বধূ ডাকিল–ঘুমুচ্ছ?
মনোময় পাশ ফিরিয়া শুইল এবং বলিল—উঁহু।
বধূ কহিল–বালিশ কোথায়? অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছি না তো! হ্যাঁগো, আমার বালিশ কোথায় লুকিয়ে রাখলে? না—এই যে পেয়েছি। বলিয়া আন্দাজে বালিশ খুঁজিয়া লইয়া তাহার ওপর শুইয়া পড়িল।
মনোময় বলিয়া উঠিল, আঃ, ঘাড়ের উপর শুলে কেন? সরে গিয়ে জায়গায় শোও।
বধূ বলিল—সর্বনাশ! গায়ের উপর শুয়েছি নাকি? পিদ্দিমটা নিভে গেল, অন্ধকারে কিছু বুঝতে পারিনি। ভাগ্যিস কথা কইলে।
কিন্তু কথা যদি মোটে না-ই কহিত, তা হইলেও মনোময়ের অস্থির দেহটাকে তুলার বালিশ বলিয়া ভুল করা কাহারও উচিত নয়।
এবার শুইয়া পড়িয়া বধূ চুপ করিয়া রহিল কিন্তু কতক্ষণ? একা-একাই কথা চলিতে লাগিল।
–উঃ কী গরম! বৃষ্টি-বাদলার নাম-গন্ধ নেই, গরমে সিদ্ধ করে মারছে। তার উপর দু-দুটো উনুনে যেন রাবণের চিতে! সেই বেলা থাকতে রান্নাঘরে ঢুকেছি আর এখন বেরিয়ে আসা! ঘরে একটা জানালাও নেই… ওগো ও কর্তা, ও ছোটবাবু, তোমরা রান্নাঘরে একটা জানালা করে দাও না কেন? এইবার করে দাও—বুঝলে?
তবু ছোটবাবু সাড়া দিল না বোধ করি। সে জানালা করিয়া দিবেই, তাই কথা কহিল না।
বধূর মুখের কাছে ঘুরিয়া ঘুরিয়া কয়টা মশা ভনভন করিয়া উঠিলো। তবু যা হোক কথার দোসর জুটিল, ঐ মানুষটাকে আর ডাকিয়া ডাকিয়া খুন হইবার দরকার নাই। মশার সঙ্গেই আলাপ শুরু হইল।
—দাঁড়া, কাল তোদের জব্দ করছি। সন্ধ্যাবেলা নারকেলের খোসার আগুন করে আচ্ছা করে ধুনো দেব, দেখি ঘরে থাকিস কী করে?
খানিক জোরে জোরে পাখা করিতে লাগিল।
তারপর মনোময়ের গায়ে নাড়া দিয়া বলিল—ঘুমুচ্ছ কী করে? মশায় কামড়ায় না? সরে এসো একটু, মশারি ফেলি।
এখানে বলিয়া রাখা যাইতে পারে যে ঘুম সম্বন্ধে মনোময়ের বিশেষপ্রকার নিপুণতা আছে। মশা ক্ষুদ্র প্রাণী, কামড়াইয়া কী করিবে? ঘুম যদি সত্য-সত্যই আসিয়া থাকে, সুন্দরবনের বাঘে কামড়াইলেও ভাঙিবে না।
বধূ মশারি ফেলিল। মনোময়ের পাশটা খুঁজিয়া দিবার জন্য গায়ের উপর ঝুঁকিয়া পড়িল। খাদের একেবারে কিনারা ঘেঁষিয়া শুইয়াছে মনোময়, বন্ধু তাহার হাতখানা সরাইয়া দিল, যেখানে সরাইয়া রাখিল, সেইখানেই এলাইয়া রহিল। পুনরায় তুলিয়া লইয়া সেই হাতখানা নিজের হাতের উপর রাখিল। তারপর মনোময়ের কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া বলিল—ঘুমুলে নাকি?
ওগো শুনছ? এরি মধ্যে ঘুম!
মনোময় নড়িয়া চড়িয়া পাশবালিশটা টানিয়া লইয়া বলিল—ঘুম কোথায় দেখলে? বলো কী বলবে?
বধূ বলিল—এসসা খানিক গল্প করি, এত সকাল-সকাল ঘুমোয় না।
মনোময় কহিল—করো।
কালকে আমি গল্প বলেছি, আজ তোমার পালা। সেই রকম কথা ছিল না?
—হুঁ।
—তবে?
মনোময় বলিল—তা হোক, আজও তুমি বলো ঊষা। কালকের শেষটা শোনা হয়নি—ঘুম এসেছিল।
বধূর নাম ঊষা। বলিল—আজও তেমনি ঘুমুবে তো?
