০১.
জানেন আন্টি, আপনার চেহারাটা একদম আমার মায়ের মতো! মেয়েটা হয়তো দীর্ঘদিন মাকে দেখে না বলে তাকে জনারণ্যে খুঁজে বেড়ায়।
ম্যানহাটনের হেরাল্ড স্কোয়ারের মেসিসে ঢোকার পর থেকে সাজেদা খেয়াল করলো একটা মেয়ে আড়ে আড়ে তাকে দেখছে। নিউইয়র্ক সিটিতে এখন এত বাঙালি যে, কোথাও কেউ স্বদেশি ভাই-বোনকে দেখলে বেশিরভাগ সময় কোনো কৌতূহল দেখায় না। একে অন্যকে বাঙালি বুঝলেও ইংরেজিতে কথা বলে যায় নিজের উৎসের বয়ান না দিয়ে। প্রথম প্রথম সাজেদা কিছুটা ধাক্কা খেতো। পরে বুঝলো বিশাল শহরের এটাই বৈশিষ্ট্য। নিরাসক্ততা এখানে স্মার্টনেস।
দীর্ঘ লম্বা চুলের শ্যামলা গড়ন মেয়েটির মধ্যে একটা আলগা মায়া ভাব আছে। কোমলে কঠিনে এক ধরনের ঋজু ব্যাক্তিত্ব সাধারণত এত কম বয়সের মেয়ের মধ্যে দেখা যায় না। হেরাল্ড স্কোয়ার মেসিসের সাততলার লাগেজ সেকশনে কাজ করে মেয়েটি। একটা দামি ব্র্যান্ডের লাগেজ বিক্রি করতে পারলে ভালো একটা কমিশন পাওয়া যায় এখানে।
সাজেদা একটা লাগেজ কিনতে এসেছিল সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া ছেলের জন্য। লাগেজ সেকশনে ঢোকার পাঁচ মিনিটের মধ্যে, সাজেদাকে দেখে মেয়েটি লাজুক আর কিছুটা কুণ্ঠিত কণ্ঠে মন্তব্য করে বসলো, জানেন আন্টি, আপনার চেহারাটা একদম আমার মায়ের মতো!
সাজেদার খানিকটা অস্বস্তি হয় মেয়েটার কথায়। বয়স পঁয়তাল্লিশ পার হয়ে গেলেও আয়নায় দিকে তাকালে তার নিজেকে তরুণী মনে হয়! কম বয়সের অগোছালে অবয়বের চেয়ে এখন নিজেকে গোছানো পরিপাটি দেখায়। গত দুই বছরে টিকটকে অ্যাকাউন্ট করে হাজার হাজার ফলোয়ার বানিয়েছে। টিকটক ফলোয়ারদের স্বপ্নকন্যাকে বাইশ তেইশ বছরের একটা মেয়ে আন্টি ডাকলে বিরক্ত হওয়াটা খুব স্বাভাবিক।
ম্যানহাটনের বেলভিউ হাসপাতালে শ্বশুরবাড়ির দিকের অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে এসেছিল সাজেদা। আপস্টেটের টেরিটাউনের বাড়ি থেকে এদিকে খুব বেশি আসা হয় না তার। ম্যানহাটনে এলে হেরাল্ড স্কোয়ারের মেসিসে ঢুঁ মারতে ভোলে না। সাজেদার খানিকটা বিরক্ত ও খানিকটা বিব্রত চেহারার দিকে তাকিয়ে মেয়েটা ওর ভুল বুঝতে পারলো।
দুঃখিত আপনাকে এভাবে বলার জন্য। প্লিজ কিছু মনে করবেন না!
মেয়েটার চেহারায় সততাটুকু আকৃষ্ট করলো সাজেদাকে। গত ১৫ বছর ধরে ইভেন্ট ডেকোরেশনের পেশার কারণে নিয়ত লোক চড়িয়ে খেতে হয় ওকে।
না না, মনে করবো কেন? তুমি তো খুব মিষ্টি মেয়ে!
মেয়েটা স্মিত হাসে। এই ধরনের প্রশংসা ও শুনে অভ্যস্ত মনে হলো।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!
