নদীর পাড়ে বুনো ঝোপ আর হোগলার বনের ভেতর মাঝে মাঝেই ডাহুক বা বুনো পায়রার বাসা পাওয়া যায়। কখনো ডিম থাকে, কখনো ছানা। সেই ছানা বাজারে নিয়ে বিক্রি করলে হাতে পয়সা আসে।
সম্প্রতি সরকারি কলেজের কাছে একটা দোকান খুলেছে, তারা মুরগি ভাজা বিক্রি করে। একেকটা টুকরা পঞ্চাশ-ষাট টাকা। কিন্তু খেতে হেব্বি মজা। হাতে টাকা পেলেই মানিক আজকাল মুরগি ভাজা খায়। সঙ্গে কোক। বাজানের কাছে টাকা চাইলে অবশ্য টাকা দেন। তবে একবারে দশ-বিশ টাকার বেশি কখনো দেন না। আর ষাট টাকা দিয়ে এক টুকরা মুরগি ভাজা খাওয়ার জন্য টাকা কোনোদিনও বাজান দেবেন না।
তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আজ কোনো পাখির ছানা পেলো না মানিক। আকাশের দিকে তাকিয়ে বেলা আন্দাজ করতে চাইলো। কত হবে এখন সময়? বারোটা কী সাড়ে বারোটা। অন্যদিন এ সময় স্কুলে অঙ্ক ক্লাস। মতিন স্যারের লাল চোখ, বেতের শপাং শপাং আওয়াজ। আজ স্কুল হয়নি। সকালে যথারীতি স্কুলে গিয়ে দেখে বন্ধ। তপু, শিউলি, আজমল, মতি, রবিন, রিনারা মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। কাছেই দারোয়ার আলম ভাইয়ের বাড়ি। কে একজন খবর আনলো, আজ স্কুল ছুটি। তারপর আর কী! যে যার মতো চলে গেলো। আর মানিক চলে এলো নদীর ধারে। কিন্তু আজ কপাল মন্দ। পাখির ছানাপোনা তো মিললো না-ই, এমনকী নদীর ধারে বুনোজাম, কুঁচফলও নেই দুয়েকটা। অগত্যা বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো।
নদী থেকে বাড়ি বেশ দূর। মানিক মনে মনে বাড়ির দৃশ্য কল্পনা করে।
বাড়িতে এখন কেবল মা আর চার মাসবয়সী ছোট্ট বোন মুক্তা। মুক্তা তো দিনের বেলাটা ঘুমিয়েই থাকে। মা হয়তো উঠোনের পাশে চাতালের নিচে বসে রান্না করছেন। মা-কে মানিকের কাছে পরীর মতো মনে হয়। কী ফর্সা গায়ের রঙ। আগুনের তাপে মায়ের গাল গোলাপি হয়ে ওঠে। সোনার চুড়িগুলো হাতের নড়াচড়ায় ঝলমল করে। দাদির কাছে পরীদের নিয়ে অনেক গল্প শুনেছে মানিক। মা যখন আপন মনে কাজ করতে থাকেন, তখন মানিকের মনে হয় সত্যিই বোধহয় পরীর দেশ থেকে শাস্তি পেয়ে এই গাঁয়ে চলে এসেছেন মা! শাস্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে একদিন হুট করে পরীর দেশে চলে যাবেন!
সবাই বলে মানিকের মুখের আদলটা ঠিক মায়ের মতো। গাঁয়ের রঙটা এত রোদে ঘোরাঘুরি না করলে ঠিক মায়ের মতোই দেখাতো। মানিক মাকে দেখে দেখে নিজের সঙ্গে মেলাতে চায়। মেলাতে চায় বটে; তবে ওর কেন যেন বাজানের মতো হতেই ইচ্ছে করে। কালো, কপালের দুপাশে টাক, মোটা ভ্রুর নিচে ছোট ছোট চোখ, দেখতে ভালো নয় মোটে। কিন্তু তার নরম কথাবার্তা আর হাসি দেখলেই মনে হয় এ লোকটার বুকের ভেতরটা মেঘহীন আকাশের মতো ফকফকা!
