নুহুর বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন আমার বয়সও পাঁচ বছর হয়েছিল। অথবা আমার বয়স যখন পাঁচ. তখন সেও পাঁচ। কেন যে বয়স পাঁচ হয় বা পনের হয় বা বারো হয়, জানি না বা কেমনভাবে হয় জানি না। সূর্য কি মানুষের কেউ হয়? তবে সূর্যের হিসাব ধরে মানুষের বয়সের হিসাব কেন? ছোটকালের এসব প্রশ্ন। বড়কাল ছোটকালকে উত্তর করে, সূর্য মানুষের কেউ হয়, সূর্য মানুষের সবই হয়। সূর্য আছে বলেই তো সব আছে। সূর্য প্রাণসংগঠক। জগৎ নামের বিরাট এক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছে সূর্য। তবে, সূর্যের আলোর অনেক সীমাবদ্ধতাও আছে, ঘরের ভেতরে ঢুকতে পারে না। ঘর তাই অন্ধকার হয়ে থাকে। অন্ধকার সর্বশক্তিমান।
তার বয়স পাঁচ বলে আমার বয়স পাঁচ বা আমার বয়স পাঁচ বলে তার বয়স পাঁচ এমন ভাবনা ভুল ছিল। তার বয়স পাঁচ বলেই তার বয়স পাঁচ এবং আমার বয়স পাঁচ বলেই আমার বয়স পাঁচ। আমি যদি মরে যায়, তবে সেখানেই থেমে যাবে জীবন-বয়সের হিসাব, শুরু হবে মরণ-বয়সের হিসাব। মানুষ বলবে তার মরণের বয়স হলো একবছর বা তিন বছর বা ছয় বছর। আর সে যদি বেঁচে থেকে যায়, তবে মরণতক তার জীবনের হিসাব চলতেই থাকবে। তার বয়স হবে ছয়, আট, নয়, বারো বা আরও বেশি। কিন্তু জীবনের বয়স কারোই অসীম হয় না, মরণের বয়স হয় অসীম। তাই বলেই তো মৃত লোকের বয়সের হিসাব খুব বেশিদিন করে না, করতে পারে না মানুষ। একবছর হলো মরা, দুবছর হলো মরা, তিন কী চার বছর হলো মরা, আট কী বারো বছর হলো মরা; তারপর আর মনেই করতে পারে না কেউ, একসময় মনে করার কোনো লোকও থাকে না। মরণকাল অসীম বলেই তো এমন হয়। সসীম কখনো অসীমের হিসাব করতে পারে না, হিসাব রাখতে পারে না। জীবনকাল সসীম, মরণকাল অসীম।
আমাদের বয়স ছয়-সাতও হয়েছিল। একসঙ্গেই দুজন খেলতাম। অদ্ভুত সব খেলা। বারবার একই খেলা ভালো লাগতো না বলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন খেলা বের করতাম নিজেরাই। এভাবে আট দশ বছর বয়সও লাভ করি আমরা। বিভিন্ন জায়গায় খেলাধুলা করে সময় কাটাতাম। তার মধ্যে একটি খেলা ছিল, পাছায় লাত্থি মারামারি খেলা। খেলাটা এমন, রাস্তার ধারে ছোট ছোট বিভিন্ন গাছ ছিল, এগুলোর কোনো একটাকে দেখিয়ে আমরা বলতাম, ‘এটাকে কে টেনে তুলতে পারে? যে পারবে না তার নগ্ন পাছায় লাত্থি মারতে পাবে যে পারবে সে।’ ও একটু দুর্বল ছিল বেশিরভাগ সময় তার প্যান্ট খোলা পড়তো এবং খোলা পাছায় লাত্থি খেতো। কিছুদিন পর খেলাটাকে অরুচিকর মনে হলে সে খেলা আমরা বাদ দেই। আমাদের অন্যকোনো খেলার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। একটা মানুষ আরও একটা মানুষকে লাত্থি মারবে এমন খেলা থেকে বের হয়ে গেলাম আমরা।
