টাইপ করতে করতে সুতপা পাখিটাকে দেখছিল বারবার। কুচকুচে কালো তুলতুলে পাখি। অথচ গলাটা কী মিষ্টি। কুহু কুহু ডাকে যেকোনো মানুষের বুকের মধ্যে তোলপাড় হয়।
সুতপার বুকের মধ্যেও ছোট্ট পাখি ঝড় তুললো। মলঙ্গা লেনে তেতলা অফিস ঘরের জানলা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে একটা শিমুল গাছ। প্রত্যেক বছর গাছটা টকটকে লাল ফুল ফুটিয়ে জানান দেয় বসন্তের। আর তখনই শালিখ কাক, বুলবুলির সঙ্গে জুটে যায় কোকিলটা।
প্রাণভরে মধু খেয়ে শালিক, কাক, বুলবুলি উড়ে যায়। ঠিক তারপরই কোকিলটা এসে বসে ডালে। পাতাঝরা ন্যাড়া ডালে লাল ফুলের মধ্যে কালো কোকিল সারা দুপুর ডাকে কুহু কুহু। কোকিলটার একটানা উদাস করা ডাকে ম-ম করে শহরতলির এ তল্লাট।
তিন বছর হলো সুতপা এই সরকারি অফিসে জয়েন করেছে। টাইপিস্ট। কলকাতা শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে তার অফিস। আগে দুবছর ওই পাখিটার ডাক শুনেছে সুতপা। তবে এবারের মতো তার বুকে ঝড় তোলেনি। গত বসন্তেও শিমূল গাছটায় কয়েকটা ফুল জানলা দিয়ে পেড়েছিল। ইয়ার্কি করে সুপার ভাইজার টাইপিস্ট রেবা রায় বলেছিল, একটা ফুল চুলে গুঁজে নে। দেখবি ভ্রমর আসবে।
-যাঃ, রেবাদি তুমি না বড় ফাজিল!
-আমি ফাজিল! আর তুই? ভাবিস আমি বুঝি কিছু বুঝি না!
-কী বোঝো?
-এই যে রোজ নিত্য নতুন পোষাক পরা। ম্যাচিং লিপস্টিক। ম্যাচিং ব্যাগ !
– যাঃ আমি একটু সাজতে ভালোবাসি। তাতে যদি চোখ টাটাও তো কাল থেকে…
– বালাইষাট, আমার জন্যে তোর যোগিনী সাজতে হবে না। তোর কেউ ঠাকুর কেটে যাবে। বুঝি।
– আহ্ রেবাদি, বিশ্বাসে করো তেমন কেউ নেই। থাকলে বলতাম না বুঝি!
টাইপ মেশিন থেকে উঠে সুতপা জানলায় গিয়ে দাঁড়ালো। পেয়েই কোকিলটা ফুড করে উড়ে গেলো। কোকিলটা উড়ে যেতেই চাপা কষ্টের ছোটাছুটি টের পেলো বুকে। ডান হাত বাড়িয়ে একটা শিমুল পেড়ে নিজের চুলে গুঁজে নিলো সুতপা।
হিমাদ্রীর ডাকে চমক ভাঙে সুতপার। সুদৃশ্য একটি ছোট্ট প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো, এই উপহারটার জন্য তোমাযকে ডেকেছি।
জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালো বাইরে। কালো ফিতের মতো রাস্তা। সারসার খেলনা গাড়ির মতন গাড়ি ছুটছে হু হু করে। বিশ্রী সব শব্দে কান ঝালাপালা। যতদূর চোখ যায় শুধু কালো ধোঁয়া। ধোঁয়ায় রাস্তার দুই দিকে সারিবদ্ধ দোকান, বাড়ি, অফিসের দেওয়ালে।
– কী রে রাস্তায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে নাকি। রেবা রায় তির্যক মন্তব্য ছুড়ে দিলো সুতপাকে। মুখ ঘুরিয়ে সুতপা বললো, আর পেলাম কই, যে দাঁড়িয়ে থাকবে?
