তরুণী চারজন খানিকক্ষণ গল্প করার পর ঘুমিয়ে পড়ল।
ডিসেম্বরের শেষ রাতে কনকনে শীত। ভোর চারটা বিশে ট্রেনে ওঠার সময় বোঝা যায়নি। আসলে কলকাতা শহরে শীত কম। শহর ছাড়িয়ে যতই এগিয়েছে শীত ততই জেঁকে বসেছে। কোথাও কোথাও ঘন কুয়াশা। ট্রেনের খোলা দরোজা দিয়ে শিশির-ভেজা হিম বাতাস ঢুকেছে হু-হু করে।
মেয়েগুলো ফ্লাস্ক খুলে কফি খেয়েছে বারবার। কখনো চকোলেট, কখনো বা পানীয়। ওরা সবাই ভ্রমণে অভ্যস্ত। তারা জানে দীর্ঘ ট্রেনভ্রমণে এ রকম ঘটেই থাকে।
তরুণীদের দললে, যে সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ, বয়স ঊনত্রিশ-ত্রিশ হবে, তার সঙ্গে রয়েছে তার কিশোরী মেয়ে। তাদের মধ্যে এই আজকের ভোরের আগে কখনো আলাপ-সাক্ষাৎ হয়নি। তাদের ভাষাও আলাদা, কথা বলছিল ইংরেজিতে। তিনজন এখনো ছাত্রী, আর অন্যজন, সবচেয়ে যে জ্যেষ্ঠ, সে একজন চাকুরে।
ছাত্রী তিনজনের বয়স প্রায় সমান, বাইশের বেশি নয় কারো। ওদের দুজন বেড়াতে এসেছে ইউরোপ থেকে, ভারতীয় উপমহাদেশ বেড়িয়ে দেখার ইচ্ছে। তৃতীয় জন পাকিস্তানি, আর চতুর্থ জন, সবচেয়ে যে জ্যেষ্ঠ, সে আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি, দিল্লিতে কাজ সেরে ভারত দেখতে দেখতে দেশে ফিরছে। তার কিশোরী মেয়েটি কম্বলের মধ্যে বন্দি হয়ে ঘুমোচ্ছে।
দীর্ঘ ভ্রমণে এ রকম হয়েই থাকে যে পাশাপাশি বসলে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। মেয়েদের সখ্য যেমন সহজে ভাঙে, গড়েও ওঠে খুব দ্রুত। বিচিত্র ইংরেজিতে কথা বলে তারা। ঘণ্টাখানেক পরে ক্লান্তি আসে। তখন পেছনে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বগির অন্য যাত্রীরা আগে থেকেই ঝিমুচ্ছিল।
ঘণ্টাখানেকের নৈঃশব্দ্যের পর বাংলাদেশি মা-মেয়েটি হঠাৎ জেগে উঠল। এরকমই হয়, যেন কোনো এক অদৃশ্য হাতের নরম ছোঁয়া তাকে জাগিয়ে দেয়। চাকরি সূত্রে তাকে প্রায়ই ভ্রমণ করতে হয়। কখনো ঘুম বা বিশ্রাম তার যাত্রাপথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এই অদৃশ্য হাত সবসময়ই লম্বা নিঃসঙ্গ ভ্রমণে তাকে পথ দেখিয়েছে, এবং নিরাপত্তা দিয়েছে। ভ্রমণকে সব সময়ই সে উপভোগ করেছে।
মা-মেয়েটি কিছুক্ষণের জন্য বসে থাকল, নিজেকে ঘুমের ঢুলুনি থেকে সামলে নেওয়ার জন্য এইটুকু সময় তার দরকার। তারপর অন্য তিনজনের দিকে নজর দিল। ওরা তখনো ঘুমিয়ে আছে যার-যার আসনে। একজন হয়তো স্বপ্ন দেখছে তুর্কী ভাষায়, একজন স্প্যানিশে, অন্যজন উর্দুতে। খুলে রাখা ইয়ারফোন কানে লাগালো সে, তারপর ওয়াকম্যানটা হাতে তুলে নিলো। সে সাবধানে উঠল, কারো ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে দরোজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সেখানে