লড়াইয়ের রসদ ব্যতিত প্রায় অভিন্ন আবহ-প্রবাহ! রক্তের কণায় কণায় উত্তেজনা বহমান। তখন মনে হয়—সম্মুখে একাত্তরের রণাঙ্গন। চতুর্দিকে ছড়ানো-ছেটানো লাশ। লাশের ওপর দিয়ে বীরযোদ্ধা হেঁটে চলেছে। পেছন ফিরে তাকানোর সময় নেই। যেতে হবে বহুদূর। ছিনিয়ে আনতে হবে লাল-সবুজের পতাকা। পতাকার জন্যই তো লক্ষ প্রাণের বিসর্জন দেওয়া! সমুদ্র অভিমুখে রক্তের স্রোত বয়ে যাওয়া!
রক্তের কাছেই লোকটি অসহায়। অসহায় ভঙ্গিতে কালের অনাচার অবলোকন করে। সাক্ষীগোপাল যেন-বা! রাজসভায় আগে একজন গোপাল থাকতো। রাজা-বাদশাহদের মনোরঞ্জনে যা করার নয়, তাই করতো! কিছু যোদ্ধাকে দেখলে মনে হয়, গোপালের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে! ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা ভুলতে বসেছে! আজিবার রহমান অসহায়। যতদিন তেজ ছিল বাধা দিয়েছে। রুখে দাঁড়িয়েছে। কতিপয় সম্ভাবনার স্বপ্নে বিভোর হয়েছে। যুদ্ধের পর নতুন আরেকটি যুদ্ধে শামিল হয়েছে। কিন্তু আজ বুঝতে পারে—
স্বপ্ন দেখতে নেই!
স্বপ্ন কেবল মরিচিকা!
স্বপ্নের পেছনে ছুটে ছুটে হয়রান।
অনেক হয়েছে! এক জীবনে অনেক পথ হেঁটেছে। নতুন করে আর হাঁটার কথা ভাবতে পারে না। গভীর রাতে চিৎকার করে ওঠে—
আগুন! আগুন!
কোথায় আগুন!
ছেলেদের ইঙ্গিত করে আজিবার রহমান আগের মতোই আতঙ্কিত- ওই দেখ, দেখ তুরা! দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। শালারা মনে হয়, বাড়িঘরে আগুন ধরি দি!
একাত্তরে অনেক আগুন জ্বলেছে! অনেক আগুনের সাক্ষী মানুষ। মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে দেবতা প্রমিথিউস স্বর্গরাজ্য থেকে যে আগুন চুরি করে এনেছিল, পাকিস্তানি শাসক ও তাদের দোসররা ওই আগুন অকল্যাণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ঘরে-বাইরে সর্বত্র আগুন। আগুনের লকলকে জিহ্বায় পুড়ে ছারখার প্রিয় মাতৃভুমি।
আগুন দেখতে প্রতিবেশীরা উপস্থিত হলে আজিবার রহমান অস্ত্র হাতে দৌড়ায়। পেছন পেছন ছেলেরা। বাবাকে ঝাপটে ধরে।
কী হয়িচে আব্বা? এরাম কোচ্চু কেনে?
কী হয়িচ মানে, তুরা কি কিচু বুজিসনি? ওই দেক শালারা একুনু যায়নি। আমাগের মদ্যি ঘাপটি মারি রয়িচে! কলকাটি নড়াচ্চে।
শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত করে লোকটি পুনরায় গুলি ছোড়ে। অন্ধকারের পানে নিশানা। হাতের লাঠিটা অস্ত্রের মতো ধরে উচ্চারণ করে, ঠা-ঠা-ঠা-ঠা…
ঘুমের রেশ কাটলেও ঘোর কাটতে সময় লাগে। বাবার পাগলামি শুরু হয়েছে। বুঝতে পারে না এর শেষ কোথায়! বড় ছেলে ম্লান হাসে। আজিবার রহমান পুনরায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, ও তুই নকশা কচ্ছিস! আমাক দেকি তামেশা কচ্চিস? দাঁড়া দেকাচ্চি মজা!