আর সে যেন মানিককেই খুঁজছিল এমনি স্বর গলায় টেনে বলে, ও মানিক তোমার মা বইলছেল মুড়ি ভাজবে। আইজ অন্য কাজ পড়ে গেছোল। তোমার মাকে বইলো আমি কাইল আসপো।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বাশিরুদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় মানিকের। লোকটা সারাবছর বিল-জঙ্গল থেকে এটা ওটা টুকিয়ে বিক্রি করে সংসার চালায়। তার কাঁধের ভাঁড়ে শাপলা, শালুক, ঢ্যাপ, মাখনা, পানিফল, বেতফল, ভুতিজাম, মেটে আলু হেলেঞ্চা শাক, গন্ধপাতা ছাড়াও কত কী যে থাকে! জঙ্গল-বিল ঘুরে ঘুরে সে সংগ্রহ করে। বাজারে এসব জিনিসের নির্দিষ্ট ক্রেতা নেই। কেউ কিনবে কি না; তারও নিশ্চয়তা নেই। অথচ আশ্চর্যের বিষয় বশিরুদ্দিনের টুকরিতে কখনোই কিছু অবিক্রীত পড়ে থাকে না। তবু বড় অভাব তার। ঘরে অনেকগুলো মুখ। অভাবের সঙ্গে যমজ ভাইয়ের মতো গলা জড়িয়ে আছে নানা রোগ। লোকটাকে মায়া লাগে মানিকের। মনে মনে ভাবে, একদিন যদি অনেক টাকা হয়, তাহলে বশিরুদ্দিনকে ও সাহায্য করবে। মানিক ডাক দেয়, বশু চাছা, বাজার যাও?
-আরে মানিক বাপ! বাজার যাইরে। হাঁটা থামিয়ে সামনের ভাঙা দাঁত বের করে হাসে বশিরুদ্দিন। তুই এইহানে কী অরছ?
-ইশকুল বন্ধ। এ লাইগ্যা এ দিক আইছলাম। কী নিয়া বাজারত যাও আইজ? বলতে বলতে মাথা ঝুঁকিয়ে বশিরুদ্দিনের টুকরিতে কী আছে, দেখতে থাকে মানিক।
টুকরির একপাশে তিন চারটে ডেউয়া। দেখেই লাফিয়ে ওঠে মানিক। মা ডেউয়া অনেক পছন্দ করে। এখন নিয়ে গেলে ভর্তা বানিয়ে মজা করে খাওয়া যাবে। চাচা, ডেউয়া কত?
-নেবা নাকি? চারটা আছে বিশ টাকা, তুমি পনরো টাকা দিও।
-বাজারত যাচ্ছ না? বাজান থে নিয়া নিও। ডেউয়াগুলো হাতে তুলে নিতে নিতে বলে মানিক।
বশিরুদ্দিন ভাঁড় কাঁধে তুলে হাঁটতে শুরু করে।
বইয়ের ব্যাগটা নামিয়ে সামনের পকেটে ঠেসে ঠেসে ডেউয়াগুলো ভরে মানিক। বন্ধুদের কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে এ ডেউয়া আর একটাও থাকবে না।
মাথার ওপর কটকটে সূর্য। সূর্যের তাপে গা জ্বলে কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ সুশীতল হাওয়া বয়ে যায়। আহা কী মিষ্টি! মাথার চুল উড়ে, গায়ের সাদা শার্ট পত পত করে উড়তে উড়তে শরীরের সঙ্গে এভাবে লেপ্টে যায়, যেন শরীর ভেদ করে সে চলে যাবে মেঘেদের কাছে! গাছের পাতা থির থির করে কাঁপে। কোথা থেকে একটা হলুদ কালো ডোরাকাটা মস্ত ফড়িং উড়ে এসে আবুল কাকার বাড়ির বাইরের কাটামেন্দির ডালে চুপ করে বসে পড়ে। বড় একটা রক্তজবা গাছ ডাল পালা ছড়িয়ে সেখানটায় খানিক ছায়া ছড়িয়েছে। ফড়িংটা ধরার খুব লোভ হয় মানিকের। কিন্তু তখনই হঠাৎ কার্ত্তিকের মা মাথায় মস্তো ডালা নিয়ে উদয় হয়। আর সে যেন মানিককেই খুঁজছিল এমনি স্বর গলায় টেনে বলে, ও মানিক তোমার মা বইলছেল মুড়ি ভাজবে। আইজ অন্য কাজ পড়ে গেছোল। তোমার মাকে বইলো আমি কাইল আসপো।
-আচ্ছা বলেই মানিক ফিরে দেখে ফড়িং উধাও।
দুই.
