এক.
ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, প্লেটে প্লেটে সাজানো ভাজা ইলিশ, বেগুন ভাজি, বোঁটাসহ শুকনো মরিচ। ইলিশ-বেগুনভাজা থেকে তেল যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে।
কাচের আলমারির ভেতরে অ্যানুমিনিয়ামের বড় ডিশগুলোর একটিতে রয়েছে ইলিশের ডিমভাজা, অন্যটি রয়েছে বড় পাঙ্গাসের টুকরো, টমেটো আর ধনেপাতা দিয়ে মাখোমাখো ঝোল। আছে গলদা চিংড়ি, পাবদা। আস্ত ইলিশ ভাজা। আর আছে নানাপদের ভর্তা। মাওয়া ঘাট, পাড় ঘেঁষে থাকা হোটেলগুলো থেকে ইলিশ আর শুকনো মরিচের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে কেউ কেউ, এই ভাত খাইয়া যান মিয়া ভাই, ভাত খাইয়া যান খালা, পদ্মার ইলিশ ভাজা, ভাত খাইয়া যান আফা। ইশের ঘ্রাণ, দোকানির হাঁকডাক, ফেরি ও লঞ্চের হুঁইসেল, স্পিডবোটের শব্দ, মানুষের কোলাহল—সব মিলিয়ে এক ব্যস্ত চিত্র এই মাওয়া ঘাটের।
লঞ্চ থেকে নেমেই কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে সোজা একটা হোটেলে ঢুকে পড়ে রতন। ইলিশ ভাজা আর ইলিশের জোড়া ডিমের অর্ডার করে প্রত্যেকের জন্য। পকেটভর্তি অনেকগুলো এক হাজার টাকার নোট চক চক করছে। বিল নিয়ে ভাবে না সে। গরম ভাপ ওঠা ভাতের প্লেটে তেলসহ ইলিশের জোড়া ডিমভাজা ঢেলে নিয়ে মাখতে থাকে ও।
দুই.
মাতব্বরচর। সময় সকাল ৬ টা ১৫ মিনিট। অন্ধকার কেটে একটু একটু করে আলোর রেখা ফুটতে শুরু করেছে। শীত আসবে আসবে। এখানে ফুলগুলো সারারাত কুয়াশায় স্নান করে আরও সতেজ আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। হালকা মিহি বাতাসে বিশাল চরজুড়ে হলুদের ঢেউ দোল খেয়ে যায়। শিশির বুকে নিয়ে কাচা মরিচের সবুজ ক্ষেতে ভরা যৌবন যেন উপচে পড়ছে। রসুন পাতাগুলো আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে। পেঁয়াজ পাতার তীব্র-ঝাঁঝালো ঘ্রাণ বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। মটরশুটি ক্ষেতে গতকালের কুঁড়িগুলো একযোগে ফুটতে যাওয়ার ব্যাকুলতা। বেগুন ক্ষেতে টুনটুনি পাখির ছোট বাসার ভেতর ঘুমের আবেশ জড়ানো। মৌমাছি, প্রজাপতি, ছোট ছোট পতঙ্গ মধুর লোভে ভোর থেকে ওড়াউড়ি করছে।
চরের এককোণে বাদাম চাষ হয়েছে যেখানে, সেখানে চাষিরা আসতে শুরু করেছে। আগাছা পরিষ্কার করতে। লাল শাক আর ধনে পাতা মিলে প্রেমের স্নিগ্ধরূপ ছড়িয়ে দিয়েছে চরের বুকে। সূর্য দেবতা তার আলো ছড়ানো শুরু করতেই এ চরের ঘরগৃহস্থালিতে ব্যস্ততা বাড়তে থাকে।