যে দৃশ্য তাকে অভিনন্দন জানাল তাতে তার নির্বাক হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। সে সটান দাঁড়িয়ে রইল স্থানুর মতো, পাছে তার এতটুকু নড়াচড়াতেও মুহূর্তটা ভেঙে ছত্রখান হয়ে যায়। ট্রেন তখন উত্তরমুখো চলেছে, বাইরে সুবেহ সাদিকের সূর্যোদয়-পূর্ব রূপালি আলোয় শীতের খোলা মাঠ দৃশ্যমান, যদিও কিছুটা ঝাপসা। এ এলাকায় এখন তেমন কুয়াশা নেই, তবে প্রকৃতির ওপর শীতের রঙ স্পষ্ট। তাদের আপাতঃগন্তব্য গেদে স্টেশন এখনো অনেক দূরে। দূর দিগন্তের পেছনে কালচে ধোঁয়াশাময় পবিত্র সৌন্দর্যের প্রেক্ষাপট ফুঁড়ে মাথা তুলছে একটা লাল বড়সড় চাকতি, তারুণ্যের ছটায় উজ্জ্বল।
‘সূর্য়োদয়! সূর্য উঠছে!’ সে নিজেকেই নিজে বলল যেন। এই এলাকাটা নদীয়ার মধ্যে পড়ে। ভৌগোলিকভাবে সেটা এখন ভারতের অন্তর্গত হলেও প্রকৃতিগতভাবে সেটা তো বাংলাদেশের মতোই। নদীয়ার সূর্যোদয় আর কুষ্টিয়া বা রাজশাহীর সূর্যোদয়ের মধ্যে কী-ই বা ফারাক! তার মনে হলো, দীর্ঘকাল বিদেশযাপনের ফলে বাংলা ভুলে যাবার যোগাড় হয়েছিল, আর এই মুহূর্তে সে লক্ষ্য করল যে অনেকদিন পর, প্রথমবারের মতো সে বাংলায় ভাবছে। তার মুখমণ্ডলে একটা তৃপ্তির হাসি রঙ ছড়ালো।
‘জাগো! ওঠো! কুইক! গেটআপ! আসো, দেখ, কী চমৎকার! এমনটা কখনো দেখনি তোমরা। আসো, ওঠো, এটা মিস কোরো না!’
‘মম, আমি ঘুমাচ্ছি!’
‘আর নয়। ঝিমাতে ঝিমাতেই আসো, এটা মিস কোরো না, পৃথিবীর আর কোথাও এমন অবাক-করা সৌন্দর্য দেখতে পাবে না। তোমরাও আসো। এটা মিস কোরো না।’
‘মম, প্লি-জ, আমাকে ছেড়ে দাও। যাও তুমি…।’ ইংরেজিতেই বলল সে।
তার বয়স এগার বছরের বেশি হবে না আজকের এই ভোরে। এই শীতের প্রভাতে বগির আর সব যাত্রী সুপ্তির ঘুমে নিমগ্ন, কেবল তার মা ছাড়া। আর, অবশ্যই, সে-ও, মায়ের ঠেলাঠেলিতে। তাছাড়া, এই লজ্ঝড়ে কেঠো ট্রেনে ঘুমানো কি এতই সহজ! এখন ভোর পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটা হবে হয়তো, ভাবল সে। ভোরের আরাম থেকে বঞ্চিত না হওয়ার প্রতিজ্ঞায় সে তার শরীরে জড়িয়ে-থাকা নরম কম্বল আঁকড়ে ধরল, চোখ দুটো কুঁচকে বন্ধ করে রাখল। কিন্তু তার মা তখনো তার বিছানার পাশে গুনগুন করে চলেছে…
কিছুক্ষণ পরে মা-মেয়েকে দেখা গেল ট্রেনের দরোজায়, ওরা সূর্যোদয় দেখছে। হিম, হাড়-কনকনে আবহাওয়া, অন্য সবাই গভীর ঘুমে নিমগ্ন।
‘সূর্যটাকে দেখ! দেখ কীভাবে ভোরের পর ভোর নতুন আশা জাগিয়ে উদিত হয় সে। এই চমৎকার উত্থানকে, উত্থিত হওয়ার এই উদগ্র আকাক্সক্ষাকে মনে রেখ। আর ভুলে যেও না এটা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সূর্যোদয়। এমনকি তোমার সবচেয়ে দুর্দশার সময়ও এই দৃশ্যটাকে ভুলে যেও না। কখনো ভুলো না!’
