—তোকে নিয়ে আজ এক জায়গায় যাবো কামাল। না করতে পারবি না।
মিলন কাকার কথায় বাবা চমকালেন। পরশুর ঘটনার পর কাকার প্রস্তাবে কোথাও আর যাবে না বলে বাবা ঠিক করেছে। কারণটা অসঙ্গত নয়। সবখানে বাবার ব্যক্তিগত পরিচয়ের পর তার বাড়ির পরিচয়টাও এমন এক নাটকীয়তার মাধ্যমে কাকা দেন যে, তা নিয়ে একটা কোনো গোল বাধে, নয় ঢোল বাজে, যা তার খুবই পছন্দ। বাবার খুবই অপছন্দ। পরশুদিন এর এক পরাকাষ্ঠা দেখা গেছে।
সে কথা মনে করে বাবা বললেন, তোর সাথে যদি আর কোথাও গেছি! তাছাড়া আজ আমার মন ভালো নাই।
পরশুর কথা—
মিলনের অনুরোধে বড়বাজারে ক’জন সিনিয়রের আড্ডায় গেলেন। আড্ডার যারা নক্ষত্র, ফেনী আর নিজামপুর কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের বড় বড় নেতা তারা। ছাত্র ইউনিয়ন করেন মানেই ছাত্রদের কাছে তাদের নাম তখন বইয়ের পাতায় ওঠার যোগ্য। মেধায় মননে তারা ভয়ানক চোখাল। কলেজে বাবা তাদের একজনকে দেখেছেন। নাকের নিচে গোঁফ, তেলবসানো চুল, একপাশে সিঁথি। হাত দুটো পেছনে নিয়ে প্রায়ই বক্তৃতা করেন। কথাবার্তায় যাথারীতি বেশ চৌকস।
সেদিনের আড্ডায় কিছুক্ষণের ভেতর বাবা টের পেলেন, বাকিরাও তাই। কে যে বেশি আর কে যে কার চেয়ে কোথায় কতটুকু কম, তার মাপকাঠি নেই।
বেশ ভারী ভারী কথা। ফরাসি, জার্মান আর রুশ মনীষীদের নাম। দুটো নাম নতুন শুনলেন বাবা। হেগেল আর ট্রটস্কি। আরেকটা দেশীয় নাম, সেটা শরৎবসু। সুভাষ বসুর নাম শুনেছেন, শরৎ বসুর শোনেননি।
ফেনী কলেজের গোঁফওয়ালা নেতাটি এক পা এগিয়ে এসে বললো, আরে একে তো দেখেছি মনে হয়। এই ছেলে, আমাকে চেনো? দেখেছ? কোথায় পড়ো?
পরিবর্তনের কথা হচ্ছে, একটা যুদ্ধের কথা উঠছে। তার ধরন, প্রস্তুতি সম্বন্ধে তেমন ধারণা না থাকলেও ওটাকে ভালো একটা কিছু বলেই বাবার মনে হতে থাকলো। তার ভেতর হঠাৎ যে বাবাকে প্রথম চোখে পড়লো এমনভাবে একজন মিলনকে বললো, কিরে, এ কাকে নিয়ে এসেছিস। আগে তো দেখিনি। নাম কী। করে কী। খায় কী। থাকে কোথায়।
যে বললো. তার চুল টানটান করে পেছন ফিরিয়ে আঁচড়ানো। গায়ে ভাঁজভাঙা সাদা সুতির খাটো পাঞ্জাবি। হাতে সোনালি ঘড়ি, মুখে পান। চিবিয়ে চিবিয়ে বয়স্কদের মতো কথা বলে। খুব আত্মবিশ্বাসী। তবে ওই আত্মবিশ্বাস কেমন বিকর্ষণ করছে মনে হলো বাবার। বিশেষ করে এমন প্রশ্নের পর মনে হতে আর কোনো বাধা পেলো না মন।
মিলন বললো, ও কামাল। আমার সাথে পড়ে। ভালো ছেলে। আমরা সবাই যখন পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে যাই, তখনো সে লেখে। ভালো ছাত্র।
ফেনী কলেজের গোঁফওয়ালা নেতাটি এক পা এগিয়ে এসে বললো, আরে একে তো দেখেছি মনে হয়। এই ছেলে, আমাকে চেনো? দেখেছ? কোথায় পড়ো?
