ঘড়িতে ১১টা ৪৫ যখন বাজে রুবেন কম্পিউটারে গানটা সিলেক্ট করে রেখেছিল যেন ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁলেই ওটা বেজে ওঠে। গানটা আর কিছু নয় জেমসের গাওয়া, ‘মা, সবাই বলে ওই আকাশে লুকিয়ে আছে/ খুঁজে দেখ পাবে দূর নক্ষত্র মাঝে’। তারপর সে তার অন্য কী-সব কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। হয়তো বইয়ের আলমারি থেকে গোটাকতক বই বের করে আনমনে পাতা উল্টাতে-উল্টাতে কোনো একটা পৃষ্ঠায় ডুবে যায় কিংবা কারও ফোন আসায় সে কথা বলতে থাকে। ওই সময় ওই গানের আওয়াজে সে চমকে ওঠে। অথচ মাত্র পনেরো মিনিট আগে সে নিজেই ঠিক করে রেখেছিল বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে গানটা বেজে উঠবে। ব্যাপারটা মোটেই অজানা বা আচমকা কিছু নয় কিন্তু মিউজিকের ১৭ সেকেন্ডের মাথায় যখন কথাগুলো ভেসে রুবেনের মগজে গিয়ে পৌঁছালো, তখন তার আদৌ মনে ছিল না এ গান সে-ই ঠিক করে রেখেছে। ‘রাতের তারা আমায় কি তুই বলতে পারিস/ কোথায় আছে কেমন আছে মা […] অনেক কেঁদেছি আর কাঁদতে পারি না।’
খুব ভোর বেলা সূর্য মুখ দেখানোর আগেই অস্বাভবিক সময়ে রুবেনের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় অন্যকিছু না ভেবে সোজা চলে যায় শহরের প্রধান সমাধিস্থলে। বহু কবরের ভিড়ে সিমেন্টের ছোট একটা খুঁটি ছাড়া এখানে তার মাতৃসমাধির আর কোনো চিহ্ন নেই। কবরের মাটি সমতল, ওপরে বড় বড় নিশ্চিন্ত ঘাসের ভেতর কাঁটানটে গাছে ভর্তি, তার ওপর দিয়ে একদল ছোট্ট রঙিন প্রজাপতি ওড়াউড়ি করে বেড়াচ্ছে। রুবেন মায়ের কবরের কাছে খানিক দাঁড়িয়ে থাকে, সূর্যোদয় দেখে; সূর্য দেখলে সেই ছোটবেলা থেকেই তার কেমন আবছাভাবে ঈশ্বরের কথা মনে হয়। তখন থেকেই ভাবার চেষ্টা করেছে সেই রহস্যময়ের অবয়ব। সে আজও রুবেনের কাছে তেমনি রহস্যময় রয়েছে বরং এতদিনে আরও দুর্জ্ঞেয় হয়ে উঠেছে। এখানে মৃদু শীতল বায়ু, ভেজা মাটি, বুনো ঝোপ, অচেনা পোকামাকড়ের গন্ধের ভেতর দাঁড়িয়ে রুবেন হাত উঁচু করে সবার মতো প্রভুর কাছে কোনো প্রার্থনা করে না। মনের ভেতরকার কিছু অব্যক্ত কথা হয়তো কেবল বিধাতা পড়ে নেন; ‘হে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্রের স্রষ্টা, হে চিরঞ্জীব, অনন্ত-অসীম আমার মাকে তোমার বানানো জায়গাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভাল স্থানটি দিও, আর আমাকেও নিও তার বুকের পাশে সদ্যোজাত শিশুটি করে; সেই ২৯ বছর আগের মত; নিরাপদ আর পরম নিশ্চিন্ত।’ রুবেন মাথা নত করে না, কেবল বিস্মিত হয় এই জগৎজীবন দেখে। বিস্ময় থেকে অন্তরে কোনো ভক্তি সৃষ্টি হয় কি না, তা সে বলতে পারবে না। মহাজনেরা তো বলে থাকেন ভক্তি বিনা মুক্তি মেলে না।