তার মা ঠিক বলেছে। কারণ, সূর্যোদয় যদি না হয় তো সূর্যাস্ত, অথবা ফুলের পাপড়ির ওপর শিশিরবিন্দু, কিংবা আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জ, অথবা রাস্তার ধারে কোনো বৃদ্ধার মুখের জটিল বলিরেখা… কোনটা অবিস্মরণীয় নয়? কিছুই তাকে এক মুহূর্ত অবসর দেয় না… তার মা সর্বত্রই কিছু না কিছু খুঁজে পেয়েছে উত্তেজিত ও আলোড়িত হওয়ার মতো, মোহিত ও অভিভূত হওয়ার মতো, আর সেটায় সে তার মেয়েসহ অন্যদেরও অংশীদার করতে চেয়েছে সব সময়…
কিশোরী মেয়েটির জন্ম বাংলাদেশে, কিন্তু বিদেশেই মানুষ, প্রায়ই মায়ের ভ্রমণসঙ্গী হয়। গা ঝেড়ে ঠাণ্ডা তাড়াল সে, গায়ের কম্বল আরো গুছিয়ে নিল, চোখ বন্ধ করল, ঢুলতে লাগল, তারপর মায়ের গা ঘেঁষে তার কাঁধে মাথা নুইয়ে দিল। মা তাকে হাত দিয়ে জাপটে নিল, ধরে রাখল শক্ত করে। মেয়েটি যখন ঘুমিয়ে পড়ার উপক্রম তখন সে তাকে গুঁতো মেরে জাগিয়ে তুলল, এটা এমন একটা শক্তিশালী তাড়না যা তার পরিণত জীবনে বারবার ফিরে আসবে অনুপ্রেরণা নিয়ে, তাকে পথ দেখাবে। সে জেগে ওঠে এবং সূর্যোদয় দেখতে থাকে।
মেয়েটি সূর্য দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। এই প্রথমবারের মতো সে সূর্যোদয়ের গরিমা উপলব্ধি করছে। এখানে, আজকের এই সকালে, এই বয়সে! সূর্যটা মাথা তুলছে, নতুন দিনের আশার আলোকরশ্মি ছড়িয়ে। সে তার মায়ের দিকে তাকায়, মা পরমানন্দে আধবোঁজা চোখে শ্বাসচাপা স্বরে ফিসফিস করে বলছে, ‘প্রকৃতির দিকে তাকাও, দেখ কী ভীষণ অসাড় হয়ে পড়েছে সে… কী প্রশান্ত, আপ্লুত ও তৃপ্ত! সে শান্তি খুঁজে পেয়েছে…! কান পেতে শোনো, সমস্ত প্রকৃতি সূর্যটাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে…!’
তার স্মৃতিতে এটা খোদিত হয়ে যায়, যা সে অনেক বছর পরেও স্মরণ করতে পারবে, আর তার এই উপলব্ধি হয় যে, সবচেয়ে সুন্দর ও পবিত্র সূর্যোদয়ের ঘটনা উপভোগ করার জন্যে ঘুমের আরাম বিসর্জন দিতে হয়; আর বাস্তবে, সেই সূর্যোদয়, তার কাছে, তার মা ছাড়া আর কিছু নয়।
বাকি মেয়েরাও উঠে এসেছে।
‘হাউ ইমপ্রেসিভ! মনে দাগ কেটে যায়, তাই না?’
দীর্ঘ ট্রেনভ্রমণে এ রকম ঘটেই থাকে যে একজন আরেকজনকে প্রভাবিত করে… সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে যেমন!
কেবল ট্রেনটা যদি হতো আরেকটু ভাল মানের, আর চলত যদি আরো একটু ধীর গতিতে… আর শীতটা হতো আরেকটু কম!
