নীরার সঙ্গে আমার দেখা একটা গল্পের ভেতর। ঈষৎ নীল আর ধূসর বর্ণের মিশ্রণে সেই গল্প। যার প্রতি লাইনে কেমন উত্তেজনা, কখনো চড়াই, কখনো উৎরাই। মনে হয় এই বুঝি পড়ে যাচ্ছি খাদের অতলে। কখনো আবার দীর্ঘক্ষণ জলে ডুবে থাকার পর ভুস করে মাথা তুলেছি। এরপর ফুসফুস ভরে বাতাস টেনে নাও। এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যে, গল্পটা এমনি এমনি হয়েছে। বরং এর প্রতিটি শব্দ, বাক্য, প্যারা লেখা আছে একটা গোপন বইতে। যে বই রাখা ছিল আমার ভেতর অলিন্দের ব্যক্তিগত কুঠুরির মাঝে। এরপর একদিন ঠিক মধ্যরাতে যখন ঘুম আসছিল না, তখন ভাবলাম বইটা বের করি। চোখ বন্ধ করে হাঁটছিলাম স্মৃতির করিডোরে। যেন একটা টানা লম্বা বারান্দা আমার সামনে। ওই রেলিংয়ের ওপাড়ে দূরে দেখা যায় কালচে সবুজ ঘন বন আর তার মাথার ওপরে ভরাট নীল আকাশ। আশপাশে রোদ নেই, বরং মন্দা একটা আলো আর হালকা কুয়াশা আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে গোটা পরিবেশ। আমি সেই ভাবনার বারান্দায় আনমনে কতক্ষণ হেঁটেছি জানি না।
টানা বারান্দার শেষ মাথায় দেয়ালঘেঁষে দাঁড়িয়ে একটা মিশমিশে আবলুস কাঠের বুক সেলফ, ওর তাকে সাড়ি করে সাজানো পাতলা খয়রি চামড়ায় মোড়ানো বই। সেখান থেকে ধুলো পড়া একটা বই খুলে বসলাম পাশের ইজিচেয়ারে। ধুলো ঝেড়ে বইয়ের প্রচ্ছদ উল্টাতেই আমার সঙ্গে দেখা হলো নীরার। বসন্তের শেষদিকের ওই দিনে একটা হালকা কালো ব্লাউজের ওপর মাখনরঙা শাড়ি পড়ে নীরা ফুটপাতের চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল, ও বুঝি কারও জন্য অপেক্ষা করছে। দৃশ্যটা কেন যে এত তীব্র আকর্ষণ করলো, জানি না। শুধু মন্ত্রমুগ্ধের মতো তখনো অপরিচিত মেয়েটার দিকে আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, আমাকে চিনতে পারছেন? না চেনারই কথা। আমাকে চেনার কোনো কারণ নীরার নেই। তবু আমার এই কথার কথা বাক্যালাপের সূচনা করে দিলো। নীরা বেশ সন্দেহ নিয়েই বলেছিল, আপনাকে কোথাও দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। না কি দেখেছি?
