লালমিয়া মিজি কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হলেও বলতে থামেন না। যেন তাকে বলতেই হবে। হয়তো তার মনে জানান দিয়ে গেছে যে, জীবনের সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ঘনিয়ে যে এসেছে, তা তো বাইরে থেকেই বোঝা যায়। তিরাশি বছর বয়সে লাঠিতে জীবনের ভার সমর্পণ করে কড়া রোদের ভেতর দিয়ে দুই মাইল হেঁটে রিপনের দোকানে এসেছেন শুধু একটা ওষুধ কেনার জন্য। ছোটবেলা দাদির কাছে শোনা সেই রাক্ষস-খোক্ষসের গল্পে শুনেছেন, রাক্ষসের জান থাকে পদ্মদিঘির কাজলকালো জলের গভীরে লুকানো কৌটার ভেতরকার ভোমরার দেহের মধ্যে। ভোমরাটার পাখা ছিঁড়লে রাক্ষসের হাত ছিঁড়ে যায়। মেরে ফেললে রাক্ষসেরও মরণ ঘটে। এখন এই বয়সে তার জানও রিপন ডাক্তারের দোকানের তাকে রাখা একটা ওষুধের পাতায় একটা ট্যাবলেটের ভেতর লুকানো আছে। না হলে এত কষ্ট করে কেউ এভাবে আসে! তবে তার যে সন্ধ্যা হয়ে আসছে এটা বাইরে থেকে বোঝা গেলেও তার মনে এতদিন এ ব্যাপারে কোনও কথা ছিল না।
আজ কেন জানি মনে হচ্ছে সত্যি তার সময় ঘনিয়ে আসছে। এটা তার বুঝ। এই বুঝ বাইরে থেকে বোঝা যায় না। যার সময় হয় শুধু সে ই বোঝে। এই যে গত মাসে খাঁয়গো বাড়ির হাফেজ খাঁর মেয়ের জামাইটা মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে মরে গেল। মরার আগে সব আত্মীয়ের বাড়ি গিয়ে দেখা করে গেছে। তাইলে কী বোঝা যায়! তার সময়ের শেষ গিট্টু সে নিজেই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু সব কথা সবার কাছে জানানো যায় না। লালমিজি—সবাই তাকে এ নামেই চেনে—রিপনের কাছে সব কথা বলতে চান, আর কারও কাছে না। রিপনের কাছে বলে শেষ করতে হবে তার তিরাশি বছরের সব কথা। বলেন, বুঝলি রিপন। নারাণগঞ্জে থাকে আমার ভাতিজার গরের নাতি হেলাল কী চাকরি করে। দেশ-বিদেশে দৌড়ায়। এই যে তরা গাছে গাছে বেরাজিলের পতাকা লাগাইছত, হেই দেশে গেছে বল খেলা দেকতে না জানি কী কামে। হেই দেশে গিয়া গাড়িত এক্সিডেন অইছে। মাজামোজা বাইঙ্গা গেছে। হেই দেশের একলোক রক্ত দিছে। আল্লায় দিলে অহন বালা অইছে। ইট্টু আটতে পারলেই দেশে আইব। হেই লোকটার ফডো পাডাইছে, দেকলাম ঠিক এক্কেরে আমাগ সরদারকান্দির নাতি হাশেমের মতন। একরকম চেহেরা। তুই দেকলে বিশ্বাস করতে পারবি না এইডা কে? মোবাইল ফোন থিকা কম্পিউটারে নিয়া ছাপাইয়া আমারে দেহাইছে। হেই বেডায় বলে হেলালরে বাই ডাকছে। দেক, কোন দেশের এক খিরিস্টান পোলা— অরা খিরস্টিান না? হেয় আমাগ নাতিরে বাই ডাকে, রক্তের গুরুপ মিল্লা যায়, রক্ত দেয়, আবার চেহেরায় ও এত্ত মিল। খোদার দুইন্নাইতে কত কী দেকলাম।
দোকানে বসা ওষুধ কোম্পানির লোকটা পাতলা বেঞ্চে বসেই থাকে। রিপন পোলাডা চালাক–সে খেয়াল করে—মুরুব্বির কথা শোনায় ব্যস্ততার ভান করে তার টাকা দেওয়ার কথা ভুলেই গেছে মনে হয়। তার দিকে চেয়ে লালমিজি বলেন, হোনেন মিয়াছাব, আপনেগ বাড়ি বিক্রমপুরে না? আপনেগ কতাবাত্তায় বুজা যায়। আপনেরা যেইভাবে জমিন নষ্ট করতাছেন, একদিন না খাইতে পাইয়া কানবেন। আপনেরা বাড়ি করেন অনেক জাগা লইয়া, গরের চাইরপাশে গাছ লাগান, খিল জমিন ফালায়া রাহেন। দেহেন তো, আমাগ চরঞ্চলে এমুন কোন আড়ি আছে? আপনেরা কন আমাগ চউরা দেশে বাড়িতে ঘনঘন গর। আরে মিয়া আমরা গিরস্তি জমিন বাঁচায়া বাড়িগর করি। গিরস্তি না করলে আপনেরা খাইবেন কী? আবার আমাগ কন চউরা?
