‘মিসতুরী, খাঁড়ি কাঠ দেওন লাগবো কিন্তু। ট্যাকা দুই-চারশ বেশি নিবা, নেও। তয় খাড়িয়া যেন ঘুণে না খায়।’ কথাগুলো বলতে বলতে তেলতেলে চীনা বেতের লাঠিতে ভর করে আয়েশি ভঙ্গিতে বসলেন গনি মিয়া।
কাঠের ফালিতে নকশা অঙ্কনে মগ্ন হেড মিস্ত্রীর ধ্যান ভাঙে। বৈশাখী মেলার কাজের চাপে আজ কয়দিন দম ফেলায় ফুসরত নেই কাঠ শ্রমিকদের। হাতের কাঠ পেন্সিলটি কানে গুঁজে তাকায় সাদা পাঞ্জাবির ওপর কালো শেরওয়ানি পরা গনি মিয়ার দিকে। পায়ে দোলানো দামি চকচকে জুতায় আভিজাত্যের জানান দিচ্ছে। মিস্ত্রীর বুঝতে অসুবিধা হয় না—গনি মিয়া আর দশজনের মতো সাধারণ মক্কেল নয়, ইনি মালদার। কাজ ভালো করলে বাড়তি কিছু আদায় করাও অসম্ভব নয়। দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দেয় মিস্ত্রী, ‘কী যে বলেন কাকা, আপনেরে খারাপ জিনিস দিমু কী দুঃখে? আপনি হইলেন গিয়া এলাকার মান্যগণ্য ব্যক্তি। আপনার লগে কি আর দুই নম্বরী চলে?’ শুকনো সেগুন কাঠে আঙুলের টোকা মেরে বলে, ‘দ্যাখেন কাকা, একদম খাসা মাল। এমন খাড়িয়া বানাইয়া দিমু, এক্কেবারে লাইফ গ্যারান্টি। যুগ যুগ চইলা যাইবো। তয় কাঠের এক ইঞ্চিও ঘুণে খাইবো না।’
চায়ের অর্ডার দেয় মিস্ত্রি। বয় জিগ্যেস করে, ‘কাক্কু, চায়ে চিনি দিমু?’
মেহেদি রাঙা দাড়িতে হাত বোলাতে বুলাতে গনি মিয়া বলে, ‘আরে মিয়া, চিনি না দিলে আর চা খাওনের ফায়দা কী! যাও, দুধ চিনি বাড়াইয়া দেও।’ ইদানীং দোকানের চায়ে তার মন ভরে না। ইচ্ছেমতো দুধ চিনি মাখানো যায় না। আজকাল বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেরা চিনি ছাড়া চা খাওয়াকে একটা ফ্যাশন বানিয়ে ফেলছে।এসব ভদ্রলোকি ঢং গনি মিয়ার একদম পছন্দ হয় না।
আরও পড়ুন: দোপাটি ॥ ফরিদা ইয়াসমিন সুমি
বুদ্ধিতে কিঞ্চিৎ খাটো জুগলী (হেল্পার) দুলাল লাইফ গ্যারান্টির অর্থ বোঝে না। বলে,‘ওস্তাদ লাইফ গ্যারান্টি মানে কী?’ মিস্ত্রী ধমক দেয়, ‘তুই এসব বুঝবি না, কাজে মন দে হারামজাদা। খেয়ে খেয়ে তো পেটটারে ঢোল বানাইয়া ফেলাইছিস। কাজ করবি ক্যামনে।’ বাম হাতের পিষ্ট দেশে কপালের ঘামটা মুছে নিয়ে পুনরায় রাংতা টানায় মনোযোগ দেয় দুলাল।
আজ বেশ ফুরফুরে মন নিয়ে বাড়ি ফেরে গনি মিয়া। ইদানীং লোকজন তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলে। যেখানে যায়, চেয়ার এগিয়ে দেয়, চায়ের অর্ডার করে। বিয়ে-সাদি, খৎনা, আকিকাসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি ছাড়া একেবারেই চলে না। সমাজের হাতেগোনা দুই-চার জনের মধ্যে এখন গনি মিয়াও একজন।
চার বছর হলো নতুন ঘরে উঠেছে গনি মিয়া। নতুন পালঙ্ক, নরম জাজিম। দক্ষিণের জানালা খুললেই শোঁ শোঁ বাতাস। ঘুম থেকে উঠতে বেশ বিলম্ব হয় আজকাল। এত সকাল উঠেই বা কী কাজ? ঘরে পাইক পেয়াদার তো আর অভাব নেই। ঘুম থেকে উঠেই দেখে টেবিলে নাস্তা সাজানো। জীবনটাকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয় তার।