—আপনার কলেজে। জি আমিও দেখেছি আপনাকে।
বাবার সপ্রতিভতায় মুগ্ধ হয়ে মিলন তার আমোদের অস্ত্রটা ছাড়লো, যা নিয়ে বাবার ববরাবর ভয়।
—কুহুমার পীর বাড়ির ছেলে ও…
নীরবতা নামলো।
প্রভাবশালী পীরবাড়ি তখন বহুমুখী তর্কের কেন্দ্রে। গ্রামের রাজনীতি এ বাড়ি টাকা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে না। নিয়ন্ত্রণ করে তার আধ্যাত্মিক প্রভাব, পরিচিতি দিয়ে। টাকা তার বহুদূর পরিধি দিয়ে আবর্তিত হয়। বাড়িতে তার ছোঁয়াচ লাগে না। কিন্তু সমাজে তার আঁচ লাগে।
এমন সময় পান খাওয়া বাবুর একটা কথা এসে বাবার বুকে বিঁধলো।
—তো পীরবাড়ির ছেলে এখানে কী?
তৃতীয় একজন সরব হলো এ কথায়—কিরে আনিস, তুই এটা কী বললি?
তার পরনেরও সাদা পাঞ্জাবি। সবাই বুঝি একেইসঙ্গে সাদা পরে মেলান্তিস খেলছে। ঘন ভুরু আর দাড়ি গোঁফের ভেতর থেকে উজ্জ্বল টানা চোখজোড়া বাবার চোখে পড়ছে। গলার স্বরটা অন্যদের মতো ঘন পুরুষালি নয়, তবে অনেক বেশি স্পষ্ট।
তার এ কথার পর মন্তব্য ব্যক্ত করলো আরও দুজন। তারা পরস্পর ভাই হতে পারে। দেখতে একই রকম। দুজনই উজ্জ্বল চোখের পক্ষে।
কাউকে না জানিয়ে বাবা যাচ্ছে মামাবাড়ির এলাকায়। মাঠটা পেরিয়ে সবুজে ছাওয়া ভূঁইয়াপাড়া আর বেশিদূর নয়। এ পথে বড়বাজার আর করইয়া স্কুলফেরত পরিচিত ছোট বড় সবার যাতায়াত। বয়স্ক কারও সঙ্গে দেখা হলে নানান ঢেঁকি গেলার কারবার শুরু হবে।
মুহূর্তে দলটা তিনভাগে ভাগ হয়ে অস্বস্তিকর তর্ক জুড়ে দিলো। একদল কুহুমার পীর বাড়ির বিপক্ষে। একদল পক্ষে। তৃতীয় দলটার—দুই ক্ষেত্রেই পক্ষে-বিপক্ষে কিছু বলার আছে। প্রত্যেকেই শক্ত ধরনের তার্কিক এবং পরাজয়ে অভ্যস্ত নয়। সুতরাং তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাবার জন্যে ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠতে থাকলো। এক পর্যায়ে বাবা বন্ধু মিলনকে সরিয়ে এনে বললেন—সাধ মিটেছে? তুই থাক। আমি চললাম।
বড়দের কাছ থেকে বিদায় নিতে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন বাবা। কিন্তু তার দিকে তখন আর কারও নজর নেই। কণ্ঠস্বর ক্রমশ চড়ছে। পান খাওয়া ছেলেটির গলাই যেন বেশি শোনা যাচ্ছিল।
উত্তর শুনে—
মিলন কাকার মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো দেখে মায়া হলো বাবার—আসলে ঝড় উঠবে বলেও মনে হচ্ছে। আলোটা কেমন দেখছিস না?