আসলে নীরা আমাকে কোথাও দেখেনি। কিন্তু ও কী করে জানবে, আমার বিবলিয়ো অদৃষ্ট দেখা যায় না এমন সুক্ষ্ণ সুতায় প্যাঁচিয়ে ওকে এনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে এই ফুটপাতে। এতক্ষণ নীরা যার জন্যই অপেক্ষা করুক না কেন, আপাতত আমার সঙ্গেই কথা বলা ওর নিয়তি। তাই অন্য প্রসঙ্গে না গিয়ে আমি সরাসরি নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম। মেয়েটি সহজভাবেই উত্তর দিয়েছিল, ওর নাম নীরা। গত রাতে একটা বাতাসের কুহক এসে ওকে বলেছে, কাল দুপুরের রোদটা যখন একটু মরে আসবে তখন যেন হালকা কালো ব্লাউজের ওপর মাখনরঙা শাড়ি পরে এসে এখানে দাঁড়ায়। মলিন পোশাক পরা একজন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মানুষ আসবেন দেখা করতে। নীরা মানুষটিকে মনে মনে কাফকার দ্য ক্যাসলের সেই প্রোটাগনিস্ট ভেবে নিয়েছিল। ভূমি জরিপের মতো কাঠখোট্টা কোনো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর আগে মানুষটা গ্রাম সংলগ্ন কোনো সরাইখানায় বসে ওর সঙ্গে এক কাপ পোড়াগন্ধি কফি খেতে চায়। কিন্তু ওর ভুল ভেঙে সামনে আমি উপস্থিত হলাম।
আমি তার কল্পনার সেই প্রোটাগনিস্টের মতো না হওয়ায় নীরা বোধয় কিছুটা হতাশই হয়েছিল। যাই হোক, তবু আমাদের বাক্যালাপ চলে। আমরা সহজ ও হালকা নানা বিষয়, এই যেমন আজ আবহাওয়াটা কেমন নিরুত্তাপ অথচ সুন্দর, বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে কিনা, শহরে ট্রাফিকের হালচাল, লোকজন ডাস্টবিনে ময়লা না ফেলে রাস্তায় ফেলছে, এসব নিয়ে কথা বলতে বলতেই সামনে হাঁটছিলাম। আমরা এসে দাঁড়ালাম কানা রাস্তার মুখে একটা বুড়ো নাগালিঙ্গম গাছের কাছে। এবার সরাসরিই নীরার চোখের দিকে তাকাই। আমার তীব্র দৃষ্টির সামনে ও কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেও ঠিকই বুঝেছিল আমি ওকে বিশেষ কিছু একটা বলবো। আর রাখঢাক না রেখে ওকে বলেছিলাম, নীরা আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আপনি দেখতে অনেকটা স্বাভাবিক সুন্দরী। আপনার চোখ, টিকালো নাক, ঠোঁটে কোনো বাড়তি কারুকাজ নেই, অথচ সব কেমন সুন্দর! কিন্তু সব ছাপিয়ে আরও সুন্দর আপনার দুটি স্ফিত স্তন।
প্রথম দেখাতেই কোনো ভদ্রলোক আরেকজন ভদ্রমহিলাকে তার স্তন সম্পর্কে প্রশংসা করবে এমনটা বোধ করি কখনো হয়নি। আর কখনো হয়নি বলে যে এখনো হবে না তেমন কোনো নিশ্চয়তা না থাকায় শব্দটা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়েই গেলো। আমার কথাতে নীরা সম্ভবত কিছুটা হতভম্ভ। ঠিক কী বলবে ও বুঝতে পারছিল না। আমিই ওকে সাহায্য করলাম সহজ হতে। নীরা, আপনি ভুল বুঝবেন না। আমার দৃষ্টি বা শব্দচয়ন এমন কিছু ইঙ্গিত করছে না, যা অসুন্দর। আপনার স্তন দুটি সত্যিই সুন্দর। যেন অদৃশ্য এক আকর্ষণে আমাকে ওরা বলছে, দেখো আমাদের দেখো। আপনার স্তন দুটির মতো এমন সুউচ্চ সুন্দর আমি দেখেছিলাম পাহাড়ে। সবুজে ঘেরা জোড়াপাহাড়, যার ওপরে উঠতে ঘাম ঝরাতে হয়। অথচ একবার যদি ওঠা যায় তাহলে চারদিকে খালি চক্ষু স্বার্থক সৌন্দর্। নীরা আপনি আমার কথায় আঘাত পাননি তো?
