বাইরে বৃষ্টি। উঠোনজুড়ে কয়েকদিনের অবিরাম বৃষ্টির জলে সাঁতার কাটছে সকাল-দুপুর-বিকেল। গাছের পাতাগুলো থেমে আছে স্থিরচিত্রের মতো। বিতৃষ্ণা জমে আছে শিরা-উপশিরায়। সবাই ক্লান্ত, ছন্দহীন।
একটি কুকুর উঠোনের এককোণে ছাউনির নিচে দীর্ঘসময় কর্মহীন বসে থেকে কী ভেবে ঠিক এক মুহূর্তে উঠে আড়মোড়া ভেঙে দাঁড়ালো। এমন অবস্থায় তাকে একটি উল্টো ও সচল ডিঙ্গি নৌকা মনে হলো। বৃষ্টিতে নেমে কয়েকটি ফোঁটা গাঁয়ে তুলে ভেজা লোমগুলো নাড়া দিয়ে চারদিকে জল ছিটিয়ে দৌড়াতে শুরু করলো। চলে যেতে যেতে কুকুরটির ডানে-বামে নড়তে থাকা লেজ সবচেয়ে বেশিক্ষণ দৃষ্টি দখল করেছিল। সেই লেজটিও একপর্যায়ে আর দেখা গেল না। শুধু দৃষ্টিটুকু আটকে রইল উঠোনের কোণে বাঁশের আড়ে ঝুলে থাকা জবজবে ভেজা একটি স্যান্ডু গেঞ্জিতে।
বৃষ্টির একটানা শব্দের রেশ কানে লেগে আছে এখনো। এই ছন্দকে টিনের চালে দ্রুতগতিতে চালিয়ে যে একটি কাল্পনিক আবহ তৈরি হয়, ব্যাকগ্রাউন্ডে তার মতোই কিছুটা সামঞ্জস্যপূর্ণ শব্দ ছিল তখন। বাইরে যখন এমন অবস্থা, তখন ভেতরে কী চলছে একপলকে দেখে আসা যাক।
ঘর! মানে এই মুহূর্তে যেখানটাতে ‘মা’ চরিত্রটি অবস্থান করছেন। এতক্ষণ তাঁর চোখেই দেখছিলাম পরিবেশের এতসব। এবার একইসঙ্গে তাকেও দেখা হবে অন্য কোনো পর্যবেক্ষণের চোখে।
একটি পরিবার। এমন সংকটাপন্ন পরিবারগুলো দেখার চর্চা আমাদের বহুদিনের। এ পরিবারটির বর্তমান অবস্থার সঙ্গে একটি তুলনামূলক সাদৃশ্য পাওয়া যাবে একটু আগে বাইরে থেকে দেখে আসা জরাজীর্ণ বৃষ্টিভেজা স্যান্ডু গেঞ্জিটির। হাতে নিলেই খসে পড়বে সুতার বাঁধন। তখন আর একে গেঞ্জি বলা যাবে না। বলব ত্যানা!
সপ্তাহখানেক আগে উঠোনের কোণে বাঁশের আড়ের ওপর রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছিল ধবধবে সাদা রঙের এই গেঞ্জিটি। একটু আগে যখন অলস কুকুরটি আড়মোড়া ভেঙে উঠে উঠোনের পথ ধরে যাচ্ছিল, সেদিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ এলো বস্তুটিতে। কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে হাতেই নিতেই খুলে খুলে কাপড়ের টুকরোগুলো চলে এলো মাহমুদার হাতে।
মাহমুদা কাপড়ের ভেজা ও ছেঁড়া টুকরোগুলো হাতে নিয়ে ঘরে ফিরে গেলে গেঞ্জিটি তাকে ফ্ল্যাশব্যাক করে পেছনের স্মৃতির দিকে টেনে নিয়ে যায়।
এ পর্যায়ে গেঞ্জিটি আর গেঞ্জি থাকল না, সেটি হয়ে উঠল একটি স্মৃতিসংবেদী মায়াজাল। জালের মধ্যে একে একে আটকা পড়তে লাগলো অনেক চরিত্রের সমন্বয়ে সময়লিপি।
গত মাসে বাড়ির প্রাক্তন প্রধান কর্তা গেঞ্জিটি নিজের জন্য কিনেছিলেন। ব্যবহারও করেছিলেন কিছুদিন। ময়লা হয়ে গেলে কয়েকদিন আগে তিনি নিজ হাতে ধুয়ে রোদে শুকাতে দিয়ে গিয়েছিলেন।
গেঞ্জিটি আর ঘরে ফিরতে পারেনি। প্রতিদিন রোদে শুকিয়েছে, বৃষ্টিতে ভিজেছে। কারোরই নজরে আসেনি এ কয়দিন। তার সুনিপুণ ও শৈল্পিক বন্ধন একে একে আলগা হচ্ছিল তখন। সাদা রং কেমন কালচে ও বর্ণবিদ্বেষী হয়ে উঠল একসময়। সামান্য শ্যাওলা জমে আঠালো ও পিচ্ছিল হলো তার শরীর। স্পর্শেই খসে পড়ার উপক্রম! এভাবে একটি ত্যানা হওয়ার ইতিহাসে অংশ নিল সে।
আচ্ছা, এতক্ষণ কী ভাবছেন মাহমুদা?
