ওই বাড়িটা শূন্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকে ভুলে গেছে বাড়িটা কার ছিল। এই শূন্যতা নিরাকার, হাহাকারহীন। কেউ আবার ভাববেন না যেন শূন্যতার গহ্বরে কী আছে, তা খুঁজতেই আমি ওই বাড়ির চৌহদ্দিতে উঁকি দিচ্ছি।
কুয়াশার পর্দা যেমন সকালের হাওয়াকে ঘন আর থমথমে করে তোলে তেমনি এক বিপন্নতা ঘিরে থাকে শূন্য বাড়িটাকে। আরও এগিয়ে যাই। জানি ভয় নেই, অরক্ষিত বাড়িটির ভেতরে ঢুকলেও বাধা দেওয়ার কেউ নেই। কে বাধা দেবে? দাবিহীন বাড়িটাকে এখন দেখলে তো আবর্জনা ফেলার নির্ধারিত স্থান বলে ভুল হয়।
দ্বিধাহীন এগিয়ে যাই। ওই তো দেখা যাচ্ছে বাড়ির মূল দরজায় আঁকা লাল রঙের স্বস্তিকা চিহ্নটা অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। দেয়ালের চুনকাম খসে পড়ছে। বারান্দার সিলিংয়ে মৌমাছির ঢাউস চাক হয়েছে।
আই শেপের এক তলা বাড়িটা অনেকটা জায়গা জুড়ে নির্মিত। ঘরগুলো স্কুলঘরের মতো টানা বারান্দা দিয়ে পরিবেষ্টিত। বাড়িটার ভিত আর দেয়াল ইটের, ছাউনি টিনের। ত্রিভুজাকৃতির মরচে ধরা টিনের চালের এখন নাজুক অবস্থা। মেঘ ভেঙে পড়লেই চাল ফুটো হবে। তাকিয়ে দেখি একটা ভারি মেঘ উপুড় হয়ে আছে টিনের ছাদে। এবার পিছু ঘুরি। হাতে খুব বেশি সময় নেই। যে কাজে এসেছি তা বৃষ্টি নামার আগেই সারতে হবে।
সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। আগের লেপাপোঁছা উঠানে এখন হাঁটুসমান ঘাস আর আগাছা। আগাছা আমূল ভেজা, দেখে মনে হচ্ছে টপটপ করে শিশির ঝরছে। আসলে শিশির বা কুয়াশা কিছুই নেই। এই শুকনো মৌসুমে হাওয়া চুঁইয়ে তবু কার্যকারণহীনভাবে জল ঝরছে। ভুল হলো। জল না, পানি। পানি ঝরছে।
পানির কাছ থেকে সরতে সরতে ঝোঁপে পা পড়ে। কাঁটামান্দারের ঝোঁপ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে দাঁড়াই। দেখতে পাই, উঠানে বেখাপ্পাভাবে একটা তুলসীমঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে। বাঁধানো বেদীর গায়ে ফাটল ধরেছে। ফোকরে লতা আর বটগাছ গজিয়েছে। বেদীর তুলসীতলাও অপরিচ্ছন্ন। শান্ত-নিরিবিলি জায়গা পেয়ে পাখিরা ইচ্ছেমতো প্রাকৃতিক কাজ সেরেছে। তুলসী গাছের পাতাও বাদ যায়নি।
ওর চোখভরা আতংক থাকবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হয় না। আমাকে বিস্মিত করে ছেলেটি বিদ্রুপের স্বরে বলে, বাড়িতে কেউ নাই।
বেদীর ওপরে বেকায়দারকম ছড়িয়ে পড়া তুলসী গাছটা দেখে বুঝতে পারি গাছটির দিকে কারও নজর পড়েনি। অমনোযোগীতা ছিল হয়তো। বাতাস পরিশুদ্ধ করতে লোকচক্ষুর অন্তরালে গাছটা তবু নিজের শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েই যাচ্ছে।