এবার মেয়েটির সচেতনভাবে আন্টি শব্দটি এড়িয়ে যাওয়াটা ভালো লাগলো সাজেদার। ভারতীয় উপমহাদেশে মনে হয় শুধু এই অভ্যাসটা আছে! কাউকে সম্বোধনের আগে বয়সভেদে একটা সম্পর্ক জুড়ে দেওয়া! কেন রে নাম ধরে ডাকলে কী সমস্যা হয়, তার মাথায় আসে না।
কী নাম তোমার? সাজেদা প্রশ্ন করে!
এখানে সবাই তুলি বলে ডাকে।
প্রশ্নটা না করলেও হতো। মেয়েটার পোষাকের ওপর নামট্যাগ দেওয়া আছে। তবে সাজেদা জানে এই দেশে কাজের জায়গায় অনেকে উচ্চারণের সুবিধার্থে নাম ছোট করে নেয়।
০২.
তুলির সঙ্গে কথা শেষ করে সাজেদা ঘুরে ঘুরে জিনিষ দেখছিল। আশেপাশে অনেক কাস্টমার আছে। তবু তুলির নিষ্পাপ চোখজোড়া সাজেদার ওপর থেকে সরছিল না। মনের একদম গভীরে কেমন একটা টান অনুভব করছিল ও।
মাকে যখন হারায় তুলি, তখন সে শিশু। কম বয়সে মাকে হারানোর বেদনা সব সময় তার ভেতরে হাহাকার সৃষ্টি করে।
পার্স থেকে বের করে মায়ের আংশিক রঙিন, আংশিক সাদাকালো ছবিটা দেখে সে। কত আগের ছবি, তবু একটু আগে পরিচিত নারীর সঙ্গে অনেক সাদৃশ্য খুঁজে পায়। সেই একই রকম উষ্ণ মেদুর হাসি, হাসিতে উজ্জ্বল দুই চোখ, কোঁকড়ানো চুলের ছন্দময়তা, বনেদী সৌন্দর্য।
চট্টগ্রামের বাড়িতে এক দুঃসম্পর্কের ফুপুর কাছে তুলি শুনেছে, মা ছিল তার সময়ে শহরের সবচেয়ে নামকরা সুন্দরী। গানবাজনাতেও ছিল অতুলনীয়। ওই সময়ে তার হাল-ফ্যাশনের পোশাক আর সাজের গল্প মুখে মুখে ফিরতো। সেই লবঙ্গলতা, কিন্নরী কণ্ঠের মেয়েটি চিরতরে হারিয়ে গেলো পৃথিবী ছেড়ে!
জুম্বা ক্লাসের পরে জিমে গোসল করে নিয়েছে। সাজগোজের কোনো বালাই নেই। শুধু হেয়ার ড্রাই দিয়ে লম্বা চুলগুলো শুকিয়ে, ঠোঁটে লিপবাম লাগিয়ে নিয়েছে।
মায়ের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা ছিল শুনেছে বাবার কাছে। কিন্তু এই সমস্যা নিয়েও তো অনেকে আশি-নব্বই বছর দিব্যি বেঁচে থাকে। তুলির মাঝেমধ্যে মনে হয়, অপার সম্ভাবনা নিয়ে পৃথিবীতে আসা মা এত সহজে হেরে যেতে পারেন না! নিশ্চয়ই তিনি আশেপাশে কোথাও আছেন! এক সকালে তুলির দরজায় এসে হাজির হবেন।
আপনার কোনো হেল্প লাগলে বলবেন! তুলি এসে নিচু স্বরে বলে সাজেদাকে।
একমাত্র ছেলের জন্মদিন এলে বিপদে পড়ে যায় সাজেদা। কী যে উপহার দেবে, বুঝতে পারে না! ভেবেচিন্তে একটা লাগেজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাসা আর হোস্টেলে আসা-যাওয়ার সময়ে ব্যবহার করতে পারবে ও। শেষ পর্যন্ত ছেলের জন্য একটা দামি লাগেজই কিনলো সাজেদা। আর এজন্য তুলিরও কিছুটা উপকার হলো। সে একটা মোটা অঙ্কের কমিশন পেলো। এটাই এই বিভাগে কাজের সুবিধা। পুরো দিনে একটা দামি লাগেজ বিক্রি করতে পারলে আর কিছু লাগে না।
তবু মেয়েটাকে আনন্দিত মনে হলো না। তুলির বিহ্বল চেহারা দেখে সাজেদার খটকা লাগে। মেয়েটা হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে গেলো কেন?
