জীবনের সমীকরণগুলো বড্ড অদ্ভুত! গোলমেলে, নিষ্ঠুর। একইসঙ্গে মায়াবীও। কোনো সমীকরণের সঙ্গে অন্য সমীকরণের মিল খোঁজা বোকামি। তবু কেউ কেউ খোঁজে সুখের মাপকাঠিতে। মিল খুঁজে পেতে পেতে শেষটায় এসে যোগ হয় ভিন্ন একমাত্রা। ধাক্কাটা লাগে তখনই। যে সুখী সম্পর্কের আলোকরশ্মি চোখে-মুখে রঙ ছড়ায়, তার গভীরে নিগুঢ় কালো অন্ধকারে ছেয়ে থাকা এক আলাদা জগতের সন্ধান পাওয়া যায় না জনমভর। আলোকরশ্মি ছড়াতে ছড়াতে একদিন নিজেরই গড়া একাকিত্বের অন্ধকার রাজ্যে সমাধিস্থ হয়ে পড়ে সে। নিজেকে হাতড়েও আর সন্ধান মেলে না তার।
খাল পাড়ের বড় হিজল গাছটার ছায়া খালের যে অংশের পানিকে আগলে রেখেছে, সেখানে পানির রঙ স্বচ্ছ। যত্নে তুলে রাখা লাউয়ের ডগার মত সজীব। টলটলে। দূর পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা পানির মিষ্টি সুরের মতো মায়াবী। তবে প্রাণোচ্ছ্বল নয়, বড্ড বেশি চুপচাপ। স্থির আর গভীর। ঠিক যেন খালের ওপারে বুনো জঙ্গলঘেরা দোতলা বাড়িটার মতো, শান্ত-গভীর।
এই বুনো জঙ্গলঘেরা শান্ত বাড়িটাতে আসতে হলে হলুদরঙা ফুলগুলোকে একপাশে রেখে বামদিকে এগিয়ে যেতে হয়। দোতলা পোড়াবাড়িটার একটি কামরায় হারাধন ঠাকুরের বসবাস। আধভাঙা কাঠের জানালাগুলো চৌধুরীদের বাড়ির ফেলে দেওয়া নাইলনের সুতো দিয়ে বাঁধা। ঝড় বৃষ্টিতে বাঁচার একমাত্র উপায়। দুদিন থেকে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। মেহগনির বড় বাগানের মাঝে এই রঙ হারিয়ে দোতলা বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে অনিচ্ছায়, একটু ফাঁকি দিতে পারলেই ভেঙে পড়বে যেকোনো সময়। কালীমন্দিরটার টানে হারান ঠাকুর এই ভাঙা বাড়ি ছেড়ে যেতে পারেননি।
ছেলে, বৌমার কাছে গেলে কি আর যত্ন করবে না! কিন্তু এই বাড়ি আর কালীমন্দিরের মায়া কাটিয়ে শহরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। বাবার এই পাগলামিতে বিরক্ত হয়ে ছেলেও খোঁজ নেয় না আর। বট-পাঁকুড় দুটো গাছ মিলেমিশে একাকার এখানে। বট-পাঁকুড়ের ছায়ায় জাগ্রত এই কালীমন্দির একসময় জমজমাট ছিল ভক্তদের পদচারণায়। আর ঠাকুর হিসেবে হারাধন ঠাকুরের জয়-জয়কার। আজ বটপাঁকুড়ের মতো হারান ঠাকুরও বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন, হারিয়েছে আকর্ষণ!
ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে হারান ঠাকুর দরজা ভিজিয়ে ঘরে ঢুকলেন।
-এত দেরি করলে আসতে? আমার একা একা ভালো লাগে? ভয় লাগে এ ভুতুড়ে বাড়িতে। চিন্তাও হয় তো, না কি?