আপনেগ দেশে ফিরিঙ্গি বাজার বইলা একটা জাগা আছে? আমার মোনে চায় একবার যাইতে হেই জাগাত। এহনও কি ফিরিঙ্গিরা আছে? অরা দেকতে কেমুন? এই ফিরিঙ্গিরা এই দেশে অনেক অত্যাচার করছে। আর আপনেরা হেগো নামে বাজারের নাম রাকছেন।
এ সময় রিপন বলে, পর্তুগিজ গ ফিরিঙ্গি কয়। অরা পর্তুগালের লোক।
যেই দেশেরই হইক। অগো কইত হারমাদ। এই মেগনা গাঙ দিয়া খালি ডাকাতি করত শালারা। আর জুয়ান মাইয়া পাইলে দইরা লইয়া যাইত। জুয়ান দেকলে পোলাগোও দইরা নিয়া দূর কোন কোন দেশে বেইচ্চা হালাইতো। দাস বানায়া জাহাজে কইরা লইয়া যাইত। আমার দাদার দাদায় দেকছে হেই জাহাজ। বষ্যাকালে বড় জাহাজ গাঙে রাইক্কা ছোড ছোড পাতলা নাও লইয়া খালের বিত্রে ডুইক্কা গেরামের বিত্রে থিকাও পোলা-মাইয়া দইরা লইয়া যাইত। আমার দাদার দাদার বাইয়েরে লইয়া গেছে। হেয় একলা নৌকাত বইয়া মাছ দরতে আছিল। কোনসুমে যে হেই পাতলা নৌকা দিয়া ফিরিঙ্গিরা আইছে বুজতে পারে নাই। নাওয়ের তন নামায়া নিজেগ নাওয়ে লইয়া যাওনের সুম আমার দাদার দাদার বাপে দূরে আরেক নাওয়ে বইয়া দেহে তার পোলারে লইয়া যাইতাছে, হেয় চিক্কোইর দিছে, অরা হেরে গুল্লি করছে। হেয় পাওয়ের মইদ্যে গুল্লি খাইয়া পানিত পইরা গেছে গা। হেয় বাঁচছে, কিন্তু হেই পোলারে আর পায় নাই। আমার দাদার দাদায় হের পরে অইছে। হেই গরে আমার দাদায় অইছে।
রিপন লালমিজির কথা বিশ্বাস করে না। তার মোনে অয় বুড়া মানুষ কত কতাই কইতে পারে। তবে সে শোনে, বাধা দেয় না, থামতে বলে না। তার এই সামান্য প্রশ্রয়ে লালমিজি বলে যেতে থাকেন। তার শুনতে ইচ্ছাও করে। বিকেলগুলো তার ভালোই কাটে। বিশ্বাস না হলেও কথার তালে তালে কল্পনা করতে খারাপ লাগে না। তা ছাড়া বুড়ায় ওষুধ নিলে টাকা বাকি রাখে না।
রিপন রাইতে আমি গুমাইতে পারি না। বুকের বিত্রে শাঁই শাঁই শব্দ অয়। হাঁপড়ে বেদনা অয়। শ্বাস কষ্ট অয়। আমার জামাই একটা কী জিনিসি কিন্না দিছে। মুখে নিয়া লম্বা কইরা দম নিলে একটা বাতাস গলার বিত্রে যায়, রাইতটা বালা যায়। হেই জিনিসটা শেষ অইয়া গেছে। তোমার দোকানে আছে?
