ঘুম আসে না মুতালেপ মিয়ার। সারাদিন জেগে থাকে মন। সারারাত দেহ।
মাঝবয়সী চোখ। বেশিক্ষণ লেগে থাকতে পারে না। ঘুম না আসাই স্বাভাবিক। তবে এ কি আর নতুন কিছু? বহুকাল হলো, এসব সহ্য করেই বেঁচেছে। সমস্যাটার শুরু হলো বছর খানেক আগে। যখন চিলতে উঠোনের ওপাশে ঘর উঠলো নতুন। আর পুরোনো খাটটা শব্দ করে ঘুমোতে লাগলো। রাতগুলো প্রায় জেগেই থাকতে হলো তাকে। জেগে থাকতে হলো মরার মতো। ওপাশের ঘরে মন লাগিয়ে।
অথচ গল্পটা অন্যরকমও হতে পারতো।
সে রাতে ওয়াজ শুনতে গিয়েছিল মুতালেপ।
অতিঘুমই তখনো সবচে’ বড় রোগ তার। ইবাদত হোক বা দোকানদারি কিংবা সেলুনে গিয়ে চুল কাটা, বসলেই ঢুলে পড়তো। তার ওপর শীতের রাত। গাদাগাদি করে বসা মানুষের ভাপ আর মুড়ি দেওয়া চাদরের ওমে ম-ম করছিল ঘুম। তবে সেদিন ঘুমোতে পারেনি।
মঞ্চজুড়ে বয়ানের আগুন।
এই যে জগৎ পুড়ছে স্ত্রীজাতির বেলেল্লাপনায়। এর দায় কার? জিজ্ঞেস করেই একটা গল্প শুরু করলেন হুজুর। সেটা শেষ না করেই প্রসঙ্গ বদলালেন। এবার বিষয় রাজনীতি। দেশ যেভাবে চলছে সেভাবে চলতে দেওয়া যাবে না। তাহলে করণীয় কী? অশ্লীল একটা রাম ঢেঁকুর তুললেন এরপর। মাইকে সেটা প্রচার হয়ে গেলো। দাঁতের ভেতর বেবোধ বেয়াড়া মাংস। গলায় বাঁধা কালো কারে ঝুলছে ধাতব দাঁত খিলান। আয়েশ করে খোঁচালেন একটু। কিছু বের হলো, কিছু হলো না। তার কারণেই কি না, হঠাৎ রেগে উঠলেন। এই গ্রামটা চমৎকার। এর আকাশে আজান বাতাসে আতর। কিন্তু নামটা বিধর্মী কেন? বলেই শুরু করলেন গ্রামটাকে জাতে তোলার কাজ। পলকেই মুসলমান হয়ে উঠলো গ্রামটা। রামচন্দ্রপুর হয়ে গেলো রহিমপুর, আকিকা ছাড়াই! ফলে চোখ ভিজে উঠলো, ‘দোজাহানের অশেষ নেকি হাসিল’ করতে আসা লোকেদের। সে জলে ভেসে গেলো দোজখ, হেসে উঠলো বেহেস্ত। নুয়ে পড়লো ময়দানের ওপর শুয়ে থাকা সামিয়ানার আকাশ। চুঁইয়ে পড়তে থাকলো ফোঁটা ফোঁটা আবে হায়াত।
এসবেও ডুবতে পারেনি মুতালেপ।
ভীষণ চাপ ধরেছিল তার। সভা ছেড়ে উঠতে সংকোচ হচ্ছিল। তাই বসে ছিল ভুরু কুঁচকে, দুই হাতে কোচড় চেপে। কিন্তু তা আর কতক্ষণ? শেষে তাই ছুটই দিতে হলো। ময়দানের সামনে কিছুদূর পর্যন্ত গিজগিজে ভিড়। টেবিলে টেবিলে মুড়ি বাতাসা কাঠিভাজার পসরা। ঘুমে ঢুলছে জ্বলতে থাকা টিমটিমে পিদিম। পিদিমের গায়ে আঁধারের সাঁড়াশি। দাঁতমুখ চেপে সব ছাড়িয়ে গেল মুতালেপ। ঢুকে গেল গভীর আঁধারে। তারপর বসে পড়ে কুয়াশাঘেরা এক ঝোপের আড়ালে। কিন্তু চায়ের কাপ তো এ না যে, উল্টে দিলেই পড়ে যাবে সব। তার ওপর বয়স হয়েছে। সবকিছুতেই তাই তীব্র জ্বালা তীক্ষ্ণ যাতনা! জান বের হওয়ার জোগাড়। ওষুধ খেয়েছে, কাজ হয় না। মনু কবরেজ অবশ্য বলেছে, ‘এ রোগ সারা ওষুধের কম্ম না। বিয়ে করতি হবে।’ আবার বিয়ে! ভাবতেই হেসে ফেলে সে একটু। যন্ত্রণায় কোঁচকানো অথচ হাসিমাখা চোখে তখনই জ্বলে ওঠে পথ বেয়ে এগিয়ে আসা পিদিমের এক তারা।
হালকা বাতাসে মোচড় খায় নিভুনিভু তারাটা। আড়মোড়া ভাঙে। মাথা তোলে, দোলে, হাই তোলে। তবে আগুন তো মানুষের মতোই, নেভে না সহজে। আর সে এগিয়েও আসে দ্রুত। ফলে মাঝপথেই উঠে দাঁড়াতে হয় মুতালেপকে। কিছু বর্জ্য তাই অনায়াসে আশ্রয় নেয় পাজামায়। অস্বস্তি আর ক্রোধ নিয়ে সে চোখ ফেলে আলোর দিকে। ওপাশে তখন দুটো ডাগর চোখ। আচমকা তাকে দাঁড়াতে দেখে ভড়কে গেছে। ফলে ভয় আতঙ্ক আর লজ্জার সঙ্গে ল্যাম্পের লাল আলোর আভা মিশেছে আগন্তুকের মুখে। অথচ কেঁপে চমকে উঠলো কি না মুতালেপ! নড়তে পারলো না অনেকক্ষণ। বাগানে খসখস একটা শব্দ হতেই নড়ে উঠল সে। খেয়াল হলো, পিদিমটা এগিয়ে গেছে বহুদূর। যদিও আলোটা জ্বলছে বুকে।
মাইকে শোনা যাচ্ছে হুজুরের জিহাদি ডাক। অথচ সে পা ফেলে উল্টোপথে। পিছু নেয় দূরগামী তারার। হাঁটতে থাকে ঘোরগ্রস্ত ইঁদুরের মতো, সামনে চলে হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা। একেবারে হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ অবশ্য পায় না। তবে ঘর চিনে পথ কিনে ফিরে আসে কিছুক্ষণ পর। জিহাদের ময়দানে তখন ঢুলছে কিরামত। হুজুরের মুখে হুরের রোশনাই আর বেহেশতি আয়েশ। তাতে ডোবে না মুতালেপ। সে মশগুল তার নিজস্ব হুর নিয়ে। একে হাতছাড়া না করার প্রতিজ্ঞাই বাজতে থাকে বুকে।
মেয়ে দেখলেই অমনটা হয় তার, একসময় সেটা মিইয়েও যায়। কিন্তু এ তো আর যে-সে মেয়ে না, এ যে হুর! দুদিন পরেই তাই খবর জানতে দৌড়তে হয় কিরামতকে। যখন ফেরে সে, মুখে তার ঝুলে থাকে চওড়া সাদা হাসি। হুরটা আসলেই হুর। এই বয়সে মুতালেপ সামলাতে পারবে কি না সন্দেহ!
ঠিক হয় শুক্রবারেই প্রস্তাব নিয়ে যাবে কালু ঘটক। ও পক্ষ একটু গাঁইগুঁই করবে হয়তো। কিন্তু ফকিরের মেয়ের জন্য তো আর রাজপাত্র আসবে না! তাছাড়া মুতালেপই বা কম কিসে? কালুর যুক্তির কাছে নিশ্চয় পার পাবে না হুরের বাপ! তা হলেই আর দেরি করা যাবে না। সৌভাগ্য যখন যেভাবে আসে, সেভাবে তখনই তাকে গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু বিয়ে যেমনই হোক, টাকা খসায়। টাকা কোথায় পাবে মুতালেপ?