ও কিছু না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার প্রশ্ন শুনে যেন কিছু বলতে চাইলো, অথচ পারলো না। আমি ওকে বললাম, চলুন নীরা আমরা আরও কিছুক্ষণ হাঁটি। আপনি হয়তো আমাকে খারাপ মানুষ ভাবছেন। কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকুন আমি তেমন নই। অন্তত আমার দ্বারা আপনার কোনো ক্ষতি হবে না।
এবার নীরা অস্ফুট স্বরে বললো, আমার শরীরের এত স্থান থাকতে প্রথমেই কেন স্তনের দিকে চোখ পড়লো? না কি এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সুযোগসন্ধানী; কী চান আপনি আমার কাছে? ওর কথা শুনে আমি কতক্ষণ হেসে নেই। তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে ওকে বললাম, শরীরের যুদ্ধ থেকে বহুদূর চলে গিয়ে ফিরে আসি শরীরের কাছে। কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে। শিশিরে ধুয়েছো বুক, কোমল জোছনার মতো যোনি মধুকূপী ঘাসের মতন রোম, কিছুটা খয়েরি। কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।
বিশ্বাস করো, ওই ঈষৎ কালো মেয়েই আমাকে প্রথম শিখিয়েছিল মাতৃস্তনের বাইরেও একেবারে অন্যরকম একটা দৃষ্টি আর সংজ্ঞা আছে স্তনের।
এতক্ষণ আমি যা বলেছি তা হয়তো বিস্মিত করেছে নীরাকে। কিন্তু এবার নীরা আমাকে বিস্মিত করলো। কথা কেড়ে নিয়ে ও নিজেও বলে চলে সেই সব লাইন, যা হয়তো গোপনে তাকে বলেছিলেন তার নীল উপাধ্যায়। তাই তো নীরার আজ হঠাৎ মনে পড়ে গেছে সব- আমার নিশ্বাস পড়ে দ্রুত, বড় ঘাম হয়, মুখে আসে সত্যি। কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে। নয় ক্রুদ্ধ যুদ্ধ, ঠোঁটে রক্ত, জঙ্ঘার উত্থান, নয় ভালোবাসা। ভালোবাসা চলে যায় একমাস সতোরো দিন পরে অথবা বৎসর কাটে, যুগ, তবু সভ্যতা রয়েছে আজও তেমনি বর্বর। তুমি হও নদীর গর্ভের মতো, গভীরতা, ঠাণ্ডা, দেবদূতী, কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে। হা হা, কথাগুলো ও কেমন নিস্পৃহেই বলেছিল।
এই সব হিমযুগ কবিতা আউড়াতে আউড়াতে আমি আর নীরা হেঁটে চললাম সামনে। আপনি থেকে আমরা ততক্ষণে নেমে এসেছি তুমিতে। যতক্ষণ না পযর্ন্ত ও আমাকে প্রশ্ন করলো, তুমি কি নীলের আবছায়া? অথচ ও এতটুকু ভাবলো না, আমি কিভাবে এর উত্তর জানবো?
এখন আমি ওকে পাল্টা প্রশ্ন করি, তুমি কি সেই নীরা, যার অসুখ হলে শহরের সবাই বড় দুঃখে থাকে? অফিস সিনেমা পার্কে লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখে রটে যায় তোমার নাম? আমার প্রশ্ন শুনে নীরা হাসে। তারপরও ওর মুখভঙ্গিতে এমন একটা উত্তর লেখা থাকে, যার আমি পাঠোদ্ধার করতে পারি না। অথচ স্পস্ট বুঝতে পারি এ হলো আমাদের এক বিবলিয়ো সম্পর্ক। এখানে ও নীরা হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। আবার আমি নীল না হলেও কিছু আসে যায় না। এইসব এলোমেলো ভাবনা আমাদের অনুসরণ করছিল ছায়ার মতো। আমি নীরাকে বললাম, তুমি হয়তো ভাবছ এত কিছু থাকতে স্তনের দিকেই চোখ গেল কেন আমার। এমন প্রশ্ন মনে আসাই স্বাভাবিক। আসলে নারী স্তন আমার কাছে যতটা না যৌনোদ্দীপক অঙ্গ তারচেয়ে অনেক বেশি রহস্য