মিলন কাকা দু’হাত নেড়ে বললো, আমি বুঝতে পারছি, সেদিন তোর অনেক মন খারাপ করিয়েছি। কিন্তু আমার কী দোষ? শেষ পর্যন্ত থাকলে তুই তাদের বুঝতি। হ্যাঁ হ্যাঁ দোষ আমারই। অসময়ে ওই কথা বলাটা আসলে ঠিক হয় নাই। কিন্তু সময়-অসময় আমি একটু কমও বুঝি বন্ধু। এজন্যেই তো তোকে চাই। আজ ভেবেছিলাম তোকে নিয়ে আরেক জায়গায় যাবো। বড় ভাইদের আড্ডা না। খুব সুন্দর একটা জায়গা। না গেলে পরে দুঃখ করবি।
—কোথায়?
—তোর আম্মার ভূঁইয়াপাড়া।
—কেন?
—তোর নানাবাড়ি যাবো না। আরেকটা বাড়ি আছে আমার পরিচিত। আমার বন্ধুর বাড়ি। বিশেষ এক বন্ধু। তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। নাম এখনই বলবো না।
বাবার মুখোভাব দেখে মিলন কাকা আশান্বিত হয়ে উঠে বললো, সেদিন যদি তোকে যুদ্ধের মধ্যে নিয়ে ফেলে থাকি, তো কথা দিচ্ছি, আজ তোকে শান্তির মধ্যে নিয়ে ফেলবো।
বাবা বললেন, ঝড়ে পড়লে কী করবো?
—আমরা গ্রামের ছেলে। ঝড়ে পড়লে কী করব মানে?
কিছুক্ষণের ব্যবধানে ভূঁইয়াপাড়ার দিকে পা চললো দুজনের। বাড়িঘর ছেড়ে অনেকটা নির্জনে এলে বুকপকেট থেকে একটা লাল-সাদা বাকশো বের করে সরু একশলাকা সিগারেট বের করলো মিলন কাকা। ক্যাপস্টান। বাবা বিস্ফারিত চোখে তাকালেন। মিলন ভুরু নাচিয়ে বললো, চলবে নাকি বাছা?
—অসম্ভব! বেয়াক্কেল নাকি তুই? এখানে…
—যে জিনিসে আক্কেল খোলে, এ হলো সেই জিনিস। চেনো?
—চাই না চিনতে।
কাউকে না জানিয়ে বাবা যাচ্ছে মামাবাড়ির এলাকায়। মাঠটা পেরিয়ে সবুজে ছাওয়া ভূঁইয়াপাড়া আর বেশিদূর নয়। এ পথে বড়বাজার আর করইয়া স্কুলফেরত পরিচিত ছোট বড় সবার যাতায়াত। বয়স্ক কারও সঙ্গে দেখা হলে নানান ঢেঁকি গেলার কারবার শুরু হবে। এর ভেতর মিলন ধরিয়েছে সিগারেট। মিলনের সঙ্গে পড়তে হয়ে যত অস্বস্তিকর অবস্থায়।
পথে লোকজনের চলাচল না পেয়ে মৌতাত জমছিল মন্দ নয়। হঠাৎ দূরে প্রথম লোকটির আভাস পেয়েই কাকা দুঃসাহসের ইতি টেনে সিগারেট ফেলে পিষে দিলো। ততক্ষণে অর্ধেক খাওয়া হয়ে গেছে।
ভূঁইয়া পাড়ায় যেতে পথে কোনো বাড়ি পড়ে না। বিরাট ফসলি মাঠ আর থেকে থেকে টুকরো টুকরো বাঁশঝাড় পথের দুপাশে। দূরে দূরে দিগন্ত। অনিয়মিত বিরতিতে একটা দুটো বট বা অশ্বত্থ। তার নিচে রাখাল আর পথিকেরা বসে বিশ্রাম নেয়। তবে ঝড়ের সময় ভুলেও নয়। ঝড়ে বাজ পড়ে এখানে প্রায়ই একাকী কোনো গাছে আগুন ধরে যায়।
ভূঁইয়াপাড়ায় পৌঁছে, অচেনা এক বাড়ির আঁচিলে ভরা আমগাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালেন দুজন। জায়গাটা সেই বাড়ির কাছারিঘরের পেছন। দেয়ালের ওপরের অংশ হলুদ আর নিচের অংশ কালো রঙ করা। রঙের প্রলেপ পড়েছে মাসখানেক। তারমানে এখানে একটা কোনো উৎসব গেছে। বাবা বললেন, এ কার বাড়ি। কাকা কোনো উত্তর দিলো না।
