আবেদ! পুরো নাম আবেদ আলি তরফদার। বাবার নাম সফর আলি তরফদার। আর এই সফর আলি তরফদারের প্রথম পুত্র আবেদ আলি তরফদার যে আমার স্বামী, এই কথাটি যতক্ষণ ভুলে থাকতে পারি, ততক্ষণই আমার স্বস্তি। যদিও তার সঙ্গে এক বিছানায় শোয়া থেকে পাশাপাশি চেয়ারে বসে একই সময় এক টেবিলে হাসি মুখ করে খাওয়া হয়ই। দলবেঁধে অথবা একা আমাকে ওর সঙ্গে বেড়াতেও যেতে হয় আত্মীয়স্বজনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। তবু স্বতঃস্ফূর্তহীন এসব বিষয় নিয়ে আবেদের সঙ্গে কোনো বিরোধে আমি মাথাচাড়া দিয়ে উঠি না। এটাও যে তার প্রতি আমার একরকম খেলা, ঠিক তা নয়। মোটকথা পরিবারের ভেতর অবস্থানটা আমার ও রকম পর্যায়ের নয়, যেখানে মা-বাবা মেয়ের সব আদিখ্যেতা মেনে নেবে। এখানে মেয়ের অবস্থানটি না ফেলতে পারার, না গিলতে। বিয়ে দিতে বড় ঘর যদি মেয়ের কপালে না জোটে, তাই ছোট ঘরকে টেনে বড় করতে হয়। নিজেদের পরিচয় সমঝে ঠেকাতে।
আমার বাবা গ্রামে তার পৈতৃক জিরাতির প্রায় পুরোটাই বিসর্জন দিয়ে মফস্বলের এই বাড়িটি করেছেন। পুকুরসমেত পোড়োভিটে দাদা সস্তায় পেয়েছিলেন তাই তার সন্তানদের জন্য কিনে ফেলে রাখা। জমিদারি নকশা ফোটাতে হলেও ভেতরে সংসার চালাতে মা হিমসিম খায়। পুরনো কাপড় আছড়ে কেঁচে ধোয়ার মতো দশা তার। ছ’টি ছেলেমেয়ের সব খরচের ধকল, তার ওপর তুলে এনেছেন ওই আর একজন। জ্ঞাতির ছেলে জামাই করে। যেন বড়লোকের হাতি পোষার মতো মধ্যবিত্তের শখ এটি। অবশ্য বাপের টাকায় লেখাপড়া করা সফল, সরকারি কর্মকর্তার চেয়ে সম্ভাবনাময় ছাত্র পুষে জামাই করে নেওয়াটা কম ধকলের খরচে হয়ে যায়।
বাবা-চাচাদের এমন হিসাব আমার নিজের কানে শোনা। ছোট চাচা অবশ্য বিয়ের জন্য অমন সব হিসাব না কষে, আমার লেখাপড়াটা ভালো করে চালিয়ে, এ বিয়ের বাধা দেওয়ার ক্ষীণ একটা প্রয়াস চালিয়ে ছিলেন। বলেছিলেন, বিষয়টি স্থূল চোখে ধরা পড়বে না। কিন্তু মেয়ের কাছে এটা অরুচিকর হবে। আমাদের কাউকে সে ক্ষমা করতে পারবে না। খটকাটি তার সারাজীবন আমাদের সঙ্গে অমীমাংসিতই থেকে যাবে।
কিন্তু ছোট চাচা ভালোবেসে একা চাচিকে বিয়ে করে হঠাৎ এনে বাড়ি তোলায়, পরিবারের মধ্যে পরামর্শদাতাদের পঙ্ক্তিতে তিনি অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েছেন। নাহলে সব ভাইবোনের ছোট হলেও ছোট চাচার মতের জন্য আগে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত পড়ে থাকতে দেখেছি। বরং সবার বড় হওয়া সত্ত্বেও একমাত্র ফুফুর মত-অমতের ধার কেউ ধারে না।
ছোট চাচির সঙ্গে বড়রা কেউ ভালো করে কথা পর্যন্ত বলে না। চাচি যখন বাড়ি আসে, এত এত জিনিসপত্র আমাদের জন্য বয়ে আনে, যা আমরা আগে কখনো দেখিনি। চাচি সবার রুচি পাল্টে দিয়েছে। আর এই সবই চাচির টাকায় কেনা। কারণ চাচি তার পৈত্রিক বাড়ির যে অংশ ভাগে পেয়েছে, তার ভাড়া কম কিছু নয়। চাচির আনা জিনিসগুলো সবাই হাত প্রসারিত করে নেয়। তবু এদের কাছে বিয়ের আগে ভালোবাসা শব্দের অর্থ, রঙঢঙ। তেমন একটা মেয়ে যাকে আত্মস্থ করে ফেলে তার পৌরুষ নিয়ে আমাদের মতো হীনধনে পোদ্দারি করা পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের সংশয় দেখা দিতেই পারে।
‘স্ত্রীকে যে চোটপাটে রাখতে পারে না, সেও আবার পুরুষ?’ সবার মুখের ওপর এ মন্তব্য আমার আরেক পিতৃব্যের। এ ধারণায় বাবাও কম যান না বোঝাই যায়। সেদিন চাচিকে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার অবস্থা থেকে তিনি কিছুটা অন্তত রক্ষা করতে পারতেন অনুজকে একটা মাঝামাঝি ধমক দিয়ে। তিনি তা না করে নিজের বড়কর্তা অবস্থানটি কঠোর মনোভাবে আরও সুদৃঢ় করে নিয়েছেন স্ত্রীমহলে। বছর পাঁচেক আগে থেকে শুরু হয়েছিল আমার আর আবেদের বিয়ের আলোচনা।
তখন আমাদের এই বাড়িটি ছিল না। অনেকদিন ধরে ঝিমিয়ে কাজ করে এই মাস ছ’য়েক আগেমাত্র এটা বসবাসের উপযোগী হয়েছে। গ্রামে আমাদের নিজস্ব চকচকে বিশাল দু’খানা ঘর ছাড়াও দুই চাচার আরও চারখানা ঘর সংবলিত বিরাট এলাকার বাড়ি। বাড়িটি পেরিয়ে আরও দু-চারটি বাড়ির আড়ালে ঢাকাপড়া আবেদদের বাড়ি। শনের ঘর, তাও মাত্র একখানা। পাশে একচালা রান্নাঘর। ডোবার মতো এতটুকু পুকুর। আবেদের বাবা নিজহাতে হালচাষ করে। তাতেও সারাবছর ঘরের ভাত জোটে না। কিন্তু চারটি ভাই সবাই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠাতে ওদের প্রতি সবার সমীহভাব জাগতে শুরু করেছে। তার ওপর আবার স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছেলে। সবই মেধাবী। অনেক মেয়ের বিত্তশালী পিতার চোখ এখন কোরবানির গরুর মতো ওদের ক’ভাইয়ের দিকে। মেয়ে নেই বলে আবেদের মার সে কি দেমাক। মেয়ে মানেই বংশের মাথা নুয়ে যাওয়ার ধকল। পুরো পরিবারটির ওপর আমার ঘৃণার উৎসে ওদের ওরকম মনোভাবটুকুও সম্পৃক্ত।