মনোময় কঠিন প্রতিজ্ঞা করিয়া বলিল—কক্ষনো না।
ঊষা কহিল—কিন্তু এখনি তো ঘুমুতে আরম্ভ করেছ, ঐ যে দেখছি।
মনোময় বলিল—দেখতে পাচ্ছ? অন্ধকারে তোমার চোখ জ্বলে বুঝি।
ঊষা বলিল—জ্বলেই তো। সাত রাজার ধন মানিকের গল্প শোনোনি? অজগর সাপ সেই মানিক মাথা থেকে নামিয়ে গোবরে লুকিয়ে রাখল, গোবর খুঁড়েও তার আলো বেরোয়। তেমনি একজোড়া মানিক হচ্ছে আমার এই চোখ দুটো চিনলে না তো!
মনোময় বলিল—কিন্তু মানিক ছাড়াও মেনি-বেড়ালের চোখ অন্ধকারে জ্বলে, বিজ্ঞান-পাঠ পড়ে দেখো।
—কিন্তু এবার তো আর চোখ দিয়ে দেখা নয় মশায়, হাত দিয়ে ছোঁওয়া। অন্ধকারের মধ্যে ঊষা মনোময়ের চোখের উপর হাত বুলাইয়া দেখিল, উহা যথানিয়মে মুদ্রিত হইয়া আছে।
ভারী রাগিয়া গেল।
—বেশ, ঘুমোও খুব করে ঘুমোও—আমি জ্বালাতন করব না। বলিয়া সরিয়া গিয়া উল্টাদিকে মুখ করিয়া শুইল।
মনোময়ও সরিয়া আসিল, আসিয়া তাহার একখানা হাত ধরিয়া বলিল—ফিরে শোও, অত রাগ করে না—এদিকে একবার ফিরেই দেখো, ঘুমিয়েছি কি না। ফিরবে না? আহা যদি কথা না বলো মাথা নাড়তে কি বাধা?
অপর পক্ষ নির্বিকার। যেমন ঘুম পাইয়াছে, তেমনি গভীর নিশ্বাস পড়িতেছে। মনোময় বলিল—ঘুমুলে নাকি? ও ঊষা, ঘুমিয়ে পড়েছ? তারও পরীক্ষা আছে। সত্যি সত্যি যদি ঘুমিয়ে থাক, হ্যাঁ’ বলে জবাব দাও।
এবার ঊষা কথা কহিল।
—খুব যা তা বুঝিয়ে যাচ্ছ!
মনোময় হাসিতে হাসিতে বলিল—কী?
—এই যে বললে, ঘুম এসে থাকলে আমি ‘হ্যাঁ’ বলে উত্তর দেব! ঘুম এলে বুঝি জ্ঞান থাকে! ভাবো, আমি বুঝিনে কিছু—আমি বোকা!
মনোময়ের দুগ্রহ। বলিয়া বসিল—বোকা নও তো কি! আমি বরাবর জেগেই আছি—তুমি চোখে হাত দিয়ে বললে, আমার চোখ বোজা খোলা চোখে হাত দিলে বুজে যায় না কার? নিজের চোখে হাত দিয়ে দেখো না। আর, এই নিয়ে তুমি মিছামিছি রাগারাগি করলে।
ঊষাকে বোকা বলিলে খেপিয়া যায়। বলিল—আমি বোকা আছি, বেশ আছি তোমার কী? বলিয়া জানালার ধারে একেবারে খাটের শেষপ্রান্তে চলিয়া গেল এবং তাহার ও মনোময়ের মধ্যেকার ফাঁকটুকুতে দুমদুম করিয়া দুইটা পাশবালিশ ফেলিয়া দিল।
মনোময় হতাশভাবে বলিল—তা বেশ! মাঝে একেবারে ডবল পাঁচিল তুলে দিলে…
খানিক চুপ করিয়া থাকিয়া আবার বলিল বেশ, আমার দোষ নেই—এবার নিশ্চিন্তে ঘুমানো যাক।
যা বলিল তাই। হাই তুলিয়া সত্য-সত্যই পাশ ফিরিয়া শুইল।
তা হোক। ঊষাও পড়িয়া থাকিতে জানে। দুইজনে চুপচাপ। যদি কেহ দেখিতে পাইত, ঠিক ভাবিত উহারা নিঃসাড়ে ঘুমাইতেছে।
খানিক পরে ঊষা উসখুস করিতে লাগিল। এমনো হইতে পারে, মনোময় সুযোগ পাইয়া এই ফাঁকে সত্য-সত্যই খানিকটা ঘুমাইয়া লইতেছে। ইহার পরীক্ষা করিতে কিন্তু বেশি বেগ পাইতে হয় না, গায়ে একটু সুড়সুড়ি দিলেই বোঝা যায়। ঘুম যদি ছলনা হয় মনোময় ঠিক লাফাইয়া উঠিবে, চুপ করিয়া কখনো সুড়সুড়ি হজম করিতে পারিবে না। কিন্তু যদি সে না ঘুমাইয়া জাগিয়াই থাকে, এবং ঊষা গায়ে হাত দিবামাত্রই হো-হো করিয়া হাসিয়া ওঠে! না রাগ করিয়া শেষকালে অতখানি অপদস্থ হওয়া উচিত হইবে না।
ও-ঘরে বড় জায়ের ছেলে জাগিয়া উঠিয়া কাঁদিতে লাগিল। শেষে তিনি দালানে আসিয়া ডাকিলেন—ছোট বউ, অ ছোট বউ, ঘুমুলি নাকি?