বিভ্রান্ত বাবা বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন, হঠাৎ কাছেই আবার শোনা গেলো কণ্ঠ দুটো। শুধু তাই না, দেখতে দেখতে কাছারির বর্ধিত দেয়ালের আড়াল থেকে দুটি মেয়ে তরঙ্গভঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে উপস্থিত।
কাছারির পেছন হলেও ওটা কোনো আড়ালের জায়গা নয়। একটা পায়েচলা সাদা মাটির পথ গেছে হাত বিশেক পেছনে। ওটা পূর্বদিক। কাছারিঘর আর সেই পথের মাঝখানে একটা জোলো জায়গায় মানুষসমান উঁচু, ঘন বেতগাছের ঝোপ। ওটা পেরিয়ে এদিকে দৃষ্টি দিতে পথিকের হয়তো ঠিক মনে পড়ে না। দিলেও ঝাপসা যা দেখা যায়, তাতে মন ওঠে না, লোকও চেনা যায় না। কেবল অবয়বটা বোঝা যায়।
আম গাছটা বাতাসে দুলছে। দুলছে আশপাশের গাব, কাঁঠাল, সোনালু। একটা ঠাণ্ডা আবহ ছড়িয়ে দিচ্ছে বাতাস। বিকেলটা ক্রমশ কালো হয়ে ওঠার ছিল। তার বদলে আরো গাঢ় সোনালি হয়ে উঠছে। তবে সোনালির পরতের নিচেই একটা চাপা লাল। রঙের এমন সূক্ষ্মতা কেবল বাবার চোখেই ধরা পড়ে। এ আলোয় ভয় আছে। রাতে ভালো ঝড়বাদল হতে পারে। ফিরতিপথে কে জানে কোন বিপদ অপেক্ষা করে আছে। না ভিজে আজ ফিরতে পারলে হয়।
বাবা বললেন, কার জন্য অপেক্ষা করছি জানতে পারি?
কাকার মুখে আবার সেই হাসি।
বাবা বললেন, তোর নাম দিলাম আজকে থেকে বিচ্ছেদ। সবসময় কেমন বিপদের মধ্যে ফেলিস।
—কিছুক্ষণ পর বাছা অন্য কথা বলবে।
—মানে?
—মানে সময়মতো বুঝবি রে, এখন আল্লা আল্লা কর!
—মার খাওয়াবি নাকি আজকে!
হঠাৎ হলদে-কালো কাছারিঘরের ওপার থেকে উঠানে দুটো মধুর কণ্ঠস্বর। তাদের অধিকারিণীদের দেখা যাচ্ছে না। তবে তাতে তো চমকে উঠতে বাধা নেই। ওরা কথা বলছে, হাসছে। বুঝি দক্ষিণ দিকে সদর দরজার দিকে এগোতে থাকলো। বাবা দেখলেন, মিলন কাকার মুখে মিটিমিটি হাসি।
মেয়েকণ্ঠ দুটি মিলিয়ে গেলো।
বিভ্রান্ত বাবা বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন, হঠাৎ কাছেই আবার শোনা গেলো কণ্ঠ দুটো। শুধু তাই না, দেখতে দেখতে কাছারির বর্ধিত দেয়ালের আড়াল থেকে দুটি মেয়ে তরঙ্গভঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে উপস্থিত।
বাবা দেখলেন, একজনের মুখ লম্বাটে, আরেকজনার গোল। লম্বাটে মুখের মেয়েটি দুই বেণী করে কাঁধের এপাশে এলিয়ে দিয়েছে। গোল মুখের মেয়েটি বেণী দুটো ঘুরিয়ে পরাবৃত্ত রচনা করেছে। দুজনের নাকেই সোনার ঝিকিমিকি নাকফুল। আড় আঁচলে পরা জংলি ছাপার শাড়ি, কাছাকাছি নকশার। যেন একই বিক্রেতার কাছ থেকে কেনা, একই কারিগরের হাতে বোনা।
মিলন লম্বাটে মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি হয়ে বললো, ভালো আছ মুন্নু? আমার বন্ধুকে নিয়ে এলাম। তোমাকে বলেছিলাম যে!