আমার এসএসসি পরীক্ষার আগে থেকে গুঞ্জন শুরু হয়েছে আবেদের সঙ্গে আমার বিয়ের। তাও আমাদের তরফ থেকে দেওয়া প্রস্তাব। ওরা প্রথমেই মনস্থির করে উঠতে পারেনি। আমি তেতে উঠি। ওদের হাঘরে নির্বোধ, দাম্ভিক মুখগুলো একে একে মনে পড়ে ঘরের তৈজসপত্র আছড়ে ভাঙি। মা মনে করে, বিয়ের কথা শুনলে সবাই প্রথমটা এমনই করে। পরে স্বামীর সোহাগ পেলে সব ঠিক হয়ে যায়। আমার বাবা সেধে আবেদের লেখাপড়ার খরচ জোগান দিতে থাকেন। যেন বড়শিতে টোপ গেঁথে রাখা। সময়মতো টান দেবেন। এদিকে আমার ছোট ভাই দু’টির দরকারি জিনিসপত্র কেনার কথা উঠলে খিঁচিয়ে ওঠেন, অর্থ অপচয়ের অপবাদ দিয়ে। ওদিকে আবার আমাদের সেই বাবা-ই কাছা দিয়ে ঘুরে বেড়ানো আবেদের বাবাকে ডেকে এনে এমনভাবে টাকার থোক ধরিয়ে দেন, যেন ঘরের ভেতরেই টাকার গাছ। উপচে পড়ছে তাই দিচ্ছি।
মাঝারি শরীরটা প্রায় অকালে নুয়ে পড়া, চৈত্রফাটা মাঠের মতো মুখাবয়বে তীর্যক ভাঁজ। ড্যাবড্যাবে চোখের নিস্প্রভ পাতা গুটিয়ে ফেলেছে দৃষ্টির সমূহ তেজ। তবু সরল অভিব্যক্তিতে চাতুর্যের টানা ভানে, বাড়ি থেকে নেমে সোজা পথে না গিয়ে, এর-ওর উঠোন বেয়ে চলে যেতে যেতে আবেদের বাবার সে কি ডাঁট! উজ্জীবিত স্বাদে টাকাটা সে হাত খুলেই বাড়ি নেয়। ভিক্ষে বা সাহায্য নয়, ছেলের দর! ডিগ্রি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত আবেদ আমার বাবার টাকায় ঢাকা থেকে লেখাপড়া করেছে। এখন চাকরি জুটিয়ে দেওয়াটাও আমার বাবার আগ-বাড়ানো চুক্তির আওতায় বরাদ্দ। যেন বাবার কোনো মন্ত্রী-মিনিস্টার আত্মীয় আছে। অথবা ঘুষের জন্য মোটা থোক টাকা মাটিতে আমার বাপের বাপ পুঁতে রেখে গেছেন। বাড়ির জমির মতো।
আবেদের সঙ্গে বিয়েটা অবশ্য ছ’মাস আগে রেজিস্ট্রি হয়েছে। তখনো সে ছাত্র ছিল। আমি ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছি। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় গ্রাম থেকে বাসে চড়ে কলেজে আসতাম। কয়েকজন মেয়ে একত্র হওয়ায় আসা-যাওয়াটা নির্বিঘ্ন হয়েছিল। এরইমধ্যে বউ হিসেবে আবেদদের বাড়ি যাওয়ার আগেই আমার বাবা ওদের ভিটেয় নতুন টিনের ঘর, টিউবওয়েল, পাকা বাথরুম করে দিলেন। এগুলো ওদের দাবিদাওয়ার বাইরের। আবেদের বাবার একটাই মিনতি, ছেলের জন্য একটা চাকরি। মফস্বল শহরের কন্ট্রাক্টর আমার বাবার কতজনের সঙ্গে যোগাযোগ। তাই চাকরি আমার বাবা দিতে পারবেন বলেই আবেদের একদর্শী বাবার দৃঢ় বিশ্বাস। এই বিশ্বাস ভেঙেচুরে তিনি বেরোবেন সে ফাঁকই-বা তার সামনে কোথায়? টেলিভিশনের বিজ্ঞাপিত লুঙ্গি, চকচকে শাড়ি। আবেদের তিন ভাইদের জন্য প্রায়ই শার্ট-প্যান্টের পিস, হাটবারে বড় মাছের সঙ্গে নতুন তরকারি। কখনো গরুর আস্ত মুণ্ডুটা কিনে উপঢৌকন হিসেবে পাঠিয়ে দিতেন। তাও চোখে পড়ার মতো জোয়ানমর্দ ভৃত্যে’র মারফত পাঠাতেন। নিজেদের জন্য কেনা দশ কেজি গোসতের খবর পাড়ার কেউ জানলো না।
অথচ সস্তায় কেনা গড়ানো রক্তের গো-মুণ্ডুর সঙ্গে মানুষের চোখ উদগ্র হয়ে উঠতো পথের ভেতরেই। কুড়াল-চাপাতিতে ক’বাপ-বেটা মিলে টানাহেঁচড়ায় সেই মাথা কাটতে গিয়ে পুরো গাঁয়ের মানুষকে নিজেদের তাঁবেদার মনে করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো। কুড়ানো লতাপাতার সব পুড়িয়েও গোসত আধসেদ্ধ হওয়ার আগেই, ঘ্রাণে দু-চারজন করে নব সুহৃদের উৎপত্তি হতে হতে ঘটনার অন্তরালের ঘটনায় গ্রাম-গ্রামান্তর সয়লাব হয়ে যেত। ওই দুচারজনকে তামদারি করেই নতুন পানির মতো নতুন সমন্ধের খ্যাতি বলিষ্ঠ জোয়ার নামাতে শুরু করে ওদের সবার ভেতর। ওদের আপাতত চাহিদা পূরণে কোনো অভাবই বাবা রাখতেন না। আবেদের ভাইগুলো এসে এসে আমাকে অন্নপূর্ণার মতো ভক্তি করলেও ওর মায়ের আচরণ ছিল, যেন সে ছেলের মা হিসেবে এসব উৎকোচের ন্যায্য পাওনাদার। বিয়ের আগে আমাদের বাড়িতে ওদের এটা ওটা পাঠানো, তাও যৎসামান্য পিঠে-চিড়ের অধিক আর কীই-বা ছিল। যা আমাদের বাড়িতে তৈরি হয় অঢেল এবং অধিক উপাদেয় করে।
সবকিছু মিলিয়ে একটা গা ঘিনঘিন অবস্থা আমার। কিন্তু এইসবের মধ্যে একটি হোঁচট আমাকে এমনি কাবু করে ফেলেছে যে, আমি আর এই বলয় থেকে নিজেকে নিক্ষেপ করে সরাতে পারিনি। আবেদের মা প্রায়ই বকবকানির গলগল ঢেউ তুলে তার শ্রেণীর প্রতিবেশিনী ক’জনকে নিয়ে ঘরে ঢোকে যখন, তখন আমার মা আমাকে ধরে এনে তাদের সামনে রেখে যায়। আমি সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে, অথবা বিমূঢ় হয়ে বসে থাকি। এতে আমাকে তাদের অনুগত ভাবতে না পারার আর কোনো খটকা খুঁজে পায় না। আমি দৌড়ে কোথায় পালাবো? ছোট চাচিই আমার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে।