ওরা আবার ঢুলতে থাকে।
মেয়েকে আসনে বসিয়ে দিয়ে জ্যেষ্ঠ মেয়েটি আবার দরোজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রকৃতিতে রূপালি, সোনালি আর রক্তিম আলোর বিচিত্র খেলা। শীতের শূন্য মাঠে কখনো কুয়াশার রহস্যময়তা, কখনো বা দূর দিগন্তে হালকা শ্যামলিমার হাতছানি। মুখে এসে চুমো দিয়ে যাচ্ছে মিঠে রোদ।
ঘাড়ের ওপর গরম নিঃশ্বাসের ছোঁয়া পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে। মুখোমুখি হলো চল্লিশ পেরুনো এক দীর্ঘদেহী শ্বেতাঙ্গ প্রৌঢ়র, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ, হয়তো কামানো হয়নি কয়েকদিন ধরে, নীল চোখে মোটা রিমওয়ালা চশমা, ঘন ছোট-করে-ছাঁটা বাদামি চুল, আর পরনে তারই মতো ভ্রমণক্লান্ত আলুথালু পোশাক।
ট্রেনযাত্রায় এরকম ঘটেই থাকে যে অচেনা-অজানা কারো সঙ্গে স্মরণীয়ভাবে দেখা হয়ে যায়, বিশেষ পরিচয় ঘটে, কথা হয়; কখনো কখনো উপহার লেনদেনও হয়, তারপর সবকিছু ভুলে যায়। তারপরেও, কখনো কখনো, কোনো কোনো বিরল ক্ষেত্রে, এমন কোনো কোনো লোকের সঙ্গে দেখা হতেও পারে যার সঙ্গে পরিচয় ঘটে, কিছু কথা বিনিময় হয়, কিন্তু তা কখনো ভুলে যাওয়া যায় না। যদিও, উভয় ক্ষেত্রেই, যে লোকেদের ভ্রমণপথে সাক্ষাৎ ঘটে তাদের মধ্যে হয়তো পুনর্বার আর কখনো দেখা হবে না।
লোকটাকে অভিযাত্রী বা ভ্রমণপিপাসু পরিব্রাজক বলে মনে হয় না। অনেকটা দার্শনিক গোছের, এমন লোকের মতো, যে কিনা কেবলই বেরিয়েছে লাইব্রেরি থেকে কয়েক ঘণ্টা পড়াশোনা করার পর… কিংবা হতে পারে মনভোলা কবি, কিংবা অংকশাস্ত্রবিদ। মনের ওপর প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে হয় তাকে। প্রণয়-পিয়াসী মজনু গোছেরও হতে পারে, যদিও বয়সটা বেমানান। কিংবা মতলববাজ, মেয়ে-পটানো ঘোড়েল লোক হওয়াও বিচিত্র নয়। শরীরের লালচে রং দেখে মনে হয় পূর্ব ইউরোপীয়, ইংরেজি উচ্চারণে জার্মান ভাষার প্রভাব।
‘আমি তোমাকে বিরক্ত করতে চাইনি। আমি কেবল তেমন একজন মানুষের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি যে জানে পৃথিবীর সবচেয়ে উপভোগ্য জিনিস হচ্ছে পবিত্র সূর্যোদয়, আর সেই সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয় ভোরের ঘুমের আরাম বিসর্জন দিয়ে। আমার অনধিকার চর্চাকে দয়া করে ক্ষমা কোরো!’
‘আমরা কি সীমান্তে পৌঁছে গেছি?’
লোকটা মাথা নেড়ে জানাল, ‘হ্যাঁ।’ তারপর সে মেয়েটির কোমরের বেল্টে আটকানো ওয়াকম্যানের দিকে ইশারা করল। ‘কী শুনছ?’