অবশ্য কথা আর হাসি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঠাণ্ডা আর মধুর মতোও থাকে। কিন্তু কথা আর হাসি যখন গরম হয় তখন তার মতো ভয়ঙ্কর আর কিছু হতে পারে না।
আরও একটি খেলা ছিল, তা হলো, মুত কাটাকাটি খেলা। দুজনে পাশাপাশি কিন্তু কিছুটা কৌণিকভাবে দাঁড়িয়ে বেশ শক্তি প্রয়োগ করে মুততাম। তার মুত এবং আমার মুতে প্যাঁচ লাগাতাম। এ খেলা বেশিক্ষণ চলতো না। যতক্ষণ মুত বেরুতো ততক্ষণ এ খেলার আয়ু। আমরা একবার এ খেলা খেলে নেওয়ার পর প্রচুর পানি পান করে নিতাম, যেন আবার প্রচুর মূত্র তৈরি হতে পারে ভেতরে আর শিগগিরই আবার খেলতে পারি। এ খেলার জন্য অপেক্ষাই ছিল বেশি। অবশ্য এ অপেক্ষাটাও ছিল খেলাতে ভরা, ধুলোবালি বা লাঠি-কাঠি নিয়ে অন্যকিছু খেলতাম। এভাবে বেশ চমৎকার দিনগুলো কাটছিল এবং আমরা বারো বছর বয়সী বয়স লাভ করি।
একদিন আমরা দুজন যখন খেলছিলাম তখন আমার চাচা এলেন এবং আমরা কী করছি সেটা জানতে চান। আমরা তখন বললাম, ‘চাচা আমরা খেলছি।’চাচা নুহুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নুহু তুমি তো বেশ সুন্দর বালক।’ নুহু বেশ সুখী হয়ে ওঠে এবং আমার চাচা বলে, ‘চলো, তোমরা আমার রুমে খেলবে, তোমাদের আমি রুটি খেতে দেব।’ তখন দুজন মিলে খেলতে অথবা রুটি খেতে চাচার রুমে যাই। চাচার রুমে আগে থেকেই বসা ছিল তার এক বন্ধু, যাকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। সে ছিল পুরোপুরি নগ্ন অবস্থায়। তাকে নগ্ন অবস্থায় এর আগে আমি দেখিনি। তাকে নগ্ন অবস্থায় দেখে আমরা লজ্জা পাই।
চাচার বন্ধুটি আমাকে তার কাছে টেনে নেয় এবং একধরনের অদ্ভুত আচরণ শুরু করে যখন, তখন আমার চাচা নুহুকে নিয়ে অন্য একটি রুমে চলে যায়। আমি কাঁদতে থাকি। এক সময়ে নুহুও কাঁদতে কাঁদতে আমরা যে ঘরে ছিলাম সে ঘরে চাচাসহ প্রবেশ করে। আমাদের পোশাকের পেছনদিক রক্তে ভিজে গেছিল। তারা পোশাক পাল্টে নিতে বলে এবং আমাদের কিছু মাখন আর রুটি দেয়। আমরা বের হয়ে আসি। রুটি-মাখন আমাদের হাতেই থাকে। রুটি খাওয়ার রুচি আমাদের ছিল না। বাইরে এসে রুটিগুলোকে আমরা ফেলে দেই রোদের মধ্যে। যখনই রোদের মধ্যে আমরা রুটি ফেলে দেই তখনই সূর্য চোখ বন্ধ করে নেয়, নেমে আসে অন্ধকার। অথবা ব্যথায় আমরাই চোখ বন্ধ করে গাছের নিচে বসে থাকি।
এভাবে আরও কয়েকদিন আমরা চাচার এবং চাচার বন্ধুর শিকার হলে একদিন আমাদের খেলার স্থান পরিবর্তন করি আর বাড়ি থেকে লোকালয় থেকে একটু দূরে ছোট জঙ্গুলে জায়গায় খেলার স্থান নির্ধারণ করি। কিন্তু সে ঠিকানাও তারা কিভাবে যেন জোগাড় করে ফেলে আর আমাদের ধরে নিয়ে যায়। আমরা আরও গভীর ঠিকানার জঙ্গল খুঁজতে থাকি আর আমরা আমাদের খেলা খেলি। তারা সেসব গভীর ঠিকানা থেকেও ডুব দিয়ে দিয়ে ডুবুরির মতো ছেঁকে তুলে তাদের রুমে নিয়ে যায় আমাদের। সূর্যের চেয়ে মানুষের শক্তি বেশি। সূর্য ঘরের ভেতর ঢুকতে পারে না, গভীর জঙ্গলের ভেতর ঢুকতে পারে না। কিন্তু মানুষ ঠিকই খুঁজে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসে। মানুষ অন্ধকারের মতো শক্তিশালী।