রুবেনের মনে হয়, অহেতুক আমরা মৃত্যুকে বীভৎস কোন দৈত্য বনিয়ে ফেলেছি, হয়তো এজন্য ধর্মের বইগুলো কিংবা ধর্মযাজকেরাও দায়ী হতে পারে। মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার কোনো যুক্তি নেই, অন্তত তার নিজের জন্য। সে বিশ্বাস করে; অবিশ্বাস করতে পারে না; কেন যে বিশ্বাসের এই দৃঢ়তা তা বলতে পারবে না, পরলোক অনেক সুন্দর; জ্যোৎস্নার মতো স্বপ্নময়, সমুদ্রতীরের মতো কল্লোলিত, আকাশতুল্য উদার-অসীম। বিধাতা মানুষকে আগুনে পোড়ানোর বা রক্তপুঁজ খাইয়ে রাখার জন্য তাকে সৃষ্টি করেননি। সে-সুন্দরকে রুবেন কেবল নিষ্ঠুর-কাহ্হার ভাবতে পারে না। অন্তরে তার বিস্ময় জাগে। সে জানে না বিস্ময় থেকে বিশ্বাস কিংবা ভক্তি কত দূর। যে-মা পরলোকে বসে এখনো রুবেনের জন্য ভাবেন; মৃত্যুশয্যায় যিনি মৃত্যু বা পরলোকের শাস্তির চেয়ে মাতৃহীন রুবেনের অবস্থা চিন্তায় অনেক বেশি কাতর হয়েছেন, বালিশে চোখের জলের দাগ পড়ে গেছে; ঈশ্বর তো আমাদের সেই মায়ের চেয়েও অধিক ভালবাসেন; আমরা তো প্রথমত ঈশ্বরেরই সন্তান। কাজেই বিধাতা কিভাবে নিরন্তর তার প্রিয়সৃষ্টির ওপর নির্দয় শাস্তির নির্দেশ দিয়ে যাবেন?
তাছাড়া সে তো গতানুগতিক লোক নয় সেই কিশোর বেলা থেকেই; যুবক বয়সে আরও প্রগতিশীল আরও বেশি আলোকিত। কিন্তু আজ এতদিন পরে তার মনে হয় নিজের বিশ্বাসের অহমিকা অক্ষত রাখতে সে কি মাকে ঠকিয়েছে?
উম্মে হাবিবা দেহত্যাগ করেছেন আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে। তারও সাতাশ বছর পূর্বে আকাশের রুবেন উম্মে হাবিবার গর্ভ হয়েই পৃথিবীতে এসেছিল। তবু আজকের দিনটা রুবেনের কাছে কষ্ট বা শোকের বলে মনে হয় না। মা চলে গিয়ে বা স্থানান্তরিত হয়ে কিংবা কেবল দৃষ্টিসীমার বাইরে অবস্থান করে তাকে বুঝিয়ে গিয়েছে জীবনের অন্য মর্ম, ভিন্ন মানে। এখন সে সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ, আকাশের বিষণ্ন মেঘ, ঝড়েভাঙা বৃক্ষ, রাস্তায় গাড়ির চাকায় পিষ্ট রক্তাক্ত কুকুরের আর্তচিৎকারের ভাষা পড়ে। বিষণ্নতার আনন্দ; অশ্রুপাতের সুখ যে জেনেছে, সে-ই কেবল বুঝেছে এই পৃথিবীকে; জগতোত্তর জগৎকে। মায়ের মৃত্যুর দিন রুবেন কেঁদেছিল বটে কিন্তু সত্যিকার অর্থে কষ্ট পায়নি বরং এক প্রকার মুক্তিই অনুভব করেছিল, মায়ের রোগযন্ত্রণা দেখে বুকের ভেতর জমে থাকা বিষবাতাসের বেলুনটাও ফুটো হয়ে মহাশূন্যে মিশে গিয়েছিল তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই।
