রুমে ঢোকার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনি প্রথম প্রশ্নটি করলেন, আপনার হাজবেন্ড কেমন আছেন? তার প্রশ্নটি এবং থ্রোয়িংয়ে দরদ এমন যেন তিনি আমার হাজবেন্ডকে বহু বছর ধরে চেনেন। অনেক দিন দেখা হচ্ছে না তাই আমার কাছ থেকে তার কুশল জেনে নিচ্ছেন। প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে চাইলাম না। একটু সময় নিয়ে কী বলবো সেটা ভাবতে চাইলাম। নিজেকে প্রশ্ন করলাম অপু কি এখনো আমার হাজবেন্ড আছে? তার পরিচয় কি আমি এখনো বহন করছি? অপুর সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে প্রায় নয় মাস। না এখনো নয় মাস হয়নি। আট মাস সাতাশ দিন। আর তিন দিন পর নয় মাস হবে। হুম এই আট মাস সাতাশ দিনের প্রতিটি দিনই আমার গননায় আছে। কারণ আমি অপুকে এখনো ভালোবাসি। আমি কোনো জবাব না দিয়ে ঠোঁটে মার্জিত হাসি লেপ্টে বললাম, আপনি ভালো আছেন?
আমার ক্ষাণিক নীরবতায় রুমে যে থমথমে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তার হাসি সেটা কাটিয়ে দিলো। তিনি হয়তো অপুর কথা ভুলেই গেলেন। কিংবা আমার এড়িয়ে যাওয়াটা বুঝে ভুলে যাওয়ার ভান করলেন। প্রাথমিক কুশল বিনিময় শেষে আমাকে লাঞ্চ করানো নিয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। অফিস সহকারীকে ডেকে কী খাবো জানতে চাইলেন। আবার বললেন আমি চাইলে পাশের কোনো রেস্টুরেন্টেও বসতে পারি। আমি ব্যস্ত হলাম না। ছোট করে বললাম, আরে ব্যস্ত হবেন না। লাঞ্চ করা যাবে। আপনার সঙ্গে প্রথম দেখা হলো, গল্প করা যাক।
একটু থেমে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বললাম, যদি আপনার সময় থাকে!
তিনি আমার কথা শেষ না হতেই ব্যস্ত হয়ে জবাব দিলেন, আরে সময় থাকবে না মানে! আপনি আমার অফিসে এসেছেন এ তো অষ্টম আশ্চর্য! আর দেখা হওয়াটা অলৌকিক।
ভদ্রলোক আবার হাসলেন। তার হাসিটা মেকি না। স্বভাবজাত। মুখ ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানিয়ে যায়। লাঞ্চ নিয়ে আমার উদাসীনতায় তিনি আশ্বস্ত হলেন না। পিয়ন দাঁড়িয়েই থাকলো। তিনি আবার বললেন, বলুন কিছু একটা।
আমি হেসে বললাম, আপনার পছন্দ মতো বলুন।
তিনি পিয়নকে ভাত, শিং মাছ, গরুর কালা ভুনা, ডাল, সবজি নিতে আসতে বললেন। অর্ডার দিতে পেরে তাকে খুশি মনে হলো। মোতালেব সাহেবের বয়স পঞ্চান্ন প্লাস হবে। লম্বায় পাঁচ ফিট ছয়-সাত ইঞ্চির মতন। পেট অন্যসব ব্যাংককারদের মতোই। মাথার চুল পুরোটাই সাদা। মুখে দাড়িহীন। সাদা গোঁফ। দেখে যে কেউ মার্জিত ভদ্রলোক হিসেবে মেনে নেবেন। বছর তিনেক আগে থেকে প্রথম তার সঙ্গে আমার ফেসবুক ইনবক্সে হাই-হ্যালো হয়। গত তিন বছরে অল্প-বিস্তর কথা হয়েছে। তবে কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি সেরকম। না ভাই, না বন্ধু, না অন্য কিছু। তারপরও আমাদের মাঝে কথা হয়। সেটা বেশ মার্জিত। নরমাললি মাঝ বয়সী পুরুষরা কিংবা পৌঢ় পুরুষরা মেয়ে দেখলে যেরকম চুকচুক করে, সেরকম কিছু পাইনি তার মাধ্যে। তিনি বেশ মার্জিত এবং সাবলীল। অপুর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর থেকেই আমি ফেসবুকে অনিয়মিত। এক রকম ঠিক করেছিলাম ফেসবুক আর ব্যবহার করবো না। কিন্তু ছাড়তে পারছিলাম না। তিন মাস ফেসবুক আইডি ডি-অ্যাক্টিভ করে রেখেছিলাম। গত সপ্তাহে আবার অ্যাক্টিভ করেছি।
দিনে কত বার যে অপুর কথা মনে পড়ে, তার হিসাব নেই। কিন্তু তারপরও গত নয় মাসে অপুর সঙ্গে একবারও কথা বলিনি আমি।
পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কোনো কিছু আমি বিশ্বাস করি না। কারণ অপু ছাড়া আমি এত দিন থাকতে পারবো এটাও অবিশ্বাস্য ছিল কিন্তু থাকতে পারছি। আবার যখন ফোন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না তখনো মানুষের জীবন যাপন স্বাভাবিক ছিল। আমরা আসলে অভ্যাসের কাছে পরাজিত হয়ে যাই। আর অন্য সবকিছুর মতোই ভালোবাসাটাও হয়তো একটা অভ্যাস মাত্র!
