ভদ্রমহিলা প্রায়ই আসেন।
নির্দিষ্ট সময় নেই। তবে নির্দিষ্ট টেবিল আছে। একদম কোণের দিকে নয়। দেয়ালের দিকে, মাঝামাঝি তিন চেয়ারের একটা টেবিলে বসেন। মাঝে মধ্যে ওই টেবিলে কাস্টমার থাকলে তাকে কেমন হতাশ মনে হয়। আমিও তাই চেষ্টা করি তাকে ওই নির্দিষ্ট টেবিলে বসতে দিতে। কখনো, ওয়েটিং সিটে বসাই। আগের কাস্টমার চলে গেলে তাকে বসাবো বলে। বেশিরভাগ সময় আমিই তার খাবার সার্ভ করি।
এই রেস্টুরেন্টে ওয়েটার হিসেবে কাজ নিয়েছি প্রায় তিন বছর হতে চললো। তখন থেকেই তাকে দেখছি। হাবিব, আমার সহকর্মী, আমার চেয়ে কিছু আগে এখানে এসেছে, যার সঙ্গে আমার সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক। একই মেসে থাকি। সেও একদিন কথায় কথায় বলছিল, আমি এখানে কাজ নেওয়ার সময় থেকেই তাকে আসতে দেখছি।
রেস্টুরেন্টটা দোতলা। আমি আসার আগে হাবিব দোতলায় কাজ করতো। এখন একতলায় চলে গেছে।
ভদ্রমহিলার বয়স বোঝা যায় না। কোনোদিন মনে হয় আটাশ, ত্রিশ, কোনোদিম মনে হয় পঞ্চাশ-ষাট! তিনি একাই আসেন। সঙ্গে কাউকে কখনো আসতে দেখিনি। তবে মাঝে-মধ্যে, খুবই কম যদিও, কোনো তরুণ বা তরুণী এসে তার পাশে বসে। সন্তান নয়, সেটা বোঝা যায়। কিন্তু তারা কারা, সেটা চেষ্টা করেও আবিষ্কার করতে পারেনি আমার কৌতূহলী মন!
রাসেলের কথা শেষ না হতেই হাবিব রাগি কণ্ঠে বললো, একদম আজে বাজে কথা কইবি না। থাপড়াইয়া সব দাঁত ফালাইয়া দিমু।
প্রথম প্রথম আমি খুবই বিরক্ত হতাম। দুটো পুরী কিংবা একটা সাদা রুটি আর এক কাপ চা নিয়ে ঘণ্টাখানেক বসে বসে মোবাইলফোন টিপছেন। আমার খুব রাগ হতো, এটুকু খাবার নিয়ে এত দীর্ঘ সময় টেবিল আটকে রেখেছেন বলে!
এমন নয় যে সব টেবিল লোকে ভর্তি তার জন্য কেউ বসতে না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে, বরং অনেক টেবিল খালি এবং শূন্য পড়ে থাকা সত্ত্বেও আমার খুব রাগ হতো, কেন জানি না। মনে মনে ভাবতাম, আমি যদি কখনো তার খাবার পরিবেশনের দায়িত্ব পাই, তাহলে ঠাণ্ডা চা আর ন্যাতানো পুরি দেবো। যেন তিনি রোজ রোজ এভাবে এসে টেবিল দখল করে বসে না থাকেন!
যখন হাবিব নিচে চলে গেলো আর ওপরতলায় পরিবেশনের ভার আমার ওপর পড়লো, তখন আমি ঠিক তাই করলাম। ভদ্রমহিলা সেদিন এক কাপ চা আর একটা নান চাইলেন। তখন বিকাল সাড়ে চারটের মতো বাজে। সবে মধ্যাহ্ন ভোজে পাট শেষ হয়েছে। রেস্টুরেন্ট প্রায় ফাঁকা। ঠিক ওই সময় ভদ্রমহিলা এলেন। আমি মনে মনে তাকে একটা উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবছিলাম। আর তিনিও যথারীতি এক কাপ চা আর একটা নান রুটি অর্ডার করলেন। আমি একটা সকালের তৈরি নান ওভেনে গরম করে নিলাম আর একটা অপরিষ্কার কাপে (যেটার চারপাশে পানি আর চা লেগে ছিল) চা এনে দিলাম। ভদ্রমহিলা চা-টা দেখেই পিরিচ ধরে একটু দূরে ঠেলে দিলেন। তারপর চশমার ওপর দিয়ে আমার দিকে একবার তাকিয়ে নান রুটি টুকরো করলেন। আমি দূর থেকে তার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। কী ঘটে দেখার জন্য। তবে তিনি যে কমপ্লেইন করবেন না, সে ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম। কারণ তিনি সব সময় চুপচাপ আসতেন এবং চুপচাপ যেতেন।
আমি লক্ষ করলাম তিনি রুটি টুকরো করে টিস্যু দিয়ে হাত মুছে ফেললেন। কোনো রুটি মুখে দিলেন না। ব্যাগ থেকে মোবাইলফোন বের করলেন। টিপতে শুরু করলেন। তার একাগ্রতায় বিঘ্ন ঘটাতে আমি বেশ কয়বার জিজ্ঞেস করলাম, ম্যাডাম, আর কিছু লাগবে? ম্যাডাম, চা কি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে? চা দেবো আরেক কাপ? ম্যাডাম পার্সেল নেবেন না কি কিছু? প্রতিবারই ভদ্রমহিলা মৃদু স্বরে বললেন, না লাগবে না। লাগলে বলবো।