আর কৌতূহলের নাম। রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে অবগুণ্ঠন আর কৌতূহলের তৈয়ার মাতৃস্তনের স্পর্শে। কথাটা প্রাসঙ্গিক কি না, জানি না, তবে বলে রাখা ভালো যে, আমি আমার মায়ের বুকের দুধ কখনো পান করিনি। আমাকে দেওয়ার মতো দুগ্ধ যে তার স্তনে ছিলই না। যাক সেসব কথা। শুধু এটুকু জেনে রাখো, পানের জন্য উষ্ণ সে তরল না পেলেও, মাতৃস্তনের স্পর্শ আমাকে দিয়েছিল নানা প্রশ্ন। শৈশবে আমি সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি নিজের মতো করে। মায়ের নরম কোমল পেলব সেই আদুরে স্তনের মাঝে মুখ ডুবালে মনে হতো, আমি যেন তার অস্তিত্বের অণু পরমাণু টের পাচ্ছি। মা যেন তার স্তনজোড়া শুধু আমাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্যই রেখেছেন। স্তনের মাঝে ছোট্ট দ্বীপের মতো খয়েরি বৃত্তটাকে মনে হতো পৃথিবীর প্রতিচ্ছবী। আর স্তনবৃত্তে থাকা বোঁটাটা উঁচু পর্বত। যেন সাধারণ চোখে সেই পর্বতের চূড়ায় কী আছে তা দেখা যায় না। কেবল মায়ের বুকের গন্ধ পেলেই পাহাড় জয়ের শক্তি সাহস মেলে। সেই থেকে আমি নারীদের স্তন খুব ভালো মতো খেয়াল করি।
নীরা এতক্ষণ কেবল মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনে গেছে। এবার ও প্রশ্ন করে, সে তো গেল মাতৃস্তন। কিন্তু অন্য একজন নারী, একেবারে আলাদা একজন নারীর বেলায় কিভাবে? কথা শেষ না করলেও ও কী বলতে চাইছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তোমার প্রশ্নের উত্তর আমি পরে দেবো। তারচেয়ে চলো আমরা এমন কোথাও ঘুরে আসি, যেখানে আমাদের উত্তরগুলো সব প্রশ্নেরাই দিয়ে দেবে।
এরপর নীরাকে নিয়ে আমি কখন কিভাবে কী যোগে সেখানে গেছি তা মনে নেই। শুধু মনে আছে ওর আর আমার গল্পটা ঈষৎ নীল আর ধূসর বর্ণের মিশ্রন। ইজিচেয়ারে বসে আমি বইয়ের পাতা উল্টালেও আসলে আছি নীরার সঙ্গে। আমাদের গাড়িটা একটা পায়ের মতো খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামছিল। বাতাসে নীরার চুল উড়ছে। আমাদের সম্ভাব্য গন্তব্য দূরের জোড়া পাহাড়ে। নীরা তুমি কি সেই কবিতাটা পড়েছ, ওই যে কেমন ভালোবাসা সংক্রান্ত। ভালোবাসা নয় স্তনের ওপরে দাঁত? ভালোবাসা শুধু শ্রাবণের হা-হুতাশ? ভালোবাসা বুঝি হৃদয় সমীপে আঁচ? ভালোবাসা মানে রক্ত চেটেছে বাঘ!
এটা কেমনতর কবিতা বলো তো, এটা কি তোমাকে ভেবে লেখা? নীরা তখন গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। চারদিকের মরা আলোটার তীব্রতা আর বাড়েনি, বরং ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশা বেড়েছে। খাড়া ঢাল বেয়ে কোন হরিদ্রাভ নারীর পেটের মতো মসৃন ভূমিতে গাড়ি তখন ছুটছে সামনে। আমার প্রশ্ন শুনে নীরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আর বলে- নীল বলেছিল ভালোবাসাকেই সে ভালবাসা দিয়ে যাবে। সেসব ছাড় তো, তোমার কথা বলো। সেই স্তন আর অবগুণ্ঠন রহস্য। আচ্ছা আমার কথাতেই আসি, স্বাভাবিক রীতি মেনেই আমি স্তন ঢেকে রেখেছি। কিন্তু তুমি সেই অবগুণ্ঠনের উপর দিয়ে দেখেই কীভাবে বুঝে নিলে যে আমার স্তন খুব সুন্দর?
