কোনো এক স্বাধীন নভেম্বরে
রায়েন্দা বাজারের কোলঘেঁষে যে বলেশ্বর নদী, তার রূপ-যৌবন তখনো অটুট। কুল দেখলেই হামলে পড়ে। যেন ওকে ভাঙতে পারলেই সব সুখ। ভাঙতে ভাঙতে শরণখোলার ভেতরে ঢুকে পড়লে মানুষ আদর করে ওর নাম দিয়েছে রায়েন্দার খাল। এই খালটাই ছিল রায়েন্দা বাজারের প্রধান অবলম্বন। হাঁটবার তো ব্যবসায়ীরা নৌকা রাখার জায়গা পেতো না। এই খাল ধানকাটা কাঁচির আকার নিয়ে গ্রাম আর বাজারের মাঝ বরাবর ঢুকে গেছে। অথবা বলা যায় গ্রামটাকে বাঁচিয়ে বাজারটা বলেশ্বর নদীর কোলঘেঁষে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, যেন খালটা তার খাপ খোলা তলোয়ার। নদীর চণ্ডাল রূপ থেকে বাঁচাতে চাইছে তার প্রিয়তম গ্রামকে।
ধান, পান, মাছ, মানুষ–সবাইকে বুকে করে রাখে এই খাল। জলিলের প্রায় সব কবিতা এই খালে বিশ্রাম করা নৌকায় অথবা ঝুকে পড়া কোনো গাছে শুয়ে-বসে লেখা। এই কবিতা লেখার কারণে কিছু বাড়তি সম্মান তার সবসময়েই ছিল। লোকজন আদর করতো। কেউ কেউ শরণখোলার কবি সাহেব বলে ডাকতো। জলিল গোপনে গর্বিত হতো। জলিলের বন্ধু হিসেবে জামালের গর্বটা একটু বেশিই ছিল। জলিলের কবিতা জবাকে জামালই দেখিয়েছিল। বন্ধুর কবিতা নিয়ে জামালের উচ্ছ্বসিত প্রশংসার বিপরীতে জবা শুধু একটা হাসি উপহার দিয়েছিল। সেই হাসি বলেশ্বরের মতো বাঁধভাঙা নয় আবার রায়েন্দার খালের মতো শান্তশিষ্টও নয়। সেদিন যদি জামাল প্রেমান্ধ না হতো, তাহলে জবার ঠোঁট পেরিয়ে চোখের রহস্যময় হাসিটায় পৌঁছাতে পারতো। জামাল জানতো না, কোনো মেয়ে যখন চোখ দিয়ে হাসে, তখন ঠোঁট অতটা কার্যকরী ভূমিকায় থাকে না।
যশোর রোডের গাছেরা
লুকিয়ে পড়ে রাতের সিন্ধুকে।
পাতার পায়ে শিকল
বাকলে পরাধীনতার শ্যাওলা
গাছ জানে না রাষ্ট্রযন্ত্রের ছলাকলা
গাছ চেনে না সিঁদুর, উলুধ্বনি
জানে না কাবিন, কবুল কারে বলে
শরীর ভরা দাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবে
বিভঙ্গী রাত আর রাস্তাগুলো
কত অন্ধ ইতিহাস ফেরি করে চলে!
