শুরুতেই বিড়াল প্রসঙ্গে আসি। বাসর রাতের জন্য এখনই অস্থির হবেন না। বাসর রাতে যারা বিড়াল মেরে এখন আব্বু বা পাপা ডাক শুনছেন, তাদের কথা বাদই দিলাম। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। এই যা- বিড়ালটা গেল কোথায়? নিশ্চয়ই মুমুর ঘরে। আসলে বিড়ালটা তো মুমুর। তাই ওর ঘরেই থাকে।
বাসায় ঢুকতে গেটের পাশে তুলতুলে একটা অসহায় বাচ্চা দেখে মুমুর মায়া হয়েছিল। মাতৃত্ব জেগে উঠেছিল। মুমু ভাবে, ধরে নিলাম পিতৃপরিচয়ের প্রশ্নই আসে না। তা-ই বলে কি মা-ও বাচ্চাটাকে ফেলে যাবে? যাই হোক, মুমু সাত-পাঁচ না ভেবে পরম আদরে কোলে তুলে নিয়েছিল।
চোখ পিটপিট করা শীর্ণকায় একটা বাচ্চা নিয়ে ঘরে ঢুকতেই মা ঘৃণায় ছিঃ ছিঃ করে উঠেছিল।
তুমি বললে তো কাঁটাবন থেকে উন্নত জাতের একটা বাচ্চা কিনে দিতাম। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া একটা বিড়ালের বাচ্চা নিয়ে ঘরে ঢুকলে? কী নোংরা!
তাতে কী মা? এটাও তো প্রাণী। ওরও তো বাঁচার অধিকার আছে।
বাহ! মাদার তেরেসা হতে চাও? আজকাল তো ডাস্টবিনে মানুষের বাচ্চাও পাওয়া যায়, তুলে আনো গিয়ে।
মা, তুমি তো একজন মা। তোমার মুখে এমন কথা শোভা পায় না। কী সব বাজে বকছ?
হয়েছে, হয়েছে। যাও, ফ্রেস হয়ে এসো। আমাকে জ্ঞান দিতে হবে না।
মেয়ের অবাধ্যতার মুখে অবশেষে মাকে মেনে নিতে হয়েছিল। সেই থেকে গত দুইটা বছর বিড়ালটিকে আগলে রেখেছে মুমু। একটা নামও দিয়েছে ওর। ‘ধলা’ বলে ডাকে। দামি-দামি খাবার বরাদ্দ আছে ধলার জন্য। মুমুর বাবা অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো দিন কিছু বলেননি। না ইতিবাচক না নেতিবাচক। মেয়ের আব্দারই প্রাধান্য পেয়েছে তার কাছে।
সেই লিকলিকে বিড়ালটা গত দুই বছরে বেশ বাড়ন্ত হয়েছে। সাদা রঙে চিকচিকে ভাব। চালচলনে বেশ গম্ভীর প্রকৃতির। সারাক্ষণ মুমুর পায়ে পায়ে ঘোরে। রাতেও মুমুর বিছানায় ঘুমায়। তবে বিছানা নষ্ট করে না। প্রয়োজনে নিজেই দৌড়ে চলে যায়।
মুমু মাঝে মাঝে অবাক হয়। কুড়িয়ে আনা সেই বিড়াল ছানাটা আজ কত স্মার্ট। কেননা ধলা সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। নির্ধারিত পাত্রে খাবার না দিলে সে খায় না। মুমু ওকে গোসলও করায়। শীতের সময় বিড়ালটা কোলের মধ্যে থাকলে ভালোই লাগে। সন্তানের মতোই আগলে রাখে। দু’জনের দারুণ বোঝাপড়া। কলেজে যাওয়ার সময় একবার বললেই হয়, ‘আমি কলেজে যাচ্ছি। বাসা থেকে বের হবে না।’ ব্যস, হয়ে গেলো। সারাক্ষণ সে মুমুর রুমে পায়চারী করবে। মুমু এলেই দৌড়ে গিয়ে ওর কোলে লাফিয়ে উঠবে। মুমুও খুব আদর করে বিড়ালটিকে।