একসময় যখন বিল চাইলেন আমি মনে মনে নিশ্চিত তিনি আর এখানে আসবেন না। কিন্তু বিল মেটানোর পর চেঞ্জ ফেরত দিতে গিয়ে ভদ্রমহিলার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টিপস পেয়ে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। পরে হাবিবের কাছে জানলাম ভদ্রমহিলা যাই খান না কেন, বরাবরই ভালো টিপস দেন।
আমি ভীষণ লজ্জা পেলাম। একইসঙ্গে তাকে খারাপ খাবার পরিবেশনের জন্য আমার অনুশোচনা হতে লাগলো। যতদিন তিনি আবার না এলেন ততদিন আমি আত্মগ্লানিতে ভুগছিলাম। কেন আমি এমন করলাম? তিনি তো কোনো ক্ষতি করছিলেন না। কিছুটা সময় শুধু বসে থাকতেন! এরপর তিনি যখন আবার আসতে শুরু করলেন, আমি খুব যত্ন নিয়ে তার খাবার পরিবেশন করতে লাগলাম।
দিনগুলো বয়ে যাচ্ছিল আপন গতিতে।
মাঝে মাঝে তিনি আমার সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা বলতেন। যেমন বাড়ি কোথায়? কে কে আছেন বাড়িতে? সামনের ঈদে আমি বাড়ি যাবো কি না। এমন সব প্রশ্ন করতেন। তার কণ্ঠস্বরটি ভারি মিষ্টি আর কথা বলতেন খুব মিষ্টি করে। তিনি কথা বলার পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত একটা ভালো লাগার রেশ আমাকে ঘিরে থাকতো। তার সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন জাগতো আমার মনে। কিন্তু সে সব প্রশ্ন করার সাহস এবং যোগ্যতা কোনোটাই আমার নেই। আমি নিতান্তই একটা হোটেল বয়! তিনি সম্ভ্রান্ত ভদ্রমহিলা। সম্ভবত উচ্চবিত্তও।
ভদ্রমহিলা হেঁটে আসতেন এবং হেঁটে যেতেন। তার হাঁটার ভঙ্গিটি দেখলে মনে হতো শক্ত লোহার পাতে তৈরি। ঋজু এবং অটল। তাকে দেখলেই মনের মধ্যে একটা সম্ভ্রম জেগে উঠতো।
সেটা ছিল বর্ষামুখর এক বিকেল। অঝোর বৃষ্টি। কাস্টমার নেই। আমরা কয়েকজন ওয়েটার হোটেল কিচেনের পাশে আমাদের চেঞ্জ রুমে বসে গল্প করছিলাম। হোটেলের কর্মীদের জন্য আলাদা রান্না হয়। কিন্তু আজ কাস্টমার না থাকায় দুপুরে আমাদের মাটন খিচুড়ি দেওয়া হয়েছিল। খিচুড়ি খেয়ে হাসফাঁস করা আমরা চায়ের জন্য আকুলি-বিকুলি করছিলাম। কিন্তু আমাদের হোটেলের চায়ের কারিগর নিয়ম ভাঙতে রাজি নন। চারটের আগে তিনি কোনোমতেই চুলোয় চা চাপাবেন না।
আমরা হোটেলের কিছু নিয়মিত কাস্টমার নিয়ে কথা বলছিলাম। কথা প্রসঙ্গে সেই ভদ্রমহিলার কথা উঠলো। হাবিব ও আমি যথারীতি তার উদারহস্তের প্রশংসা করছিলাম। কিন্তু আমাদের সঙ্গে থাকা অন্যেরা হাসাহাসি করছিল। তাদের মতে মহিলাটি পাগল। সম্ভবত কোনো পুরুষের কাছে প্রতারিত হয়ে বিয়ে করেননি বলে সন্দেহ পোষণ করলো একজন। আবার একজন বললো হয়ত বিধবা। স্বামী মারা গেছে। সন্তানেরা কাছে নেই। একাকিত্ব দূর করতে হোটেলে এসে বসেন। তবে এর মধ্যে রাসেল খুব বিশ্রী একটা কথা বলে বসলো, দ্যাখো যাইয়া কম বয়সে হোটেলে হোটেলে খদ্দের জোগাড় করতো, এই বয়সে খদ্দের পায় না। কিন্তু হোটেলে ঘোরার অভ্যাস বদলাইতে পারে নাই। রাসেলের কথা শেষ না হতেই হাবিব রাগি কণ্ঠে বললো, একদম আজে বাজে কথা কইবি না। থাপড়াইয়া সব দাঁত ফালাইয়া দিমু।
ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকালেন। তারপর মৃদু স্বরে বললেন, আমি চল্লিশ মিনিট ধরে বসে আছি। তোমাদের ডাকছি। অন্য টেবিলে যাচ্ছ, এ টেবিলে আসোনি কেন?
