়ারে কী সুখ পেলো? গায়ে সুতোটিও নেই, বুকে একটা ব্রেসিয়ার ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্রামের এমাথা-ওমাথা। এও কি দেখার মতো?
রঞ্জু পাগলার কথা আজিজার বেপারি, রোজিনা, বিল্লাল, শেফালি আর শ্যামল মাস্টারের কানেও গেলো। রঞ্জুর ব্রেসিয়ার পরে ঘুরে বেড়ানোর খবরটা সবাই একভাবে দেখলেও তারা দেখলো ভিন্ন চোখে। কিন্তু কেউই এই ব্রেসিয়ার রহস্যের কূল-কিনারা করতে পারলো না।
শ্যামল মাস্টার রাতে শুয়ে শুয়ে রঞ্জুর কথা ভাবতে লাগলেন। রঞ্জু তার ছাত্র ছিল। হঠাৎ কাঁচুলি পরে ঘুরে বেড়ানোর মতো মস্তিষ্কবিকৃতির মাহাত্ম্য খুঁজতে লাগলেন। প্রতিদিনের অভ্যাসে ঘুমের আগে আজও ব্রেসিয়ারটা তোষকের নিচ থেকে বের করলেন। চোখের সামনে ধরতেই সেই মেয়েটা দেখা দিলো। ক্ষতবিক্ষত চেহারাতেও আজ তাকে একটু অন্যরকম লাগছে। প্রসন্ন আনন্দ খেলা করছে তার রক্তাক্ত চেহারায়।
শ্যামল বাবু মৃদু হাসির ভঙ্গিতে বললেন, ‘তোমাকে আজ অন্যরকম লাগছে যেন?’
শুনেই মেয়েটির চেহারায় ফের ভর করলো বিষাদের মেঘ। বললো, ‘আমার বাড়ির ঠিকানা পেলেন?’
শ্যামল বাবু ডানে-বাঁয়ে ঘাড় নাড়লেন।
মেয়েটি মলিন গলায় বললো, ‘তাহলে আমার আর বাড়ি ফেরা হচ্ছে না। আমি এখানে পড়ে পড়েই শেষ হয়ে যাবো?’
শ্যামল বাবু উৎসুক ভঙ্গিতে বললেন, ‘তুমি সেদিনও বলছিলে তোমার আর একা একা থাকতে ভালো লাগছে না। ভয় হচ্ছে বলছিলে। কোথায় থাকো তুমি?’
‘কেন, তা জেনে আর আপনার কী হবে? আপনি তো আর আমার জন্য কিছু করতে পারবেন না।’
‘আচ্ছা তোমার এই অবস্থা কে করলো, কিছুই তো বললে না। না বললে কিভাবে কী করব?’
মেয়েটি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে দখিনের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। শ্যামল মাস্টারও বিছানা থেকে উঠে ধীর পায়ে তার পিছু নিলেন। ‘বললে না কে তোমার এমনটা করেছে?’
মেয়েটি পেছন ফিরে তাকালো। বলরেঅ, ‘ব্রেসিয়ার বুকে ঝুলিয়ে যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাকে দেখেননি?’
‘দেখব না কেন, রঞ্জু।’
‘হ্যাঁ’
‘ওই কি তবে…।’ শ্যামল বাবু বিস্মিত হলেন।
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি থানায় যাচ্ছ না কেন? পুলিশকে বলছ না কেন? চলো তোমাকে থানায় নিয়ে যাচ্ছি।’
মেয়েটি শব্দ করে হেসে উঠলো। বললো, ‘আপনি আমাকে থানায় নিয়ে যাবেন?’
শ্যামল বাবু শশব্যস্ত গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। চলো এখনি থানায় চলো। পুলিশকে তুমি সব বলবে। কী করে রঞ্জু তোমার এমনটা করলো।’
মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিলো। শ্যামল দত্ত কম্পিত হাতে মেয়েটির হাত ধরে বিদ্যুৎস্পৃশ্যের মতো আবার ছেড়েও দিলেন।
‘আহ্, এত বরফ হয়ে আছে!’
তার নিচ থেকে পেলব উরু বেয়ে গড়াতে গড়াতে রক্তের দাগটা শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। আজিজার, রোজিনা, বিল্লাল, শেফালি আর শ্যামল মাস্টার খেয়াল করলেন, দেহটার বুকের বাম পাশে একটা রক্তমাখা ব্রেসিয়ার পড়ে আছে।
মেয়েটি মলিন মুখে বললো, ‘থাকবে না। সেই কবে থেকে একা একা পড়ে আছি। আচ্ছা চলুন হাত ধরতে হবে না। আমিই আপনার পিছু পিছু যাচ্ছি।’
শ্যামল দত্ত থানার দিকে রওনা হলেন। ঘর থেকে বেরোতেই উত্তরের পুকুরের ওপাশ থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে এলো কানে। পরক্ষণেই এপারের কুকুরগুলোও তার প্রতিবাদ করে উঠলো। রাত ভোরের দুয়ারে। শ্যামল দত্তের সেদিকে খেয়াল নেই। তিনি মেয়েটিকে নিয়ে থানার পথে হনহন করে চলতে লাগলেন। কিছুদূর গিয়ে বারবার পেছন ফিরে দেখছেন, মেয়েটি তার পিছু পিছু যাচ্ছে কি না। ‘এসো এসো, ভয় নেই। আমি আছি। আমি থাকতে তোমাকে কেউ কিছু বলবে না।’
০৬.