মানসীর চোখে অভিমান ঝরে পড়ছে।
হারান ঠাকুর হেসে ওঠেন, মানসির অভিমান দেখে।
-এই ঝড় জলে তুই জেগে আছিস এখনো? ঘুমাতে পারতি৷
এবার ঘেঁষে বসে মানসী। হারান ঠাকুর এর মানেটা বোঝে।
-আজও কিন্তু মাছ নাই। মাছ ছাড়াই শুকনো রুটি খেতে হবে।
কথা বলতে বলতে হারান ঠাকুর তালি দেওয়া ছাতার সঙ্গে বাঁধা পুটলিটা খুলে পায়াভাঙা চেয়ারের ওপর রেখে দেন। মানসী তাড়াতাড়ি পোটলা খুলতে গেলে ধমক দেন হারান ঠাকুর। একটু তো ধৈর্য ধর বাবা। আমাকে ভেজা জামাটা বদলাতে দে। মানসী মাথা নিচু করে অভিমানে দূরে সরে যায়, তার পেটে যে রাজ্যের ক্ষুধা! অভিমান দেখে আবারও হাসি পায় হারান ঠাকুরের।
-অমনি গাল ফোলানো না? তোর কথায় কথায় অভিমান শুধু, কী যে করি তোকে নিয়ে! আমরা একসঙ্গে খাবো বলে বললাম।
সব জায়গায় নতুনের জয়জয়কার। পুরনো জিনিস শুধু জঞ্জাল বাড়ায়, কাজে আসে না। সব জীবনেরই একসময় ভাটা পড়ে, ফুরিয়ে আসে দিন। পুরনো এই বটপাঁকুড় আর হারান ঠাকুট যেন তারই মূর্ত প্রতীক।
মানসীর মুখ থেকে অভিমানের কালো মেঘ দূরে সরে গেলো। হারান ঠাকুর ভেজা জামাটা ছেড়ে গামছা গায়ে জড়ালেন। বাড়িতে জামার অভাব হলেও গামছার অভাব হয় না। গামছা অনেকটা পোশাকের অভাব পূরণ করেছে হারান ঠাকুরের। একটা গামছা শরীরের নিম্নাংশে পেঁচিয়ে অন্যটি দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে অস্পষ্ট ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে থমকে গেলেন হারান ঠাকুর। অস্পষ্ট, ঘোলাটে চোখে কত অভিমান জমা। অপূর্ণতা! সব ব্যর্থতা আমার, আমি পারিনি সুখ দিতে। মনে মনে নিজেকে দোষ দিতে থাকে হারান ঠাকুর।
শিপ্রার এই ছবিটা কোনো এক মহালয়ার দিনে তোলা। কতবছর আগে তা আজ আর হিসাব করে বের করাও অসম্ভব। এই রঙহীন বাড়িটায় তখনো রঙ ছিল। ভালোবাসার রঙে আরও বেশি রঙিন ছিল এই পরিবার, এই সংসার। ২ ছেলে-মেয়ে আর শিপ্রার হাসি, গল্প, অভিমান আর অনুযোগে মুখরিত বাড়ির প্রতিটি দেয়াল। প্রাণ ভরপুর ছিল এই বাড়ি। এ সময়টাতে তালের বড়ার প্রস্তুতি চলতো বাইরের উঠোনে। নিকোনে নতুন উনুনে শিপ্রা তখন খোলা চুলে বসে পড়তো সাদা রঙের আল্পনা আঁকতে। টুপটাপ শিউলি ঝরা শুরু করতো উনুনের চারপাশে। শিপ্রার করা আল্পনা আর শিউলি ফুল মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতো। তিনটে উনুন একবারে জ্বলে উঠতো পিঠা তৈরির দিনে। কার্তিকের মা ছিল এই বাড়ির নুন-ডাল-ভাত। প্রতিবেশীরা সবাই শিপ্রাকে ভালোবাসতো। কার্তিকের মা ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। তবে শিপ্রার মনের কথা সব বলার নির্ভরশীল জায়গা ছিল ছোট মৌলভীর বউ। দুজনে একপ্রাণ যেন। কী যে সেই মিল, চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। শিপ্রার শাখা সিঁদুর না থাকলে দুই বোন বলে ভুল করতো সবাই। একরকম শাড়ি করিয়ে নিয়েছে কতবার। ছোট মৌলভীও বড্ড ভালো মানুষ ছিলেন। সব মানুষ তার ভালো আচরণের জন্য সম্মান করতো। তাদের দুই সখীর কাজ কমিয়ে দিতে কার্তিকের মার জুড়ি নেই। তবে শিপ্রাকে একটু বেশিই ভালোবাসতো সেটা স্পষ্ট হতো নানান কাজে। তার এক মেয়ে ছিল শিপ্রার বয়সী।