বাজারভর্তি চা’র দোকান। দোকানে দোকানে নেচে বেড়ায় নেংটি পরা মেয়েরা। বিরক্ত লাগে মুতালেপের। ভাবে এরা কি খায় না কিছু? খায় না বলেই কি দর্শক এদের খায় বেশি? সকাল নেই দুপুর নেই রাত নেই, বাচ্চা বুড়ো বিচার নেই, লোকসব পড়ে থাকে সিডির সামনে। বুড়োরা না হয় বুড়ো, পড়া নেই কাজ নেই, বাচ্চাদের তো পড়া আছে, জোয়ানদের তো বউ আছে শোয়া আছে, তবু তাদের রোখা যায় না। এসব করে করেই দলে দলে বখে যাচ্ছে সব। কিন্তু মাথাব্যথা নেই কারো, না বাপ-মায়ের, না মেম্বার চেয়ারমেনের। বাচ্চাগুলোকে ঘরে রাখতে হবে, সিডিগুলো বন্ধ করতে হবে। বলে বটে, কিন্তু বোঝে যে এই নেংটির অভাবেই তার খদ্দের কম। প্রতি মাসে তাই কিছু কিছু জমিয়ে রাখছে, সিডি কিনবে।
টাকাগুলো তো আছেই! দোকান যেমন চলছে, চলবে। ঘরটা আগে আলো হোক। ঘর আলো হলে বাইর এমনিতেই ফকফক করে। তারই প্রস্ততি নিতে থাকে সে।
কিন্তু জীবন এমনই পথ, যত সোজাই হোক না কেন, বাঁক সে নেবেই।
ঠিক শুক্রবারের আগের সন্ধ্যার ঘটনা।
খরিদ্দার নেই। তেলের ঢমে হেলান দিয়ে পান চিবুচ্ছে মুতালেপ। আর বিলি কাটছে হুরের স্মৃতির গায়। কে যেন ছুটে এলো আবদুলের বিয়ের খবর নিয়ে। রোদেলা মনে হঠাৎ তাতেই মেঘ। মা মরার পর বিগড়ে গেছে ছেলেটা। বাপ বলে স্বীকার করে না তাকে। এখানে-ওখানে যায়। যার তার সঙ্গে মেশে। এটা-ওটা খায়। খোঁজ-খবর প্রথম প্রথম করত মুতালেপ। পরে বলতে গেলে ত্যাজ্যই করেছে। ত্যাজ্য ছেলের কিছুতে তার কিছু আসেও না, যায়ও না। খুশির এই খবরটাতে যেমন ভয় করে তার। বউ নিয়ে ত্যান্দরটা মুতালেপের ঘরে উঠবে না তো?
পায়ে ঘোড়ার পা লাগিয়ে সে ছুট লাগায় ঘরপানে।
পড়োপড়ো ঘরটাকে সে নতুন করে তুলেছে কদিন হলো। আলো জ্বালেনি এখনো, হুরই আলো হবে এ ঘরের। সেখানে অন্য কারোর ছায়া পড়তেও দেবে না। রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চলে সে।
গ্রামগুলো সব পুকুরের মতো। পানি যতটাই থাক, ঢেউ থাকে না। নিস্তরঙ্গ সেই দুনিয়ায় বিয়ে আর মৃত্যুই সবচে’ বড় ঢিল। ফলে বাড়ি পৌঁছে কোনো সোরগোলই দেখে না যখন, তখন স্বস্তিই পায়। বউ নিয়ে বন্ধুর বাড়ি উঠেছে আবদুল। শুনতেই কেমন একটা অবসাদ ঘিরে ধরে মুতালেপকে। হাত পা ছেড়ে দেয়। বসে পড়ে। কেমন যেন দুঃখ-দুঃখও লাগে। জবার কথা মনে পড়ে। নিজের দোষ স্বীকার করে মুতালেপ। কিন্তু দোষ তো মানুষই করে! শাস্তিটা এভাবে না দিলেই পারতো না জবা? সোনায় মোড়ানো সংসার তার, এখন লোহার দামেও কি কিনবে কেউ? কলজেটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কষ্ট হয় আবদুলের জন্যও। পাগলটা বোঝে না। শুধু কি মা গেছে তার, মুতালেপের যায়নি কিছু? কষ্ট কি তার কিছু কম? সে কি পাথর?
