শেষরাতের দিকে কেমন একটু শীত শীত লাগে। ঘুমের মধ্যেই জড়সড়ো হয়ে কুঁকড়ে যায় জবা। ঘুমে লেপ্টে থাকা শরীর হঠাৎনামা শীতে আরাম খোঁজে, উষ্ণতা চায়। কিন্তু চলতে থাকা এসিটাকে আরামদায়ক মাত্রানুপাতে কমিয়ে বা বাড়িয়ে নেওয়ার মতো প্রস্তুত নয় এখন শরীর। ঘুমে কাতর। বরং পায়ের কাছে ভাঁজ করে রাখা নরম, রঙিন কাঁথাটাই ঘুমের ঘোরে মুড়ি দেয় জবা। ছড়িয়ে দেয় মহুর শরীরেও। ঘুমে কাদা মহু এই হঠাৎ উষ্ণতায় নড়েচড়ে ওঠে, আরেকটু কাছে সরে আসে, মিশে যায় জবার বুকের সঙ্গে। মেয়েকে জড়িয়ে আরও গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় জবা। পাশের রুমে তুহিন তখনো ল্যাপটপে ডুবে, অফিসের কাজে। বাইরে তুমুল শ্রাবণ, প্রকৃতির অভিমানী চোখে ঝরঝর জলধারা ঝরছে অবিরাম। বাতাসে ফিসফাস, গুঞ্জন।
এলার্ম বেজে চলে, ঘুম ভাঙে না জবার। বেজে বেজে থেমে যায়, আবার বাজে। জবা বা মহু কারও সাড়া নেই, টের পেয়ে তুহিন পাশের রুম থেকে উঠে আসে কাজ ফেলে, এক মুহূর্ত চোখ কুঁচকে দেখে মা-মেয়ের ঘুমের বহর। কেমন একটু মায়া চলকে ওঠে বুকের ভেতর, প্রেম। ঘুমন্ত মুখ দুটোকে কী মিষ্টি আর পবিত্র দেখায়! যেন শরতে ফোটা শিউলি, স্নিগ্ধ, নরম। বিশেষত মহু! তার কচি মুখটা একটু ফোলা, ঈষৎ ফাঁকা ঠোঁটের কোণে আটকে আছে এক টুকরো হাসি। আহা! পৃথিবীতে আত্মজার ঘুমন্ত, কোমল মুখশ্রীর চেয়ে পবিত্র কী আছে আর! বুকের ভেতর শান্তির হাওয়া ছড়ানোয় আর কী তুল্য হতে পারে এর! কয়েক মুহূর্ত পলকহীন তাকিয়ে নিজের মনেই ভাবে তুহিন। ঝুঁকে চুমু খায় মহুর গালে। বিরক্ত মহু উমম শব্দ করে আরও গুটিয়ে যায় জবার কাছে। তুহিন জবার মুখের সঙ্গে ঠোঁট ঘষে, দুই দিনের না কামানো দাড়িসমেত গাল জবার গালে ঠেকতেই বিরক্তিতে চোখ মেলে জবা। ঘুম ঘুম গলায় বলে, কী?
এলার্ম বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল তো, উঠবে না? সকাল হয়ে গেছে! মহুকে স্কুলে দিতে হবে না? আর তোমার অফিস?