লাঠির মাথা ছেলের কপালে ঠেকিয়ে বলে, ইবার তোক খতম কোরবু। বুক ঝাঁজরা করি দেব।
লোকটা পাগল হোলু না কি?
তাইতো মনে হচ্চে।
আগে তো এরাম ছিলু না!
চেনাজানা মানুষ আজিবার রহমানকে দেখে অবাক হয়। চিনতে কষ্ট হয়। সমাজের চোখে আজ যে পাগল একাত্তরের রনাঙ্গণে সে’ই ছিল বীরযোদ্ধা। বীরবিক্রমে লড়াই করেছে। শোকচা ব্রিজ, আলমডাঙ্গা, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। জাতির বুকে চেপে বসা জগদ্দল পাথর সরিয়েছে!
একমাত্র ছেলের মৃত্যুর খবরে মা লতিফুন নেছা পাথরপ্রায়!
টগর শহীদ হয়িছে!
তার লাশের সঙ্গে খানসেনারা খুব জুলুম কচ্চে গো!
আহা, কার মার ছেলি! একি সয্যু হয়!
সহ্য হওয়ার কথা নয়। যোদ্ধার লাশ নিয়ে পৈশাচিক উন্মাদনায় মত্ত। গরুর গাড়ির পেছনে লাশ বেঁধে আশেপাশের গ্রামগুলোতে টেনে নিয়ে বেড়িয়েছে। কাঁচা রক্ত ছড়িয়ে পড়েছে এলাকাময়। শহরের মোড়ে যে চারতলা, তার পাশে প্রায় দু’দিন লাশ ঝুলিয়ে রেখেছিল!
নতুন আরেকটি লাশের খবর চাউর হয়—
টগর একলা না গো আমার আজিবারউ মরি।
মামা মইজদ্দিন বুক চাপড়ে বিলাপ করে, হায় হায় আমা নতির (লতিফুন নেছা) একুন কী হবে! ও আল্লা, বুইনডার কপালে এই গেরো (বিপদ) ছিলু! কী নিয়ি বাঁচবে সে! মষির কান্দে চড়ি কিডা মাটে যাবেনে!
মা লতিফুন নেছা শব্দ করে কাঁদতে পারে না। চোখের জল শুকিয়ে গেছে। মেয়েটির দুর্ভাগ্য—একমাত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই স্বামী আফিল উদ্দিন মৃত্যুর দেশে পাড়ি জমিয়েছে। বাপ-ভাই পুনরায় বিয়ের কথা ভেবেছিল। কিন্তু ওই ভাবনায় লতিফুনের আপত্তি। ছেলে আজিবার রহমানকে অবলম্বন করে বাকি পথটুকু পাড়ি দিতে চায়।
একদিন পর অচেতন অবস্থায় মাঠের মধ্যে আজিবার রহমান উদ্ধার হয়।শরীরের রক্তের চিহ্ন। মৃত্যুর মুখ থেকে ছেলেটি ফিরে এসেছে। মাও ফেরার কথা বলে—
যুজ্জু করার দরকার নি বাপ। চ, আমরা ইন্ডিয়ায় যাই!
পালানোর কথা ভাবতে পারে না। বরং আগের চেয়ে আরও বেশি বেপরোয়া! মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। অস্ত্র হাতে নিয়ে মাঠে-ময়দানে চষে বেড়ায়।
যুদ্ধ শেষে সরকারের কাছে অস্ত্র জমা দিয়েছিল। একটি সার্টিফিকেট পেয়েছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছিল। অথচ বহুদিন পরে সার্টিফিকেটই তার প্রতিপক্ষ। শত্রু।
ছেলেরা প্রলোভন দেখায়—
ইবার আর ভুল করুনা আব্বা! তুমি তো আসল যুদ্ধা। সগলেই জানে। তাছাড়া সাটিফিকিট রয়িছে! তালিকায় নাম উটলি মেলা সুযুক-সুবুধি।
সুবিধার কথা শুনে আজিবার হতাশ হয়, এসব তুরা কী বুলছি? লোকের কাচ হাত পাতবু ক্যান?