বহুদিন পর মতিঝিলে এসেছি। দিন না বলে বছর বলাই ভালো। হিসাব করে দেখলাম প্রায় তিন বছর হবে। শেষ বারও এমন একাই এসেছিলাম। অফিসিয়াল কাজে। আজ এসেছি ব্যক্তিগত কাজে। দরকার ছিল আরও আগেই আসার। কিন্তু নানান কারণে সেটা হয়ে ওঠেনি। বাসা থেকে বের হয়ে পথে পথে ভেবে নিয়েছি কাজ শেষ করে কার কার সঙ্গে দেখা করবো। কিংবা কার কার সঙ্গে দেখা করা যায়। মতিঝিলকে বাংলাদেশের ব্যাংকপাড়া বলা হয়। প্রায় সব ব্যাংকের হেড অফিস এখানে। সে কারণে আমার ব্যাংক রিলেটেট মানুষদের মনে পড়লো। মনে করার চেষ্টা করি কে কে এখানে আছে। প্রথম সার্চেই তিন জনকে খুঁজে পাই। একজন আমার মামাতো ভাইয়ের শালী লতা আপু। যার সঙ্গে দু বছর আগে শেষ দেখা হয়েছিল এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। তখন জেনেছিলাম তিনি জনতা ব্যাংকের হেড অফিসে বসেন। তার ফোন নম্বরও আমার ফোনে সেভ করা আছে। তবে কখনো ফোন করা হয়নি। আর যে দুজনকে মনে পড়লো, তারা কেউই তেমন ঘনিষ্ঠজন নন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিত। দুজনই বড় কর্মকতা। একজনের নাম মনে থাকলেও আরেকজনের নামই মনে পড়ছে না। তবে ম্যাসেঞ্জারে খুঁজলে নাম ফোন নম্বর সবই পাওয়া যাবে। ইনবক্সে একাধিকবার কফি খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু কখনো দেখা হয়নি। আমার এই এক সমস্যা; হুডহাট মানুষের নাম ভুলে যাই। আর এই কারণে প্রায়ই পথঘাটে বিব্রত হতে হয়।
গত মাসের ঘটনা, বসুন্ধরা সিটির ফুটকোটে বসে কলিগ ও বন্ধু রতনের সঙ্গে গল্প করছি। হঠাৎ একজন মহিলা এসে সামনে দাঁড়ালেন। দেখে চেনার উপায় নাই তিনি বাংলাদেশি। মুখের মেকাপ আর হিজাবের নিখুঁত ব্যবহার তাকে আরবীয় করে তুলেছে প্রায়। যদিও শরীরের গঠনে বাঙালিয়ানা স্পষ্ট। বয়স কমাতে যত রকম চেষ্টা আছে বোঝা যাচ্ছে, কোনোটারই ত্রুটি তিনি করেনি। যেন হাজার বছরের পরিচিত এমন ভঙ্গিতে বললেন, আরে আপু আপনি এখানে? কেমন আছেন? অনেক দিন পর দেখলাম আপনাকে। একদম আগের মতোই আছেন? কেমনে যে নিজেকে এত ফিট রাখেন?