মেঘ জমছিল বুকে, ঝড় উঠবে, বৃষ্টি নামবে। তার আগেই পাড়ার ছেলে-মেয়েদের একটা সরগরম ঢেউ চোখে পড়ে। ভেসে আসছে নতুন বউ। ঘরছাড়া হওয়ার শঙ্কাটা আবার মাথাচাড়া দেয়। উঠে দাঁড়ায় মুতালেপ। বউমা এসে সালাম করে, তারপর চলে যায়। বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে মুতালেপ, সালামি দেওয়ার কথাও খেয়াল হয় না তার। খেয়াল অবশ্য আরেকটা ব্যাপারও করে না। সেটা করে কিরামত।
তারপর থেকেই এই নির্ঘুম দিন, ঘুমহীন রাত।
ওঘরের উৎসবের তোড়ে ভেসে যায় এ ঘরের ঘুম। না, অন্যের সুখে শোক মুতালেপ করে না, তার কষ্ট নিজেকে নিয়েই। হুর হারানোটা অঙ্গহানির মতোই জ্বালায়।
হুরের সংসার যদিও জমে ওঠে বেশ।
প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো আলেয়ার। বিয়ের দিন বাবা-মার জন্য যতটা, তার চেয়েও পুড়ছিল পাড়াতো ভাইটার জন্য। দুদিন ধরে তো তার চেহারাই ভেসেছে চোখে। চোখ বুজলেই তার চোখদুটো চোখে পড়ে। কান্না পায়। কিন্তু মানুষের মনই বেহায়া সবচে’, সবচে’ সহজে বদলে যায়। কিছুদিন যেতেই তাই ওলোট-পালোট।
বান্দির মতো খাটতে দেখেছে মাকে। জেনে এসেছে পুরুষকে খুশি রাখাই মেয়েমানুষের ইবাদত, বেহেস্তের সিঁড়ি। পৃথিবী উল্টে গেলেও বরই ঠিক। অথচ আবদুল করে উল্টো। তার কাছে আলেয়াই আগে। তাকে খুশি রাখতেই তটস্থ আবদুল। এটা সেটা পাগলামি করতেই থাকে সারাক্ষণ। আর হাসে অকারণ, বাচ্চাদের মতো নিরপরাধ গুলুগুলু মিষ্টি মিষ্টি সে হাসি। আলেয়া তাই টলমল করে সুখে। আবদুলের চোখ দুর্বল। নিজেকে ওর চশমা মনে হতে থাকে। মনে হয় সে-ই আবদুলের দৃষ্টি।
বদলে আবদুলও গেছে। আগে তার দিন রাত হতো আড্ডায়। রাত ভোর হতো নদীতে। শীতের জিরাফগলা রাতই হোক বা গরমের ঘাড়খাটো, পার হয়ে যেতো আবদুলের গানে। অথবা মফিজের চুটকিতে। অথবা রইসের কৌতুকে। অথবা তিনটাতেই। সঙ্গে থাকত এ তরল, সে গরল। সেই উদ্দাম জীবন এখন ঘুপচিঘরের ছোট্ট বিছানায় দিব্যি মানিয়ে গেছে। ঘরেই তার ভোর জাগে, ঘরেই আসে ঘোর। নদী নৌকো সব এখন আলেয়া। ইচ্ছেমতো সাঁতার কাটে, ইচ্ছেমতো ডোবে। মাঝে মধ্যে নৌকা চড়ে। মাঝে মাঝে একে অন্যের নৌকা হয়।
কিন্তু সুখের ধর্মই তো শেষ হওয়া। একদিন তাই নিখোঁজ হয় আবদুল।