আমার মা যখন মারা যান, তখন আমি খুব ছোট ছিলাম। দুই-চারটি ছবি ছাড়া মায়ের আর কোনো চিহ্ন নেই আমার কাছে। সবচেয়ে স্পষ্ট যে ছবিটি, সেই ছবির সঙ্গে আপনার চেহারায় মিল আছে।
সাজেদার চোখ সমবেদনায় পূর্ণ হলো। তুলির চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো, আমি খুব দুঃখিত তোমার মায়ের কথা শুনে। শৈশবে মাতৃহারা হওয়ার মতো কষ্টের আর কিছু নেই। তবে তোমাকে দেখে বুঝতে পেরেছি, তোমার মা খুব ভালো একজন মানুষ ছিলেন।
তুলির দুই চোখ জলে ভরে উপচে পড়লো। সাজেদা পার্স খুলে টিস্যু দেয় তার হাতে। কৃতজ্ঞচিত্তে চোখে পানি নিয়ে হাসলো তুলি, আপনার নাম তো বললেন না?
আমার পুরো নাম সাজেদা আখতার। তোমার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগলো তুলি। বেঁচে থাকলে তোমার মা নিশ্চয়ই খুব গর্বিত হতেন তোমার জন্য।
আমারও তাই মনে হয়। আমি তাকে খুব মিস করি।
সাজেদা দ্রুত তুলির একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে চাপ দিলেন, আমি নিশ্চিত যে তিনি ওপর থেকে তোমাকে দেখছেন। তোমার জন্য দোয়া করছেন। তুমি আমার সঙ্গে তোমার মায়ের মিল খুঁজে পেয়েছ, এটা আমাকে কতখানি আনন্দিত করেছে, বলে বোঝাতে পারবে না। সময় পেলে ফোন কোরো। আমি টেরিটাউনে থাকি। সেখানকার ঠিকানাও দিয়ে দিচ্ছি। সময় সুযোগ পেলে বেড়াতে এসো।
সাজেদা তার সারাজীবনে এভাবে কারও সঙ্গে কথা বলেনি। কোনেদিন অপরিচিত কাউকে নিজের নম্বর আর ঠিকানা দিতে চায়নি। এমন নয়তো সে বোকা। কিন্তু মেয়েটার মধ্যে এমন কিছু ছিল যেটা তার মধ্যে অন্যরকম একটা আবেগানুভূতির সৃষ্টি করলো!
উল্টো দিকে তুলির মনও একইরকম ভালোবাসায় প্লাবিত হলো। মেসিসের স্টোরে এই সামান্য পরিচয়ে বহুদিনের জমে থাকা বেদনা যেন ভাষা পেলে। মাকে ঘিরে সামান্য স্মৃতি, অন্যদের কাছ থেকে জানা তথ্য তুলি বলতে লাগলো। তাদের মধ্যে কেমন যেন মানসিক সংযোগের সৃষ্টি হলো, যেন তারা বহু জনম ধরে একে অন্যের চেনা।
০৩.