বউটি চমৎকার হয়েছে, এমন উচ্ছ্বাস আবেদের মা একবারও ঝাড়েনি। বরং শ্যামলা মেয়ের সঙ্গে অন্যসব কিছু নিয়ে মোটামুটি পুষিয়ে গেছে গোছের ভাবখানা নিয়ে সহসা চৌকাঠ ডিঙিয়ে রওয়ানা হলে, মধ্যের আঁচল ঘোমটা দেওয়া, আটপৌরে হলেও রুচিশীল আমার মা তার হবু মূর্খ, দাম্ভিক বেয়াইনকে চূড়ান্ত পরিতুষ্টিতে টেনে তুলতে সে বেলা আটকে রাখতেন। তারপর রান্নাবান্নায় আনুষ্ঠানিকতার আমেজ তুলতেন। আর এতে আমার নিজস্ব গ্লানির সঙ্গে মায়ের ইদানীংকার হ্যাংলামো যোগ হয়ে আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে রাখে। দুই পুরুষ আগে আবেদদের কেউ একজন কেউকেটা ছিল এবং ওরা আর আমরা সেই একই রক্তের দু’ধার সিঁড়ি। ওদের সমকক্ষতার জোর সেখানেই থিতু।
স্বামী-স্ত্রী দু’জনের জন্য প্রথম যে একখানা বিছানা যত্ন ও আগ্রহে সাজানো হয়, যে বিছানার ঘরের নাম বাসরঘর। সেটা আবেদদের বাড়ি আমার বাবার তৈরি করা ঘরে হয়। ওদের পুরনো ঘরখানা এখনো আছে। ঢুকতে গেলে নুয়ে ঢুকতে হয়। চারদিকে পাটখড়ির বেড়া। মাঝখানে তেমনি আরেকটি বেড়া ঘরটিকে দু’টি রুমে বিভক্ত করেছে। দুই রুমে ছোট দু’টি জানালা তবু আলো ফরফর করে। এরই এক রুমে আগে ওরা চার ভাই এক চৌকিতে গাদাগাদি করে থাকত। অন্যটিতে ওদের মা-বাবা, হাঁড়িকুড়ি, কোলামাচা আর তা এখনো সে ঘরে ঢুকলে বোঝা যায়। আগে কখনো এ-বাড়িতে আমার ঢোকা হয়নি। দূর থেকে শুধু চোখে পড়তো। বিয়ের কথাবার্তা চলাকালীন চোখে শূল বেঁধাতে আর একবারও তাকাইনি। কারণ বিষয়টি মনে হতেই আর ভালো লাগতো না। সমান ঘর-মর্যাদা পরিচিত যে ক’জন তরুণকে আমার ভালো লাগতো, হয়তো তারা কেউ উচ্চাভিলাষী ছিল না কিন্তু স্বপ্নের ভেতর তাদেরকে নির্দ্বিধায় রাজপুত্তুর সাজানো যেতো। যারা আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল, কিছুটা তোষণ-নির্দেশনা পেলে তাদের কেউও আবেদের চেয়ে ভালো করতে পারতো। কিন্তু ওই ওরাই কিনা একটা সময় আবেদের নাম জড়িয়ে আমাকে ক্ষেপাতো।
এখন আর শনের ওঘরে কেউ ঢুকছে না। কাঠের নকশি তোলা বড় দরজার পাটাতন ঘরে তাদের সমস্ত কোলাহল। পরের জিনিসে কারও এত তৃপ্তি থাকে, আমার আগে জানা ছিল না। আবেদকে আমার সেই প্রথম কাছে থেকে দেখা। আগের দেখা ছিল ভিন্নরকম। পথে-বেপথে। গ্রামে স্কুলের ওপর ক্লাসে পড়া ঢেমনাগোছের ডাঙ্গর ছোঁড়া। সম্পর্কে আত্নীয়। ব্যস। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিয়ের সাম্ভাব্য জের ধরে আমার মা-বাবাই চেয়েছেনও আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করুক। ওর সঙ্গে আমি নিরালায় কথা বলি। এতে আবেদেরও সাড়া ছিল বলে মনে হয় না। না হলে এসে পড়লে ঠেকাতো কে?
প্রতিরাতে বিছানার প্রথম আলাপ আমাকে আর আবেদকে নিয়েই হতো। আমার বাবা-মা’র প্রচণ্ড শঙ্কা টের পেতাম তাতে। আমার নির্বিকার অবস্থা তাদের বিচলিত করে রাখতো। কিন্তু আমি অবিচলিত থাকতে পারলাম কই? কানাডা থেকে ফিরে এসে গাঁয়ের হাওয়া খেতে আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা চাচির একমাত্র বোনের ছেলেটি সম্পর্কে আমার ধারণায় ততদিনে চিড় ধরে গেছে। সেটি করেছে চাচি স্বয়ং। আমার এখনো মনে হয়, ছোট চাচিই পারতো আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে। কিন্তু চাচি বলেছে, জেনেশুনে ওরকম এক অকর্ম্মা, বখাটের সঙ্গে তোর বিয়ে দেই, আর এ বাড়ির ভাত আমার কপাল থেকে উঠুক! ওর কালচারে তুই নিজেকে মানাতে পারবি না। ওদের পাশের বাড়ি মেয়ে ওর জন্য বাড়ি ছেড়েছিল বলে মেয়ের বাবা মাস্তানির অপবাদ দিয়ে ওকে জেলে পুরতে চেয়েছিল। অগত্যা ওর বাবা ওর চাচার কাছে বিদেশ পাঠিয়েছিল ওকে। বিদেশি হাওয়ায় স্বভাব বদলের জন্য। তা দু’বছরে কতটা আর পাল্টেছে? লেখাপড়া করতে গেলে অন্যকথা। ওখানে সবাইকে কাজ করতে হয় বলে ও চলে এসেছে। অযথা প্রচুর টাকা খরচ হওয়ায় ওর বাবাও ওকে বিষের মতো দেখে। তোর চাচাও আমাকে আস্ত রাখবে তোর অশান্তি হলে? তার চেয়ে যা হয়েছে, হয়েছে! ওটা ওর জন্য কোনো বিষয়ই নয়। তুইও বিষয়টি সেভাবে দেখ, তাতে দম আটকা অবস্থা থেকে মুক্তি পাবি!
এসব শোনার পর আমার ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দিয়ে কথা আসে না। কিন্তু চাচি আবার শুরু করে, আবেদ নিরীহ প্রকৃতির ছেলে, দেখিস তোর কথায় উঠবে বসবে। চাচির কথায় এবার আমার গলা আরও বুঁজে আসে। মনে মনে বলি, এখন এত যে দরদ দেখাচ্ছো, তখন তো মানা করোনি তোমার বোনের ছেলের সঙ্গে মিশতে? বরং ডেকে তার সামনে বসিয়ে রেখে, নিজে লাপাত্তা হয়ে থাকতে! সমস্ত পৃথিবীটা আমার কাছে অসুন্দর, কুৎসিত, বেখাপ্পা ঠেকে। একটা ফণার লুকানো আভাসে ভয়ের অস্তিত্ব সাপের মতো পাক খায়। মা’র সঙ্গে ঝগড়া লেগে চাচি যদি কিছু বলে! সবার খোঁচামারা কথা চাচি-ই বা কতটা সহ্য করবে?
তবু সাহসে ভর করে বলি, পরের কথায় উঠবস করা স্বভাবের পুরুষগুলো যে মেরুদণ্ডহীন, তা জানো?