একলা পেট ভয় তেড়ে হয়, দোকলা পেট ভয়ঙ্কর। বিয়ের পরই তাই চিন্তায় পড়ে আবদুল। পরিশ্রমে ক্লান্তি নেই, কিন্তু কাজ পাওয়া দায়। আগের ফসল উঠে গেছে, পরের চাষ শুরু হয়নি; গ্রামজুড়ে অবসর। কী করা যাবে? লুৎফর মিয়াই ভরসা তখন। ব্ল্যাক মার্কেটের ব্যবসা। সবসময়ই কাজ চলে তার দলের। দলটা ওপার যায়। এটা সেটা যন্ত্রপাতি নিয়ে আসে, দেশের সীমান্তে এলেই খালাস। এক চালানে যা আয়, তা দিয়ে পরের চালান পর্যন্ত খাওয়া যায় সুখের ওপর মজা থুয়ে। সে দলেই ভিড়ে যায় আবদুল। কিন্তু যায়ই শুধু, ফিরে আর আসে না।
মাসখানেক পর একটা লাশ মেলে ‘বর্ডার-বিলে’। ডুবে ছিল, জামার নিচে বল বিয়ারিং জড়ানো। পিঠে গুলির ক্ষত। চেনার উপায় নেই, পচা মুখ গলা দেহ। খুব হৈ চৈ এলাকায়। লোকে বলে ও-ই আবদুল। আলেয়ার যদিও বিশ্বাস হয় না। তার মনে হয় কোনো কারণে লুকিয়ে আছে লোকটা। সুযোগমতো ফিরে আসবে। এসেই চোখ ধরবে পেছন থেকে।
‘বলোদিনি আমি কিডা।’
‘তা কতি পারব না। তবে যে বিটাই হও, শিগগিরই হাত সরাও, আমার লোক এই আসলো বলে, এই অবস্তায় দেকলি দাঁতমুক আর আস্ত রাকপেনে না!’ আহ্লাদি গদগদ স্বরে উত্তর করবে আলেয়া।
আবদুল তখন আরেকটু চেপে ধরবে। বলবে, ‘তালি তো যা করার তাড়াতাড়িই করতি হবে।’ বলে আরেকটু চেপে ধরবে।
দুজন মিলে যখন এক হয়ে যাবে, তখন মুখ ঘুরাবে আলেয়া। ‘ছাড়ো তো, আর ঢং করতি হবে না। একা ফেলে যেকেনে ছিলে, যাও সেকেনে রং লাগাও। আমার কাজ আচে।’
রাগ ভাঙবে রাতে। অভিমানের শীতল কালো ঘনমেঘ উষ্ণ হবে। একসময় গলে যাবে বৃষ্টিধারায়। তারপর রঙিন আকাশ।
কিন্তু মেঘ বড় নাছোড়। কাটতে চায় না। আকারে প্রকারে বাড়েই শুধু।
যে পাখি সঙ্গী হারায়, সেই জানে তুষের আগুন পোড়ায় কেমন! দিনকে দিন সেই জ্বলুনি বাড়তে থাকে আলেয়ার। একের পর এক লোলুপ দেহে কার্তিক জাগে। জোড়া জোড়া চোখ মাপতে থাকে তাকে। জিবে জিবে লালার নহর! কিন্তু কী করবে, পেট তো আর বাতাসে চলে না! তাছাড়া একা মেয়েলোকের কাছে ঘর যা, জঙ্গলও যে তা-ই, বুঝতে বাকি থাকে না তার। মা’র কথাটা তাই মনে পড়ে খুব। ‘যে পুরুষ, সম্পর্কে যা-ই হোক, সে পুরুষ।’ নিজেকেই যেন অসহ্য লাগে। মনে হয় ঝুলে পড়ে দড়ির গলায়। কিন্তু তখন যদি ফিরে আসে আবদুল!
মুতালেপের কষ্ট অবশ্য দ্বিগুণ।
একদিকে হুরের চিন্তায় ডুবে থাকে। এতটুকুন মেয়ে, কী পেতে কী পেল! দুমুঠো ভাতের জন্য কাজ করে বাড়ি বাড়ি। দুটো হাঁড়ি ভেঙে তাই এক করতে চায় সে। বিয়ের পরপর উদ্যোগটা আলেয়াই নিয়েছিল। বসেছিল বর-শ্বশুর দুজনকে নিয়ে। তিনজনের সংসার। বাপ ছেলে আলাদা খাবে কেন? কেন কথা হবে না দুজনের? বুঝিয়েছিল। এখন যেহেতু আবদুল নেই, এক তো তারা হতেই পারে! কিন্তু সাহস হয় না বলার।
তার সঙ্গে যোগ হয় কিরামতের শয়তানি। তা নয়তো কী? সে ছাড়া কে আর জানতো ঘটনাটা?