-কেন, ট্রেন বাসেও তেমন কারও দেখা পাসনি বুঝি !
-না।
-যদি বলিস তো আমি দেখতে পারি।
রেবা রায়ের কথাগুলো গরম সিসের মতন কানের মধ্যে ঢুকলো। সুতপার মুখ লাল হয়ে গেলো রাগে। বেশ বাজখাঁই গলায় বললো, দরকার হবে না।
আমিই খুঁজে নিতে পারবো।
-হ্যাঁ তা তো পারবি! যা তোর মোহিনী রূপ। কত নাগর যে ফেঁসেছে, এসেছে…
– সাবধান রেবাদি, তুমি যদি আর একটাও বাজে মন্তব্য কলো আমিও কিন্তু বলবো। তখন বলো না ছোট মুখে বড় কথা বলছি।
– কী বলবি রে তুই! কী বলবি, বল!
তোমার মোহিনী রূপের কীর্তি। পরকীয়া প্রেম পর্বের কাহিনি। ভাবছ আমি বুঝি কিছু জানি না।
চুপসে যায় রেবা রায়। কাটা ঘুড়ির মতো গোত্তা খেয়ে বসে পড়ে নিজের টেবিল। মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করে ঝিম মেরে যায়। সুতপাও এসে আবার নিজের টাইপ মেশিন বসলো। একটি কাগজ লাগিয়ে খটখট শব্দ তুললো। কিছুতেই সুতপার অফিসে মন বসছিল না। কোকিলটা আবার ডাকতে শুরু করেছে। কান পেতে কিছুক্ষণ ডাকটা শুনতে শুনতে মেশিনের পরে মাথাটা রেখে চোখ দুটো বন্ধ করল। কুহু কুহু ডাকে আকণ্ঠ ডুবে গেলো।
-সুতপা দি, আপনার ফোন। বড় সাহেবের ঘরে।
-আমার ফোন? আমাকে কে ফোন করবে?
-আমি কী করে জানবো বলুন। একগাল হেসে বড় সাহেবের পিওন অজিত চলে গেল।
কাঁপা-কাঁপা হাতে রিসিভার তুলে কানে দিতেই চমকে উঠলো সুতপা। হিমাদ্রী। বুকের মধ্যে ছলকে উঠলো একটা খুশি। বুঝি এরকম একটি ডাক শোনার জন্যে ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছিল সুতপা। অস্ফুটে কোনোরকমে বললো এখুনি ! সুতপার অবস্থা দেখে বড় সাহেব বললেন, এনি প্রবলেম মিস?
– নো স্যার। মাই রিলেটিভ…
-সান্যাল।
-আই মিন, কোনো বিপদ টিপদ হয়নি তো! না, না স্যার, মায়ের একটা ওষুধ পাওয়া যাচ্ছিল না। সেটা পাওয়া গেছে। ফোনে….
– ঠিক আছে, বড় বাবুকে বলে চলে যান।
ঝট করে একটা মিথ্যে সাজিয়ে দিলো সুতপা। নারীর ছলনা দেবতারও অজ্ঞাত। তাও সুন্দরী, সদ্য যৌবনা নারী। কুমারী।
মনে মনে সুতপা একটু লজ্জা পেলো। জীবনে এই প্রথম এমন একটা অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে মিথ্যে বললো। মিথ্যে বলার অভ্যাস না থাকলেও কিভাবে যে বলে ফেললো, সেটা ভাবছে মনে মনে।
তাড়াহুড়ো করে ব্যাগটা নিয়ে বড়বাবুকে কাছে এলো সুতপা। বড়বাবুকেও ভুজুং-ভাজং দিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে গেলো।
চাঁদনি বাস স্টপে এসে দাঁড়ালো সুতপা। হিমাদ্রী ফোনে অপেক্ষা করতে বলেছে। ঠিক দেড়টায় আসবার কথা। সুতপা বারবার ঘড়ি দেখছে। মুখে যথারীতি এক গভীর উৎকণ্ঠা। একটা অদৃশ্য ভয় শিরশির করছে বুকের ভেতরে। চারদিক চোরা চোখে দেখছে। যদি পরিচিত, কেউ দেখে ফেলে!