কয়দিন ধরে শরীরটা কেমন জানি ম্যাজ ম্যাজ করে গনি মিয়ার। ঘুম থেকে উঠলে গায়ে ব্যথা অনুভব করে, মাথা ঝিমঝিম করে, রাতে ঘুমও ভেঙে যায় বারবার। কিছুই বুঝে উঠতে পারে না গনি মিয়া। আগে শিমুল তুলোর খাটে শীতল পাটি বিছিয়ে দিব্যি ঘুমিয়েছে। আর এখন এত দামি নরম তোষকে শুয়েও গায়ে ব্যথা! কত্ত কত্ত দামি খাবার! প্রতিদিন মাছ মাংস খেয়েও শরীর যেন আগের মতো চলে না। ভাবতে ভাবতে অতীতে ফিরে যায় গনি মিয়া, নস্টালজিক হয় কিছুটা। এককালে দুই বেলা পেট পুরে খাওয়াই ছিল তার কাছে স্বপ্ন। সূর্যোদয়ের আগেই চলে যেতে হতো মাঠে। সারাদিনের গতর খাটুনির পরও আধাপেট খেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হতো। মাছ মাংস জুটতো কালেভদ্রে। তবু দেহে শক্তি ছিল, হিম্মত ছিল। আর এখন দুই ছেলে দুবাই থাকে, একজন নামকরা ঠিকাদার, বাজারে বড় মুদি দোকান। মাস যেতে না যেতেই অ্যাকাউন্টে টাকা। সামর্থ্য আছে কিন্তু খেতে মন চায় না। কী আজব দুনিয়া! রুজি বাড়ছে আর রিজিক কমে যাচ্ছে দিনে দিনে। শরীরটাও যেন আগের মতো চলছে না। গনি মিয়া ডাক্তার দেখানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
আরও পড়ুন: কোরবানি ॥ শারমিন রহমান
শহরের সবচেয়ে বড় ডাক্তারের চেম্বার।
হাফ ডজন রিপোর্টে নজর বুলালেন ডাক্তার। এরপর মোটা ফ্রেমের চশমাটা টেবিলে রেখে শুরু করলেন, ‘সুগার বেশি আছে, মিষ্টি জাতীয় খাবার নিষেধ। মাছ মাংস খাবেন সীমিত পরিমাণে। চা খেলে অবশ্যই চিনি ছাড়া। সকাল-বিকাল ঘাম ঝরাতে হবে। বুঝলেন? ঘাম ঝরাতে হবে। প্রেসার হাই, গরু, খাসি খাবেন না। নিয়ম করে দৈনিক একঘণ্টা হাঁটবেন। বেশি বেশি পানি পান করবেন। কারণ, ক্রিটিনাইনের মাত্রাটা বেশি দেখা যাচ্ছে। টক জাতীয় খাবার আপাতত বন্ধ। ও আচ্ছা, ফ্যাটি লিভারের সঙ্গে কিছুটা ডিসলিপিডিয়াও আছে, রিচ ফুড খাবেন না। অতিরিক্ত তেল, চর্বি, ঘি, মাখন অ্যাভোয়েড করবেন, কেক পেস্টি বাদ দেবেন। বুঝলেন? এখন শরৎকাল। জানালা খুলে ঘুমাবেন না। রক্তে ইসোনোফিল বেশি তো তাই। মানে রক্তে এলার্জি আছে, এলার্জি। বুঝতে পেরেছেন? কুয়াশা থেকে এজমা এসে যেতে পারে সাবধান! ঠাণ্ডা জাতীয় খাবার একেবারে নয়। অতিরিক্ত গরম বা ঠাণ্ডা লাগাবেন না। ফ্রিজের জিনিস খাবেন না। আর হ্যাঁ, অবশ্যই শক্ত বিছানায় ঘুমাবেন, জাজিম-তোষক একেবারে চলবে না। ক্লিয়ার? সময় করে একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ দেখিয়ে চশমার পাওয়ারটা ঠিক করে নেবেন। ঠিক আছে? আপাতত এই ছয়টি ওষুধ খান। দেখি কী হয়।একমাস পর এই পরীক্ষাগুলো করে দেখা করবেন (লিপিড প্রোপাইল, আরবিএস, ক্রিটিনাইন, এসজিপিটি, ইউএসজি আপার এবডোমেন)। নেক্সট পেশেন্ট।
প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে রোবটের মতো হাঁটতে লাগলো গনি মিয়া। ভাবতে থাকে এত কিছুই যদি খেতে বারণ হয়, তবে বাকি আর কী থাকে।এত এত টাকা দিয়েই বা আর কী হবে। বাসায় এসে শখের তোষক আর জাজিমগুলো সরালো। দেখলো জাজিমের নিচের সেগুন খাটটি এখনো চকচক করছে। মিস্ত্রীর গ্যারান্টি ঠিক আছে। কাঠে কোনো ঘুণ ধরেনি। বরং ঘুণ ধরেছে দেহে।