ধড়মড়িয়ে উঠে বসে জবা। কটা বাজে? ঘুমচোখে প্রশ্নটা ছুড়েই ছুট লাগায় ওয়াশরুমে। তুহিন শুয়ে পড়ে মহুর পাশে। আগড়ুম বাগড়ুম বলে চেষ্টা করে মেয়ের ঘুম ভাঙাতে।
জবা ততক্ষণে কিচেনে ব্যস্ত। একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে সে। সাব এডিটর। সঙ্গে লেখালেখির ভূতটাকেও সামলে চলে সস্নেহে। ভোরে উঠে সব কাজ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ে, ফিরতে সন্ধ্যে, মাঝে মাঝে রাত। মহুকে স্কুলে দেওয়া-আনা সুবিধা মতো চালিয়ে নেয় দুজনে, পালা করে। আজ তুহিনের সময় হবে না, অফিসে যাচ্ছেতাই রকম কাজের চাপ যাচ্ছে। জবাকেই দায়িত্বটা সামলাতে হবে। কিচেনের টুংটাং চলতে চলতেই বাকি সব কাজও চলতে থাকে সমানে। এ সময়টায় জবাকে দশভূজা মনে হয় তুহিনের। মহুকে স্কুলের জন্য রেডি করা, স্কুলের টিফিন, সেইসঙ্গে দুপুরের খাবার তৈরি করা, নিজে রেডি হওয়া, সকালের নাস্তা টেবিলে দেওয়া, সংসারের টুকিটাকিতে জবার ব্যস্ততা এসময় চোখে পড়ার মতো। তুহিন যথাসাধ্য সাহায্য করে, হাঁপিয়েও ওঠে। কিন্তু জবার ক্লান্তি নেই। সে সর্বংসহা ধরিত্রী এ মুহূর্তে। বাকি সময়টায় গনগনে আগুন, ছুঁয়েছ কী ফোস্কা পড়ে যায় অবস্থা! অদ্ভুত!
অফিসের কাজের ফাঁকে ফোন বেজে যায়। একচোখে একবার দেখে জবা। তারপর ডুবে যায় নিজের কাজে, ফোনটা আস্তে নিয়ে সাইলেন্ট মুডে রাখে। ছেলেটা অদ্ভুত কিসিমের। কী বলে, কী চায়, নিজেই জানে না। আর্টিকেলটা রেডি করতে হবে দুপুরের মধ্যেই। আপাতত খোশ গল্পের সময় নেই। লেখাটা রেডি করে মেইল করে দেয় জবা। ঘড়ি দেখে। দুটো বেজে দশ। মহুর স্কুল ছুটি হয় আড়াইটেয়। যেতে পাঁচ মিনিট। বেল টিপে কফি দিতে বলে জবা। আপাতত একটু দম ফেলা যাক স্বস্তির। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতেই ফোনটা হাতে নেয় জবা। নয়টা মিসড কল। তার মানে আরও বেশি। নাম্বারটায় রিং দেয়। রিসিভও হয় সঙ্গে সঙ্গেই।
—হ্যালো!
—কী ব্যাপার?
—এই তো! তোমার?
—ভালো। অনেকবার রিং দিয়েছ দেখলাম।
—দেখলে? কী ভাগ্য আমার! তবু দেখলে!
—কেন ফোন দিয়েছিলে? কোনো দরকার?
—নাহ্! কোনো দরকার নেই!
—তাহলে?
—এমনিই। ইচ্ছে হলো। কেন, ফোন দেওয়া যাবে না?
—অকারণে দেওয়া যাবে না।
—তোমার কাছে যেটা অকারণ, সেটা অন্যের কাছে কারণ হতে পারে।
—সেই কারণটাই জানতে চাইছি।
—কণ্ঠটা শুনতে ইচ্ছে করছিল।
—রাখছি। বাই।
ফোনটা কেটে দিয়ে বের হয়ে পড়ে জবা। মহু’র স্কুল ছুটি হলো। দুই পাশে বেণী দুলিয়ে মহু আসে। হাওয়ায় তার চুলের সাদা রিবনগুলো ফুরফুর ওড়ে। দেখে বুকের মধ্যে আনন্দ চলকে ওঠে জবার, স্নেহ উছলে ওঠে। নিজের স্কুলের দিনগুলো মনে পড়ে যায়। আহা! আনন্দময় শৈশব কোথায় যে হারালো কবে!
মহুকে বাসায় দিয়ে, লাঞ্চ করে আবার দে ছুট। অফিস। এ সময়টা মহু স্বাতীর সঙ্গে কাটায়। স্বাতী ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে, ইকোনোমিক্স। জবা বা তুহিন না আসা পর্যন্ত সে মহুকে সময় দেয়, পড়ায়। স্বাতী বলতে গেলে এ পরিবারেরই সদস্য এখন। তার কাছে মহু নিরাপদ, জবা-তুহিনও নিরুদ্বেগ।
রাতে মহুর স্কুলের পড়া সুযোগ হলে একটু দেখে দেয় জবা, মাঝে মাঝে তুহিনও। ফাঁকে ফাঁকে ফেসবুকে দুই-একবার ঢুঁ দেয়। পরিচিত দুই চারজনের সঙ্গে হাই হ্যালো করে। নিউজফিড দেখে। ভালো কোনো পোস্ট চোখে পড়লে চোখ বুলিয়ে নেয়। এরমধ্যেই ইনবক্সে টুং করে মেসেজ এসে জড়ো হতে থাকে। বেশিরভাগই দেখা হয়ে ওঠে না। পরিচিত বা জরুরি মনে হলে দেখে, নতুবা নয়। টুং শব্দ হতেই মেসেজটা দেখে জবা।
—তখন ফোন কেটে দিলে যে?
—ব্যস্ত ছিলাম।
—হু। বাঁচতে ইচ্ছে করে না আর, জানো?
—কেন, কী হলো?
—এমনেই। ভালো লাগে না কিছু।
—বেশ তো। মরে যাও। বেঁচে থাকার মধ্যে তেমন ভালো লাগার কিছু নাইও আসলে।
—ইয়ার্কি করো না। এবার সত্যিই মরব, দেখো।
—আমার দেখার কিছু নাই। শুভ কাজে দেরি করা ঠিক না। জলদি মরো। মরার আগে কুলখানির দাওয়াতটা দিয়ে মরো। ঢের দিন বিরানি টিরানি খাই না।
—ধুর! তোমার সাথে কথা বললে দেখি মরার ইচ্ছাটাও মাটি হয়া যায়!
—হায়াল্লা! কও কী!
—ঠিকই কই। এই পাষাণ মন নিয়া আবার বালের লেখালেখি করো!
—বাদ দিতে কও?
—না। লেখো তো বাল, লেখলেই কী আর বাদ দিলেই কী।
—সেই তো। তুমি আবার সেই বালের ফ্যান, বাতাস ছাড়া।
—মেজাজ খারাপ করাবা না কইলাম।
—অত টাইম নাই রে। গেলাম।
—ঐ! যাবা না কইলাম! শোনো!
ওয়াইফাই অফ করে মেসেঞ্জার থেকে বের হয় জবা। খাবার সময় হলো। মহুকে তাড়াতাড়ি বিছানায় না পাঠালে ঘুমোতে দেরি করে, সকালে উঠতে চায় না, দেরি হয়ে যায় স্কুলে। খাবার টেবিলে টুকটাক কথা হয়। বেশিরভাগই মহু বকবক করে। তুহিন বরাবরই কম কথা বলে, চাপা স্বভাবের। জবারও বেশি বকবকানি পছন্দ নয়। ফলে মহু’র কথার বাইরে কাজের কথাই হয় বেশি। তুহিন-জবার সম্পর্কটা খুব মাখামাখি নয়, খুব দূরত্বও নেই। একে অন্যকে বোঝে, শ্রদ্ধাবোধও আছে। সংসারটা তাই শান্তিরই তাদের। আজকাল অবশ্য মেসেঞ্জারেও তারা মাঝে মাঝেই হাই হ্যালো করে, সময় সুযোগ মিললে ঠাট্টা ইয়ার্কিও বাদ যায় না। বিশেষত রাতে তাদের মেসেঞ্জার আলাপন জমে ওঠে প্রায়ই। দুজন দু রুমে, কখনো বা পাশাপাশি শুয়ে মেসেঞ্জারে হাসি ঠাট্টা করে, হেসে ওঠে শব্দ ক’রে।
পৃথিবীটা দ্রুত বদলে যাচ্ছে, দাম্পত্য সম্পর্কেও লেগে যাচ্ছে প্রযুক্তির বেহুদা আঁচড়, নিজের মনেই কথাগুলো নাড়াচাড়া করে জবা। মাথা নাড়ে। বিষয়টা কতটুকু ইতিবাচক আসলে? না, নেতিবাচকতাই বেশি। একান্ত সময়গুলো গিলে নিচ্ছে প্রযুক্তি, ভার্চুয়াল সম্পর্ক এসে দখল করে নিচ্ছে সত্যিকার সম্পর্কের ভিটে, নাড়িয়ে দিচ্ছে ভিত্। কথাগুলো মনে আসতেই বর্ষণকে মনে পড়ে দুম করে। ছেলেটা পাগল। সায় দেয় মনে মনে।
বর্ষণ প্রথম দিকে বলতো জবার লেখার ভক্ত সে, এখনো বলে। তবে জবা বোকা নয়। সে লক্ষ করে বর্ষণের মনোযোগ যতটা না তার লেখার দিকে, তারচে’ ঢের বেশি ব্যক্তি জবার দিকে। বয়সে সে জবার চে’ ছোট, বেশ ক’ বছরের। বিয়ে করেনি। কোনো একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। কবিতা লেখে। জবা ভেবে পায় না—প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেও কী করে বর্ষণ এতটা সময় আর ধৈর্য পায় তার পেছনে ব্যয় করার, বিশেষত যেখানে সত্যিকার অর্থেই জবার দিক থেকে না আছে কোনো সায়, না কোনো সম্ভাবনা। জবা অনেকবার, অনেক রকমভাবে বুঝিয়েছে ছেলেটাকে, সে বয়সে বড়, তার একটা বছর সাতেকের মেয়ে আছে, একটা জলজ্যান্ত বরসহ তার একটা সুখী সংসার আছে, মিছে তার পেছনে কেন সময় নষ্ট করছে বর্ষণ! তার পুরো জীবন পড়ে আছে, সে সুদর্শন, ভালো চাকরি করে, কবিতা লেখে, কত মেয়েই তো পথ চেয়ে বসে আছে তার। কিন্তু বর্ষণ সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দেয়, থাকুক গে। আমি শুধু তোমাকে চাই। আমি চাই শুধু তুমি আমার পথ চেয়ে থাকো।
অনেক বকে, ধমকে, ব্লক করে, আনব্লক করে, বুঝিয়ে, শেষে হাল ছেড়ে দেয় জবা। বলে, আচ্ছা, একটা কাজ করি আসো।
—কী?
—দেখো, অনেকেরই তো দুটো বউ থাকে, দিব্যি সুখে শান্তিতে সংসারও করে তারা, কষ্ট করে মানিয়েও নেয়। তাহলে চল আমরাও বিয়ে করে ফেলি। না হয় থাকলই আমার দুটো বর। তোমরা দুজন একটু মানিয়ে নিলেই ব্যস আর চিন্তা নেই। তোমারও সুবিধা, দারুণ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পাত্রী, সঙ্গে বোনাস হিসেবে সাত বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে। বাড়তি সুবিধা হবে তিনজনই চাকরিজীবী, শনৈ শনৈ উন্নতি হবে সংসারে। কী, রাজি?
জবা ভেবেছিলে বর্ষণ দমে যাবে। কিন্তু ফাজলামিতে সে-ও কম যায় না। সে বলে, আমার আপত্তি নাই।
—ঠিক আছে। তাহলে কার্ড ছেপে ফেলো। লোকজনকে দাওয়াত করো। এতবড় একটা আনন্দের ব্যাপার তো একা একা ঘটান উচিত হবে না। ঢাকঢোল পিটিয়ে, শান-শওকতের সাথে করা উচিত, কী কও?
—হু। তা উচিত।
জবা হাল ছেড়ে দেয়। নাহ্। এর সঙ্গে আর ফাজলামি করা উচিত নয়। এ তো মহা ফাজিল। যা, ভাগ—বলে অগত্যা নিজেই কেটে পড়ে জবা। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করে বর্ষণ কেমন সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। জবার নারীমন বুঝতে পারে, বর্ষণের এই আসক্তি পুরোটা মিথ্যেও নয়, তার প্রতি ধীরে ধীরে সত্যিই দুর্বল হয়ে পড়ছে ছেলেটা। জবা সাবধান হয়। সে বুঝতে পারে বর্ষণ আসলে একধরনের ফ্যান্টাসিতে আক্রান্ত। এক প্রকার ঘোরের মধ্যে আছে ছেলেটা। কিছু পুরুষের বয়স্ক নারীদের প্রতি আসক্তি থাকে, বর্ষণ হয়তো সে দলের কেউ। নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নেয় জবা। ব্লক করে দেয় বর্ষণকে। কিন্তু বর্ষণের পাগলামি থামে না। নতুন নতুন আইডি খুলে চলে তার খুদেবার্তা পাঠানো, নতুন নতুন নাম্বার থেকে ফোন। বিরক্ত হয়ে আবার মূল আইডি আনব্লক করে জবা। শর্ত একটাই, বেচাল কোনো কথা চলবে না, অকারণে ফোন বা মেসেজ নয়। কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে এবার বর্ষণ। তবে সুযোই পেলেই নিজের অনুভূতি জানাতে ভুল করে না। শেষে কৌতূহল বাড়ে জবার। বলে, আচ্ছা, এই যে তোমার অনুভূতি আমার প্রতি, এটা কী আসলে? আমাকে তো কোনোদিন দেখোনি পর্যন্ত। তাহলে?
—কল্পনায় দেখেছি।
হো হো হাসে জবা। হাসি সামলে বলে, বড় হও বাছা। তুমি পোলাপান।
—পোলাপান যে নই, সেটা প্রমাণের সুযোগ দাও, বুঝবে।
—থাপ্পড় কদ্দিন খাস না?
—যদ্দিন থেকে পোলাপান নই তদ্দিন।
থেমে যায় জবা। পাগল ক্ষেপাতে নাই, জানে সে। কিন্তু একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত, তার প্রতি বর্ষণের অনুভূতিটুকু, প্রকাশকৃত শ্রদ্ধাবোধটুকু পুরোপুরি মিথ্যে নয়। তাহলে বর্ষণের ব্যাপারটা ঠিক কী? তার মধ্যে কৌতূহল দানা বাঁধে। তার লেখক সত্তা তাকে বর্ষণের প্রতি কৌতূহলী করে তোলে। বর্ষণের সঙ্গে যতটুকু কথা হয়েছে তার, তাতে সে বুঝেছে, বর্ষণ অতি সাধারণ এক পরিবারের ছেলে, অবিবাহিত, সহসা বিয়ের সম্ভাবনা নেই, ফ্যামিলিতে কিছু সমস্যা আছে, যেগুলো না মেটা পর্যন্ত তার বিয়েটা আটকে থাকবে। তাহলে কি যৌন অবদমন থেকে তার প্রতি বর্ষণের এই আসক্তি? ভাবতেই কেমন গা রি রি করে ওঠে জবার। ছিঃ। কেউ একজন তাকে শুধু যৌন প্রয়োজন মেটানোর সামগ্রী ভাবছে, সহজলভ্য ভেবে হাত বাড়াতে চাইছে, ব্যাপারটা রীতিমতো অপমানজনক, গা গুলানো। মানসিক বোঝাপড়া ছাড়া দুজন মানুষ যৌনসম্পর্কে জড়াচ্ছে, ব্যাপারটা ভীষণরকম পাশবিক ঠেকে তার। আর তারপর, মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নেয় জবা। নিজের প্রতি পুরোপুরি আস্থা আছে তার, আছে শ্রদ্ধাবোধও। সে দেখবে, কতটা ভুল সে, অথবা কতটা ঠিক। নারী-পুরুষের সম্পর্ক কি আসলে শুধুই যৌনতায়? যৌনতা কি শুধুই দৈহিক আসক্তি, না কি মনোদৈহিক একাগ্রতা? দেখবে সে-ও। মানুষ আর পশুতে কি তফাৎ নেই আদতেই কোনো! শুধুই কথার কথা, বৃথা বাগাড়ম্বর! তার কাছে সম্পর্ক একপ্রকার প্রার্থনা, যাতে একাগ্রতা থাকে, নিবেদন থাকে থাকে প্রেমের পবিত্রতাও। অন্যেও কাছে কি তবে বিষয়টা অন্যরকম? দেখতে চায় সে। ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে ওঠে ভীষণ।
ছুটি নেয় জবা একদিনের। তুহিন অফিসে। মহু স্কুলে। স্বাতীকেও না করে দেয় আসতে। বর্ষণকে আসতে বলে, বাসায়। নিজের হাতে যত্ন ক’রে রান্না করে জবা। স্নান করে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে। হালকা একটু কাজল দেয় চোখে। কপালে টিপ। বর্ষণ আসে। দরজা খুলে দেয় জবা। সোফায় এসে বসে। সামনা সামনি। অনেকক্ষণ, চোখে চোখে চেয়ে থাকে জবা। দ্বিধাহীন। তার চোখে প্রশয় নেই, শাসন নেই, নিরুত্তাপ, নৈর্ব্যক্তিক চোখ, পলকহীন। বর্ষণ চোখ নামিয়ে নেয়। অস্বস্তি ভাসে বাতাসে। নীরবতা ভাঙে জবা।
—কী হলো? কথা বলো!
—তোমার অনেক সাহস!
—না। আমি সরল। আমি বিশ্বাস করি নিজেকে, অন্যকেও।
—আমি যদি বিশ্বাসের মূল্য না দেই?
—সেটা হবে তোমার অযোগ্যতা, অক্ষমতা।
—তুমি বাসায় একা, আমি যদি তোমার কোনো ক্ষতি করি?
—কী রকমের ক্ষতি?
—বুঝে নাও।
শব্দ ক’রে হাসে জবা। বর্ষণের মনে হয় কোথাও ঝর্ণা বইছে কলকল। তাতে ঝরে পড়ছে জবার সারল্য। হাসি থামিয়ে জবা বলে, জোর করে, একতরফা যা করা হয়, সেটা যৌনতা নয়, ধর্ষণ। ওতে সুখ নেই। তুমিও ধর্ষক নও। আর আমি অতটাও দুর্বল নই।
—আমি তোমাকে চাই। তোমার সবটুকু।
—সবটুকু বলতে?
—সবটুকু বলতে সবটুকু—গোঁয়ারের মতো বলে বর্ষণ।
—সবটুকু মানে তো শরীর, মন। সেটা তো সম্ভব নয়। কারণ তোমার প্রতি আমার মধ্যে ওরকম কোনো অনুভূতি তৈরি হয়নি। শরীর চাও?
—চাই।
—ভেবে বলো।
—চাই, চাই, চাই!
—শুধু শরীর চাও? আমি শুধুই একটা শরীর? বেশ, নাও তবে!
বর্ষণ কিছু বুঝে ওঠার আগেই। টান দিয়ে একে একে সব পোশাক খুলে ফেলে জবা। তারপর দৃঢ়, শান্ত পদক্ষেপে বর্ষণের সামনে এসে দাঁড়ায়। আদিম এক নারীর প্রতিমূর্তি হয়ে বর্ষণের নাগালের মধ্যে এসে স্থির, অনড় দাঁড়িয়ে থাকে জবা।
বর্ষণ কী করবে বুঝতে পারে না। তার চোখ আটকে যায় জবার শরীরের ভাঁজে। তারপর পলকহীন চোখ রাখ জবার চোখে। সে চোখে রাগ নেই, ঘৃণা নেই, অভিমান নেই, ভালোবাসা নেই, অভিযোগ নেই। আছে তীব্র অপমানবোধ, ধারালো ব্যক্তিত্বের অহঙ্কার। আর তখনই জবার মনে হলো, মহুর স্কুল ছুটি হবে এখনই।