এক.
এত ভাব নিচ্ছস কেন?
যেদিকে তাকাই, সব জায়গাতেই গোলাপ আর গোলাপ। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। নিজেকে মনে হচ্ছে গোলাপের রানি।
ও, বুঝসি। সেজন্য ভাব নিচ্ছস?
হু হু হু। তুই নে। এই ফুলের মাঝে অনুভূতিই অন্যরকম।
হ রে! তর মনে বসন্ত এসে গেছে। প্রেম করবি?
কী? কী বললি? প্রেম? হইছে-আমার কখনো প্রেম-টেম হবে না। টের পাচ্ছস? দেখ, সুমধুর সুগন্ধ ভেসে আসছে।
এটা মাধবীলতা ফুলের গন্ধ।
মাধবীলতা?
হ, মাধবীলতার ফুল ছোট আর ঘিয়ে রঙের। অত্যন্ত সুগন্ধময় ও দুর্লভ গাছ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাধবীলতা নিয়ে কী বলেছেন জানস?
আমি কবিতা খুব কম বুঝি। পড়িও কম। কালেভদ্রে দুই-একটা পড়ি। তুই বল কী বলেছেন।
তিনি বলেছেন, ‘বসন্তের মাধবী মঞ্জরী মিলনের স্বর্ণপাত্রে সুধা দিলো ভরি।’
বাহ! অসাধরণ। তবে বসন্তে মেয়েরা করবী ফুল খোঁপায় দেয়। চল সামনে হাঁটি। করবী পেলে তরে কিনে দিচ্ছি।
রানী আর মাসউদ হাঁটছে। কাল বসন্ত দিন। রঙিন বসনে, ফুল্ল সাজে বসন্তের প্রথম দিন কখনো কাটানো হয়নি রানীর। আজ অনেকে সেজেছে সে। মেরুন রঙের থ্রিপিস পরেছে। চুলের একপাশে সিঁথি করেছে। চুল বেণী করে ক্লিপ দিয়ে আটকে রেখেছে। কিছুটা রোমাঞ্চের পরশ দিচ্ছে মাসউদকে। সাদুল্লাহপুর গোলাপ বাগান। এই বাগানে এর আগে কখনো আসেনি রানী। পত্র-পত্রিকা আর টেলিভিশনে অনেক খবর দেখেছে এই বাগান নিয়ে। বিশেষ করে প্রতি বছর ফাল্গুন এলেই খবরের কেন্দ্রবিন্দু এই গোলাপ বাগান।
ওরা হাঁটছে। মোটামুটি আজ ভালোই ভিড়ভাট্টা। কারও মাথায় গোলাপের রিং, কারও খোঁপায় গোঁজা গোলাপ। অনেকে মালা করে গলায় পরেছেন গোলাপ। কেউবা হাঁটু গেড়ে প্রিয় মানুষটিকে উপহার দিচ্ছেন গোলাপ। মাসউদ বললো, অন্য ফুলও আছে। হলুদ গাঁদা, জারবেরা, ক্যালেন্ডিয়া, চন্দ্রমল্লিকাসহ নানান জাতের ফুলের চাষ হয় এখানে। রানী বললো, দারুণ প্রকৃতি। প্রতিদিন যদি এখানে আসতে পারতাম।
রানী, তরে একটা কথা বলতে চাই।
কী কথা?
ইদানীং আমার একটা প্রেম করতে ইচ্ছে করছে। কয়েকদিন ধরে ইউটিউবে প্রচুর রোমান্টিক নাটক দেখছিলাম, গান শুনছিলাম।
গুড। তো প্রেম কর। ইচ্ছে হইছে কর, না করছে কে।
ইচ্ছে হলেই তো আর প্রেমে পড়া হয় না। কে করবে প্রেম, কে আমাকে সময় দেবে? এই প্রযুক্তির যুগে সবাই ডিজিটাল প্রেমে ব্যস্ত। আমার আবার এসব ভাল্লাগে না। আমার ইচ্ছে-যেই প্রেমে পড়ুক, ভার্চুয়ালি নয়, সরাসরি প্রেম হবে। একসাথে ঘুরব। পার্কে যাব। বাগানে প্রকৃতি দেখব। মাঠে যাব, ঘাসের ওপর শুয়ে থাকব। পাশে বসে থাকবে প্রেমিকা। ঘাসের পাতা ছিঁড়ে আমার নাকে ধরবে, এ রকম প্রেমিকা চাই। দেখ, আজ তুই আর আমি এই গোলাপ বাগানে ঘুরতেছি। কী অদ্ভুত অনুভূতি, মজাই আলাদা।
তা ঠিক বলছস। বাট…
বাট কী?