মশারির কোণা তুলে রহমান শেখ ঘুমন্ত ছেলেকে একবার দেখে নেয়। মাতবরচরের শেষ বাড়িটার ঠিক দুই বাড়ির আগের বাড়িটা রহমান শেখের। একমাত্র ছেলে রতন শেখ ক্লাস নাইনে পড়ে। শতকষ্ট মেনে নিয়েও ছেলেকে কোনো কাজে দেয়নি। ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন তার। বাড়িসহ বাপদাদার আমলের দুই বিঘা জমি পেয়েছে সে। চোখের সামনে চার-চারবার ভাঙতে দেখেছে এই চর। লোকে বলে এবার চর স্থায়ী হয়েছে, আর ভাঙবে না। চাষাবাদ করেই অনেক ভালো আছে রহমান শেখ। জমাজাত্তি না থাকলেও সংসারে অভাব অনটন বলতে গেলে নেই্-ই। এই চরের জমিকে সোনা মনে হয় তার। জমিতে একদিন যেতে না পারলে তার বুকটা ভারী হয়ে ওঠে, যেমনটা হয় একমাত্র ছেলে রতনের মুখটা দেখতে না পেলে।
মাঝে মাঝে রহমান শেখ নিজেকে প্রশ্ন করে, রতন, না চাষের জমি—কোনটার জন্য মায়া বেশি? কষ্ট বেশি? এই অনুভূতির কথা কাউকেই বোঝাতে পারে না সে। একদিন শুধু বউকে ফিসফিস করে বলেছিল, বউও তার কথায় একটু হেসে সমর্থন করেছিল।
এই জমি যে রহমান শেখের হৃদয়ের কতটা জুড়ে রয়েছে, বুঝেছিল সেবার, যে বার টানা সাতদিন জ্বরে ভুগেছিল। জমিতে যেতে পারেনি, তার মনে হয়েছিল, জ্বর নয়, জমিতে না যেতে পারার কষ্টেই তার নিশ্বাস বন্ধ আসছে। গম আর সবজির চাষ করেছিল সেবার। বউ বা ছেলে কেউ তাকে জমিতে যেতে দেয়নি। সাতদিন বিছানায় শুয়ে থাকার পর ছেলেকে চুপিচুপি বলেছিল, আমারে ধইরা একটু জমিতে নিয়ে যাবি? জমিতে গেলেই আমি সুস্থ হয়ে যাব। দেখিস। রতনও মাকে না জানিয়েই বাবাকে নিয়ে গিয়েছিল মাঠে। রহমান শেখ সেদিন ভোরের প্রথম আলোয় নিজের হাতে লাগানো সবজি ক্ষেতের ফুল আর গাঢ় সবুজ পাতা দেখে আপ্লুত হয়েছিল। বাতাসে দোল খেতে খেতে গমের চারাগুলো হেসে উঠেছিল তাকে দেখে। সেই হাসি সংক্রমিত হয়েছিল রহমান শেখের মুখ বেয়ে সংসারেও। বুক ভরে নিশ্বাস নিয়েছিল সে। এই জমি যেন তার সন্তান, কখনো কখনো তারও চেয়ে বেশি!
তিন.
কলাগাছের ছায়াঘেরা বাড়ি। পুরনো টিনের। ভেতর দুই কামরা। সামনে পেছনে লম্বা বারান্দা। পেছনের বারান্দায় পর্দা দিয়ে দুই ভাগ করে একপাশে খাবারের ব্যবস্থা, অন্যপাশের নামাজের জায়গা। সামনের বারান্দায় কয়েকটি চেয়ার পাতানো। বাড়িতে কেউ এলে তাতেই বসতে দেয়। ঘরের দুই কামরার একটিতে রতন থাকে, অন্যটিতে বউ নিয়ে রহমান শেখ।
পুরনো টিনের ঘরের বেড়ায় অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকে পড়ছে। সারাঘর আলোয় ঝলমল করে তুলেছে। রতনের চোখে-মুখে সে আলোর লুটোপুটি। একলাফে জেগে ওঠে রতন। খুব দেরি করে ফেলেছে সে। মাওয়া ঘাটে ইলিশের ডিম মাখানো ভাত খাওয়া তাহলে স্বপ্ন ছিল! আবার সেই স্বপ্নটা দেখলো আজ রতন। গত দুই মাসে পাঁচ-ছয়বার দেখলো একই স্বপ্ন।
আসলে ঘটনাটা একটু ভিন্ন রকমের। হয়েছি কী, ঠিক দুই মাস আগে রতন কাউকে কিছু না জানিয়ে চেপে বসেছিলে লঞ্চে। গিয়েছিল বন্ধু ইকবালের সঙ্গেই। ইকবাল লঞ্চে সেদ্ধ ডিম বিক্রি করে। প্রতিদিন আসা-যাওয়া আছে তার। তাই ইকবালকে ইচ্ছার কথা জানাতেই সে রতনকে নিয়ে যায় মাওয়া ঘাটে। যাওয়ার পথে লঞ্চে ইকবাল সুর করে ডিম বিক্রি করে, আর রতন পানির জগ-মগ নিয়ে তার পাশেপাশে লঞ্চের এমাথা থেকে সে মাথা হেঁটে বেড়িয়েছে। ইকবালের বদৌলতে তার লঞ্চভাড়াও লাগেনি। রতন দেখে—লঞ্চে কোন খাবার না আছে? ঝালমুড়ি, চোলা, চানাচুর, পপকর্ন, সন্দেশ, সিঙ্গাড়া, পিঠা—কী নেই লঞ্চে? রতন দেখে, দেখে আর ভাবে। ইকবাল তাকে চিড়া আর নারকেল কিনে দিয়েছিল, খেতে কী সুস্বাদু! এখনো রতনের মুখে সেই স্বাদ লেগে আছে।
