পণ্ডিচেরির রোদেলা সাগর সৈকত আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে যাব—সময়টা ছিল এমন।
আমরা সাদাকালো কিছু শামুক-ঝিনুক কুড়োচ্ছিলাম সৈকতের স্মারক হিসেবে। জাহরাকে বলছিলাম, ‘দেখো, এই এক আমরা ছাড়া বোধ হয় আর কারও কাছেই এ সবের কোনো গুরুত্ব নেই। নয়তো এত-এত লোক, আমাদের মতো আবেগী হয়ে এসব ভাঙাচোরা কুড়োচ্ছে ক’জন?’
জাহরা হাসলো। ‘শোনো, গোটা ভারতবর্ষের লোক এমন ভাবপ্রবণ, শুধু যে বাঙালিই এমন, তা কিন্তু নয়। ভালো করে তাকিয়ে দেখো, আমাদের মতো আরও অনেকেই এমন আছে, ঝিনুক কুড়োচ্ছে, দেশে নিয়ে সাজিয়ে রাখবে, কাউকে দেবে, অথবা যা খুশি। মালাই না হয় গাঁথলো।’ বলতে বলতে চারদিকে প্রথমবারের মতো লক্ষ করল জাহরা, আমাকে কথাগুলো বলার আগেও করেনি। কিন্তু আমার কথা ভুল প্রমাণিত করার মতো কোনও উদাহরণ শেষতক দেখাতে না পেরে নিচের ঠোঁট ওপরেরটার ওপর তুলে ভ্রূকুটি করল। ‘কী ব্যাপার!’
‘কী দেখলে। তোমার কথা কিন্তু ভুল নয়। আসলে ব্যাপার হলো, এখানকার যারা স্থানীয়, তারা ঠিক ভারতবর্ষীয় নয়, এরা আটকে পড়া পর্তুগিজ, ফরাসিদের বংশধর। সমুদ্র নিয়ে ওদের ভাবালুতার ধারা ভিন্ন। এই দেখো, এখানে সাগরের গলায় বেড়ি বেঁধে পোষ মানানো হয়েছে। জোয়ারে যতটুকু এগিয়ে আসে সাগর, ওটুকু জায়গা রেখে পাথরের দেয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে। দেয়াল ঘেঁষে দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ। কী হলো এটা? মেরিন ড্রাইভ তো আমাদেরও আছে।’
রাস্তা পেরিয়ে এসে ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে এক উন্মুক্ত পানশালার সামনে এসে থামলাম দু’জন। বাহারি পাগড়ি পরা এক পরিবেশক, লোকের পছন্দমতো পানীয় ওয়ানটাইম গেলাসে ঢেলে হাতে তুলে দিচ্ছে। আমরা দুই গ্লাস ফ্রুটবিয়ার নিয়ে চুমুক দিতে দিতে দেয়ালের বেড় টানা সমুদ্রটার দিকে চোখে করুণা নিয়ে তাকিয়ে আছি, আর হালকা রোদ সামনে রেখে দোকানের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ফ্রুটবিয়ারের সুশীল মাদকতা উপভোগ করছি। বানিয়েছে দারুণ। মনে হচ্ছিল, মেরুদণ্ডের ঠিক গোড়া থেকে শান্তির শীতল জলস্রোত ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের দিকে বুকে হেঁটে বুঝি এগোচ্ছে।
যুদ্ধশহর ভেলোরের পথে রওনা হলাম
এদিকে আমাদের গাড়ির তামিল ড্রাইভার মেরিন ড্রাইভ ঘেঁষা ফুটপাথ ধরে আমাদের খুঁজতে খুঁজতে এগোচ্ছিল। দু’জনকে দেখতেই পেয়েই বিকট শব্দে হর্ন। অচেনা ভূমিতে চেনা সমুদ্রের মোহে পড়ে ওর কথা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। আমরা পণ্ডিচেরির ছেলেমানুষী জাদুঘরের পাশের রাস্তায় রেখে এসেছিলাম ওকে। এক ধরনের শাস্তি হিসেবেও, বলা যেতে পারে। বাঙালি হওয়ায় অপরাধে সে রীতিমতো জোর করে ঋষি অরবিন্দের আশ্রম, আস্তানা দেখতে আমাদের বাধ্য করেছিল। আমরা দু’জনেই বেশ বিরক্ত ছিলাম ওর ওপর। ভাষার আড়াল তো আছেই, বোঝালেও বুঝতে চাইছিল না।