আমাদের খেলা আর জমে না। নুহু আনমনা হয়ে যায়। সে ভীষণ মনে ব্যথা পেয়ে আছে। আমিও। আমাদের পেছনটা রক্তে ভেসে যায় যখন, তখন তারা আরও বেশি আনন্দ পায়। শেষের দিকে তারা তাদের মাজার নাচনের গতি বাড়িয়ে দেয়। উহ্ আহ্ করতে থাকে। যেন তারাও কষ্ট পাচ্ছে। মানুষে যে সুখ পেয়ে এমন কাতরাতে পারে, এমন ধারণা আমাদের ছিল না। আমরা ভাবতাম তারা কষ্টই যখন পাচ্ছে, তখন বারবার আমাদের ডেকে এনে এমন করছে কেন। আর আমাদেরও তো কষ্টের শেষ নেই। তারা তাদের নিজের কষ্ট ভেবেও তো আমাদের নিস্তার দিতে পারে। এভাবে ভেবে ভেবে আমরা আমাদের বেদনা আর অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছিলাম। কিন্তু অভিজ্ঞতাগুলো ভাগ না হয়ে যোগ হয়ে যাচ্ছিল।
একদিন নুহু বলছিল, ‘ভাত রান্না করার পর মাড় গালানো দেখেছিস। তোর চাচার নুনু থেকে মাড় বের হয় যখন, তখন সে থেমে গিয়ে নুনু বের করে দাঁড়ায়। আমি তখনো বাঁকা হয়ে থাকি। আমার পিঠের ওপরেই গরম বিষ ঢেলে দেয়। আমার পিঠের চামড়া পুড়ে যায়, এমন গরম! ভাত পেকে গেলে যেমন মাড় বের হয়। মানুষ পেকে গেলেও মাড় বের হয়। আমি ভাত খাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছি। ভাত দেখলে মাড়ের কথা মনে হয়, মাড়ের কথা মনে হলে আমার বেদনা আর রক্তের কথা মনে হয়। ভাত খেতে পারি না। ভাত খেতে পারি না। ভাত খেতে পারি না’। বলতে বলতে সে কাঁদতে শুরু করে।
আমার চোখ দিয়েও টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। আমার চোখের এক ফোঁটা পানি আমারই পায়ের ওপর পড়ে। গরম। নুহুর চোখের পানিও কি গরম? তার দিকে তাকালাম। তার চোখের পানি ভূমিতে পড়ছে আর সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে যাচ্ছে। তার চোখের পানির ফোঁটা যেখানে পড়ছে, সেখানে হাতের চেটোর বিপরীত দিক রাখি, যেন আমার হাতের ত্বকে তার চোখের পানির তাপ অনুভব করতে পারি। দেখি, তার চোখের পানিও গরম। কোনো মানুষের চোখের পানি ঠাণ্ডা আছে কি? নাকি সব মানুষের চোখের পানিই গরম? মানুষের ভেতর থেকে যা কিছু বের হয়, তার সবই বুঝি গরম। চোখের পানি গরম, রক্ত গরম, শ্বাস-প্রশ্বাস গরম, মুত গরম, মল গরম, কথা গরম। অবশ্য কথা আর হাসি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঠাণ্ডা আর মধুর মতোও থাকে। কিন্তু কথা আর হাসি যখন গরম হয় তখন তার মতো ভয়ঙ্কর আর কিছু হতে পারে না।
সে তার বেদনা ভুলতেই পারছিল না, বেদনাসহ্যশীল হতেই পারছিল না। আমি চুপ করে থাকি। আমি লজ্জিত থাকি, কারণ আমার চাচা এসব করছিল।