বার দুই ডাকাডাকির পর ঊষা উঠিয়া গিয়া ভিতর হইতে জিজ্ঞাসা করিল—কী?
—তোর ঘরে স্পিরিটের বোতলটা আছে, বের করে দে, খোকার দুধ গরম করব।
বোতল বাহির করিয়া দিয়া তোশকের তলা হইতে দেশলাই লইয়া ঊষা প্রদীপ জ্বালিল। মধ্যেকার পাশবালিশের প্রাচীর তেমনি অটল হইয়া আছে। ঊষা যখন উঠিয়া গিয়াছিল, অন্তত সেই অবকাশে বালিশ দুইটির অন্তর্ধান হওয়া উচিত ছিল। কাণ্ডখানা কী?
দীপ ধরিয়া মনোময়ের মুখের দিকে তাকাইতেই বুঝিতে পারিল, সে দিব্য অঘোরে ঘুমাইতেছে—ঘুম যে অকৃত্রিম, তাহাতে সন্দেহ নাই। দাম্পত্য জীবনের উপর ঊষার ধিক্কার জন্মিয়া গেল। পুরুষমানুষের কেবল চিঠিতে চিঠিতেই ভালোবাসা। ভালোবাসা না ছাই! গরমের ছুটিতে ক-দিনের জন্য বাড়ি আসা হইয়াছে, একেবারে রাজ্যের ঘুম সঙ্গে করিয়া লইয়া আজ যখন কাজকর্ম মিটাইয়া নিজেরা খাইয়া বাসনকোশন ও পিড়ি তুলিয়া এঘরে চলিয়া আসিতেছে। —এমন সময় টুপটুপ করিয়া রান্নাঘরের পিছনে সিঁদুরে গাছের তলায় ক-টা আম পড়িল। সেজ জা প্রস্তাব করিলেন—চল না ছোট বউ, আম ক-টা কুড়িয়ে আনি। ঊষা বলিল—এখন থাকগে, সকালে কুড়োলেই হবে। সেজ জা বলিলেন সকালে কি আর থাকবে? রাত থাকতেই পাড়ার মেয়েগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যাবে। তখন বড় জা মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিলেন—না–না—সেজবউ ও ঘরে যাক। আর একজনের ওদিকে ঘুম হচ্ছে না, তা বোঝো? চলো, তুমি আর আমি কুড়োইগে। আজ তোরও খুব ঘুম ধরেছে, না রে ঊষা? ঊষার লজ্জা করিতে লাগিল। জোর করিয়া বলিল—না, আমিও কুড়োতে যাব—এবং খুব উৎসাহের সহিত আম কুড়াইয়া বেড়াইয়াছিল। তখনই কিন্তু ছাঁত করিয়া মনে উঠিয়াছিল—জাগিয়া আছে তো?