হিমাদ্রীর গলা বেজে উঠল আচমকা। কী অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলাম নাকি।
লজ্জায় লাল হয়ে উঠল সুতপার মুখ। আমতা আমতা করে বলল, না, না। এই তো সবে এসেছি।
কয়েকমাস হলো হিমাদ্রীর সঙ্গে সুতপার পরিচয় হয়েছে। পাতাল রেলের রবীন্দ্রসদন স্টেশনে। এসক্লেটরে উঠতে গিয়ে সুতপার হাই হিল স্যান্ডেলের স্ট্র্যাম্প ছিঁড়ে যায়। পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিল হুড়মড়িয়ে। হিমাদ্রী পাশ থেকে আলতো হাতে সুতপার পলকা শরীরটা ধরে নেয়। লজ্জায় সুতপার টকটকে ফর্সা মুখ পাণ্ডুবর্ণ হয়েছিল।
অনেক চেষ্টা করেও সুতপা নিজেকে সংযত রাখতে পারেনি। একটু একটু করে নিজেকে মেলে ধরেছিল। হিমাদ্রীর সামনে। হিমাদ্রীর স্পর্শ তার শরীরের সব তার একসঙ্গে বাজিয়ে দিলো। বেজে উঠবো জীবনবীণা সপ্তসুরে। আজকাল প্রায়ই অফিসে আসার পথে রবীন্দ্রসদন স্টেশনে অপেক্ষা করে সুতপা। হিমাদ্রীও৷
সুতপা টের পায় ইদানিং হিমাদ্রীর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছেটা খুব বেড়ে যায়। বাড়ি ফিরেও সমস্ত শরীর-মনে হিমাদ্রীর জন্যে একটা ভালো লাগা জেগে থাকে।
মুখ ফুটে কেউ কাউকে বলেনি মনের কথা। ভালোলাগা, ভালোবাসার কথা। তবু একটা ঘোর, একটা আবেগে ভাসছে দুজনে। ভাসতে ভাসতে হয়তো খুঁজে পাবে বন্দর। নোঙর করবে জীবন জাহাজ ।
হিমাদ্রীর ডাকে চমক ভাঙে সুতপার। সুদৃশ্য একটি ছোট্ট প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো, এই উপহারটার জন্য তোমাযকে ডেকেছি।
-উপহার!
-হ্যাঁ।
-কিসের জন্যে!
– ধরো তোমার জন্মদিন।
-আমার জন্মদিন। আমি জানলাম না!
-থাক। অত জেনে-টেনে কাজ নেই। আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই দিলাম।
-তা তুমি আমার অফিসের ফোন নম্বর কোথায় পেলে?
-বাঃ পাওয়া কী এমন কঠিন কাজ বলো তো!
-না আমি তো দেইনি। আমার অফিসের কাউকেই তো তুমি চেনো না। তবে পেলে কিভাবে।
-শোনো আমিও একজন সরকারি কর্মচারী। সুতরাং একটু বুদ্ধি খরচ করলেই পাওয়া যায়। থাক ওসব থাক। চলো একটু আউরাম ঘাটে গিয়ে বসি আজ। বেশ নিরিবিলি।
-আমি যে অফিসে একটা মিথ্যে বলে এসেছি।
-কী মিথ্যে। প্রেম করতে যাচ্ছ না তাই তো!
-যাঃ, ইয়ার্কি না। তোমার ফোন পেয়ে বেশ অবাক হয়েছিলাম। সাহেবের চেম্বারে তো। নার্ভাস লাগছিল। সাহেব জিজ্ঞাসা করতে মিথ্যে বলে ফেললাম। মায়ের অসুখ। একটা ওষুধের জন্যে রিলেটিভ ফোন করেছে।
– রিলেটিভ? হা হা করে হাসতে লাগলো হিমাদ্রী।
-কেন তুমি আমার রিলেটিভ নও?
