দুপুর গড়িয়েছে। তবে বিকেল হতে অনেক দেরি। এ সময়টায়, দুপুরের খাওয়ার পর লোকজনের কাজেকর্মে খানিকটা ঢুলুনি আসে। অফিস-আদালতই হোক কিংবা বাজার-দোকান; সব জায়গাতেই এ সময়টায় কাজে একটু ঢিলেঢালা ভাব দেখা যায়। সুযোগ পেলে একটু ঝিমুনিও। শফিকুলের দোকানটাও এসময় খালি থাকে। ক্রেতা থাকে না বললেই চলে। আজকাল সাধারণত সন্ধ্যার দিকেই একটু দোকানে আসে শফিকুল। তাও নিয়মিত নয়। আগে অবশ্য দুপুরের ভাত খেয়ে একটু ঘুমাতো। সে সময় দোকানের বেচাবিক্রি দেখভাল করতো সুমন। শফিকুল ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা খেয়ে আসরের আজান পড়লে দোকানে আসতো ফের।
সুমন শফিকুলের দোকানের কর্মচারী। বিগত কুড়ি বছর ধরে শফিকুলের কাছেই আছে। দরিদ্র পরিবারের বাপ-মরা সন্তান। শহরে এসেছিল কাজের খোঁজে। ঐটুকু ছেলে, বয়স বড়জোর দশ কী বারো। একটা নির্মাণাধীন ভবনে হেলপারের কাজ করছিল। মাথায় করে এক একবারে ষোলো থেকে আঠারোটা খানা ইট তিন তলায় তুলতে হতো।
শফিকুল তখন বয়সে তরুণ। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় সন্তান। মাধ্যমিকটা টেনেটুনে পাস করেছিল। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকের ক্লাস শুরুর পরপরই সে বুঝেছিল পড়াশোনা তাকে দিয়ে হবে না। বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিল ছেলে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি-বাকরি করে সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু পড়াশোনা তো শফিকুলের মাথাতেই ধরে না। সে তাই বাবা-মায়ের মনে বিস্তর কষ্ট দিয়েই পড়াশুনার পাট চুকিয়ে কাজের ধান্ধায় নেমে পড়ে। গ্রামে কাজের সুযোগ কম। চলে আসে জেলা শহরে। নানান কাজে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে পৈত্রিক সম্পত্তির নিজের ভাগের জমিটুকু বিক্রি করে দোকানটা তখন দিয়েছে সবে।
মুদি দোকান। নাম আল্লাহর দান স্টোর। দোকানের মাথায় লাল বোর্ডে হলুদ রঙের বড় বড় অক্ষরে জ্বল জ্বল করে সে নাম। দূর থেকে চোখে পড়ে। চাল-ডাল-আটা-ময়দা-চিনি ইত্যাদি পাওয়া যায়। আশেপাশে মুদি দোকান একটাও নেই। তাই দোকান জমে উঠতে সময় লাগে না। দোকানের যাবতীয় কাজ শফিকুল একাই করে। মাল কিনে আনা, সাজানো, বিক্রি করা, লিস্ট করা, সদরে আড়তে গিয়ে মাল কিনে আনা, সব কাজ সামলাতে পেরে উঠছিল না। কিন্তু ছোট দোকান, সে মুহূর্তে মাইনে দিয়ে একজন কর্মচারী রাখার ক্ষমতা তার ছিল না। দোকানের আয় থেকে ভাড়া, বাড়িতে পাঠানো আবার নিজের সংসার চালানোর পর বেতন দিয়ে কর্মচারী রাখাটা যেন বিলাসিতা। তাছাড়া ততদিনে সে বিয়েও করে ফেলেছিল, দাদার পছন্দের মেয়ে রানিকে। খরচ তাই বাড়তির দিকেই কেবল।
তবুও শফিকুল মনে মনে আশা করছিল কেবল পেটেভাতে যদি একজন সাহায্যকারী পাওয়া যেতো। বেশি কাজ নয় শুধু শফিকুল যখন মাল কিনতে যায় বা কোনো কাজে যায়, দোকানটা যেন বন্ধ রাখতে না হয়। এক কাস্টমার দুই বার ফিরে গেলে আর আসবে না; এ ভয়টা সব সময় মনে কাজ করতো।
