এক.
মুরিকুলির জন্য সেই ঘরটাই নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে সে মোটেও থাকতে চায় না। একসময় এই ঘরটা ছিল মুরিকুলির মায়ের রান্না ঘর। একপাশে একটা ঢেঁকিও ছিল। এখন মুরিকুলির ভাষায় এটা হলো পাপের ঘর। ঘরটার একপাশে ঠেসে বোঝাই করা গাছের শুকনো ডাল। জ্বলানির জন্য সংগ্রহ করে রাখা এই স্তূপিকৃত গাছের ডালকে পাপ বলে মনে করে মুরিকুলি। কোনোদিন তার মায়ের জন্য বাড়তি জ্বালানি এনে রাখেননি ঠাকুমা।
সকালে মুরিকলি ঘুম থেকে উঠে দেখতো মা রান্না ঘরের বাসি কাজ সেরে স্নান শেষে কপালে পেল্লায় এক লাল টিপ দিয়ে উনুনের কাছে গেছে। উনুনের পাশেই ঠাকুমা দু’বোঝা কী তিন বোঝা খড়ি এনে রেখেছেন। মা তাই দিয়ে রান্না করছেন। ঠাকুমার প্রথম কাজই হলো বৌমার রান্নার জন্য শুকনো খড়ি জোগাড় করা। এই-ই দেখে এসেছে মুরিকুলি। আর এখন সে কী দেখছে? মাঝে মাঝে মুরিকুলির মনে হয় ঘরখানায় আগুন জ্বালিয়ে দিতে কিন্তু পারে না! অদৃশ্য দেবতার উদ্দেশে সে হাত কপালে তোলে। ক্ষমা করে দে বোমাঙ মা; কিন্তু সেই ক্ষমা কি মেলে! এতই সহজ! মুরিকুলি পাশ ফিরে শোয়। নিজেকে একটা পাথরের মতো ভারী বস্তু বলে মনে হয়। চোখ বন্ধ করে সে কিছু ভাবতে চেষ্টা করে, হঠাৎ সে হারিয়ে যায় মোঙনিবুড়ির ঘটনার ধারে। বাহা উৎসবের দিনগুলোতে কি চমকটাই না দেখতো বিজু মনি। সে নাচতো ঝুমুর দলের সঙ্গে।
ধানহাটিতে তেমন দিন কি কোনোদিনও এসেছিল মুরিকুলির গোষ্ঠীর জন্য! তেমন দিন, যেদিন মানুষ খাবারের জন্য কেবল ছুটছে? না, দোসাদ দেবতার কৃপায় ধনে-ধানে ভালোই ছিল ধানহাটির মানুষ। আর তাই ঝুমঝুম ঝুমুর নাচে মুখর হয়ে উঠতো ধানহাটি গ্রাম। মুরিকুলির হাতে বাজত তুমদা কিংবা টামাক। আজ আর সেই দিন নেই। ঝুমুর নাচের দিন বিস্মৃত হয়েছে সবাই। আজ আর কোনো প্রেমিকা বটতলায় অপেক্ষমাণ প্রেমিকের জন্য চিড়ে মুড়ি নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দেয় না। কেউ আর ‘উন্দুর ধরতে যায় না। যেমন করে তার মা ঠাকুরমা যেত হাতে দা নিয়ে। ধানের ক্ষেতে উন্দুরের গর্ত হাতড়ে তারা নিয়ে আসতো দোসাদ দেবতার আশীর্বাদের ধন। কোথায় সেই দিন, মায়ের কপালের রক্তরাঙা সকাল? মুরিকুলির শ্বাসকষ্টটা বাড়ছে। শ্বাসকষ্টের সঙ্গে বাড়ছে কাশিও। একটু আগেই সে ঘুমোতে চেষ্টা করেছে! কিন্তু সে চেষ্টা বৃথা। তার চোখ যায় স্তূপিকৃত জ্বালানির দিকে—এ বাড়িতে এমন কেউ নেই তার নিজের, যারা ক্ষণে ক্ষণে তাকে দেখে যাবে! দু’বেলা কেবল একজনই আসে।
