অঞ্জন অপেক্ষা করছে কখন ওর ঘুম ভাঙবে। কারণ ও জানে—যা কিছু ঘটছে, সব ওর স্বপ্নের ভেতরেই ঘটছে।
অঞ্জন নিশ্চিত ও এখনো ঘুমিয়ে আছে। কবে যেন অঞ্জন শুনেছিল, স্বপ্নের রঙ থাকে না। এখন যা কিছু ঘটছে, কোনো কিছুর রঙ ও আলাদা করতে পারছে না। এটা স্বপ্নদৃশ্যই। তাই সব রঙ হারিয়ে গেছে। না, অঞ্জন ভুল ভাবছে। মৌলিক রঙ তিনটা ঠিকই আছে। ওই যে, মায়ের কপালের সিঁদুর টিপ, পরনের শাড়ির সবুজ আর নীল ফুল—সব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কী ফুল ওগুলো? দৃষ্টি প্রসারিত করে অঞ্জন। সবুজ লতার মাঝে নীল অপরাজিতার থোকা। দুয়েকটা লাল জবাও আছে আঁচলে।
সেই স্কুলে থাকতে অঞ্জন বিজ্ঞান বইয়ে পড়েছিল, মৌলিক রঙ তিনটি—লাল, সবুজ আর নীল। কিন্তু রঞ্জন ভিন্ন কথা বলে। রঞ্জন তো ছবি আঁকে। ও বলে—লাল, হলুদ আর নীল মৌলিক রঙ। অঞ্জন অবশ্য সামনে হলুদের উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছে না। বাবার পরনের গতকাল রাতেও হলুদ রঙের ফতুয়া ছিল, এই মুহূর্তে বাবার পরনে বর্ণহীন ফতুয়া।
অঞ্জন জানে, রঙ বিষয়টাই কল্পনা। মানুষের চোখ লাল, সবুজ ও নীল রঙের প্রতি বেশি সংবেদনশীল বলেই এগুলো মৌলিক রঙ। এই মুহূর্তে ওর সামনে মায়ের শরীরে ধারণ করা মৌলিক রঙ ছাড়া বাকি সবকিছুই রঙহীন। অবশ্য রঙহীন হলেও চৌদিকের জিনিসপত্রের অবয়ব খুব স্পষ্ট। অদ্ভুত এক কারসাজি চলছে যেন।
ওই তো ওদের বাড়ি ঘিরে তোলা রিয়াজুদ্দিন প্রামানিকের বাঁশের বেড়ার প্রতিটা খাঁজ দেখা যাচ্ছে। এমনকি কলপাড়ে হেঁটে বেড়ানো মায়ের আদরের ঝুঁটিওয়ালা রাগি মোরগটাকে পর্যন্ত স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। চোখ দুটো আরও প্রসারিত করলে উঠানের দক্ষিণ প্রান্তে পড়ে থাকা বাবার হাত দা-খানাও চোখে পড়ছে।
অঞ্জন জানে, রঙের কারসাজি বলে কিছু নেই। আলোক তরঙ্গের দৈর্ঘ্য বা কম্পাঙ্কের ভিন্নতা ওর মস্তিষ্ককে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় উদ্দীপ্ত করে সামনের দৃশ্যটাকে শুধুমাত্র মৌলিক রঙেই রাঙিয়ে তুলছে। আসলে সামনের দৃশ্যটা বাস্তব জীবনে রঙের উপস্থিতির মতোই অবাস্তব আর কাল্পনিক।
আর তার খণ্ডিত মাথার ঠিক পাশেই মায়ের আদরের ঝুঁটিওয়ালা রাগি মোরগটা দাঁড়িয়ে আছে।