এবারে মনোময়ের ট্রাংক হইতে ঊষা কখানা উপন্যাস আবিষ্কার করিয়াছে। আজ রান্নাঘরে ভাত চড়াইয়া দিয়া তাহার একখানা লইয়া বসিয়াছিল। সুপ্রসিদ্ধ গোবর্ধন পালিত মহাশয়ের রচিত ‘অদৃষ্টের পরিহাস’। বইখানা শেষ করিতে পারে নাই, ফেন উথলাইয়া উঠিল—অমনি সে পাতা মুড়িয়া রাখিয়া দিয়াছিল, এখন এমন করিয়া শুইয়া কী করা যায়, ঘুম যে আসে না! কুলুঙ্গি হইতে বইখানা টানিয়া লইল।
খাসা লিখিয়াছে, পড়িতে পড়িতে ঊষা অবিলম্বে মগ্ন হইয়া গেল।
উপন্যাসের নায়িকার নাম অধীরা। সম্প্রতি তাহার সঙ্গীন অবস্থা। নায়ক প্রণয়কুমারকে দস্যু ভৈরব সর্দার ইতিপূর্বে বন্দী করিয়া লইয়া গিয়াছে। অধীরা অনেক কৌশলে তাহার সন্ধান পাইয়া স্বয়ং দস্যুগৃহে গিয়াছিল, এখন রাত্রিবেলা ফিরিয়া আসিতেছে।
বর্ণনাটা এইপ্রকার:
একে অমাবস্যার রাত্রি, তায় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সূচীভেদ্য অন্ধকার, কেবল মধ্যে মধ্যে খদ্যোতকুল ঈষৎ জ্যোতিঃ বিকিরণ করিতেছে। এই অন্ধকার-মগ্ন নিস্তব্ধ নিশীথে অরণ্য-সমাকীর্ণ পথপ্রান্তে উন্মাদিনীর ন্যায় ছুটিয়া চলিয়াছে কে? পাঠক-পাঠিকাগণ নিশ্চয়ই চিনিতে পারিয়াছেন, ইনি আমাদের সেই জমিদার-দুহিতা ষোড়শী সুন্দরী অধীরা। কণ্টকে পদযুগল রক্তাক্ত হইতেছে, তথাপি ভ্রূক্ষেপ নাই। এমন সময় পশ্চাতে পদধ্বনি শ্রুত হইল। নিশ্চয়ই ভৈরব সর্দারের অনুচর অনুসরণ করিতেছে, এইরূপ বিবেচনা করিয়া অধীরা আরও দ্রুতবেগে গমন করিতে লাগিল। পশ্চাতের পদধ্বনি ক্রমশ স্পষ্ট হইতে স্পষ্টতর লাগিলা অধীরা অধিকতর বেগে দৌড়িতে আরম্ভ করিলা কিন্তু দুর্দৈববশত একটি বৃক্ষকাণ্ডে বাধিয়া পদলন হইল। অনুসরণকারী তৎক্ষণাৎ বজ্রমুষ্টিতে তাহার হস্তধারণ করিল। অধীরা নানাপ্রকারে অঙ্গসঞ্চালন করিয়া দস্যুহস্ত হইতে অব্যাহতি লাভের চেষ্টা পাইতে লাগিল। এই সময়ে বিদ্যুৎস্ফুরণ হইল। দামিনীর তীব্র আলোকে দেখিতে পাইল অনুসরণকারী আর কেহ নহে, স্বয়ং প্রণয়কুমার। প্রণয়কুমার প্রশ্ন করিল— পাপীয়সী, এই গভীর রাত্রে নিবিড় অরণ্য মধ্যে কোথায় চলিয়াছিস? আমি তোকে ভালবাসিয়া পরম বিশ্বাসে বক্ষে ধারণ করিয়াছি, সেই বিশ্বাসের এই প্রতিদান?—প্রণয়কুমার আরও কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু অকস্মাৎ মেঘগর্জন দিঙমণ্ডল প্রকম্পিত করিয়া তাহার কণ্ঠস্বর বিলুপ্ত করিয়া দিল এবং প্রলয়বেগে বাত্যা ও ধারাবর্ষণ আরম্ভ হইল।
এই যে বাত্যা ও ধারাবর্ষণ শুরু হইল, ইহার পর পাতাতিনেক ধরিয়া আর তাহার বিরাম নাই। বর্ণনাগুলি বাদ দিয়া ঊষা পরের পরিচ্ছেদে আসিল। সেখানেও বৃহৎ ব্যাপার। প্রণয়কুমার একাকী পঞ্চাশজন আততায়ীকে কিরূপ বিক্রম সহকারে ধরাশায়ী করিয়া দস্যুগৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়াছিল, তাহার রোমাঞ্চকর বিবরণ। কিন্তু ঊষার তাহাতে মন বসিল না। ষোড়শী সুন্দরী অধীরা নায়ককে খুঁজিতে গিয়া যে উল্টা উৎপত্তি ঘটাইয়া বসিল, সে কোথায় গেল? প্রণয়কুমারের। বিক্রমের বৃত্তান্ত পরে অবগত হইলেও চলিবে, ঊষা তাড়াতাড়ি একেবারে উপসংহারের পাতা খুলিল।