আজকাল মুরকুলির যে কী হয়েছে, কিছুতেই ঘুমাতে পারে না। ঘুম এলেই সে স্বপ্নে একটা নীলগাই দেখে। সে দেখে একটা নীলগাই তাকে পিষে মেরে ফেলতে চাইছে কিন্তু কিছুতেই সে মরছে না। প্রাণপণে সে গড়াতে থাকে, নীলগাইয়ের পায়ের নিচ থেকে সে মুক্তি পেতে চায়—পারে না। এক সময় তার ঘুম ভাঙে । সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়। হাঁপাতে থাকে। কাকে যে জিজ্ঞেস করবে—কেন সে এমন স্বপ্ন দেখে রোজ? মুরিকুলি নীলগাইয়ে উদ্দেশে প্রণাম জানায়। সে জানে তার গোত্রের জন্মই হয়েছে এই নীলগাই থেকে—মুর্ম্মু। কিন্তু কেন নীলগাই তার সঙ্গে এমন করছে? প্রতিরাতে তার সঙ্গে কেন এমন করছে মুর্ম্মু? কেন ? উত্তর সে জানে না। কে দেবে উত্তর? সে ফের তাকায় স্তূপিকৃত জ্বালানির দিকে। এ হলো পাপ। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সংগ্রহের পাপ। সেই পাপেই সে জ্বলছে। কিন্তু কী ইবা করতে পারে সে? ভাবতে ভাবতে হঠাৎই ঝিমুনি আসে মুরিকুলির। সে টের পায়, কে যেন হাসছে। বাহা উৎসবের চিরপরিচিত গন্ধ সে টের পায়, সে শুনতে পায় ঝুমুর নাচের বিশেষ তাল।
মুরিকুলি ঝুমুর নাচের দলে কাউকে খঁজছে সেই দীঘল চুল, খলসে মাছের মতো কপাল, ধনুকের ছিলার মতো ভ্রূ; চান্দো ছড়ার জলের মতো টলটলে চোখ, কানের কাছে একগুচ্ছ চুল; মুরিকুলি খুঁজছে। আচমকা বঞ্চিত মেয়েটি মুরিকুলির সামনে এসে দাঁড়ায়। কানে জোড়া ঝুমকো। মিষ্টি হেসে বলে, চেড়েঁম এড় কিদিং; কাড়িংমে মারুখা রুমোল।
রুমাল?
ভীষণ ঝাকুনি খায় মুরিকুলি।
রুমাল কেন চাইছে সে? কবে সে তাকে রুমাল দিয়েছে যে, বিজুমনি আজ তা চাইছে এসেছে? কোনো দিনও তো বিজুমনির সঙ্গে তার ভাব ভালোবাসা ছিল না; কোনো কথাও তো সে বিজুমনিকে দেয়নি যে, তা রক্ষা করতে পারেনি বলে সে অভিমান করে বলবে, ‘তুমি আমাকে ফাঁকি দিলে!’ মুরিকুলি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই হাসিটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তন্দ্রা ছুটে যায় তার।
দুই.
ধানহাটি গ্রামের দক্ষিণ দিকে যেখানে চান্দোছড়াটা একেবারে একা হয়ে বয়ে চলেছে তার ওপাশেই মুরিকুলি মুর্মূর বাড়ি। জন্মের পর এই বাড়িতে দরজার মাথায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল তার নাড়ি। বিশ্বাস এই যে, বোঙ্গা মায়ের কুনজর পড়বে না মুরিকুলির ওপর। কিন্তু তাতে কি রেহাই পেয়েছে সে? শীর্ণ হাতটার দিকে তাকিয়ে মুরিকুলি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার বাম হাতের কব্জি থেকে কনুই পর্যন্ত সিকা আঁকা। ৯টি ক্ষত চিহ্ন ছাড়াও কানে ছিদ্র করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে লোহার অলঙ্কার। মায়ের একমাত্র পুত্র সে; কোনোভাবেই বোঙ্গার নজর লাগা চলবে না! কিন্তু এতকিছুর পরেও দুভার্গ্য তার পিছু ছাড়েনি। একা যে মুরিকুলিই বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে সেই ক্ষত তা তো নয়, কিন্তু অন্যদের চেয়ে তাকে খানিক বেশিই দাম দিতে হলো, এই যা। একশ ষোল বছর আগে যে শাল পাতার ডাল বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে সমস্ত গ্রামবাসীকে ডেকে ছিল সিধু কানু, ঠিক