ঠিক তখুনি রাজপুত্তুরের মতো ফুটফুটে সুন্দর সুমনকে চোখে পড়ে শফিকুলের। বাসার দিকে যাচ্ছিল দুপুরের খাবার খেতে। সুমন তখন মাথায় ইটের বোঝা তুলছে, ফর্সা মুখ রোদে,তাপে,পরিশ্রমে টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। মুখটা একটু হা করে নিশ্বাস নিচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। তখন শেষ দুপুর, চৈত্রের গনগনে সূর্য তখনো তীব্র তাপ ঢালছে। ছেলেটাকে দেখে মায়া হয় শফিকুলের। আহা! ওটুকু বাচ্চা এত ভারী কাজ করছে! সে এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে। নাম পরিচয় জেনে নেয় । এক মা ছাড়া তার কেউ নেই । না আত্মীয়, না সম্পত্তি। এই হেলপারের কাজ করে নিজের খরচ মেটায়। গ্রামে মা লোকের বাড়ি কাজ করে কোনোমতে পেট চালায়। কথাগুলো শুনতে শুনতে হুট করে শফিকুল সিদ্ধান্তটা নিলো, এই ছেলেকে যদি পেটে-ভাতে কর্মচারী হিসেবে রাখা যায়, তাহলে মন্দ হয় না।
এক কথাতেই সুমন রাজি হয়ে গেলো। সুমনকে ওখান থেকে ছাড়িয়ে শফিকুল বাসায় নিয়ে আসে। দোকান থেকে মিনিট পাঁচেকের পথ, গলির ভেতরে ছোট্ট টিনের দুই কামরা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সংসার। সুমনকে পেয়ে রানি খুব খুশি । কারণ এখন মাঝে মধ্যে শফিকুল তাকে নিয়ে বাইরে যেতে পারবে।
সেই থেকে সুমন শফিকুলের দোকানে আছে। দশ বারো বছরের ছেলেটা এখন বত্রিশ বছরের তরুণ। শফিকুলের দোকান মূলত এখন সেই-ই চালায়। দোকান অবশ্য এখন অনেক বড় হয়েছে। আগে কেবল মুদি সামগ্রী রাখতো। এখন এখানে প্রসাধনী, খেলনাও পাওয়া যায়।
গত কুড়ি বছরে এলাকারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। একতলা, দোতলা বাড়িগুলো উধাও হয়ে আট তলা,দশ তলার সুউচ্চ বিল্ডিং উঠেছে। আগের মানুষ অনেকেই আর নেই। নতুন নতুন মানুষ এসেছে। দোকানের সামনের রাস্তা দিয়ে যেখানে কেবল দিনে একটা দুটা প্রাইভেট কার চলতো, এখন সেখানে প্রায়ই প্রাইভেট কারের জ্যাম লেগে যায়।
লম্বা হাই তোলে শফিকুল। সুমন ছুটিতে বাড়ি গেছে। সে ইতোমধ্যে বিয়ে করেছে। তার দুটো সন্তানও আছে। স্ত্রী সন্তান গ্রামেই থাকে। দোকান বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেটে-ভাতের সুমনকে মাইনে দিতে শুরু করেছিল শফিকুল। সে মাইনেও বছর বছর বেড়ে এখন ত্রিশ হাজার। শফিকুলের দোকানের সুনাম আছে। সঠিক মাপ, সঠিক মূল্য এবং ভালো জিনিস। প্রত্যেকটা কাস্টমারকে সমান গুরুত্ব দেওয়াই শফিকুলের দোকানের বৈশিষ্ট্য। কাস্টমারের বিশ্বাস-আস্থা একবার অর্জন করতে পারলে কোনো দোকানিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না।
সুমন খুব বিশ্বস্ত। সে দোকানটাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। আজকাল সুমনই দোকান চালায়। সেই-ই আড়ত থেকে মালামাল আনে। টাকা-পয়সার হিসাবও তার কাছেই থাকে। শফিকুল মনে মনে স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জানায়। যেন কর্মচারী নয়, ভাই হিসেবেই স্রষ্টা সুমনকে শফিকুলের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। নাহলে এই অসুস্থ শরীরে দোকান টিকিয়ে রাখা তার পক্ষে সম্ভবই হতো না।
শফিকুল দেখেছে নিপুণ হাতে কাজ সামলায় সুমন। সুমনের সবচে বড় সুবিধা হলো তার সুন্দর চেহারা। সে একটু হেসে কাস্টমারকে অপেক্ষা করতে বললে কেউ রাগ করে না। সুমনের মুখের দিকে তাকালে সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের মায়াও মন কেড়ে নেয়।
এ কথা-সে কথার পর আমজাদ আলী জানতে চায় শফিকুল কি অন্য কোনো ব্যবসা শুরু করেছে? তা না হলে সে কেন দোকানে বসে না আজকাল?