হাবিবের এমন ক্ষেপে যাওয়া দেখে অন্যেরা অবাক হয়ে তাকায়। রাসেলবিন্দু মাত্র ভড়কে না গিয়ে বলে, বাফরে! তর দেখি মহব্বত গইল্যা পড়তাসে। বাকিরা হো হো করে হেসে ওঠে।
হাবিব তার প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে গিয়ে সবার সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ে। হাবিবকে উত্তেজিত করতে কেউ কেউ রাসেলকে আরও উৎসাহিত করে। রাসেল উৎসাহ পেয়ে বাজে কথা বলার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে হাইব্যারে ওই মহিলা আম খাওয়াইসে লাগে! সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।
হাবিব চেঁচিয়ে ওঠে, ওই খানকির পোলা আর যদি হের নামে কিছু কস…
কী রে তোরে কচি পাইয়া দেখি দেওয়ানা কইরালাইছে…
হাবিব লাফিয়ে গিয়ে রাসেলকে ঘুষি বসিয়ে দেয়। রাসেলও উল্টো মার ফিরিয়ে দিতে দিতে বলে, শালা ট্যাংরা মাছ! পারবি আমার লগে?
রাসেল লম্বা, চওড়া, বড়সড়ো বেশ। হাবিব বরং হালকা পাতলা শুকনো। রাসেলের সঙ্গে মারামারিতে হাবিব কখনোই পারবে না, সেটা সহজেই অনুমেয়। আমি দ্রুত উঠে হাবিবকে টেনে সরাতে সরাতে বলি আয় তো। মারামারি করিস না। মালিকের কেউ দেখলে চাকরি যাইব। চাকরি পাওন কিন্তুক অত সহজ না।
ছোটখাটো গোলমাল, হৈ চৈ বেঁধে গেছে। প্রায় সবাই রাসেলের দলে। ঠিকই তো, ওই রকম বয়স্ক একটা মহিলা হোটেলে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে, এটা তো অবশ্যই দৃষ্টিকটু। বুড়া মানুষ। কাম কাজ না থাকলে ঘরে বইসা ধর্মকর্ম কর। হোটেলে বইসা থাকস ক্যান?
আমি হাবিবকে সরিয়ে আনতে ব্যর্থ হই। এরই মাঝে কে একজন ম্যানেজারকে খবর দিয়েছে। ঝগড়া থামল হাবিবের চাকরিচ্যুতির মধ্য দিয়ে। কারণ হাবিব আগে রাসেলকে আক্রমণ করেছে। আমি পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম। কিন্তু চাকরি যাওয়ার ভয়ে রাসেলের ভারী দলের বিপক্ষে হাবিবের হয়ে কিছু বলার সাহস আমার হলো না। আমি চুপচাপ দেখলাম, পাওনা টাকা গুনে নিয়ে রাসেলকে বিচ্ছিরি গালি দিয়ে হাবিব বেরিয়ে গেলো। পেছনে রাসেলদের ব্যঙ্গাত্মক হাসি পড়ে রইলো।
দিন কয়েক পর ভদ্রমহিলা এলেন। নির্দিষ্ট টেবিলে বসলেন। কেউ তার কাছে অর্ডার নিতে গেলো না। আমি যাবো কী যাবো না, ভেবে দ্বিধা করছিলাম রাসেলদের টিপ্পনি সহ্য করতে যদি না পারি, আমারও চাকরি চলে যাবে। চাকরি চলে গেলে আমি অথই সাগরে পড়ব।
ভদ্রমহিলা অনেক সময় বসে রইলেন। দুই তিনবার গলা চড়িয়ে এক্সিউজ মি বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেন। অন্য ওয়েটারেরা যথারীতি বিভিন্ন টেবিলে সার্ভ করা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। আমার খুব অস্বস্তি লাগছিল। শেষ পর্যন্ত আমি এগিয়ে গেলাম, সরি ম্যাডাম। কী দেবো বলেন?
আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম আমার অন্য সহকর্মীরা নিজেদের মধ্যে চোখে চোখে কথা বলছে, আমাকে কিছু নাজেহাল করার অভিপ্রায়ে।
আমি আবার অর্ডার চাইলাম।
ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকালেন। তারপর মৃদু স্বরে বললেন, আমি চল্লিশ মিনিট ধরে বসে আছি। তোমাদের ডাকছি। অন্য টেবিলে যাচ্ছ, এ টেবিলে আসোনি কেন?
সরি ম্যাম, আমি মৃদু স্বরে বললাম।
ভদ্রমহিলা ব্যাগটা হাতে নিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলেন।
আরও পড়ুন: সময়, প্রেম অথবা শরীর উপাখ্যান ॥ ফরিদা ইয়াসমিন সুমি