তারপর মহিলা তার সঙ্গে থাকা পেটওয়ালা প্রায়বৃদ্ধ পুরুষটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তার মুখে আলগা বিনয়। যেন সে আমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ধন্য। আমিও সামাজিকতার খাতিরে রতনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। তারপর ব্যস্ততা দেখিয়ে জামাইকে নিয়ে চলে যেতে যেতে বাসায় বেড়াতে যাওয়ার বিশেষ আবদার জানিয়ে গেলেন। এই টোটাল সময়টা আমি যে বিব্রত ছিলাম, সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছিল রতন। চলে যাওয়ার পর হেসে উঠলো, তুমি নিশ্চয়ই এদের চিনতে পারোনি!
আমি অবাক, তুমি বুঝলে কিভাবে?
রতনের স্বভাব সুলভ হাসি। আমার চিন্তিত ভঙ্গিতে জবাব দেই, একদম ঠিক। মনে করতে পারছি না। মহিলা কী যে মনে করলো!
রতন আবার হাসলো, আরে মনে করার সময় পেলো কখন! সে এই অল্প সময় যতগুলো কথা বলেছে তাতে আবার মনে করার সময় আছে নাকি!
এবার আমিও হেসে উঠলাম। আমি চিনতে পারিনি সেটা ওই মহিলা না বুঝতে পারলেও ছেলে বন্ধু নিয়ে সন্ধ্যার পর এখানে ওখানে আড্ডা দিচ্ছি সে খবর নিশ্চয়ই পেটে রাখবে না। রসিয়ে রসিয়ে প্রচার করে দেবে সবার কাছে।
আমার কাজ পৌনে একটার দিকে শেষ হলো। প্রথমে ভাবলাম লতা আপুকে ফোন দেই। পরে আবার ভাবলাম তার সঙ্গে দেখা হলে আর বাকি দুজনের কারও সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাবো না। আর তিন জনের সঙ্গে একদিনে দেখা করাও সম্ভব না। ঠিক করলাম অগ্রণী ব্যাংকের জিএম সাহেবের সঙ্গে দেখা করবো। আমার কাজে হয়তো তিনি কোনো সহযোগিতাও করতে পারবেন। যদিও কারও হেল্প নিয়ে আমি কাজটি করতে চাই না। ম্যাসেঞ্জারে স্ক্রল করে মোতালেব সাহেবকে খুঁজে পেলাম। অনেক দিন কথা হয়নি তার সঙ্গে। পুরো নাম মোতালেব হোসেন খন্দকার। ম্যাসেঞ্জারে ফোন না দিয়ে নম্বর খুঁজে ফোন দিলাম। তিনি প্রথমে না চেনার ভান করলেও দ্বিতীয় কাথায়ই চিনলেন। আমি মতিঝিলে আছি জানাতেই খুশি হয়ে তার অফিসে আমন্ত্রণ জানালেন।
মোতালেব সাহেবের সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য পনেরো-ষোল বছর। তিনি বিয়ে করেননি। কেন করেননি এরকম প্রশ্ন আমার মধ্যে তৈরি হলেও কখনো জানতে চাইনি। মনে মনে ভেবেছি কারও একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় জানার অধিকার নিশ্চয়ই আমার নেই। কিন্তু তিনি আমাকে নানান রকম প্রশ্ন করতেন। তবে সেগুলোও খুব ব্যক্তিগত নয়। কখনোবা শ্রীকান্তের কণ্ঠে একটি রবীন্দ্র সঙ্গীতের লিংক দিতেন ইনবক্সে। তবে আমার অপুর প্রতি প্রেম-ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখে তার যে ঈর্ষা লাগতো সেটা মাঝে মাঝে স্পষ্ট করেই বলতেন। এটাও বলতেন যে, আপনার মতো বউ পাওয়া তো যে কোনো পুরুষের সৌভাগ্য। আমি হাসির ইমো দিতাম।
মোতালেব সাহেবের কথা জানতো অপু। এ নিয়ে অপুর কোনো সন্দেহ কিংবা আপত্তি ছিল না। কারণ আমার প্রতি অপুর ওইরকম আস্থা ছিল। তারপরও আমাদের একসঙ্গে থাকা হয়নি। সাড়ে তিন বছরের প্রেম। এগারো বছরের সংসার। নয় বছরের একটি মেয়ে। কোনো কিছুই আটকে রাখতে পারেনি আমাদের। না তেমন কিছু ঘটেনি। যে কারণে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। বরং এটা বলা যায় যে আমরা নিজেদের মতো থাকার জন্য আলাদা হয়ে গেছি। অপুর প্রতি এখানো আমার শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আছে। কিন্তু কোনো টান নেই। আকুতি নেই। নিবেদিত হওয়ার তাড়না অনুভব করি না। অপুকে প্রথমে আমিই কথাটি বলেছিলাম। অপু হেসেছিল। বলেছিল, কী বলছ আবলতাবল। তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