সুমন ছুটিতে গেছে। এক সপ্তাহের ছুটি। এত বড় ছুটি সে এতদিনে একবারও নেয়নি। এমনকী তার বিয়ের সময়ও না। এদিকে সুমনের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার কারণে বলতে গেলে শফিকুল সুমনের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে দোকানের ব্যাপারে। দোকানের পরিসর বৃদ্ধি পাওয়ায় আরেকজন কর্মচারী রাখতে চেয়েছিল শফিকুল। রেখেওছিল। পর পর দুজনকে সুমনই বাদ দিয়ে দিয়েছে। তার কথা বিশ্বস্ত নয়, এমন কাউকে দোকানে রেখে সে শান্তি পাবে না। যতদিন তেমন কেউ না জোটে ততদিন একাই সামলাবে ।
লম্বা লম্বা হাই তোলে শফিকুল। দুপুরে ঘুমিয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন এক কাপ চা খেয়ে ঘুম তাড়াতে হবে। বাসা কাছেই। প্রথম জীবনে যে বাসাটায় ছিল সে বাসার পাশেই পাঁচ শতাংশ জায়গা কিনে ছোটমতো একটা ঠাঁই তুলেছে শফিকুল। দুই মেয়ে আর স্ত্রী কে নিয়ে সেখানেই থাকে। ইচ্ছে ছিল দোকানে একটু লাভ বাড়লে বাড়িটা দোতলা করবে। এজন্য টাকাও জমাতে শুরু করেছিল। কিন্তু এরই মধ্যে অসুস্থতার কারণে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। তার ওপর বছর হতে চললো দোকানের আয়ও কমে গেছে। মাল বিক্রি হয় না। কাস্টমার কমে গেছে। প্রচুর মাল মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় ফেলে দিতে হয়েছে। জমানো টাকা ভেঙে মাল এনেছে কয়েক মাস আগে।
সুমন বলে, ভাইজান এখন সবাই সুপারশপে কেনাকাটা করে। এজন্য দোকান কম চলে। কিন্তু সুপার শপের জিনিসের মতো কিংবা তারচেয়েও ভালো জিনিস তার দোকানে অনেক কম দামে পাওয়া যায়। তাহলে লোকে কেন সুপারশপে যায়? ভেবে পায় না শফিকুল।
বেচাবিক্রি যে কমে গেছে সেটা আজ শফিকুল খুব ভালো মতোই বুঝেছে। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত তেমন কাস্টমার আসেনি। যারা এসেছে বেশিরভাগই ছোটখাটো জিনিস নিয়েছে। চাল, ময়দা বা চিনি এসব নেয়নি। দুয়েকজন তো বলেইছে, ভাই আজকাল সব দুই নম্বর মাল রাখেন কেন? আরেকজন বললো,সেদিন ময়দা নিয়ে দেখি সব জরা বেঁধে গেছে। মেয়াদোত্তীর্ণ। ফেরত নিয়ে আসলাম, আপনার কর্মচারী বাজে ব্যবহার করলো। ঠিক করেছি আর আসবো না আপনার দোকানে। আজ আপনাকে দেখে কথা বলতে এলাম।
শফিকুল বুঝতে পারে না, এমন অভিযোগেরর কারণ। ভাবে, সুমন এলে সমস্ত মালপত্র নামিয়ে দেখতে হবে। একা হাতে সামলাতে গিয়ে হয়তো সুমনের ভুল হচ্ছে।
