গল্প লেখার তাড়া, ক্রমাগত লেখার তাড়ায় গল্পকারের নিত্য রুটিন হুমড়ি খায়। এইবার সম্পাদক গোঁ ধরেছেন, কনটেম্পোরারি আইটেমে লিখুন। কনটেম্পোরারি থিম। কি-বোর্ডে আঙুল থেমে যায় গল্পকারের। প্রতিমুহূর্তে যে দেশে বদলে যায় আলোচনার বিষয়, সেখানে গল্পের বিষয় নির্বাচন করা আরও কঠিন। তবু গল্পকার ভাবে, ভাবে কোন কন টেম্পোরারি মুহূর্তটা ধরবে সে! কোনটা! ধরতে তো হবেই একটা কিছু, লক্ষ-কোটি মুহূর্তের একটি মুহূর্ত—নিজের গল্পকার সত্তা টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই।
গল্পকারের সাধ, আমার প্রতিটি মুহূর্ত গল্প হয়ে উঠবে। এক বিষাদাক্রান্ত সন্ধ্যায়, পাহাড়ের ঢাল ঘেঁষে চলে যাওয়া বুনো পুরুষ-নারীর মিছিল, গাছের ডাল থেকে একটানা ঝিঁঝি, নাম না-জানা একটা পাখির কোউউউউউউউ শব্দে কেমন মাথা ঝিম ধরে যায় আমার। গভীর ঘুমে ভারী হয়ে আসা চোখদুটো গায়ের সমস্ত জোরে খুলে রাখি আমি।
আমি বুনো নারী-পুরুষের মিছিল দেখি, কোথায় যায় এরা? কোথায় গিয়েছিল? কী অদ্ভুত নাগরিক যন্ত্রণাহীন নিষ্পাপ তরঙ্গ এদের চলে যাওয়ায়! আমি দেখি, অবাক শান্তিতে দেখি, নিশ্চিন্ত স্বস্তিতে দেখি। দেখছি গত দুদিন ধরে, প্রাণ জুড়িয়ে দেখছি। হ্যাঁ, শান্তিতে আর স্বস্তিতে। কারণ, সভ্য সমাজে যে গুরুভার ও দায়ের জীবন ফেলে এসেছি আমি, চাইলেও আর ফেরা হবে না সে জীবনে।
এ রাস্তায় নিত্য যাতায়াতে কোনোদিনই এদের কাউকে আমার চোখে পড়েছে বলে মনে পড়ে না। পড়ার কথাও নয়। আমি তো চলেছি পিচঢালা মসৃণ নিষ্প্রাণ পথ দিয়ে, এই সবুজ অরণ্যের প্রাণময়তায় প্রবেশের সুযোগই হয়নি কিংবা প্রয়োজন কিংবা ইচ্ছারও। ইচ্ছারা তো পরিবেশ পরিস্থিতির অধীন। তাদের নিয়ন্ত্রণে পুতুল বৈ দেখি না নিজেকে। সাধ-আহ্লাদ-বিলাসিতা কিংবা এসব জীবনে থাকে কিংবা থাকতে হয়, তাই বা আমি জানতে পেরেছি কখন!