আর পড়তে পারে না জামাল। দুই হাতের তালুতে মেলে রাখা বইটা এত শব্দে বন্ধ করে যে, পাশের যাত্রীর আধপাকা ঘুম ছুটে যায়। বোকার মতো খানিকটা তাকিয়ে আবার সে ঘুমিয়ে পড়ে। সম্ভবত শব্দের উৎসটা ঠিকঠাক ঠাহর করতে পারেনি। বিব্রত জামালও ধরা না দিয়ে বাসের জানালা গলিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। যদিও শেষ নভেম্বরে এসি কোচের জানালা দিয়ে অন্ধকার আর কাচে জমে ওঠা ভেজা কুয়াশা ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। জামাল বিরক্তি নিয়ে তাকায় পাশের যাত্রীর দিকে। এই বিরক্তির কারণ সে জানে না। সম্ভবত নিজের অক্ষমতা, ব্যর্থতার আস্ফালন বিরক্তির মতো করে প্রকাশ পাচ্ছে। পরক্ষণেই নিজের ছেলেমানুষি ঈর্ষা আর বিরক্তিতে হাসি পায় জামালের। জামাল বইটা ব্যাগে ঢোকাতে গিয়েও পারে না। খুলে উৎসর্গ পাতা দেখে।
‘কবিতাকে ভালোবেসে যে আমায় ভালোবেসেছিল।’
জলিলের এই আত্মবিশ্বাস জামালকে কতবার যে টুকরো করেছে! একবারও বোঝেনি! একবারও না! জবাকে যেদিন জান বাজি রেখে মাঠ থেকে জলিলের নানার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল, সেদিনও ঘুণাক্ষরে টের পায়নি ওদের দু’জনার গভীর প্রণয়। অথচ কী বোকার মতো জামাল ভেবেই নিয়েছিল, জন্মাবধি একসঙ্গে বড় হওয়া জবা শুধুই তার।
অন্ধ ইতিহাসের পথ ধরে
জামাল আর জবা জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই একসঙ্গে আছে বলা যায়। ওদের বন্ধুতা অনেকটা বংশপরম্পরায়। জামালের দাদা আর জবার দাদা মুর্শিদাবাদ থেকে বাগেরহাট এসেছিলেন। মোংলার চালনা বন্দরের জাহাজঘাটায় দু’জনই খালাসি হিসেবে কাজ করতেন। কাজ করতে করতে বন্ধুত্ব হয়েছে, না কি আগে থেকেই তারা বন্ধু ছিলেন, তা সঠিকভাবে এখন আর কেউ বলতে পারে না। ওদের ছেলেপুলে বড় হলে চাকরি আর কাজের সূত্রে ছড়িয়ে পড়ে বাগেরহাট ও আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলে। কিন্তু দুই জনেরই বড় ছেলে কাঞ্চন আর শিবেন আত্মার বন্ধু হয়ে ওঠে। কাঞ্চন বৈবাহিক সূত্রে শরণখোলা এসে আস্তানা গাড়ে। কাঠ ব্যবসায়ীর একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করে শ্বশুরের বিশাল ব্যবসা হস্তগত হলে ব্যবসা সামলাতে বন্ধু শিবেনকেও নিয়ে আসে তার কাছে। অনেক দেখেশুনে বন্ধুকে বিয়ে দেয় গ্রামের এক পুরোহিতের কন্যার সঙ্গে। কিছুদিন যেতেই কাঞ্চনের ঘরে পুত্র জামালের জন্ম হয়। আর শিবেনের ঘর আলো করে আসে জবা। নামের মিল, একসঙ্গে চলাফেরা দেখে গ্রামে আসা নতুন কেউ ভেবে বসতো ওরা ভাইবোন। বছর দশেক বয়সে গ্রামের মক্তবে যেতে যেতে জামালের পরিচয় হয় সদ্য বাবাহারা জলিলের সঙ্গে। জলিলের নানা ছিলেন এই গ্রামের একমাত্র পাঠশালার একমাত্র আরবি শিক্ষক। জলিলের বাবার মৃত্যুর পর জলিলের মা তাকে নিয়ে বাপের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ায় এই গ্রামে সে নবাগত।
জলিলের সঙ্গে জামালের বন্ধুত্বে দেরি হলো না। সেই বন্ধুত্ব গাঢ় হলো জবার কবিতাপ্রীতিতে।
জলিল সেই বয়স থেকেই কবিতা লেখে। অবশ্য এগুলো কবিতা কি না, এ নিয়ে তার সংশয় কাটে না। দুপুরের ভাতঘুম ফেলে জবাদের বাড়ির পেছনের আম বাগানে অথবা রায়েন্দার পাশে সবুজ ঘাসে বসে তিন জনের কবিতা পড়া আর কবিতা শোনার আসর চলতে থাকে। আর দশটা ছেলেমেয়ের তুলনায় এরা বেশ আলাদা, এটা বুঝতে গ্রামবাসীর সময় লাগে না। জলিল কবিতা লেখে। এই সংবাদ আরবি শিক্ষক নানার কানে পৌঁছাতেও দেরি হয় না। নানার হাতের বেত্রাঘাতের ব্যাপারে জলিল মোটামুটি নিশ্চিত ছিল। কিন্তু জলিলকে অবাক করে দিয়ে নানা অপার প্রশ্রয় দিলেন।
সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে খাতার পাতা কবিতায় ভরে ওঠে। জবার বয়সী অনেকেরই বিয়ে হয়ে গেছে ততদিনে। জাত মিলিয়ে পাত্র না পাওয়ায় জবা তখন সমবয়সী দুই বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতে পারে। জবার প্রতি জামালের টানটা ততদিনে আরও তীব্র হয়। জবা অন্য কারও হতে পারে, এটা ভাবলেই তার মরে যেতে ইচ্ছে করে। এক-আধবার ভেবেছিল, জবাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে। কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায়? এই গ্রামের বাইরে জামালের কোনো পৃথিবী নেই। জলিলকে বলতে চেয়েছে ওর ভালোবাসার কথা। যদি ও জবাকে বুঝিয়ে বলে। কিন্তু জলিলেরও ইদানিং কী হয়েছে। আচমকা কই যে যায়। আবার দু’একদিন পর ফিরে আসে। জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর দেয় না। একদিন জেলেপাড়ায় শুকোতে দেওয়া জালের নিচে বসে জামাল অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে জলিলকে, ‘এই যে এত কবিতা লিখিস, এগুলো দিয়ে কী করবি পরে?’ জলিল অবাক হয়ে তাকায়। আসলেই তো। কবিতা লিখতেই জানে সে। এগুলো দিয়ে কী করবে, তা তো জানে না। পাশে বসা জবা জালের কাঠি নাড়তে নাড়তেই হেসে ফেলে।
-ও কবিতা লিখে তোকে দেবে। তুই ওর জন্যে একটা বই বানায়ে দিবি।
-আমি! আমি বই বানাতে পারি না কি! কী যে বলিস, জবা!
