জীবন কিছুটা প্রতিভাবান, একে কিছুটা মহৎ করা সম্ভব। অবশ্য মৃত্যুই প্রতিভাবান আর মহৎ। কিন্তু প্রাণটা কী? প্রাণটা অর্জিত কিছু? না। একরকম মাগনায় পাওয়া গেছে প্রাণটা আর শরীরটা। এই মাগনা পাওয়া প্রাণ আর শরীর নিয়েই কিছুটা নদীর জল, গাছের ফল খেয়ে নেওয়া গেলো আর এই পৃথিবীর ভূমিতেই পায়খানা করা গেলো, পেশাব করা গেলো। আর জীবনের বেশিরভাগটাই তো দারুণ ব্যথা অন্ধকারের কারাগার। তো মরতে সমস্যা কী? তারপরও, মাগনায় পাওয়া এই শরীর আর প্রাণ নিয়ে মানুষেরা কত কী-ই না করে বেড়াচ্ছে। আর মরতে চায় না কেউ, মরতে চাচ্ছে না কেউ। আরে বোকা, মৃত্যু কি তোর মতো অজ্ঞ, গণ্ডমুর্খ। কিছু বোঝে না? নিশ্চয়ই মৃত্যু এক মহান প্রতিভাবান আর বিবেচক। আর প্রাণ মাগনা পাওয়া গেলেও, জীবন মাগনা পাওয়া যায় না। জীবন গঠন করতে হয়। মৃত্যু কখনো কখনো দুর্ঘটনা ঘটায়, ভুল করে, প্রতিভাবান হওয়া স্বত্ত্বেও।
প্রাণ, জীবন, মৃত্যু নিয়ে শুভম বিভিন্ন সময় যেসব কথা বলত তার সারাংশ অনেকটা এমন। হ্যাঁ, মৃত্যু গতকাল পৃথিবীর, আমাদের এদিকটাতে, একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দিলো, না ভুল করলো, না তার প্রতিভারই স্বাক্ষর রাখলো তা আমরা বুঝতে পারলাম না।
শুভমের বাবার টাকার অভাব নেই। টাকা তাদের প্রচুর। শুভমের বাবা মারা গেলে রাজত্ব শুভমের। ছোট শহরে ওদের বাস। আমাদের বন্ধুত্ব স্কুল থেকে। তারপর তার ঢাকায় পড়তে যাওয়া ফটো আর ফটোগ্রাফের ওপর। বড়লোকের ছেলে না হলে এই পড়া কেউ পড়বে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। শুভম এই পড়া পড়তে না গেলে আমরা জানতেই পারতাম না, ছবি তোলার জন্য পড়ালেখা করা লাগে। আমরা কলেজেই সমস্ত পড়া শেষ করেছি। শুভম ঢাকায় পড়া শেষ করে ফিরে আসে বাড়িতে।
শুভম সারাদিন স্টিল ক্যামেরা আর ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে মেতে থাকে। যেন পৃথিবীর প্রতিটি পরিবর্তনের ছবিই সে ধরে রাখবে। আমরা সকাল হলে অফিসের দিকে রওনা দেই আর ও ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়ে। আমাদের অফিস মানে ৯টা ৫টা নয়। এ অফিস এনজিও অফিস, চলে প্রায় ৫টা ৯টা। ভোর ৫টা থেকে অফিস শুরু হয়ে যেতো বাসা থেকেই।
মেয়েটা একটা চিপস মুখে তুলে দিতে যাচ্ছে এমন সময় ভিডিওটা শেষ হয়ে গেলে আমরা খুব আপসোস করতে থাকি, আবার প্রথম থেকে ঘুরিয়ে দেখি।
শুভম, প্রজাপতি, বেড়াল, মুখ বাঁকা মানুষ, গম্ভীর মানুষ, খ্যাদা মানুষ, গরু, সুন্দর মানুষ, ছাগল, গরুর গাড়ি আর তার চাকা এসবের ছবি তোলে বিভিন্ন ক্ষণে, বিভিন্ন কোণে। আমরা পরে এসব দেখতাম আর চা খেতাম।
আর একটা বিচিত্র কাজ তার, ভিডিও করা। মাঝে মাঝেই সে তার ভিডিও ক্যামেরাটা তাদের বাড়ির ছাদে এমনভাবে বসিয়ে রাখে, যেন রাস্তা আর মোড়ের সবকিছু ধরা পড়ে ভালো মতো। এই মোড়টা শুধু না, কখনো কখনো সে ভিডিওক্যামেরা নিয়ে গ্রামে গিয়েও এক জায়গায় স্থির রাখে। যা যা ভিডিও হয় আমরা পরে কম্পিউটারে দেখি।
একদিন মোড়ের একটা ভিডিও দেখছিলাম। একটা মানুষ বিশাল হাই তুলে চলে গেলো। হাই তোলার সময় তার চোখ মুখ কোঁচকানোর ভঙ্গি দেখে হাসি থামানো যায় না। তারপরই দেখা গেলো, একটা মানুষ কলার খোসায় পিছলে ঢাকনাহীন ম্যানহোলের ভেতর তলিয়ে গেলো, একটু পরে উঠে এলো মাথায় কলার খোসা, গায়ে মাছের আঁশ আর কাদা জল মেখে। এসব দেখি আর হাসি।