মুমুরও তো বয়স দিনদিন বাড়ছে। বিবাহযোগ্য হয়ে উঠেছে। ফলে একদিন পাত্রপক্ষ এসেছে মুমুকে দেখতে। মুমুকে সাজিয়ে গেস্টরুমে আনা হলো। বিড়ালটা মুমুর পেছন পেছন এসে সোফায় মুমুর পাশেই বসল। পাত্রপক্ষ বিব্রত হলেও মুমু মুচকি হাসলো। দু’পক্ষের কথাবার্তা শেষ। ছেলেটা কেবল মুমুর আঙুলে আংটি পরাতে যাবে। আঙুলটা ধরলো। আর অমনি ধলা ঝাপিয়ে পড়লো ছেলেটার হাতের ওপর। ছেলেটা ভয়ে সরে গেল। মুমু হেসে উঠলো। আংটি ছিটকে পড়লো মেঝেতে। সবাই বিব্রত। মুমুর বাবা করজোরে ক্ষমা চাইলেন সবার কাছে। ছেলের পক্ষ রাগ করে চলে গেলেন। মুমু তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়নি।
রাতে শুয়ে শুয়ে ধলার সঙ্গে কথা বলে মুমু। ধলা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে। ‘কেন এমন করলি? আমি কি সারাজীবন এ বাড়িতেই থাকবো?’ ধলা মাথাটা নিচু করে। মুমুর বুকে মাথা রেখে নিশ্চুপ শুয়ে থাকে। মুমু ধলার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘শোন, আমি এখান থকে একা যাচ্ছি না। গেলে তোকে সঙ্গে নিয়েই যাবো। তুই আমার সঙ্গেই থাকবি। তুই তো আমার সন্তানের মতো।’ ধলার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। মুমু অবাক হয়। নিজের অজান্তেই তার চোখের কোণেও জল আসে।
দরাজায় কড়া নাড়ে মা। ‘দরজা খোলাই আছে মা, চলে এসো।’ বলে উঠে আঁচলে চোখ মোছে। ধলা খাট থেকে নেমে রুমের কোণায় গিয়ে বসে থাকে।
কাজটা কী হলো বল তো?
কোন কাজটা মা?
আরে ভুলে গেলি? তারা কী ভাববে বল তো?
ওহ, ধলার কথা বলছো?
হুম, তা-ই তো বলছি। এমন বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে আগে বুঝতে পারিনি। তাহলে রুমে আটকে রাখতাম।
আমিও তো বুঝতে পারিনি মা।
ওনারা ফোন করেছিলেন। এখানে আত্মীয়তা করা তাদের পক্ষে সম্ভব না।
ঠিক আছে মা। ঘাবড়াও কেন? এখানে না হলো অন্য কোথাও হবে। দেখবে আরো কত প্রস্তাব আসবে। তখন দেখা যাবে। এখন শুধু শুধু ভেবে সময় নষ্ট করো নাতো। যাও, খেয়ে শুয়ে পড়ো।
এক কাজ করা যায় না?
কী কাজ মা?
ধলাকে বস্তায় ভরে অনেক দূরে ফেলে দিয়ে আসা যায় না?
কী বলছো তুমি মা। ধলা আমার সন্তানের মতো। ওকে ফেলে দিয়ে আসবো? অসম্ভব! প্রয়োজনে সারাজীবন একা থাকবো।
পাগলামি করে না মুমু। বোঝার চেষ্টা করো। তোমার বাবা খুব ক্ষেপে আছেন। মহল্লার লোকজন বাজে কথা বলছে।
তাই বলে ধলাকে আমি বিসর্জন দেব? কখোনই না মা। এই আমার শেষ কথা।
জানি না, কী করবে? শোনো, তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করার তোমার বাবাই করবে।
মানে?
জানি না।
মা ধপাস করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলেন। মুমুর মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে উঠল। ‘ধলা, এদিকে আয়।’ ধলা কাছে এলে ওকে জড়িয়ে ধরে সারারাত কাঁদলো।
সকালে অনেক দেরিতে ঘুম ভাঙতেই ধলার কথা মনে পড়লো। ধলা তো খাটে নেই। কোথায় গেল? বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। তাহলে কী? তবুও বাবার সামনে যেতে ইচ্ছে হয় না। মাকে জিজ্ঞেস করে যা শুনলো তাতে হতাশ। ধপ করে বসে পড়লো সোফায়।
তোর বাবা অফিসে যাওয়ার সময় ধলাকে বস্তায় ভরে নিয়ে গেছে।
মানে? তুমি কিছু বললে না?