বাড়িতে যাওয়ার পর তুলির মন জুড়ে রইলো সাজেদা। কোনোভাবে ওই চেহারা ভুলতে পারছিল না। মনের মধ্যে ক্রমে এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করতে থাকে। দুজন মানুষের চেহারায় কিভাবে এত মিল থাকতে পারে, মাথায় আসে না তুলির। তার কৌতূহল বেড়ে যায়।
দিন শেষের সূর্যাস্তের লালিমা ম্যানহাটনের আকাশে মিলিয়ে যাওয়ার পরে, ট্রেনে ব্রংকসে পার্কচেস্টারশায়ারে নিজের ছোট অ্যাপার্টমেন্টে ফেরে তুলি। বাড়ি ফিরে পোশাক না পাল্টে আলমারির ড্রয়ার থেকে পুরনো ফটো অ্যালবাম বের করে। কয়েক পাতা ওল্টাতে মায়ের ছবি চলে আসে। ওর মায়ের নানা বয়সের, নানা ভঙ্গিমায় তোলা ছবি। তার সময়ের একজন ফ্যাশন দুরস্ত, ডাকসাইটে সুন্দরী। মায়ের সৌন্দর্য অবলোকনের সঙ্গে সঙ্গে তুলি আজ তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে থাকে পারিবারিক সদস্যদের সঙ্গে তোলা অন্য ছবিগুলো।
খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে একটি ছবি পেয়ে যায়। এই যে ছবিটা, যেখানে তার মা, তার ছোট বোন আর নানা-নানি আছে! ছবিতে মায়ের বোনকে চিনতে বেগ পেতে হয় না তুলির। আজ মেসিসে পরিচয় হওয়া সাজেদাই তিনি।
তুলির সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রী আনন্দে নেচে ওঠে।
প্রবল আনন্দের মধ্যে ও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে টেরিটাউনে যেতে হবে। আর সেটা কালকেই। কালকে ওর কাজ নেই। জুম্বা ক্লাস আছে সকালে। ক্লাসটা করেই টেরিটাউনের বাস ধরতে হবে। ব্রঙ্কসের পারচেস্টারশায়ারে ওর বাসা থেকে বেশ দূরে সাজেদার বাড়ি। নতুন এই আবিষ্কারের আনন্দের কাছে সব ধরনের কষ্ট তুলির কাছে সামান্য মনে হলো এই মুহূর্তে।
আনন্দে উত্তেজনায় কাঁপতে থাকলো সে। পরদিন আলোক উজ্জ্বল শনিবার সকালে প্রথমে ট্রেনে করে টেরিটাউনের দিকে রওনা হয় তুলি। জিপিএসে সাজেদার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে রুটটা জেনে নিয়েছে। প্রথমে ট্রেনে, এরপর দুই বার বাস পরিবর্তন করে সেখানে যেতে হবে। জুম্বা ক্লাসের পরে জিমে গোসল করে নিয়েছে। সাজগোজের কোনো বালাই নেই। শুধু হেয়ার ড্রাই দিয়ে লম্বা চুলগুলো শুকিয়ে, ঠোঁটে লিপবাম লাগিয়ে নিয়েছে।
আরামদায়ক আবহাওয়ার মধ্যেও সাজেদার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘামের দাগ। সেদিকে তাকিয়ে তুলির কিছুটা মায়া হয়। প্রশ্নটা করে খালাকে হয়তো বিব্রত করা হলো!
প্রতিটি মাইল অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনার পারদ যেন তুঙ্গে উঠছে তুলির। কিভাবে নতুন আবিষ্কারের কথা সাজেদাকে বলবে সেটাই ভাবছিল মনে মনে। তবে টেরিটাউনে পৌঁছানোর পরে কেমন যেন একটু নার্ভাসনেস পেয়ে বসলো তুলিকে। এভাবে না বলে আসাটা কি ঠিক হলো! তিনি তো বাসায় নাও থাকতে পারেন! তাহলে এত দূর আসাটা বৃথা হবে। বাসায় না থাকলেও তুলি অপেক্ষা করে থাকবে তার ফেরার জন্য। যেভাবে হোক দেখা করে যেতে হবে।
এসব ভাবতে ভাবতে তুলি দেখতে পেলো বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আছে সাজেদা। ফুলের গাছের যত্ন নিচ্ছে। তুলিকে বাড়ির সামনে রাস্তা দিয়ে আসতে দেখে এত অবাক হলো যে বলার নয়! সে ঠিক বুঝতে পারছিলো না, তুলি কি অন্য কোনে কাজে, না কি তার বাসার উদ্দেশে এসেছে?