তার হাতে ধরে থাকা ত্যানাসূত্রে তিনি অশ্রুসিক্ত।
একটি পরিবারের দীর্ঘ পরিভ্রমণ তাকে নিয়ে এসে থামিয়ে দিল স্বামীর দুর্ঘটনা পরবর্তী পাল্টে যাওয়া দৃশ্য পরম্পরায়।
২.
এ বাড়ির কর্তা আজ সপ্তাহখানেক অবচেতন হয়ে পড়ে আছেন হাসপাতালের বিছানায়।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের স্বীকারোক্তি বলছে, ‘চেতনা পুরোপুরি ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। চিকিৎসা চালিয়ে গেলে অনন্ত দু-তিন মাস তাকে এভাবে অচেতন অবস্থায় বাঁচিকে রাখা সম্ভব। কিন্তু তাতে লাভ কী? বাড়াবাড়ি কিছু পয়সা খরচ হবে আর কি!’
হ্যাঁ, ঠিক তাই। তার মতো এই প্রশ্নটি অনেকেরই। তবে ডাক্তারের মতো নির্বিকারে কারও কণ্ঠে আসেনি—এই যা পার্থক্য।
অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ এ চিকিৎসা চালাতে গেলে কর্তার জীবনভর কার্পণ্যের বিনিময়ে অর্জিত সঞ্চয়ের কিছু টাকা ছাড়া আর বিকল্প পথ নেই। এই কটা টাকাও ইতোমধ্যে তার অনুপস্থিতিতে উত্তরাধিকারদের মালিকানার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। কোথায় কিভাবে খরচ করা হবে, তার সিদ্ধান্ত দাঁড়িয়ে আছে তিন সন্তানের সম্মিলিত মতামতের ওপর।
বাবার চিকিৎসা চালানো হবে কি না—তার পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনায় বড় ছেলে বলেছে, ‘বাবা সারাজীবনে আমাদের জন্য তেমন কিছু তো করতে পারলেন না, শেষপর্যন্ত এ কটা টাকাও যদি…।
মেজ ছেলে বড়ভাইয়ের কথা অর্ধেক থেকে টেনে নিয়ে সংযুক্ত করে বলল, সামনে আমার চাকরির পরীক্ষা। আর জানোই তো, এই যুগে টাকা ছাড়া চাকরিবাকরি হয় না! ছোট ছেলে এ ব্যাপারে কোনো কথা বলল না। এই নীরবতারও নিশ্চয়ই কোনো অর্থ থাকবে।
তাদের বক্তব্য একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে এলে এ ব্যাপারে মায়ের অভিমত জানতে চাইল তারা।
মাহমুদা শুধু ছেলেদের কথায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়েছিলেন। কিছু বলার শক্তি ও উৎসাহ কোনোটাই ওঠেনি তার কণ্ঠে। তিনি একটি বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে বোধশূন্য দৃষ্টিতে স্তম্ভিত হয়ে দেখছিলেন ওদের।
দুটি ঝাপসা চোখ বিপুল বিস্ময়ে তখন কিছু একটা খুঁজে চলছিল।
৩.