নীরা আমি কল্পনার চোখে অবগুণ্ঠনের ভেতরেও স্তনের সুকোমলতা টের পাই। এটা খানিকটা অভিজ্ঞতা বলতে পারো। আমি সেই অস্পৃশ্য অনুভব দিয়েই আমার মতো করে স্তন ছুঁয়ে দেখি। জানো কখনো কখনো আমি একটা অদ্ভুত দৃশ্য কল্পনায় দেখতে পাই। দেখি দীঘল কেশের ঈষৎ কালো কোনো মেয়ে যে সদ্য স্নান সেরে এসে দাঁড়িয়েছে উঠানে। ওর চুল ছুঁয়ে আসা জলের বিন্দু স্থানুজ হয়ে বসেছে স্তনের জমিনে। আমি সে মেয়েটিকে চিনি না, কখনো দেখিনি। তবু হালকা ভেজা তার স্তন দেখে মনে হয়েছিল ও যেন আমার চেনা। আমি সেই পেলভ স্তন ছুঁয়ে দেখেছিলাম। আমার স্পর্শ পেয়ে ওর শরীর কেঁপে উঠেছিল খানিকটা। বুক জুড়ে হালকা সোনালি রোম কোনো এক অজানা শিরশিরানিতে হয়ে উঠেছিল স্পস্ট। বলতে বাধা নেই, স্বপ্নে পাওয়া হলেও সেটাই ছিল আমার প্রথম যৌনোদ্দীপনা। এরপর স্বপ্নে আমরা প্রায়ই মিলিত হয়েছি। ওর সুডৌল স্তন নিয়ে খেলেছি নিজস্ব খেলা। কর্ষণে ঘর্ষণে দংশনে আমি ওকে দিয়েছি উত্তেজনার পারদ। আর ছলাকলায় সে আমাকে দেখিয়েছে এক অন্যরকম স্বর্গ। বিশ্বাস করো, ওই ঈষৎ কালো মেয়েই আমাকে প্রথম শিখিয়েছিল মাতৃস্তনের বাইরেও একেবারে অন্যরকম একটা দৃষ্টি আর সংজ্ঞা আছে স্তনের। সেটা কামের, সেটা প্রেমের।
তবে যেন ভালোবেসেও জয়ী হতে হতে তুমি কামের কাছে হারে গেছ। তুমি পরাজিত বিবলিয়ো বন্ধু আমার। তোমাকে সত্যিই নদীতে সঁপে দিয়ে আমি ডুবে গেছি।
আমাদের সেই প্রেম কামের ডুব কেবলই চলছিল। অবশেষে একদিন সে আমাকে অন্যরকম এক প্রেম শেখালো। এ হলো জলের সঙ্গে সঙ্গম। মেয়েটি আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছিল নদীতে। স্রোত তখন বইছিল ভাটিমুখী। সুতাবস্ত্রহীন আমাকে সে দাঁড় করিয়ে দেয় কোমর সমান জলে। তারপর কানে কানে বলে, টের পাচ্ছ, নদী কেমন তোমার রক্তে রক্তে বয়ে যাচ্ছে? কেমন সে ইচ্ছে মতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে শরীর? এবার তার সঙ্গে তোমার সঙ্গম হতে পারে। যাও, আলগোছে ঝাঁপিয়ে পড়ো তার বুকে। আমি তাই করেছিলাম, সন্তর্পণে নিজেকে সপে দিয়েছিলাম নদীর কাছে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করেছিলাম, আহা কী অদ্ভুত আবেশ! বিশ্বাস করো নীরা, সেদিনই আমার উপলগ্ধি হয়েছিল কেন এখানে রমণীগুলো নদীর মতন, নদীও নারীর মত কথা কয়। এরপরে কতবার আমি নদীর স্তন পান করে ধন্য হয়েছি গোনা নেই। সঙ্গমে এত সুখ যে আমি নারীতেও পাইনি। যেমন তোমার উপাধ্যায় বলেছিলেন তোমাকে। তুমি নিরন্নকে মুষ্টিভিক্ষা দিলে এইমাত্র, আমাকে দেবে না? শ্মশানে ঘুমিয়ে থাকি, ছাই-ভস্ম খাই, গায়ে মাখি। নদী সহবাসে কাটে দিন। এই নদী গৌতম বুদ্ধকে দেখেছিল। পরবর্তী বারুদের আস্তরণও গায়ে মেখেছিল। এই নদী তুমি! এসব বলতে বলতেই আমি যেন কথা হারিয়ে ফেলেছি। আর কী বলবো মাথায় আসে না। নীরা একটা চোরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, আমি ঠিকই টের পাই।