কিন্তু ভিতরে ঢুকিয়া দেখিল, থালার উপর লঙ্কা ও লবণ সহযোগে কাঁচা আম জারানো হইয়াছে। মুখোমুখি বসিয়া ঊষা ও রাধারানী নিঃশব্দে মনোযোগের সহিত আহার করিতেছে। মনোময়কে দেখিয়া ঘোমটা টানিয়া দিয়া ঊষা হাত গুটাইয়া লইল। রাধারানী হাসিয়া উঠিল
উপসংহারে আসিয়া অধীরার দেখা মিলিল, কিন্তু বেচারী তখন অন্তিমশয্যায়। এমন সময়ে অতি আকস্মিক উপায়ে প্রণয়কুমার তথায় উপস্থিত হইল। স্থান সম্ভবত হিমালয় কিংবা বিন্ধ্যাচলের একটি নিভৃত গুহা, কারণ ইতিপূর্বে উত্তুঙ্গ পর্বতশৃঙ্গের বর্ণনা হইয়া গিয়াছে।
ঊষা পড়িতে লাগিল।
অধীরা বলিল—আসিয়াছ হৃদয়বল্লভ? আমি জানিতাম তুমি আসিবে। এই সংসারে ধর্মের জয় অবশ্যম্ভাবী। শেষ মুহূর্তে বলিয়া যাই আমি অবিশ্বাসিনী নহি। ভৈরব সর্দারের গৃহে যে ছদ্মবেশী নবীন দস্যু তোমার শৃঙ্খল উন্মোচন করিয়া দিয়াছিল, সে এই দাসী ভিন্ন আর কেহ নহে। হায়, আমাকে চিনিতে পার নাই।
প্রণয়কুমার বক্ষে করাঘাত করিয়া কহিল—আমি কি দুরাত্মা! তোমার ন্যায় নিষ্পাপ সরলাকে তুষানলে দগ্ধ করিয়া হত্যা করিলামা আমার এই দুষ্কৃতিতে অদ্য একটি অম্লান অনাঘ্রাত কুসুম কাল-কবলিত হইতে চলিয়াছে। এই মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত কিসে হইবে?
অধীরা গদগদ কণ্ঠে কহিল তোমার কোন দোষ নাই, সমস্তই অদৃষ্টের পরিহাস। আমার জন্য
তুমি কত যন্ত্রণা সহিয়াছ। যাহা হউক এই পৃথিবী হইতে অভাগিনীর অদ্য চিরবিদায়। আবার জন্মান্তরে দেখা হইবে! যাই প্রাণেশ্বর।।
এই বলিয়া অধীরা ঝঞ্চাতাড়িত লতিকার ন্যায় প্রণয়কুমারের পদতলে পতিত হইল।
বই শেষ হইয়া গেল, তবু ঊষার ঘুম আসে না। ঐ বইয়ের কথাই ভাবিতে লাগিল। এ সংসারে পুণ্যের জয় পাপের ক্ষয় অবশ্যম্ভাবী, তাহাতে আর ভুল নাই। অতবড় দাম্ভিক দুর্ধর্ষ প্রণয়কুমার —তাহাকেও শেষকালে অধীরার শোকে রীতিমতো বুক চাপড়াইয়া কাঁদিয়া ভাসাইতে হইয়াছে। হাঁ—বই লিখিতে হয় তো লোকে যেন গোবর্ধন পালিত মহাশয়ের মতো করিয়া লেখো।
বিছানার ও-পাশে তাকাইয়া মনোময়ের জন্য অনুকম্পায় তাহার বুক ভরিয়া উঠিল। আজ ভালো করিয়া কথা কহিলে না, মাঝের বালিশ দুইটা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া একটু টানাটানিও করিলে না, করিলে তোমার অপমান হইত—বেশ ঘুমাও, এমনিভাবে অবহেলা করিয়া নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমাও—কিন্তু একদিন বুক চাপড়াইতে হইবে। ঊষার রাগ আরও ভয়ানক হইল, রাগের বশে কান্না পাইল। এমন করিয়া এক বিছানায় শুইয়া থাকা যায় না। ঊষা ভাবিতে লাগিল, এখনই একখানা চিঠি লিখিয়া দূরে বহুদূরে একেবারে চিরদিনের মতো চলিয়া গেলে হয়, কাল সকালে ঘুম হইতে উঠিয়া তখন প্রণয়কুমারের মতো হাহাকার করিতে হইবে।