একটা বিষয়ে খটকা লাগে, এই যে এত গাছগাছালি ঘেরা বাড়ি, এখানে তো বিচিত্র সুরে পাখি ডাকার কথা। কিন্তু কোথাও কোনো কুজন নেই। বৃষ্টি থামার ঠিক পরের মুহূর্তের মতো স্তব্ধ চারদিক। এই স্তব্ধতা আর্দ্র নয়; শুষ্ক, প্রাণহীন। আবার ওই যে দেখতে পাচ্ছি উঠানের পশ্চিমপাশের গন্ধরাজ গাছ ভরা ফুল, অথচ ফুলের আশপাশ কোথাও ঘ্রাণ নেই। গন্ধরাজের ঘ্রাণ কি রাতে ছড়ায়? আর অমন জমকালো ভাঁটফুলের ঝোপ? দিনে দুপুরে ওরাও কি অমন নির্জীব আর ঘ্রাণহীন থাকে? তা অত বাসী ফুলই বা গাছে লটকে থাকে কী করে? ওই তো ওই শিউলি গাছটারও একই অবস্থা। অসময়ে শাখায় শাখায় ঘি রঙা নিষ্প্রাণ ফুল ফোটাচ্ছে।
ওসব ফুল গাছ-টাছ নয়, আমি মেহগনি গাছ জোড়া খুঁজছিলাম।আসলে গাছগাছালি দেখলে মাথার ভেতরে কেবল ‘মেহগনি কাঠের খাট’ ঘুরতে থাকে। বুবাইয়ের জন্য একটা খাট দরকার। ছেলেটা বড় হয়েছে, স্কুলে যাচ্ছে। এই জানুয়ারিতেই সুরেশ মাস্টারের ছেড়ে যাওয়া স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ছেলেকে এখন আলাদা ঘর দিতে হবে। খাট ছাড়া কি আর ঘরের কথা ভাবা যায়? বুবাইয়ের মায়ের একটাই কথা, ছেলের জন্য মেহগনি কাঠের খাট চাই।
সুরেশ মাস্টারের বাড়িতে আর যাই হোক কাষ্ঠল গাছের অভাব নেই।এই তল্লাটের মানুষেরা তা ভালো করেই জানে। বিশালাকার গাছগুলোর জন্যই এখানে লাগাতার নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে থাকে। আবার গাছগুলোর জন্যই মানুষ এই স্তব্ধতাকে খান খান করে ভাঙে।এই তো দূরে দাঁড়িয়েও দেখতে পাচ্ছি, জ্বালানির জন্য উঠানের আতা আর কাঠবাদাম গাছের সুবিন্যস্ত ডালগুলো খেয়ালখুশিমতো কেটেছে কেউ, কাটা ডালপালা গাছের গোড়াতেই ছড়িয়ে রেখেছে। শুকনো পাতাগুলো নির্দ্বিধায় মাড়িয়ে গেছে মানুষ কিংবা দুরন্ত কোনো প্রাণী। ওসব বাদে এই দুটো মেহগনি গাছই কেবল হাতের নাগালে ছিল। বাকিসব সগৌরবে আকাশ ছুঁয়েছে।
কাছে গিয়ে দেখি একটা মেহগনি গাছ নেই। তবে যেটা আছে সেটাও কম পুরু না। মনে পড়ে আমার বুবাইটার ঘরের জন্য একটা খাট দরকার। এমন একটা গাছ কেটে চেরাই করে শুকিয়ে আধুনিক নকশার একটা বক্স খাট বানাতে কত খরচ পড়বে কে জানে। তবে গাছটা কাটতে সময় বেশি লাগবে না। একটা বেলাই যথেষ্ট। দুপুরের পর আরো ভূতুড়ে হয়ে যায় জায়গাটা। অমন গা ছমছমে সময়ে গাছটার ব্যবস্থা করতে হবে। এই যে এর জোড়াটাকে যে আগেই কেটে নিয়ে গেছে কেউ টুঁ শব্দটিও হয়নি।
এখানে এখন শব্দ করবে কে? আগে হরদম শব্দ হতো।গানও শিখতো এই বাড়ির মেয়েটা, ভোর হলেই আ আ আ সুর তুলে হারমোনিয়াম বাজাতো।
ওরা সেদিন হারমোনিয়ামটা ভেঙে ফেলেছিল। সুরেলা যন্ত্রটা সেসময় বড় বেসুরো হয়ে উঠেছিল। ভাঙার শব্দ এমনই হয়, দরজা, জানালা, বইয়ের আলমারি, ঠাকুরের আসন-সব বেসুরো শব্দেই ভাঙে।