একইভাবে একদিন তাকেও তাই করতে হবে—ভাবেনি ধানহাটির কেউ। লাশটা সোকড়ায় পড়েছিল উবু হয়ে। মুরিকুলির বাড়ি থেকে ট্রেন যাওয়ার রাস্তাটা দেখা যায়। ওখানে ধান ক্ষেতের ধারে নিচু জমিতে পড়ে ছিল লাশটা। হাতের হাসুয়াখানা একটু দূরে পড়ে আছে। মুরিকুলি তাদের আডিয়া ডংরাটা রেলের রাস্তার ধার থেকে নিতে এসেছিল। দূরে কিছু একটা পড়ে থাকতে দেখে সে ছুটে আসে। হাত থেকে খুন্টো খসে গেলে তার ষাড়টা স্বাধীনতার বার্তা পেয়ে যায়, সে উল্টো পাল্টা দৌড়াতে থাকে। মুরিকুলির সে দিকে কোনো লক্ষই নেই। মেয়েটির ডান হাতের খোলা অংশ দেখে সে চিনে নেয়, মেয়েটি আর কেউ নয়, তার স্বজাতি! বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। তার বোন বাহা নয় তো! ভয়ে ভয়ে সে মুখটাকে নিজের দিকে ঘোরায়—বিজুমনি! কাদা মেখে গেছে মুখের একপাশ। এক ঢাল চুল মাটি মাখা; গলায় আঁচড়ের দাগ। মুরিকুলির চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। অনেক হয়েছে, অনেক। সে কোমরের গামছাখানা খুলে মুখটা মুছে দেয়, তারপর ফের কোমরে বেঁধে নেয়। উঠে দাঁড়ায়। চারিদিকে বিজন, সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সে দিকে তাকাতেই দেখতে পায় ধান ক্ষেতের ভেতর বিজুমনি নাচছে—একা, ওর সঙ্গে নাচছে ধানগুলোও।
আড় চোখে তাকাচ্ছে বিজুমনি, হাসছে মিটমিট করে নাচছে সে—গলার হাসুলি, কোমরের হাড়াহাড়ি কিছুই নেই আজ! নাকের মাকড়ি আর নথও নেই। সে নাচছে। পায়ে কেবল বস্কি জোড়া আছে। সে নাচছে। ঝুমুর নয় ঝুমুর গানে নাচছে লাগড়েঁ কিংবা ডানটা দাহার; কিংবা জতুর, রিংজা, দূর থেকে ভেসে আসছে।
দায়া দুলোড় ঞেঁলতে
কুলি মেগে সানাঞাঁ..
অর্থাৎ আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু আমার মনের কথা বলতে পারছি না; তারপর হিলহিল হাসির শব্দে সে মিলিয়ে গেলো বাতাসে।
মুরিকুলি চোখটা রগড়ে নেয়। তারপর নিচের দিকে তাকায়। লাশটা পাঁজাকোলে করে এলোপাথাড়ি হাঁটতে থাকে বাড়ির দিকে। এখন বিজুমনি পড়ে আছে উঠোনে, মুরিকুলির মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদছে, কাঁদছে বোন বাহা। ছোট ভাইটাকে শালগাছের ছোট ছোট পাতাসমেত ডাল দিয়ে পাঠানো হয়েছে গ্রামে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই গ্রামের সবাই জড়ো হয়ে গেছে মুরিকুলির বাসায়। বিজুমনির মাথার কাছে বসে সোমেন হাসদা ডাক ছেড়ে কাঁদছে—একমাত্র বোন তার গুডু ধরতে গিয়েছিল সড়কের ধারে।
উবু হয়ে সে যখন উন্দুরের গর্তে হাসুয়া চালাচ্ছে, তখনই পিছন থেকে এসে ঘিরে ধরে তিন চারজন। ভয় কাকে বলে জানে না বিজুমনি। সে উঠে দাঁড়ায়। হাসুয়া হাতে নিয়ে বলে, খবরদার, সোমেন বয়হাতি। সোমেন আমার ভাই। জানতে পারলে তোদের রক্ষে থাকবে না।
হাসতে থাকে ওরা। একজন বলে, এখানে কী করতে এসেছ খুকি?