আমি বুঝছিলাম। অপু বিষয়টি বুঝতে পারছে না। আমি আরও সময় নিতে চাইলাম। আস্তে আস্তে অপুকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। দেখলাম অপুও ঠিক আমার মতোই। নিঃসঙ্গ। কিন্তু কখনোই সে আমি কষ্ট পাবো দেখে বলেনি। অভিনয় করে গেছে ঠিক আমার মতোই। আমার অভিনয়টা শুরু হয়েছিল বিয়ের তিন-সাড়ে তিন বছর পরপরই। নির্ভরতা থাকলেও শরীরিক কিংবা মানসিক টানটা আস্তে আস্তে কমতে থাকলো। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। সমস্ত পড়ালেখা, বুদ্ধি দিয়ে নিজেকে নিবেদিত করার চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হলাম। কোথায় যেন বারবার তাল কেটে যাচ্ছিল। অপু আমার এই চেষ্টা বুঝতে পারছিল কি না, বুঝতে পারিনি তখন। কিন্তু ডিভোর্সের আগে যখন অপুর সঙ্গে একদম খোলামেলা কথা হচ্ছিলো, তখন অপুও ঠিক এই কথাগুলো বলেছিল। আমার মতো করেই আপুও চেষ্টা করেছে স্বাভাবিক হতে। কিন্তু পারেনি। আমাদের পারিবারিক কিংবা শ্বশুর বাড়ির দিক থেকেও কোনো ধরনের জটিলতা ছিল না। আর্থিকভাবেও আমরা দু’জনই সাবলম্বী।
অপু একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভালো বেতনের চাকরি করে। আমি একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করি। বিয়ের পাঁচ মাসের মাথায় আমার চাকরি হয়। আমার চাকরি নিয়ে অপুর কিংবা তার পরিবারের কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু আমাদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বাসায় ফিরে দু’জনই ক্লান্ত থাকি। শারীরিক সম্পর্ক প্রতিদিন থেকে সপ্তাহে দুই দিন। তারপরে সপ্তাহে একদিন। আলোচনা করে ছুটির দিনটাকে বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু যে দম্পতির আলোচনা করে যৌন সঙ্গমের সময় দিন বেছে নিতে হয়, তারা যে কতটা ছকে বাঁধা কিংবা টান-নিবেদন হীনতার মধ্যে বসবাস করছে, সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম।
ভদ্রলোকের ফোনের রিংটোনে আমার চিন্তায় ছেদ পড়লো। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সরি ফোনটা একটু রিসিভ করি। যেন তিনি আমার অনুমতি নিয়েই ফোন রিসিভ করবেন। না বললে রিসিভ করবেন না। আমি সম্মতি সূচক হাসলাম। তিনি কথা বলতে বলতে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বৃষ্টি বিদায় করে হালকা রোদ উঠছে। আমি চেয়ার থেকে উঠে জানালা খুলে দিলাম। হালকা মোলায়েম বাতাস। আমি আবার পেছনে ফিরে গেলাম।
বিয়ের আগে বিভিন্ন স্থানে অপুর সঙ্গে আমার ঊনপঞ্চাশ বার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল। প্রতিটি মিলনের পর আমি ডায়েরিতে লিখে রাখতাম। এই ঊনপঞ্চাশ বারের কোনো বারই আমার অমতে কিছু হয়নি। কিন্তু বিয়ের পর কতবার যে আমার অমতে কিংবা উদাসীনতা থাকা সত্ত্বেও শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে সেটা আমিও যেমন জানি না, অপুও জানে না। সেটাকে গুনে রাখার প্রয়োজনও মনে করিনি। কারণ বিয়ের আগে হওয়া সম্পর্কটা আমার কাছে একটা থ্রিল মনে হতো। আর বিয়ের পর হওয়া সম্পর্কটাকে একটা ডিউটি মনে হতো। যেন এটাও একটা অফিসিয়াল ডিউটি। দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনার পর অবশেষে আমি ও অপু বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। অপু একটি প্রস্তাব রাখলো, আমরা তিন বছর আলাদা থাকার পর যদি আবার এক অন্যের প্রতি টান অনুভব করি, তাহলে আবার বিয়ে করবো।
আমি অপুর প্রতি ওর ভালোবাসা অনুভব করলাম। অভ্যাসকে মিস করবে সেটাও বুঝলাম। কিন্তু পাত্তা না দেওয়ার মতোন করে হাসি দিলাম। তারপর কৌতুক করে বললাম, তখন কিন্তু হিল্লে বিয়ে করতে হবে জানো তো?