—মেয়ের বিয়ে একটু নিচু ঘরে হওয়া ভালো! আমার বোন যে উন্নাসিক তোকে ধুয়ে ফেলবে, গেঁয়ো বলে।
—তার মানে আমাদের ঘর নিচু জেনে তুমি এসেছ? আমার কথার তোড়ের মুখে চাচি আমতা আমতা করতে থাকে। চাচির কোনো জবাবের ধার না ধেরে মুখ ছুটে গেলো আমার, ক’জন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ-ব্যারিস্টার তোমার বংশে আছে? আমার দাদা স্বয়ং এই গ্রামের হাইস্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা, হেডমাস্টার ছিলেন। আমার ফুফুর যেমন বিয়ে হয়েছে, ফুপা পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এই গ্রামে তখন কারো অমন বিয়ে হয়নি! কোনোরকম কর্মদক্ষতা ছাড়া, শুধু আর্টস্-এর দুইখানা সার্টিফিকেট নিয়েই আমার ল’ইয়ার চাচার সঙ্গে ঝুলে এসেছো। তোমাদের বাড়িটা ক’খানা ইটের দেয়ালের এই তো তোমার ফুটানি!
চাচি হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু আমি থামি না। একটু দম নিয়ে আবার শুরু করি। বলি, গালভরে বলো, ভাইরা ব্যবসায়ী, বাবা মস্ত ব্যবসায়ী ছিলো কিন্তু হিসাবনিকাশ করা ছাড়া একটারও কোনো ডিগ্রি আছে বলে আমার মনে হলো না। দেখাতে তো নিয়েছিলে আমাকে। চাচির চোখ প্রায় ছিটকে বেরিয়ে আসা, থতমত অবস্থা দেখে শেষে কথা থামিয়ে নিজেই ভড়কে দৌড় দেই। বাড়ি ছেড়ে একেবারে ঢালে নেমে আসি। যেখানে অসময়ে কেউ আসে না। দৌড়াতে দৌড়াতে আমার ঘোর ছুটে যায়। আমি ভয় পেতে থাকি, যা সত্যি, তা চাচি আন্দাজে জেনে থাকলেও রক্ষে থাকবে না। তার ওপর আবার তাকে চটানো। অথবা সে ফাঁদ পেতে প্রশ্রয় দিয়েছে কিনা অঘটনের নেপথ্যে। চাচার সঙ্গে তার একা চলে আসা নিয়ে যেন বাড়ির কেউ আর উচ্চবাচ্চা না করতে পারে। করলে সময়মতো মোক্ষম বিষয়টি উগড়ে দেবে—আর ভাবতে পারছি না।
সেদিনই মাগরিবের নামাজের পর বিয়ে। বাড়িতে প্রচণ্ড ধুমধাম, শরতের রোদ গড়ানো পড়ন্ত বিকেল। ঢাল আবার বেয়ে উঠে ভিড়ের মধ্যে ঢুকতেই একদল আমাকে আলাদা করে ফেললো। হলুদ-মেহেদি, ধান-দুর্ব্বা, সুগন্ধী কিসব বরণের উপকরণে আমি মৌ মৌ করছি। কিন্তু আমার বিপন্ন মগ্নতা কাটছে না। সেই তমিস্রা ঘোর নিয়ে আমি ঢুকে পড়েছি আবেদদের নতুন বাঁধানো, প্রশস্ত উঠোনের ঝকমক বাড়িতে। সময় তখন প্রায় মাঝরাত। অধিক সময় ধরে বেহারাদের পালকির দুলুনি কাটাতে না পেরে টলতে টলতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভেঙে আবার টলতে লাগলাম।
অন্ধকারের পরত জড়ানো সকালে চোখ মেলে দেখি, ঘরে আর কেউ নেই। আবেদ এলো অনেকক্ষণ পরে। কিছুটা লজ্জা রাঙানো তার মুখ। সংকোচে গুটোনোও অনেকটা। তাতে আমার বোধে প্রকট ঘা দিল, এই ঘর-আসবাব, এমনকী ওই রান্নাঘরখানাও আমার বাবার তৈরি করে দেওয়া, যেন আমার কোনো অস্বস্তি না হয়।
আবেদকে আমি আর সম্মানের চোখে দেখতে পারছি না। আমার অপ্রসন্নতা আরও বিদীর্ণ করে আবেদ বলে উঠলো, রাতে আমি এখানেই ছিলাম। কিন্তু এত গভীর ঘুমে ডুবে ছিলে তুমি। জাগাতে সাহস হলো না। একটা তছনছভাব আমাকে গ্রাস করতে চলেছে। একটা মেরুদণ্ডহীন পরিবারের সঙ্গে এভাবে আমার নিয়তি বাঁধা ছিল? যেদিকে তাকাই, শুধু আমার বাবারই নৈপুণ্যের স্বাক্ষর। শ্বশুরবাড়ির প্রতি, সবদিক টেনেও একটু মধুভাব জমাতে পারি না প্রাণে। তিষ্ঠানো এবার আমার প্রতিপদে বেঁকে ফেরার পালা। চাচিকে চটিয়ে এসেছি, সে হ্যাপা কদ্দুর এগুলো। মন ছুটে যায় আমাকে আজন্ম লালিত বাড়ির দিকে।
জানালা দিয়ে আমাদের বাড়ির দু-চারটি গাছ দেখা যাচ্ছে। আমাদের বড় বাড়িটি ঢেকে রেখেছে মাঝখানে পরপর আরও দু’টি বাড়ি। আমার ছোট আরও তিনটি বোন আছে। তাদের প্রতি দায়বদ্ধতাটুকু জালের মতো আমাকে আটকে রাখে। যে কোনো ধরণের কলঙ্ক ঘটালে ওদের বিয়েতে বিঘ্ন ঘটবে। ভাই দু’টি আমাদের সবার ছোট। চারবোন এখন সমান। এখন একটা একটা করে ঝেড়ে বিদেয় করার পালা। বোনদের কথা ভেবে শুধু পা আটকে গেলো। আবেদ তখনো আমার পাশে বসা। আমি কোনো রোমাঞ্চ অনুভব করি না এতে। মৃন্ময়ের স্মৃতিগুলো ডাহুকের মতো ডুবছে ভাসছে। জানালাঘেঁষা পুকুরে মেঘলা আকাশ ছায়া ফেলে অতলান্ত করে রেখেছে কাকচক্ষু জল। একফালি অভিনিবেশও এত ব্যাপ্ত করে দৃষ্টির পরিধি! বিম্বিত, চলিষ্ণু রঙগুলো জলাধারের মতো নিবিষ্ট করে রাখলো এক আশ্চর্য আকাশের স্বপ্নে। চোখ যাকে ভাষা পায় না দেখার।
সমস্ত পৃথিবীটা খটখটে ঠেকছে। মানুষগুলোকে মনে হচ্ছে সমবেদনাহীন। একপেশে। কারো জন্য আলাদা কোনো টান নেই। নিভৃতির সব আড়ালে যেন ছিঁড়ে খসে গেছে। কী নির্লজ্জ এই পৃথিবী! পাশে বসে থাকা আবেদকে মনে হচ্ছে একটা বাদুর। যে এখনো একটা চাকরির জন্য ঝুলে আছে। যার নিজস্ব কোনো অভিমত নেই। নাহলে এমন একটা মূর্খ বাপের কথায় কেউ পটে? এমএ পাস করা একটা ছেলের চাকরি আমার বাবা কিভাবে দেবেন, যার দৌড় নিজের মফস্বল শহর পর্যন্ত? দু’দিন পর নাইওর এসে আমি আর আবেদদের বাড়ি গেলাম না। তবে এর মধ্যে আমার সঙ্গে আসা আবেদের সঙ্গে কোনোভাবেই দুর্ব্যবহার করা গেলো না। আমাকে নিতে এসে একে একে সবাই ফেরত গেলো। তাই পালকি এনে আর কেউ হেনস্থা হওয়ার বিষয়টি ঘোষণা করলো না। আমার ছেলেমানুষির মূল্য দু’পক্ষই দিলো দেখলাম।
এরই মধ্যে আমাদের শহরের এ বাড়ির কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠানোও শুরু হয়ে গেছে। সবার মনোযোগ আপাতত বাড়িটির দিকে। আবেদও বাড়ির ছেলের মতো বাবাকে সহযোগিতা করছে। এতে ওর বাবা-মা’র খেই হারানো দশা। ছেলে বুঝি হাতছাড়া হলো। গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে ওর মাকে একটি টেলিভিশনের চাহিদা জাগিয়েছিল। ভেবেছিল, বিষয়টি একবার বউয়ের বাপের কানে তুলতে উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে। তাই আমাদের বাড়ি বসে এইসব ফিসফাস। কিন্তু মা’কে আবেদের প্রচণ্ড ধমক সেদিন ওর নিজের অংশবিশেষ আমার কাছে কিছুটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু আমি নিজেই অস্পষ্ট জালে পেঁচিয়ে থাকতে চাই। চাচির গতিবিধিও বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তখন ধ্রুপদী চরিত্রের এই চাচিকেই-বা আমরা কে-ই বা কতটা বুঝতে পেরেছি!