এই যে গল্পকার আমাকে খুঁজে চলে এসেছে গজারি বনের গহীনে, আমার জীবন কিংবা স্বপ্ন কি তার মতো? আজ তার সঙ্গে দেখা হওয়ার মুহূর্তে আমি অসুখী হলাম। ভাবলাম আমি কেনো এই গল্পকার হলাম না। নিশ্চয়ই তবে ওর মতো আমার নিশ্চিন্তে অপার শান্তিতে এই শান্ত প্রকৃতি আর অচেনা আদিবাসী জীবন দেখার সুযোগে আমি আর কারও কাছে চলে আসতে পারতাম! আর নিজেকে নিরাপদ রেখে আমার মতো অন্য কারও শান্তির ঘুম ভাঙিয়ে তার কাছে জানতে চাইতাম প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে বলো। আমি প্রতিটি মুহূর্তের গল্প বলতে চাই।
নিজের শখ সাধ-আহ্লাদ স্বপ্ন কত কিছুই থাকার কথা আমার, সব এই নিভৃতে ঘুমিয়ে উপলব্ধি করছি। জীবনের একটি দিন, একটি ঘণ্টা এভাবে নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় পাইনি এর আগে। কেবল নাক-মুখ গুঁজে কেবল দৌড়েছি, বেঁচে থাকার পেছনে দৌড়েছি। বাঁচিয়ে রাখার পেছনে দৌড়েছি। সকাল পার করে বিকালের দিকে, বিকাল পার করে রাতের দিকে। কেবল দৌড়। সার্টিফিকেটের পেছনে দৌড়, চাকরির পেছনে দৌড়, টিকে থাকার দৌড়, টিকিয়ে রাখার দৌড়। এই অবিশ্রান্ত দৌড়ের দৃঢ় বাঁধের ফাটল চুঁইয়ে কখন যে একটু নেশার রঙ লেগে গেলো, গায়ে গতরে, হৃদয় মনে! তারপর সেই নেশার মাশুল! মাশুলের পেছনে দৌড়! এখানে অলক্ষ্যে শুয়ে আছি বলে সব দেখছি সেলুলয়েডের ফিতার মতো। কী অর্থহীন হয়ে গেলো মুহূর্তেই সবকিছু। আমি আর দৌড়াবো না ঊর্ধ্বশ্বাসে বেঁচে থাকার লড়েইয়ে।তাই বলে মুহূর্তকাল থেমে কী থাকবে এই পীচঢালা রাস্তার গাড়ির সারি, আমার ছেলের বড় হওয়া, আমার মায়ের আরও বুড়িয়ে যাওয়া, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে রোগীদের লম্বা সারি। আমার মতো জীবনও পুনঃপুন স্তব্ধ হবে যত্রতত্র।
গল্পকার আমার পাশে এসে বসলো যখন, নিভৃত উপলব্ধির শান্তিতে বিঘ্ন ঘটলেও বিরক্ত হই না আমি। আমি গল্পকারের কাছে জানতে চাই, আমি যদি প্রতিটি মুহূর্তের গল্প বলি, তুমি লিখে জানিয়ে দাও বিশ্ববাসীকে, তবে কী আর কেউ এভাবে নিভৃতে ঘুমাবে না বেওয়ারিশ হয়ে?
গল্পকার নীরব হয়ে যায়। আমি বিব্রত হই। তাকে হাত ধরে টেনে বসাই। গল্পকার গন্ধ পাচ্ছেন জীবন হীনতার? টিকতে পারছেন? শুরু করি আমার মুহূর্তের গল্প?
যখন মায়ের কোলে বাবুকে দিয়ে শেষবার চুমু খাই তার কপালে, বাবু খুব বিচলিত হয় না। আমার মাকেই মা জানে সে আদরে স্নেহে বায়নায়। আমি বহিরাগত। মাসশেষে টাকা পাঠাই, ছুটি ছাঁটায় দেখতে আসি। মায়ের গলায় নিরুপায় কাতরতা, মোসাদ্দেক বিয়া না কইরা বইসা আছে তর জন্যি। একবার হ্যাঁ করো। অতবড় জীবন রইছে সামনে পইড়া। পোলাডার ভবিষ্যত। পোলা একখানে তুই একখানে। কয়দিন এভাবে? ভাইবা দেখ!
