অনেক রাত হয়েছে। ফুড ক্যাসেল থেকে সবাই চলে গেছে। ঝাড়-মোছ করছে দুজন ওয়েটার। ক্যাশিয়ার বসে হিসাব করছেন। তার চশমাটা একটু ঢিলা। চোখে ঠিকমতো থাকে না। নিচে পড়ে যায়। বামহাত দিয়ে চশমাটা ঠিক জায়গায় রাখার জন্য বার বার চেষ্টা করছেন।
ক্যাসেলের ক্যাম্পাসে এখনো কিছু মানুষ হাঁটাচলা করছে। কিছুটা গম্ভীর। অনেকটা সাবধানে। এক বৃদ্ধ বসে আছেন বৈদ্যুতিক আলোর শেষ মাথায়। গাছের পাতার ছায়াঘন জায়গাটায়।
ক্যাসেলের পাশেই একটা হোস্টেল। হোস্টেলের সবাই ঘুমিয়ে গেছে। কেবল একটা রুমের জানালায় আলো জ্বলছে। রুমে দুজন থাকে। তারা রাতে ঘুমায় না। ক্যাসেলের ক্যাম্পাসে সারা রাত ঘোরাঘুরি করে। তাদের দুজনেরই খালি গা। পরনে শুধুই লুঙ্গি। পায়ে কোনো জুতো নেই। একজনের হাতে গিটার। অন্যজনের হাতে একটা প্যাড ও কলম।
সবাই চলে গেলে বৃদ্ধের একা একা বসে থাকতে ভালো লাগে। রাতের নিস্তব্ধতা তাকে একধরনের সম্মোহনী শক্তিতে আচ্ছন্ন করে রাখে। দেখতে নেশাখোর লাগে না। চেহারায় বিশেষ ধরনের মার্জিত ভাব আছে। পকেটে থাকে হাই কোয়ালিটির সিগারেটের প্যাকেট। তাতে নেশা হয় না। প্রতিরাতে নেশার জন্য তার একটা ফেন্সিডিলের দরকার হয়।
লুঙ্গি পরা ছেলে দুটো এদিকে এলো। একজন শাওন। পড়ে ঢাবির ইকোনমিক্সে। গানের গলা খুব ভালো। তার মাথায় একটা ব্যান্ডদল গড়ার চিন্তা-ভাবনা আছে। অন্যজন আরিফ। পড়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। কবিতা-গান লেখে। এগুলোকে কণ্ঠে আর গিটারে তোলে শাওন।
তারা প্রতিরাতে এখানে বৃদ্ধকে মাতাল অবস্থায় দেখতে পায়। আজ এখনো মাতাল হননি। হবেন। প্রতিরাতে মাতাল হওয়ার আগে অনর্গল বকবক করেন। আজও করছেন। শাওন বলল- গতমাসে লোকটা আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল।
তুই জানলি কিভাবে?
পত্রিকায় দেখলাম।
কেন?
ফ্রাস্টেশন।
শেষ বয়সে?
বৃদ্ধরাই তো হতাশ বেশি।
ভুল বলেছিস্। বৃদ্ধেরা তো আশাহীন। যাদের কিছু নেই; তারা হতাশ হয় কিভাবে?
আরিফ একটু চুপ করে থেকে বলল,
কিসের হতাশা বৃদ্ধের?
কোনো কিছুর না।
কী করে বুঝলি?