আপুও হাসতে হাসতে বলল, করবা সমস্যা কী?
না সমস্যা কিছু না। অন্য একজন পুরুষের সঙ্গে শুবো সেটা তোমার ভালো লাগবে তো? আর তার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর সে যদি ছাড়তে রাজি না হয়?
ছাড়াতে রাজি না হলে তুমি ডিভোর্স দিবা। তার যদি তাকে ভালো লাগে তার সঙ্গেই থেকে যাবা।
এই প্রসঙ্গ নিয়ে হাসি তামাসা করলেও এটা নিয়ে মুক্ত আলোচনা করার মতো মানসিক অবস্থা সেদিন আমাদের কারোই ছিল না।
ভদ্রলোক রুমে প্রবেশ করলেন। টের পেয়ে আমি জানালা থেকে সরে আসলাম। কী বৃষ্টি দেখছিলেন? আমি কোনো জবাব না দিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসলাম। আমি তখনো অপুর মধ্যে ডুবে আছি। হঠাৎ করে মেয়েটার কথাও মনে পড়লো। মেয়ের জন্মের আগেই আমরা জেনে যাই আমাদের মেয়ে হবে। নাম রাখা নিয়ে একমাসব্যাপী গবেষণা চলে। তারপর আমরা দুজনে দুটো নাম পছন্দ করি। দুজনের নামের থেকে অক্ষর নিয়ে একটা নাম রাখার ডিসিশান নেই। রুহির আমার কাছে থাকার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত অপুর মা এটা হতে দেয়নি। ভদ্র মহিলার প্রতি আমার কখনোই কোনো অভিযোগ ছিল না। অভিযোগ করার মতো কখনো কোনো আচরণ তিনি করেননি। কিন্তু মেয়েকে ছাড়া থাকার কষ্টটা তার জন্য আমার করতে হচ্ছে। পরে অবশ্য চিন্তা করে দেখলাম আমার কষ্ট হলেও এটা ভালোই হয়েছে। রুহির সঙ্গে সপ্তাহে একবার কথা হয় আমার। তবে অপুর সঙ্গে কথা হয় না। আমি ইচ্ছে করেই এটা এভয়েড করি। দিনে কত বার যে অপুর কথা মনে পড়ে, তার হিসাব নেই। কিন্তু তারপরও গত নয় মাসে অপুর সঙ্গে একবারও কথা বলিনি আমি।
তিনি চমকালেন কি না জানি না। কিন্তু আমি তার কথা শুনে চমকে উঠলাম। তিনি বললেন, জানি।
পিয়ন খাবার নিয়ে এলো। আমি শিং মাছ আর ডাল দিয়ে ভাত খেলাম। আমার খাবার দেখে মোতালেব সাহেব হাসলেন।
এত কম খেয়ে বেঁচে থাকেন কেমন করে!
