আমি অনেক গল্প খুঁজি। হ্যাঁ, অনেক গল্প। এই ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে খুঁজে বেড়াই গল্প। গল্প আমার হৃদয় আন্দোলিত করে। মনকে সজীব করে। দুঃখ, যাতনা, ব্যথা, যন্ত্রণা, হতাশা-সব দুমড়ে মুচড়ে পানির মতো গলে যায় গল্প শুনলে।
এই তো গতকাল বাসে যাচ্ছিলাম। বাসে বসে অনেক যাত্রীর গল্প শুনছিলাম। শুধু বাসে নয়, দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই গল্প শুনি। হাটে, ঘাটে, মাঠে, শপিংয়ে, অফিসে, স্টার সিনেপ্লেক্সে, বন্ধুদের আড্ডায়, প্রেমিকার কাছে, পত্র-পত্রিকায়, টেলিভিশনে-হ্যাঁ, সবখানে, সবার কাছে গল্প শুনি।
অতি সম্প্রতি কয়েকটি গল্প পথে যেতে যেতে শুনছিলাম।
১.
-ভাই, আপনাকে একটা প্রশ্ন করি, আপনার বাসা কই?
-কেন? ঢাকায়।
-না, মানে আপনাকে পেছন থেকে আমার এক ভাইয়ের মতো দেখতে মনে হলো। জানতে চাইলে কী মনে করেন এজন্য বলতে চাইছিলাম না।
-হা হা হা, এই তো জানলেন।
-ধন্যবাদ।
-আপনার নাম?
-সাবের।
-ভালো থাকুন।
২.
-হ্যালো, কথা শোনা যাচ্ছে? তুমি বাড়ি যাওয়ার পর আর ঠিকমতো ফোন-ই দিচ্ছ না। ঠিকমতো কথা বলছ না। তোমার যদি কথা বলতে ইচ্ছে না করে, তাহলে বলে দাও।শুধু শুধু এভাবে থাকার মানে হয় না। করোনাকাল শেষ হয়ে যাচ্ছে।
৩.
-তোমারে বারবার বলছি কারো সাথে জড়াবা না। যদি কখনো শুনি তোমারে সাইজ করে ফেলবো। বাস থেকে নেমে সোজা বাসায় গিয়ে ঘুমাবা। ঈন্দ্রানী বলল, সেদিন তুমি সন্ধ্যার সঙ্গে কফি খাচ্ছিলে। আর যেন কখনো না দেখি।
৪.
-না, আমি আজ আসতে পারব না। অফিসের কাজের ঝামেলায় আছি।
কেন? আসব? কোনো সমস্যা? ধুর আসতে পারব না।
শুধু শুধু কথা বাড়াচ্ছ।
তুই একটা ডিস্টার্ব।
৫.
-তোমাকে যা বলার আমি বলে দিছি। সিদ্ধান্ত তোমার।বিয়ে করলে করবা। না করলেও সমস্যা নেই। অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হতে চাও নো প্রোবলেম। এখন আর সেই দিন নেই যে তুমি চলে গেলে আমি মরে যাব। বন্ধু হিসেবে থাকবে। বউ ঠিক-ই মিলে যাবে। হঠাৎ ফোনটা বন্ধ হয়ে গেলো।
উহ! মাঝে মধ্যে মনে হয়, এই মিথ্যার জগতটা বাস্তবে আমাদের আরও একা করে দিচ্ছে।
৬.
‘আমার স্বামী কই? তারে আপনারা আইনা দেন। সে আমারে ফোন করে না কেন? দুই মাইয়া লই এখন কই যামু? কে আঙ্গোরে দেখবে? কোনাইতুন খানা আইবো।’
কয়েকদিন আগে চরে গেছিলাম বাদাম কিনতে। পথে নুরানীর মায়ের লগে দেখা হইতেই হাউ মাউ কেঁদে উঠলো। বাম হাতটা ধরে এই বেদনার কথা বললো নুরানীর মা নাসরিন।
৭.
পূর্ণিমার রাত। এই রাতেও আজ চোখে ঘুম আসছে না। প্রচণ্ড গরম। রাতে তিনবার বিদ্যুৎ চলে গেছে। জানালায় চোখ রাখতেই হঠাৎ একটা আলো চোখে পড়ল। মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ। মাঝে মাঝে মনে হয় আছি কেন বেঁচে? হঠাৎ শিউলির ফোন।
-হ্যালো, হ্যালো, প্রবীর আছ?
