আমরা দুটো দিন গভীর উদ্বেগে কাটানোর পর শহরের প্রধান যাজক তার নাম বললেন। আমরা তখন খানিকটা আশ্বস্ত হলাম। কিন্তু সেই সন্ধ্যায় কোনোক্রমেই তার দুর্গম গ্রামে গিয়ে দ্বিপ্রহর রাতের মধ্যে তাকে আনা সম্ভব ছিল না। রাতটা অপেক্ষা করে আমাদের মধ্যে থেকে একজন তাই সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে একটা বাইসাইকেল চালিয়ে রওনা হলো মিথুরাপ্পা গ্রাম। তারপর আমরা সবাই অধীর আগ্রহে লোকটার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। কেউ কেউ বোধহয় সকালের প্রাতরাশ গ্রহণের কথাও ভুলে গিয়েছিল। বরং মনে মনে কাক্সিক্ষত মানুষটির ছবি আঁকছিল। কেউ তাকে শ্মশ্রূমণ্ডিত, কেউ শ্মশ্রূহীন, কেউ কালো, কেউবা জ্যোতির্ময় ত্বকের অধিকারী বলে তাকে কল্পনা করতে থাকলো। তার আসতে বিলম্ব হওয়ায় সূর্য বেশ খানিকটা ওপরে উঠে আসায় নতুন করে কারও কারও খিদে লাগতে শুরু করলো। অবশেষে লোকটা যখন এল প্রথমে আমরা বুঝতে পারিনি যে এই লোকটার জন্যই আমরা অপেক্ষা করছিলাম—ইনিই মিথুরাপ্পা গ্রামের সেই যাজক। পোশাক-আশাক ও চেহারা বিশেষত্বহীন বলে লোকটাকে দেখে আমরা প্রথমে খানিক হতাশ হই। তবে তিনি যে কতটা করিতকর্মা তা বোঝাতে আধঘণ্টার বেশি সময় নিলেন না।
এবার সমস্যাটার কথা বলি—আমাদের বাড়িতে ১৫-১৬ বছর বয়সী একটি মেয়ে হঠাৎ অদ্ভুত ও ভয়ঙ্কর আচরণ শুরু করেছিল। তার নিজের কণ্ঠ হারিয়ে পুরুষালি কণ্ঠে অচেনা ভাষায় কথা বলছিল সে। সে-ভাষা বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি বা উর্দু নয়। আরবি জানা মৌলবি শ্রেণির লোকেরা বলল এভাষা আরবিও নয়। খানিক বাদে অবশ্য সে ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে শুরু করে। পুরুষালি কণ্ঠের আড়ালে লুকনো অস্তিত্ব জানাল পাহাড় আর মরুভূমির দেশ থেকে সে এখানে এসেছে। আমাদের বাড়ির ১৫-১৬ বছরের ওই মেয়েটি মাসখানেক আগে নদী থেকে গোসল করে ভিজে শরীরে যখন শর্ষে খেতের আল ধরে বাড়ি ফিরছিল তখনই ওর পিছু নেয় ওই অচেনা অস্তিত্ব। মেয়েটির কণ্ঠ পুরুষালি থেকে যখন মেয়েলি হতে শুরু করে তখন তার কথায় এতক্ষণের উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনা আর থাকে না। বরং সেই কণ্ঠে যন্ত্রণা আর ক্ষোভ প্রকাশ পেতে থাকে। তারপর এক সময় কথা বন্ধ করে কেবল মিহি সুরে কাঁদতে থাকে মেয়েটি। মেয়েটির মা তার শরীর স্পর্শ করে জানায়—ওর গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আমরা দেখতে পাই মেয়েটির চোখদুটো লাল টকটক করছে। হঠাৎ মেঝেতে শুয়ে পড়ে মেয়েটি দুতিন বার গড়াগড়ি করে, তখন তাকে নিয়ে আমাদের দুর্ভাবনা চরমে ওঠে। অবশ্য খানিক বাদে মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়ে, অথবা