অঞ্জনের স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো। এখনো গড়গড় করে পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের অনেককিছু বলে দিতে পারে। অথচ এইচএসসিতে আর্টস নিয়েছে ও। অঞ্জন গণিতে একেবারে কাঁচা। কাঁচা মানে পাস করাই মুশকিল ছিল ওর জন্য তাই মুখস্থ ক্ষমতা থাকার পরও হাসিব স্যারের পরামর্শে সায়েন্স বা আর্টস কোনোদিকেই ও যায়নি। কোন সন্তান কোন বিষয়ে পড়বে—অঞ্জনের বাবা-মা এসব বোঝে না। তারা শুধু একটাই স্বপ্ন দেখেন, হাসিব স্যারের ছেলে আসিফের মতো অঞ্জন বা রঞ্জন একদিন উকিল বা বিচারক হবে। তাহলে জমিজমা নিয়ে সৃষ্ট ঝামেলাগুলো সহজেই ফয়সালা করতে পারবে। এই কারণে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একজন উকিল বা বিচারক থাকা দরকার—প্রতিদিন অন্তত একবার অঞ্জনের বাবা কথাটা বলে।
আজও বলেছে। হ্যাঁ, ওদের বাড়ির পশ্চিমপাশে বাঁশের খুঁটি গেঁড়ে রিয়াজুদ্দিন প্রামানিক যখন বেড়া দিতে শুরু করেছিল তখনই বাবা কথাটার পুনরাবৃত্তি করেছে।
রিয়াজুদ্দিন প্রামানিকের কল্যাণে উকিল, বিচারক, কোর্ট-কাচারি, জমিজমার দাগ, খতিয়ান, মৌজা, জে.এল. নম্বর সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা হয়েছে বাবার। শুধু বাবার কেন, অঞ্জন আর রঞ্জনও এখন জানে কোন ধারায় জামিন পাওয়া যায়, কোন ধারায় জামিন পাওয়া যায় না।
রিয়াজুদ্দিন প্রামানিকের দায়ের করা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের একশ চুয়াল্লিশ ধারার মামলাসহ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের দুই দুইটা ফৌজদারি মামলায় হাজিরা দিতে দিতে ওরা এসব জ্ঞান লাভ করেছে। এর মধ্যে জামিন অযোগ্য ধারায় আনা চাঁদাবাজির মামলায় এক সপ্তাহ হাজতবাস করার কারণে অঞ্জন চাকরির একটা মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি।
বেড়া তোলার সময় একবার তর্জনি তুলে শাসিয়েছে রিয়াজুদ্দিন প্রামানিক। বলেছে, মামলায় সাজা খাটিয়ে অঞ্জন, রঞ্জনের চাকরি-বাকরি না হওয়ার স্থায়ী ব্যবস্থা করে দিবে। এসব কথা শুনে অঞ্জনের মা উথাল-পাতাল কেঁদেছে। তবু বেড়া তৈরির কাজ থামায়নি রিয়াজুদ্দিন প্রামানিক।
ওরা দশ জন ছিল। রাতারাতি বাড়ির চারদিকে বেড়া তুলে এখন বিরতি দিয়েছে। এখন অঞ্জনদের বাড়ির কেউ বাইরে যেতে পারবে না। বাড়ির পূর্বদিক দিয়ে চলে যাওয়া সরকারি সড়ক পর্যন্ত ডিঙাতে পারবে না। এমনকি বাড়ির পেছনের ল্যাট্রিনেও যেতে পারবে না। যেতে হলে রিয়াজুদ্দিন প্রামানিকের তোলা বাঁশের বেড়া ডিঙাতে হবে। ল্যাট্রিনের কথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা বিপত্তি ঘটে। অঞ্জনের তলপেটে চাপ লাগে। ওর মনে হতে থাকে এই মুহূর্তে একঘড়া জল বের হতে না পারলে রীতিমতো কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। কিন্তু স্বপ্নে কি প্রস্রাবের বেগ অনুভূত হয়? কই বিজ্ঞান বইয়ে এমন কিছু লেখা ছিল বলে তো অঞ্জন মনে করতে পারছে না। ছিল কি?