মৃত্যুর ৩৬ ঘন্টা আগে তার বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে গিয়েছিল, অথবা মা আসলে তখন চেতনার অতল অসীম গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছিল; আমরা জ্ঞানসম্পন্নরা ভুলবশত তাঁকে অচেতন ভেবেছি। মা অচেতন অবস্থার আর চোখ মেলে তাকায় নি আর কিন্তু যা বুঝানোর যে মন্ত্রণা দেবার তা দিয়ে গিয়েছে রুবেনকে। ওই অচেতনায় মা ছড়া পড়ছিল, মা এমন ভাবে কথা বলছিল যেন খেলছে শিশুদের সঙ্গে ঠিক শিশু হয়ে। মধ্যরাতে সে শিশুদের মত বর্ণ পরিচয় পড়েছে ক খ গ ঘ […]। তারপর ভোর রাতে ঘুমন্ত মানুষকে আলগোছে জাগিয়ে দিয়ে উচ্চারণ করেছে আপাত অচেতন; গভীরচেতনা থেকে সন্ধিসাঁকোয় দাঁড়িয়ে জীবনমৃত্যুর সেই চরম সত্য। যে সত্য রুবেন কেবল নিজের কাছেই রাখতে চেয়েছিল পরম আপন করে বুকের খাঁচায়; কিংবা খাঁচার ভেতরের বুকে। সন্দেহ নেই মায়ের অনুপস্থিতি তার পৃথিবীর অর্ধাংশ শূন্য করে দিয়েছে। সে শূন্যতা কখনোই কিছুতে পূরণ হবে না। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পূর্বে টানা একটা বছর সে মায়ের প্রগাঢ় নীল কষ্ট দেখেছে, নিজের হৃদযন্ত্র অথবা আত্মার ভেতর অনুভব করেছে সেই যন্ত্রণা। রোগগ্রস্ত মা দাঁতে দাঁত চেপে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাক, পূর্ণ হয়ে থাক মায়ের জাগতিক স্থান তা রুবেন চায়নি।
মায়ের তো পৃথিবীতে তেমন কেউ আর ছিল না; রুবেনের পিতার স্মৃতি বলতে কতগুলো ছবিমাত্র, মা অনেক আগেই হয়তো ঈশ্বরের কাছে মৃত্যু প্রার্থনা কেো, করেনি বেঁচে থাকতে চেয়েছিল যন্ত্রণাকে তুচ্ছ করে কেবল রুবেনের জন্যই। কিন্তু রুবেন তা চায়নি। বরং সে-ই হয়তো-কোনো অবচেতনে বলেছিল আকাশকে, সূর্যকে, বলেছিল সমুদ্রকে, আকাশ উচ্চে উড়ে চলা পাখিকে; তোমরা বলোনা তোমাদের স্রষ্টাকে, সেই অক্ষয় নিয়ন্ত্রককে; আমার মাকে যেন সে মুক্তি দেয়; আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না একবিন্দু। কাজেই মায়ের মৃত্যু তার কাছে শোক নয় বরং তা আনন্দের। মা থাকাটা যেমন ছিল ভরসার, সৌভাগ্যের তেমনি মায়ের অনুপস্থিতিও প্রতি মুহূর্তে তার চেতনায় দূরগির্জার ঘণ্টাধ্বনি হয়ে বাজতে থাকে। মা দূর থেকে বলে, আকাশ থেকে জানায়; বজ্রপাতের সময় বিদ্যুৎ চমক হয়ে বলে ওঠে, ‘কষ্ট কি বাবা, এই তো আমি আছি তোমার পাশেই; তোমার চারিদিকের বাতাসে। আকাশের মেঘে। স্রোতস্বিনী জলে, সাগরের গভীর নীলে।’ মা তো কেবল সাতাশ-আটাশ বছরের সম্পর্ক মাত্র নয়; অনন্তের মা, অনিঃশেষ মা, সাত আসমান মা, জান্নাতুল ফিরদাউস মা!