-কি ব্যাপার, এত রাতে কল দিলা?
-হ। মেজাজ খারাপ। এজন্য ফোন দিলাম।
-ধুর! কবিতা শোনাবা?
-রাত তিনটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। মুড নাই।
বাইরে ঝড় শুরু হয়েছে। আবার বিদ্যুৎ চলে গেলো। ফোনেরও নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো।
ধীরে ধীরে মেজাজটা স্থির হতে লাগল। বিছানায় শুয়ে আবারও জানালায় তাকাল প্রবীর। হুট করে এক মেয়ে জানালায় হাত ঢুকিয়ে দিতেই চুড়ির শব্দ শোনা গেল। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠতেই প্রবীর মাথা ঘুরে পড়ে গেলো।
প্রবীরের গল্পটি আপাতত ওখানেই শেষ করছি। চলুন আরও কিছু নতুন গল্প শুনি।
৮.
আজ এটাই প্রথম ট্রেন। ড্রিম লোকাল। মায়াপুর স্টেশনে সারাদিনে চারটা ট্রেন আপ-ডাউন করে। ভোরের প্রথম আলোটি ট্রেনের জানালা দিয়ে চোখে এসে পড়লো। শরীর ঝিমঝিম ভাব। বুঝে উঠতে পারছে না। ঘুমচোখে ট্রেনের কামড়া থেকে নামার পর মনে হলো এখানে কেন ?
এদিক-ওদিক তাকায়। লোকজন ট্রেন থেকে নেমে ছুটছে যে যার গন্তব্যে। কিন্তু পাপড়ি কোনকিছু ঠাহর করতে পারছে না- কী করবে সে।
সামনে আগায়। মিনিট দুয়েক হাঁটার পর দেখতে পেলো একজন হকার ভ্যানগাড়িতে ছারপোকার ওষুধ বিক্রি করছে। সে সময় কোনো ক্রেতা না থাকায় ওই হকারের কাছে যায় পাপড়ি। গিয়ে একটু পানি খেতে চায়।
-কি রে কেড়া তুই?
-ভাই দেন একটু পানি, গলাড়া শুকায়া গেছে-বলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হকারের সাউন্ড বক্সে বাজছে তখন-‘ছারপোকা, জাগায় কামড়ায়, জাগায় মরে../মাইরা ফালান, মাইরা ফালান..’।
আমি হাঁটছি। শোলার আগুন নিভে গেলো। সামনে টর্চ লাইটের আলো জ্বালিয়ে কে যেন আসছে।
হকার পানির বোতল আগায়া দিলো। বোতলটি খুব একটা পরিষ্কার নয়। পানিও মনে হলো কোনও ড্রেন থেকে আনা। কিন্তু এসব বুঝার মতো পরিস্থিতি নেই পাপড়ির। দুই ডোক পানি খেলো। এমন সময় হকার জিজ্ঞেস করলো
-কী সমস্যা তর?
ফোঁপাতে ফোঁপাতে পাপড়ি বলে
-আমি বোনকে খুঁজতে গেছি শ্যামপাড়ায়। হঠাৎ ওরা আমাকে সবাই ঘিরে ফেললো। কোনও কিছু বুঝার আগেই চোখ বেঁধে ফেললো। আমি থমকে যাই। ওরা মুখ চেপে ধরলো।
-এরপর?
-তারপর কি হলো কিছুই জানি না। এখন এই জায়গায়।
-তর বোনের কি হয়েছিলো? কেন খুঁজতে গেছিস? তর বাবা-মা কেউ আছে?
কোনও কথা আসছে না পাপড়ির। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে এক বয়ষ্ক মহিলা এলো ছারপোকার ওষুধ কিনতে। পাপড়ি পানির বোতলটা হাতে নিয়ে আবারও পানি খেতে লাগলো।
রোদ উঠছে। পাঁচ মিনিট পর ট্রেনটি স্টেশন ছেড়ে গেলো। ট্রেন থেকে নামা যাত্রীরাও চলে গেছে। ফাঁকা স্টেশন। ওই মহিলা দুই প্যাকেট ছারপোকার ওষুধ কিনে চলে গেলো।
শরীরটা একটু স্বাভাবিক এখন। মাথায় হাত দিয়ে হকারের পাশে বসে আছে পাপড়ি। মাথায় রাজ্যের চিন্তা। আকাশে কয়েকটা কাক উড়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ট্রেনের হুইসেল বাজছে। আরেকটি ট্রেন আসছে। হকার শার্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করে আগুন ধরিয়ে টানতে লাগলো। সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে। পাপড়ি ওখান থেকে উঠে সামনে হাঁটা শুরু করলো।
৯.