সেদিন ছেলের কপাল থেকে ঠোঁটজোড়া সরিয়ে ছেলেটার কপোলের ভাঁজে ছেলের বাপকে দেখি। কী আশ্চর্য! দায়িত্ব ফেলে পালিয়ে যাওয়া লোকটা সারাজীবন ছায়া হয়ে লেগে থাকবে আমার ছেলের সঙ্গে। নিজে আট মাস গর্ভে রেখে, হাইপ্রেসার আর হাই ব্লাড সুগারে জীবনের সংশয় নিয়ে জন্ম দেওয়া ছেলেটা কাপুরুষ, প্রতারক বাপের ছায়া হয়ে আমার সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরবে, আজীবন যতদিন আমি বেঁচে থাকি।
গল্পকার ছেলের বাপের কথা জানতে চায়, আমি তাকে মনে করিয়ে দেই, মুহূর্তের কথা।সে ফিরে আসে মুহূর্তে, আমি বলতে থাকি।সেদিন স্কুলের খোলা মাঠ পেরিয়ে আমার মন ছুটে গেলো ওই স্কুলের টিনশেড ঘরগুলোর দিকে। আমরা মেয়েরা ছয়-সাতজন গাদাগাদি করে বসতাম এক বেঞ্চে। অন্যপাশে ছেলেরা। ছেলেরা এসেই বোর্ডে কাব্য করতো। এইচ প্লাস জে। হেলেনা আর জয়নাল স্যার। স্কুলের লাইলি-মজনু।
স্যাররা পড়াতেন না। কখনো আসতেন, কখনো আসতেন না। গল্প গুজব করে চলে যেতেন। আমাদের ক্লাসের সুন্দরী হেলেনা প্রেমে পড়েছিল জয়নাল স্যারের। একদিন স্যারের বাসায় দুজনকে হাতেনাতে ধরলো পাড়াপড়শী। সবাই বললো অবৈধ সম্পর্ক। আমি বললাম প্রেম, প্রেমে আবার বৈধতা-অবৈধতা কী? হ্যাঁ, হেলেনা বলেছে আমাকে সে জয়নাল স্যারকে ভালোবাসে। কিন্তু কেউ শুনলো না আমার কথা। অবৈধ সম্পর্ককে বৈধতা দিতে তারা উঠেপড়ে লাগলো পবিত্র দায়িত্ব জ্ঞানে। কাজী ডাকা হলো। বাড়িওয়ালা দুই কেজি মিষ্টি আনালো। গল্পকার আমাকে মনে করিয়ে দিলো, মুহূর্ত। প্রতিটি মুহূর্তের গল্প। আমি পথ হারাইনি। নিশ্চিত করলাম গল্পকারকে। সেই স্কুল মাঠ লাগোয়া রাস্তাটা পাড়ি দিতে দিতে আমার সেই মুহূর্তে অনেক অনেকদিন পর হেলেনাকে মনে পড়লো। স্কুল মাঠের উত্তরকোণে বিরাট জামরুল গাছ, ঘেঁষেই আরেকটা কামরাঙা গাছ। পাল্লা দিয়ে টিয়া পাখির ঝাঁক আর ছেলেদের ঢিল। পশ্চিম কোণে টিউবওয়েল তলায় মেয়েদের দল ওই যে আমি, ওই যে হেলেনা। অকারণে সেই মুহূর্তে হেলেনাকে মনে পড়ছিল আমার। দাইয়ের হাতে বাচ্চা খালাস করতে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেলো মেয়েটা।
বাসের জন্য স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিলাম প্রায় ঘণ্টাখানেক। শুক্র-শনি দুদিন আর একদিন দোলপূর্ণিমা—মোট তিনদিন ছুটির পর প্রতিটি বাসে কর্মস্থলমুখী মানুষের উপচেপড়া ভিড়। নারী-পুরুষ। আমি ভিড় ঠেলে উঠতে চাই না। অনাকাঙ্ক্ষিত, অযাচিত ঠেলা-ধাক্কা এড়ানো যায় না। শরীর রিরি করে ঘেন্নায়। প্রতিদিন আমার বমি আসে। একজন হাত বুকে ঠেসে ধরে তো আরেকজন পাছায়। ভিড়ের চাপে কয়জনের সঙ্গে নিত্য বিবাদ! প্রতিদিন ফিরে লাক্স সাবানে ছাল বাকলা তুলে ফেলি গায়ের—শহরের অবদমিত পুরুষগুলোর অনিয়ন্ত্রিত লোলুপ স্পর্শের। মুখ ভর্তি থুথুর দলা ফেলতে ফেলতে গলা শুকিয়ে যায়।
এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ে দুটি দুর্ধর্ষ মেয়ের কথা। গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না লিখে কী অসম্ভব তোলপাড়ই না লাগিয়ে দিলো মেয়েদুটো! উপচেপড়া ভিড়ের বাসগুলোর জানালা দিয়ে গা রিরি করা ঘেঁষে দাঁড়ানো দেখি আর মনে মনে সেই মেয়েগুলোকে স্যালুট দেই। একবার যদি এদের দেখা পেতাম! বাসের জন্য দাঁড়াতে দাঁড়াতে সেই মুহূর্তে আমার মেয়েগুলোর কথা মনে পড়লো। একটিবার সামনে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিতে পারতাম যদি, ওই যে বিজয় দিবসের দিন সম্মিলিত কুচকাওয়াজ প্রধানমন্ত্রীকে স্যালুট দেয়, ঠিক সেভাবে। গল্পকারের চোখ হঠাৎ ঝলসে উঠলো নদীর বুকে খেলতে থাকা ঢেউয়ে চমকে ওঠা রোদের মতো। আক্ষেপে বলে, আহা যদি আগে বলতে, নিশ্চয়ই ওদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে পারতাম। থাক,আর কী হবে! কত অপ্রিয় হাতের আক্রমণ প্রতিদিন গায়ে মেখে এ পথযাত্রা! সব তো অবসান।
ঠিক সন্ধ্যার আগে আগে যে বাসটা আসে, ভিড় কম। সন্ধ্যা বলেই বোধহয়, আমি উঠে বসি। মাত্র ঘণ্টা দুই। পৌঁছে যাব রাত গভীর হওয়ার আগে। রোদের গন্ধ মুছে গাছের ডালে, পাতায় শান্ত-শীতলতা। বাসটা মোটামুটি খালি। জানালার পাশের সিটটাতেই বসি আমি, শান্ত নীরব হাওয়া জানালা গলে মোলায়েম বাতাস চুলগুলো উড়িয়ে চোখেমুখে ঝাপটা দেওয়ার মুহূর্তে আমার মোসাদ্দেকের চেহারাটা মনে পড়ে। বোকা গোবেচারা মোসাদ্দেক, লাস্ট বেঞ্চের কোণায় বসে থাকতো মাথা নুইয়ে। কোনোদিন কোনো মেয়ে দূরে থাকুক, ছেলের দিকেই কি তাকিয়েছে ভালো করে? ক্লাস এইট ডিঙাতে না ডিঙাতে বাপের ব্যবসায় গিয়ে বসলো। উপায়ই বা কী, তখন প্রতিটি ক্লাস ডিঙাতে দুই তিন বছর লাগতো। নিচু ক্লাসের ছেলেরা পেছন পেছন ক্ষেপাতো—আদু ভাই আদু ভাই।
দোকানের সাইনবোর্ডের দিকে নজর যায়, রুমা স্টোর। এখানে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সুলভমূল্যে পাওয়া যায়। মুহূর্তে আমার মনে পড়ে, মোসাদ্দেক স্টোরে একদিন কলম কিনতে গেলে ওপরে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে মোসাদ্দেক ভাই জিজ্ঞেস করেছিল, ভালো আছো জোৎস্না? বুঝিনি সে কোনোদিন আমাকে দেখেছে। আর এতটাই পছন্দ করেছে যে, আমার আম্মার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পর্যন্ত পাঠিয়েছে।