ভুল করুনা আব্বা। সুযুক বার বার আসপে না। তুমার সাতে যারা যুজ্জু করিছিলু তারা সগলেই সুবুধি নেচ্চে।
ছেলেদের মুখের পানে তাকিয়ে আজিবার রহমান যাচাই-বাছাইয়ে অংশ নিয়েছিল। সরকারি আমলাদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সম্মুখে ঠিকঠাক উত্তর দিয়েছিল।
না, কমিটি তাকে হতাশ করেনি। গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সুযোগ-সুবিধাও পাচ্ছে। মাস গেলে মোটা অঙ্কের টাকা। কালেভদ্রে চাল-ডালও আসে।
ইদানিং বুকের মধ্যে খচখচানি। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নতুন একটা খেলা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন সরকার ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে পরিপত্র জারি করছে। দলীয় কর্মীদের সুবিধা দিতে নানা প্রচেষ্টা। সাধারণ মানুষের দ্বিমুখী হয়রানি। এই হয়রানি আজিবার রহমানের মতো যোদ্ধাদের পছন্দ হয় না। সরকারি আমলা বা যুদ্ধের সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা নেই, তাদের সম্মুখে পরীক্ষা দিতে দ্বিধা। চোখের সামনে অনিয়মের পাহাড়। যারা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, টাকার জোরে তারাও তালিকাভুক্ত হয়ে যাচ্ছে।
লজ্জা।
জাতীর জন্য এ বড় লজ্জার!
আজিবার রহমান নিজেও লজ্জার মুখোমুখি। ছেলেদের সঙ্গে রাগারাগি করে—
তোগের জন্যিই লোকের কথা শুনা!
কী কথা আব্বা?
আমার নাম নাকি ইবার কাটা পড়বেনে?
বয়স হয়েছে। মানসিক চাপ সহ্য করতে পারে না। যে যা বলে তা’ই বিশ্বাস করে। বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে সাপ ও মাছের গর্তে হাত দেয়। কিন্তু মাছের বদলে সাপ ও সাপের বদলে মাছের দেখা পেলে মরিয়া হয়ে ওঠে। বিছানায় বুক দিয়ে পড়ে থাকে। বিড় বিড় করে কী সব বলাবলি করে।
দাদুভাই, এমন করে কী বলছো তুমি?
মাতা। তোর মাতা বুলছি। দূর হ আমার সামনে তিকি!
স্কুল পড়ুয়া নাতনি মিথিলাকে তাড়া করে। সারা উঠোন তেড়ে বেড়ায়। কারণে-অকারণে নাতনি তাকে জ্বালাতন করে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কটাক্ষ করে।
মন দিয়ে পড় দাদুভাই, সামনেই তো পরীক্ষা! এ প্লাস না পেলে কিন্তু ফেল্টুস! তোমার নাম কাটা পড়বে!
নামের ভয়ে আজিবার রহমান ভীত-সন্ত্রস্ত, নাম কাটা পড়লে লজ্জায় মুখ দেখানো যাবে না। হঠাৎ হটাৎ ছেলেদের ডেকে পাঠায়।
কী হোলু আব্বা!
বুলছি, আমার নাম কি সত্যি সত্যি কাটা পড়বেনে?
ছেলেরা অভয় দেয়। পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে বলে।
এমন কী আর প্রস্তুতি! কোথায় কোথায় যুদ্ধ করেছে, সঙ্গে কে কে ছিল, কী ঘটেছিল, কোন অস্ত্র কিভাবে চালাতে হয়—এসব। বয়সজনিত কারণে আজিবার রহমান তালগোল হারিয়ে ফেলে। অতীতের পানে তাকালে ঝাপসা মনে হয়। মেঘাচ্ছন্ন। মেঘ তাড়িয়ে বেড়ায়—
খুন! খুন!
রাতের পরিবেশ আলোড়িত করে তার কণ্ঠস্বর ইথারে ইথারে ছড়িয়ে পড়ে।
এই দ্যাক কাকে খতম করিছি।
লাশের শরীরে একের পর কোপ মারে। শরীর দিয়ে ঘাম ঝরে পড়ে। লোকটা তবু থামে না। রামদা উঁচিয়ে নাচানাচি করে, তুরা দেক, কাকে খুন করিছি!