মায়ের মৃত্যুর দিনে এ বাড়িতে যত লোক এসেছিল তার আগে বা পরে কোন একই দিন তার দশ ভাগের এক ভাগ লোকেরও সমাগম হয়নি। তাদের কেউ কেউ অক্ষম ভাষায় রুবেনকে সান্ত্বনাও দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। মানুষগুলোর সামনে রুবেনের নিজেকে অপ্রস্তুত মনে হচ্ছিল। এত লোকের সমাগম প্রথমে অর্থহীন মনে হলেও সে খেয়াল করে মানুষের বিচিত্র প্রতিক্রিয়ায় শোকের পরিবেশ বেশ খানিকটা হালকা হয়ে উঠেছে। কখনো কখনো মনে হচ্ছিল মৃত্যু যেন শোক নয় কোনো; একটা উৎসব। মায়ের মৃত্যুর আগে রুবেন মৃত্যু সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে এড়িয়ে চলতো, এমনকি ভয়ও পেতো। এখন হয়েছে অনেকটাই তার বিপরীত। আত্মীয়-অনাত্মীয় চেনা-কমচেনা যে-কারও মৃত্যু সংবাদ জানতে পেলে রুবেন সাগ্রহে চলে যায় জানাজায় কিংবা গোরস্থানে। বেশ ভালোই লাগে তার; প্রতিটি মৃত্যুই তার মায়ের মৃত্যুকে সজীব করে তোলে। কবরস্থানকে তার কাছে মৃত্যুপুরী বলে মনে হয় না, বরং বাইরের চেয়ে এখানকার পরিবেশটিই ভালো বোধ হয়। বড় বড় কড়ই আর মেহগনি গাছে ঢাকা গোটা কবরালয়; আছে স্বজনদের সমাধিজুড়ে চাষ করা গন্ধরাজ বেলি জবা গাঁদা হাস্নাহেনা ফুলের বাগান। এখানে এলে বেশ ভালোই হয়; যতক্ষণ থাকে মাকে দেখতে পায়, মনে পড়ে অচেতন মায়ের উচ্চারিত সেই বিস্ময় সেই চন্দ্রালোকের মতো স্নিগ্ধ সত্য। কত মধ্যরাতে তারপর সেই সত্য সেই সুন্দরের আবাহন রুবেনের চেতনাকে স্নাত করেছে বিস্ময়ের ঝরনা-ধারায়। কবরস্থানে হাঁটতে-হাঁটতে তার মনে হয় মা এর চেয়ে অজস্র গুণ সুন্দর স্বপ্নময় জ্যোৎস্না-ছাওয়া উদ্যানে বিচরণ করছে, সেখানে একটিই না-পাওয়া মায়ের; তার প্রিয়পুত্র কবে আসবে তার কাছে। বেলি ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে রুবেনের মনে হয় একটু আগেভাগেই মায়ের কাছে চলে যেতে পারলে মন্দ হয় না।
কবরস্থান থেকে ফিরে আকাশের নিচে দোতলার ছাদে ফুলের গাছগুলোর কাছে দুচারটি চেনা পাখির ডাক শুনে অনেকটা সময় কেটে যায়। নিচে দরজায় নক করার শব্দ পেয়ে রুবেন ছাদ থেকেই নিচে তাকিয়ে দেখে পায়ে গ্যাংগ্রিনঅলা সেই বৃদ্ধ, যে কারও কাছে ভিক্ষা চায় না, কেবল অসহায় গোঙানি-মিশ্রিত কান্নার মত আওয়াজ করে, অস্ফুট আওয়াজ থেকে কোন কথা উদ্ধার করা যায় না, রুবেন জানে সে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে পারে। সাধারণ ভিখিরির চেয়ে বেশি বেশি ভিক্ষে পাওয়ার এ তার এক ধরনের কৌশল হতে পারে। লোকটি তো এত সকালে বের হয় না। সে যা-ই হোক মায়ের মত্যুবার্ষিকীর সকালটা রুবেন তার নিজের মত করে শুরু করতে চেয়েছিল, লোকটি এসে ভালই হল। দরজা খুলে রুবেন তাকে ভেতরে ডাকে, ‘আসেন, ঘরের ভিতরে আসেন।’ লোকটি বুঝতে বোধ হয় এক মুহূর্ত সময় নেয়। তারপর বলে, ‘ঘরে আসতি কন?’
‘হ্যাঁ, আসেন।’
‘আমি বাবা, রাতি কিছু খাইনি, খিদের জ্বালায় সকালেই আপনাদের দরজায় এসে বিরক্ত করচি।’
‘আপনি বসেন, আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি।’
রুবেন মিনিট বিশেকের মধ্যে হোটেল থেকে পরোটা, ডাল, ডিমভাজি নিয়ে ফেরে। লোকটার সঙ্গে বসে নিজেও খায়, দু কাপ চা করে আনে। ভিক্ষুক লোকটি সসঙ্কোচে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে, ‘বাবাজি, বাড়িতে আর কেউ নেই?’