সুরেশ মাস্টারের এই বাড়িতে ভাঙচুর হয়েছিল। আমি দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। উত্তেজিত ছাত্রজনতার অংশ হইনি।এসব ঘটনা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখতেই আমার ভালো লাগে। কে চায় ঝামেলায় জড়াতে! আজ তেমন কোনো ঝুট-ঝামেলা নেইবলেই বাড়িটার এত কাছাকাছি চলে এসেছি। খুটে খুটে স্বস্তিমতো সব দেখে নিচ্ছি।
হঠাৎ দেখি আট-দশ বছর বয়সী একটাছেলে ছুটে এসে তুলসীমঞ্চের সামনে দাঁড়িয়েছে। ও আমাকে দেখতে পায়নি। সর্তক চোখে চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে নির্দয়ের মতো ছেলেটা গাছের পাতা টেনে টেনে ছিঁড়তে শুরু করেছে।ওর পরনের গেঞ্জির কোচড় ভরে উঠেছে তবু ও থামছে না।
আমি ডাক দেই, অ্যাই কী করিস রে?
ভেবেছিলাম আমার উপস্থিতিতে ছেলেটা ছুটে পালাবে। ওর চোখভরা আতংক থাকবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হয় না। আমাকে বিস্মিত করে ছেলেটি বিদ্রুপের স্বরে বলে, বাড়িতে কেউ নাই। মালাউনরা ভাগছে।
তাতে তোর কী রে?
তাতে আমার বাপের বিয়া…।
ছেলেটি আধময়লা দাঁত বের করে হাসছে। আমি চড় দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত উঁচু করতেই ও হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির সীমানা ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
তাতে তোর কী রে?
তাতে আমার বাপের বিয়া…।
ছেলেটি আধময়লা দাঁত বের করে হাসছে। আমি চড় দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত উঁচু করতেই ও হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির সীমানা ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
সেদিনের আগ্রাসী ছাত্রজনতার মাঝেএই ছেলেটিও হয়তো ছিল। স্বস্তিকা আঁকা ঘরের দরজা, জানালা আটকে রেখেও ওই সময়ে শেষ রক্ষা হয়নি। প্রথমদিকে ছাত্রদের ঘরে অনুপ্রবেশ আটকানো গেলেও ওদের মুখনিঃসৃত শব্দাবলি আটকানো যাচ্ছিল না। প্রায় অর্ধশত কণ্ঠের শ্লোগান বলে কথা, থেমে গেলেও প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল শ্লোগানের একেকটা শব্দ, ‘মালাউনের ফাঁসি চাই…ফাঁসি চাই।’ এমন শ্লোগানের উচ্চারণে শরীরে অলৌকিক কিছু একটা ভর করে হয়তো। একটা পর্যায়ে তাই ছাত্রদের লাথির তোড়েই দরজা ভেঙে গিয়েছিল।
বুঝে যাই বুবাইয়ের জন্য মেহগনি কাঠের খাটটা আপাতত বানানো সম্ভব হবে না।
ঘরে মাথা নিচু করে অনেকদিন পর অনেক অনেকবার সেদিন মালাউন শব্দটা শুনছিলেন রামমোহন হাইস্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক সুরেশ ধর। শব্দটা শেষবার তিনি শুনেছিলেন বছর দুই আগে, এক সহকর্মীর মুখে। ওইবার স্কুলের পিকনিকের চাঁদার পরিমাণ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে একটু অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। সিনিয়র শিক্ষক আর সদ্য যোগদানকৃত সকল শিক্ষকদের সমপরিমাণ চাঁদা ধার্য করা হয়েছিল। তার কাছে