যুদ্ধের সময় কাজলা নদীর পাড়ঘেঁষে নিরালীতে যে ক্যাম্প করা হয়েছিল, সেখানে তার মেয়েকে তুলে দিয়েছিল এলাকার শান্তি কমিটির কিছু মানুষ। মেয়েটিকে আর ফিরে পায়নি, লাশটাও না। নিরালীর সবাই যখন ভারতের দিকে রওনা দেয়, তখন হারান ঠাকুর আর শিপ্রার সঙ্গে কার্তিকের মাও থেকে যায়। মেয়েকে হারিয়ে সে যেতে চায়নি নিরাপদ স্থানে। শিপ্রার মাঝে যেন কার্তিকের মা খুঁজে পেয়েছে হারিয়ে যাওয়া মেয়ে চন্দনাকে।
আহা চন্দনা! আহা যুদ্ধের সে সব রুদ্ধশ্বাস দিন। এক স্মৃতি থেকে অন্য স্মৃতি। আজকাল যেকোনো বিষয় দিয়ে শুরু হোক না কেন স্মৃতি গিয়ে কড়া নাড়ে সেই বিভীষিকাময় একাত্তরেই। বড্ড বিরক্ত লাগে, মনে করতে চায় না কিছুতেই তবু।
হারান ঠাকুর ছেলে মেয়ে ভাই বোন মা-কে ওপারে পাঠাতে পারলেও এই দেশ, এই জন্মভিটা রেখে যেতে পারেননি তিনি। সেই থেকে দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে ছেলেমেয়ের মধ্যে। কাছে থাকলে তো মায়া জন্মে। মায়া তৈরি হওয়ার সুযোগ তো তিনিই দেননি। দোষটা তারই, ছেলেমেয়ের নয়। এখানেই মরতে চান তিনি। এই জন্মভিটার মায়া কাটাতে পারেননি আজও। অথচ মৃত্যু যেন সোনার হরিণ। যে দেশের মায়ায় সন্তান, আত্মীয় স্বজন থেকে দূরে সরে যেতে হয়েছে, সে দেশ আজ তার নয়, এ কথা তাকে বুঝিয়ে দেওয়ার পর থেকেই মৃত্যুর প্রতিক্ষায় থাকেন হারান ঠাকুর। অথচ মৃত্যুও তাকে ভুলে গেছে আপনজনদের মতো।
মানসীর চিৎকারে হারান ঠাকুর বেরিয়ে আসেন স্মৃতি থেকে।
-বড্ড পেটুকরে তুই, একটুও ধৈর্য ধরতে পারিস না?
মানসীকে কপট রাগ দেখাতে দেখাতে পুরনো ঘড়িটার দিকে তাকান হারান ঠাকুর। তবে ঘড়িটা এখনো ব্যাটারি বদলালে চলছে, এটা এক বিস্ময় তার কাছে। এভাবে ছবির সামনে ১ ঘণ্টা কুড়ি মিনিট দাঁড়িয়ে। আপনমনে হেসে ওঠেন। এই হাসিতে যে ব্যথা লুকানো, তা কি ছবি হয়ে যাওয়া মানুষটা বুঝতে পারে? না বুঝতে পারাই ভালো। না হলে শিপ্রা আমার এত সুখ দেখে হিংসে করতো। মনে মনে প্রমাদ গোনেন তিনি। মানসীকে কাছে ডেকে আদর করেন।
-চল বাবা আর রাগ করিস না প্লেট নিয়ে আসি। এখনই খেতে দেবো। বড্ড কষ্ট দিয়েছি তোকে। তুই আমাকে আরও আগে ডাকতে পারতি।
মানসীকে শুকনো রুটি আর কিছুটা গুড় দিলে ব্যথাতুর দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে হারান ঠাকুরের দিকে।
-খা না বাবা আজকের মতো। কাল মাছের ঝোল দিয়ে গরম ভাত খেতে দেবো৷ তুই তো জানিস আমার অম্বল! বয়স হয়েছে, রাতের বেলায় ভাত খেলে অসুবিধে হয় যে। তাই তো রুটি আনলাম।
মানসী মাথা নিচু করে চুপচাপ খেয়ে নেয়। মানসীর পাতে কাল যে করেই হোক এক টুকরো মাছ দিতেই হবে। বড্ড অভাবের সংসার। একমাস থেকে মানসীকে মাছের কথা বলছে হারান ঠাকুর। মানসীর চোখের দিকে তাকাতে পারেন না এসব কথা মনে পড়লে। আত্মীয়হীন, বন্ধুহীন এই জগৎ সংসারে মানসী তার একমাত্র আপনজন। দুটো কথা কইবার একমাত্র জায়গা।