চলনসই কিছু জিনিসপত্র রেখে, ভেতর থেকে সব জানালা দরজা এঁটে প্রধান দরজায় তালা লাগাতেই মাসহ আমরা কেঁদে ফেললাম। আগে থেকে কাঁদছিল বাড়ির অন্যরা। যেন আমরা নির্বাসনে যাচ্ছি। আমরা এ বাড়ি উঠে এলে আবেদ বেশির ভাগ সময়ই আমাদের বাড়ি থাকে। কেন থাকে বুঝতে পারি না। সবার সামনে দেখানেপনার দু-চার কথা বললেও দু’জনের একার সময়ে কিছুই বলতাম না। বিছানায় আমরা এখনো দুজন দু’দিকে মুখ দিয়ে থাকি। বালিশ দু’টিও পাল্টাপাল্টি হয় না। তবু ও বাড়ি গেলে যত রাত হোক ফিরে আসে। ঢাকায় যায় মাঝে মাঝে, দু-চারদিন থেকে আবার এখানেই আসে। চাকরির জন্য কোথায় গেলো, কেমন ইন্টারভিউ দিলো, কোথায় সম্ভাবনা আছে, কোথায় নেই, খেতে বসে বাবার সঙ্গে তার আলাপে জানতে পারি। উদ্যোগ শুনে বাবা খুশি হলেও এবার গা’ছাড়া ভাব। এই তঞ্চকতায় আমি বাবাকেও ক্ষমা করতে পারি না। ক্ষমার অযোগ্য আমিকেন্দ্রিক আমার এইসব বিষয়ে একা ছারখার হতে থাকি। আর আবেদ? যার, আমার প্রতি কোনো জবরদস্তি বা কৈফিয়ৎ তলব পর্যন্ত নেই। ক্রমে ওর মেরুদণ্ড আমার মজ্জায় বিলীন হয়ে আসে।
লেখাপড়ায় আমার কোনো উদ্যম নেই। টলায়মান এমন পরিবেশে কেউ তো আর যেকোনো বিষয়ে স্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে না! স্বপ্নকে ছবির মতো টেনে নামাতে হয়। কঠিন বিবাদের পরও, ক্ষতির প্রবল আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও ছোট চাচির প্রতি একটা অপ্রতিরোধ্য টান আমাকে গেরো দিয়ে রেখেছে। কী শৈল্পিকভাবে মানুষের রঞ্জিনীবৃত্তিকে দপদপিয়ে জ্বালিয়ে দিতে পারে মহিলা। শ্বাসরুদ্ধকর সব কাহিনীতে তার নিজের জীবন ঠাসা। ভাগ্নে সম্পর্কের ছেলেগুলো পর্যন্ত তাকে ঘিরে থাকে। না, খারাপ কিছু ভাবছি না। কিন্তু আমি কেন পারলাম না একজন মানুষকে সুতোর টানের মতোও বাঁধতে।
মন্ময় তো জেনেই গেছে যে আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে! ও তো একবার এসে অপেক্ষাও করতে বলে যেতে পারতো? আমার কি জোর ছিল ওকে ডাকতে? যদি কোনো অঘটন ঘটেই থাকে, তো তাই হোক। থাকুক তা অঘটন হয়েই। কোনো দুর্ঘটনা সূত্র করে সারা জীবনের জন্য কাউকে জীবনে বাঁধতে যে চায় চাক, আমি চাই না! এ কার জোর এসে ভর করে? এই আমাকে কি কেউ প্রভাবিত করছে? যে মুখ ভেসে ওঠে তাকে ঠেকাতে দু’হাতে নিজের শ্রাবণমুখ ঢাকি। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, চাচি তুমিও আমাকে ভালোবাসোনি।
গতকাল আবেদ ফিরেছে ক’দিন ঢাকা থেকে এসে। আজ দুপুরে খেয়ে বেরিয়েছে, যেমন প্রতিদিন বিকেলে বেরোয়। রাতের পেণ্ডুলাম এগারোটা মিউজিকে বেজে উঠেতেই মা ঘাড় ফিরিয়ে তবু ঘড়ি দেখলেন। ক’টা বাজে দেখতে। তারপর কপাল কুঁচকে আমাকে বললেন, আবেদ দেরি করছে যে? আজ নাও ফিরতে পারে! ওদের বাড়ি যেতে পারে। উত্তরটা এমনভাবে দিলাম, যেন আমি আবেদের আসা-যাওয়ার কত খবর রাখি! এবাড়ি থেকে আমাদের গ্রাম বেশি দূরে নয়। মাইল দশেক হবে। ওদের একেবারে ঘরের কাছ দিয়ে রাস্তা। বাস থেকে ক’পামাত্র। আমাদের বাড়ি যেতে একটু বেশি হাঁটতে হয়। পথে আবার নড়বড়ে সাঁকো পড়ে। ভারী কিছু নিতে হলে সাঁকো ছেড়ে পানি ঝাঁপাতে হয়।
রাত বারোটায় মেইন গেটে শব্দ পেয়ে বাবাই দরজা খুলতে গেছেন। ঘুমে তার পা টলছে বোঝা যাচ্ছে। তবু কে না কে এলো দেখতে নিজেই গেলেন। গেটের কাছটা রাস্তার ওপাশের বাঁশঝাড় নুয়ে এসে ঢেলে পড়ে আঁধার গাঢ় করে রেখেছে। ভেতর থেকে গেটের সুইচ জ্বালিয়ে গেলেও ও আলো পাতালে পড়ে থাকে। মানুষ চিনতে সহায়তা করে না। তাছাড়া বাড়িটাও তো কম বড় নয়। একবিঘে। ছোট চাচা হয়ত এখানে কিছু করবে না। কিন্তু আর দুই চাচার তো বাড়ির নকশা পাশ হয়ে গেছে। এখন কাজ শুরু করতে যতক্ষণ। গ্রামের বাড়ি খা খা নিজঝুম করে সবাই এখানে হুড়মুড় করে উঠবে। নাগরিক সব সুবিধার জন্য। ছোট চাচি তো ঢাকায়ই থাকে। কারো অনুমতি নেওয়ার বালাইও নেই। পৃথিবীটা যেন তার আনন্দধাম। চাচার সঙ্গেও তার কোনো দ্বন্দ্বও নেই। যেন কোনো আদেশ-উপদেশ নয়, যেন একজন আরেকজনকে অনুরোধ করে প্রতিটি কথা বলছে। আমারও ছোট চাচির মতো হতে খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু আবেদকে আমি আমার পাশে ভাবলে সব ঘুলিয়ে যায়। চাচি মন্ময়কে কেন বখাটে বললো? সে এড়িয়ে সরিয়ে রাখার জন্য কি?