রিপন জানায় তার দোকানে ইনহেলার নাই। শহরের বড় বড় দোকানে রাখে। শহর থেইক্কা এত্ত দূরের দোকানে এইসব বিক্রি হয় না বলে রাখে না।
মুন্সীর হাটে পামু?
মোনে অয় না।
রিপন জানায় মুন্সীর হাটে গেলে আরেকটু যাইয়া শহর থিকাই আনা যায়। লালমিজি হতাশ হয়ে যান। তার হতাশা বিরাট একটা গুমোট বাতাস হয়ে দোকানে ঘুরতে থাকে। রিপন বোঝে, ওষুধ কোম্পানির লোকটাও বোঝে। রিপনের মোনে অয় লালমিজির শেষ নিঃশ্বাস বুঝি বের হয়ে যায়। তিনি বড় বড় করে শ্বাস নিতে থাকেন। কথা যেন শেষ। বাইরের দিকে চেয়ে থাকেন আর শ্বাসকষ্ট টুকু যেন বরণ করে নিতে চেষ্টা করেন। এক হাতে পকেট হাতড়ে ট্যাবলেটের একটা পুরনো পাতা বের করে দেখান, এই বড়িগিলি আছে–থাকলে একটা অহন দেও। পরে তোমারে টেকা দিয়া দিমু।
রিপন দেখে মন্টিলুকাস্ট জাতীয় দামি ট্যাবলেট। একেকটা পনেরো টাকা করে। এইসব ওষুধও এসব বাজারে পাওয়া যাবে না। শহরের দোকান ছাড়া কোথাও পাওয়া যাবে না। রিপনের কাছে নাই। কিন্তু সে এ কথাটা বলতে পারে না। সাহস হচ্ছে না। তার না সহ্য করার শক্তি এখন আর নাই লালমিজির। হয়তো দোকানেই মারা যাবেন। শ্বাসকষ্ট বাড়ছে তার। সে সঙ্গে কাশি। কফে তার শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে আছে। অনেক কেশেও সামান্য কফ বাইরে টেনে আনতে পারছেন না। এই বয়সে এই রোগী বাঁচানো কঠিন। এখন নেবুলাইজ করা দরকার। ধারে কাছে কোনো দোকানে মেশিন নাই। সদরে নেওয়া দরকার। কে নেবে! রিপন বিপন্ন বোধ করে। তার হাত কাঁপতে থাকে।
লালমিজি কাঠের চেয়ারটায় ঠিক মতো বসতে পারছেন না। কাঁপা কাঁপা হাতে রিপনের একটা হাত ধরে বললেন, দেও রিপন একটা বড়ি দেও থাকলে। আমার কষ্ট হইতাছে। আল্লাহ বাঁচায়া রাখলে তোমার টেকা দিয়া দিমু। যদি চইলা যাই তবুও তোমার টেকা মাইর যাইব না।
রিপন বলল, জ্যাডা, এই দামি অষুধ আমার কাছে নাই। অন্য অষুদ আছে, কম দামি। একটা দেই?