মসৃণ ভূমি পেরিয়ে আমাদের গাড়ি ততক্ষণে এসে পৌঁছেছে একটা সরু পথে। যার উভয় পাশে উঠে গেছে সুউচ্চ পাহাড়। আমি গাড়ি থামালাম। এতক্ষণ নীরা কোন কথা বলেনি। নীরা তুমি কিছু বলবে না? সে চুপ করে ছিল, আমার প্রশ্ন শুনে শুধু বললো- হুম, তারপর। আমি মসৃন পাহাড়ের গায়ে হাত বুলাই। মনে হয় যেন শায়িত কোন নারীর দেহ পথ ধরে এসে পৌঁছেছি তার বক্ষযুগলের মাঝে। চলো নীরা, আমরা হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ে উঠি। পাহাড় তোমাকে বলে দেবে আমার প্রশ্নের উত্তর। যে উত্তর আমি বহুদিন বহুদিন লুকিয়ে রেখেছি নিজের মধ্যে। আজ নারীর স্তনের মতো যুগল পাহাড় বাইতে বাইতে খাঁচা খুলে বের করি সেই লুকানো পাখি। ও উড়ে যাক চরাচরে।
অতঃপর আমি আর নীরা হাঁটি।আমাদের পায়ের চাপে নুড়ি পাথর সরে সরে যায়। এটা কেমন কেমন বাতাস সঙ্গী হয়। জানো নীরা আমি সেই ঈষৎ কৃষ্ণ রমণীকে এখনও স্বপ্নে দেখি। আমাকে নদীর কাছে সঁপে দিয়ে দেখেছিলাম তাকে ডুবে যেতে। আমার কথা শুনে নীরা থেমে যায়। কেন, হঠাৎ কেন সে ডুবে গেল তোমায় ছেড়ে? ভাবছিলাম নীরার প্রশ্নের জবাব দেব। কিন্তু ইচ্ছে করলো না। মনে মনে ভাবলাম, দেখেছ নীরা আমি এমনই প্রতারক। তোমাকে কিভাবে বলি যে, বাস্তব বা কল্পনা কোথাও না কোথাও ক্ষণমুহূর্তে হয়তো আমার প্রতারণা বসেছিল খুঁটি গেড়ে। তারই শাস্তি ভোগ করে চলেছি আমি। আজ এই পাহাড়ে এসেছিলাম আমি চূড়ায় উঠে চিৎকার করে সব জানিয়ে দিতে। অথচ পারছি না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মাতৃস্তন কেমন পাল্টে গেল সামান্য নারী দেহভাগে। আমাকে তুমি ধিক্কার করতে পারো। কিন্তু কাউকে হয়তো কোনদিন বোঝাতে পারবো না, কেন হাত বাড়িয়েছিলাম।
টানা বারান্দার ওপাশে এখন রোদ মরে গিয়ে অন্ধকার ঘনিয়েছে। আমার বাস্তবের মধ্যরাতের সঙ্গে মিশেছে কল্পনার আঁধার। পাতলা খয়রি চামড়ায় মোড়া বইটা যখন বন্ধ করলাম, তখন দেখি আশপাশে আর কিছু নেই। শুধু মাথার ভেতর নীল ধূসর বর্ণের নীরার গল্প। মনে মনে বললাম, শোনো নীরা আমি জয়ী নই, আমি পরাজিতও নই, ভালোবাসায়-কামে-প্রেমে আমি এমনই একজন সামান্য মানুষ। হালকা আঁধার তখন আরেকটু রঙ ধরেছে। যেন নীরার উপলব্ধি তার সঙ্গে মিশে আমাকে ফিসফিসিয়ে বললো, তোমার কল্পনার ঈষৎ কৃষ্ণ মেয়েটি কি আমি? যার চুল ছুঁয়ে আসা জলের বিন্দু স্থানুজ হয়ে বসেছিল স্তনের জমিনে। তবে যেন ভালোবেসেও জয়ী হতে হতে তুমি কামের কাছে হেরে গেছ। তুমি পরাজিত বিবলিয়ো বন্ধু আমার। তোমাকে সত্যিই নদীতে সপে দিয়ে আমি ডুবে গেছি।