যন্ত্রণায়-ঘৃণায় সে অচেতন হয়ে যায়। সারারাত বাড়ির সবাই গভীর উদ্বেগে প্রায় নির্ঘুম কাটায়। সেই রাতে এই ছোট্ট বাজারের মত জনপদে বিদ্যুৎ না থাকায় আকাশের তারাগুলো অসম্ভব উজ্জ্বল দেখালেও আকাশছোঁয়া গাছগুলোর নিচে অন্ধকার আরও গভীর হয়ে উঠেছিল। শিশুরা মায়ের শরীর স্পর্শ না করে ঘুমতে ভয় পেল। বড়দের কেউ কেউ ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল তারা কোনো বালির পাহাড় থেকে ধপাস করে পড়ে যাচ্ছে আবার কেউ স্বপ্ন দেখলো ঘোলাটে জলে ডুবে তার শ্বাস সাদা পাথর হয়ে আটকে যাচ্ছে কণ্ঠনালীকে বেষ্টন করে।
বালিকা-রোগীকে আগন্তুক লোকটি আধঘণ্টার মধ্যে প্রায় সম্পূর্ণ ভালো করে তুলল দেখে আমরা অবাক না হয়ে পারিনি। যাজকের কর্মকাণ্ড নিরীক্ষা করে আমাদের কেউ কেউ বোধ হয় যীশুখ্রিস্টের কথা—তাঁর কবরস্থ মৃতকে জীবিত করা, কুষ্ঠ রোগিকে ভাল করা, মাটির পাখিকে ফুঁ দিয়ে জীবন্ত পাখির মত উড়িয়ে দেয়া, রান্নামাছ আবার তাজা করা প্রভৃতি বিষয় ভাবছিল। ফলে ততক্ষণে সাধারণ-দর্শন লোকটি আমাদের সেই একই চোখে আর সাধারণ দেখাচ্ছিল না মোটেই। আমরা খেয়াল করলাম যাজকের জোড়া ভ্রূ, তার অসম্ভব উজ্জ্বল দৃষ্টি, আর তার গায়ের ছেয়ে রঙের আলখাল্লাটিও একবারে আলাদা কৌশলে বানানো। তার চেয়ে বড় কথা তিনি যখন বাড়ি ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাইরে দাঁড় করানো রিকশাভ্যানটায় উঠলেন, তখন আমি স্পষ্ট খেয়াল করলাম তার হাতের যে লাঠিটি আমরা সস্তা কোনো ধাতুতে তৈরি বলে ধরে নিয়েছিলাম, তা আসলে খাঁটি সোনা ছাড়া আর কিছু নয়। অবশ্য তার ওই দণ্ডে সূর্যালোকের ঝলকানি আমি ছাড়া আর কারো চোখে পড়েছিল কিনা তা আমি নিশ্চিত নই। তার ভ্যানটি চলতে শুরু করলে আমি যথাসম্ভব নিশব্দে খানিক দৌড়ে তাকে অনুসরণ করলাম।
তিনি আমার পায়ের শব্দ শুনে পেছন ফিরে তাকিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার দৌড়াচ্ছ কেন?’
আমি বললাম, ‘আমি আপনার সাথে আবার একদিন দেখা করতে চাই।’
‘তো ভালো কথা। করবে। আমার গ্রামের নাম মিথুরাপ্পা—বড় রাস্তা থেকে নেমে পশ্চিম দিকে পাক্কা আট মাইল রাস্তা।’ ভ্যান জোরে চলতে শুরু করায় আমি দৌড়ানো বন্ধ করে সালামের ভঙ্গিতে হাত উঁচু করে তাকে বিদায় জানালাম।
আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না, তার সঙ্গে ভ্যানে চড়ে চলে যেতে পারলেই ভালো হতো। পরের দিন ভাবি, কালই তো উনি এলেন, আজ যাওয়া ঠিক হবে না। কাজেই আরও দুটো দিন পার করতে হল অধীর অপেক্ষায়। আমি টের পাই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মত তার অদৃশ্য বাঁশির মিহি সুর যেন আমাকে টানছে। কেমন সেই মিথুরাপ্পা!