-শিখে নিবি। বন্ধুর জন্যে মানুষ কত কী করতে পারে। তুই পারবিনে! আর শোন বই বানিয়ে প্রথম বইটা আমায় দিবি। দিবি তো?
জবার এমন সিরিয়াস ভঙ্গি দেখে দুই বন্ধু হেসে ওঠে একসঙ্গে।
এমনি এক গল্প করার দিনে রায়েন্দা খালের দিক থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে মহেশ কাকাকে দৌড়ে আসতে দেখে তিন জনই ঘাড় উঁচু করে। হাতের ইশারায় কিছু একটা বলতে চায় কাকা। ঠিক পরিস্কার নয়। কাছাকাছি এলে বুঝতে পারে ওদের সরে যেতে বলছে। হতচকিত উঠে দাঁড়াতে গেলে এক ঝটকায় জবাকে মাটিতে শুইয়ে দেয় জলিল। জামালকেও মাটিতে শুয়ে পড়তে বলে।
-এক্ষুনি জবাকে নিয়ে আমার মায়ের কাছে যা। কোনোমতেই জবাদের বাড়িতে যাবি না। মা যা করার করবে। যা বলছি তাই কর। এক মুহূর্ত দেরি করিস না।
জলিলের কণ্ঠে আশ্চর্য এক কঠোরতা। জামাল চমকে ওঠে। কোথায় পেলো এমন কঠোরতা? কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। কোনোরকম গড়িয়ে উঁচু ডিবি পার হয়ে জবাকে জলিলের মায়ের কাছে রেখে ফিরতে না ফিরতেই গুলির আওয়াজ কানে আসে। আতঙ্কিত জামাল একটা মুলিবাঁশের ঝোপের আড়ালে বসে পড়ে।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ। এটাই ছিল শরণখোলা থানায় সর্ব প্রথম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গানবোট টহল। নদীপথ বরাবরই বিপদসংকুল ওদের কাছে। ফলত নদীপথে বরিশাল হয়ে ঝালকাঠি, কাউখালী, হুলারহাট, তুষখালী বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন করে রায়েন্দা এসে সম্ভবত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তাই আর তীরে না উঠে রায়েন্দা খাল ও নদীতে কতক্ষণ টহল দিয়ে আবার বরিশালের উদ্দেশে চলে যায়। তখন পাঞ্জাবি গানবোট আসতে দেখে আওয়ামী লীগ ও সংগ্রাম কমিটির লোকজন এবং হিন্দু পরিবারগুলো আত্মগোপনে যায়। এই ফাঁকে কিছু হিন্দু পরিবারের ঘর বাড়ি লুট পাট হয়। টানা তিন দিন জবারা জলিলের নানাবাড়ি থাকলো। নিজের বাড়িতে ফিরে এসে খুব অবাক হলো এই ভেবে যে, গ্রামে তো হানাদার বাহিনী ঢোকেনি। তাহলে লুটপাটগুলো কে করলো! কে আগুন দিলো ঘরবাড়িতে! এই গ্রামের সবাই তো আপনজন ছিল! এক বোবা ভয় ওদের শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো যেন।
জুনের এক তারিখ পাঞ্জাবি বাহিনী রাজাকারদের নিয়ে শরণখোলা থানায় ক্যাম্প বসালো। জুলাই মাসের শেষ দিকে রায়েন্দা বাজারের আওয়ামী লীগ নেতার দোতলা বিল্ডিং দখল করে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর শক্তপোক্ত যৌথ ক্যাম্প বসালো। বলা যায় দক্ষিণাঞ্চলের এক শক্তপোক্ত ঘাঁটি হলো এই রায়েন্দা বাজার। ঘাঁটি স্থাপনের দু’দিন পরে এক ভাতঘুমের দুপুরে দু’টি অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। শিবেনকে ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি করে তার বউকে তুলে নিয়ে বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হলো। আর জবাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। জবা অনেকটা ম্যাজিকের মতো ভ্যানিস হয়ে গেলো। পুরো