পরের দিন, নুহু বলে, ‘ভাতের মাড় দেখলে আমার মনে হয় অজস্র মানুষের নুনু থেকে বের হওয়া মাড় জমা হয়ে আছে এখানে। ভীষণ গরম। ভাত খেয়ে খেয়েই বুঝি মানুষের ভেতর এমন মাড় জমে, গরম মাড়। ভাত খেলে নিশ্চয়ই আমার ভেতরেও এসব মাড় জমা হবে। আমি আমার ভেতর মাড় তৈরি করতে চাই না। নইলে আমাকেও তো তোর চাচার রকমে অন্য কারো সঙ্গে এমন করতে হবে। আমি ভাত খাই না, কারণ, আমি চাই না, আমার পেটের ভেতর মাড় জমা হোক আর নুনু দিয়ে বেরিয়ে কারও পিঠের ওপর পড়ুক।’
এখানে যে যত মার খেতে পারে, সে ততবেশি দিন বেঁচে থাকে। যে পারে না, সে মরে গিয়ে মুক্তি পায়।
পরের দিন, নুহুর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। তাদের বাড়ি থেকে ভেসে আসা চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমি তাদের বাড়ি গেছিলাম। গিয়ে যা দেখলাম আর শুনলাম তাতে ভীষণ ব্যথা পাই আমি। সেদিন তাদের বাড়িতে কিছু একটা উপলক্ষে অনেক মানুষের খাবার আয়োজন চলছিল। বিশাল ডেগে ভাত রান্না হচ্ছিল। ভাত রান্নার ওখানেই ছিল নুহু। সে ভাতের টগবগ করে ফুটা দেখছিল, মাড় তৈরি হওয়া দেখছিল একদৃষ্টে বাবুর্চির পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। পরে সে একটা কাঠের টুলে বসে। ভাত রান্না শেষ হলে ভাতের মাড় গালানো হয় বড় একটা ডেগে। তার বাবা মা আর অন্যরা অতিথিদের সামলাতে ব্যস্ত ছিল। বাবুর্চি রান্নাস্থলে গেলে দেখতে পায়, যে ডেগে মাড় গালিয়ে রাখা হয়েছিল সে ডেগে মাথা নিচু করে পড়ে আছে নুহু। তাড়াতাড়ি তাকে তপ্ত মাড় থেকে তোলা হয়। ততক্ষণে তার মুখ, গলা, বুক, পেট সব ঝলসে গেছে। বাবুর্চি বলছিল, ‘আমি তাকে দেখেছিলাম সে টুলে বসে বসে ঢুলছিল। তাকে আমি শুধু বলেছিলাম, তুমি তোমার ঢুলন বাদ দিয়ে এগুলো একটু দেখতে থাকো, কুকুর বিড়াল যেন ঢুকতে না পারে, আমি পেশাবখানা থেকে ফিরে আসছি। ফিরে এসেই দেখি গরম মাড়ের ভেতর পড়ে আছে। সম্ভবত সে ঢুলতে ঢুলতে পড়ে গেছে।’
সাদা কাফনে মুড়িয়ে তার লাশ চৌকির ওপর রাখা ছিল। তাকে মাড়হীন ঝরঝরে একটা বড় ভাত বলে মনে হচ্ছিল। নুহু মানুষ। আমার চাচা আর চাচার বন্ধুও মানুষ। নুহুকে মানুষে খেয়ে খেয়ে বড় ভাত করে দিয়েছে। এখন এ বড় ভাত খাবে মাটি আর মাটির বন্ধুরা।
তারপর চল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে।
আমি আজ পর্যন্ত কাউকে কিছু বলিনি। আমার মনে হয় না, এটা কোনো দুর্ঘটনা ছিল। সে ইচ্ছে করেই মাড়ের উত্তাপের ভেতর ঢুকে পড়েছিল। সে মারা যাওয়ার পরও বেশ কয়েক বছর আমার চাচা আর তার বন্ধুর লালসার শিকার হতে হয় আমাকে। দ্বিগুণ চাপ সহ্য করতে হচ্ছিল আমাকে।
আমার বেঁচে থাকা দেখে আমারই মনে হয়, এ ভূপিণ্ডের নিদয় হৃৎপিণ্ড। এখানে যে যত মার খেতে পারে, সে ততবেশি দিন বেঁচে থাকে। যে পারে না, সে মরে গিয়ে মুক্তি পায়। অথবা যে যতদিন বেশি বেঁচে থাকে, তাকে ততবেশি এসব ভোগ করতে হয়। যে মরে যায়, সে বেঁচে যায়।