বখাটে ছেলের রেজাল্ট এত ভালো হয়! চালচলনে অত মার্জিত? মন্ময় ছবি আঁকে। গান গাইতে পারে। একটি বিষয় ছেড়ে আরেকটিকে টেনে নিচ্ছে। ও যে ক’দিন ছিলো গ্রামে ওর সমকক্ষ সব কেমন ঘোরপ্যাঁচে বেঁধে রেখেছে। যেন কতকালের জানাশোনা সবার সঙ্গে। যেন স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা এক তরুণ। মেয়েদের সঙ্গে মিশতেও তার কোনো জড়তা নেই। সেজন্য ক’দিনে তাকে আমার ঈর্ষাই হতো। ওর সঙ্গে চাচির খুনসুটিও বাড়াবাড়ির পর্যায়ের মনে হতো। কারণ ওর পাশে আমি নিজেকে স্থাপনার মতো ভেবে শিহরিত হয়েছি। সেদিন আমার এই রাগের মুখে ছোট চাচি হতভম্ব হয়ে থাকলেও পরে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা-করেছে, লীনু কাউকেই আঁকড়ে ধরতে যাস না। নিজের জন্য নিজেকে ছাড়া আর কাউকে অপরিহার্যও করতে যাস না। দেখ্, এসব বিষয় তোর থেকে আমি অনেক ভালো জানি। এরকম নির্বোধ যন্ত্রণা আমার মধ্যে অনেক তুই বরং অনেকের জন্য নিজেকে অপরিহার্য করে তোল! আচ্ছা তুই গান শিখবি? দেখ্ প্রতিভা সবখানে, সব চোখেই সুন্দর! ব্যক্তি মানুষ স্থান কাল পাত্রে। চাচি’র একটানা কথার উত্তর আমি ছিটকে সরে মুখ ভেংচে বললাম, কোনোদিন যেন নাচতে বলো! যা রূপ খুলছে তোমার। আমার কথা শেষ না হতে চাচি হরিণীর মতো ছুটে এসে আমাকে আগলে ধরলো, কাঁপা, চাপাস্বরে বললো, শিখবি। নাচ। আমি তোকে শেখাবো!
—এত অভিনয়ের পরে আবার তুমি নাচতেও পারো?
—আমি তো নৃত্য শিল্পী-ই! তোর চাচা এক অনুষ্ঠানে আমার নাচ দেখে আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। আমাদের অনেকদিনের সম্পর্ক। তবে আমি যত অনীহা দেখিয়েছি, ও তত আগ্রহ দেখিয়েছে। এতে করে বুঝেছি, আসলে অবিনয়ী ভাবটিই সবার পছন্দ। এই যে তোরা মেয়ে বলে আলাদারকম একটা মূল্যবোধ পুষে রেখে দাপুটে পুরুষদের মধ্যেও গর্ব বোধ করিস। আমার কাছে এটা নিরেট সংকীর্ণতা ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু একজন শিল্পী সর্বত্রই শিল্পী। কারণ তার নিজের প্রতি বিশ্বাস। সে কিন্তু কারো স্বীকৃতির পরোয়া করে না!
চাচি সেদিন তার অনেক কথা বলতে বলতে শেষে যা বলেছিল, তা এ রকম—দু’দিনের মেলামেশাকে কেন্দ্র করে কাউকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া যায়? তার মানে তুই খুব ঠুনকো? ঠিক সেদিন থেকেই প্রতিটি ক্ষেত্রে বিরোধ পেচিয়ে যাচ্ছিলাম আমার নাটাই থেকে মাঞ্জাসুতো কাটা ঘুড়ির মতো আমারই এই চাচির সঙ্গে।
পূর্বপুরুষেরা অন্য জেলার হলেও পুরনো ঢাকায় চাচিরা বহুযুগের বাসিন্দা। নিজস্ব ছাড়াও ঢাকাইয়া পুরা কৃষ্টিতে চাচি প্রচ্ছন্নবেশ। লেখাপড়ায় উচ্চাকাঙ্ক্ষার চেয়ে ব্যবসায়ে উন্নতিটাই যে পরিবারের স্বপ্ন, তবু এই পারিবারিক গণ্ডির বাইরে চাচি যেন আরো কিছু কুড়িয়েছে। যার সূত্র ভালো লেখাপড়ার চেয়ে অকপট হৈ-হুল্লোড়ে স্বভাব, সত্যবাদিতা, একটা দর্পিত, কন্দর্পতেজ যেন ইচ্ছে করে কোথাও ফুটিয়ে রাখে। যা অন্যকে বুঝতে হয় নিজের প্রাণে উৎকীর্ণ করে। তার চলার গতিতে শরীরময় মৃদু তরঙ্গের মতো সারাক্ষণ যে মুদ্রা ভেসে থাকে। তাও সেদিনই স্পষ্ট হয়েছিলো ‘আমি নৃত্যশিল্পী!’ এই স্বীকারোক্তি’র মধ্য দিয়ে। কে তাকে কী ভাবছে, তাতে কখনো উদগ্রীব হতে দেখিনি। আমাদের অমন জহিন চাচা, যে অনেক মেয়ের স্বপ্নের পুরুষও, স্ত্রী’র মতের বাইরে সে একপা যেতে পারে না। অথবা চাচার পা ফেলার পরিধির বাইরে চাচি মত রাখতে যায় না। ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। নাহলে পাশের বাড়ির হীরা ফুপু, যে আমার চাচার সঙ্গে বিয়ের পর বিদেশে গিয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য নিজেকে তৈরি করছিল নিজের সাবজেক্টই পাল্টেছিলো চাচার সঙ্গে আইন পড়তে। দু’পক্ষের স্বীকৃতিও ছিলো সে বিয়েতে। কিন্তু ছোট চাচা অনিমা নামের মেয়ে, এই চাচিকে বিয়ে করেছে শুনে যে, সে মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটিয়ে যে রোগী হয়ে আছে, এটা কে না জানে! চাচা বিয়ে করেছে শুনে হীরা ফুফু ক’দিন দরজা বন্ধাবস্থায় ছিল। তারপর আবোল তাবোল বকা শুরু করলে সবাই বলাবলি করতে লাগলো-ভূতে ধরেছে। প্রকৃত চিকিৎসার পর ধরা পড়েছে মনোবৈকল্য ঘটেছে মেয়েটির।
ছোট চাচি নতুন অবস্থায় বাড়ি এলে আমরা খুব সতর্কাবস্থায় ছিলাম। কেউ এসে এসব তথ্য তার কানে না তোলে। কারণ নতুন বউ দেখতে এসে গোড়ার কথা তোলার মানুষই বেশি। কিন্তু বিষয়টি চাচি কিভাবে জানতে পেরে, নিজেকে একেবারে স্বাভাবিক রেখে বলতে লাগলো, বিশেষ কেউ বিয়ে না করলে যে পাগল হয়ে যায়, তাকে তো সে বিয়ে না করেই রক্ষে পেয়েছে! এখন খুব বেশি করে বুঝতে পারছি, আমি যথার্থ মানুষের হাত ধরেছি! বলিহারি চাচি আমার থেকে কতটা বড় হতে পারে? বছর পাঁচেক! কিন্তু আমার মনে হয়েছিল অন্যকথা, যেভাবেই হোক খোলস বা ছত্রভঙ্গ’র পর যারা নিজেকে টেনেটুনে অতোটা অটল রাখতে পারে, তারাই প্রকৃত ভণ্ড, চতুর এবং স্বার্থপর যাকে বলে। নিজেকে ভদ্রস্থ রাখার প্রয়াসী এই মানুষগুলো আসলে সাধারণের জন্য বিপজ্জনক। বিরোধী হয়ে ওঠে যারা, অথবা বিগড়ায়ও, তারাই খাঁটি। এই অর্থে ছোট চাচি ক্রমে আমার কাছে এক অনর্থ। বৈপরীত্যে সমান হওয়া দূরে থাক, তার ডানপিটে স্বভাবটিও আমি আত্মস্থ করি সে যোগ্যতাও আমার নেই। আমি জানি তার আধিপত্য ঢিমে তালে চলা এ সংসারে সবার জন্য বিস্তারিত আলো এনে দিতে পারে। তাই বুঝি তাকে প্রতিহত করার টানেই প্রবল ঝাপটাতে থাকি বাড়ির বড় মেয়ে আমি।