রিপন সামান্য কফের ওষুধ দিতে পারে। কিন্তু এখন সে কোনো ওষুধ দিতে ভয় পাচ্ছে। কিছু হয়ে গেলে স্থানীয় সমাজে অনেক ঝামেলা হতে পারে। সে লালমিজির চিকিৎসা করতে সাহস পাচ্ছে না। সে তো কোনো পাস করা ডাক্তার না, গ্রাম ডাক্তারির কোর্সটাও করেনি। সামান্য একজন ওষুধ বিক্রেতা মাত্র। তার ট্রেনিং নাই, সার্টিফিকেট নাই, ট্রেড লাইসেন্স নাই বলে শহরে সে দোকান চালাতে পারবে না। এ কারণেই সে এই গ্রামে নড়বড়ে এক দোকান নিয়ে পড়ে আছে। জ্বর-জারি-ঠাণ্ডা-আমাশয় আর ডায়রিয়ার সামান্য ওষুধ বেচে। কিন্তু এখানকার সরল মানুষগুলো তার ওষুধের ওপর আস্থা রাখে। ওষুধ কোম্পানির লোকটা ক্যামিস্ট্রিতে অনার্স, মাস্টার্স। ভয়ানক ইন্টারভিউ দিয়ে ওষুধ কোম্পানির চাকরি নিয়েছে। মাসের টার্গেট পূরণ করার জন্য গ্রামের ছোট দোকানগুলোতেও আসতে হয়। সে বলল, রিপন সাহেব, মনে হচ্ছে চাচামিয়ার অবস্থা বেশি ভালো না। কিছু একটা করা প্রয়োজন। তার বাড়িতে খবর দেওয়া দরকার। চেনেন নাকি তাকে?
এইট পাস রিপন নিজের নামের সঙ্গে সাহেব শব্দটির জুটি দেখে সন্তুষ্ট। শব্দটির ভারে তার গলার স্বর যেন কিছুটা বসে গেছে। সে বলল, চিনি, কিন্তু তার বাড়িতে খবর দেই কাকে দিয়ে!
রিপনের উদ্যোগহীনতা দেখে লোকটা বিমূঢ়ের মতো চেয়ে থাকে। লালমিজি লোকটার হাত ধরে বললেন, বাবা আপনের কাছে আছে এই অষুদ? থাকলে দেন বাবা, রাইতটা যেন পার করতে পারি।
লোকটা তার ব্যাগরে ভেতরের সব কিছু উল্টেপাল্টে দেখল এ জাতীয় কোনো ওষুধ নেই। শিশুদের উপযোগী সিরাপের ফাইল আছে। এমন বয়স্ক লোকের কাজ করবে কি না কে জানে। ওষুধটা সঙ্গে সঙ্গে কাজ করবে না। সময় লাগবে। একটা ফাইল বের করে বলল, সিরাপটা খেতে পারবেন? দেখতে পারেন।
লালমিজি সিরাপের বোতলটার দিকে চেয়ে রইলেন। রিপনকে আবার বললেন, রিপন যুদি আমি কাইল পর্যন্ত বাঁচতে না পারি, আমার লাইগা আল্লার কাছে দোয়া কইরো।
এবার রিপন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। সিরাপটা খুলে চামচে করে তার সামনে খেতে দিয়ে বলল, কয়েক চামচ খেয়ে দেখতে পারেন।
প্রবল কাশি আর শ্বাসকষ্টের ভেতর লালমিজি বললেন, থাকলে একটা বড়ি দেও। খাইয়া বাঁচি। আমার বাঁচনের খুব শখ রিপন।
শিশুদের সিরাপটা খাওয়ানো গেল না লালমিজিকে। কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। চোখে পানি এসে গেল। পুরো মুখসহ চোখ লাল হয়ে গেল। বমি হতে থাকল। রিপন ভয় পেয়ে গেল। ওষুধ কোম্পানির লোকটা বলল, যদি বমি করে সেরে উঠতে পারেন তাহলে হয়তো বেঁচে যাবেন। শ্বাসনালী থেকে কফ বেরিয়ে গেলে শ্বাসকষ্ট কমে যেতে পারে। কিন্তু অন্যরকম কিছু ঘটলে ভয় আছে।
এ সময় বাইরে থেকে কিছু লোক এসে লালমিজির অবস্থা দেখে শোরগোল শুরু করে দিল। অমুকরে খবর দে, তমুকরে ডাক দে, অমুকে মইরা যাইতাছে ইত্যাদি। রিপন অসহায়ের মতো তার র্যাকের সমস্ত অষুধের দিকে চেয়ে রইল।