মন কষাকষির জেরেই হয়তো বলে বেড়িয়েছে নেমকহারামটা। গ্রামময় হাসাহাসি কানাঘুষা। মেয়েরা বউরা মুখ টিপে হাসে। ছেলেরা বুড়োরা টিটকারি মারে। ‘মামি চাচি বাদ যায়নি, তাই বলে ছেলের বউ! তাও না হয় হলো, তার জন্য ছেলেকে মারতে হবে!’ শুনতে শুনতে একটা মাথা তার কেটে পড়ে বারবার। ইচ্ছে করেই নাকি সে বর্ডারে পাঠিয়েছে ছেলেকে। বর্ডারে গেলে যে ফেরে না মানুষ, তা কি জানতো না সে? জানতো যে আজ হোক কাল হোক, মারা আবদুল পড়বেই। অবাক লাগে। এমন হারামি হয় কী করে মানুষ! হ্যাঁ, তার অনুরোধেই লুৎফর দলে নিয়েছে আবদুলকে। কিন্তু বাপ যদি শত্রুও হয়, তবু তো সে বাপ! আর বাপ কি কখনো সন্তানের মৃত্যু চায়? বোকাগ্রাম বোঝে না এসব। দোকানে খরিদ্দার এমনিতেই কম আসত, আরো কমে যায়। বাকি খেয়েছে যারা, তারা আসে না, টাকা চাইলে দেয় না। হুরও তাকায় চোখে ঘৃণা আর অবিশ্বাস মেখে। ছেলে হারানোর যন্ত্রণা তাই দ্বিগুণ তিনগুণ হয়ে বিঁধতে থাকে বুকে। খুব ছোট, আধখানারও অর্ধেক, মনে হয় নিজেকে। অভিশপ্ত মনে হয়, বুকের ভেতর বসত গড়া শুন্যতাটুকু ভরে রাখে অসহ্য হাহাকার।
প্রতিদিন সে প্রতিজ্ঞা করে, আলেয়াকে বউমার মতো দেখবে। ছেলের আমানত হিসেবেই আগলে রাখবে। এটা তো জানা কথাই যে পুণ্যে ঘাটতি থাকলে হুর জুটবে না, তাই জোটেনি। পরকালে তাকে পেতেই হবে, হারানো যাবে না। তার জন্য ইবাদত লাগবে, পুণ্য লাগবে। কিন্তু বিবেকখেকো রাতগুলোর বুদ্ধিনাশা অন্ধকারে সব ভুলে যায় সে। হুরকে নিয়েই রাত কাটে তার। ঘাটে বসে খাটে শুয়ে হুরের চিন্তায় বিভোর থাকে মন। ওঘরে তার হুর তখন কাঁদছে হয়তো। একা। এই কান্না মুছে দেওয়ার সুযোগ কি পাবে না সে? কিছুই কি করার নেই তার?
এর মধ্যেই ফিরে আসে আবদুল!
মুতালেপই বলে বেড়ায় কথাটা। মাঝে মাঝে আবদুল ফিরে আসে রাতে। তক্কে তক্কে আছে সে, জাপট দিয়ে ধরবে; প্রমাণ করে দেবে ছেলে তার আছে আজো, মরেনি। শুনে অবাক হয় না লোকে। বুঝে নেয় এসব দায় এড়ানোর বাহানা। উড়িয়ে দেয় হেসে।
আলেয়া কিন্তু হাসে না। সত্যিই যদি ফিরে এসে থাকে মানুষটা! চোখের জলে ভাবনা ভেজায়। ভূত হয়েও যদি ফিরে আসে, আসুক; মানুষটা তো তারই। খোলাচোখ তাই মেলে রাখে খোলা জানালায়। মাঝে মাঝে জেগে থাকাই সার হয়। মাঝে মাঝে রঙিন হয়ে ওঠে রাত। ছুটে যেতে ইচ্ছে করে তখন। মনে হয় আছড়ে পড়ে মানুষটার বুকে, নদীর কুলে ঢেউ যেমন পড়ে। কিন্তু কিসের যেন সংকোচ এসে বেঁধে রাখে তাকে। সংকোচ না আসলে, ভয়। সত্য জানার ভয়। গিয়ে যদি দেখা যায় ভূতই লোকটা, তখন সহ্য হবে? না। তারচে’ এই ভালো, সে আসুক, আলেয়া দেখুক। আগুন তাতে নিভবে না হয়তো, কিন্তু তাপ তো কিছুটা কমবে!