অঞ্জনকে হতচকিত করে হঠাৎ দড়াম করে একটা শব্দ হয়। শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে অঞ্জন দেখতে পায় সিনেমার শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্যের মতো বাবা বুকে হাত চেপে ধরে উঠানে লুটিয়ে পড়ছে। আহা…বাবা ব্যথা পেলো তো! উঠতেও তো পারছে না বাবা! কিন্তু কেউ যাচ্ছে না কেন বাবার কাছে? রঞ্জন কোথায় রঞ্জন?
অঞ্জন তো ঘুমাচ্ছে! ওই তো রঞ্জনকে দেখা যাচ্ছে। রঙহীন বিবর্ণ রঞ্জন। রঞ্জনের শার্টও রঙহীন। অন্য সময় তো ওর শার্টের বুকে, হাতায় হরেক রঙ লেগে থাকে। এখন কিছু নেই। তাহলে এসব যা কিছু ঘটছে, সব অঞ্জনের ঘুমের ভেতরেই ঘটছে। অঞ্জন হালকা একটা শ্বাস ফেলে। রঞ্জন বাবার কাছে ছুটে গেছে। ও এখন চিৎকার করছে, ‘অঞ্জন…তাড়াতাড়ি আয়…বাবাকে হাসপাতালে নিতে হবে…অঞ্জন, বেড়া ভাঙ। হাত দা-টা নে। অ্যাই অঞ্জন…অঞ্জন রে…’
অঞ্জন না ছুটে অপেক্ষা করে। ও জানে, বাস্তবে এসব কিছুই ঘটছে না। ওই যে বাবার পাশে মায়ের অস্থির দেহটা কাঁপছে, কাঁপতে কাঁপতে নুয়ে পড়েছে মাটিতে। রঞ্জন বিকট স্বরে চেঁচিয়ে চলছে, ‘বেড়া ভাঙ অঞ্জন। উপড়ে ফেল সব। দা দিয়ে কোপ মার!’ এসবের কিছুই বাস্তবে ঘটছে না।
এবার উঠান থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয় অঞ্জন। প্রায় ঘনিয়ে আসা রাতের মতো সবকিছু কেমন ফিকে হয়ে আসে। অঞ্জনের কেবলই মনে হতে থাকে, এবার ওর ঘুম ভেঙে যাবে। স্বপ্ন দৃশ্যেরও পরিসমাপ্তি ঘটবে। অঞ্জনের চিল চিৎকার স্তব্ধ হবে। মায়ের নিরানন্দ মুখ উজ্জ্বল হবে। বাবা লোভী কণ্ঠে বলে উঠবে, ‘আইন পড়া দরকার। পরিবারে একজন উকিল নইলে বিচারক দরকার।’
অঞ্জন অপেক্ষা করে কখন ওর ঘুম ভাঙবে। কারণ ও জানে যা কিছু ঘটছে সব ওর স্বপ্নের ভেতরেই ঘটছে।
হঠাৎ ‘অঞ্জনরে…’ ব্যাকুল স্বরে রঞ্জন ডেকে উঠতেই ঘাড় ঘোরায় অঞ্জন। তখনই আজানের ধ্বনি ভেসে আসে। কোন ওয়াক্তের নামাজের সময় হলো ঠাহর করতে না পারলেও অঞ্জন এবার সব রঙ পষ্ট দেখতে পায়। দেখতে পায়, একটা দা হাতে রঞ্জন দাঁড়িয়ে আছে, ওর টিয়া রঙের শার্টের বুকে লাল ছোপছাপ আঁকা।
উঠানে এখন আর বাবা শুয়ে নেই, বাবার বদলে ওখানে পড়ে আছে রিয়াজুদ্দিন প্রামানিকের দেহের লাল খয়েরি খণ্ড। আর তার খণ্ডিত মাথার ঠিক পাশেই মায়ের আদরের ঝুঁটিওয়ালা রাগি মোরগটা দাঁড়িয়ে আছে।