এই নগরীর যা অবস্থা, তাতে ডিজিটাল ছাড়া উপায় কী বল। জ্যাম, যান্ত্রিক জীবন, করোনাকাল। দম বন্ধ জীবন। সেই আগিলা যুগের প্রেম কেউ করতে চায় না। সময়ও ম্যাচ করে না। বুঝলি তো?
কিন্তু কী করার, গোলাপ বাগানে গোলাপের মাঝে নিজেকে সামলে নিতে পারেনি মাসউদ। ভাবনা বাদ দিয়ে ফোন দিলো রানীকে।
বিকেল শেষ হয়ে আসছে। সবাই নিজ নিজ গন্তব্যে ছুটছে। রানী আর মাসউদ গোলাপের বাগানে ভেতর ডুবে আছে নিঃশব্দের মতো।
দুই.
কিছুটা ক্লান্ত দেহ। বাসায় এসেই ঘুমিয়ে পড়ে মাসউদ। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায়। বিছানা থেকে উঠে মুখটা ধুয়ে নিলো। ড্রয়িং রুমে গিয়ে টিভিটা অন করে স্পোর্টস চ্যানেলে খেলার খবরটা দেখছে। হঠাৎ গোলাপ বাগানের কথা মনে পড়ে গেলো। বিশেষ করে রানীর কথা। মেয়েটা এত সরল সোজা, বাট প্রেমটাই বোঝে না। কখনো বললো না, ‘মাসউদ, তোমায় ভালোবাসি’। মাসউদও তাকে সরাসরি কখনো বলেনি ভালোলাগার কথা।
গত বছর পহেলা বৈশাখে রমনায় তাদের প্রথম দেখা। পথম যেদিন রানীকে দেখেছিল, তখনই ভালো লেগেছিল তাকে। দেখতে বেশ সুন্দরী। লাল ফর্সা চেহারা। হাত, পা ধবধবে সাদা। হাত পায়ের দিকে তাকালে আর চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। বেশ সুন্দর। সে সময়ই রানীকে বলেছিল, চলো বন্ধু হই। হাসিমুখে উত্তর দিয়ে তখন রানী বলেছিল, ধন্যবাদ। এরপর সময় পেলেই দুজনে মাঝে মাঝে বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে যায়। হাতে সেলফোনটা নিয়ে রানীকে ফোন দিলো।
হ্যালো, ধুর! তুমি যে কী, ফোন দিবা না?
কেন?
ঠিকমতো পৌঁছাইছো কি না জানাব না?
ধুর, এসে দিছি একটা ঘুম।
ভালো তো। কাল তো ফাগুনের দিন। চলো ঢাকার বাইরে কোনো গ্রামে যাই। ঘুরে আসি।
সম্ভব না, বলেই ফোনটা কেটে দিলো।
টেলিভিশন বন্ধ করে দিলো। মোবাইলটা রেখে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ালো মাসউদ। বাইরে তাকিয়ে দেখে মধ্যরাত। আবারও বিছানায় এলো। একবার বসছে, আবার শুয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ভাবছে। রাত বাড়ছে। পায়চারী করতে করতে একসময় বিছানায় এসে ঘুমিয়ে পড়লো মাসউদ।
তিন.
রানীকে কালকের ওই কথাটা বলার আগে আরও কবার ভাবা উচিত ছিল। কিন্তু কী করার, গোলাপ বাগানে গোলাপের মাঝে নিজেকে সামলে নিতে পারেনি মাসউদ। ভাবনা বাদ দিয়ে ফোন দিলো রানীকে।
হ্যালো, তুমি কই?
আমি…বাসায়। কেন?
বিকেলে দেখা করতে পারবা?