বেচারার বেজার মুখটা দেখে পরিষ্কার হলো, সময় নিয়েই আসল দুশ্চিন্তা ওর। দীর্ঘ পথ এখনো পড়ে আছে পাড়ি দেওয়ার বাকি, সন্ধ্যার আগেই তো ভেলোর ফিরতে হবে। নিশ্চয়ই এখানে ওখানে খুঁজে হয়রান। ওই পানশালার সামনে আমাদের দেখতে যে পেয়েছে, এটা দু’পক্ষেরই সৌভাগ্য।
সাগরকে বিদায় জানিয়ে যুদ্ধশহর ভেলোরের পথে রওনা হলাম।
ভারতের হাইওয়েগুলো মেঘনা নদীর মতো প্রশস্ত হয়ে প্রায় পুরোপুরি সরলরৈখিক থেকে দিগন্তে মিশে গেছে। আক্ষরিক অর্থেই ওগুলো রাজসিক হাইওয়ে।
ভেলোরে ফেরার মূল রাস্তায় ওই ধরনের এক হাইওয়েতে উঠতে আমাদের তখনো কিছু সময় বাকি। পণ্ডিচেরির ভাষাতীত সুন্দর বুনো রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি ছুটে চলছিল, গতিবেগ খুব বেশি ছিল না। ফ্রুটবিয়ারের প্রভাব তখনো আমার রক্তে মগজে আরাম ছড়াচ্ছে। বেশ অনেকটা পথ এগোনোর পর আমার কাঁধে মাথাটা রেখে ঘুমিয়ে গেছে জাহরা।
জাহরা তখনো তন্দ্রায়
হঠাৎ চোখে পড়লো, দানবাকৃতির এক মালবাহী গাড়ি তার ভীষণ সবল আকার নিয়ে উল্টোদিক থেকে সবেগে ছুটে আসছে। বিপদটা হলো, তার গতিপথ সরলরৈখিক নয়, এদিক-ওদিক দুলছে, যেন টলছে মাতালের মতো।
টলতে টলতেই দেখতে দেখতে গাড়িটা খুব কাছে চলে এলো। গর্জন করছে।এরপর যা দেখলাম, তাতে আমার হৃৎপিণ্ড মুহূর্তে গলাপথে বেরিয়ে আসার জোগাড়। জাহরা তখনো তন্দ্রায়। গাড়িটা বিচিত্র কৌণিক বেগে একেবারে আমাদের লক্ষ করেই ছুটে আসতে লাগলো।
পথ বেশি চওড়া নয়, তামিল ড্রাইভারের চোখে কৌতুক। ট্রাকচালককে এক মুহূর্তের জন্য দেখতে পেলাম। মাথায় পাগড়ি, সূক্ষ্মাগ্র মস্ত বাঁকানো গোঁফ, কামানো গাল, আর ভয়ার্ত দু’টো চোখ।
জাহরাকে যখন ঘটনাটা বলছিলাম, এও বলেছিলাম, ‘কোথাও কোনো গোলমাল হয়ে থাকবে আসলে। অনেক সময় অতি সাবধানতায় যা হয়, এড়াতে চাওয়া দুর্ঘটনাটাই ঘটে। ব্যাপারটা বেশি হয় মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানোর সময়, এ আমি বহুবার দেখেছি। বিশেষ করে যদি ঘটনাক্রমে চালক হয় বাঁহাতি কিন্তু যেতে হয় ডানে অথবা উল্টোটা। নয়তো ট্রাকের ওই শিখ চালকের চোখে ভয় কেন দেখা যাবে।’ জাহরা শুনে গেছে, কিছু বলেনি।
যাহোক, আমাদের তামিল ড্রাইভার ঝুঁকিটা বুঝতে মূল্যবান কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নিল। অথবা তখনই সরে না গিয়ে শেষ মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। যেন ওই মালবাহী গাড়িটার কোনো বিপদে ফেলার ইচ্ছে থাকলেও যেন তা বিফলে যায়। নিজের ওপর হয়তো এতখানি বিশ্বাসই ওর ছিল।
তার সঙ্গে আমার দৃষ্টি বিনিময় হলো