আমি দ্বিতীয়বার আর ওদের দিকে তাকাইনি। যে ছোট্ট সমতল দেশে ১০-১১ কোটি লোকের বসবাস সেখানকার কোনো কোনো গ্রামের কিছু জায়গা যে এখনও এতটা নির্জন নিস্তব্ধ হতে পারে এখানে না এলে তা বোঝা সম্ভব ছিল না।
বুধবার সকালেই রওনা হয়ে গেলাম। এইটুকু পথ টেম্পুতে ৪০ মিনিটের বেশি লেগে গেল—রাস্তাটা কাচা আবার কোথাও প্রচুর ধুলো, টেম্পুর চাকা তাতে আটকে যায়। টেম্পু-ড্রাইভারের বামপাশে বসেছিলাম। তাকে বললাম ‘আমি মিথুরাপ্পা যাব।’ সে নিজেই বলল, ‘আপনি বোধহয় জিহান মাস্টারের বাড়ি যাবেন?’ আমি জানলাম যাজক এক সময় স্কুল শিক্ষক ছিলেন বলে অনেকে এখনও তাকে মাস্টার বলে। টেম্পু ড্রাইভার নিজেও এক সময় তার কাছে পড়েছে।
‘হ্যা, কিন্তু আপনি বুঝলেন কী করে?’
‘আপনার চেহারা দেখেই বুঝেছি।’
টেম্পুঅলা আমাকে একটা বিস্তীর্ণ পাটখেতের পাশে নামিয়ে দিল। আমি তার হাতে ভাড়া তুলে দেয়ার পর সে রাস্তার অন্য দিকটা দেখিয়ে বলল, ‘এই যে বাঁশবাগান দেখছেন এর মধ্য দিয়ে পায়েচলা পথ চলে গিয়েছে। পথটা নদীর কিনারায় গিয়ে শেষ। ওখানে দেখবেন বাঁশের সাঁকো। সাঁকো পেরুলেই ডান হাতে নদীর ধারে প্রথম বাড়িটা জিহানের স্যারের।’
টেম্পুটা চলে যাওয়ার পর অদ্ভুত এক নীরবতায় ভরে উঠল চারিপাশ। বর্ষার শেষ বলে ভেজা মাটি আর বুনো উদ্ভিদের গন্ধ ভাসছিল বাতাসে। দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোনো মানুষ বা বাড়িঘর চোখে পড়ছে না। সূর্যটা মেঘে ঢাকা পড়ায় চারিদিক আরও গভীর সবুজ দেখাচ্ছে। পাটখেতের ভেতর হাতখানেক গভীর জল জমে আছে। সেখানে হঠাৎ ঝপাত করে কিসের একটা আওয়াজ হয়। প্রথমে ভাবি—ব্যাঙ, না ব্যাঙের লাফানো আওয়াজ তো এতো জোরে হবে না বড় কোনো মাছটাছ হবে। আমার মনে হল খেতে নেমে ব্যাপারটা অনুসন্ধান করি—বড় কোনো মাছ হলে ধরতে পারলেও খারাপ হয় না ; কিন্তু এখন সে সময় নয়। সাবধানে চারিদিক এমনকি আকাশটা ভালো করে দেখে নিয়ে আমি বাঁশবাগানের পথ ধরে এগুতে থাকলাম। নিস্তব্ধ পথে কেবল দুটো গুঁই সাপের সাক্ষাৎ মিলল, তখন আমি সামান্য ভয় পাচ্ছিলাম এই ভেবে যে ওরা আসলে গুঁইসাপ নয়, অশরীরী কোনো কিছু গুঁই সাপের বেশ ধরে আছে। প্রাণীদুটো গভীর দৃষ্টি নিয়ে আমাকে দেখছিল। আমি দ্বিতীয়বার আর ওদের দিকে তাকাইনি। যে ছোট্ট সমতল দেশে ১০-১১ কোটি লোকের বসবাস সেখানকার কোনো কোনো গ্রামের কিছু জায়গা যে এখনও এতটা নির্জন নিস্তব্ধ হতে পারে এখানে না এলে তা বোঝা সম্ভব ছিল না।