‘না।’
‘এত বড় বাড়িতে আপনি একাই?’
‘একা থাকাই তো ভাল, আমরা তো আসলে সবাই একা।’
রাতে বিছানায় গিয়ে ঘুম আসতে চায় না। এরকম সময় রুবেন সাধারণত হাতে একটা বই তুলে নেয়। ঘরের আলোর বেড সুইচটা হাতের কাছে রেখে সে বইয়ে মনোযোগ দেয়। কিন্তু আজ আর তা করে না। পরিবর্তে জানালার পর্দা ফাঁক করে গ্লাস সরিয়ে দেয়। বিছানা আর মেঝের অনেকটা অংশ জ্যোৎস্নায় ভরে যায়। আকাশের দিয়ে তাকিয়ে সোনার পানিতে ধোয়া গোলাকার রুপোর চাঁদ চোখে পড়ে। আজ পূর্ণিমা নাকি? বেশ একটা মিষ্টি বাতাসও বইছে। ঘরে ফ্যান চললেও দখিনের এ হাওয়াটাকে আলাদা করে বোঝা যায়, এ বাতাস ঠিক কৃত্রিম বাতাসের সঙ্গে মিশে যায় না। এই প্রাকৃতিক কোমল বাতাস মায়ের খুব প্রিয় ছিল। এ রকম বাতাসের সময় মা ঘরের পাখা বন্ধ করে দিত। মায়ের কামরার দখিন বারান্দায় একটা লালচে টবে মাঝারি আকারের বেলি ফুলের গাছ ছিল। রুবেন বোধ হয় জন্ম থেকেই দখিন বাতাসের বয়ে আনা সেই সুবাসের সঙ্গে পরিচিত।
জানালার গ্লাস এবার পুরোপুরি খুলে দেয় রুবেন। একটা বেলি ফুলের গাছ থাকলে কি চমৎকার হত! রুবেন বিছানা থেকে উঠে বসে। বেলি ফুলের গন্ধের জন্য তার ভেতরে এক ধরনের তৃষ্ণা তৈরি হয়, তাতে গলাটা শুকিয়ে আসে। সাইড টেবিলে রাখা গ্লাসের পানির সবটুকু এক নিশ্বাসে শেষ করে। জ্যোৎস্নার আলোয়ও বোঝা যায় বিছানায় আজ রুবেন ধবধবে শাদা চাদর বিছিয়েছে। ঠিকরে পড়া নরম আলোয় শাদা বিছানা দেখে কাফনমোড়া মাকে মনে পড়ে। টানা দুটো বছর মা এরকম বিছানায় রোগশয্যায় ছিল। মা বেঁচে থাকতে সে-সময় রুবেনকে যে উপলব্ধি দান করতে পারেনি, সে যেন মরে গিয়ে রুবেনকে নতুন জন্ম দিয়েছে। এখন রুবেন একেবারে আলাদা একজন মানুষ; সমুদ্রের মত গভীর আর আকাশের মত বিস্তৃত। বিয়ে-চাকরি-সন্তান এসব শৃঙ্খলে নিজেকে বাঁধবার তাগিদ বোধ হয় নি। মায়ের মৃত্যুর পর গতানুগতিক শেষকৃত্যের অনেককিছুই করেনি রুবেন, তার ওসবে বিশ্বাস ছিল না বলে। মিলাদ, দোয়া, কুলখানি, কাঙালি ভোজ এসবের কোন মানে সে খুঁজে পায়নি। মনে হয়েছে এসকল আয়োজন শোকের পরিবর্তে অহেতুক এক ধরনের হাঙ্গামা, যা রুবেনের সুস্থির শোকের গভীর জলে অহেতুক অস্থিরতা বাঁধাবে। তাছাড়া সে তো গতানুগতিক লোক নয় সেই কিশোর বেলা থেকেই; যুবক বয়সে আরও প্রগতিশীল আরও বেশি আলোকিত। কিন্তু আজ এতদিন পরে তার মনে হয় নিজের বিশ্বাসের অহমিকা অক্ষত রাখতে সে কি মাকে ঠকিয়েছে?