পড়শীদের একজন বলে, ইবার আর হবেনান গো, তুমার আব্বাক পাবনায় নিয়ি যাও। পাগলা গারদে ভর্তি করো গা।
লাশের পানে ইঙ্গিত করে ছেলে জিজ্ঞেস করে, লোকটা কিডা আব্বা? কাকে খুন করিছু?
রাজাকার। শালা আস্ত রাজাকার।
ছেলেরা বুঝতে পারে, বাবার অবস্থা ভালো না। পরীক্ষা পর্যন্ত ছাত্র বাঁচে কি না, সন্দেহ।
জীর্ণশীর্ণ পোশাকে যে মাটিতে পড়ে আছে, সে লাশই বটে! পটলের ক্ষেতে যে কাকতাড়ুয়া ছিল, সেটাকেই রাজাকার ভেবে হামলা চালিয়েছে। পরম উল্লাসে চিৎকার করছে!
ডাক্তার দেখিয়েছে। মানসিক চাপে নুয়ে পড়েছে। যাচাই-বাচাই না হওয়া পর্যন্ত পাগলামি অব্যাহত থাকবে। মন ভালো থাকলে স্বাভাবিক আচরণ করে। নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে ঘুরে বেড়ায়।
তোমার কী হয়েছে দাদুভাই?
কই কিচু হয়নি তো!
তুমি নাকি পাগল হয়ে গেছো?
পাগলামির কথা ভেবে আজিবার লজ্জিত। ছেলেদের আস্বস্ত করে—
চিন্তা করসিনি বাপ। সব ঠিক হয়ি যাবেনে!
আন্তরিক হয়ে বলে, এডি ঠিক না।
কোনডি আব্বা?
আমাগের নিয়ি এত তামাশা হবে ক্যান?
তামাশা না আব্বা, যারা বাদ পড়ি আচে তাগের নাম লেখাবে।
আজিবার রহমান উচ্চস্বরে হাসে, ধুর পাগল! ঘটনা তা না।
তাহলে কী?
রাজাকারগের নাম মুক্তিযুদ্দুর খাতায় তোলবে।
ইতি সরকারের লাব কী?
আছে। আছে। রাজাকাররা একুন বড় বড় নিডার! উরাই আমাগের নিয়ি নকশা মারাচ্ছে। শালাগের আমি ছাইড়বু না।
কী করবা তাগের!
দুই.
বিচিত্র নকশা। মহান যোদ্ধাদের কেউ কেউ পথ হারিয়েছে। নৈতিক অধপতন হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজসে অনৈতিক কাজে লিপ্ত। প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা বিকাশ, তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলতে সর্বপরি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সুবিধার জন্য প্রতিটি উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবের চিত্র ভিন্ন। সরকারি বিধি লঙ্ঘন করে বাণিজ্য শুরু হয়েছে। আঁতাতের মাধ্যমে বাণিজ্য চলছে। একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য সামনে রেখে পেছনে চলছে ক্লিনিক-ব্যবসা। ব্যবসার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে আজিবর রহমান নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কাছের বন্ধুদের মধ্যে ক্ষোভ-আক্ষেপ।
কাজটা তুমার ঠিক হয়নি ভাই।
কুন কাজটা ভাই?
সপ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা ঠিক না। তুমার নাম কাটা গেলি আমার দোষ নি।
দোষ তার অদৃষ্টের। তা না হলে সহযোদ্ধাদের কাছে জিম্মি হবে কেন! জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেতে ভিন্ন পথ খোঁজে।
এট্টা উপগার করবি বাপ।
কী উপগার?
আমাকে এট্টা পিস্তল জুগাড় করি দে।
পিতার আবদারে পুত্র অবাক হয়, পিস্তল!
হ।
পিস্তল দিয়ি আবার কী করবা?
খুন।
কাকে?
পরীক্কা দিতি যায়ি একজনকে খুন কোরবু!
তিন.
যোদ্ধাবান্ধব পরিবেশ। উপজেলা চত্বরে যোদ্ধারা সমবেত হয়েছে। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। খুঁটিনাটি বিষয়ে নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। ভুল হলেই বিপদ, শিকারির ফাঁদে আটকা পড়তে কতক্ষণ! কম বয়সী যোদ্ধারা তুলনামূলক নির্ভার। কমিটির সামনে পেশী ফুলিয়ে যুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছে। অফিসারের চোখ তো কপালে ওঠার উপক্রম!