তার কাঠের ঘর, উপরে টালি। চারিদিকে সারিবদ্ধ দেবদারু-মেহগনি গাছগুলো পরিকল্পনা করেই লাগানো; তবু হঠাৎ মনে হয় একটা নির্জন জঙ্গলে ঘেরা এই বাড়ি। অঘ্রান মাস চলছে, খেজুর বাগানের ভেতর একটা মাদুর বিছিয়ে আমরা বসি, পাতার ফাঁক দিয়ে আসা দুপুরের রোদও মন্দ লাগে না। তিনি সংক্ষেপে আমার বৃত্তান্ত জেনে নেন। তারপর বলেন, ‘এসব বিষয় খুব সহজ নয়, এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভাল।’ তিনি প্রায় তিন যুগ ধরে এক অদ্ভুত জগৎ নিয়ে আছেন। অনেক মারাত্মক অভিজ্ঞতাও তার হয়ে, নিজের বা পরিবারের মানুষের জীবনও সংশয়াপন্ন হয়েছে। তবে সেদিন তিনি অন্য একটা অভিজ্ঞতার কথা বিবৃত করলেন : ‘খুব ভোরে আমি বেরুতাম। সেদিন বেরিয়ে দেখি অদ্ভুত কাণ্ড। আকাশে অজস্র তারা নেচে বেড়াচ্ছে আতসবাজির মত। একটা বাজির ফুলকি যেন এসে পড়ল আমার পায়ের কাছে। আমি এক পা পিছিয়ে দাঁড়াতেই আগুনের ওই খণ্ডটার জায়গায় দেখি এক দীর্ঘাকায় সুদর্শন পুরুষ দাঁড়িয়ে। ভারী কণ্ঠে সালাম জানিয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে সে অনুরোধ করল তার সাথে যেতে। তার শরীর থেকে যে সামান্য আলো নির্গত হচ্ছিল সেই আলোতে আমি কব্জির ঘড়িতে দেখে নিলাম রাত মোটে দুটো পঁচিশ বাজে। আশ্চর্য, আমি ঘড়ি না দেখেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম কেন। কিন্তু আমি যে—
লোকটা আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, একবার যেতেই হবে—আমাদের বাদশাহর মেয়ের বিয়ে। তাঁর খুব ইচ্ছে সে বিয়েতে আপনি উপস্থিত থেকে আশীর্বাদ করে আসবেন।
কোথায়—কতদূর?
আমি নিজেকে নির্ভয় রাখার চেষ্টা করলাম। আমার জানা ছিল এসব ক্ষেত্রে ভয় পেতে নেই, ভয় পেলেই বিপদ।
লোকটা বলল, আপনি ভাববেন না, দুই ঘন্টার মধ্যেই আমি আবার আপনাকে পৌঁছে দিয়ে যাব। আপনি আমার এই চাদরটা ধরুন। সামান্য একটু সময় দুচোখের পাতা দয়া করে বন্ধ রাখবেন।
চোখ খুলে মনে হল সত্যিই আমি বড় কোনো জাঁকজমকের মধ্যে এসে পড়েছি। ওরা আমাকে একটা মখমলে মোড়া নরম আসনে বসতে দিল। চারদিকে অদ্ভুত ভাষার কোলাহল, বিভিন্ন রকমের বাদ্যযন্ত্র, বাসন-কোসন প্রভৃতির আওয়াজ আর বিচিত্র সুবাস। গন্ধগুলো আমার পরিচিত নয়, তবে কোনোটা খাদ্যের আবার কোনো গন্ধ ফুলের বলে মনে হল। কিন্তু বিশেষ কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। মাঝে মাঝে সোনালি রঙের কিছু আবছায়া আমার সামনে দিয়ে খেলে যাচ্ছিল। যে লোকটি আমাকে সঙ্গে করে এনেছিল মাঝখানে সে এসে বিশাল একটি ধাতব থালাভর্তি খাবার দিয়ে গেল। একটি খাদ্যেরও চেহারা দেখে মনে হল না যে আগে দেখেছি। তবে খাবারগুলোর রঙ আর গন্ধ ছিল অপূর্ব। তারপর কেউ বিশেষ একজন আমার কাছে এল বুঝতে পারলাম আলোর রঙ আর চারপাশের বাতাসে সুবাসের পরিবর্তনে। আমাকে বলা হল তাঁর কন্যার বিবাহ-পরবর্তী আশীর্বাদ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে। তিনি আমার কথা শুনেছেন, তার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল আমি এই কাজটি করব। বিদায়ের আগে বাদশাহ আমার কাঁধে সবুজ রঙের পেলব একটা উত্তরীয় জড়িয়ে দিয়ে বললেন, আসার জন্য অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা, আমার মেয়েটির সুখের জন্য দোয়া করবেন, আবার দেখা হবে।