পেছনে মস্ত বাঁশবন, একধারে বিশাল ফসলের মাঠ আর একধারে গাজীদের পোড়ো ভিটের মাঝে প্রায় নিঃসঙ্গ, একা মানিকদের বাড়িটা। বাড়ির সামনে বিশাল একটা কড়ই গাছ। নিচে আগাছা, ঘাস, তৃণ, গুল্মে বাড়িটাকে আরও নিভৃত করে তুলেছে।
মানিক জানালার পর্দা সরিয়ে হতবাক হয়ে দেখে, মা আর নাটু কাকা দুজনের গায়ে কোনও পোশাক নেই। নাটু কাকা মাকে বিছানায় ফেলে কী যেন করছে। মা শুধু গোঁ-গোঁ আওয়াজ করছেন।
বাড়ির সামনে এসেই থমকে দাঁড়ায় মানিক। সীমানা বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঠোনে একটা সাইকেল দেখা যাচ্ছে। একটু এগিয়ে মানিক দেখে সাইকেলটা নাটু কাকার। নাটু মানে নাটু হাওলাদার। বাজারে দুটো ইলেকট্রনিক্সের দোকান আছে। গ্রামের তরুনদের জাগরণ নাট্য গোষ্ঠীর জন্য সে ক্লাবঘর বানিয়ে দিয়েছে। যেমন লম্বা, তেমনি স্বাস্থ্যবান। তবে তার সবচে’ বড় পরিচয়, সে বাবার কেমন যেন সম্পর্কীয় ভাই। মাঝে মাঝেই আসে। লোকটার সঙ্গে খাতির নেই মানিকের। দুই-একবার বাবা বাড়ি নাই বা ঘরে গিয়া বসেন ছাড়া আর কোনো কথা কখনো হয়নি। তবে সাইকেলটা দেখে দেখে খুব চেনা হয়ে গেছে মানিকের।
দাদি মারা যাওয়ার পর বাড়িটা এখন খা খা করে। বাজান তো ফেরে সেই রাতে। বাজারে বাজানের একটা কাপড়ের দোকান আছে। ছোট দোকান। মানিক মাঝে মাঝে বাজারে গেলে বাজানের দোকানে যায়। বাজান তখন ওকে হাতেমালীর দোকানে নিয়ে পরোটা-মাংস খাওয়ায়। কখনো দই মিষ্টি। তবে পাখির ছানা নিয়ে হাটে গেলে মানিক কখনোই বাজানের মুখোমুখি হয় না। ও জঙ্গলে পাখি ধরতে যায়, এই খবর জানলে বাজান খুব বেজার হবেন। সাপ-খোপ বা কী আপদ কোথায় লুকিয়ে আছে, কে বলতে পারে!
বাজানের কাছে ও পরম আদরের। বাজান লোকজনের কাছে বলেন, এইটা আমার মিছরির টুকরা! কেন বলে মানিক জানে না।
আদর করে মূল্যবান রত্নের নামে নাতি নাতনির নাম রেখেছেন দাদি। মানিক আর মুক্তা। দাদি নাই। দাদির ঘরটাতেই এখন মানিক থাকে। ঘরের সামনে একপাশে গন্ধরাজ অন্যপাশে কলাবতী ফুলের গাছ। বাড়িতে ঢুকে নিজের ঘরটা পেছনে রেখে রান্নাঘরের চাতালে আসে মানিক। চাতালের নিচে মা নেই। চুলা নেভানো। একটা আধপোড়া লাকড়ি (কাঠের টুকরো) চুলা থেকে বের করে পাশে রাখা। ব্যাগ থেকে ডেউয়াগুলো বের করতে করতে মানিক দুই বার মা বলে ডাক দেয়। আর তারপর ওর চোখে পড়ে মায়ের ঘরের বদ্ধ দরজার দিকে। বাইরে দাওয়ার সামনে একজোড়া পুরুষের জুতা। নিশ্চয়ই এই জুতা নাটু কাকার। কিন্তু মা কই। মায়ের ঘরের দরজা বন্ধ কেন?
দ্রুত চাতাল থেকে মায়ের ঘরের বারান্দায় উঠে আসে মানিক। দরজার বাইরে থেকে নাটু কাকার মৃদু কণ্ঠ শোনা যায়। মানিক জানালার পর্দা সরিয়ে হতবাক হয়ে দেখে, মা আর নাটু কাকা দুজনের গায়ে কোনও পোশাক নেই। নাটু কাকা মাকে বিছানায় ফেলে কী যেন করছে। মা শুধু গোঁ-গোঁ আওয়াজ করছেন।
দশ বছর বয়সী মানিকের নারী-পুরুষের মিলন বিষয়টা জানা নেই। মা আর নাটু কাকার অবস্থা দেখে মানিক ধারণা করে, নাটু কাকা নিশ্চয়ই মাকে খুন করে ফেলছে। পাড়ার লোক ডাকতে গেলে ততক্ষণে যদি নাটু কাকা মা কে মেরে পালিয়ে যায়, তাই ভয়ে আতঙ্কে মানিক চিৎকার করে ওঠে, নাটু কাকা আপনে মায়েরে মারেন কেন? ছাড়েন, ছাড়েন আমার মায়েরে।
মানিকের মা আর নাটু দুজনেই ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে ওঠে। নাটু তো আরও আসে। এরকম পরিস্থিতি তো এর আগে কখনো হয়নি। নাটু দ্রুত মানিকের মা-কে ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। হতভম্ব মানিকের মা ও তাড়াতাড়ি শাড়ি টেনে নিজেকে আবৃত করতে থাকে। এদিকে মানিক দরজায় দুমদুম কিল ঘুষি মারতে মারতে ভয় আর কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে চিৎকার করতে থাকে, মা ও মা, দরজা খোলো। নাটু কাকায় তোমারে কেন মারে? সে তোমারে খুন করতে লাগছে কেন? তুমি বাঁইচ্চা আছ মা?
মানিকদের বাড়ির পেছনে কলাবন আর বাঁশঝাড়ের মাঝে নাটু গর্ত খুঁড়ছে কোদালে খুপ্ খুপ খুপ শব্দ তুলে।
নাটু শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে, তুমার পোলায় না বলে ইশকুলে গেছে? মানিকের মা বলে, হ। ইশকুলেই তো গেছিল।
অহন কী অইব বুঝছো? তুমার পোলা তো ভাবতাসে আমি তুমারে খুন করতে আইছি। কিন্তু গেরামের লোকজন শুনলে তো সব বুইজ্জা ফালাইবো। হায় হায় রে। আমার মান-ইজ্জত সব গেলো। শেষ কথাটা প্রায় আর্তনাদ করে নাটু।
শুধু নিজেরটা ভাবতাসো? হের বাপে শুনলে আমার কী অইব বুজো? মানিকের মা আঁচল দিয়ে ভয়ার্ত মুখ মোছে।
মানিক দরজা ধাক্কা দিয়েই যাচ্ছে। এ রকম আর কিছুক্ষণ হলে পাড়ার লোকজন জড়ো হয়ে যাবে। নাটু মানিকের মা-কে দরজা খুলতে বলে নিজে ঘরের একপাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
দরজার খিল সরতেই ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে মানিক। অক্ষত মা-কে দেখে একটু আশ্বস্ত হয়। দাঁত কিড়মিড় করে বলে, ওই কুত্তার বাচ্চা আমি না থাকলে তো তুই আমার মা-রে আইজ খুন কইরা ফেলতি। বাজানরে কমু তরে পুলিশে দিতে, দাঁড়ায় রইছোস কেন? যা, যাস না।
মানিক ওর ছোট্ট হাত দিয়ে নাটুর গায়ে ধাক্কা দেয়। হাতে গামছা নিয়ে মানিকের কাছে আসার অপেক্ষাতেই ছিল নাটু। মুহূর্তের মধ্যে সে মানিকের গলায় গামছার ফাঁস পরিয়ে দেয়। একটা প্যাচ কষে মানিককে মেঝেতে ফেলে ওর ওপর বসে পড়ে।
মানিকের মা ‘হায় হায়’ করে ওঠেন, করো কী। মইরা যাইবো তো।
নাটু সে কথার উত্তর না দিয়ে মানিকের গলা চেপে ধরে আরও জোরে।
ছোট্ট, হালকা পাতলা দশ বছরবয়সী মানিকের নিশ্বাস নাটুর নিচে পড়ে ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে।
মানিকের নিথর শরীর ফেলে উঠে দাঁড়ায় নাটু। মানিকের মা থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে, পোলাডারে মাইরা ফেললা?
না মারলে গেরামে তুমি-আমি কেউ আর মুখ দেখাইতাম পারতাম না। আর আজকের কথা শুনলে তুমার স্বামী তুমারে রাখতো?
মানিকের মায়ের জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। সে হতবাক হয়ে মৃত ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। নাটু বলে, কোঁদালডা দাও।
-কেন?
-লাশটা পুঁইতা ফেলি।
মধ্য দুপুরের কড়া রোদ গাছের পাতা ঝলসে দিচ্ছে। দূরে একটা গরু ডাকছে। কয়েকটা শালিক আর চড়ুই গাছের ডালে ডালে কিচিরমিচির তুলেছে। মানিকদের বাড়ির পেছনে কলাবন আর বাঁশঝাড়ের মাঝে নাটু গর্ত খুঁড়ছে কোদালে খুপ্ খুপ খুপ শব্দ তুলে।