এসব কী বলছেন ভাই? এও সম্ভব!
তাহলে আর বলছি কী! একাই ৫০ জন পাকসেনাকে তাড়া করেছিলাম। ভাগ্যিস, অস্ত্র জ্যাম করেছিল, না হলে একটাও প্রাণ নিয়ে পালাতে পারতো না!
অফিসার অনুযোগের সুরে বলে, না না ভাই, এত সাহস ভালো না। অঘটন ঘটলে আজ আর আমাদের দেখা হতো না!
সময় বিষয়ে প্রশ্ন করে, যোদ্ধার দাবি নিয়ে এতদিন পরে কেন?
কয়েকমুহূর্ত ভেবে বলে, দেখুন, খাঁটি দেশপ্রেমিক আমি। কোনো সুবিধা নেওয়ার মানসিকতা ছিল না।
এখন হচ্ছে যে!
নিতান্তই সামাজিক প্রয়োজন।
ও আচ্ছা। তা আপনার কাগজপত্র কোথায়?
একগাল হেসে জানায়, আর বলবেন না ছ্যার, এতদিন কি সেসব থাকে?
অফিসার আশাহত হয়, ভুল হয়েছে। কাগজ-পত্র সংরক্ষণ করলে ভালো করতেন।
যোদ্ধার পক্ষে অন্য আরেকজন বলে, কাগজই কী সব! তাছাড়া দেশপ্রেমিকের বিষয় আলাদা। কাগজপত্র সংরক্ষণের চেয়ে দেশের জন্য কাজ করা জরুরি মনে করেছে। খাঁটি প্রেমিক হলে যা হয়!
কিছু যোদ্ধার ক্ষেত্রে কাগজই অকাট্য দলিল। দেখাতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যৎ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে। বয়স্কদের নিয়ে ভিন্ন ঝামেলা। লাঠি বা অন্য কারও হাত ধরে এসে ভুলভাল উত্তর দেয়। কিংবা যা প্রশ্ন করেছে, তার বিপরীত উত্তর। প্রশ্ন-উত্তরের মাঝে আদব-লেহাজও নজরে রাখে। বিসিএস ক্যাডারভুক্ত একজন অফিসারকে ‘ভাই’ সম্বোধন করলে চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কাজটা অন্যায়!
স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পরেও ভুল হয়, ভুল করে ‘ভাই’ সম্বোধন করে।
যোদ্ধাদের মধ্যে হঠাৎই গুঞ্জন আরম্ভ হলো। প্রসঙ্গ আজিবার রহমান।
কী হয়িছে ভাই?
কী আর হবে? সকালে নাকি সার্টিফিকিট পুড়ি ফেলি।
পাগল। পাগল। পাগল নাকি নিজির পা’য় কেউ নিজি কুড়–ল মারে!
দুই-একজন হাসি-তামাশাও করে। তামাশার ছলে বলে, এরাম লোকের নাম কাটি দিউয়াই ভালো। সে মুক্তিযুদ্দা হওয়ার যোগ্য না। একুনকার মতোন হলি যুদ্দ কত্তি পাত্তু না।
পরের খবর আরও ভয়ানক। অফিসার বাইরে এসে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে?
আজিবার রহমান নেই, উনি মারা গেছেন!
সবার চোখেমুখে হতাশার ছায়া। কারও চোখে জল। অগ্নিপরীক্ষায় যাকে কেউ হারাতে পারেনি, নকশার পরীক্ষায় হাজির হতেই তার আপত্তি! তার নিয়তির নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। যোদ্ধাদের মধ্যে ভাগাভাগি। পরীক্ষা দেওয়ার চেয়ে লাশের কাছে যাওয়া উত্তম মনে করে। কেউ কেউ রয়ে যায়। অফিসারের মনে দ্বিধা, কারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা—যারা লাশ দেখতে গেছে তারা, না কি সামনে দাঁড়িয়ে আছে যারা!
এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। একজন আজিবার রহমান জানলে জানতে পারে!