নেতারা বলেছেন, কান্নাকাটি, মিছিল-মিটিং,
অনশন করে কোনো লাভ নেই
সেই লঞ্চে ওষুধ বিক্রি করে এক ফেলিঅলা। ভারি মজার মানুষ। কথা বলার ঢং থেকে রতন হেসেই গড়াগড়ি খায়। ফিরতি পথেও সেই লোকটি। ঠিক আগের বারের মতোই একই কথাগুলো হুবহু আউড়ে গেলো, রতন দেখে অবাক! লঞ্চ থেকে অবাক বিস্ময়ে নদীর দুই পাড় দেখে। দেখে নদীর চর। দুই পাড়ের জনপদ। সে যত দেখে, ততই মুগ্ধ হয়। নদী যেখানে গভীর, পানি যেখানে নীল, সেই সব ভয়াল পথ পার হয়ে রতন পৌঁছে গিয়েছিল মাওয়া ঘাট। আর কী আশ্চর্য। সেখানে সারি সারি খাবারের দোকানগুলোয় বিচিত্র সব খাবার। ইলিশ মাছ, ইলিশের ডিম ভাজা। কত রকমের যে ভর্তা, তার ইয়ত্তা নেই। রতনের কাছে টাকা ছিল না বলে সেদিন সে খেতে পারেনি।
চার.
বিছানা থেকে নেমে মামার দেওয়া ট্রাংক বের করে রতন। বাবার পুরনো লুঙ্গি দিয়ে ট্রাংকটিকে সে ঢেকে রাখে সবসময়। মা কোমরে যে সুতা বেঁধে দিয়েছিল, সেই তাগার সঙ্গে ঝুলছে দুটি চাবি। একটি ট্রাংকের, অন্যটি টেবিলের ড্রয়ারের। কোমর থেকে চাবি না খুলে, একটু সামনে ঝুঁকে ট্রাংক খোলে রতন। ভেতর থেকে একটি সাবানের প্যাকেট বের করে নেয়। এটি তার টাকা জমানোর ব্যাংক। এই ব্যাংকে ৬০ টাকা জমা হয়েছে। টাকাগুলো গুছিয়ে সাবানের প্যাকেটে রেখে ট্রাংকে তালা মারে। এখনো অনেক টাকা জমাতে হবে। ইকবালকেও নিজের টাকায় খাওয়াতে চায়।
পাঁচ.
রতনদের বাড়ি থেকে সোজা পূর্বদিকে ১০ মিনিট হেঁটে গেলেই পদ্মা। পশ্চিমে স্কুল, বাজার। পড়া শেষ করে সময় পেলেই রতন চলে যায় পদ্মার পাড়ে। কখনো বন্ধুদের সঙ্গে কখনো বা একা একা। পদ্মার পাড়ে বসে থাকতে খুব ভালো লাগে তার।
পাড় ঘেঁষে অনেকটা জায়গা ফাঁকা। কাশবনের ঝোপ হয়েছে কোথাও কোথাও। স্বচ্ছ পানির নিচে সাদা বালি চিক চিক করে। কাঁঠালবাড়ি থেকে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চ, ফেরি, স্পিডবোটগুলো নাক উঁচু করে হহুসেল বাজিয়ে চলে যায়।। আবার মাওয়া ঘাট থকে ফিরে আসে কাঁঠালবাড়ি।
পড়ন্ত বিকেলে পদ্মার রূপ যেন উপচে পড়ে। নদীর পাড়ে পা ঝুলিয়ে বসে সে। পদ্মার সৌন্দর্য, পদ্মাপাড়ের মানুষের ব্যস্ততা দেখে। গোধূলি নেমে এলে মায়াবি আলো ছড়াতে ছড়াতে সূর্যটা ডু্বে যাবে যাবে করছে। পশ্চিমের চরগুলোয় সন্ধ্যা নামার আয়োজন চলে। অতিথি পাখির ডানায় ডানায় রক্তিম আভা লেগে আছে। পদ্মার জল কেটে ভেসে চলছে ওরা ছন্দে ছন্দে। শীতের দেশ থেকে এসেছে এই পদ্মার বুকে। শীত কমলেই আবার নিজের দেশে ফিরে যাবে পাখিগুলো।
ছয়.