-তাই বুঝি ?
-আহ্ খুব না। দেখাচ্ছি মজা। কথাটা শেষ করেই হিমাদ্রীর পেটে জোরে চিমটি কাটে সুতপা ।
-ঠিক আছে, বলে হিমাদ্রী সুতপার মসৃণ গ্রীবায় আলোত ডান হাতের তর্জনী বুলিয়ে দিলো। প্রথম নিবিড় পুরুষালি স্পর্শে সুতপার শরীর খুশিতে ভরে উঠলো কানায় কানায়। দারুণ এক রোমাঞ্চে সারা শরীর ছুটতে লাগলো। সুতপা বেশ বুঝতে পারছে হিমাদ্রীর দৃপ্ত পুরুষালি গন্ধে বুঁদ হয়ে যাচ্ছে তার সমস্ত সত্তা। পুরুষালি ঘামের গন্ধের সঙ্গে পারফিউমের মিশ্র গন্ধে যে কী গভীর মাদকতা, সুতপা আগে টের পায়নি। সুতপা বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো। হিমাদ্রীর ডান বাহুর স্পর্শে উষ্ণ কোমল স্তন তিরতির কাপছিল। দারুণ লাগছিল সুতপার। প্রথম প্রথম হিমাদ্রী বুঝতে পেরে বেশ লজ্জা পাচ্ছিল। একটু সরে সরে যাচ্ছিল।
বাচ্চা ছেলের মতো হিমাদ্রী সুতপার স্তন থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো। গরম তাওয়ার মতো ছেঁকা লাগলো তার হাতে।
ধীর পায়ে সুতপা হিমাদ্রীর সঙ্গে হাঁটতে লাগলো। রাজভবনের পাশ দিয়ে আকাশবাণীর সামনে জেব্রাক্রসিংয়ের মুখে একটু দাঁড়ালো। রোদের তির্যক ফলা রাজভবনের গাছে গাছে লুকোচুরি খেলছে। নানান পাখির কলকাকলির সঙ্গে পাতার মর্মর। মিষ্টি ফুলের একটা গন্ধ মাঝে মাঝে সুতপার নাকে লাগছে। অন্য মনস্কভাবে সুতপা রাজভবনের বাগানের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। বিস্ময়ঘেরা চোখে সুতপা বললো, কলকাতার এই জায়গাটা কী সুন্দর না?
-হ্যাঁ দারুণ।
-আমরা কাজের চাপে কিন্তু খেয়াল করি না, কলকাতা কিন্তু একটু একটু করে বদলাচ্ছে।
-হু। বদলাচ্ছে মানে তিলোত্তমা হয়ে উঠছে। সত্যিকারের তিলোত্তমা।
-সত্যি তাই। অথচ আমরা খেয়াল করি না। একটু বৃষ্টিতে জল জমেছে, কী বদনাম শুরু করে দেই কলকাতার ।
সুতপার কথা শেষ হতেই রাজভবনের গাছে একটা কোকিল ডেকে ওঠে। আবার কোকিলের ডাক শুনে সুতপা কেমন যেন তন্ময় হয়ে গেলো। আজ কোকিলের এই ডাক যেন তার রক্তে উন্মাদনা বাড়িয়ে দিয়েছে। হাজারটা ঘোড়া ছুটছে তার সমস্ত শরীরে।
-কী হলো? জিজ্ঞাসা করে হাতটা ধরলো সুতপার। পরম নির্ভরতার সুতপাও হিমাদ্রীর হাতটা ধরে। পুরোপুরি যেন সঙ্গে দিয়েছে নিজেকে। ভীষণ ঘনিষ্ঠ হয়ে হাঁটছে দুজনে। সুতপার এখন আর অন্যদিকে কোনো খেয়াল নেই। খেয়াল নেই আশে-পাশের লোকজনদের। এক অন্য তন্ময়তা আনন্দ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে সুতপা।
সুতপার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল হিমাদ্রীর শরীরের ওপর ভার ছেড়ে দিতে। ক্রমশ শরীরটা একাত্ম হয়ে যাচ্ছে হিমাদ্রীর সঙ্গে। এ এক অন্য বোধ, অন্য অনুভূতি, রাস্তা বলেই হয়তো সুতপা আবার একটু সরে সরে হাঁটতে লাগলো। রাস্তা পার হতেই সুতপার চোখে মুখে গঙ্গার ঠাণ্ডা একটা হাওয়ার পরশ লাগলো। সুতপা বেশ বুঝতে পারছিল ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল পরতে পরতে। একটা খুশি ফুটে উঠছিল সুতপার মুখে।