আমার ভেতরটা এই সহজ-সরল লোকটার জন্য পুড়তে থাকে। কিন্তু আমি তখন আলী আসগরকে কথা দিয়ে ফেলেছি। দ্য নিউ লাইফ ডায়াগোনস্টিক ও হাসপাতালের রিসিপসনিস্ট আলী আসগরের সঙ্গে একসঙ্গে বক্সের ভাত মাছ শাক ভাগাভাগি করে খাই। রোজায় এক ইফতার আধাআধি খাই। চাকরি শেষে নার্সের পোশাক খুলে ব্যাগে ঢুকাই, সাধারণ এক প্রেমিকার সঙ্গে আসগর আমার এক রুমের বাসায় আসে। অন্ধকারে আমরা আদিম নারী পুরুষ হই। কী করে মোসাদ্দেক ভাইয়ের কথা ভাবি সে মুহূর্তে! বড় বাজার, বড় বাজার—বলে গাড়িটা হঠাৎ ব্রেক করে।
গল্পকার বড়ই অধৈর্য! মুহূর্তের গল্প শুনতে চাইলাম তো মুহূর্তের। আমি মুহূর্তেই ছিলাম। মুহহূর্তেই ফিরে যাই। অগণন মুহূর্তের সমষ্টি আমাদের জীবন। গাড়িটা ব্রেক করে, সেই মুহূর্তে আমার মনে পড়ে আলী আসগর যেদিন বাড়ি যাচ্ছে বলে বিদায় নিয়ে গেলো, সেদিন আমার গর্ভের পূর্ণ পাঁচ মাস। কপালে চুমু খেয়েছিল, গালে-গলায় ঠোঁটেও। আমি টেরই পাইনি আলী আসগর আর ফিরবে না। পুরুষরা পারে পোয়াতি বউ রেখে নির্দ্বিধায় লিবিয়া হয়ে ইটালি পাড়ি জমাতে! সেই মুহূর্তে আলী আসগরের পেশীল বাহুর কথা মনে পড়ে আমার। পিষ্ট হতে হতে নির্ভরতাই খুঁজেছি তার বাহুবন্ধনে। এত শিথিল সে বন্ধন টের পাওয়ার আগেই উধাও সে।
হঠাৎ দেখি বাস অন্ধকার, সব আলো নেভানো। ছুটে চলা বাসের জানালা দিয়ে থেমে থেমে আসা আলোয় আমি খুব খেয়াল করি না—বাসে আর কেউ আছে কী নেই! সেই অন্ধকার, যে অন্ধকারে পথ হারিয়েছিলাম পাঁচ মাসের পোয়াতি আমি। একটু বেঁচে থাকার আলো খুঁজতে আলী আসগরের গ্রামের বাড়ির বাসে চড়েছিলাম সেদিন।
বাসটি কি থেমে পড়ে হঠাৎ! মুহূর্তে আমি টের পাই ছাল ওঠানো শিলনোড়ার মতো রুক্ষ একটা হাত আমার মুখ চেপে ধরেছে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সিট থেকে টেনে-হিঁচড়ে বাসের মেঝেতে ফেলে দেয় আমাকে। আলী আসগরের মা আমাকে বেবুশ্যে, পাড়ার মাগী বলে খেদিয়ে দিয়েছিল উঠান থেকে। ভরা আট মাসের পেট নিয়ে চৈত্রের খাঁ খাঁ রোদ্দুরে আমি হেঁটে এসেছিলাম অনাগত অনিশ্চিতের মাটির পথে। মুহূর্তে আমাকে শুইয়ে দেয় সেখানে তিনজন জোর করে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, সেই অন্ধকারে একটু পরে হারাবো আমি।
গায়ের সমস্ত শক্তি একীভূত করে প্রতিরোধ করতে চাই আমি। পা দাপিয়ে, হাত উঁচিয়ে, চিৎকার করে। আমি আমার আব্বাকে ডাকি। বাজার থেকে ফিরে জিলাপির পোটলাটা হাতে দিয়েই যে চাটাইয়ে শুয়ে পরলেন, আর উঠলেন না। আমি আলী আসগররে ডাকি—আমি তোমার সন্তানের মা। এই মৃত্যুর মতো নিগ্রহ থেকে তারে বাঁচাও তুমি।