এসবের কোনোকিছু না করে মানুষটিকে পাগল শ্রেণীর মনে করে সশব্দে দরজা লাগিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে রুবেন আবারও খানিকক্ষণের জন্য নিজেকে বিছানায় নিয়ে ফেলে।
ভালোবাসা তো যুক্তির অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বাসও। রুবেনের কি মনে হয়; সে বাথরুমের দিকে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়ায়। আপদমস্তক চন্দনগন্ধী সাবান দিয়ে গোসল করে। কাপড় বদলে শাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে নেয়। গায়ে আতরও মাখে। বারান্দায় গিয়ে চাঁদটা নিরীক্ষণ করে;দেখে এতক্ষণে ৪-৫ডিগ্রি সরে গিয়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনার মত করে রুবেন কেবল দুটি বাক্য বলে; হে প্রভু, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। আমার মাকে নিরন্তর শান্তি দিও,স্বস্তি দিও। খানিক জ্যোৎস্না আর হালকা শাদা মেঘের ওড়াউড়ি দেখে বিছানায় এসে শোয়। ছোট্ট এই শহরে নিশুতি রাত, সকলে ঘুমে অচেতন। রুবেন চোখ বন্ধ করে ঘুমকে নিজের করে পাওয়ার চেষ্টা করে। বোধ হয় দশ-পনের-বিশ মিনিট বা আরও বেশি সময় পেরিয়ে যায়। রুবেনের ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে খুব পরিচিত একটা সুবাস আঘাত করে; বেলি ফুলের গন্ধ। কিভাবে কোত্থেকে! তার জানা মতে এ বাড়ির ১০০ গজের মধ্যে এই ফুলের কোন গাছ নেই। তবু গন্ধ তীব্রতর হতে থাকে; সেই ছোটবেলার মত। তার ছোট্ট গাল মায়ের বুক স্পর্শ করে থাকত। মা ছড়া কিংবা গান গেয়ে রুবেনকে ঘুমের তলে তলিয়ে দিত; এমন সময় কোত্থেকে একখণ্ড মিহি দখিন বাতাস এসে গন্ধটা একেবারে মগজের ভেতর নিয়ে যেত। তার পর সকালে সূর্যের আলো। আর কিছু মনে থাকত না রুবেনের। বেলি ফুলের গন্ধটা সত্যি সত্যি পাচ্ছে রুবেন। তাহলে সে এখন কোথায়। একবার চোখ মেলে তাকিয়ে ঘরের দেয়াল, বাইরের বরান্দা, নিজের পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা শরীরের দিকে তাকিয়ে রুবেন নিশ্চিত হয় এসব দৃশ্য তার ২৯ বছর বয়সের; টাটকা বর্তমানের। কিন্তু গন্ধটার উৎস কী? তাহলে কি মা…
পরের সকাল অনেক রকমই হতে পারে। হয়তো রুবেন বুঝতে পারে সে আজকাল আরও বেশি অদ্ভুত ভাবনা ভাবছে, এর পেছনে আছে তার নিরন্তর অবসর আর ভয়াবহ বিচ্ছিন্নতা। এভাবে চলতে থাকলে সিজোফ্রেনিয়াতে পেতে কতক্ষণ! একটা বিয়েশাদি করে ফেলা যায়। বিয়ে তো করলে করতে হবে একটা মেয়েকে। রুবেন যে একজন আপদমস্তক পুরুষ একথা প্রায়ই সে বিস্মৃত হয়। বিয়েরও পর চিন্তার সুতোগুলো এরকম এলোমেলো থাকলে, জট পাকালে সব মিলেয়ে ঝক্কি আরও বেড়ে যাবে। আজকাল প্রতি বৃহস্পতি বার একদল হুজুর শ্রেণির লোক আসে তার কাছে সাতপাঁচ বুঝিয়ে তাকে তাবলিগে; চিল্লায় যেতে অনুনয় করে। ব্যাপারটা খারাপ নয়, জীবন থেকে বেশ কিছুদিন পালিয়ে