আমি হেসে বললাম, একটু কন্ট্রোল না করলে বুড়িয়ে যাওয়া মানুষটাকে দেখে কারও যে আর ভালো লাগবে না।
তিনি যেন প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। বললেন, যার ভালো লাগার যে-কোনো রকম থাকলেই লাগবে।
নিজেকে মোটা দেখতে আমার ভালো লাগে না। আর ফিট থাকতে একটু কন্ট্রোল তো করতেই হয়।
এবার তিনি জোরে হাসলেন। নিজের পেটের দিকে দেখিয়ে বললেন, এই যে দেখেন আমি কেমন কন্ট্রোল করছি।
বাকি খাবার তিনি একাই খেলেন। আমি অবাক হলাম না। না খেলেই বরং অবাক হতাম। কারণ না খেলে তার শরীর ও ভুড়ির প্রতি অসম্মান করা হতো।
আমি স্বাভাবিক হলাম। গল্প চলতে লাগলো। মাঝে মাঝে পিয়ন এসে দু-একটা কাগজে সই নিয়ে যাচ্ছে। তিনি তার বাল্য প্রেমের কথা বললেন। প্রেমিকার আত্মহত্যাই যে তার বিয়ে না করার কারণ সেটা বেশ বুঝতে পারলাম। কথা বলতে বলতে তিনি হঠাৎ উদাস হয়ে গেলেন।
দেখুন একটা জীবন তো কোনো রকম চলেই যায়। কিন্তু যে মানুষটা আমার প্রতি আস্থা রেখে জীবন উৎসর্গ করেছে তাকে ভুলে যাওয়াকে আমি পাপ মনে করি। আমরা যখন এক সঙ্গে বিষ খেয়েছিলাম তখন তো আর জানতাম না যে আমি বেঁচে যাবো। আমিও তো মরে যেতে পারতাম। ভাগ্য আমাকে নিয়ে কৌতুক করলো।
আমি গভীর বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন বাল্য প্রেমের ছবি দেখা যাচ্ছে। তিনি আবার শুরু করলেন, কারিমা আর আমি একই ক্লাসে পরতাম। ক্লাস এইটের শেষ দিকেই আমাদের প্রেম হয়ে যায়। আর নবম শ্রেণিতে সেটা গ্রামে জানাজানি হয়ে যায়। তারপর আমার কিংবা তার বাড়িতে থাকার অবস্থা নাই। বাবা-মায়ের পক্ষ থেকে ভৎসনা। এরকম অসহ্য যন্ত্রণা থেকে বাঁচতেই আমরা নবম শ্রেণির দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা চলছিল সেদিন।
ভদ্রলোক আবার থামলেন। আমি বুঝতে পরছিলাম। তিনি এই গল্পটা আর দীর্ঘ করতে চান না। আমিও যেটা জানার বা বোঝার ছিল বুঝে গেছি। তেমন ভেবে তার নিঃসঙ্গতার প্রশ্ন করলাম না। কেবল জানালার ওই পাশে চড়ুই পাখির ডানা ঝাপনাটানো দেখতে লাগলাম।
তিনি নিজেকে সামলে আবার শুরু করলোন, হুম এখন এই বয়সে এসে মনে হয় একজন মানুষ থাকলে খারাপ হতো না। যে চলে গেছে তাকে ভেবে বাস্তবিক সময়টা বিসর্জন দিয়েছি। এটাকে ভুল মনে হয় না। তবে এই বয়স কারও প্রতি নির্ভরতা খুঁজে।
আমি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার চেষ্টা করলাম। তিনিও হয়তো ইচ্ছে করেই নিজের গল্পটাকে আর দীর্ঘ করলেন না। যেহেতু আমরা দুজনই ব্যাংকার তাই সরকারি বেসরকারি ব্যাংকের নানা সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা চললো।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম পাঁচটা ছুঁইছুঁই। আমার খুব তাড়া না থাকলেও নিজেকে একা রাখার একটা তাড়া অনুভব করলাম। টেবিলে রাখা সাইট ব্যাগটি হাতে নিয়ে বললাম, আজ তাহলে উঠি।
ভদ্রতা দেখিয়ে তিনি বললেন, অবশ্যই। অবশ্যই।’
কিন্তু তার মুখ বলছিল আড্ডাটা আরও দীর্ঘ হলে ভালো হতো। আমরাও খারাপ লাগছিল না। কিন্তু কী কারণে যেন অপুকে খুব মিস করতে লাগলাম। মন খারাপ হয়ে গেলো। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম। তিনিও আমাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য দাঁড়ালেন।
আমাকে এগিয়ে দিতে নিচতলা পর্যন্ত আসলেন। বিদায় নেওয়ার পূর্বক্ষণে বললেন, অপু সাহেবকে আমার সালাম জানাবেন।
এবার আর নিজেকে লুকিয়ে রাখলাম না। আমি বললাম, আমাদের গত ফেব্রুয়ারিতে ডিভোর্স হয়ে গেছে।
তিনি চমকালেন কি না জানি না। কিন্তু আমি তার কথা শুনে চমকে উঠলাম। তিনি বললেন, জানি।
তার মুখের দিকে তাকানোর সাহস হলো না। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি আর দাঁড়ালাম না। দ্রুত পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। পেছন থেকে হয়তো তিনি ডাকলেন অথবা ডাকলেন না।