অনুসন্ধান শুরু করে যাজকের চোখের পাতায়, কপালের বলিরেখায়, রোদেপোড়া ত্বকে, তার কণ্ঠে আর অদূরেই রাখা তার রৌদ্রদণ্ডে।
আমাকে যেখান থেকে নেয়া হয়েছিল ভোর হওয়ার বেশ আগেই আবার সেখানে রেখে গেল সেই গম্ভীর কণ্ঠের লোক। আমি খানিক পথ হাঁটার পর জামার ডান পকেটটা সামান্য ভারী মনে হল, হাত দিয়ে দেখি সেখানে চারটে সোনার মোহর—আমি নিশ্চিত করেই চিনেছিলাম, এজন্য সেকরার দোকানে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না।’
যাজকের এই বৃত্তান্ত শুনে আমার অবশ্য ভয় লাগেনি, মনে হচ্ছিল তিনি কোনো বাস্তব বিষয়ই বিবৃত করছেন। আমার তখন মনে পড়ল যাজকের লাঠির কথা, সেটা তো সোনার বলেই মনে হয়েছিল। তাহলে সেই মোহর দিয়েই যাজক এই লাঠি বানিয়ে নেন?
জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কিনা তবু বললাম, ‘আপনার লাঠিটা কি তবে—’
‘ও, তুমি খেয়াল করেছ?’
‘আরে না, ওই মোহর নিজের কাজে লাগানোর মতো বোকা আমি নই। তবে কাউকে দান করে দেন?’
‘নাহ।’
‘তাহলে?’
‘মোহরগুলো পকেটে নিয়ে আমি নদীর ধারে যাই, তারপর একটা নৌকা ভাড়া করি। বলি—যাও। মাঝি মাঝনদীতে পৌঁছলে বলি, রাখো এবার। পকেট থেকে মোহরগুলো বের করতে দেখে মাঝির চোখ চকচক করে ওঠে। আমি প্রথমে একটা মোহর ফেলে দিই। মাঝি বোধহয় তা খেয়াল করে। বলে, ‘ওটা কি সোনার—ফেলে দিলেন কেন? আমাকে দিতেন!’
‘আমি দ্বিতীয়টা যখন হাতে নিই তখন সে গলুই ছেড়ে আমার দিকে ছুটে আসে।’
‘ফেলবেন না দয়া করে, আমাকে দিয়ে দেন—আমি খুব গরিব মানুষ।’
‘আমি একটু হেসে দ্বিতীয় মোহর ছুঁড়ে ফেলার সাথে সাথে মাঝি জলে লাফ দিল। আমি অবশিষ্ট মোহরদুটোও রূপগঙ্গার জলে ডুবিয়ে দিই।’
‘তাহলে আপনার ওই লাঠিটা?’
‘ওটা সোনার নয় মোটেও।’
‘তো?’
‘রোদ—রোদ। স্রেফ হেমন্ত কালের খাঁটি রোদ দিয়ে বানানো—তুমি বলতে পারো রৌদ্রদণ্ড ।’
‘আর সেদিনের সেই মাঝি—তার কী হলো?’
‘ওর লাশ পরদিন সকালে পাওয়া গিয়েছিল রূপগঙ্গা নদীর কূলে—আমাদের গ্রাম থেকে তিন মাইল দূরে।’
‘কিন্তু আপনি ওই স্রোতের ভেতর মাঝি ছাড়া কিভাবে তীরে এলেন?’ আমি দেখি উঠোনের পাশে বারান্দার কোনায় তার লাঠিটা রাখা।
‘তোমার কী ধারণা—আমি সাঁতার জানি না?’ যাজক বোধ হয় সামান্য হাসেন। আমার বিস্মিত দৃষ্টি দ্রুত আবিষ্কারক হতে চায়। অনুসন্ধান শুরু করে যাজকের চোখের পাতায়, কপালের বলিরেখায়, রোদেপোড়া ত্বকে, তার কণ্ঠে আর অদূরেই রাখা তার রৌদ্রদণ্ডে।