বেড়াবার সুযোগ। অবশ্য রুবেন এমনিইে তো জীবন-পলাতক। অদ্ভুত কোন স্বপ্নের ভেতর কিংবা কোন প্রেতের মায়াজালে বিভ্রান্ত হয়ে আগেভাগেই মায়ের কাছে চলে যাই; এই ভুলবশত এই ভাবনার তাড়নায় একগাছি রশি গলায় বেঁধে হয়তো সে ঝুলে পড়ে বৈদ্যুতিক পাখার সঙ্গে কিংবা রুবেনের পরিচিত জনেরা তার খোঁজ না পেয়ে, সাড়া না পেয়ে ঘরের দরজা ভেঙে দেখে শাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা তিরিশি যুবকের মৃত্যু বা ক্ষত চিহ্নহীন নিথর লাশ পড়ে আছে শুভ্র বিছানায়। কেউ বলে, ‘একা-একা এত বড় বাড়িতে থাকত; ভয়টয় পেয়েছিল।’ কারও নিশ্চিত মন্তব্য, ‘আসলে জ্বিনের কাণ্ড, ওরাই ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলেছে।’ এসব কথায় কেউ কেউ অবজ্ঞা করে বলে, ‘কী যে বলেন আপনারা; এই একুশ শতকে জ্বিন-ভূত! কোথায় যে আছেন সব। স্রেফ হার্ট অ্যাটাক। যে কারও যখন তখন হতে পারে। গত কালকের কাগজে দেখলেন না; ঢাকায় বত্রিশ বছরের সাংবাদিকের ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু; ওরকমই কিছু একটা হবে।’ এ মন্তব্যেরও পাল্টা উত্তর দেয় আর একজন।
কিংবা এক রহস্যময়ী নারীর আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে গল্পটি শেষ হয়। সেদিনই শেষ-বিকেলে স্বপ্নভাঙা ঘুমের ভেতর কলিং বেল শুনে উচ্চগতি হৃৎপিণ্ডে সিঁড়ি বেয়ে দরজা খুলে ষাটোর্ধ শুভ্রকেশ অর্ধেক মুখঢাকা এক নারীকে দেখে রুবেন। তার সরাসরি প্রশ্ন, ‘তোমার মা নেই বাড়ি?’
‘কে আপনি?’
‘তোমার মায়ের চেনা মানুষ। আছেন তিনি বাড়িতে? তাহলে ভেতরে আসতে দাও।’
‘আপনি কেমন চেনা; কোন খবরই তো রাখেন না, আপনার বাড়ি কোথায়? কতদিন হয়ে গেল;’
‘থাক বলতে হবে না, আমার জানা আছে তুমি কি বলবে।’
রুবেন এবার বিরক্ত হয়; ‘শুনবেন তো আমার কথা!’
‘বলেছি তো, জানি আমি। কিন্তু তুমি কি আসলেই জানো তিনি কোথায়?’
এবার রুবেন মহিলার চোখের দিকে চোখ রাখে। পোশাক, কথা বলার ভঙ্গি, দৃষ্টি, চোখের রঙ কোনোকিছুই তার চেনা নয়। চোখে চোখ রেখে তার ভয় লাগে।
‘কে আসলে আপনি বলুন তো? আমাদের কোন আত্মীয়?’
‘আমি সব জানি, শুধু তুমি কি বল তা-ই আমি জানতে এসেছিলাম। হ্যাঁ আমাকে আত্মীয় বা বন্ধু আবার অনাত্মীয় বা শত্রু দু-ই ভাবতে পারো।’ বলেই মহিলাটি দ্রুত পশ্চিম দিকে ছুটতে শুরু করে, তার পিঠে টোপলা, হাতে শাদা লাঠি।
‘আরে কোথায় চললেন?’
‘চলি, মাগরিবের সময় হল।’ তার গতি বাড়ে।
কি হল এবং হচ্ছে তা বুঝে বাস্তবে ফিরতে রুবেন দুতিন মুহূর্ত সময় নেয়। তারপর দরজা খোলা রেখে খালি পা স্যান্ডো গেঞ্জি লুঙ্গি পরা অবস্থায়ই সে মহিলাটির পেছনে ছুটতে থাকে। অথবা এসবের কোনোকিছু না করে মানুষটিকে পাগল শ্রেণীর মনে করে সশব্দে দরজা লাগিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে রুবেন আবারও খানিকক্ষণের জন্য নিজেকে বিছানায় নিয়ে ফেলে।