দূর থেকে সুতপা গঙ্গা দেখতে পেলো। গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে রুপোর জলের মতো চিকচিক করছে জলধারা। কাছে আসতেই শুনতে পেলো কুলকুল জলরাশি যেন ঝুমঝুম বাজছে।
অলস দুপুরে হিমাদ্রীর গায়ে হেলান দিয়ে সুতপা অবাক চোখে গঙ্গা দেখছিল। কানের কাছে হিমাদ্রী মুখ দিয়ে ফিসফিস করে বললো, কী দারুণ না?
-ই, ভাবতেই পারছি না এত সুন্দর একটা শহরে দৈনন্দিন আমাদের ছুটে আসতে হয়।
-ছুটে আসি, অথচ শহরটার পরতে পরতে যে সৌন্দর্য তাকে দেখার না।
-একটু অবকাশ আমরা পাই না।
-তোমার সাথে এভাবে না এলে আমিও কি শহরটাকে চিনতাম ।
হিমাদ্রী সুতপার ব্যাগ থেকে উপহার প্যাকেটটা বের করলো একটানে। রঙিন মোড়ক খুলে একটা বাক্স। তার ভেতর থেকে ছোট একটা সেলফোন। সেলফোনটা সুতপার হাতে দিয়ে বললো, এটা আজ থেকে আমাদের দূরত্ব দূর করবে। যখন যার ইচ্ছে হবে ইচ্ছে মতো কথা বলা যাবে। আমার সেলফোনের। নাম্বার এই যে লোড করে দিয়েছি।
সুতপার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে হিমাদ্রী দাঁড়ালো। হাতে ধরে মোবাইল অপারেটিং শেখাচ্ছিল হিমাদ্রী। একরত্তি সেটটা চোখের কাছে তুলে গঙ্গার দিকে তাক করে ছবি তুলছিল। আলতো আঙুল দিয়ে সুতপার আঙুলে চাপ দিয়ে মোবাইলে চাপ দিল। হিম একটা শব্দ হলো। স্ক্রিনে ধু ধু জলরাশি। সুতপা বেশ মজা উপভোগ করছিল।
ধীরে ধীরে সুতপার শরীরের সঙ্গে হিমাদ্রীর শরীর মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। মেয়েলি হরমোনের গন্ধের সঙ্গে একটা উগ্র পারফিউমের গন্ধে হিমাদ্রী কেমন যেন বুঁদ হয়ে যাচ্ছিল। অপটু হিমাদ্রী ভয়ে ভয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে সুতপার মুখটা নিজের মুখের কাছে টানলো। সুতপার মুখে বিন্দুমাত্র ভয়ের ছোঁয়া ফুটলো না। বরং অদ্ভূতরঙা অপটু ঠোঁটটা এগিয়ে দিলো বাচ্চা পাখির ঠোঁটের মতন।
হু হু করে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে পড়লো দুজনের শরীরে। গরম তাপে পুড়ে যাচ্ছে সুতপার বুকে সদ্য ফোঁটা দুটি পদ্মকুঁড়ি স্তন। বাচ্চা ছেলের মতো হিমাদ্রী সুতপার স্তন থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো। গরম তাওয়ার মতো ছেঁকা লাগলো তার হাতে।
এক টুকরো রোদের মতো হলুদ আঁচলের ওড়াউড়ি দেখতে দেখতে স্টেশন গহবরে নেমে গেলো হিমাদ্রীও।
হিমাদ্রীকে পুরোপুরি সঁপে দিয়েছে সুতপা। সুতপাও হিমাদ্রীকে। আশ্চর্য এক তৃপ্তির স্বরে সুতপা বললো, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে আমি একবারও যাইনি জান!