তুলি! তুমি এখানে! আমি সত্যি এখানে তোমাকে আশা করিনি! কালকেও তুমি বলোনি যে আজ টেরিটাউনে আসবে? হঠাৎ কী হলো?
এক মুহূর্তে দ্বিধাধন্দ্বে ভোগার পরে তুলি আসল সত্যিটা বলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। কোনো ধরনের কুশল বিনিময় ছাড়া ও বলে উঠল, আমি এখানে এসেছি, কারণ। কারণ গতরাতে আমি মায়ের ছবিতে আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনি আমার মায়ের বোন সাজু। আর আমি তিলোত্তমা, আপনার বোনের একমাত্র মেয়ে। এজন্যেই মেসিসে আপনাকে এত চেনা মনে হচ্ছিল। আপনি নিশ্চয়ই আমার মায়ের কথা বলতে পারবেন।
সাজেদার চেহারায় আগের সেই বিরক্তি মেশানো বিস্ময়ভাব কেটে গেলো দ্রুত। সেখানে দেখা দিলো আবেগ আর ভালোবাসার মাখামাখি রূপ। তুলিকে দু হাতে জড়িয়ে ধরলো সাজেদা। কিছুক্ষণ পরে আস্তে করে বললো, চল, ভেতরে গিয়ে কথা বলি। মায়ের বোনের বাসায় এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বললে চলবে!
কথা বলতে বলতে ইশারায় সাজেদা তার পেছনে নিজের বাড়ি দেখালো। বাড়ির ভেতরে ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে তিনটি বিড়াল এগিয়ে এসে যেন স্বাগত জানালো। এত সুন্দর তিনটি বিড়াল দেখে তুলির মন সঙ্গে সঙ্গে ভালো হয়ে গেলো। তুলির কাছে মনে হলো, তিনটি বিড়াল তিন রকমভাবে সুন্দর!
-নরওয়েজিয়ান বিড়াল না? কী সুন্দর!
বিড়ালের প্রশংসা শুনে খুব আনন্দিত হলো সাজেদা।
-জানো তো, ওদের শরীরের লোম খুব ঘন হয়। প্রচণ্ড শীত যে কারণে ওদের কাবু করতে পারে না!
-কিন্তু আপনার বাসা কত পরিষ্কার! কোথাও লোম নেই!
-অপরিষ্কার থাকবে কেন? আমরা তো নিয়মিত ঘর পরিষ্কার করি!
-কিন্তু, জানেন আমার বাবার বাসায় গেলে আপনার মেজাজ নষ্ট হবে! ঘরের সব জায়গায় বেড়ালের লোমে ভরা! সাদা, কালো, ধূসর নানা রঙের লোম। যেখানে বসবেন শরীর লোমে ভরে যাবে!
সাজেদা তুলির কথার পিঠে আর কোলো কথা বললো না। তবে খেয়াল করলো, সাজেদার হাসিমুখ মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে গেলো বাবার প্রসঙ্গ ওঠায়। বিষয়টা তার মনের পুরনো প্রশ্নগুলোকে সামনে নিয়ে এলো। মায়ের মৃত্যুর পরে কেন এতদিন নানার পরিবার যোগাযোগ রাখেনি ওর সঙ্গে! কী এমন ঘটেছিল তাদের মধ্যে, আপন বোনের মেয়েকে দেখার ইচ্ছে হয়নি সাজেদার!
তুলি এবার কৌশলী হয়! যেভাবে হোক সাজেদার মুখ থেকে কথাগুলো বের করতে হবে!
তুলি দেখলো, সাজেদা বড় একটা মগে কফি বানাচ্ছে মনোযোগের সঙ্গে। কফির কড়া গন্ধ সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। চমৎকার একটা ভালো লাগার অনুভূতির সৃষ্টি হলো তুলির! বহুদিন পরে একজন রক্তের সম্পর্কের মানুষের সংস্পর্শে এলো সে।
আমি কি আপনাকে খালামনি ডাকতে পারি?