সে বলে গুডু ধরতে; ধান নিতে। ইন্দুরের ধান নিতে। আবারও হাসতে থাকে ওরা পৈশাচিক হাসি। ইন্দুর ধরতে? আমরা তোমাকে ধরতে এসেছি সুন্দরী! তুমি ইন্দুরের ধান নিবা আর আমরা তোমার ঘ্রাণ নেবো।
চিৎকার করে ওঠে বিজুমনি। কিন্তু সময়টা তার পক্ষে ছিল না। চতুর্থ লোকটা তার গলা টিপে ধরে শেষ খিস্তি কাটল নে-নে, ধান-নে, বেছন ধান! আহ্। হেসে উঠলো সবাই। বিকৃত হাসি। শরীরের নিম্নাংশে কী হচ্ছিল টের পায় না সে; বিজুমনি শ্বাস নিতে পারছিল না। গোঙ্গাচ্ছিল। চোখের সামনে একটা ফুলতোলা রঙিন রুমাল উড়ে এসে পড়লো। ডান হাতটা বাড়িয়ে সে রুমালখানা ধরার বৃথা চেষ্টা করলো মাত্র।
তিন.
মুরিকুলি সমবেত গ্রামবাসীকে বলে, অনেক হয়েছে। সেদিনও ধানের জন্য মরছে সানতাল আজও তাই হলো! সানতালদের অপরাধ কী? সিদো কানো আমাদের ভাই। তাদের রক্ত আমাদের শরীরে ভুলে গেলে চলবে কেনে! সমবেত গ্রামবাসী হ-হ বলে চিৎকার করে। বয়স্ক নারী বেতুরা টুডু আচমকা উঠে এসে সোমেন আর মুরিকুলির মাথায় হাত রেখে স্লোগান দেয়:
আবুদ শান্তি বোন খাজোয়া
জমি বুন হাতাওয়া—জমি চাই মুক্তি চাই।
একশ ষোল বছর আগে যে আওয়াজে মুখরিত হয়েছিল ভাগন ডিহি গ্রাম আজ সেই একই শব্দে ফেটে পড়লো ধানহাটি। আর অপেক্ষা নয়। ধানহাটির প্রায় নয়জন ওই দিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো যুদ্ধে যাওয়ার। ঐতিহ্যবাহী তীরধনুক আর বর্শা ছেড়ে ওরা ট্রেনিং নিলো বন্ধুক চালানোর। সোমেন এসেছিল নিজ এলাকায় আর মুরিকুলি দলছুট হয়ে গিয়েছিল রাজশাহীর তানোর। কোনো ক্ষোভ ছিল না তার। দলের সবার সঙ্গে সে থ্রি-নট-থ্রি উঁচিয়ে গর্জে উঠেছিল—‘জয় বাংলা’ বলে। পশ্চিম পাকিস্তানি মহাজনের হাত থেকে নিস্তার পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল মুরিকুলি। সেবার মুরিকুলির বাপের পাঁচজনের একটা দল গিয়েছিল ধান কাটতে তানোরে। ধান নিয়ে ফিরতে পারেনি কেউ। ধানের বদলে একটা ছোট স্লিপ ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের। স্লিপ নিয়ে দিনাজপুর সদরে গোডাউনে দিনের পর দিন বসে থেকেও ধান পায়নি কৃষক সানতালরা। বাচ্চারা সেদিন চন্দনের ফল ভেজে ক্ষুধা মিটিয়েছে। ঠকবাজ খান মহাজনদের বিরুদ্ধে নাখোশ মুরিকুলি আর তার গোত্র। কিন্তু সে কি জানতো সবার জন্য স্বাধীনতা নয়, সবার জন্য জমি-বাড়ি-ভিটেও নয়? জানতো কি মুরিকুলি! মুরিকুলির শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। কলমিটাও এলো না এখনো। মায়ের মুখটা খুব মনে পড়ছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই মাকে নিয়ে বাবা ভারতে চলে যায়। সোমত্ত তিন বোন ছিল মুরিকুলির। মামার বাড়িতেই থেকে যায় মা। যুদ্ধ শেষ হলে সুখবরটা দিতে আর মা বোনদের আনতে গিয়েছিল মুরিকুলি। মামারা আর আসতে দেয়নি ওদের। কিন্তু মুরিকুলি নাছোড়। ধানহাটি তার একমাত্র