-তাই!
-হুঁ।
-আগামী সপ্তাহে তবে ভিক্টোরিয়া…
-খুব আহ্লাদ না?
-বাঃ, তুমিই বলবে, আর আমি বললেই দোষ!
-না, না পরে। এখনি আর নয়।
-কেন ?
-অফিস কেটে এভাবে বের হলে সবাই খুব নিন্দে করবে।
-বেশ তবে ছুটির পর…
-না। মা খুব অসুস্থ। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হয় আমাকে। মা চেয়ে থাকে। সুযোগ করে আমি জানাবো। এখন তো মোবাইল দিলে। তখন কথা হবে।
সুতপা বেশ হাসলো। মুখে তার এক সমুদ্র হাসি। হলুদ শাড়ির আঁচ উড়ছিল হাওয়ায়। বারবার ওড়া চুলে মুখটা ঢাকা পড়ছিল। সুতপার কথা শুনে হিমাদ্রীর একটা কবিতা মনে পড়ে গেলো। তার কলিগের লেখা,
কথার দাম কমে গেছে
ল্যান্ড ফোন পুরনো এখন চিঠির মতন;
রাংচিতা গাছের বেড়ার উঠোনে লেটার বক্স
টেবিলে ফোন সেট নির্বাক-
মোবাইল নম্বর চায় সকলেই,
ভ্রাম্যমান কথারা মাছির ডানায় ওড়ে
গড়াগড়ি খায় বাজারে কসাইখানায়…’
হিমাদ্রী ভাবলো মোবাইলটা কি তবে দুজনার মধ্যে দেয়াল তুললো। আবেগ ইচ্ছা সব কি তবে নিয়ন্ত্রিত হবে ওই ওটুকু একটা যন্ত্রে। রক্ত মাংসের শরীর তার কী কোনো আলাদা অস্তিত্ব আর থাকবে না! শিউরে উঠলো হিমাদ্রী। মোবাইলটা উপহার দিয়ে কি তবে সে একটা ভুল করে বসলো। মস্ত বড় ভুল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে সুতপা ভাবলো, এটা দেখলে রেবা রায়ের খুব হিংসা হবে। রেবা রায় ভাববে সুতপা নিশ্চয়ই মনের মানুষ নিজেই খুঁজে পেয়েছে। তাকে দরকার হয়নি। ভীষণ জেলাস হবে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে গর্বভরে সুতপা মোবাইলটার গায়ে আলতো হাত বোলাতে লাগলো। খুশিতে চোখ চিকচিক করে উঠলো সুতপার। আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছলো। ধরা গলায় বললো, চল বাড়ি ফিরতে হবে না বুঝি।
—হুঁ চলো, কথাটা বলে হিমাদ্রী পা বাড়ালো। হাঁটতে গিয়ে টের পেলো পা দুটো বেশ ভারী লাগছে। কোনোমতে হেঁটে এসপ্লানেড স্টেশনের সামনে এলো। সুতপা বললো, আমি আগে যাই। তুমি পরে এসো।
বিহ্বল হিমাদ্রী বললো, কেন?
-বারে কেউ যদি দেখে ফেলে, কী ভাববে বলো তো?
-কী আর ভাববে। বলবে প্রেম করেছে।
-না, না। তুমি পরে এসো।
কোনোমতে কথাগুলো বলে সুতপা তর তর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো মেট্রো গহ্বরে। আলো-আঁধারে মুহূর্তে মিলিয়ে গেলো সুতপা। এক টুকরো রোদের মতো হলুদ আঁচলের ওড়াউড়ি দেখতে দেখতে স্টেশন গহবরে নেমে গেলো হিমাদ্রীও।