এই জন্য যে, লোকটার টাকা-পয়সার অভাব নেই।
একটু দূরের বেঞ্চে বসে তারা বৃদ্ধকে লক্ষ করছে। আশপাশের সব বেঞ্চই খালি। শুধু একটা বেঞ্চে বসে আছেন বৃদ্ধ। তার ডানহাতে ফেন্সিডিলের বোতল। ঢক ঢক করে মুখে ঢেলে দিচ্ছেন।
দুজন ওয়েটার সব কাজ গুছিয়ে দেয়ালঘেঁষা একটা টেবিলে বসে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে বৃদ্ধের ওপর। কারণ বৃদ্ধ তাদের নিয়মিত কাস্টমার হলেও অতিরিক্ত বুঁদ হয়ে গেলে বিল না দিয়েই চলে যান। ক্যাশিয়ার চলে যাওয়ার সময় ওয়েটারদের বলে গেলেন, বৃদ্ধকে তোমাদের কাছে রেখে দিও।
একটা সবুজ জিপ বৃদ্ধের সামনে এসে থামলো। জিপভর্তি পুলিশ। তাদের ইউনিফর্মও সবুজ। দুজন কালো পোশাকের র্যাব। চোখে কালো চশমা। মাথায় চুল আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না। কালো কাপড় দিয়ে মাথা মোড়ানো। পরস্পর কী যেন বলাবলি করছে। একজন বললো, এই লোকটাই তো আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল?
অন্যজন বলল, কী করে বুঝলে?
বর্ণনা অনুযায়ী তা-ই মনে হয়।
ধরে নিয়ে যাব?
লাভ নেই।
কেন?
নেশা যাদের অভ্যাস তারা এমনিতেই মৃত। মৃতকে আজরাইলের (জেলহাজত) ভয় দেখিয়ে কী লাভ?
এভাবে ভাবলে তো দুনিয়াটাই একসময় জেলখানা হয়ে যাবে।
পুলিশ প্রধান বলল, যেকোনো সময় লোকটাকে ধরা যাবে। ড্রাইভার চলো।
হর্ন বাজাতে বাজাতে পুলিশের জিপ চলে গেল বৃদ্ধের নাকের ডগা দিয়ে। বৃদ্ধ ওয়েটারকে ডাকলেন। দুজন ওয়েটার। একজন বিবাহিত। অন্যজন এখনো প্রেমের নাগাল পায়নি। বিবাহিত ওয়েটার এসে বলল, কী লাগবে?
বৃদ্ধ অসহায়ের মতো তাকিয়ে বললেন, ফেন্সিডিল আছে?
আমরা রাখি না।
কী রাখো তাহলে! বৃদ্ধ উত্তেজিত হতে গিয়েও শান্ত গলায় বললেন, আমার নেশা দরকার। যা আছে তা-ই দাও।
মদ দেব?
দাও।
পকেটে টাকা আছে?
বৃদ্ধ ওয়েটারের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই সে চলে গেল। ফিরে গিয়ে তার সহকর্মীকে বলল, বৃদ্ধের মতলব সারা রাত্রের। অথচ আমার ঘুম পাচ্ছে। খুব ঘুম দরকার। দুদিন দুঃস্বপ্নের কারণে ঘুমাতে পারিনি। গতমাসে লোকটি আত্মহত্যা করলেই ভালো হতো। দু’গ্লাস মদ ঢেলে দিয়ে ওয়েটার আবার চলে আসল তার সহকর্মীর কাছে।
আরিফের কবিতায় গিটার বাজিয়ে শাওন সুর তোলার চেষ্টা করছে। শাওন আকাশের দিকে তাকিয়ে নতুন লিরিক খুঁজছে। মুদু বাতাস। গাছের পাতারা অল্প অল্প নড়ছে। এটা দেখতে আরিফের খুবই ভালো লাগে। শাওন গিটার থামিয়ে বললো,
রাতের নিস্তব্ধতার আলাদা একটা সুর আছে।
আরিফ চোখ নামিয়ে বলল, তা তো অবশ্যই।
শুনতে পাস।
হ্যাঁ, পাই। পাই বলেই তো রাত এত ভালো লাগে।
বৃদ্ধ মূলত বধির। সে এই সুর শুনতে পায় না। তবে বৃথা কেন রাত্রিযাপন!