ঠিকানা। একমাত্র ঠিকানা বাংলাদেশ। যুদ্ধজয়ী মুরিকুলি যখন পশ্চিম দিনাজপুরের কাঙ্গার ঘাট গ্রামের নেপুন মারান্ডির বাড়ির উঠোনে দাঁড়ায়, ছুটে আসে মা লস্মানি মারান্ডি। এক উঠোনে বারোঘর। মায়েরা সাত ভাই। মায়ের চিৎকারে মামারা আর মামাতো ভাই বোনেরা ছুটে আসে। মা জড়িয়ে ধরে গদগদ কণ্ঠে ডাকে আমার কুলিবাহা কুলি! কেমন ছিলি বাপ এতদিন! সারা শরীরে মা স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেন। বড় মামি একটা ঝিনুক নিয়ে এসে মায়ের পাশে দাঁড়ান। মা তাতে আঙুল ডুবিয়ে কপালে বিজয়ের চিহ্ন এঁকে দিলে সবাই উলুধ্বনি দেয়। সে এক বিস্ময়কর অনুভূতি। আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল মুরিকুলি। মায়ের পায়ে উবু হয়ে প্রণাম করে সেই ধুলো মাথায় মেখে সে বলেছিল, ‘মারে দেশ স্বাধীন হইছে ধানহাটিতে কোনো চিন্তা নাই মা। চল না কেনে! মা ছেলের কপালে চুমু খায়। মুরিকুলি বড় বড় দাঁত বের করে হাসে; চোয়ালে তার মস্তবড় ক্ষত। শত্রুর গুলিতে তার একপাটি দাঁত উড়ে গেছে। হাসলে তাই আগের মতো সুন্দর দেখায় না। তবু লস্মানি ছেলের মুখের হাসিটা প্রাণভরে দেখে আর ঠিক সেই সময় বড় মামা-নেপুন মারান্ডির নির্দেশে ভাইয়েরা মাদল আর ঢোলে চাপড় দিয়ে ওঠে। অন্যভাই বোনেরা লস্মানি আর তার ছেলে মুরিকুলিকে ঘিরে নাচতে থাকে। গাইতে থাকে প্রাণশক্তি জাগানিয়া বিদ্রোহের গান—যা সিধুকানুর উদ্দেশে একদিন গাওয়া হয়েছিল।
চার.
মুরিকুলির সঙ্গে কেউ আসেনি, বড়মামার মুখের ওপর না বলতে পারার মানুষ বাবা নয়। মা তো নয়ই। বোনদের ওখানেই বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে মামারা। মুরিকুলিকেও থেকে যেতে বলেছিল বড়মামা। কিন্তু মুরিকুলি কি সেই জাতের! মোটেই না। ধানহাটি তার গ্রাম। ধানহাটি তার দেশ। এই দেশটার জন্যই তার লড়াই। পরের দেশে কেন থাকবে সে! চলে এসেছে। পেছনে মায়ের হাহাজারি আর কত কাকুতি মিনতি। না। কোনো কিছুই তাকে টলাতে পারেনি। একবার পেছনে ফিরেও তাকায়নি। শিস দিতে দিতে মাথা দোলাতে দোলাতে সে বের হয়ে এসেছে। একা। কাঁটাতার পেরিয়ে সে যখন পা রাখে বাংলাদেশের সীমানায়, তার রক্ত যেন শির শির করে ওঠে। উবু হয়ে সে ভক্তি জানায় দেশমাতাকে, আনন্দে জল এসে যায় চোখে, চারিদিকে খা খা করছে বিরান মাঠ। মুরিকুলি এগোয়, মাঠের মধ্যে ডিগবাজি খায়, উচ্ছ্বাসে হাত উচিয়ে স্লোগান দেয়—‘জয় বাংলা’। তারপর খিল খিল করে হাঁসতে থাকে। বাড়ির ষাড়টার কথা মনে পড়ে। মুরিকুলির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে কেমন পাগলামিই না সে করেছিল।