ছোট চাচি বাড়ি ফিরলে এখন আমাদের এ বাড়িতেই ওঠে। গাঁয়ের বাড়িটিকে আমরা পুরনো বাড়ি বলি। গাঁয়ের বা গ্রামের বাড়ি বলি না। বাসে মাত্র আধঘণ্টার পথ। চাচি সেখানেও যায় আরো দু’চাচা-চাচিকে দেখতে। কিন্তু দিনে দিনে ফিরে আসে। এছাড়াও যাওয়া-আসার পথে পড়ায়, গ্রামের আত্মীয়স্বজনের উৎপাতে বাড়িটি প্রায়ই পান্থশালায় পরিণত হয়ে থাকে। সে সব ধকলের জন্য অবশ্য নিচের তলায় আলাদা জায়গা রাখা আছে। এক বিকেলে পড়ো পুকুরটির অব্যবহৃত নিজঝুম ঘাটে বসে, স্ফটিক জলের ভেতর ঢিল ছুঁড়ে বর্ণময় আকশের ছবি ভাঙতে ভাঙতে চাচিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মন্ময় আমার কথা জানতে চায় না কখনো?
—চাইবে না কেন? কিন্তু এটা কি ফিরে এসে বয়ান করার মতো কিছু? যেন ভাঙা ছবির আস্ত প্রাণ উপড়ে রামধনু ঘোর কেটে চাচি আমার সবটুকু বিধ্বস্ত করে ফেলে! যেন একা স্থির থাকা যে কারও পক্ষে অসহ্য! কোনো প্রকার ঘৃণা নয়, ভালোবাসাও নয়, শুধু একটু বেদনা আমি তন্নতন্ন করে খুঁজি আঁকড়ে ধরতে। কিন্তু সৈকতিনীর ঝাপটার মতো চাচি আমার মুঠো খুলে ধুয়ে ফেলে স্মৃতির সবটুকু বালিকণা। যাতে অবশিষ্ট কোনো রেশও থাকে না আমার রঙিন হয়ে ওঠার আবির।
গেটের শব্দ আমাকে বারান্দায় টেনে দাঁড় করিয়েছিল। দেখলাম আবেদ ফিরেছে। বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে। খাবারটা মা’ই বেড়ে খাওয়ায়। বুঝলাম, এখনো সে তড়িঘড়ি করে উঠে পড়েছে খাবার বেড়ে দিতে। প্রতিবেলা আবেদের পাতেই পড়ে এ বাড়ির মাছের বড় টুকুরো। দুধের সর। আমি গৌণ। অন্যেরাও সেই সারিতে। ভাই দু’টি অবশ্য আদায় করে নেয় ন্যায্যটুকু। পিতা পরিবারের কর্তা, তার কথা আলাদা, দেবতার মর্যাদা অর্জনের সুযোগ পরিপার্শ্বই তাকে দেয়।
আমি আবেদের অস্তিত্ব টের পেয়ে রুমে ঢুকে পড়েছি। হাত নিশপিশ করা কিছু লেখাজোকা, হিজিবিজি টান আবেদের জন্য চাচির কেনা শেষবারের টাই’টা শার্টের সঙ্গে হ্যাংগারে ঝুলছে। আমার জন্য আনা ডায়রির এবছরের প্রতি পৃষ্ঠার জলছবি দেখে দেখে কী এক ঘটনা জীবনে স্পষ্ট করে তোলার মত্ত চেষ্টায়, তা চোখের ভেতরে আরও দুর্বিষহঝাপসা হয়ে ওঠে। মন্ময়ের অভিভূত স্মৃতিময় ক্ষণগুলো কেমন স্বপ্নছোঁয়া ঠেকে। যেন সে স্বপ্ন কখনো এ জীবন স্পর্শ করেনি। এই লাবণ্য যেন একান্ত ফ্রেমে বন্দি করে রাখলেই শুধু মূল্যবান। লুকোতে চাইলে ত্রাস! দোলাচলে আবেদ ঢুকতেই, না তাকিয়ে আমার মুখ থেকে এই প্রথম কোনো অসহ্য কৈফিয়ৎ ধনুক ছিলা তীরের মতো তার প্রতি ছুটে গেলো-রাত বারোটা পর্যন্ত কোথায় ছিলে? উত্তরটা তখনই এলো না। পাশের চেয়ার টেনে সোজা হয়ে বসলো আবেদ। ফস করে সিগারেট ধরালো। ওর গা থেকে সিগারেটের গন্ধ বেরুলেও আমার সামনে সে কোনোদিন সিগারেট খায়নি। আমার দিকে ফিরে শোয়নি পর্যন্ত। আমি তো না-ই। আজ যেন ও খাপ খুলে বেরোতে শুরু করেছে।
—আজ প্রথম আমার কৌমার্য ঘুচিয়ে এলাম। ছ’মাসের বিবাহিত জীবনে স্ত্রী যাকে নিষ্কাম করে রেখেছে, তাকে ফেরানোর টান এ বাড়ির কোথায় বাঁধা?’ আবেদ সতর্ক, উদ্বেগহীন একটি পেরেক আমার মাথায় ঠুকে দিয়েছে। অসহ্য ঠেকছে। তবু দ্বিতীয়বার মুখ খুলতে রুচি হচ্ছে না, নাকি শঙ্কায় আটকে পড়েছি, বুঝে উঠতে পারছি না। আমি আঙুলে আঁচলের কোণা পেঁচাতে থাকি। বুকের ’পর তিন ভাঁজ তোলা কুঁচিগুলি ঠিক করি। যেন গুনে গুনে নকশার বুনন পরখ করছি ধূসররঙ শাড়িতে। আমার মনোযোগ যেন এর চেয়ে বেশিদূর প্রবাহিত করা জরুরি মনে করছি না এখন, ভাবখানা এমন বোঝাতে আমি মরিয়া। দু’জন একা আমরা এই প্রথম একই সারিতে পাশাপাশি বসা। যদিও চেয়ার দু’টির মাঝখানে যথেষ্ট ফাঁকা জায়গা বিদ্যমান।
আসলে তুমি বোধহয় জানো না, তোমাকে বিয়ে করতে আমার ঘোর আপত্তি ছিল। ভেবেছিলাম, চাকরিবাকরি করার যোগ্যতা রাখে, নিজেকে নিজের তৈরি করতে কৌশল জানা, নিজের মেরুদণ্ডে প্রত্যয়ী এমন একটা মেয়ে বিয়ে করে জীবনটা সম্মানজনক, নির্ঝঞ্জাটভাবে নির্বাহ করব। কিন্তু তোমার ব্যবসায়ী বাবা আমার বাবাকে অন্ধ করে দিলেন। তবে আমি আমার বাবার মতের যে-দিকটিতে প্রাধান্য দিয়েছি, বাবা যা বলে আমাকে বুঝিয়েছেন, তা হলো এইরকম-গ্রামে একটা ভালো ঘরে সমন্ধ হলে গ্রাম্যসমাজে আমার ইজ্জত বাড়ে। পুরনো সম্পর্ক নতুন করে বন্ধনে শক্তিও বাড়ে। গ্রামে বসবাস করতে গেলে এমনটি দরকার!