পুরনো বট-পাঁকুড়ের ছায়ায় যে কালীমন্দির, তারই একটু সামনের দিকে যেখানে কাজলা বয়ে চলেছে পরম মমতায়, সেখানে এই দুটি প্রাণীর অন্য কোনো আপনজন নেই। এই দুটি প্রাণী একে অন্যের ব্যথায় সমব্যথী। নিজের খাবারের চেয়ে মানসীর কষ্টে বুকটা ফেটে আসে হারান ঠাকুরের। কী-ই বা করতে পারেন তিনি। হাঁটুর ব্যথাটা বড্ড বেড়েছে। নড়তেই কষ্ট হয় হারান ঠাকুরের। আজকাল এই কালীমন্দিরে লোকজন একেবারেই আসে না। ভাঙাচোরা মন্দিরের প্রতিমাও পুরনো হয়ে গেছে হারান ঠাকুরের মতো। এদের কেউ চায় না। সব জায়গায় নতুনের জয়জয়কার। পুরনো জিনিস শুধু জঞ্জাল বাড়ায়, কাজে আসে না। সব জীবনেরই একসময় ভাটা পড়ে, ফুরিয়ে আসে দিন। পুরনো এই বটপাঁকুড় আর হারান ঠাকুট যেন তারই মূর্ত প্রতীক।
হারান ঠাকুরের একমাত্র কথা বলার সাথী মানসী। সেও আজ ছেড়ে চলে গেলো তাকে। সেদিকে কারও খেয়াল নেই। সবাই হারান ঠাকুর বেঁচে আছে, সেটা নিয়েই কথা বলছে। হারান ঠাকুর মাছের টুকরোসহ ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। কী করবেন? কী করা উচিত তার?
ভোর হতেই বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে কোচড়ে কিছু খুচরো পয়সা গুঁজে লাঠিতে ভর দিয়ে ছাতা মাথায় বাজারের দিকে রওনা দেন হারান ঠাকুর। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছেই। বাজারে গিয়ে দেখেন, এক এক করে জেলেরা আসতে শুরু করেছে মাছ নিয়ে। সবজি বসেছে কয়েকটা দোকানে। এলাকার ছোট ছেলেরা বাড়ির গাছের আমড়া, কদবেল, কামরাঙা নিয়ে বসে আছে। বেশ ভালো লাগছে হারান ঠাকুরের। মাছ আসছে। কাজলার মাছ সব নয়। এখন শুধু কাজলার ওপর নির্ভর করে না জেলেরা। রাত বাকি থাকতে তারা ট্রলারে চেপে মাছের আড়তে গিয়ে মাছ নিয়ে আসে এই বাজারে। তাই একটু দেরিতে বসে এই নিরালী বাজার।
হারান ঠাকুর দুই তিন জনকে চিনতে পারেন। ওদের বাপ-দাদার সময়ে হারান ঠাকুরের বেশ নাম ডাক ছিল। তাকে ছাড়া হতো না কোনো পুজো। একটু একটু করে হারান ঠাকুর এগিয়ে যান ওদের দিকে কাঁপা-কাঁপা পায়ে। কোমরে গুঁজে রাখা শেষ সম্বল এই খুচরো পয়সাগুলো বের করে দেন জেলের হাতে। খুব অসহায় স্বরে বলেন, যেমনই হোক একটা মাছ দাও। আমার মানসীটার মুখে একটু মাছ তুলে দেই। নবীন আর গোবিন্দ জেলের ছেলেরা হারান ঠাকুরের মুখে এমন কথা শুনে বিরক্ত হন।
-পুরান পাগলে ভাত পায় না, নতুন পাগলের আমদানি। বড় বড় রুই, কাতলা দেইখা আর সহ্য হয়নাই, তাই না ঠাকুর মশাই? এসব আর চলবে না, এই খুচরো পয়সা গোনার সময় নেই আমার। এই দিয়ে তো পুঁটি মাছও পাওয়া যায় না। ঝামেলা কইরেন না তো, যান এহান থেইকা।