আসলে সে তখনো টেপ চালু করেনি, যদিও কানে ইয়ারফোন লাগিয়েছে। সে ওয়াকম্যানটা বের করে লোকটির হাতে দিল।
ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে টেপ চালু করে দিল লোকটি।
‘লা ট্র্যাভিয়েটা! আলেক্সান্দার দুমার গল্প। দীর্ঘ ট্রেনভ্রমণে সাউন্ডট্র্যাক পছন্দ করলে অপেরার চাইতে ভাল আর কী হতে পারে! তাই না? আমারও খুব পছন্দ এটা।’
তরুণী মা-মেয়েটি, যে-কিনা ভোরের ঘুম বিসর্জন দিয়ে ট্রেনের দরোজায় হু-হু বরফ-শীতল বাতাসের কামড় সয়েছে কেবলই সূর্যোদয় দেখার জন্যে তার এখন আদৌ কথা বলতে ভালো লাগছে না। সে ঘুরে দাঁড়াল এবং সূর্য দেখায় মন দিল। সূর্যটা তখনো বিশাল ডিমের কুসুমের মতো টকটকে লাল, এবং উপভোগ্য ও সুখপ্রদ।
‘মজার ব্যাপার, তাই না?’ মনে মনে বলল মেয়েটি, এই রকম এক মুহূর্তে যে-কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে যে এই সেই সূর্য যে উদিত হচ্ছে, আর এই সেই পৃথিবী যে স্থির দাঁড়িয়ে আছে এখনো। যদিও সত্যিটা হচ্ছে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। কত সহজেই না প্রতারিত হওয়া যায়… আর প্রতারণা কতই না রঙে মোড়া আর চাতুর্যময়!’
‘দর্শন, না অংক?’ মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, কিন্তু সূর্যোদয়ের শেষ রংটুকুও উপভোগ করতে চায় সে, তাই তার ওপর থেকে চোখ সরাল না।
‘ওহ, পরিচয় দিতে ভুলে গেছি। কী বোকা আমি! আজকাল এ রকম হচ্ছে আমার! বুঝতে পারছি আমি আর পারছি না। যাই হোক, আমার নাম ওয়াল্টার, আমি একজন লেখক। আমি জার্মান, অ্যামেরিকায় চলে যাচ্ছি… মানে আমি অভিবাসী হতে চলেছি। সত্যি বলতে কি আমি এটা চাই না, কিন্তু,’ সে চারপাশে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি নাজিদের কথা শুনেছ তো? হিটলারের কথা? ওরা ইহুদীদের উচ্ছেদ করছে… এথিন্ক ক্লিনজিং… ইহুদীদের খতম করে ফেলবে।’
‘আপনি মজা করছেন। ইহুদী নিধন তো অনেক পুরনো খবর, এখন বরং ইহুদীরাই অন্যদের খতম করে চলেছে!’
‘তার মানে… ওহ কী আশ্চর্য দেখ, আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল! তার মানে তুমি ইহুদীদের ভয়ে পালাচ্ছ? ঠিক আমি যেমন নাজিদের ভয়ে…? ওহ, সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে।’
নিজের জায়গায় ফিরে তরুণী মা-মেয়েটি তার বন্ধুদের ‘শুভ সকাল’ জানাল।
‘আমরা সীমান্তে পৌঁছে গেছি।’
ওদের আলাপ থামল। ততক্ষণে রোদ উঠেছে। তাবৎ পৃথিবী আলোয় উজ্জ্বল। শীতও নেই আর তেমন।
ভারতীয় সীমান্তের কাস্টমস কর্মকর্তাটি অল্পবয়সী এক তরুণ, কোনো আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সন্তান। হয়তো চাকরিতেও নতুন। সদ্যজাগা খোলামেলা সংক্ষিপ্ত বসনের চার বিদেশি তরুণ বয়সী মেয়েকে দেখে সে ভড়কে গেল, হাসল একটু জড়তা কাটাতে, তারপর কিছু কৌতুক করার চেষ্টা করল। তবে তার মাতৃভাষা-প্রভাবিত ভারি কড়মড়ে উচ্চারণের হিন্দি শুনে কিছুই অনুধাবন করা গেলো না।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তরুণীদের ফিকফিক হাসি, ঢলাঢলি, আর চোখের ঠারাঠারি তাকে এতটাই মুগ্ধ করল যে এমনকি পাকিস্তানি পাসপোর্টও তার খোশমেজাজ নষ্ট করতে পারল না।
‘ক্ষমা করবেন, আমি একজন মা-মহিলাকে খুঁজছি… যে পবিত্র ভোরে সূর্যোদয় উপভোগ করার জন্যে কষ্ট স্বীকার করতে আনন্দ পায়।’
‘ওয়াল্টার? আপনি কি আমাকে খুঁজছেন?’