চারদিকে সূর্যের শেষ আলোটুকুর লুকোচুরি চলছে। জেলেদের ডিঙিগুলো কেরোসিনের বাতি জ্বেলে ভাসছে পদ্মার বুকে। মৃদু বাতাসে দুলছে মাতবরচরের শস্যক্ষেত। মোহনীয় সে দৃশ্য। প্রাণভরে দেখে নেয় রতন। সেলিম এসে ডাক দেয়—চল্ বাড়ি যাই। রতন উঠে দাঁড়ায়, বাড়ি ফিরবে। ঠিক এমন সময় করুণ সুরে বেজে ওঠে লঞ্চের হুইসেল। কী এক অজানা যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়ে রতন।
এদিকে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়ে গেছে। কাঁঠালবাড়ি টু মাওয়া সেতু। সেলিম ও তারেক এই নিয়েই আলোচনা শুরু করে। কত মেশিন এসেছে। কত কত লোক কাজ করছে। সে কাজ দেখতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে প্রতিদিন।
পদ্মা সেতু হলে ঢাকা কত কম সময়ে যাওয়া সম্ভব, কতগুলো ফ্লাইওভার হবে, মাতবরচরে গ্যাসলাইন বসবে, চারদিকের এসব উন্নয়নকর্মকাণ্ডে গল্প করে তারেক আর সেলিম। তবে এসব আলোচনায় রতনের কোনো আগ্রহ নেই, বিষয়টা তেমন নয়। আসলে রতনের আজ মন ভালো নেই। সে ভাবে এই লঞ্চ-ফেরি-স্পিডবোট—সব একদিন হারিয়ে যাবে? কোথায় যাবে এসব?
এই কাঠালবাড়ি-মাওয়া ঘাটের সঙ্গে জড়িত পেশাজীবীরা হয়তো খুঁজে নেবে অন্য কোনো পেশা। কালের বিবর্তনে মানুষ ভুলেই যাবে কাওড়াকান্দি-কাঠালবাড়ি-মাওয়াঘাটের এই কাহিনী।
সাত.
সরবার তেত্রিশ হাজার বিঘা জমি নেবে মাতবরচর-কাঠালবাড়ি আর চরচান্দ্রা থেকে। ভবিষ্যতে এয়ারপোর্ট হবে এখানে। সরকারের নকশা প্রস্তুত। পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়েছে অনেক। রাস্তা চওড়া করতে যাদের চাষের জমি চলে যাচ্ছে, সরকার তাদের জমির দামের দ্বিগুণ টাকা দিচ্ছে। করছে পুনর্বাসের ব্যবস্থাও। লাখ লাখ লোক কাজ পেয়েছে। হাসি ফুটেছে স্থানীয় পরিবারগুলোর।
দেশের উন্নয়নের জন্য অনেকের বাপ-দাদার ভিট চলে গেছে—এই গল্প বারবার শুনেছে রহমান শেখ। আজ সেই একই গল্পের কোনো চরিত্রের দাঁড়াতে হবে, এমন কথা স্বপ্নেও ভাবেনি সে।
জটলাটা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। মাতবরচরের মাঝামাঝি যে তেঁতুল গাছ রয়েছে, তাকে ঘিরেই জটলা। নকশা পৌঁছে গেছে এ চরের মানুষগুলোর কাছে। যেসব মানুষের জমি স্থান পেয়েছে এই মূল্যবান নকশায়, তাদের আহাজারিতে আঁতকে উঠেছে এই চরের পাখাপাখালিপর্যন্ত। রহমান শেখের বাপ-দাদার সেই দুই বিঘা জমিও যে সরকারের প্রয়োজন হবে, সে কথা শুনে রহমান শেখ বাক্যহারা। বসে পড়ে মাটিতে। নিজেকে এতটা অসহায় আর কখনোই মনে হয়নি তার। মাতবরচরের মূল্য আজ সবাই জেনেছে। ঢাকা থেকে স্যুট-টাই-সানগ্লাস পরা লোকজনের সঙ্গে এসেছে ধবধবে ফর্সা বিদেশিরাও। তাদের সঙ্গে আছে স্থানীয় নেতা, নেতার চ্যালারা।
কার কাছে গেলে তার দুই বিঘা জমি সরকার ছেড়ে দেবে—বুঝতে পারে না রহমান শেখ। এই চরে তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, সংসার। এই চর ছেড়ে বউ-ছেলে নিয়ে কোথায় দাঁড়াবে সে?