প্রায়ই আসে আবদুল। ঘুরপাক খায়। হঠাৎ হঠাৎ পা বাড়ায় আলেয়ার ঘরের দিকে। আবার পিছিয়ে যায়। কিন্তু অভিনয় তো অভিনয়ই। একদিন তাই ধরা পড়ে সব। চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকে আলেয়া। লোকটার উদ্দেশ্য কী? কেন ধোঁকা দিচ্ছে তাকে। কেন? কী লাভ এতে?
লাভ নেই জেনেও কাজটা করে চলে মুতালেপ। আড়চোখে যখন দেখে তাকিয়ে আছে হুর, তখন ভীষণ এক পুলক জাগে। এই অনুভূতি সে বলে বোঝাতে পারবে না। আগে ছিটেফোঁটা ঘুম হতো, ছেলে মরার পর তাও গেছে। বন্দি বন্দি লাগে। মাঝখানে একফালি উঠোন। সোজাপথে এইটুকু দূরত্বই অনেক, অতিক্রম করা যায় না! তাই এই বিকল্প ব্যবস্থা। গড়নে চলনে বাপ ছেলে একই রকম। ফলে ধরা সে পড়বে না, বিশ্বাস ছিল। তবে বিশ্বাস খুবই পলকা জিনিস, আয়না যেমন, ভাঙতে আয়োজন লাগে না।
প্রতিরাতের মতোই দীর্ঘ রাতটা সে রাতে বেড়ে চলে শামুকের গতিতে। বাড়তে বাড়তে মাঝপথে আসে। তারপর হেলে পড়ে ভোরের টানে। তখন বের হয় মুতালেপ। বারান্দার পশ্চিমে যেখানে পেয়ারা গাছ দুটো ঝোঁপ গড়েছে তার আড়াল গ’লে ঢুকে পড়ে বাগানে। বাগানটা উঠোন বেড় দিয়ে ঘুরে গিয়ে নোঙর ফেলেছে হুরের ঘরের কানাচে। মাটিতে শুকনো পাতার মল। মচ মচ খস খস বাজতে থাকে। জুতোটা তাই খুলে রাখতে হয়। পরনে ছেলের জামা। ছেলের প্যান্ট। আস্তে আস্তে সে এগিয়ে যায় শিমুল গাছটার দিকে। এখান থেকেই জানলাটা দেখা যায় স্পষ্ট। মনে আছে, আবদুলের নতুন ঘরে পুরনো খাটটা শব্দ করতে শুরু করলেই চুপপায়ে বের হতো সে। এইখানে, ঠিক এইখানে, দাঁড়িয়ে থাকত। শীতের দুধঝরা জোছনায় ভিজে দাঁড়িয়েছে সে। বর্ষার কান্না মেখেও দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দেখত শরীরটা তার দু’ভাগ হয়ে গেছে। খুব তিরস্কার করছে একভাগ, ধিক্কার জানাচ্ছে-মানুষ হয়ে এমন অমানুষ সে হচ্ছে কী করে? প্রশ্ন করতো। ধরা পড়ে গেলে মুখ দেখাবে কেমন করে? তাছাড়া পরকালের কথাটাও তো চিন্তা করতে হবে। যা হয়েছে হয়েছে, এরপর আর যেন ছোঁক ছোঁক না করে সে। এভাবে যেন আর তাকে দেখা না যায়। শাসাত, হুঁশিয়ার করত। কিন্তু আরেক ভাগ ঠিকই দাঁড়িয়ে থাকত পেছনে দাঁড়ানো শিমুল গাছের মতো-সজাগ, সটান। হুরের জানলায় চোখ!
তারপর একদিন ভীষণ ঘেমে ওঠা ভোর। বাইরেই হাঁসফাঁস, ঘর তো সাক্ষাৎ চুলো। স্বাভাবিকভাবেই খুলে গিয়েছিল জানলাটা। হঠাৎই। তাই চমকে উঠেছিল মুতালেপ। তড়িঘড়ি লুকিয়েছিল শিমুলগুঁড়ির আড়ালে। তখনই বুঝেছিল, মাঝ বয়সেই আসলে জোয়ান বেশি হয় লোক! জানলার ওপারে তখন হুর দাঁড়িয়ে। ঝড়ক্লান্ত মেয়েটা হয়তো গোসল করে এসেছিল। অথবা প্রস্তুতি নিচ্ছিল যাওয়ার। চোখ ভরে দেখছিল মুতালেপ। কী যে আগুন তার হুরের গায়ে, কী যে তেজ! এখনো চোখে ভাসে সে রূপ। ভুলতে পারে না। আবদুল চলে যাওয়ার পর অবশ্য বন্ধই হয়ে গিয়েছিল এই চোরা সুড়ঙ। তাই এই সাজ, এই গুজব। এতে যে এত কাজ হবে, সারারাত তার দিকে তাকিয়ে থাকবে তার হুর, ভাবতেও পারেনি। হ্যাঁ, ও যে আবদুলের দিকে তাকায়, শ্বশুরের দিকে না, তা জানে মুতালেপ। তবু, এই তাকানোটাই যে তার সম্বল!