তুলি বলার পরে সাজেদা ফিরে তাকালো। তার কিছুটা চিন্তাযুক্ত চেহারায় মেঘ কেটে সূর্য উঠলো ধীরে ধীরে! তার আলোকরশ্মিতে যেন সারা ঘর ভরে গেলো।
জানি, আপনি এত সুন্দর যে আমার খালামনি মনে হয় না!
ছুটে এসে সাজেদা জড়িয়ে ধরলো তুলিকে!
অবশ্যই, তুমি আমাকে খালামনি ডাকবে! পরিবারের সবার মধ্যে আমি ছিলাম বুবুর সবচেয়ে প্রিয়! তুমি তার একমাত্র সন্তান, তুমি যদি খালামনি না ডাকো, তাহলে কে ডাকবে বলো?
তুলির মুখে কোনো কথা আসে না। ওর মাথায় শুধু একটা প্রশ্ন ঘুরছে, এত প্রিয় যে বুবু, তার সন্তানকে কেন এত বছরে কোনো খোঁজ নিলো না খালা!
ভাগ্নির জন্য খুব যত্ন করে টেবিলে খাবার সাজায় সাজেদা। ভাত, দুই তিন রকম সবজি, মাছ ভাজা, মুরগির মাংসের ঝোল। দ্রুত হাতে শশা-টমেটু দিয়ে দেশি স্টাইলে সালাদ বানাতে থাকে খালা। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে চারদিকে তাকায় তুলি।
ছবির মতো সাজানো সবকিছু খালার। একমাত্র ছেলে ডর্মে থাকার কারণে বাসা একদম খালি। ডাক্তার খালু হাসপাতাল আর নিজের চেম্বার নিয়ে ব্যস্ত! খালা শখের ডেকোরেটরের কাজ করে বিভিন্ন ইভেন্টে। বিশাল এক ট্র্যাক চালিযে নিজেই সব কিছু নিয়ে হাজির হয়ে যায়।
সাজেদার কপাল, হাসি, ঘুরে তাকানো সবকিছুতে মায়ের সঙ্গে কত মিল। শৈশবের মায়ের যে ছবিটা তুলির মনে খোদাই করা আছে, সেটা ঠিক এইরকম। এজন্যই মেসিসে দেখার পরে অনেকটা গায়ে পড়ে কথা বলতে গিয়েছিল ও। সাজেদা তো শুধু তার খালা নয়, মায়ের অতীতের বন্ধ বইটা আবার খুলে পড়তে পারা।
আমার জন্মের সময়টা তোমার মনে আছে খালামনি?
খেতে খেতে জানতে চায় তুলি। সাজেদা লেবু চিপে দেন তুলির ভাত-তরকারি মেশানো প্লেটে। এত যত্ন করে শেষ কবে খাইয়েছিল মনে করতে পারে না তুলি।
খুব মনে আছে। বুবু তো কনসিভ করার পরে প্রথমে আমাকে বলেছিল। তোমার জন্মের আগের নয় মাস, এমন কোনো দিন নাই বুবুর সঙ্গে কথা হয়নি। হাসপাতালে যেদিন তোমার জন্ম হয়েছিল, ওই দিনটার কথাও স্পষ্ট নে আছে। আমরা কত আনন্দ করেছিলাম। ছবি তুলে, ভিডিও করে এলাহি কাণ্ড!