কি বলবো বল। আগামীকাল অন্য একটি ছেলে আসবে তোকে দেখতে। তোর বাবা চায় না যে, আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটুক।
মা, এটা কোনো কথা? কেন এমন করলে তোমরা? তোমরা বললে বরং আমিই ধলাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেতাম।
থাক মা, শান্ত হঅ। এখন তোর ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে। সংসার সাজাতে হবে। ধলার চিন্তা তুই মাথা থেকে মুছে ফেল মা। আমার অনুরোধ। তুই এখন আর কোনো পাগলামি করিস না।
মুমু চুপ করে থাকে। সোফা থেকে উঠে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।
এবার তেমন কোনো ঝামেলা ছাড়াই ছেলেপক্ষের সঙ্গে একটা দফারফা হয়ে গেল। দিন-তারিখ নির্ধারণ করে মুখে মিষ্টি পুড়েই ছেলেপক্ষ বিদায় নিল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন মুমুর বাবা-মা। কিন্তু অসহ্য যন্ত্রণা কুড়েকুড়ে খাচ্ছে মুমুকে। রাতে বিছানায় গিয়েও চোখের পাতা এক করতে পারে না মুমু। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ধলার মুখ। মাঝরাতে ধলার কণ্ঠস্বর শুনতে পায় সে। ধরমর করে উঠে বসে। আলো জ্বেলে দেয়। সারাকক্ষ খুঁজতে থাকে। কোথাও নেই। বারান্দায় যায়। কার্নিশে, জানালায় সর্বত্র খুঁজতে থাকে। ধলার সন্ধান মেলে না। তবে তার ডাক ঠিকই শুনতে পায়। কী অসহায় আর্ত কণ্ঠস্বর। মুমু ঘুমোতে পারে না। ইজি চেয়ারে দুলতে থাকে। কর্ণকুহুরে বেজে চলে ধলার আর্তনাদ।
এরপর যথাসময়ে যথানিয়মে যথাযোগ্য মর্যাদায় এবং বহুল আনন্দঘন পরিবেশে বিবাহ কার্য সম্পাদন হয়েছে। কনেকে নিয়ে বরের যাত্রার পালা। নিময়মাফিক কান্না-কাটি ও বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে কনেকে গাড়িতে তোলার সময় বিদ্যুদ্বেগে ছুটে এলো ধলা। সেকি তার চিৎকার। সবাই হতভম্ব। কোথা থেকে এলো ধলা? জানলো কী করে? মুমুর পায়ের কাছে এসে লুটিয়ে পড়ল ধলা। মুমু তাকে তুলে নিলো কোলে। নতুন বর হতবাক। কিছু বুঝে ওঠার আগে মুমুর বাবা বললেন, ‘বাবা সুমন, ধলা ওর প্রিয় বিড়াল। বলতে পারো সন্তানের মতো।’ মুমু এবার বরের উদ্দেশে আব্দার তুলল, ‘আমি ওকে সঙ্গে নিতে চাই।’ লাজুক হেসে বর জানালেন, ‘ঠিক আছে সমস্যা নেই।’
বাস, ঝামেলা চুকে গেল। ধলাকে পেয়ে সেকি উচ্ছ্বাস মুমুর। কনে, বর ও বিড়ালকে বরণ করে নেয়া হলো। ধলার স্থান হলো এবার বাসর ঘরে। সারাদিনের ঝক্কি কাটিয়ে ফ্রেশ হয়ে বাসরের বিছানায় বর-কনে। পুষ্পসজ্জিত কক্ষে নিয়ন আলোয় জ্বলজ্বল করছে ধলার চোখ। তবে কেমন একটা অসহায় ভাব। এই প্রথম বিচ্ছিন্নতার বিরহ যেন হাড়েহাড়ে উপলব্ধি করছে ধলা।
এ সময়ের বিবরণ খুব বেশি না দেয়াই বরং ভালো। বরাবরই যা হয়ে থাকে। গল্প, দুষ্টুমি, হাসি এবং ঠাট্টার মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছে সময়। কিন্তু যখনই ওষ্ঠ মিলনের সময় এসেছে, সুমন জড়িয়ে ধরেছে মুমুকে। এই প্রথম আলিঙ্গন। বন্ধ চোখ। স্বর্গীয় অনুভূতি আস্বাদনের কাল। কেউ কাউকে যেন ছাড়তে চাইছে না। একটি স্পর্শকাতর সময়। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল সুমন। ভয় পেল মুমু। চোখ খুলে আবিষ্কার করলো ধলাকে। সুমনের চুল খামচে ধরেছে বিড়ালটা।
মন্তব্য