কুকুর আর কুকুরনির সঙ্গম দেখি মনোযোগ দিয়ে। কিন্তু কোনো দৃশ্যই বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না কারণ মানুষগুলো, যানগুলো, কুকুরগুলো চলমান। একটা বাসস্টপও আছে। বাসে মানুষ উঠছে, নামছে। বাক্স-পেটরা বা ব্যাগ নিয়ে টানাটানি আর বাস চলে গেলে নতুন যাত্রী যারা আসে, তাদের আবার বাসের জন্য অপেক্ষা করা। মানুষ আলাদা আলাদা কিন্তু কোনো বৈচিত্র্য নেই।
তবে কয়েক সপ্তাহ আগে বাসের একটা চমৎকার ভিডিওচিত্র দেখা গেছিল, দু’দিক থেকে দুটা বাস এসে গতি ধীর করলো ছোট একটা জ্যামের কারণে। একটা বাসে একটা যাত্রী সিগারেট খাচ্ছিল আর তার হাতটা বাইরেই ছিল অন্য বাসের যাত্রী যেন ওঁত পেতে ছিল। যেমনই কয়েক সেকেন্ডের জ্যাম ছুটে গেছে, ড্রাইভাররা গাড়ি চালাতে শুরু করেছে অন্যবাসের যাত্রীটা সিগারেট ধরা যাত্রীর হাত থেকে সিগারেটটা দ্রুত টেনে নিয়ে নিজে টানতে লাগলো। বাস দুটি দু’দিকে চললো। সিগারেট খোয়ানো যাত্রী বোকার মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। বাস চলছে। সিগারেট হরণকারী যাত্রী শুধু একবার মাথা বের করে একটু হাসি ছেড়ে দিলো ওই যাত্রীর দিকে। ভিডিওটি দেখতে দেখতে আমাদের হাসি আর থামে না।
আর একটা চমৎকার ভিডিওর কথা মনে আছে, বাসস্টপে একটা সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকজন তাকিয়ে আছে তার দিকে। কেউ তাকিয়ে টিজ করে চলে যাচ্ছে, কেউ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে আর মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকছে। মেয়েটা যদি বায়ূপরাগী বা বাকপরাগী বা দৃষ্টিপরাগী হতো, তবে আজ এখানে অবশ্যই সে গর্ভবতী হয়েই ফিরে যেতো। উড়ন্ত চুমু কেউ কেউ ছুড়ে দিচ্ছে। সত্যি এমন সুন্দরী মেয়ে এই ভাঙাচোরা ছোট্ট শহরে জন্মের প্রথম সম্ভবত।
‘মেয়েটা নায়িকা বা নায়িকাদের মতো’, আমি বললাম। সাজেমান বললো, ‘রূপকথায় পরির কথা পড়েছি আর শুনেছি কিন্তু তাদের রূপ এই মেয়েটির কাছে একেবারে খেলো।’ মেয়েটির কোনোদিকে খেয়ালই নেই। চিপসের প্যাকেট থেকে চিপস বের করে এক মনে খাচ্ছে। কোনো ভিখারিও তার কাছে ভিক্ষা নিতে যাচ্ছে না, তার সৌন্দর্য আর আভিজাত্যের জৌলুসের আভায় দগ্ধ হয়ে, সংকোচে তাকিয়ে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে।
একটা ভিখারি বেপরোয়ার মতো তার কাছে যায় এবং ভিক্ষা চায়। খুব সুন্দরভাবে মেয়েটি একটা পয়সা বের করে তার ছোট ব্যাগ থেকে এবং ভিখারির হাতে দেয়। ভিখারি কৌশলে অথবা অজান্তেই হাতের স্পর্শ লাভ করে সুন্দরীর। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকদের মধ্যে ভিখারি হওয়ার সাধ জাগে এবং তাদের চোখে-চেহারায় ভিখারির প্রতি ইর্ষা দেখা যায়। মেয়েটা একটা চিপস মুখে তুলে দিতে যাচ্ছে এমন সময় ভিডিওটা শেষ হয়ে গেলে আমরা খুব আপসোস করতে থাকি, আবার প্রথম থেকে ঘুরিয়ে দেখি। কী হলো, কোথায় গেলো মেয়েটি, কিছুই বোঝা গেলো না।
যেদিন মৃত্যু কর্তক দুর্ঘটনা বা ভুল বা প্রতিভাপূর্ণ স্বাক্ষর রচিত হয়, সেদিন আমার অফিস ছুটি হয়েছে একটু তাড়াতাড়ি। অফিস করতে যেমন ভালো লাগে না, তেমন অপ্রত্যাশিত ছুটি দিয়ে কী করবো, সেটাও বুঝতে না পেরে খারাপ লাগে। মনে হয়, অফিস হওয়াটাই ভালো ছিল। যাই হোক, শুভমের ওখানেই যাওয়া গেলো।
কিন্তু ব্যাপারটা এত দ্রুত আর অস্পষ্ট যে, আমরা বার বার ভিডিওটি চালিয়েও বুঝতে ব্যর্থ হলাম, কারটির নিচে শুভম চাপা পড়লো সে কারের ড্রাইভারটি কে? আমরা বুঝতে ব্যর্থ হলাম, ড্রাইভারটি নারী না পুরুষ?