তুলি খেতে খেতে গভীর মনোযোগের সঙ্গে খালার গল্প শোনে। খাওয়া শেষে টেবিল গোছাতে সাজেদাকে সাহায্য করে। দুজনে মিলে প্লেট ধুয়ে রাখে।
কাজ করতে করতে দুজনের কথা চলতে থাকে। তুলি মূলত শ্রোতা। সাজেদা স্মৃতির খাতা থেকে এক একটি পাতা মেলে ধরতে থাকে। তুলির কিছু ধূসর স্মৃতি ছিল শৈশবকে ঘিরে। সাজেদার কথায় হারিয়ে যাওয়া টুকরোগুলো দিয়ে একটা ছবি পাওয়ার চেষ্টা করে।
সাজেদার যে কফির প্রবল নেশা, এটা অল্প কিছুক্ষণে বুঝে ফেলেছে তুলি। আবার সেই সেই মৌ মৌ গন্ধযুক্ত কফি বানায় সাজেদা। দুই মগে চা নিয়ে বাড়ির সামনে ছোট বাগানে গিয়ে বসে ওরা দুজনে! যেন বসার পরে নানা ধরনের কথা বলে খালা ওর মন অন্যদিকে না নিতে পারে, এজন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তুলি। প্রশ্নটা ওকে করতেই হবে। মনের মধ্যে অতৃপ্তিবোধ নিয়ে কোনো আলোচনাই শুনতে ভালো লাগে না।
তুমি মাকে এত ভালোবাসতে, তাহলে এত বছর আমার কোনো খোঁজ নাওনি কেন?
০৪.
তিন রঙের তিনটা বিড়াল বাড়ির বারান্দায় আর উঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছে আনমনে। এখন তো বসন্তকাল, আশেপাশের গাছগুলো পাতা আর ফুলে ভরে উঠতে শুরু করেছে। হালকা গরম, হালকা ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় সূর্যকে পেছনে ফেলে বসেছে তুলি। আরামদায়ক আবহাওয়ার মধ্যেও সাজেদার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘামের দাগ। সেদিকে তাকিয়ে তুলির কিছুটা মায়া হয়। প্রশ্নটা করে খালাকে হয়তো বিব্রত করা হলো!
সরি খালামনি, এভাবে জানতে চাওয়ার জন্য!
তোমার সরি হবার কিছু নেই তুলি। প্রশ্নটা তুলে খুব ভালো করেছ। বহু বছর ধরে একটা বেদনাকে আমি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। সেটা বলার সময় এসেছে!
তুলির চেহারায় বিস্ময় বাধ মানে না। কী এমন ঘটেছিল, যা এতটা বিধ্বস্ত করেছে সাজেদাকে।
তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি বা রাখার কোনো সুযোগ ছিল না, তার কারণ হলে তোমার বাবা।
বাবা? এই একটা শব্দ অনুরণিত হয় তুলির কণ্ঠে।
হ্যাঁ, তোমার বাবার জন্য। আর এখন এটা বলার সময় এসেছে। জানি, তুমি সত্যিটা শুনলে প্রচণ্ড আঘাত পাবে। তবু সত্যি তোমার জানতেই হবে! তোমার মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী তোমার বাবা!
এভাবে একদিন হয়তো বিড়ালের লোমের বিছানায় মৃত্যু হবে বাবার। কেউ পাশে থাকবে না। অন্তত আমি তো যাবো না!
তুলি যেন আর নিতে পারছে না। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রোলার কোস্টারে ওকে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ওর মাথাটা প্রচণ্ডভাবে ঘুরছে।
সাজেদা তবু থামে না, আমার বাসায় তুমি তিনটা বিড়াল দেখছো। কিন্তু ছোট বেলা থেকে আমাদের বাসায় কোনো বিড়াল থাকতে পারতো না। কারণ হচ্ছে বুবুর ছিল বিড়ালে ভয়াবহ অ্যালার্জি। সে বিড়াল একদম সহ্য করতে পারতো না। প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়তো বিড়াল বাড়িতে থাকলে। তোমার মায়ের অ্যাজমা ছিল মারাত্নক। এসব জেনেই তোমার বাবা বুবুকে বিয়ে করেছিল গ্রিনকার্ড প্রাপ্তির বিনিময়ে! তখন তোমার বাবার সরল আর মফস্বলী চেহারাটা দেখেছি আমরা। কিন্তু ভেতরের শয়তানটা চিনতে পারিনি। এই বিয়েটা সে স্বার্থের কারণে করেছিল। বুবু তাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছিল। কিন্তু তোমার বাবা অনেক আগে থেকে বাংলাদেশে গোপনে খালাতো বোনকে বিয়ে করে রেখেছিলেন!
হ্যাঁ, উনি তো আমার সৎমা ছিলেন!