বাবা ওদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। শাড়ি পরিহিতা এমন সুশ্রী কিশোরীদের দিকে কান লাল করে তাকিয়ে থাকার চেয়ে বেতঝোপ ভালো। ওপারে কারা যেন যাচ্ছে।
নাহার যে আদৌ তা নন, বেশ বোঝা গেলো। তাদের দিকে তাকিয়ে বাবাও হাসতে শুরু করলেন। মুন্নু এসে মিলন কাকার হাত ধরে বললেন, তোমার বন্ধু চালাক আছে। ও আমাদের এখন।
মিলন কাকা বাবার দিকে ফিরে বললো, কিরে, কামাল? অভদ্র একটা। কথা বল! ও হলো মুন্নু। আর তিনি…
পাশের মেয়েটিকে নির্দেশ করে কাকা থেমে গেলে মুন্নু বললেন, ও নাহার। আমার বন্ধু।
কাকা বললেন, বাহ, আমি বন্ধুকে নিয়ে এলাম। তুমিও তোমার। তা বন্ধু কি চলে যাবেন? না আছেন।
—বন্ধু আজকে রাতে আমাদের বাড়িতে থাকবে।
—আর এখন কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো?
মুন্নু বললেন, ইচ্ছা হলে থাকো!
—না, ইচ্ছা করছে না। তোমাদের ওই নাটপুকুরে চলো।
—চলো।
চার জনের দল ‘নাটপুকুরের’ দিকে চললো।
মুন্নুদের এ বাড়ি আরও দুই পুরুষ আগে এক সম্পন্ন সনাতনী গোমস্তার কাছ থেকে কেনা। বিরাট বাড়ির পশ্চিম প্রান্তে ভাঙা নাটমন্দির আগের মতোই আছে। নতুন মুসলমান পরিবারটির ধর্মীয় সংস্কারের হাত ওখানে পড়েনি। মন্দিরের সামনে একটা পুকুর আয়না হয়ে শুয়ে ওপরে আকাশের দিকে চেয়ে আছে সেই পুরনো দিনের মতোই। কেবল চারপাশটা গেছে বদলে। একসময়ের জমাট আসা-যাওয়ার স্থান এখন পোড়ো। পুকুরের চারপাশে বুনো ঝোপঝাড়, আশপাশে লাল লাল বন্য ফলের গাছ। এই ফলে ভালো আঠা হয়। শেষ পশ্চিমে ভাঙাচোরা নাটমন্দিরটা ঢেকে গেছে শূন্যলতায়।
বাতাসের তোড় একটু শান্ত হয়ে এসেছে। মিলন কাকা মুন্নুর দিকে চেয়ে বললো—কামাল বলছিল ঝড় হতে পারে। কিরে, দেখলি তো তোর ঝড়। শেষাংসটুকু বাবাকে উদ্দেশ করে।
মুন্নু বললেন, ভুল তো ভাবে নাই।
কাকা যেন শুনতেই পেলো না—ও কী বলে জানো? বলে ঝড় এলে আমরা কী করবো? বোঝো? আমি বলি তুই গ্রামের ছেলে এসব কী বলিস। ঝড় এলে কী করবো মানে?
মুন্নু বললো, সত্যিই তো। পথের মাঝখানে ঝড় এলে কী করতে?
—কী করতাম মানে? তুমিও দেখি কামালের মতো।
—বলোই না কী করতে? মুন্নু মনে হলো একটা কিছু ধরতে পেরে মজা পেয়ে গেছেন।
—কী আর করতাম। নিশ্চয়ই একটা কিছু করতাম!
—নিশ্চয়ই একটা কিছু করতো, বলে নাহারের দিকে তাকালেন মুন্ন। তারপর দুজন ঝরনার মতো হাসতে শুরু করলেন। মিলন কাকা মান বাঁচাতে মরিয়া। বললো, নাহলে বৃষ্টিতে ভিজতাম! তো কী হয়েছে?