‘ওহ, তুমি এখানে! তুমি ঠিক আছ তো? তোমার সঙ্গে এরা খারাপ আচরণ করেনি তো? অমর্যাদাকর, ক্ষতিকর কিছু? তোমাকে নিয়ে আমি খুব চিন্তিত ছিলাম।’
তার কণ্ঠ ক্লান্ত। তাকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে।
‘না, তেমন কিছুই ঘটেনি। কেন ঘটবে? আমি ভাল আছি। কেউ আমার পেছনে লাগেনি। আপনার খবর কী?’
‘আমি এখানে নেমে যাচ্ছি…।’ তারপর হঠাৎ কণ্ঠ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আসলে আমি পালিয়ে যাচ্ছি। পাসপোর্ট চেকিংয়ের সময় ধরা পড়ার কথা আমি ভাবতেও পারি না… তুমি বুঝতে পারছ? আমার সঙ্গে অপরাধীর মতো আচরণ করা হবে, অপমান করা হবে… ওহ, আমি সইতে পারি না। মৃত্যুর চেয়েও এটাকে আমার কাছে ভয়ঙ্কর মনে হয়। বিরক্তিকর… অপমানকর… যন্ত্রণাদায়ক!’
‘কিন্তু ওয়াল্টার, ইহুদীরা এখন আর বিপদাপন্ন নয়, তারাই বরং অন্যের বিপদের উৎস! …তাছাড়া এটা জার্মানি নয়, এটা হচ্ছে ভারত, মানে ইন্ডিয়া। আর সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশ।’
‘তাতে কিছু আসে-যায় না, বিবেচনার বিষয় হচ্ছে আত্মমর্যাদার ওপর আঘাত। যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা বন্য জন্তুর মতো আচরণ করে, যখন ক্ষমতাবান মানুষ বিশ্বাস করে যে সন্ত্রাস হচ্ছে বিজয় লাভের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার, যখন কিনা মিথ্যা প্রোপাগান্ডা সত্যকে নিয়ন্ত্রণ করে…’
মেয়েগুলি, যারা এতক্ষণ পর্যন্ত ব্যস্ত ছিল নিজেদের নিয়ে, সীমান্ত পেরুনোর প্রস্তুতিতে, তারা হঠাৎ অনুধাবন করতে পারল যে তারা এই লোকটি সম্পর্কে যা ধারণা করছিল, যে সে একজন প্রণয়পিয়াসী ধরনের মানুষ, বা ধাড়ি মতলববাজ, আসলে তা নয় ব্যাপারটা।
‘আমাকে এখনই চলে যেতে হচ্ছে, মাদমোয়াজেল। এই যে নাও তোমার অপেরা টেপ। আমি এটা মনের ভুলে নিয়ে যাচ্ছিলাম। তাছাড়া আমি তোমাকে এই বই দুটোও দিয়ে যেতে চাই, আমার প্রিয় লেখক এরা।’
‘তাহলে আমাকে দেবেন কেন?’
‘কারণ আমার আর এগুলোর প্রয়োজন হবে না… অনেকবার পড়েছি আমি, বলতে পারো মুখস্থ হয়ে গেছে। তাছাড়া যেহেতু আমি… না, মানে, আমাকে যেতে হচ্ছে…। আমাকে এই মুহূর্তেই যেতে হবে। এই অপমানজনক অভিযাত্রার অবসান টানতে হবে আমাকে… বিদায়!… ভালো থেক তুমি! তোমরাও…। বিদায়!’