ঘুম আর আটকানো যাচ্ছে না। শফিকুল দোকান থেকে বেরিয়ে গেটটা টেনে তালা দিতে দিতে ভাবে, বহুদিন পর সে এ কাজটা করছে। বিশ বছর আগের দিনগুলো তার মনে পড়ে। এমন শীত শীত ঝিম ধরা দুপুরগুলোয় ঠিক এমনই সময়ে সে ভাত খেতে বাসায় যেতো। রানি খাবার সাজিয়ে বসে থাকতো। মাছের মুড়োঘণ্ট বা মুরগির ঝাল কখনো ভুনা গরু; এসব উপভোগের সময় কই। শফিকুল কেবল নাকে-মুখে দুটো গুঁজে ছুটতো দোকানে। এরপর সুমন এলে, সুমন আগে খেয়ে আসতো। এরপর শফিকুল যেতো। এখন সুমন আর যায় না। বাসার কাজের লোক টিফিন বক্সে করে সুমনের খাবার দোকানেই দিয়ে যায়। বরাবরের মতো দোকানের সঙ্গে লাগোয়া স্টোর রুমের ছোট চৌকিতে রাতে ঘুমায় সুমন। স্টোর রুমটা অবশ্য বেশ গুছিয়ে নিয়েছে সে। আর শফিকুলের তো ভাত খেয়ে দোকানে আসতে সন্ধ্যাই হয়ে যায় আজকাল, যদি আসে কখনো।
শফিকুলের বয়স এখন পঁয়তাল্লিশ। সে বুড়িয়ে যায়নি। বরং এখনই তার দুই হাত দিয়ে কাজ করার বয়স। কিন্তু বছর দুই আগে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হয়। হার্টে দুটো রিং পরাতে হয়। ডাক্তার বলেছে, বেশি বেশি রেস্ট করতে, মূলত তখন থেকেই সুমনের হাতে পুরো দোকানের দায়িত্ব পড়েছে।
এবার সুমন ছুটি নিয়ে বাড়ি যাওয়ার পর দোকানে বসে শফিকুল বুঝতে পারছে দোকানের সোনালি দিন এখন অতীত। চাবিটা পকেটে ভরে বাসার দিকে হাঁটছিল শফিকুল। এই এলাকাটা তার এতটাই চেনা যে চোখ বুঁজে হাঁটলেও ঠিক বাসায় পৌঁছে যাবে সে। একটা সময় এ পথে হাঁটতে কত পরিচিত মুখের দেখা মিলতো।
ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সাধারণ চাকরিজীবী; কত পেশার কত রকম মানুষ। ব্যবসায়িক স্বার্থেই সবাইকে হাসিমুখে সালাম দিতো শফিকুল। তারাও বেশিরভাগই শফিকুলের দোকান থেকে মাসকাবারি সওদা নিতো। অনেকদিন দেখা না হলে অনেকে নিজেই চলে আসতো একদিন, হঠাৎ।
আজ হাঁটতে হাঁটতে পুরানা দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে শফিকুলের। আশ্চর্য! এই এলাকাতে থেকেও এই এলাকায় ব্যবসা করেও গত দুই বছরে শফিকুল কেমন অচেনা দূরের হয়ে গেছে! এটা খুবই খারাপ। এবার থেকে নিয়মিত দোকানে বসবে সে। সুমন আছে, থাকবে। তবে নিজের ব্যবসায় নিজে খেয়াল রাখলে হয়ত সোনালি দিন হারিয়ে যেতো না এভাবে।
এই যে শফিকুল ভাই,কেমন আছেন?
আমজাদ আলীর ডাকে মাথা তুলে শফিকুল। আমজাদ আলী বিশাল ব্যবসায়ী। নিউমার্কেটে তার দুটো দোকান আছে। রেন্ট-এ কারে চারটে গাড়ি খাটে। আন্তঃজেলা বাস সার্ভিস আছে গোটা পাঁচেক। এছাড়াও অনেক ব্যবসায় লগ্নি আছে তার।
আমজাদ আলীকে দেখে শফিকুল খুশি হয়। কতদিন পর দেখা। এ কথা-সে কথার পর আমজাদ আলী জানতে চায় শফিকুল কি অন্য কোনো ব্যবসা শুরু করেছে? তা না হলে সে কেন দোকানে বসে না আজকাল?
শফিকুল জানায় সে আর কোনো ব্যবসা ধরেনি। সুমনই সব কাজ দেখে। অসুস্থতার কারণে সে বাসাতে থাকে।
ছোট ছোট অনেক দোকান নিচে-ওপরে। এরই মাঝে কালো বোর্ডে সাদা হরফে লেখা ‘সুমন সুপার মার্কেট’!