তাছাড়া তোমার বাবার ইচ্ছেটা এত জোরালো ছিল। যাকগে, বাবার শক্তি-ইজ্জত বাড়াতে আমি নিজে কতটা ছোটো হয়েছি সেটা তোমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না লীনু। আর দু’পক্ষের ইজ্জত জিইয়ে রাখতেই আমার দশা এখন শাঁখের করাত। কারণ তোমার বাবাও তো তোমার জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করার আশায় আমার বাবাকে সম্মানিত করে তুলতে একটা মূল্য ব্যয় করেছেন। আমি কাল সকালে চলে যাবো। কবে ফিরবো জানি না।
ওর আগ বাড়িয়ে বলা, সহজ ধীর লয়ের কথার শেষেরটুকু বলতে বলতে ও বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। আরও দুতিন টান দিয়ে ধোঁয়ার পাক খেলিয়ে সিগারেটের শেষাংশ আগুনসহ দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে রেলিংয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকে ও। এবং তা অনেকক্ষণ।
ঘরের ভেতর তাপ গনগনাচ্ছে। অথচ শেষ হেমন্ত শীতের আভাস দিচ্ছিল একটু আগেও। বহুদূর ছিটকে পড়া একটি মন্দীভূত বিন্দুর জ্বলজ্বল ওর হঠাৎ এত ভালো লেগে গেলো? আমারই মেরুদণ্ড বলতে কিচ্ছু নেই, এই তো বুঝিয়ে দিলো ও! ভিত্তি থেকে শেকড় উপড়ানো মনে হচ্ছে। তবু অসহ্য চিৎকারে ফুঁসে উঠতে পারছি না। শুধু কপালের ফুলে ওঠা রগ চেপে রগড়াতে থাকি। আমার এ অবস্থায় পাশ কাটিয়ে বিনাবাক্যে আবেদ একসময় বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। খসখস শব্দে টের পাচ্ছি ও পত্রিকা পড়ছে। এমনি হয়, ও বসে থাকলেও তো আমি ডাকি না। ওর কথাগুলোর প্রতিধ্বনিও নয়, ও একবারই যা বলেছে তাই যেন মুহুর্মুহু বজ্র ঠিকরাচ্ছে মগজে। ওর হঠাৎ স্পর্ধিত, অচেনা মুখের দিকে আমি ঘাড় ফেরাই, মিলিয়ে দেখতে। যার ব্যক্তিত্বকে আমি কখনো আবিষ্কার করতে যাইনি। তাতে কোনোরকম সৌন্দের্যের উপাদান খোঁজা দূরে থাক। বিয়ের পর এ ক’মাসে তবে কি ওর এই বাধ্যতাই আমাকে ক্ষেপিয়ে রেখেছে?
বিরূপবোধের সংঘর্ষ ওর মূল্যবোধ প্রতিভাত করছে আমার অবশ মস্তিষ্কে দু’হাতের ভাঁজে প্রসারিত খবরের কাগজে ওর সমস্ত মুখমণ্ডল ঢাকা। আমার রক্ত চনমন করে ওঠে, এত রাতে পড়ার জন্য ও কী খবর বাকি রেখেছে দিনভর? বিছানা বালিশ আমার কাছে বহুদূর দ্বীপের মতো মনে হচ্ছে। রুমের দরজা খোলা, বারান্দাও। পাশে পর্দাতোলা জানালায় অর্ধেক চাঁদ, টিমটিমে কিছু তারা, বর্ণচ্ছটার ভেলায় পশরা সাজিয়ে কার্নিশে এসে ভিড়ে আছে আকাশ। প্রপঞ্চে ডুবন্ত আমি যেদিকে যাবো, যেন অকূল সাঁতরে এগোতে হবে। তবু উঠে দাঁড়াই। কপাল চেপে পরোয়াহীন চক্কর খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ওর ভাবলেশহীনতা, নাকি চরম সহনশীলতা ও দূরদর্শিতার প্রাখর্য অগ্নিস্ফূলিঙ্গের মতো আমাকে নিক্ষিপ্ত করে দিলো বিছানায়।
জিদ্দি, হেঁচকা টানে ফালিফালি হয়ে গেলো ক’ভাঁজ কাগজ। ছ’মাস বিবাহিত জীবনের একটানা ঘৃণার সঙ্গে সহসা যুক্ত ক্ষোভে বাঁধ ভাঙছে চরম অধিকার হারানোর বেদনা। আবেদের চোখে ভীষ্মাগুনে ফুটছে কি আর কারও মুখচ্ছবি? নাকি ভাসছে জলধনু ছায়া! হঠাৎ বারুদমিশ্র একটা দাহ তোলপাড় ঢেউয়ের মতো প্রবল ঝাপটায় স্মৃতির পুরনো দাবানল নিবিয়ে, অবিমিশ্র, প্রলয়ঙ্কর, মন্দ্রিত ঝড় ডাকলো বুকের গহীন ভেতরে। সহিষ্ণু বিবেকের ওর অহঙ্কৃত, তপোমূর্তি শুধু সদ্যোজাগ্রত উত্তাল কামজ তাড়নায় লণ্ডভণ্ড করে দিতেই সহসা ওকে আমি নিজের দিকে ফেরালাম।