মোসাদ্দেক ভাইরে ডাকি, তুমি আমারে এখনো ভালোবাসো, ভুল জীবনের গলিতে ডুবে মরা আমাকে! এই অসহ্য নরকযন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করে প্রমাণ দাও শেষবার। আমি আর কাকে ডাকবো, পুলিশ? রাষ্ট্র তোমাকে দায়িত্ব দিয়েছে আমাকে রক্ষা করার। রক্ষা করো আমাকে। ওরা নাইলনের শক্ত দড়িতে বাঁধে আমার হাত-পা। মুখে গুঁজে দেয় মবিলে ভেজা ত্যানা। আমার প্রাণপণ চিৎকার যতটা বাইরের ইথারে অবমুক্ত হয়, তারচেয়ে অধিক ঢুকে যায় কণ্ঠনালী পেরিয়ে শরীরের অসহ্য যন্ত্রণায়। বাইরে ঝিঁঝি পোকার একটানা ডাকের সঙ্গে একসুরে মিশে যায় আমার গোঙানি।
বাইরে কি শেষ না হওয়া গজারি বন? ঘন ডাল-কাণ্ডের আড়ালে হারিয়ে গেছে পথ! এই পথ বেয়েই দেখি—এখন দিনের আলোতে আদিবাসী নারী-পুরুষ অবোধ্য ভাষায় কথা বলতে বলতে ঠিকানায় ফেরে। আমার ঠিকানা নির্ধারিত হয়ে গেছে এই অনির্ধারিত ঠিকানায়।
মুহূর্তে মনে হয়, আমার আর ঘরে ফেরা হবে না কোনোদিন। ফেরা হবে না ঘর বাঁধার স্বপ্নের কাছে। কেউ একজন হ্যাঁচকা টানে খুলে নেয় আমার সালোয়ার। উড়না ছুড়ে মারে জানালা দিয়ে থইহীন অন্ধকারে। আমার মাথা থেঁতলে গেছে গল্পকার। তুমি আর আমাকে ফেরাতে পারবে না জীবনে। দুটো লোমশ হাত টেনে ছিঁড়ে ফেলে আমার কামিজ, অন্তর্বাস। ঠিক তখন আমার মনে পড়ে, মোসাদ্দেক ভাই আমাকে প্রথম প্রেমপত্র লিখেছিল। লিখেছিল—তরে আমি খুব আদর করবো সোহাগী! এইট পাস মোসাদ্দেক ভাইয়ের চিঠিতে একটা বানানও ভুল ছিল না। সেই রাত আমি ঘুমোতে পারিনি। আদরের শিহরণে কেঁপে কেঁপে উঠেছি ঘুমের ঘোরে।
উফ গল্পকার কী বীভৎস যন্ত্রণা ঢুকে যাচ্ছে নারীত্বের অন্দরে! কী ভয়ঙ্কর উন্মত্ততা রক্তমাংসের এই নারীদেহ কামড়ে খুবলে! আমাকে নাও মৃত্যু—সেই মুহূর্তে প্রার্থনা করেছিলাম আমি। গল্পকার ওরা আমার কোনো কথা শোনেনি। কেবল শুনেছিল এই কথাটা। হাতুড়ি দিয়ে থেঁতলে দিয়েছিল আমার মাথা।তারপর আমাকে রেখে গিয়েছিল এই অনন্ত শান্তির কাছে।
গল্পকার এই রাস্তায় কত-শত বার পার হয়েছি গন্তব্য অভিমুখে। ত্রস্ত-তাড়া, দ্রুত অফিস ধরা, অপত্যের অনিবার্য টান—ছেলের কাছে পৌঁছানো। কোনোদিন শুনিনি এই গজারি গাছ ফুঁড়ে চলে যাওয়া শো শো বাতাসের ধ্বনি, দেখিনি কেমন নির্বিবাদ ব্যস্ততাহীন জীবন চলে যায় এই পাতাদের শান্ত ছায়া মেখে মেখে।
তুমি যাও তো গল্পকার। আমি ঘুমোতে এসেছি। আমাকে ঘুমোতে দাও শান্তিতে। অনেক জ্বালিয়েছ তোমরা—এই প্রয়োজনের নামে, নিয়মের নামে, বেঁচে থাকার নামে। আর পারবো না। যাও এবার। যাও।
কই কোথাও কেউ নেই। চারদিকে ঘন ঝোপঝাড়।বিষাক্ত পোকা, পেঁচানো শেকড়ের জট, সরু-মোটা শেকড়। আমার দেহ ঘিরে লাল পিঁপড়ের সারি। ফুলে ওঠা পেটের গন্ধে বুনো নর-নারীর কেউ কি উঁকি দেয় এই নিশ্ছিদ্র অন্ধকার জঙ্গলে? গল্পকার, গল্পকার।
কই কোথাও তো কেউ নেই।