সে দ্রুত চলে গেল।
তরুণী মা-মেয়েটি কী করবে বুঝে উঠতে সময় নিল একটু। তারপর তার মেয়েকে বন্ধুদের দেখতে বলে লোকটির পেছনে ছুটল। অন্য তিন তরুণী বসে থাকল অসহায়ের মতো।
শত চেষ্টা করেও তার সন্ধান পাওয়া গেল না।
দীর্ঘ ট্রেনযাত্রার প্রকৃতিই এরকম যে, এমন বহু লোকের সাথে দেখা হয় যাদের সঙ্গে এ জীবনে হয়তো আর কখনো দেখা হবে না…
‘আমরা এখন কোথায় যাব?’
‘এরপর দর্শনা! বাংলাদেশের চেকপোস্ট।’
বন্ধুরা সব একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল। নতুন দেশ, নতুন অভিজ্ঞতা! ওদের মুখ-চোখ আনন্দে চকচক করতে লাগল।
তরুণী মা-মেয়েটি লোকটার রেখে-যাওয়া বই দুটো তুলে ধরল। একটা বোদলেয়রের রফলুস দু মল, আরেকটা প্রুস্ত-এর রিমেমব্র্যান্স অব থিংস পাস্ট।
দর্শনা স্টেশনে পৌঁছে মেয়েগুলো তাদের পরস্পরের ঠিকানা লেনদেন করল, এবং একে অন্যকে বিদায় জানাল। এইভাবে চারজন বিশ্ব-পরিব্রাজক পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল: একজন যাবে খুলনায়, একজন কুষ্টিয়ায়, তৃতীয় জন সৈয়দপুর, আর মেয়েকে নিয়ে মা-মেয়েটি যাবে প্রথমে রাজশাহী, তারপর ঢাকায়।
সেদিনের পর অনেকদিন পেরিয়েছে, তারা সবাই বেড়ানো শেষে যে-যার জায়গায় ফিরে গেছে। তারা বেশ কিছু কাল পরস্পরকে গ্রিটিংকার্ড পাঠাল, ইমেইলে মেসেজ পাঠাল, কিছু কথা, কিছু শুভেচ্ছার বিনিময় করল… তারপর এই রকম ভ্রমণে যা ঘটে থাকে… দেখা হয়, পরিচয় হয়, ভালো লাগে, তারপর আবার ভুলেও যায়।
তবে ওয়াল্টার নামটা মা-মেয়েটি ভুলতে পারেনি। তার দেওয়া বইগুলো সে খুব যত্ন করে রেখেছে। বই দুটো বারবার পড়েছে সে। স্মৃতি-বিস্মৃতির কী জটিল গ্রন্থি!
লোকটার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল কলকাতা থেকে গেদে ট্রেনভ্রমণের সময়, তখন তার মনে হয়েছিল সে ডিপ্রেশনের রোগী, কিংবা কিছুটা বা পাগলাটে। কিন্তু ওই লোকটা পবিত্র ভোরের সুন্দর সূর্যোদয় দেখে মোহিত হয়েছিল। তার মনে হয়, যেন বা সে কোনো একদিন হঠাৎ তার সামনে এসে উদিত হবে, বলবে, চলো, আমরা আবার পবিত্র ভোরের সূর্যোদয় দেখি। সেদিন সে তাকে তার বইগুলো ফেরত দিতে পারবে। প্রিয় লেখকের প্রিয় বই বলে কথা।
ওই তরুণী মা-মেয়েটি, যাকে ভবিষ্যতে এরকম আরো অনেক ভ্রমণ করতে হবে, সেসব ভ্রমণপথে আরো কত-কত লোকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ-পরিচয় ঘটবে, কিন্তু সে জানে দীর্ঘ ট্রেনভ্রমণে পরিচয় হওয়া লোকেদের সাথে পুনর্বার আর কখনো দেখা না-ও হতে পারে। তথাপি সে আশা করে হয়তো কখনো ওয়াল্টার নামের ওই লোকটার সঙ্গে তার পুনর্বার দেখা হতেও পারে; যেহেতু, অবশ্যই, এ কথা সে কোনোদিনও জানতে পারবে না যে, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন নামক প্রখ্যাত জার্মান লেখক-দার্শনিক, সিজোফ্রেনিয়ার রোগী, ভারতের সীমান্তবর্তী ছোট্ট স্টেশন গেদের কাছে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে।