আমি এখন বসে আছি একটা অহিংস কাঠের চেয়ারে। পৃথিবীর সবকিছুই অবশ্য অহিংস, অহিংস্র। এ পর্যন্ত আমি একটাও বস্তু বা প্রাণীর নাম জানি না, যে বা যারা হিংস্র। পৃথিবীতে চূড়ান্তভাবে একমাত্র হিংস্র প্রাণী মানুষ। কাঠের চেয়ারটাতে আমি বসে আছি সুতরাং যতটা আমার ওজন তার পুরোটায় সেখানে দেওয়া আছে। আমি আমার ওজন দিয়ে পুরো চেয়ারটাকে ঠেসে ধরে আছি নিচের দিকে। অন্যপক্ষে চেয়ারটা তার শক্তি দিয়ে আমাকে ঠেলে ধরে আছে ওপরের দিকে। আমি আমার সুবিধার জন্য তাকে চেপে ঠেসে বসে আছি কিন্তু চেয়ারটি এমন বেশি ঠেলা দিচ্ছে না ওপরের দিকে যেন আমার ঊর্ধ্বপ্রাপ্তি ঘটে। বা এমন কম ঠেলা দিচ্ছে না যেন আমার অধঃপতন ঘটে। চেয়ারটা যদি তা করত তবে এখানে বসে থাকতে হতো না আমাকে। যা হোক। আমি চেয়ারে বসে আছি এবং চিন্তা করে দেখছি—যেসব জিনিস বা বিষয় আমার ভালোলাগে সেগুলো আমার কাছে নেই, একেবারেই নেই। আবার এটাও দেখতে পাচ্ছি যে, যেসব জিনিস বা বিষয় আমার খারাপ লাগে সেসব জিনিসও নেই আমার কাছে। বিষয়টা অদ্ভুত বলেই মনে হলো আমার কাছে। ‘হয় ভালো লাগবে নয় খারাপ লাগবে’ এর বাইরে মানুষ যায় না বা যেতে পারে না। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। আমি চেষ্টা করতে লাগলাম আমার ছোট ছোট বা বড় বড় স্মৃতিগুলোকে খুঁচিয়ে বের করতে যাতে আমার খারাপ লাগে অথবা ভালো লাগে। স্মৃতিগুলো মনে করার চেষ্টা করতে লাগলাম। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, আমি যেন একটা স্মৃতিবন্ধ্যা, আমার কোনো স্মৃতি নেই। বহুক্ষণ চেষ্টা করে কোনো স্মৃতিই বের করতে পারলাম না, আমার ভালোলাগা বা খারাপ লাগা বোধকে জাগ্রত করার কাজে লাগানোর জন্য।
আমি চেয়ার থেকে উঠে, জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, যেন এমন একটা দৃশ্য দেখতে পাই যা দেখে আমার একটা স্মৃতি মনে পড়তে পারে। এবং এ স্মৃতি আমাকে ভালোলাগা বা খারাপলাগা একটা বোধের ভেতর নিয়ে যাবে। সম্ভবত আমি সফল হতে পারব কারণ হেঁটে আসতে দেখতে পাচ্ছি ‘প’ কে। সম্ভাবনা একারণেই বলছি, তাকে যে আজ দেখতে পেলাম সেটা বহুদিন পরে। তখন ‘প’ মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে। আমরা ভর্তি হয়েছি তারও একবছর আগে। তার হেঁটে যাওয়া, থুথু ফেলা, কথা বলা, হাঁচি দেওয়া, হাসি দেওয়া সবকিছুই এত ভালো লাগতো, আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতাম আর তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতাম। কিন্তু সে এমন একটা অবজ্ঞা ছুঁড়ে দিত যে, আমার ভেতরটা মুচড়ে যেত। কোনো কোনো দিন অবজ্ঞা নিয়েই কথা বলত কিন্তু সেই অবজ্ঞা ভরা কথাও মধুর মনে হতো। রাতে ঘুমাতে গেলে ঘুম হতো না। তার হেঁটে যাওয়া, কথা বলা আর হাসির শব্দ আমাকে জাগিয়ে রাখত সারারাত। পড়তে গেলে বইয়ের ভেতর তার মুখ ভেসে উঠত। ‘ঈশ্বর সমগ্র পৃথিবী ব্যেপে আছেন’ বলে মনে করা হয়, সেটা সত্য কি মিথ্যা আমি বলতে পারব না। কিন্তু কোনো কিছু ‘সমগ্র ব্যেপে আছে’ এমনটা হওয়া সম্ভব। প আমার সমগ্র কিছু ব্যেপে উপস্থিত হতো। মনে হতো, সে ছাড়া আর কিছুই যেন নেই এ পৃথিবীতে। এভাবেই সময় চলে গেছে। সে কখনোই ধরা দেয়নি। যেদিন শুনলাম যে, তার বিয়ে হয়ে গেছে, সেদিন কী যে অন্ধকার নেমে এলো পৃথিবীতে তা বুঝিয়ে বলা অসম্ভব। বুকের ভেতর, রক্তের ভেতর কী যে বয়ে বয়ে যেত ক্ষণে ক্ষণে। মনে হত আমি মরে যাব। আমার বেঁচে থাকা সম্ভব না। রাতে একা একা কত কেঁদেছি। এমন অবস্থা বছরখানেক ছিল। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বিয়ে করব না কোনোদিন। করিওনি। কিন্তু কেন করিনি সে ব্যাপারটা আর মুখ্যভাবে মনে পড়ে না এখন। এখন কেউ যদি আমাকে বিয়ে করতেও চাই হয়তো করে ফেলতে পারি অথবা অভ্যাসের কারণে নাও করতে পারি, এটা আর তেমন ব্যাপার নয়। এই যে এখন ‘প’ হেঁটে যাচ্ছে, তাকে দেখে ধড়াস করে উঠল না বুক, তেমনভাবে রক্ত নেচে উঠল না। ভালো লাগা বা খারাপ লাগা বোধ তৈরি হলো না। আমি খারাপ লাগা বা ভালোলাগা একটা বোধ তৈরি করতে চাচ্ছি ভেতরে। হচ্ছে না।
আবার চেয়ারটাতে এসে বসলাম। অন্য একটা স্মৃতি বের করতে হবে। আমার মায়ের বা বাবার মৃত্যুর স্মৃতি কি আমাকে খারাপ লাগা বোধের দিকে নিয়ে যেতে পারে? আমি আমার বাবা মায়ের ছবি যেখানে টাঙ্গানো ছিল সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছবি জিনিসটাকে অদ্ভুত বলে মনে হয় আমার। একটা ছবি যখন দেখি এবং জানি যে, লোকটা বেঁচে আছে তখন ছবিটাকে একরকম লাগে আবার লোকটা যখন মৃত তখন সেই ছবিটাকেই অন্যরকম লাগে। যেমন, পাশের ঘরে আমার ছোটকাকার হাসি মুখে একটা ছবি রয়েছে। তখন আমার থাকার ঘর ছিল সেটাই। প্রতিরাতে ঘুমাতে গেলে, ঘুম থেকে জেগে উঠলে বা অন্য যেকোনো কারণে বা অকারণে ছবিটা দেখতে পেতাম। তিনি বিদেশে শ্রমরত ছিলেন। একদিন টেলিফোন এলো তিনি মারা গেছেন। বাড়ির সবাই কান্নায় ব্যস্ত এবং আমিও। মনটা ভীষণ খারাপ হয়েছিল একথা আমার মনে আছে। আরও মনে আছে ঘরে ঢুকে যখন ছবিটার দিকে চোখ যায় খেয়াল করি ছবিটার সবকিছু ঠিক আছে—মুখে হাসি আছে, দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা আর যা যা ছিল সবই একই আছে কিন্তু তারপরেও মনে হলো এটা একটা মৃত মানুষের ছবি। ছবিটাকে একটু অন্যরকম লাগছে। যখন মানুষ জীবিত থাকে তখন তার ছবিটার ভেতরেও একটা প্রাণ থাকে সম্ভবত, হোক সে প্রাণ ছবিসুলভ এবং মানুষটা মরে গেলে ছবির ভেতর থেকে সে প্রাণটা উবে যায়। কিন্তু এ চিন্তুা করার পরেও একটা ব্যাপার আমি খেয়াল করেছিলাম একদিন। সেটাও খুবই আশ্চর্যজনক মনে হয়েছিল আমার। সেদিন গেছিলাম এক বন্ধুর বাসায়। বন্ধুটি আমাকে বসিয়ে একটু বাইরে গেলে আমার সামনে থাকা টেবিলে একটা ফটো এ্যালবাম দেখতে পাই এবং সেটা হাতে নিয়ে দেখতে থাকি। একটা ছবিতে আমার চোখ আটকে গেল। একটা মেয়ের ছবি। ‘ছবির তরুণীটা কে রে?’ এ প্রশ্নটা করলাম বন্ধুকে যখন সে ফিরে এলো। সে জানাল, তার কোনো এক কাজিনের। পরে বলল, সে এক্সিডেন্টে মারা গেছে। ছবিটা আবার দেখলাম, মনে হলো এ ছবিটা একটা মৃত মানুষের ছবি এবং ছবিটাতে জীবন্তের আবহ আর নেই। এই বিষয়টাকে কী ‘এইগুলো সবই মনের কারিশমা, অন্য কিছু না’ এই সহজ বাক্যের এবং বোধের ভেতর ফেলা যাবে। আমার মনে হলো—না। অন্য কিছু একটা আছে। অথবা নেই। কিন্তু ‘অথবা নেই’ এটা আমি মানি না। আমি আমার বাবা মায়ের ছবির সামনে দাঁড়ালাম, তাদের মৃত্যুদিনের কথা স্মরণ করলাম। বাবা মারা গেছিলেন মায়ের মৃত্যুর পরে। প্রচুর বিষণ্নতা, প্রচুর কান্না ছিল তখন, একথা মনে পড়ল। কিভাবে কাঁদছিলাম, কত জোরে কাঁদছিলাম মনে পড়ল, আবার এও বুঝলাম তাদের মৃত্যুতে যে গভীর বেদনাবোধ ছিল তা হারিয়ে গেছে। ছবি দেখে একটা শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠল কিন্তু সেদিনের বেদনাবোধ জেগে উঠল না।
আমি আবার নিজেকে মনে করাতে পারলাম যে, আমার যা ভালো লাগে তা আমার কাছে নেই, যা খারাপ লাগে তাও আমার কাছে নেই অথচ আমার ভালো লাগবে বা খারাপ লাগবে এমন কিছু আমার চাই। আমি অন্য একটা স্মৃতি মনে করতে চেষ্টা করলাম। এবার যে স্মৃতিটা আমার মনে পড়ল সেটা কোনো সময়ই আমি কাউকে বলতে চাইনি আবার কোনো সময়ই আমি নিজেও মনে করতে চাইনি। সে স্মৃতিটাও বের করলাম কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে পারলাম না। স্মৃতিটা অসমাপ্ত রেখেই সেখান থেকে ব্যাক করলাম। স্মৃতিসুতা ধরে যতদূর পর্যন্ত এখন গিয়েছি ততদূর পর্যন্ত গেলেই হাত ‘পা’ ঠাণ্ডা হয়ে যায়, গা শিরশির করে ওঠে। যখন ‘প’-এর স্মৃতি মনে পড়েছিল তখনই এটাও মনে পড়তে চাইছিল। আমি মনে পড়তে না দিয়ে তাকে সরিয়ে দিয়েছি। এটা একটা স্বপ্নের স্মৃতি—‘প’ যেন কারাকে ঠিক করেছে আমাকে মারার জন্য বা শায়েস্তা করার জন্য। যাদের ভাড়া করা হয়েছে তারা আমাকে শায়েস্তা করার জন্য ধরে নিয়ে গেছে আর আমার পোশাক খুলে মাটিতে শোওয়ায়ে ফেলেছে। একেবারে ধারালো চকচকে ছোরা বের করে লিঙ্গটার কাছে ছোঁয়াচ্ছে আর কেটে ফেলার হুমকি দিচ্ছে, ধারাল আর ঠাণ্ডা ছোরার ছোঁয়ায় কেঁপে উঠছে প্রাণ, শরীর। শিশ্ন কেটে ফেলার যন্ত্রণা, রক্তের ফোয়ারা বয়ে যাবার বিভৎসতা কল্পনা করছি স্বপ্নের ভেতর। পরবর্তী সময়ে, স্বপ্নের শিশ্নে চাকু ঠেকানো দৃশ্যের আগ পর্যন্ত মনের ভেতর আনতে পারতাম কিন্তু তারপরের অংশ পারতাম না। স্বপ্ন দেখার বহুদিন পরও জাগ্রত অবস্থায় শিশ্ন কাটতে চাওয়া স্বপ্নদৃশ্য মনে করতে গেলে শরীর ঘেমে উঠত। আমি এ স্বপ্ন মনে করতে চাইনি কখনোই। এখন মনে করলাম, কারণ আমার খারাপ লাগা বা ভালো লাগা বোধকে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু পুরো স্বপ্ন মনে করলাম, সেই বিভৎসতা অনুভব করার চেষ্টা করলাম কিন্তু হলো না কিছুই। এর আগে স্বপ্নদৃশ্যটা মনে পড়েছে যতবার, ততবার শরীর দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেছে। স্বপ্নের লোকগুলো আমাকে বলিয়ে নেবার চেষ্টা করছিল, আমি আর কোনদিন ‘প’ এর পিছু নেব না। অদ্ভূত। আমি যে ‘প’-এর পিছু নিয়েছি বা নিই সেটা প’ই জানত না। এ স্বপ্নের পরেও ‘প’ কে আমি স্বপ্নে দেখেছি। অন্যান্য অনেক স্বপ্নদৃশ্যের মধ্যে রমণ করাও ছিল। তবে রমণের স্বপ্নটা মাত্র একবারই দেখেছি, তার বিয়ের কয়েকবছর পর। স্বপন দেখে খুব সুখ অনুভব করছিলাম। এসব স্বপন মনে করেও আমার ভালোলাগা বা খারাপলাগাবোধ এলো না।
এবার এ লেখাটা হঠাৎ করে অন্যদিকে বাঁক নেবে, কারণ, ঠিক এ মুহূর্তে আমার বাসায় একজন নারী প্রবেশ করল যার কোলে বছর চার পাঁচের একটা ছেলে। আপনাদের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেই, সে প। আমি অবাক হয়ে বললাম—আরে তুমি কোথা থেকে, কিভাবে, এতদিন পরে? আমার ঠিকানা পেলে কোথায়? ‘প’ বলল—পথ অপরিচিত হলেও চেনার বাসনা থাকলে মনই নিয়ে চলে আসে। এই নাও তোমার সন্তান। এতক্ষণে ছেলেটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। হুবহু আমার মত চেহারা। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। ‘প’ হেসে বলল—‘আরে অবাক হয়ে দেখছ কি, নাও, তোমার ছেলেকে সামলাও আমি আর পারব না। আমি বললাম—এটা কী করে সম্ভব!? আর কিছু বলতে পারলাম না। অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তার আমার সংশ্রবই হয়নি কোনোদিন, কী করে এটা হতে পারে!
গল্পের সংজ্ঞা ও প্রতিক্রিয়া
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শেষ হওয়ার পরেও শেষ হয়নি বলে মনে হবে’ বলে যে মত দিয়েছেন ছোটগল্পের ব্যাপারে সেটা আমি মানি। ব্যাপারটি পাঠকের। লেখককে কোনো একখানে থামতে হয় এবং সেটাই গল্পের শেষ বলে ধরে নিতে হয়। নইলে লেখক থামেন কেন? যদি লেখক চালিয়েই যান তখন সেটা কি আর গল্প থাকবে? যতগুলো ছোটগল্পের সংজ্ঞা জানি তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংজ্ঞাটিকেই সেরা বলে মনে হয়। এখন কোনো ছোট গল্পকার যদি মনে করেন যে ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ একথা আমি মানতে চাই না এবং গল্পটা শেষ করবই, তাহলে কী দাঁড়াবে? পৃথিবীর ছোটগল্পের সংজ্ঞাকে অতিক্রম করে চলে যাবে গল্পটি। তারপরেও গল্পটি শেষ হয়নি বলেই মনে হবে। কারণ একটা মানুষের লীলার সমাপ্তি নেই।
এগল্পটা লেখার সময় যেভাবে গল্পটা শেষ করব বলে মনে করেছিলাম সেটা করতে পারলাম না। এর মানে দাঁড়াতে পারে, যে চিন্তাটাকে এখানে কাজে লাগাতে চেয়েছি সেটা সম্পর্কে আমার ধারণা পুষ্টভাবে স্পষ্ট নয়। অথবা আমার চিন্তাকে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। কিন্তু চিন্তাকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি আমি? তবে একটা ব্যাপার, চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও, এটুকু বুঝতে পারছি যে, গল্পটা এখানেই থেমে থাকতে পারবে না বা থেমে গেলে হয়তো কোনো সমস্যা নেই কিন্তু আমিই থামিয়ে রাখতে চাই না। গল্পটার আরও একটু এগুনো দরকার বলে মনে করছি। যদিও/তারপরেও গল্পটা শেষ হবে না বা পাঠকের মনে হতে পারে—শেষ হয়েও শেষ হলো না।
সমস্যার ভেতর পড়া গেল গল্পের সমাপ্তি নিয়ে। যখন আমি গল্প নিয়ে এমন ধরণের সমস্যার মধ্যে থাকি তখন দুজন লোককে ডাকি। তারা হলো, মোমিনুল বারি এবং লতিফা ইয়াসমিন। যতটুকু গল্পটির লিখেছি সে অংশটুকু তারাকে দিয়ে, তাদের মত করে সমাপ্তি দিয়ে আনতে বলি। তারা আমার অসমাপ্ত গল্পটি নিয়ে যায় এবং কদিন পরে তাদের মত করে শেষ করে নিয়ে আসে। আমি ভেবেছিলাম আমার চিন্তা আর তাদের চিন্তার একটা সমন্বয় করে আমি নিজেই গল্পটা শেষ করব কিন্ত তা আর হলো না। তারা দু’জনেই এমনভাবে শেষ করেছে যে, কোনোটার সঙ্গে কোনোটা মিলবে না, মেলানো যাবে না। এবং আমি এত ফালতুভাবে গল্পটি শেষ করতে চেয়েছিলাম যে, নিজের ভেতর নিজেই লজ্জায় পড়ে যায়। গল্পটির দু’জনকৃত দুটো সমাপ্তি দিয়ে দিচ্ছি।
গল্পটির সমাপ্তি পড়ার নিয়মকানুন
গল্প পাঠের কোনো নিয়মকানুন থাকে না, থাকা উচিত নয়। সনাতনি পদ্ধতিতে যে গল্প গঠিত আর পঠনের নিয়ম সেটাই সবচে উৎকৃষ্ট। কিন্তু এ গল্পটির ক্ষেত্রে যেহেতু সামান্য পার্থক্য আছে সেহেতু একটা নিয়ম দিয়ে দেওয়া উচিত বলে আমার মনে হলো। এ নিয়ম না মেনেও গল্পটি পাঠ করা যেতে পারে।
নিয়ম ১: আমি গল্পটি যেখান থেকে ছেড়ে রেখেছি সেখানের দুই-একটি বাক্য আবার পড়ে নিয়ে মোমিনুলের সমাপ্তি পড়তে হবে। মোমিনুলের সমাপ্তি পড়া শেষ হলে, আমি যেখান থেকে ছেড়ে রেখেছি সেখানের কয়েকটা বাক্য আবার পড়ার পর সরাসরি লতিফার সমাপ্তি পড়তে হবে। অথবা,
নিয়ম ২: আমি গল্পটি যেখান থেকে ছেড়ে রেখেছি সেখানের দু’একটি বাক্য আবার পড়ে নিয়ে লতিফার সমাপ্তি পড়তে হবে। লতিফার সমাপ্তি পড়া শেষ হলে, আমি যেখান থেকে ছেড়ে রেখেছি সেখানের কয়েকটা বাক্য আবার পড়ার পর সরাসরি লতিফার সমাপ্তি পড়তে হবে। অথবা,
নিয়ম ৩: আমি গল্পটি যেখান থেকে ছেড়ে রেখেছি সেখানের দু’একটি বাক্য আবার পড়ে নেবার পর ইচ্ছে করলে আপনি নিজেও একটি সমাপ্তি তৈরি করতে পারবেন।]
মোমিনুল বারি কর্তৃক সমাপ্তি
আমার আশ্চর্য হওয়া দেখে ‘প’ বলল—আমার বিয়ে হওয়ার পর কোনো সন্তান হচ্ছিল না এবং বছর তিন পার হয়ে গেলে একদিন আমি স্বপ্ন দেখি, তুমি আমাকে জোর করে তোমার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য বলছ। আমি যতবার না করি তুমি ততবার জোর করছ আর শেষ পর্যন্ত তুমি তা করেই ছাড়। এ স্বপ্নসঙ্গমের পরে আমি প্রেগনেন্ট হই।’ আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি—‘তারিখটা কি তোমার মনে আছে?’ সে হেসে বলে—‘স্বপ্নের তারিখ কখনো কেউ মনে রাখে? তারপরেও আমার মনে আছে কারণ সেদিন ছিল আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। কিন্তু তারও একমাস আগে থেকে আমার স্বামী বাসায় ছিল না, ব্যবসার কাজে বাইরে ছিল।’ আমি তাকে না বলেই আমার রুমে এসে আলমারী থেকে ডাক্তারের একটা প্রেসক্রিপশন বের করলাম তারিখটা মিলিয়ে দেখার জন্য। অদ্ভূত ব্যাপার মিলে গেল আমার তারিখের সঙ্গে তার তারিখ। আমি রুম থেকে বেরিয়ে বললাম—‘হ্যাঁ ঠিকই আছে, তারিখটা আমিও খুঁজে পেয়েছি। তোমাকে বহুবার স্বপনে দেখেছি কিন্তু ঐ একদিনই তোমার সঙ্গে স্বপ্নের ভেতর আমি মিলিত হয়েছিলাম এবং ভীষণ খুসি হয়ে উঠেছিলাম। সকালে ঘুম ভাঙ্গার পরেও স্বপনে তোমার সঙ্গে রমণের আনন্দ, সাগরের ঢেউয়ের মত আমার ভেতর আছড়ে পড়ছিল। এই উত্তাল আনন্দ নিয়ে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম। কোনটা সিঁড়ি আর কোনটা মেঝে আর কোনটা আমি আর কোনটা আমার মাথা, বুক বা কোনটা আমার হাত পা, হাত সে জ্ঞান লোপ পেয়েছিল। যখন আমার ভেতর আমি ফিরলাম ততক্ষণে পা পিছলে সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছি আর আমার পা ভেঙ্গে গেছে। অনেকদিন ভুগতে হয়েছে আমাকে। তখন যে ডাক্তার আমার চিকিৎসা করেছিলেন তার প্রেসক্রিপশনে যে তারিখ আছে, তার একদিন আগেই তোমার স্বপন দেখার তারিখ বা তোমাদের বিয়েবার্ষিকী। তবে তোমার স্বপ্ন আর আমার স্বপ্নের ভেতর একটা পার্থক্য আছে। আমি তোমাকে রমণের জন্য জোর করিনি, তুমিই বার বার সেধে সেধে আমাকে তোমার সঙ্গে মিলিত হতে বলছিলে।’ আমার কথা শুনে প হাসল। আমি বাচ্চাটার দিকে তাকালাম, তাকে কোলে নিলাম। প তখন হাসতে হাসতে কাঁদতে লাগল এবং চোখ মুছে নিয়ে বেরিয়ে যেতে গেল। আমি বললাম—‘আরে কী কর! একে রেখে চলে যাবে নাকি সত্যি সত্যি?’ সে বলল—‘হ্যাঁ। কেন?’ বললাম—‘তোমার স্বামী কী বলবেন?’ সে বলল—‘সে আর আমার স্বামী নেই। সে যখন দেখল যে, তোমার সঙ্গে এ ছেলের চেহারার হুবহু মিল আছে তখন ও আর আমার সঙ্গে থাকেনি।’ প এবার একরাশ হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বলল—‘স্বপ্নে এসো।’ এবার চলে গেল। ছেলেটিকে বললাম—‘বাবা তোমার মা ফিরে আসবে, মন খারাপ করো না, কী খেতে চাও বল?’
লতিফা ইয়াসমিনকৃত গল্পের সমাপ্তি
আমার অবাক হওয়া দেখে প বলল—‘অবাক হচ্ছো কেন? তুমিতো জ্ঞানী মানুষ। জ্ঞানী না হলেও নিজে নিজে মনে কর। তাই বলেইতো কোনোদিন বলনি আমাকে, আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার কথা অথচ আমি তা বুঝতে পারতাম। আমি নিজেই কোনো কোনো সময় তোমার আকুলতা দেখে বলতে চেয়েছি—‘‘ভালোবাসি’’ কিন্তু বলতে পারিনি। এটা আমার জ্ঞানের জন্য নয়, আমার নির্জ্ঞানতার জন্য। তো, আমার বিয়ে হয়ে গেল। এরপর বুঝতে পারলাম, তোমাকে ‘ভালোবাসি’ না বলে কী ভুল আমি করেছি! আমি ভেবেছিলাম আমার বিয়ে হলে তোমার কষ্ট হতে পারে কিন্তু আমার কোনো কষ্ট হবে না। তা সম্পন্ন ভুল। আরো বেশি আমি তোমার প্রতি তৃষ্ণার্ত হয়ে গেলাম। প্রতিদিন আমার প্রতি তোমার আকুলতা দেখে দেখে আমি অভ্যাস্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং সেটার প্রতি আকৃষ্ট হয়েই প্রতিদিন কলেজে এসে হাজির হতাম যদিও তোমাকে পাত্তা দিতাম না। এই ‘পাত্তা না দেওয়াটা’ খুব ভালোলাগতো আমার। আমার স্বামী আমাকে ভালোবাসলে মনে হতো—না, সে তোমার মত করে আমাকে ভালোবাসতে পারছে না। তারপরেও লোকটা তার মত করে খুব বেশি ভালোবাসত আমাকে। আমি তার সঙ্গে বিছানাতে গেলেও তোমার কথাই ভাবতাম। একদিন তার সঙ্গে মিলনের চরম মূহুর্তে তোমার নাম করে বলে ফেলি—ম গো এ সঙ্গম ভালো লাগছে খুব। মনেই ছিল না আমার দেহাদেহি হচ্ছে আমার স্বামীর সঙ্গে, তোমার সঙ্গে নয়। ‘ম গো এ সঙ্গম ভালো লাগছে খুব’ বাক্যটি শুনে আমার স্বামী তখনই থমকে যায় এবং আমাদের বেডরুমে যে সময়গুলো ছিল সে সময়গুলোর ভেতর থেকে কয়েকটি সেকেন্ড স্ট্যাচু হয়ে থাকে। সময়ের স্ট্যাচুত্ব ভেঙ্গে আমার স্বামী কোনোরকমে সঙ্গম শেষ করে। যদিও ততক্ষণে আমরা দু’জনেই ঠাণ্ডা হয়ে গেছিলাম। সে তখনই কিছু বলে না কিন্তু আমি বুঝতে পারি মনে মনে—একটা ভালো ভুল করে ফেলেছি। কিন্তু আমার কী দোষ বল, আমি তো চাতুরি করেই ছিলাম, তার সঙ্গে মিলিত হলেও তোমার সঙ্গে মিলিত হয়েছি বলে মনে হত, মুখের সামনে ভেসে থাকত তোমার মুখ। তারপরেও তোমার নাম কোনোদিন উচ্চারণ করিনি। কিন্তু সেদিন কেন যে এমন কথাটা বেরিয়ে গেল এখনো বুঝে উঠতে পারি না। এরপরে যখন বাচ্চাটা হলো তখন আমার স্বামী অবাক হলো বা সন্দেহ করল। কিন্তু আমি অবাক হলাম সবচেয়ে বেশি। কারণ তোমার সঙ্গে আমার সংশ্রব হওয়াতো দূরের কথা, তোমার হাতের কাছাকাছিই কোনোদিন যাইনি আমি। আমি একটা ব্যাখ্যা তৈরি করার চেষ্টা করলাম। ভাবলাম প্রতিটা মানব সন্তান প্রথমে ভাব হয়ে থাকে। মানে, সন্তানের রূপমূর্তি মায়ের মনে ভাব হয়ে থাকে। আমার ভেতরেও আমার এ সন্তানের রূপটা ভাব হয়ে ছিল বলেই এমন হয়েছে। আমার স্বামীর সঙ্গে রমণের সময় তোমার সঙ্গে রমণ করছি বলে ভাবতাম বলেই এমন হয়েছে।’ কথা বলতে বলতে ‘প’ বিষণ্ন হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কথা বলা শেষ করে আমার দিকে তাকায়। একধরনের ভালোলাগার বোধ তৈরি হয় আমার ভেতর। আমার ভালো লাগে। আমি আমার সন্তানকে বুকে টেনে নিলাম।
[আমার সমাপ্তি, এ দুটো সমাপ্তির চেয়ে মোটেও ভালো হত না। অতএব অনুরোধ, লতিফা ইয়াসমিনের সমাপ্তি বা মোমিনুল বারির সমাপ্তিকেই গল্পটার সমাপ্তি হিসেবে ধরে নিন অথবা পূর্ব অনুরোধ মত নিজেরাই একটা সমাপ্তি তৈরি করে নিন।]