শুভম তার ভিডিও ক্যামেরা ছাদে চালু করে বসিয়ে নিচে নেমে আসে আর আমরা কম্পিউটার ছেড়ে অন্যদিনের তোলা ভিডিও চিত্রগুলো দেখতে ব্যস্ত। চা খাওয়া শেষে সিগারেটা খেতে ইচ্ছে করবেই। শুভম তার ধাতব প্যাকেট পরীক্ষা করে দেখলো। কোনো সিগারেট নেই। আমি বললাম, নিয়ে আসছি একদৌড়ে মোড় থেকে। শুভম বললো, থাক, আমি যাচ্ছি। দ্রুত সে বের হয় কিন্তু দ্রুত ফিরে আসে না। তার বিনিময়ে কয়েক মিনিট পরে, একটা চিৎকার চেঁচামেচি ফিরে আসে। চিৎকার, চেঁচামেচি শুনে বাইরে গেলে তার চ্যাপ্টা মাথা রাস্তার সঙ্গে মিশে থাকতে দেখে আঁতকে উঠি আর কারটা পালিয়ে যায়। কালো পিচের রাস্তায় টায়ারে লেগে থাকা রক্তের ছাপ কিছু দূর পর পর দেখা গেলো। কারটা সম্ভবত শুভমের রক্ত সারা দেশে ছড়িয়ে দেবে। হঠাৎ আমার খেয়াল যায় ছাদের ওপর ক্যামেরাটার ওপর আর মনে ভাবনা আসে, পৃথিবীর কোনো মানুষ কি তার নিজের মৃত্যুর ভিডিও করেছে কখনো?
সুরতহাল, পোস্টমর্টেম, থানা পুলিশ করতে একদিন পার হয়ে গেলো। পরদিন জানাজা।
গোরস্থানে জানাজা শেষে সবাই বের হয়ে আসার সময়, ভিডিওতে দেখা সেই মেয়েটিকে ফুল হাতে হেঁটে আসতে দেখা গেলো। সে মেয়ে ফেরেশতার মতো হেঁটে আসছে। সব মানুষ বিস্ময়ে নিষ্কাম চোখে মেয়ে ফেরেশতার দিকে তাকিয়ে আছে। সাদা টুপির মানুষ, কালো টুপির মানুষ, লাল টুপির মানুষ, সব মানুষ। বৃদ্ধ, যুবক, কিশোর, শিশু সবাই তাকিয়ে আছে মেয়ে ফেরেশতার দিকে। সে শুভমের কবরে ফুল রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকজন বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়েই আছে। এর মধ্যেই সে কবরস্থান থেকে বেরিয়ে পথ ধরে। লোকজন শুধু তার দিকে তাকিয়েই থাকে। কেউ কিছু বলে না। যখন মেয়েটি রাস্তার দূরত্বে মিলিয়ে গেলো, তখন সবাই একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, মেয়েটা কে গো?
কয়েকদিন পর, আমি শুভমের মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে যায়। তার সঙ্গে কথা বলার পর শুভমের ঘরে গিয়ে বসি। আমার সঙ্গে সাজেমানও আছে। আমরা তার কম্পিউটার অন করি তার মৃত্যুর ভিডিওটি দেখার জন্য। আমরা দেখি একটা সাদা কার দাঁড়িয়ে আছে। শুভম রাস্তা পার হলো। সিগারেটের দোকানের সামানে দাঁড়ালো। কারটি স্টার্ট হলো। শুভম সিগারেট নিলো আর ঘুরে দাঁড়ালো। কারটি ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো। কারটি খুব ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। কারের এগুনোর ধরনটি অনেকটা সেই টিকটিকির মতো, যে তেলাপোকা ধরার জন্য ধীরে ধীরে এগোয়। শুভম এদিক-ওদিক দেখে রাস্তায় নামামাত্রই হঠাৎ করে কারটা ষাঁড়ের মতো গোঁয়ার আর স্পিডি হয়ে যায়। কিন্তু ব্যাপারটা এত দ্রুত আর অস্পষ্ট যে, আমরা বার বার ভিডিওটি চালিয়েও বুঝতে ব্যর্থ হলাম, কারটির নিচে শুভম চাপা পড়লো সে কারের ড্রাইভারটি কে? আমরা বুঝতে ব্যর্থ হলাম, ড্রাইভারটি নারী না পুরুষ?