কিন্তু আজকে হুরের হলো কী? জানালা কেন খোলে না? প্রশ্ন জাগতেই খেয়াল হলো কেউ একজন এগিয়ে আসছে উঠোন দিয়ে!
ফিকে আঁধারের ফাঁক গলে দেখা যায় লোকটাকে। চেনাও যায়। গুঁটিপায়ে হেঁটে আসছে আবদুল! চোখ বেরিয়ে আসে মুতালেপের। আবদুলই ফিরে এসেছে! আনন্দে না বিস্ময়ে জানে না, বসে পড়ে সে। ভয় হয় ধরা পড়ে যদি! সন্তানের কাছে লজ্জায় পড়ার চেয়ে লজ্জার আর কিছু নেই। দ্রুত ফিরে যায় সে, ঢুকে পড়ে ঘরে। আবদুল তখনো ঘরের সামনে। দাঁড়িয়ে আছে। ইতস্তত করছে। হঠাৎ তখন, হঠাৎই, মুতালেপের জানালা বরাবর তাকায় সে একবার। সেদিকেই তাকিয়ে ছিল মুতালেপ, ধড়াস করে ওঠে বুকটা, মনে হয় সব যেন বুঝে ফেলেছে ছেলেটা, চোখ মাথা নামিয়ে তাই আড়াল নেয়। এরপর যখন তোলে, তখন ঘরে ঢুকছে আবদুল। খুশি খুশি লাগে মুতালেপের। সকালেই সে দেখে নেবে তাদের, যারা বলেছিল ছেলেকে সে-ই মেরেছে। ভাবতে ভাবতেই মন খারাপ হয়, হুরটা আবার দূরে চলে গেল। আবার সেই একঘেয়ে একটানা বিরক্তির রাত, বিভক্তির দিন! তখনই শব্দ হয় একটা। দরজা খুলে যায় আবদুলের ঘরের। হুরটা বের হয় তখন। তার মুখে বুকে চোখে নিশ্চয় এখন আনন্দের স্রোত! বিষাদনীল চোখ সে ফেলে রাখে তার হুরের দিকে। হুরটা তখন তার জানালায় একবার চোরা চোখ ফেলে কলপাড়ে যায়। বদনায় পানি নেয়, পায়খানায় যাবে।
কেন যেন সন্দেহ হয় মুতালেপের। আবদুলই তো, নাকি অন্য কেউ এলো? কত লোকেরই তো নজর মেয়েটার ওপর, তাদের কেউ যদি ছদ্মবেশে এসে থাকে মুতালেপের বুদ্ধিতেই! ভাবতেই বেরিয়ে পড়ে মুতালেপ। ছুটে যায় হুরের ঘরে। ঢুকেই অবশ্য থমকে দাঁড়াতে হয়। আবদুলের জামা আর প্যান্ট পড়ে আছে। জুতোটাও। ঘরে কেউ নেই! তাহলে? খাটের নিচে দেখে সে। দরজার পেছনে দেখে। চালের আড়ায় দেখে। নেই তো নেই। এর মধ্যে কেউ তো বেরও হয়নি ঘর থেকে। ঘটনা কী? দাঁড়িয়ে তল পায় না। তাই বসে। বসেও পায় না। অবাক মনে তখন নিজের দিকে তাকায়। আবদুল হয়ে বসে আছে সে আবদুলের খাটে!
তখনই ঘরে ঢোকে আলেয়া। মুখে তার অন্য রঙের দৃষ্টি। ওয়াজ শুনতে গিয়ে ল্যাম্পের আলোয় যে দৃষ্টিটা প্রথম চোখে পড়েছিল মুতালেপের, এ দৃষ্টি সে দৃষ্টি না।