হারান ঠাকুরের পুরনো ছাতাটায় বৃষ্টি মানছে না। বাতাস বইতে শুরু করেছে। ঝড় শুরু হলো বোধহয়। মাছ বাজারের এককোণে ছাপড়া দেওয়া খোলা ঘরটাতে সারিবদ্ধ ধারালো বটিগুলো থেকে আলো ছড়াচ্ছে। কত কত সংসারের হাসি আর রান্নাঘরের গল্প তৈরি হচ্ছে এখানে। বড় বড় রুই, কাতলা, পাঙ্গাস, বোয়াল কাটা পড়ে চোখের নিমিষেই। হারান ঠাকুর তাকিয়ে আছেন সেদিকে। কী বলনবে মানসীকে আজ? কিভাবে তাকাবেন ওর চোখে চোখ রেখে। বড় বড় মাছগুলো হারান ঠাকুরের চোখের সামনে ছোট ছোট টুকরোতে পরিণত হচ্ছে। কত সন্তান, স্ত্রীর চাওয়া পূরণ হচ্ছে হাতে হাতে।
-কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন বৃষ্টির মধ্যে জেঠা? বড় রুই মাছের চার পাঁচ টুকরো ব্যাগে চালান দিয়ে পরম যত্নে কথাগুলো বলছিলেন একজন। হারান ঠাকুর তাকে চিনতে পারেন না। খুচরো পয়সাগুলো ছেলেটার হাতে দিতে গেলে জিভ কেটে দূরে সরে যায় সে। পয়সাগুলো তার কোঁচড়ে গুঁজে দিয়ে বলে, পয়সা লাগবে না জেঠা। ছোট্টবেলা বাবার হাত ধরে কত গিয়েছি আপনার বাড়িতে। জেঠিমার হাতের রান্না খেয়েছি। কত যত্নে আমাদের বয়সী সব ছেলেমেয়েকে খাইয়েছেন জেঠিমা আর আপনি। মনে পড়ে খুব। আমি তো এটুকু আপনার জন্য করতেই পারি। প্লিজ না করবেন না।
না, আজ হারান ঠাকুর না করবেন না। মানসীর কাছে ছোট হতে পারবেন না তিনি। ছেলেটির প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখে জল ছলছল করে ওঠে। কয়েকফোঁটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে টুপ করে ঝরে পড়ে। বৃষ্টির জলের সঙ্গে তা মিলে একাকার হয়ে যায়। হারান ঠাকুর বাড়ির দিকে এগুতে থাকেন। বাড়ির চারপাশে কিছু মিষ্টি আলুশাক হয়েছে, সেগুলো দিয়ে আজ মাছটা রান্না করে দেবেন মানসীকে। ও আজ অনেকদিন পর ভাত খাবে। মানসীর তৃপ্তিমাখা মুখটা মনে পড়ে নিজের অপরাধবোধ কমে হালকা হয়। কিন্তু মাথাটা কেমন ঝাঁকি খেয়ে ওঠে। পায়ের নিচের মাটি কেঁপে ওঠে। হঠাৎ কী হলো তার। তিনি কি মারা যাচ্ছেন? এমন লাগছে কেন? কিছুই বুঝতে পারছেন না। বিকট একটা আওয়াজে কানে তালা লাগে। আচ্ছা, তিনি মরে গেলে মানসী কি এ বাড়িতে থাকবে? একা হয়ে যাবে যে মানসী! একা থাকা যে কতটা যন্ত্রণার, সেটা বোঝেন হারান ঠাকুর। মানসীর কষ্টের কথা ভেবে তার আরও মাথা ঘুরছে।
না মারা যাননি হারান ঠাকুর। বাড়ির সামনের মিষ্টি আলু শাক ক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। বাড়ির সামনে অনেক লোকজন। পুরনো ফাটল ধরা বাড়িটা বয়সের ভার আর সইতে না পেরে শুয়ে পড়েছে মাটিতে। দূরের প্রতিবেশীরা হারান ঠাকুরের মারা যাওয়ার আশঙ্কায় ছুটে এসেছিল, কিন্তু আশাহত হয়েই ফিরে যাচ্ছে। ‘বুড়োর কই মাছের প্রাণ’। কেউ কেউ বলছে, ‘বুইড়া ১০০ বছর বাঁচবে’।
মানসীর কথা কেউ বলছে না। হারান ঠাকুরের একমাত্র কথা বলার সাথী মানসী। সেও আজ ছেড়ে চলে গেলো তাকে। সেদিকে কারও খেয়াল নেই। সবাই হারান ঠাকুর বেঁচে আছে, সেটা নিয়েই কথা বলছে। হারান ঠাকুর মাছের টুকরোসহ ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। কী করবেন? কী করা উচিত তার?
একমাত্র সাথী, তার সন্তান আজ তাকে ছেড়ে চলে গেলো। অথচ লোকগুলো বারবার বলছে, একটা বিড়াল চাপা পড়ছে, বুইড়ার কিছু হয় নাই।
আরও পড়ুন: সিঙ্গেল মাদার ॥ শারমিন রহমান