আমরা প্রকৃতির সুর শুনি। সে হয়তো অন্য সুর খোঁজে।
তা ঠিক। কেন বৃদ্ধ আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল জানতে চাইলে কেমন হয়?
যদি অভদ্রতা হয়ে যায়।
হতে পারে।
আরিফ বললো, আমার কাছে বৃদ্ধের একটা ‘আত্মোপন্যাস’ আছে। তাতে আছে তার একডজন আত্মহত্যার ধারাভাষ্য। খুব লোমহর্ষক।
শাওন কৌতূহলের সুরে বলল, কেমন?
আরিফ বলতে শুরু করলো, আত্মহত্যার তিন দিন আগে থেকে সে প্রস্তুতি নেয়। একটা ঠিকানাহীন চিঠি লেখে। নতুন ব্লেজার পরিধান করে। যে রুমে আত্মহত্যা করতে চায়; সেটার নতুন দেয়ালে আয়না টাঙিয়ে রাখে। নিজের আত্মহত্যা নিজেই দেখার জন্য। তাছাড়া…
শাওন বললো, প্রতিবার তাকে কে বাঁচায়?
তা লেখা নেই।
নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা।
আরিফ আবার বললো, আত্মহত্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পর সে কিছু কবিতা লেখে। সবকটা কবিতার অনুলিপি বইটাতে আছে। খুব সুন্দর হাতের লেখা। একটা কবিতা এমন,
আমি মরে গেলে পৃথিবীর হবে না কিছুই
না হারাবে কোন রত্ন, না হবে জঞ্জাল সাফ
পৃথিবী আসলে মায়াশূন্য আলিঙ্গন।
দুজন পতিতা বৃদ্ধকে অতিক্রম করছিল। খুব অল্প বয়স ওদের। জীবনের জ্যামিতিক মারপ্যাঁচ এখনো ওরা বুঝে ওঠেনি। শুধু বোঝে বেঁচে থাকতে হলে টাকার দরকার। একটি মেয়ে বলল, প্রতিরাতে বৃদ্ধ কী চায়?
অন্যজন বলল, মনে হয় ব্যাডবডি।
কিন্তু কোনদিন তো চোখ তুলেও তাকায়নি।
সে তাকাবে কেন? ব্যবসাটা আমাদের। আমরা তাকে প্রলুব্ধ করব।
যাবো ওনার কাছে?
চল্।
আমরা ওনার মেয়ের মতো। যদি গ্রহণ না করেন।
কামনার ধর্ম বিচার-বিবেক মানে না।
মেয়ে দুটো বৃদ্ধের কাছে এগিয়ে এলো। তার মাথা নিচু। নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন। তবে এখনো সেন্সলেস হননি। একজন বলল, আর ইউ নিড টু ব্যাডগার্ল? দালালের শেখানো বুলি। খুব সুন্দর করে বলতে পারে ওরা।
প্রশ্ন শুনে বৃদ্ধ হকচকিয়ে গেলেন। ভ্রূ কুঁচকে কপালে ভাঁজ পড়লো। ষাট বছরের জীবনে এই প্রথম সরাসরি কোন মেয়ের আমন্ত্রণ পেলেন। অথচ চব্বিশ বছর বয়সে এক মেয়েকে চুমু খাওয়ার অপরাধে দু’বছর জেলে কাটাতে হয়েছে। মেয়েটি প্রেমিকা ছিল তার। সে অধিকারেই তাকে চুমু খেয়েছিল। তখন ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। ঢাকা শহরের মোড়ে মোড়ে বসানো ছিল সিসি ক্যামেরা। সেই ক্যামেরাতে ধরা পড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেওয়া তার জীবনের প্রথম চুমু।
জেল থেকে খবর পেয়েছিলেন প্রেমিকা আত্মহত্যা করেছে। কারো জন্য নয়। শুধু তার জন্য। আত্মহত্যার আগে একটি চিঠি পাঠিয়েছিল তার কাছে। তাতে লেখা ছিল, আমি লজ্জায়-ভয়ে কুকড়ে ছিলাম সেদিন। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাজটা করেছিলে তুমি। তাই প্রাপ্যটা ফিরিয়ে দিতে পারিনি। তবে জেনে রেখো, আমি অত কৃপণ নই। পাল্টা চুমু পাবে ওইপারে।
কেন আত্মহত্যা করলো সে? এ প্রশ্নের উত্তর বৃদ্ধ আজো পাননি। তখন থেকেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কোনো মেয়ের চুলের ঘ্রাণও নেবেন না কখনো। তা-ই হয়েছে। নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। আশ্চর্য হলেও সত্য, পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে কোনো মেয়ে প্রপোজ করারও সাহস পায়নি। অথচ শেষ বয়সে মৃত্যুর কাছাকাছি এসে তা-ই শুনতে হলো। লজ্জায়, অপমানে কাঁপতে কাঁপতে বৃদ্ধ মাটিতে লুটিয়ে পড়লনে। কী জবাব দেবেন প্রেমিকাকে?