শুনে আমজাদ ভ্রূ কুঁচকে বলে, আপনার দোকান এখন কেমন চলে? শফিকুল সেটাও জানায়, দোকান বছর খানেক ধরে ভালো চলছে না। জমা ভেঙে মাল এনেছে গত কয়েক মাস। আমজাদের মোবাইলফোনে ঠিক সে সময়ই একটা কল আসে। আমজাদ কল রিসিভ করে কথায় ব্যস্ত হওয়ার আগে শফিকুলকে বলে, মানুষকে বিশ্বাস করা ভালো। তবে আপনি একবার আড়তে যান, সময় করে।
আমজাদ চলে যায়। কিন্তু তার শেষ কথাটা শফিকুলের বুকে বেশ খোঁচা দেয়। শফিকুল চা খাওয়ার কথা ভুলে যায়। দ্রুত দোকানে ফিরে এসে দোকান বন্ধ করে রওনা দেয় সদরে।
আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে শফিকুলের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তারা শফিকুলের কাছে পাওনা টাকা দাবি করতে থাকে। গত সাত আটমাস ধরে সুমন আড়তদারদের নিকট থেকে বিভিন্ন মালামাল বাকিতে নিয়েছে। আড়তদাররা প্রায় সবাই শফিকুলকে চেনে। কাজেই বাকিতে মাল দিতে কেউ অসম্মতি জানায়নি। অথচ, সুমনকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়েই মাল কিনতে পাঠাতো শফিকুল। বাকি-বকেয়া তার পছন্দ নয়।
সুমন তাহলে টাকা গুলো কী করেছে?
শফিকুল বিশ্বাস হয় না সুমন টাকা চুরি করতে পারে। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত শফিকুল রাত দশটায় বাসায় ফেরে। দীর্ঘদিন পর এত সময় বাইরে থাকায় রানি এবং কন্যারা ভীষণ উদ্বিগ্ন ছিল। তাকে সুস্থ অবস্থায় ফিরতে দেখে মেয়েরা পড়তে চলে যায়। রানি চিন্তিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে, কী হইছে?
শফিকুল সব খুলে বলে। রানি বলে, এখন হাত মুখ ধুয়ে খেতে আসো। খাওয়ার পর বাকি চিন্তা।
সেনপুর সুমনের বিয়ের সময় এসেছিল শফিকুল আর রানি। প্রায় দশ বছরের ব্যবধানেও বাস থেকে নেমে তেমন পরিবর্তন চোখে পড়লো না তাদের। কাছেই একটা ছোট হোটেল দেখিয়ে রানি বললো, চলো নাস্তা খেয়ে নেই।
গতকাল রাতে রানিই শফিকুলকে বুদ্ধি দিয়েছে সুমনের গ্রামে আসার। হঠাৎ করে এসে সুমনকে চমকে দেবে, সেই সঙ্গে সুমন আসলেই টাকা চুরি করেছে কি না, সেটাও তাদের জীবনযাপনের ধরন দেখলেই বোঝা যাবে। হুট করে সুমনকে সরাসরি দোষারোপ করাটা ঠিক হবে না।
সকালে ফজরের নামাজ পড়েই বাসা থেকে বেরিয়েছে তারা। দিনে দিনেই ফেরার ইচ্ছে নিয়ে।
হোটেলটা ছোট। রুটি ভাজি আর চায়ের অর্ডার দিলো রানি। শফিকুল এক বোতল পানি নিয়ে গুনে গুনে চারটা ওষুধ খেয়ে নিলো। খাবারের আগে পরে তাকে ওষুধ খেতে হয়। ওষুধ খেতে খেতেই সে দেখলো, রানি একটা বয়স্ক লোককে ডাকছে, চাচা, এদিক আসেন।
লোকটা কাছে এলে দেখা গেলো তিনি পরিচিত । শফিকুলের মনে নেই কিন্তু রানির ঠিকই মনে আছে, সুমনের বিয়েতে লোকটি রানি আর শফিকুলকে খুব খাতির আপ্যায়ন করেছিলেন। লোকটি সুমনের সম্পর্কের মামা।
ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে আসা লোকটিও পরিচয় দেওয়ার পর রানি আর শফিকুলকে চিনতে পেরে খুবই উচ্ছ্বসিত হলো। রানি তাকে অনুরোধ করলো সুমনের বাড়িতে নিয়ে যেতে। সুমনের বাড়ি যাওয়ার পথ তাদের মনে নেই।
লোকটা পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো, বাজারের ভেতর দিয়ে পথ। পচা শাকসবজি , মুরগি ও মুরগির বিষ্ঠার গন্ধে ভারী বাতাস। রানি ও শফিকুল নাকে কাপড় চাপা দিয়ে হাঁটছে। হঠাৎ পথ প্রদর্শক থেমে গেলেন। হাত তুলে একটা লম্বা বিল্ডিং দেখিয়ে বললেন, আমাগো সুমনের।
রানি আর শফিকুল তাকিয়ে দেখলো, স্কুল ঘরের মতো একটা দুইতলা বিল্ডিং। ছোট ছোট অনেক দোকান নিচে-ওপরে। এরই মাঝে কালো বোর্ডে সাদা হরফে লেখা ‘সুমন সুপার মার্কেট’!