—খুব বুদ্ধি। মুন্নুর হাসি থামে না।
প্রথমবারের মতো নাহার কথা বলে উঠলেন—মন! ওরা মনে হয় একটা কোনো গাছের নিচে দাঁড়াতো।
এ কথার পর ঝরনার তোড় বেড়ে গেলো। নাহার বলে গেলেন, বিরাট একটা গাছ। গাছের নিচে দাঁড়াতো। কারণ, বড় গাছ খুব ভালো ছাতা!
ঝরনা এবার প্রমত্তা পাহাড়ি নদী।
মিলনের মুখ ছোট হয়ে গেছে। বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, একটা কিছু বল!
বাবা দেখলেন, কিচ্ছু না বলাই ভালো। তাকে হেনস্তা করতে নামা বন্ধু এখন নিজেই খাবি খাচ্ছে। আর মেয়েগুলো তুখোড়। এখন মিলনের পক্ষ নিতে গিয়ে বিপদ বাড়ানোর মানে হয় না। আর নাহার এতক্ষণ কথা বলছিলেন না বলে তাকে খানিক অপ্রতিভ ভেবেছিলেন বাবা। নাহার যে আদৌ তা নন, বেশ বোঝা গেলো। তাদের দিকে তাকিয়ে বাবাও হাসতে শুরু করলেন। মুন্নু এসে মিলন কাকার হাত ধরে বললেন, তোমার বন্ধু চালাক আছে। ও আমাদের এখন।
বাবা তখন কাকার কাঁধে হাত রেখে হাসলেন। তার চোখ দেখে বোঝা গেলো তলপেটে হাসিরা গুড়গুড় করছে। কিন্তু ওপরে তার আভাস দেখানো বারণ, বাবা তা জানেন—তুই বলছিস ঝড়ের কথা? এতে সুন্দর একটা সময় কাটালাম। এখন বাড়িতে গিয়ে একটা ভালো ইতি টানি চল। উচিত হবে।
হাসির উত্তাপে বরফ গেলো গলে। দুই অজেয় কিশোরী আর পরাস্ত দুই কিশোরের হলো সন্ধি। হক সাহেব থেকে শেখ সাহেব, ঝালপোয়া থেকে ছানা পিঠা, বঙ্কিম থেকে রোকেয়া, পাইলট থেকে ফেনী কলেজ—আলাপে আলাপে সাঁঝের দিকে ঠেলে নিয়ে চললো ওরা সময়টাকে। মিলন কাকাকে তো নতুন করে চেনার কিছু নেই। কিন্তু মুন্নু আর নাহার প্রতিমুহূর্তে বিস্মিত করছিলেন বাবাকে। এঁরা না জানি কেমন পরিবারের সন্তান। এত তুখোড়, এত সপ্রতিভ। নিশ্চয়ই বাড়িতে লোকে রাজনীতি করে, ঢাকায় আসা যাওয়া করে।
এলোমেলো—
বাতাস, সোনালি আলো, পুরনো পুকুরপাড়, প্রাচীন নাটমন্দির, আর দুটি কিশোরীসহ এই অবিশ্বাস্য বিকেল বাবার মনে গভীর ভাবাবেগ সৃষ্ট করলো। এর অল্পই তার রাতের দিনলিপির পাতায় আসবে, বাকিটা বহুদূরের পাহাড়ে ধ্বনিত হতে হতে মিলিয়ে যাবে যদিও তার স্মৃতিতন্তু, মস্তিষ্ক থেকে ওদের হারাবে না। সঞ্চারিত করে দেবে তার পুত্রের ভেতর। সেই বিকেলের বায়ান্ন বছর পর, বুদ্ধপূর্ণিমার আবহময় এক রাতে, কথাগুলো তার হয়ে বকে যাবো আমি। যুগপৎ বাবার বন্ধু ও শত্রু। সমাধির অন্ধকার থেকে বেরিয়ে বাতাসের ভাঁজে বাতাস হয়ে, ভাসমান তার সূক্ষ্ম শরীর হয়তো আমার ঘরময় ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে এখন। কাঁধে রেখেছে অদৃশ্য হাত।
সন্ধ্যা—
ঘনাচ্ছে যখন, মুন্নু বললেন, এবার বাড়িতে চলো।
—মাথা খারাপ! বাড়িতে যাবো না।
—বাড়িতে যাবে না তো আমাদের বিপদে ফেলতে এলে কেন?