বেলা পড়ে আসে। মুরিকুলি আসছে, গ্রামে হৈচৈ পড়ে যায়। সোমেন এগিয়ে আসে। পাশে সুশীল সরেনের বোন কমলি। কপালে সিদুঁর উঠেছে। খোঁপায় জবাফুল গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দিকে চোখ পড়তেই নিজের ভেতর ফিরে আসে মুরিকুলি। আপনা থেকেই ডান হাতটা চলে যায় বাম চোয়ালে। কমলি আগের মতোই চেয়ে থাকে মুরিকুলির দিকে। সোমেন বলে, হামাক বাড়ি চলনা কেনে। সোমেনের কাঁধের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে জড়িয়ে ধরে মুরিকুলি। দুজনেই কেঁদে ফেলে। ধানহাটি আর ধানহাটি নেইরে কুলি! তামান পুইড়া গেছে। সোমেনকে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ায় মুরিকুলি। শ্রাবণের মেঘের মতো কালো হয়ে যায় মুরিকুলির মুখ। কিছুই জানতে চায় না আর মুরিকুলি। সে গ্রামের দিকে পা বাড়ায়। সোমেন বলে, অ্যারে কুলি চলনা কেনে হামাক বাড়ি। সোমেনের মুখের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্তভাবে মুরিকুলি কেবল বলে, হামার বাড়ি একবার যাই। সোমেন আর্তস্বরে বলে, পরে যাস না কেনে। কেন সোমেন এরকম করছে অন্যসময় হলে সে ঠিক জানতে চাইতো। আজ আর কিছুই ইচ্ছে করছে না। সে শালবাগানটার দিকে হাঁটছে। বাগানটা পার হলেই চান্দোছড়া। ওপাশেই মুরিকুলির একলা বাড়ি। পলতা পাতায় ঢাকা বাড়ির বেড়া। সোমেন সামনে এসে দাঁড়ায়, মুরিকুলির হাত ধরে—কুলি চল না কেনে আগে একবার হামাক বাড়ি। কিন্তু আসল কথাটা বলতে পারে না মুখ ফুটে। মুরিকুলি হাসে। এ হাসি চেনে সোমেন। না বাচক হাসি, অনিচ্ছের হাসি। সোমেন বলতে চেয়েও বলতে পারে না, ও বাড়ি দখল হয়ে গেছে। বেহাত হয়ে গেছে। যাস না। মুরিকুলি ছড়ার ঠাণ্ডা পানিতে পা ডোবায়। বলে, তুই একবারও কি হামার বাড়ি গেছিলি? উঠোনে বোমার দেবতার থানটা ঠিক আছে তো! তুলসীগাছটা? সোমেনের চোখ ভিজে ওঠে। তারপর বলে ওপর চোয়ালে একটা দাঁত আগে উঠেছিল বলে মা কি কাণ্ডটাই না করেছিল! অপশক্তি বোঙাবুড়ি নজর দিয়েছে তার মুরিকুলিকে তাই কানে ফুটো করে লোহার রিং পরিয়ে দিয়েছিল তোর মা! তারপর হাসতে থাকে মুরিকুলি। ছড়ার মাঝামাঝি এসে ঘুরে দাঁড়ায় সে, সোমেনের উদ্দেশে বলে, দেখ সোমেন, সেই দাঁতটা শত্রুর গুলিতে উড়ে গেছে আর গালেও বড় একটা ফুটো হয়েছে। বোমাঙবুড়ি আর কি নজর দিতে আসবে? বলে হাসতে থাকে। সোমেন বোকার মতো ওর কথা শুনে যায় আর মুরিকুলির পিছু পিছু হাঁটতে থাকে।
পাঁচ
কাশিটা বাড়ছে শ্বাসকষ্টটাও। কদিন আগে সোমেন চলে গেছে। এখন কি তবে তার পালা? সোমেন দিন পনেরো আগে এসেছিল। বলে ছিল, তার আর বেশি দেরি নেই। মৃত্যুকে মুরিকুলি কোনোদিন ভয় পায়নি। পাবেই বা কেন। কৈশোরে ‘আ-পরী তুইন এনেইদ’ খেলতে খেলতে সে বড় হয়েছে। কলাগাছে তীর বেঁধানোর খেলা এটা। সাথীদের পিছে ফেলে সে বিজয়ী হতো বারবার। অশুভশক্তি বিনাশী খেলা হলো ‘আ-পরী তুইন এনেইদ’। কিন্তু কেন যে জয় করতে পারছে না এই জীবনবিনাশী অশুভ শক্তিকে। বারবার জিতে গিয়েও কেন হেরে যায় মুরিকুলি। কেন? কাশিটা বাড়ছে। চোখ বন্ধ করলেই নীলগাইটাকে সে দেখতে পায়। নীলগাইটা ছুটে আসছে। তাই জেগে থাকতে