আলো লইয়া টেবিলের ধারে গিয়া সে সত্যসত্যই চিঠি লিখিতে বসিল। কিন্তু ছত্র পাঁচেক লিখিয়া আর উৎসাহ পাইল না। কারণ, দূরে—বহুদূরে—চিরদিনের মতো যে-স্থানে চলিয়া যাইতে হইবে, তাহার ঠিকানা জানা নাই। বাইরে উঠানের পরপারে পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নায় লিচুগাছটি ডালপালা মেলিয়া ঝাঁকড়া-চুল ডাইনী-বুড়ির মতো দাঁড়াইয়া আছে। আর যাহাই হউক এই রাত্রিতে দরজার খিল খুলিয়া উহার তলা দিয়া কোথাও যাওয়া যাইবে না, ইহা নিশ্চিত অতএব চিরদিনের মতো দূরে বহুদূরে যাইবার আপাতত তাড়াতাড়ি নাই। ঊষা পুনরায় বিছানায় শুইতে আসিল। আসিয়া দেখে, ইতিমধ্যে মনোময় জাগিয়া উঠিয়া মিটমিট করিয়া তাকাইয়া আছে। আলো নিবাইয়া গম্ভীরমুখে সে শুইয়া পড়িল।
হঠাৎ মনোময় এস্তভাবে বলিয়া উঠিল—ঊষা, ঊষা—দেখেছ লিচুগাছের ডালে কে যেন ধবধবে কাপড় পরে দাঁড়িয়ে আছে, জানালা দিয়ে ঐ মগডালের দিকে তাকিয়ে দেখো না।
ঊষা বুঝিল, ইহা মিথ্যা কথা সে বড় ভীতু বলিয়া মনোময় মিছামিছি ভয় দেখাইতেছে। তবু তাকাইয়া দেখিবার সাহস হইল না, সে চোখ বুজিল। কিন্তু চোখ বুঝিয়া আরও মনে হইতে লাগিল, যেন সাদা কাপড় পরিয়া তাহার মেজ জা একেবারে চোখের সামনে ঘুরঘুর করিয়া বেড়াইতেছে না এই বাড়িতে মেজ জা গিয়াছেন, চৈত্রে চৈত্রে এক বৎসর হইয়া গিয়াছে, লিচুতলা দিয়া তাহাকে শ্মশানে লইয়া গিয়াছিল।
ঊষা এমন করিয়া আর চোখ বুজিয়া থাকা বড় সুবিধাজনক বোধ করিল না একবার ভাবিল—তাকাইয়া সন্দেহটা মিটাইয়া লওয়া যাক, মিছা কথা তো নিশ্চয়ই—ভূত না হাতি সাহস করিয়া সে চোখ খুলিল, কিন্তু তাকাইয়া দেখা বড় সহজ কথা নয়। ক্যাঁচক্যাঁচ কটকট করিয়া বাঁশবনের আওয়াজ আসিতেছে, তাকাইতে গিয়া কী দেখিয়া বসিবে তাহার ঠিক কী? মনোময়ের উপর আরও রাগ হইতে লাগিল। এতক্ষণে ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া জ্বালাইল, এখন জাগিয়া উঠিয়াও এমন করে!
উঠিয়া তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করিতে গেল, অমনি মনোময় খপ করিয়া তাহার হাত ধরিয়া বসিল।
—ও কী? কী হচ্ছে? এই গরমে জানালা বন্ধ করলে টিকব কী করে?
ঊষা বলিল—আমার শীত করছে।
মনোময় বলিল—বোশেখ মাসে শীত কি গো?
ঊষা বলিল—শীত করে না বুঝি! কখন থেকে একলা একলা খোলা হাওয়ায় পড়ে আছি।
ঊষার গলার স্বর ভারী-ভারী।
মনোময় বলিল—আচ্ছা, আমি জানালার দিকে শুই—তুমি এই দিকে, কেমন?
ঊষা কহিল–থাক, থাক—আর দরদে কাজ নেই।
দু-ফোঁটা চোখের জল গড়াইয়া আসিয়া মনোময়ের গায়ে পড়িল।
মনোময় শুনিল না—বালিশ দুটাকে এক পাশে ফেলিয়া জোর করিয়া ধরিয়া ঊষাকে ডানদিকে সরাইয়া দিল। ঊষা আর নড়িল না, শুইয়া রহিল। একেবারে চুপচাপ।
খানিকক্ষণ পরে মনোময় ডাকিল—ওগো!
ঊষা খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
মনোময় জিজ্ঞাসা করিল—হাসছ কেন?
ঊষা বলিল—ঘুমুচ্ছিলে যে বড়!