মিলন কাকা যেন আকাশ থেকে পড়লো—মানে?
—আমরা তাহলে এতক্ষণ কোথায় ছিলাম। যাদের কথা বলে বের হয়েছি, তারাই বা কোথায়? কী উত্তর দেবো?
—আমাদের কথা বলেছ বাড়িতে? কাকা আশ্চর্য।
মুন্নু ততোধিক আশ্চর্য—ওমা, বলবো না?
নাহার বললেন, বাড়িতে চলুন। অসুবিধা তো নাই। আছে?
মিলন বললো, ঝড় নামলে?
বাবা তখন কাকার কাঁধে হাত রেখে হাসলেন। তার চোখ দেখে বোঝা গেলো তলপেটে হাসিরা গুড়গুড় করছে। কিন্তু ওপরে তার আভাস দেখানো বারণ, বাবা তা জানেন—তুই বলছিস ঝড়ের কথা? এতে সুন্দর একটা সময় কাটালাম। এখন বাড়িতে গিয়ে একটা ভালো ইতি টানি চল। উচিত হবে।
বাড়িতে চা হলো, বিস্কুট হলো। হঠাৎ মুন্নুর দাদি বললেন, অরে মিলইন্যা। তোর লগে ইয়া কন?
—কুহুমার পীর বাড়ির ছেলে দাদি। পীর আজিম উদ্দিন সাহেবের নাতি।
মুহূর্তের নীরবতা। তারপর একটা হুলস্থুল পড়ে গেলো। এমন কাণ্ড ঘটবে মিলন কাকাও ভাবতে পারেনি।
পীর সাহেবের নাতি! কোন ছেলের ঘর?
ভূঁইয়া পাড়ার সবচেয়ে আলোচিত, প্রশংসিত এবং প্রয়াত মেয়েটিই যে এই ছেলেটির মা সেটা প্রকাশ পাওয়ার পর আনন্দের আবহ শোকে রূপ নিলো।
এরপর অনেকটা সময় কেটে গেছে। মাগরিব পার হয়ে এশার সময় হয়-হয়। পুরনো দিনের অনিঃশেষ গল্প তখনো ভাঁজ খুলছে।
দরজায় মুন্নু আর নাহারকে রেখে কাকাকে নিয়ে নিয়ে বাবা যখন বাইরে পা রেখেছেন, ঝড়ের আভাস তখন আর অবশিষ্ট নেই। আকাশ পরিষ্কার। উত্তর থেকে দক্ষিণে একটা ছায়াপথ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।
মুন্নুর দাদি কাঁদছেন। কণ্ঠে বিলাপের সুর নেই। স্বগতোক্তির মতো আঞ্চলিক টানে বলে চলেছেন তার কথা—এত ভালো মেয়েটিকে এত অল্প বয়েসে স্রষ্টা কেন নিয়ে গেলো? ওইখানে ওই চৌকাঠের ওপর সে এসে বসতো, পিঠ ছাপানো চুল, পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখতো আমাকে। বলতাম, তোর এই শ্যামলা গায়ের রঙ দেখে কেউ যদি নাও ভোলে, ওই রেশমি চুল আর চোখ দুটো দেখে ভুলবে। বলতো, অথচ এসব কিছুই আমার না। মেয়েটা কথা বলতো এই একটা-দুটো। কিন্তু যা বলতো মনে গিয়ে লাগতো। ও কিছু বলার পর আমরা আর কথা পেতাম না। সব চুপ। একসময় ধীরে ধীরে উঠে চলে যেতো। সবসময় এমন চুপচাপ থাকতো, যেন ও নাই। বলতাম, মা তুই এই মৌনী গুণ কোত্থেকে পেলি? আমি যে সারাজীবনে এটা আনতে পারলাম না। আনলেও রাখতে পারলাম না। ও হাসতো। বলতাম, আমাকে বললি না বেটি। বললে যে তোর মতো সুখী হয়ে যাব। তাই হিংসা করলি। তখনো চুপ। ওর একটা সবুজ শাড়ি ছিল। ঘুরে ফিরে ওটাই শুধু পরতো। বলতাম তোর বাবা এত বড় সওদাগর। এই