রাতে থানায় কয়েকজন কনস্টেটেবল, আর দুজন দারোগা ছাড়া কেউ নেই। শ্যামল বাবু থানায় দারোগা সাহেবের সামনের চেয়ারে বসলেন। পাশের চেয়ারটি টেনে অন্য কাউকে বসতে বললেন। ‘আহা, বসো বসো। লজ্জা পেলে হবে না। বলো দারোগা বাবুর কাছে সব খুলে বলো। কই বসো।’
দরোগা পরিতোষ পাল একবার শ্যামল বাবুর দিকে একবার তার পাশের খালি চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কাকে বসতে বলছেন মাস্টার বাবু? কেউ তো নেই পাশে।’
শ্যামল বাবু অবাক হয়ে তাকালেন। ‘কী বলছেন পাশে কেউ নেই?’ কাউকে আঙুলের ইশারায় দেখানোর ভান করে বললেন, ‘এই যে মেয়েটা। দেখছেন না কী হয়েছে ওর? ওর জন্যই তো এতরাতে থানায় এলাম।’
পরিতোষ বাবু এবার অবাক হলেন। বললেন, ‘মাস্টার বাবু কী বলছেন কিছুই তো বুঝতে পারছি না! আপনি কি কাউকে সঙ্গে করে এসেছেন?’
শ্যামল বাবু ঘন ঘন ওপরে-নিচে মাথা নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই তো ওকেই তো নিয়ে এলাম। দেখুন না মেয়েটার কী হাল করেছে ওই রঞ্জু।’ ফের পাশের চেয়ারটার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘কোথায়, বলো। আমাকে যা যা বলছিলে সব বলো। দেখো দারোগা বাবুরা তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।’
শ্যামল বাবুর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না পরিতোষ পাল। চেয়ার থেকে উঠে শ্যামল বাবুর পাশে এসে বসলেন। বললেন, ‘বলুন তো কী হয়েছে?’
শ্যামল বাবু একে একে পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন। মেয়েটির সঙ্গে তার আলাপের সবকিছুই। তারপর মেয়েটিকে খুঁজে নেওয়ার মতো করে বললেন, ‘আরে কোথায় গেলে তুমি? কোথায় গেলো মেয়েটা?’ বলতে বলতে তিনি থানার বাইরে এলেন। পরিতোষ বাবু বুঝতে পারছিলেন শ্যামল বাবু স্বাভাবিক নেই। ‘শুনুন মাস্টার বাবু, শুনুন কাকে খুঁজছেন?’ বলতে বলতে তার পেছন পেছন বেরিয়ে এলেন। ততক্ষণে ডালপালা ছড়াচ্ছে ভোরের আলো।
পরিতোষ বাবু দেখলেন থানার সদর ফটক দিয়ে একদল লোক হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকছেন। এত সকালে কী হলো? পরিতোষ বাবু এগিয়ে গেলেন।
‘নমস্কার দারোগা বাবু।’ দলের একজন বললো।
‘নমস্কার। কী ব্যাপার বলুন তো?’
মাঝবয়সী একজন হাঁপধরা গলায় বললো, ‘লাশ দারোগা বাবু। মেয়েমানুষের লাশ।’
‘কোথায় লাশ?’ পরিতোষ পাল জানতে চাইলেন।
‘ওই দে ইশকুলের পুকুরের ওপারে খলভিটাত। সকালে পোড়াদহ বিল থেকে মাছ ধর্যা ওই রাস্তা দিয়্যাই আসিচ্ছিনু। দেকি একটা গুন্দো ওটা মরা মানুষ লিয়্যা শিয়াল টানাটানি করিচ্চে। ওটি হামরা মানুষ র্যাখ্যা আচ্চি বাবু। তাড়াতাড়ি চলেন।’
সূর্য আলো ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই সারা গ্রামে খলভিটার লাশের খবর রটে গেলো। সারাগ্রামের মানুষ ভেঙে পড়লো খলভিটার চারপাশে। ভিটা বলতে ওখানে কয়েকটা মাটির ডিপি। তার ভেতর শেয়ালের গর্ত। লাশটা সেই ডিপির কাছেই পড়ে আছে। লতাপাতা দিয়ে শরীরটা কোনোমতে ঢেকে রাখা।
খবর পেয়ে আজিজার, রোজিনা, বিল্লাল, শেফালি সবাই এসেছে। শ্যামল মাস্টার এসেছেন দারোগা বাবুর সঙ্গেই। তিনি মাটির একটা ছোট্ট ডিবির ওপর বসে নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি যেখানে বসেছেন সেখান থেকে দেহটাকে খুব ভালো করেই নিরীক্ষা করা যাচ্ছে। মেয়েটার গালে কামড়ের গর্তটায় রক্ত জমে কালো হয়ে আছে। সেখানে কিলবিল করছে নীল মাছির দল। শুকনো পাতার আড়াল থেকে স্তন খুবলে নেওয়া বুকটাও দেখাচ্ছে স্পষ্ট। নাভির নিচটা ঢাকা এক টুকরো কাপড়ে। আগন্তুকদের কেউ হয়তো ঢেকে দিয়েছে। তার নিচ থেকে পেলব উরু বেয়ে গড়াতে গড়াতে রক্তের দাগটা শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। আজিজার, রোজিনা, বিল্লাল, শেফালি আর শ্যামল মাস্টার খেয়াল করলেন, দেহটার বুকের বাম পাশে একটা রক্তমাখা ব্রেসিয়ার পড়ে আছে।
আরও পড়ুন: সময়, প্রেম অথবা শরীর উপাখ্যান ॥ ফরিদা ইয়াসমিন সুমি