গ্রাম আতঙ্কে জুবুথুবু হয়ে আছে। নির্ঘুম রাত কাটছে সবার। জামাল পাগলপ্রায় হয়ে জলিলের খোঁজ করে। জামালের বাবা বন্ধু পরিবারের শোক আর রাজাকারদের শিয়াল দৃষ্টির আতঙ্ক নিয়ে একেবারে চুপসে আছে। জবাকে কোথায় খুঁজবে জামাল? জলিলকেও কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে মনে ভাবে, একবার জলিলের নানাবাড়ি যাবে কাল সকালটায়। সকাল হতে না হতেই খবর ছড়িয়ে পড়লো জলিলের নানাকে ধরে নিয়ে গেছে। জামালের বাবা জামালকে ঘর থেকেই বের হতে দিচ্ছে না। জবা কোথায় গেলো! এভাবে একটা মানুষ নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে পারে! বাবা-মায়ের চিন্তা, ওদিকে জবার চিন্তা জামাল কেমন ডুবে যেতে থাকে। তার মনে হয় কেউ তাকে বলেশ্বর নদীতে ডুবিয়ে চেপে ধরে আছে। কাটা গরুর মতো ছটফট করে সে। কী শুরু হলো চারদিকে! সব কী শান্ত সুন্দর ছিল। এই গ্রাম, গ্রামের মানুষ, নদী, খাল সব কী দ্রুততায় পাল্টে গেলো।
জবা আমাদের দেখা হবে। না হলে কবিতায় আমাকে খুঁজে নিও। আমার সব কবিতা একটা ছোট্ট ট্রাংকে রেখে বাড়ির পেছনের বাঁশবাগানে পুতে রেখেছি।
জবার অন্তর্ধানের বারো দিন পার হলো। জবার মায়ের খবরও কেউ জানে না। জবাকেও কী তবে…নাহ! আর ভাবতে পারে না জামাল। জলিল কেমন করে ওদের ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো? একবারও ভাবলো না আমার কথা, জবার কথা। অভিমানে রাতের আকাশ ভেঙে নামা জোছনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে জামাল। হঠাৎ জানালায় মৃদু আওয়াজে ধড়মড় করে উঠে বসলো। সম্বিত ফিরতেই বুঝলো আওয়াজটা আর কারও নয়। বন্ধু জলিলের। স্বপ্ন নয় তো! কাঁপা হাতে জানালার কপাট খুলতেই দেখে মুখে কাপড় বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে জলিল।
-বন্ধু ঢেঁকি ঘরে আয়। অনেক কথা আছে।
-তুই কই ছিলি জলিল? জানিস জবাকে…
কথা শেষ করতে দেয় না জলিল।
-জবা বেঁচে আছে। তুই তাড়াতাড়ি বাইরে আয়। আমার সময় কম।
নিজের কানকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যিই জবা… জামাল দ্রুত বাইরে আসে।
-শোন তোদের বাড়িতে আজ আগুন দেবে। তুই চাচা-চাচিরে নিয়া জাইল্লা পারে আয়। আমি অপেক্ষা করছি। একটুও দেরি করিস না। জবারে এক জায়গায় পৌঁছায়া দিতে হবে।
জামাল হাঁ হয়ে থাকে জলিলের কথায়। আজও সেই আশ্চর্য আদেশের সুর। কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় জালিল। জামাল নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। তার মানে জবা বেঁচে আছে! জামালের অন্তরাত্মা কাঁপতে থাকে। দরদর করে ঘামতে থাকে উড়নচণ্ডী বাতাসেও। সে ভেবে পায় না তার নিরীহ বাবা-মায়ের কী দোষ? কেন ওদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হবে। মাকেও যদি কাকীমার মতো…নাহ আর ভাবতে পারে না জামাল। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই ভীত-সন্ত্রস্ত বাবা-মাকে নিয়ে জাইল্লা পারে পৌঁছে যায় জামাল। মোংলাগামী একটা ট্রলারে বাবা-মাকে তুলে দেয় জামাল ও জলিল। ওখান থেকে খুলনায় ওর খালার বাড়িতে আশ্রয় নেবে। জামালকে যদিও ছাড়তে চায়নি কিন্তু জবার কথা শুনে আর না করে না। যাওয়ার আগে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে জামাল। জলিল এক ঝটকায় তাকে নিয়ে একটা মাছ ধরা নৌকায় উঠে পড়ে।