মনোময় কহিল—তুমি যে রাগ করেছিলে বড়! এমন ভয় দেখিয়ে দিলাম।
ঊষা বলিল না, তুমি বড্ড খারাপা অমন ভয় আর দেখিও না। আমি সত্যি সত্যি যেন দেখলাম, সাদা কাপড়-পরা মেজদিদির মতো কে একজন। এখনো বুক কাঁপছে। তুমি সরে এসো—বড্ড ভয় করে।
ভাব হইয়া গেল।
টং।
বড় জায়ের ঘরে ক্লক আছে, নিশুতি রাত্রে তাহার শব্দ আসিল।
মনোময় বলিল—ঐ একটা বাজল—আর বকে না, এবার ঘুমানো যাক।
ঊষা বলিল—একবার আওয়াজ হলেই বুঝি একটা বাজবে! উঃ, কী বুদ্ধি তোমার! বাজল এই মোটে সাড়ে ন-টা।
মনোময় বলিল—সাড়ে নটা বেজে গেছে সাড়ে তিন ঘণ্টা আগে।
ঊষা বলিল, না হয় সাড়ে দশটা, তার বেশি কক্ষনো নয়।
মনোময় বলিল—তারও বেশি! আচ্ছা দেশলাই জ্বালো, আমার হাতঘড়িটা দেখা যাক।
ঊষা তবু তর্ক ছাড়িল না।
—তা বলে এর মধ্যে একটা বাজতেই পারে না।
মনোময় বলিল—আলোটা জ্বালো আগে।
—জ্বালি। তুমি বাজি রাখো, হেরে গেলে আমায় কী দেবে?
মনোময় বলিল—যা দেব তা এখনো দিতে পারি—মুখটা এদিকে সরাও।
ঊষা বলিল—যাও!
দেশলাই ধরাইয়া কুলুঙ্গির মধ্য হইতে হাত-ঘড়ি বাহির করিয়া দেখা গেল, কাহারও কথা সত্য নয়—একটা বাজে নাই, আড়াইটা বাজিয়া গিয়াছে।
সর্বনাশ! ঊষা শঙ্কিত হইয়া পড়িল। আবার খুব সকালে সকলের আগে উঠিতে হইবো না হইলে রাধারানী নামক এক খুদে ননদী আছে, সে উহাকে খেপাইয়া মারিবে।
বিছানায় স্বচ্ছ জ্যোৎস্না চাঁদ অনেক নামিয়া পড়িয়াছে। ঊষা হঠাৎ জাগিয়া ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল। আগে বুঝিতে পারে নাই। শেষে দেখিল তখনো ভোর হয় নাই। ভালো হইয়াছে, সেজ জা ও রাধারানীকে ডাকিয়া তুলিয়া রাত থাকিতে থাকিতেই ননদ-ভাজে মিলিয়া বাসন। মাজা গোবর-ঝাঁট দেওয়া ও আর সকল কাজ সারিয়া রাখিবে, শাশুড়ি সকালে উঠিয়া দেখিয়া একেবারে অবাক হইয়া যাইবেন।
খাট হইতে নামিয়া দাঁড়াইয়া আগের রাত্রির কথাগুলি ভাবিতে ভাবিতে ঊষার হাসি পাইল। বাপরে বাপ, মানুষটি এত ঘুমাইতে পারে, এখনো বেহুশ! আগে ভালো করিয়া দেখিয়া লইল, মনোময় সত্যসত্যই ঘুমাইয়াছে কি-না, তারপর চুপিচুপি তাহার পায়ের গোড়ায় প্রণাম করিল। এ কয়দিন রোজ সকালেই সে প্রণাম করে, কারণ গুরুজন তো! রাত্রে ঘুমের ঘোরে কতবার গায়ে পা লাগে। তবে মনোময়কে চুরি করিয়া কাজটা করিতে হয়, সে জানিতে পারিলে ঠাট্টায় ঠাট্টায় অস্থির করিয়া তুলিবো।
মনোময়ও একটু পরে জাগিল। তাকাইয়া দেখে, পাশে ঊষা নাই। আকাশে তখন চাঁদ আছে। কি কাজে হয়তো বাহিরে গিয়াছে, ঘুমের ঘোরে এমনি একটি যা-তা ভাবিয়া সে আবার ঘুমাইয়া পড়িল।
সকালে জাগিয়া উঠিয়াও পাশে ঊষাকে দেখিতে পাইল না। তাহাতে অবশ্য আশ্চর্য নাই, রোজ সকালেই ঊষা অনেক আগে উঠিয়া যায়। সেলফ হইতে দাঁতন লইতে গিয়া মনোময় দেখিল, টেবিলে প্যাডের উপর ঊষার হাতের লেখা চিঠি রহিয়াছে। রাত্রে বসিয়া বসিয়া কী লিখিতেছিল বটে!