নেতারা বলেছেন, কান্নাকাটি, মিছিল-মিটিং, অনশন করে কোনো লাভ নেই। দেশের উন্নয়নের জন্য এটুকু ত্যাগ করতেই হবে। এছাড়া দ্বিগুণ দাম পাচ্ছে জমির। এমন কথাতেই জোর দিচ্ছে কেন সবাই, তা কোনোভাবেই মাথায় ঢোকে না রহমান শেখের। এই জমিটুকু তো সে কোনো কিছুর বিনিময়ে ছাড়তে রাজি নয়। রহমান শেখ ভাবে, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! এই চরের সবচেয়ে বেশি জমি হায়দার শিকদারের। অথচ নকশায় তার জমিকে রাখা হয়নি। শুধু হায়দার শিকদারের জমি রক্ষার জন্য নকশায় কত কত পরিবর্তন করা হয়েছে। গরিব সাধারণ মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে হলেও উন্নয়ন হোক, দেশের—বুকের তলা থেকে বেরিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস।
আট.
শুক্রবার সকাল হতে না হতেই মাতবরচরের বাতাস ভারী হতে থাকে। একে একে স্থানীয়রা চর ছেড়ে চলে যাচ্ছে, দূরে কোথাও। রতন বুঝতে পারছে না ঘটনাটা কী ঘটছে! এমন দুর্যোগের জন্য কোনো প্রস্তুতিই ছিল না তার। এই চরের প্রতিটি ধূলিকণা, গাছ ভালোবাসে রতন। হঠাৎ করেই এই পরিস্থিতি যেন রতনকে বড় করে দিয়েছে। সেদিনের পর থেকে রহমান শেখের শরীর ভাঙতে থাকে। মুখে কথা নেই। রতন বাপের সামনে কোনো দুঃখের কথা বলে না। বরং সান্ত্বনা দেয়। বাপকে বোঝায়, শহরে গিয়ে থাকতে পারবে তারা। ভালো স্কুলে পড়তে পারবে সে। তবু রহমান শেখের মুখে কথা নেই। তার মনে ক্ষোভ—সরকার জমি নিয়ে যে দ্বিগুণ দাম দিয়েছে, তার পুরোটা তারা পায়নি। নেতা-পাতিনেতা-আমলার হাত ঘুর ঘুরে তাদের হাতে এসে পৌঁছেছে সামান্যই।
নয়.
আজ রতনরা চলে যাচ্ছে মাতবরচর ছেড়ে। বাবাকে ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে। মা লুকিয়ে কাঁদছে। জমির পাওনা বাবদ সব টাকা আজ রতনের পকেটে। তারা এসে পৌঁছায় মাওয়াঘাটে, যেখানে সারি সারি খাবার দোকান। দোকানগুলোয় সেই স্বপ্নের ইলিশ, ইলিশের ডিম ভাজা। স্বপ্নে দেখা সেই সব মাছ-ডিম-বেগুন ভাজির ঘ্রাণ আজ বাস্তবেই এসে নাসারন্ধ্র ছেদ করে রতনের পেটে্ ও মগজে হানা দিচ্ছে দুর্ধর্ষ ডাকাতের মতো। কিন্তু একদিন যে সব স্বপ্নের খাবার মুখে তুলতে পারেনি টাকার অভাবে, আজ কাড়ি কাড়ি টাকা পকেটে থাকার পরও সে সব খাবার রতনের মনে কোনো আগ্রহ জাগাতে পারেনি। এসব খাবার নয়, রতনের মন ছোটে অন্য কোনো খানে, অন্য কোনো চিন্তায়।