ওকে। টেক্সট দিয়ে রাখো। আমি চলে আসবনি।
ওকে। রাখছি।
মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছে। ওরা হেঁটে হেঁটে বাসস্ট্যান্ডে এলো। রানী বাসে উঠবে। হাতটা ধরে মাসউদ বললো, মিস ইউ। ভালো থেকো।
ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলো। নাহ! আজ সব খুলে বলতেই হবে। দুই দিন পর ফ্লাইট। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি হয়েছে। কোম্পানিতে চলে যেতে হবে। যেতে হবে কানাডায়। ছাড়তে হবে ঢাকা। বিছানা থেকে উঠে গোসল সেরে কাপড় চোপড় পরে রেডি হলো। আজ নীল রঙের জিন্স প্যান্টের সঙ্গে হালকা আকাশি রঙের ফুল শার্ট পরেছে। বের হলো মাসউদ। ভিসা সেন্টারে কিছু কাজ আছে। এরপর হোটেলে লাঞ্চ সেরে বিকেলে যাবে আশুলিয়ায়। ওখানে রানীকে আসার জন্য বার্তা দিয়ে রেখেছে মাসউদ।
চার.
আবহাওয়াটা চমৎকার। বেশি শীত নেই। রোদ আছে। আকাশে কাক উড়ছে। মাসউদ চলে এলো আশুলিয়ায়। ঢাকার দূষিত বায়ু ছেড়ে বাঁচতে মাঝে মাঝেই এখানে আসে সে। আজ একটু অন্যরকম। দুদিন পর এই আলো বাতাস ছেড়ে চলে যাবে দূর পরবাসে। এ কথা ভাবতেই শরীর শিউরে ওঠে মাসউদের। রানী চলে এলো। মাসউদ বললো,
কী খবর? তোমাকে তোমাকে দারুণ লাগছে। মাসউদের কথা শুনে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে রানী। কোনো কথা নেই মুখে।
কী ব্যাপার কথা বলছ না কেন? তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। হয় তো আজই তোমার সঙ্গে শেষ দেখা। ফ্লাইট ঠিক হয়ে গেছে। নতুন চাকরি হয়েছে। যেতে হবে কানাডায়।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো রানীর। মনটা বিষণ্ন। চোখের কোনায় জল আসছে। কিছুক্ষণ মাসউদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। বললো, তার মানে চলে যাচ্ছ?
মাথা নিচু করে বসে আছে মাসউদ। তিন মাস পর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা রানীর। পরীক্ষা শেষে কয়েকদিনের জন্য মাসউদকে নিয়ে বেড়ানোর পরিকল্পনা করেছিল রানী। মাকেও রাজি করিয়েছিল। মাসউদের কথা মাকে অনেক বলেছে। রানী বললো, অভিনন্দন। নতুন জীবন শুভ হোক।
তোমায় অনেক মিস করবো।
পরীক্ষার পর তোমাকে নিয়ে ঘোরার প্ল্যান করেছিলাম। মাকেও রাজি করিয়েছিলাম।
মাসউদ রানীর হাতটা ধরে একটা হাসি দিলো। কিছুক্ষণ বসার পর রানী বললো, চলো। সামনে হাঁটি।
ঠিক সন্ধার আগে। হঠাৎ আকাশ মেঘলা হয়ে গেলো। ওরা হাঁটছে। কিছুদূর যাওয়ার পর ছোট্ট একটা ব্রিজে দাঁড়ালো। এরই মধ্যে হালকা বৃষ্টি শুরু হলো। মাসউদকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু রানীর। বললো, চাকরির খবর কখনো বলোনি কেন? ওখানে গিয়ে কতদিন থাকবে? ঢাকায় তো আর মনে হয় দুই-তিন বছরের মধ্যে আসা হবে না। ততদিনে বাবা হয়তো বিয়ের ব্যবস্থা করবে। বাট আমি…
কথা বলতে পারছে না রানী। চোখ থেকে জল পড়ছে। মাসউদও কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখলো।
বৃষ্টি থেমে গেছে। মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছে। ওরা হেঁটে হেঁটে বাসস্ট্যান্ডে এলো। রানী বাসে উঠবে। হাতটা ধরে মাসউদ বললো, মিস ইউ। ভালো থেকো।