শেষ মুহূর্তটি চলে এলো। শিখ চালক তার দৈত্যকে বাগাতে পারেনি। এবার আমাদের পালা।
তামিল চালক মুখের পেশিতে কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে সিডানের মাথা একবারে বাঁকিয়েই ঝটকায় ডানে বাঁক নিলো। পেছনের চাকায় তীব্র আর্তনাদ। ধুলোয় ভরে গেলো চারপাশ। জাহরা মাথা হেলে পড়ে গেল আমার কোলের ওপর।
ওই ধুলোর ভেতর দিয়েই দেখলাম, আমাদের সিডানের দ্বিগুণ উচ্চতায় থাকা চাকার বৃত্তগুলো যখন জানালার প্রায় কাচ ঘেঁষে যাচ্ছিল, তন্দ্রায় অর্ধচেতন জাহরাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে রেখে বিস্ফারিত চোখে দেখছিলাম ওই ঘূর্ণায় মতিবৃত্ত, কাঁটা, সদ্য ফসকে যাওয়া বীভৎস মৃত্যু।
এরপর অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সামনে আমরা একটা গাড়ি দেখতে পেলাম, পেছনটা খেলা, ছোট ট্রাক মতো। গাড়িটা পেছনে তার ফেলে আসা পথের পুরোটা জুড়ে, ফুল ছিটিয়ে ছিটিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ওটাকে দেখতে পেয়ে গতি কমালো আমাদের চালক।
দেখলাম, পেছন খোলা গাড়িটির মধ্যখানে একটি খাটিয়া পাতা। তাতে আগাগোড়া সাদা কাপড়ে ঢেকে একজোড়া মরদেহ বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মৃত মানুষ দুটির মাথার কাছে, চোখ বন্ধ করে ঘোর কালো এক লোকবাজিয়ে চলেছিল অচিন বাদ্যযন্ত্র। কী করুণ এর সুর! মরদেহ দু’টির পায়ের কাছে বসে যে মানুষটি সারা পথে ফুল ছিটিয়ে ছিটিয়ে চলেছিল তার সঙ্গে আমার দৃষ্টি বিনিময় হলো।
গোঁফ আছে দেখার মতো
কী আশ্চর্য, লোকটি মৃদু হাসছে! চোখে স্পষ্ট বিদ্রূপ। অজান্তেই জাহরাকে ডেকে বললাম, ‘দেখো, দেখো, কী বলতে চায় এ লোক?’
জাহরার তন্দ্রা ভেঙে গেল। চোখের নিচটা একটুখানি ফুলে আছে। জড়ানো গলায় প্রশ্ন করলো, ‘কী হয়েছে? কোন লোক?’
আমি আবার ওর মাথাটা কাঁধে রেখে দিলাম। ‘না, কেউ না।’
যন্ত্র শকট দুটির মধ্যকার দূরত্ব বাড়তে বাড়তে একসময় বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল মরদেহের গাড়িটি। বিষাদী ওই মৃত্যুমুখী সুর এরও বেশ আগে অন্তর্হিত হয়েছিল।
ভেলোরে এসে গাড়ি থেকে নামার পর গাঢ়স্বরে বললাম, ‘ধন্যবাদ ভাই।’
ঋষি অরবিন্দভক্ত এ তামিল সাধারণ পুরুষদের মতো বলিষ্ঠ নয়। তবে গোঁফ আছে দেখার মতো। মাথা নুইয়ে নীরবে বিনয় দেখিয়ে হাসলো লোকটা। চোখ দুটো ঝিমমিক করছে, যেন সব বুঝে ফেলেছে।
হাত বাড়িয়ে দিলাম। সানন্দে চেপে ধরলো ও। বললাম, ‘চায়ী?’
তামিল টানের ভাঙা হিন্দিতে জবাব, ‘নেহি সাব, যানা পাড়েগা।’
‘বেশ, দেখা হবে আপনার সঙ্গে।’
‘ফির আইয়ে তো’— হাতের ইশারায় ফোন বোঝালো। আমিও বুঝে নিয়ে বললাম, ‘বেশ বেশ। আপনার ছাড়া আর কারও গাড়িতে উঠব না। ঋষি অরবিন্দের মাজারে মাজারে থামাতেও পারেন বারবার, আমাদের কোনও অসুবিধা নেই।