চারপাশে পাহাড়। মাঝখানে নদী আর সবুজ প্রকৃতি। আকাশে মেঘেরা উড়াউড়ি করছে। প্রকৃতির এই মায়ার আবহে নিজেকে হঠাৎ হারিয়ে ফেলতে ফেলতে ঠিক বিকেলে পাহাড়ের চূড়ায় উঠলাম। যখন হেঁটে হেঁটে উঠছিলাম তখন মাঝে মাঝেই পথ ঢেকে যাচ্ছিলো বৃষ্টি, মেঘ আর কুয়াশায়।
পাহাড়, মেঘ, প্রকৃতি দেখতে দেখতে হঠাৎ সেদিনের কথা মনে পড়ে গেলো। ডরোথির গল্পের কথা।
ডরোথি সেদিন বলেছিলো সামির কথা। সেদিন সবশেষ কথা হয়েছিলো সামির সঙ্গে। বারবার যোগাযোগ করাও অনেক কঠিন। দুজনের মাঝে ভৌগোলিক ব্যবধান দশ হাজার মাইলেরও বেশি। কিন্তু শুধু ভৌগোলিক ব্যবধানই নয়, রয়েছে আরও একটি বাধা। দুজনের ভাষা দুইরকম। ওর ভাষা বুঝা যায় না। ওর সঙ্গে কথা হতো গুগল ট্রান্সলেটর ব্যবহার করে।
প্রায় আট বছর আগে জেরুজালেমে ঘুরতে গিয়েছিলো ডরোথি। সেখানেই সামির সঙ্গে দেখা হয়।আলাপ হয়। প্রথম দেখাতে যদিও প্রেমে পড়েনি ডরোথি, কিন্তু বন্ধুত্ব হয়েছিল দুজনের। ডরোথি দেশে ফেরার পরও চলতে থাকে আলাপ। ডরোথি ইংরেজি জানতেন না, সামিও বুঝতেন না ডরোথির ভাষা। কাজেই গুগলের অনুবাদ ছাড়া গতি ছিল না। কিন্তু তাতে কাছাকাছি আসা আটকে থাকেনি। বন্ধুত্ব গড়ায় ভালোবাসায়। এক সময় দুজন দুই দেশের ভাষাও শিখতে থাকে। কিন্তু করোনা মহামারির পর থেকে আর কারো যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। বিদেশি গণমাধ্যমে একবার খবর দেখেছিলো ওখানে নাকি করোনাভাইরাস খুব একটা ছিলো না। তবুও যদি ওর হয়ে থাকে কিংবা করোনায় কিছু কি হলো–কোন কিছুরই হদিস মেলাতে পারছে না ডরোথি। এখন পর্যন্ত প্রায় দুইশ মেইল করেছে। কিন্তু কোনও উত্তর নাই। মেসেঞ্জার তো অলয়েজ ওপেন করে রাখা। কিন্তু কোনও খোঁজ নেই।
ডরোথির এই গল্প শোনার পর মাঝে মাঝেই মাথায় ঘুরপাক খায়। সন্ধ্যা শেষে রাত বাড়ছে। পাহাড়ের চূড়া থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলাম। কোনো কোলাহল নেই। সুনসান নীরবতা। পাহাড় যেন শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ রাস্তার পাশে তাকিয়ে দেখি, মেঘের কোলে অনিন্দ্য সুন্দর এক বাড়ি। আমি ওই বাড়ির দিকে যাচ্ছি। এ সময় ডরোথির ফোন। আমি কিছুক্ষণ হাঁটার পর ওই বাড়িতে ঢুকে গেলাম।
১০.
পাহাড় ঘুরে ফিরছিলাম। নাইট জার্নি। আকাশে হালকা মেঘ। তারার আলোও আছে। পাশে বসা যাত্রী বললেন, দেখেছেন আমরা কোথায় যাচ্ছি! ফেসবুকে দেখেন খবরটা-‘বিয়ে বাড়িতে আনন্দ করায় স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যা’। আমি বললাম
-‘হুম। এই ধরনের ঘটনা ইদানীং প্রায়ই শোনা শোনা যায়।’
-‘হা হা হা’।
-‘দিন দিন যা অবস্থা হচ্ছে!’