বলেশ্বরের উত্তাল ঢেউ পাড়ি দিয়ে প্রায় আট মাইল উজানে গিয়ে নৌকা থামে। একটা চরের মতো। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যায় না। ঝোপঝাড় ও বাঁশ লতায় পেঁচানো পথ পেড়িয়ে ওরা আস্তানায় ঢোকে। জামাল চমকে ওঠে! গ্রামের বেশ কিছু পরিচিত মুখ এখানে দেখতে পায়। এরা সবাই মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছে! আর জামাল কিছুই জানে না! নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করে জামালের।
-এ কোথায় নিয়ে এলি জলিল।
জবা দেশহীন হলো। দেশ স্বাধীন হলো। বন্ধুত্ব বিচ্ছিন্ন হলো। দেশ স্বাধীন হলো। সীমান্ত তৈরি হলো।
জামালের কথার উত্তর না দিয়ে জবাকে ডাকে জলিল। জবা একটা ছোট্ট পুটলি হাতে একটা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। জামাল স্থির তাকিয়ে থাকে জবার দিকে। এ কী সত্যি! জবা সত্যিই বেঁচে আছে! বারো দিন নয়, মনে হয় বারো বছর পরে ও জবাকে দেখলো।
-শোন জামাল। আবেগের সময় এটা নয়। আজ ভরা জোয়ার। হারামির বাচ্চারা জোয়ারকে বড় ভয় পায়। এই জোয়ার ভোর পাঁচটা অব্দি থাকবে। এর মধ্যেই মহেশ কাকা তোদের রূপসা পৌঁছে দেবে। ওখান থেকে উঁচু রাস্তা পার হলেই শার্শা বাজার। বাজার থেকে বাসে বেনাপোল বর্ডারে যেতে চল্লিশ মিনিটের মতো লাগবে। বেনাপোল পার হয়ে ফের ট্রেন বা বাসে মতিগঞ্জ। জবার মাসি থাকে ওখানে। তার বাড়িতে জবাকে পৌঁছে দিয়ে তবেই তোর ছুটি। যদি জবাকে বাঁচাতে চাস আর দেরি করিস না। জামালের মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে, ‘তুই!’ জলিল মৃদু হাসে। ‘যে হাত কলম ধরতে জানে সেই হাত আজ দেশের প্রয়োজনে অস্ত্রও ধরতে জানে। দেশই যদি না থাকে কবিতা লিখে কী হবে।’ জামাল স্পষ্ট দেখলো, জলিলের চোয়ালটা শক্ত হলেও চোখটা চিকচিক করছে। ‘আর দেরি করিস না জামাল। সময় নষ্ট করলে ঠিকঠাক পৌঁছাতে পারবি না। বেঁচে থাকলে দেখা হবে।’ জবা যেন পাথর। একটা কথাও বলেনি এখন পর্যন্ত। ঠিক নৌকায় তুলে দেওয়ার আগ মুহূর্তে জলিলের দিকে তাকাতেই জলিল ওর হাতটা ধরে।
-জবা আমাদের দেখা হবে। না হলে কবিতায় আমাকে খুঁজে নিও। আমার সব কবিতা একটা ছোট্ট ট্রাংকে রেখে বাড়ির পেছনের বাঁশবাগানে পুতে রেখেছি। সেই কবিতা নিয়ে তোমার কাছে যাবো। তোমাকে ফিরিয়ে আনবো। আগে দেশটা ফিরিয়ে আনি।
এটুকু বলেই চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতায় আবার অন্ধকারে হারিয়ে গেলো সদলবলে। তবে এবারের হারিয়ে যাওয়াই শেষ। আর কখন ম্যাজিকের মতো ফিরে আসেনি। সেদিনই প্রথম টের পেলো জামাল অন্ধকারেও কিছু অনুভব জোনাকির আলোর মতো মৌলিক।
দেশ স্বাধীন হলো। জলিল হারিয়ে গেলো। দেশ স্বাধীন হলো। জবা দেশহীন হলো। দেশ স্বাধীন হলো। বন্ধুত্ব বিচ্ছিন্ন হলো। দেশ স্বাধীন হলো। সীমান্ত তৈরি হলো। দেশ স্বাধীন হলো…