এক শাড়ি ছাড়া আর কোনো শাড়ি দেয় না তোকে কিনে? ভেবেছিলাম জবাব দেবে না। কিন্তু বললো, আমার শাড়ি তোমার দোয়ায় একটা না খালা। কিন্তু সবই সবুজ। এই রঙ আমার ভালো লাগে। বললাম, এত রঙ থাকতে এই বাঙাল রঙ সবুজ তোর প্রিয়? বলে, রসুলের প্রিয় রঙ সবুজ ছিল খালা। কেন জানেন? কারণ আরব দেশে সবুজ নাই। আমার সবুজ প্রিয় কেন বলি? এই বাংলাদেশে আপনি যেদিকে তাকান, দেখবেন, সবুজ। যখন আমি থাকব না, তখন এই চারপাশে সবুজ দেখে আমাকে মনে পড়বে। মনে হবে চারপাশে শুধু আমি আর আমি। এই ভাবি। আর সবুজ খুব আপন লাগে। পরতে ভালো লাগে। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না। ওর মায়ের সাথে আমার সখী পাতানো ছিল। বললাম, খবরদার মুমু, আমি তোর মা। মায়েরে এগুলা কী বলিস? থাকবি না মানে? কই যাবি? বললো, আমি খুব তাড়াতাড়ি মরে যাবো খালা। ছুটে এসে ওরে ধরে বললাম, তওবা কর, এখনই তওবা কর। তওবা করলো। কিন্তু ওর চোখ দেখে মনে হলো, ওর কথা সত্যি। আমি ওরে জড়িয়ে ধরলাম। ও আমার হাতের ভেতর শূন্য হয়ে গেলো। চলে গেলো। ফিরলো না। আর কোনোদিনই ফিরবে না। এখন সে মাটির নিচে থেকে মাটির ওপর ফুল ফোটাচ্ছে। সেই ফুলের ঘ্রাণের সাথেই কি আজ তার ছেলে আমার কাছে চলে এলো? বহু যোগ আল্লা আমারে দেখিয়েছে। এই যোগের জন্যে তার শোকর করব না তারে শাপ দেবো বুঝতে পারছি না। একবার মনে হয় শোকর করি। একবার মনে হয় শাপ দিই। শোকরই করি। আল্লা তোমার কাছে শুকরিয়া। তোমার কাছে শুকরিয়া আল্লা। মেয়েটা আমার কাছে আসতে চেয়েছিল। পারে নাই। তার ছেলেকে পাঠিয়েছে। আমার আর কোনো সন্দেহ নাই। আর কোনো সন্দেহ নাই।
বাবার চোখে জল। নিজ মায়ের জন্যে বহুদিন কাঁদেননি বাবা। ঠিক করলেন আজো কাঁদবেন না। কান্নাগুলো জমা হচ্ছে। কোনো একদিন মুহুরি নদীর ধারে একা বসলে কাঁদবেন। নদীর জল নদীতে মিশে সাগরে চলে যাবে। কেউ কিচ্ছু জানবে না।
কুপির আলোয় গাঢ় রহস্যময়ী হয়ে ওঠা মুন্নু আর নাহার, বিরাট সেই ঘর, ছাদে কড়িকাঠের আলা আঁধারি। দেয়ালে মানুষগুলো ভৌতিক ছায়া। খোলা জানালা দিয়ে বাইরের তাকালে আকাশের নীল অন্ধকারের পট। তাতে সেই বুড়ো আমগাছ বাতাস দুলছে।
অবশেষে ছুটি মিললো।
দরজায় মুন্নু আর নাহারকে রেখে কাকাকে নিয়ে নিয়ে বাবা যখন বাইরে পা রেখেছেন, ঝড়ের আভাস তখন আর অবশিষ্ট নেই। আকাশ পরিষ্কার। উত্তর থেকে দক্ষিণে একটা ছায়াপথ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।
মিলন কাকা বললো—আমার সাথে আসবি আর কোথাও? কী মনে হয়?
—চেষ্টা চালিয়ে যা। মত বদলাতেও পারি।