এ দৃশ্য দেখে মেয়ে দুটো ভয়ে বৃদ্ধের কাছ থেকে দ্রুত সরে গেল।
ওয়েটার দুজনই সবগুলো তালা-চাবি নিয়ে সাঁটারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বৃদ্ধ বিল পরিশোধ করলেই সাঁটার লাগিয়ে দেবে। বৃদ্ধকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে অবিবাহিত ওয়েটার বলল, বৃদ্ধের নেশা মাত্রাচ্যূত হয়েছে।
বিবাহিত ওয়েটার বলল, তার উচিত এখনই বাসায় ফিরে যাওয়া।
কিছু মানুষ আছে বাসা থেকে খোলামেলা জায়গায় রাত কাটাতে বেশি পছন্দ করে। বাসা-বাড়ি শান্তির নীড় হলেও সবার জন্য না। সে-ও তেমন।
আমি আমার বাসা ছাড়া কোথাও থাকতে পারি না।
তুমি যে বৃদ্ধের মতো, তা বলছি না।
বোধ হয় বৃদ্ধের কেউ নেই।
সব থাকলেও কিছু মানুষ বৃদ্ধের মতো থাকতে ভালোবাসে।
বিবাহিত ওয়েটার হাই তুলতে তুলতে বলল, তুমি একা মানুষ। সারারাত থাকলেও তোমার ক্ষতি নেই। আমি চলি। আমার স্ত্রী আমার জন্য বিছানায় অপেক্ষায় থাকে। বলেই বিবাহিত ওয়েটার রাস্তায় নেমে গেল।
শাওন এবং আরিফ হেঁটে হেঁটে ওয়েটারের কাছে আসল। বৃদ্ধ মাটি থেকে উঠলেন আধা ঘণ্টা পর। জামা-কাপড় ঝেড়ে পরিষ্কার করে ওয়েটারের কাছে এলেন। বললেন, আরেক গ্লাস হবে?
ওয়েটার বলল, আজ আর না।
বৃদ্ধ পকেট থেকে টাকা বের করে বিল পরিশোধ করলেন। সেইসঙ্গে কিছু বখশিসও গুঁজে দিলেন ওয়েটারের হাতে। আরিফ বলল, আংকেল, আপনার ‘লাইভ সুইসাইড’র ওয়েব অ্যাড্রেসটা দেওয়া যাবে?
বৃদ্ধ ভড়কে গিয়ে বললেন, তোমরাও জেনে গেছ?
তারপর একটা প্যাডে অ্যাড্রেস লিখে দিয়ে বৃদ্ধ রাস্তায় নেমে পড়লেন। ওয়েটার, শাওন এবং আরিফ তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি পায়ে জড়তা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। তবে হাঁটার মধ্যে ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মানবোধ আছে।