চায় ও। সেদিন পলতা পাতায় জড়ানো বেড়াটা ঠেলে সে নিজের উঠোনে এসে দাঁড়াতেই পাথর হয়ে গেলো। এ বাড়িতে ওরা কারা? ছুটে গিয়ে ঘরে ঢোকে সে। ঘরে জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলে দিলে তেড়ে আসে খলিল মোল্লা। দরজারপাশ থেকে আড়কাঠ নিয়ে এলোপাথাড়ি পেটাতে থাকে মুরিকুলিকে। মুরিকুলিও হিংস্র হয়ে ওঠে। এটা আমার বাড়ি, আমার বাপের। সোমেন, যে একদিন সহযোদ্ধা ছিল মুরিকুলির, সে এসে ওকে টেনে সরায়। খলিলকে সে শুধু বলে—এ অন্যায়। লোকটা খিস্তি দিয়ে ওঠে। মুরিকুলি মারাং বুরোর উদ্দেশে মিনতি জানায়। বোমাঙমাকে ডেকে ডেকে বলে, আমি জমি চাই না, মুক্তি চাই। মুক্তি চাই ঠাকুর। সোমেন তাকে নিয়ে নিজের বাড়ি আসতে চায় কিন্তু মুরিকুলি অটল। না এই বাড়ি ছেড়ে সে কিছুতেই যাবে না। সোমেন বলে, আজ তুই যখন এসে পড়েছিস, তখন এর বিচার হবেই। চলনা কেনে হামার বাড়ি।
স্পষ্ট জবাব মুরিকুলির, না। হামার কুনো নালিশ নাই। নিজেকে ‘আ-পরী তইেন এনেইদ’ খেলার তীরাবদ্ধ কলাগাছ বলে মনে হলো মুরিকুলির। দেখা যাক বোমাঙঠাকুর কয়টা তীর মুরিকুলির গায় বেঁধাতে পারো? কয়টা। তারপর আচমকা সে খলিল মোল্লার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। হামার কিছু চাই না, খালি এইবাড়ির এক কোনায় একটু ঠাঁই দিলেই চলবে। খলিল মোল্লা সহজে রাজি হয়নি। বউটার মনটা নরম তাই শেষমেষ জায়গা হয় তার। বিনিময়ে সে খলিল মোল্লার কাজ করে, ফাইফরমাশ খাটে। সবচেয়ে পাপের কাজ সে করে গাছের ডাল কেটে রান্না ঘর বোঝাই করে। সেই পাপেই বুঝি নীলগাইটা তাকে তাড়া করে। পঁয়তাল্লিশটা বছর সে এভাবেই কাটিয়ে দিয়েছে। কোনো নালিশবিহীন, অভিযোগবিহীন। ধানহাটিতে বিদ্যুৎ এসেছে। তারঘরে জ্বলজ্বল করে জ্বলে নিয়নের বাতি আর মুরিকুলি রান্নাঘরের একপাশে অন্ধকারে পড়ে থাকে। আজ আর কলমি একবারও আসেনি। শ্বাসকষ্টটা বাড়ছেই, কাশিও। শ্বাস টেনে তোলার ক্ষমতা কমে আসছে মুরিকুলির। সকাল হয়ে আসছে। একটা সকাল কি সে দেখে যেতে পারবে না? খলিল মোল্লার ঘরে টেলিভিশন চলছে। বাচ্চারা খলবল করে কী সব বলছে। মুরিকুলির শরীর টেনে তোলার শক্তি নেই। মাটির ঘরের মধ্যে আলো একটু দেরিতেই আসে। মুরিকুলি নেতিয়ে পড়ে। চোখটা বুজে আসে। মুখটা বেঁকে যায়। শ্বাসকষ্টে গলাটা শুকিয়ে আসে। জীভটা বের হয়ে আসছে। একবার কমলিকে ডাকে। একমাত্র সেই দিনে এক-দুবার আসে। কাল একবারও আসেনি।
মুরিকুলির কানে কেবল একটা শব্দই বাজতে থাকে, মুক্তি মুক্তি। তার সামনে নাচতে থাকে একটি মেয়ে বিজুমনি। সে নাচছে। ধানহাটি গ্রাম সেই নাচে মুখর হয়ে উঠছে। নাচতে নাচতে বিজুমনি উঠে যাচ্ছে আকাশে। নিচে তর্জনি তোলা হাতের এক অংশ দেখা যাচ্ছে। মুরিকুলি চোখ বড় বড় করে তাকাতে চেষ্টা করে, যতই সে চোখ প্রসারিত করে বোঝার চেষ্টা করে, দেখে, আঙুলটা ক্রমশ একটি গাছ হয়ে যাচ্ছে।