তোমার মায়ের মৃত্যুর পরে তাদের একসঙ্গে থাকার কোনে বাধা থাকেনি। ততদিনে তোমার বাবা আমেরিকার সিটিজেন হয়ে গেছে। শুরুর দিকে তোমার বাবা তার আসল রূপ সবার কাছে উন্মোচন করেনি। তোমার জন্মের পরে তোমার মা যখন আরও বেশি অসুস্থ হয়ে গেলো, তখনই সে মরিয়া হয়ে উঠলো। দশ-বারোটা বিড়াল দিয়ে ঘর ভরে রাখতো! দিনের পর দিক ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছে বুবু। তোমার বাবা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি। আমরা দেখা করার চেষ্টা করলে নিজের ফোন-বুবুর ফোন বন্ধ করে রেখেছে। শুরুতে মৃত্যুর খবরটা জানতে পারিনি আমরা! তারপর তোমাকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে যাওয়ার পরে, ওদের এক প্রতিবেশী জানায়, তোমার মায়ের মৃত্যুর কথা! ততদিনে নিউজার্সির এক গোরস্থানে তোমার মাকে দাফন করা হয়ে গেছে।
আবেগে বিহ্বল সাজেদার কথা বলতে বলতে গলা ভেঙে আসে। ঠাণ্ডা কফির কাপে চুমুক দেয়।
তুলি বুঝতে পারে ওর পুরো জীবন মিথ্যার ওপর ভরে করে সাজানো। মায়ের তিলে তিলে মৃত্যু, সেখানে বাবার নৃশংস ভূমিকা, ও কি কোনোদিন মেনে নিতে পারবে! তুলি তবু চায় আসল সত্যিটা বের হয়ে আসুক।
আপনারা বাবাকে ধরার চেষ্টা করেননি!
করেছিলাম! কিন্তু আমি আর মা কীই-বা করতে পারি! তোমার নানা মারা গেছেন আগেই। তোমার বাবা চট্টগ্রামের কোনো এক এলাকায় গা ঢাকা দিয়েছিলেন। সবকিছু আগে থেকে ছক এঁকে রেখেছিলেন তিনি। এখানে যে হাসপাতালে তোমার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল, সেখানে ওরা শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার কথা উল্লেখ করে। যে কারণে তোমার বাবার বিরুদ্ধে বাংলাদেশি আইনে আমরা কোনো অভিযোগও উত্থাপন করতে পারিনি।
জন্মদাতা বাবার বিরুদ্ধে মারাত্নক এই অভিযোগ অবিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ ছিল তুলির। কারণ সাজেদা কিভাবে এত নিশ্চিত হলো বিড়াল তার বোনের মৃত্যুর কারণ! কিন্তু তুলি জানে, তার বাবার বিড়াল আসক্তির কথা! চট্টগ্রামের রাউজানে তাদের বিশাল বাড়িতে মানুষ নয়, যেন বিড়ালরা বাস করে। সারা বাড়িতে শুধু ওরা আর ঘরজুড়ে ওদের লোম। কেউ পরিষ্কার করে না বলে পুরো বাড়ি ঘর নোংরা করে ফেলেছে ওরা। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী তার খালাতো বোন বিড়ালের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কয়েক বছর আগে চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে। তুলি ক্যাডেট কলেজে পড়া শেষে সুযোগ পেয়েই আমেরিকা চলে এসেছে। এই দেশে জন্ম হওয়ার কারণে কলেজে ভর্তি কোনো সমস্যা হয়নি।
তুমি জেনে কিছুটা আনন্দিত হবে খালামনি, প্রকৃতি বাবার অপরাধের শাস্তি দিয়েছে। বাড়ি ভর্তি বিড়াল নিয়ে একা থাকে এখন বাবা। সৎমা তার ছেলেমেয়ে নিয়ে কয়েক বছর আগে চলে গেছে। কাজের লোকরাও থাকতে চায় না। এভাবে একদিন হয়তো বিড়ালের লোমের বিছানায় মৃত্যু হবে বাবার। কেউ পাশে থাকবে না। অন্তত আমি তো যাবো না!