-ইদানীং খবরের হেডলাইন পড়লেই আতঙ্ক লাগে। দেখেন এই যে হেডলাইন-‘জেলখানায় বন্দী বাবা ও ভাইকে দেখতে যাওয়ার পথে ধর্ষণের শিকার’।
-‘আসলেই দুঃখজনক।’
বাস যাচ্ছে। ওই যাত্রীর সঙ্গে আলাপে আলাপে নানান বিষয়ে কথা হলো। উনি জার্নিতে ঘুমানোর আগে একটা গল্প বললেন। তখন মধ্যরাত। রাস্তার দুই পাশে গাছ-গাছালি। কখনো উচু, কখনো নিচু রাস্তা। শাঁ শাঁ করে বাস যাচ্ছে। আমি গল্প শুনেই যাচ্ছি। চলুন গল্পটি আবারও শুনি।
তখন আমি গ্রামে থাকতাম। সন্ধ্যার পরই ধানখেতের ভেতর সরু রাস্তায় হাঁটতাম। একদিন হাঁটতে হাঁটতে রাত হয়ে গেলো। গ্রামে রাত মানে সুনসান নিরবতা। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। লোকজন খুবই কম থাকে। বুকের ভেতর ভয়, আতঙ্ক। হঠাৎ একটি ছায়া আমার পিছু পিছু হাঁটছে।
হ্যাঁ, ছায়া-ই হাঁটছে।
-এই ছায়া, তুই কে?
-সত্যিই তুই ছায়া না অন্য কিছু?
-কথা বল?
ছায়া হাঁটছে। কথা বলে না। শব্দ নেই। আমি জোরে হাঁটা শুরু করলাম। হঠাৎ একটি পাখির ডাক শোনা গেলো।
পেছনে তাকালাম। না, ছায়া নেই। মাথায় নানা চিন্তা। সঙ্গে ভয়, আতঙ্ক। হঠাৎ ছায়া আমার পেছনে হাঁটলো, এখন দেখি নাই। হাঁটতে হাঁটতে সামনে একটা বাড়িতে ঢুকে গেলাম।
সুনসান নিরবতা। বাড়িতে মনে হয় কেউ নাই। বাড়ির আঙ্গিনায় অন্ধকার। বাড়ির পেছনে বড় বাঁশঝাড়। অনেক বাঁশ। লম্বা লম্বা বাঁশ। হালকা বাতাসে বাঁশের ঝাড় শব্দ শোনা যাচ্ছে।
-বাড়িতে কেউ আছেন?
-কে… রে…
-চাচী আমি।
-তো কিছু দরকার
-হ চাচী, একটু পানি খাব।
গ্লাস নিয়ে এসে বলল, কল থেকে নিয়ে খাও। তো তোমার কি হইছে? হাপাচ্ছ কেন?
-না, চাচী। ওই রাস্তা দিয়ে আসতেছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা ছায়া আমার পেছনে হাঁটছে। পরে আবার দেখি নাই।
-হা হা হা। হু হু করে হেসে দিলেন চাচী। আরে পোলাপান, গ্রামেগঞ্জে একলা রাতে হাঁটলে এরকম হয়ই। আসলে এটা কিছু না।
-না চাচী, ভুত,পেত্নী আছে তো। একবার আমার এক কাজিনকে ভুত ধরেছিল। ওই ভুতটা মনে হয় ছায়া হয়ে আমাকে ধরতে আসছে!
-আরে ধুর পাগল। যাও বাড়ি যাও। ভয়ের কিছু নাই। পাকঘর থেকে একটা শোলা নিয়ে ওটাতে আগুন ধরায়ে যাও। সমস্যা নাই।
রাত তখন দশটা বাজে। আমার অবস্থা চূড়ান্ত রকমের খারাপ। দাঁতে দাঁত চেপে শোলায় আগুন ধরিয়ে আবারও হাঁটতে লাগলাম। ছোটবেলায় অনেক ভুতের গল্প শুনেছিলাম। ছায়া কী ভুত না আবছায়া-মাথায় নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।
আমি হাঁটছি। শোলার আগুন নিভে গেলো। সামনে টর্চ লাইটের আলো জ্বালিয়ে কে যেন আসছে। কাছে আসতেই বললাম
-ওই আতা কাকা, দাঁড়াও। আমারে একটু আগায়া দাও তো। ভয় ভয় লাগছে।
-চল। টর্চ লাইট আছে। সমস্যা নাই। আজ অন্ধকার একটু বেশি।