চাঁদা চাইতে এসেছিল ক্লাস থ্রির ইংরেজি শিক্ষক হারুণ। সে সবে যোগদান করেছিল স্কুলে। চাঁদার পরিমাণ শুনে সুরেশ ধরের ভ্রু কুঁচকে উঠলেও আড়ষ্ট ভঙ্গিতে তিনি চাঁদার টাকা দিয়ে দিয়েছিলেন। বিকালে বাসায় ফেরার পথে ধর্ম স্যার জিন্নাহ বলছিলেন, চাঁদার পরিমাণ ইনসাফ মতো হয় নাই। কালকে হেডস্যারের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। কিছুতেই এই চাঁদা দেওয়া যাবে না। আমরা একজনও চাঁদা দেবো না। সুরেশ স্যার তো চাঁদা দিয়ে দিয়েছেন; হারুণ স্যার বলে উঠতেই জিন্নাহ স্যার বলেছিলেন, দেবেই তো, হিন্দুমানুষ যে। নিজের পরিচয় শুনে সেদিন কুণ্ঠিত ভঙ্গি ছেড়ে আপাদমস্তক লজ্জায় ডুবে গিয়েছিলেন সুরেশ ধর।
নিজের বাড়ি-ঘর ভাঙচুরের দিনে সুরেশ ধরের সেই লজ্জাটুকুও ভেঙে গিয়েছিল। এমনিতে বিজ্ঞানের শিক্ষক সুরেশ ধর ছিলেন আপাদমস্তক ভদ্রলোক। বিজ্ঞান সংক্রান্ত পড়াশুনার নেশা ছাড়িয়ে তিনি কেন ওই দিন ক্লাসে ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনায় ঢুকে গিয়েছিলেন বিষয়টা কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারেনি। এমন কি ক্লাস এইটের ছাত্ররাও না। ওদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছিল কী করে সে সম্পর্কেও ওরা কিছু বলতে পারেনি। রক্তের ভেতরে টগবগানি টের পেয়েছে শুধু। তার জেরেই এই বাড়িতে হামলা করেছে ওরা।
বাবাকে আড়াল করতে গিয়ে সুরেশ মাস্টারের ছেলে রাজেশ মার খেয়েছে সেদিন। রাজেশও কম মারকুটে ছেলে না। রাজেশের সঙ্গে একবার আমার হাতাহাতি হয়েছিল। আমার নির্দোষ কৌতুকে ক্ষেপে উঠেছিল রাজেশ। একদিন, হাত টেনে ধরে ওকে বড়বাজারের‘মান্নার বিখ্যাত গরুর চাপ’ গাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, ‘এক গাল খেতেই হবে।’ কথাটা শেষ না হতেই আমার গালে চড় মেরেছিল রাজেশ। আমি তখন ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে ছন্দ আওড়েছি, ‘তুলসীপাতা, তুলসীপাতা…হিন্দুরা খায় গরুর মাথা।’ সেই থেকে আমাকে দেখতে পেলে রাজেশ অন্য দিকে হাঁটতে শুরু করে। এখন তো বাবার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ও বাড়িই ছেড়েছে।
এদিকে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে আমি অন্যমনস্ক হয়ে গেছি বুঝতে পারিনি। আধভাঙা একটা ইটে হোঁচট খেতে খেতে সামলে উঠি।ঘাড় তুলে দাঁড়াতেই আমার বিস্ময়ের সীমা থাকে না। দুজন বিশালদেহী মানুষ আমার আরাধ্য মেহগনি গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে।
লতা-গুল্মের ঝোপ ছাড়িয়ে মাথাটা আরও উঁচু করি। মানুষ দুজনের হাতে থাকা রোদ পিছলানো চকচকে কুড়াল জোড়ায় চোখ পড়তেই মন আফসোসে ভরে ওঠে। বুঝে যাই বুবাইয়ের জন্য মেহগনি কাঠের খাটটা আপাতত বানানো সম্ভব হবে না।
মন্তব্য