আজ অনেকদিন পর ঘরে ফিরেছেন তিনি। কিছু কাজ সেরে বিকেলের মধ্যেই মাহমুদা আবার ফিরে যাবেন হাসপাতালে। খুব বেশি না, আর বড়জোর দু’তিনদিন ছুটতে হবে হয়ত।
কাপড়ের টুকরোগুলো হাতে নিয়ে এতকিছু ভাবতে ভাবতে বাইরে হঠাৎ হাঁস-মুরগির চেঁচামেচির শব্দ শুনলেন তিনি। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সন্ধ্যা-সন্ধ্যা এখন। ছোট ছোট বৃষ্টির ফোঁটা ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে।
পোষা রাজহাঁসটি দূর থেকে উঁচুস্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। মাহমুদার আশ্রয় পেয়ে হাঁসটি কোলের মধ্যে ঢুকে পড়ল আহ্লাদে। শাড়ির ভাঁজের মধ্যে জড়িয়ে গেল গোঙ্গানির মতো শব্দ করে। মাহমুদা তাকে কোলের ওপর তুলে নিলেন। একি অবস্থা ওর! চোয়ালের কাছাকাছি ক্ষতবিক্ষত। ফুলে মোটা হয়ে আছে, রক্ত ঝরছে। রক্তের ধারায় লাল হয়ে গেছে গলার কাছে সাদা রঙের মসৃণ পালকগুলো। ভিজে একাকার হয়ে আছে।
এই হাঁসটি মাহমুদার বিশেষ প্রিয়। তিনি একে ‘আদর’ নামে ডাকেন। আদর বলে ডাকলেই হাঁসটি মাথা উঁচু করে রাজসিক ভঙ্গিতে তার সামনে এসে দাঁড়াতো। দেখে খুব আনন্দ হতো মাহমুদার, যেন প্রচণ্ড বুদ্ধিমান কেউ একজন তার সামনে। যার সঙ্গে সহজে ভাষা ও অনুভূতি বিনিময় করা যায়। তিনি অনর্গল কথা বলে যেতেন রাজহাঁসটির সঙ্গে। হাঁসটিও তার কথার প্রত্যুত্তর দিত বিভিন্ন আকারে ইঙ্গিতে। মাহমুদা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে অনুভূতি পাঠ করার চেষ্টা করলেন। ঠিক একই দৃষ্টিতে হাঁসটিও তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখে টিপটিপ করেছে জল, টোকা পেলেই ঝরে পড়বে। সহানুভূতির আকুতি মিশে আছে স্বচ্ছ চোখের গভীরে। কিছুক্ষণ নীরবে দৃষ্টির কথোপকথন হলো তাদের। মাহমুদা হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন ক্ষতস্থানটি। ঠিক চোয়ালের কাছে বড় ও বীভৎস ক্ষত। এখনো রক্ত ঝরছে। এটুকু সময়ের মাঝেই জমাট বেঁধে নরম পালকের সঙ্গে শক্ত হয়ে গেছে। স্পষ্টত হাঁসটির বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই—এই বাক্যহীন নিষ্ঠুর বোধের মুখোমুখি মাহমুদা। গলার এমন এক যায়গায় জখম যে, কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পড়বে।
৪.
ছোট ছেলে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে। মাকে কোনো প্রয়োজনে ডাকছিল এতক্ষণ। সাড়াশব্দ না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে চলে এলো এদিকে।
ইশ! কিভাবে হলো এটা? মা তোমার প্রিয় রাজহাঁসটি না? খুব উত্তেজিত স্বরে বলল।
সে এসে দেখল রাজহাঁস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাকে। আরও কাছে এগিয়ে এলো।
একে তো বাঁচানো যাবে না দেখছি । ওহহহ!
মা! বেজি কামড়েছে না?
মাহমুদা কোনো জবাব দিলেন না। নির্বিকারে একটি মমতার হাতে হাঁসের নরম পালকগুলো নেড়ে যাচ্ছেন।
কোথায় ছিল?
পাশের ঝোপের দিকে ইঙ্গিত করে দেখালেন তিনি।
যাক, তা-ও ফিরে এসেছে! বর্ষাকালে এই দিকে বেজির উৎপাত এত বেড়ে যায়!
তুমি একটু দাঁড়াও! আমি ঘর থেকে দা নিয়ে আসছি। এখনই জবাই করে দেই।
সে ঘরের দিকে চলে যাচ্ছে দা নিয়ে ফিরে আসার জন্য। মাহমুদা ছেলের গতিশীল মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন পলকহীন। এভাবে তিনি শূন্যদৃষ্টি নিয়ে আরও একদিন তাকিয়েছিলেন তার তিনছেলের মুখের দিকে।
মাহমুদার চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে এলো। চোখে পর্যাপ্ত আলোর অভাব বোধ করলেন তিনি।
আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করে দেখলেন, ছেলের মুখটি প্রিয় রাজহাঁসকে আক্রমণ করা অবিকল একটি ঘাতক বেজি।