উষা লিখিয়াছে:
তোমার কোনো দোষ নাই। তুমি আমার জন্য কতই যন্ত্রণা সহিয়াছ। তুমি কতই বিরক্ত হইয়াছ। এই পৃথিবী হইতে অভাগিনীর চিরবিদায়। জন্মান্তরে দেখা হইবে, যাই।
ইহার পরে ‘প্রাণেশ্বর’ কথাটা লিখিয়া ভালো করিয়া কাটিয়া দিয়াছে। ঊষার পেটে পেটে যে এত তাহা মনোময় জানিত না। এরূপ লিখিবার মানে কী?
যাহা হউক সে বাহিরে গেল। অন্যদিন ঊষা এই সময়ে রান্নাঘরের দাওয়া নিকায়। আজ সেখানে নাই। এবার একটু শঙ্কা হইল। মেয়েরা তো হামেশাই আত্মহত্যা করিয়া বসে, যখন তখন শুনিতে পাওয়া যায়। খিড়কির পুকুর বেশি দূরে নয়, জলও গভীর। কিন্তু কী কারণে ঊষা যে এত বড় সাংঘাতিক কাজ করিবে, তাহা বুঝিতে পারিল না। রাত্রে ঘুমের ঘোরে হয়তো সে কী বলিয়াছে। আনাচ-কানাচ সকল সন্দেহজনক স্থান দেখিয়া আসিল, উষা কোথাও নাই। এমন। মুশকিল যে একথা হঠাৎ মুখ ফুটিয়া কাহাকে জানাইতে লজ্জা করে। পোড়ারমুখী রাধারানীটাও সকাল হইতে কোথায় বাহির হইয়াছে যে তাহাকে দুটা কথা জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিবে!
অবশেষে মনোময় বড় বউদিদির ঘরে ঢুকিল। সে-ঘর ইতিপূর্বেই একবার খুঁজিয়া দেখা হইয়াছে।
বড়বধূ বিছানা তুলিতেছিলেন, বোধ করি মনোময়ের গতিবিধি লক্ষ করিয়া থাকিবেন, হাসিয়া বলিলেন—হারানিধি মিলল না? না ভাই, আমি চোর নই। ঘর তো আমাদের অজান্তে একবার দেখে গিয়েছ, এইবার বিছানাপত্তর ঝেড়েঝুড়ে দেখাচ্ছি—এর মধ্যে মেরে রাখিনি।
মনোময় বলিল—ঠাট্টার কথা নয় বউদি, ছোট বউ কোথায় গেল বলো দিকি? এই দেখো চিঠি।
বলিয়া চিঠিখানা দেখাইল।
চিঠি পড়িয়া বড়বধূ গম্ভীর হইয়া গেলেন। বলিলেন—কী হয়েছিল বলো তো—এ তো ভয়ের কথা!
মনোময় প্রতিধ্বনি করিল—সাংঘাতিক ভয়ের কথা।
—তোমার দাদাকে বলি তবে?
বিমর্ষ মুখে মনোময় কহিল—না বলে উপায় কী?
বড়বধূ বলিলেন—ভালো করে খুঁজে-টুজে দেখেছ তো?
—কোথাও বাকি রাখিনি, বউদি।
—গোয়ালঘর, সিঁদুরে আমতলা?
—হুঁ।
—চিলেকোঠা?
—হুঁ।
—তোমার নিজের ঘরে? সিন্দুকের তলায় কি বাক্সের পাশে? দুষ্টুমি করে লুকিয়ে-টুকিয়ে থাকতে পারে।
মনোময় বলিল—তা-ও দেখেছি, তন্নতন্ন করে দেখেছি।
বড়বধূ হতাশভাবে বলিলেন—তবে কী হবে? আচ্ছা, সিন্দুকের ভিতরে, বাক্সের ভিতরে?
বলিতে বলিতে হাসিয়া ফেলিলেন।
মনোময় মাথা নাড়িয়া বলিল—বউদি, ব্যাপার কিন্তু সহজ নয়।
বড়বধূ বলিলেন—নয়ই তো! আচ্ছা এসো তো আমার সঙ্গে, আমি একটু দেখি।
বলিয়া মনোময়কে সঙ্গে করিয়া রান্নাঘরের দাওয়ায় উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—এ ঘরটা দেখেছ?
এত সকালে রান্নাবান্না নাই—এ ঘরে আসিবে কী করিতে?
কিন্তু ভিতরে ঢুকিয়া দেখিল, থালার উপর লঙ্কা ও লবণ সহযোগে কাঁচা আম জারানো হইয়াছে। মুখোমুখি বসিয়া ঊষা ও রাধারানী নিঃশব্দে মনোযোগের সহিত আহার করিতেছে। মনোময়কে দেখিয়া ঘোমটা টানিয়া দিয়া ঊষা হাত গুটাইয়া লইল। রাধারানী হাসিয়া উঠিল।