বাঁশির সুরে সুরে আইজও ভাইরে খুঁইজা ফিরি—অদ্ভুত বাক্যটা খোকন বিশ্বাসের মুখে নতুন কিছু নয়। প্রায়ই শোনা যায়। প্রথমদিকে কথাটার বিশেষ পাত্তা দিতাম না। যেদিন এর গূঢ়ার্থ বুঝলাম, সেদিন নৈঃশব্দ্যের দরজায় নিজেকে সঁপে দিয়ে শুধু অনুশোচনা করেছি—হায়রে পৃথিবী! তোর খোলসের ভেতরে কেন যে এত এত খোলস!
স্কুল-কলেজের আশে-পাশে, শিল্পকলা অ্যাকাডেমির সামনে অথবা শহরের নিরাপদ কোনো খোলা জায়গায় সুযোগ বুঝে বাঁশের বাঁশিটাতে ফুৎকার ছাড়ে খোকন। তার সুরের মূর্ছনায় গ্রাম-বাংলার হারিয়ে যাওয়া অনেক গানের রোদন ভেসে ওঠে। তার সুর তোলা বাঁশি অতীত-বর্তমানের যুগলস্পর্শে কখনো কখনো মানুষের চোখ ভিজিয়ে দেয়। মুগ্ধ হয়ে পথচারীরা সামনে থাকা শতচ্ছিন্ন খাপরে সাধ্যমতো টাকা-পয়সা রেখে যায়। ওই টাকাই তার সম্বল। প্রায়ান্ধ, মহন্ত-জীবনে এরচে’ বেশি কী আর চাওয়া-পাওয়ার থাকতে পারে?
বাম চোখে হালকা আলোর লেশ থাকায় একটু কষ্ট হলেও সে পথ চিনতে ভুল করে না। শহরময় তার অবাধ বিচরণ। তারপরও তার খোঁজ-খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করে না কেউ। শহরাঞ্চলে এটা স্বাভাবিক ঘটনা।
খোকন বিশ্বাসের বাঁশির প্রতিটি ছিঁদ্রের মধ্যে যেই সুপ্ত-আখ্যান ঘুমিয়ে আছে, সেটা এই শহরের কেউ না জানলেও, আমি জানি। একদিন সুযোগ পেয়ে তার অতীত-জীবন সম্পর্কে যা জানলাম, তা যেকোনো সভ্যতা পতনের মতোই অবিস্মরণীয়। তার মুঠো জীবনের শানে-নুজুল থেকে কিছুটা ধারণা নেওয়া যাক।
খোকন বিশ্বাসের বড় ভাই ছিল কমল বিশ্বাস। বাঁশি বাজানোর বিস্ময়কর প্রতিভা ছিল তার। দিনভর ক্ষেতেখামারে কাজ করে আসা আবাদজীবীরা তার বাঁশির সুরে পরম স্তস্তিতে ক্লান্ত-দেহ বিছানায় এলিয়ে দিতো। লণ্ঠনের মৃদু আলোর ঝলকানিতে কখনো বা বেড়ালমুখো চাঁদের কোমল-শীতল আলোয় তার সুর তোলা মুখের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে যেতো গ্রাম-গঞ্জের খেটে খাওয়া মানুষ। কমলকে ঘিরে কর্ম-ব্যস্ততার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসা মানুষগুলো পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তো সবুজ ঘাসে বুনে রাখা নৈসর্গিক শীতল পাটিতে। ছোট ভাই খোকন বিশ্বাসকে খুব স্নেহ করতো সে। মাঝে-মধ্যে তাকেও সঙ্গে নিয়ে রাতের পর রাত বাঁশি বাজিয়ে কাটিয়ে দিতো। সচ্ছল ঘরের মানুষ হওয়ায় পারিবারিক পিছু টান ছিল না। তার ইচ্ছের ওপরও কেউ পাঁচিল টানেনি। খোকন মূলত বড় ভাইয়ের কাছে থেকেই বাঁশি বাজানোর তালিম নিয়েছে।
কমলের বাঁশির জাদুমাখা সুর একবার যার কান পর্যন্ত পৌঁছাতো, ঘরে তার মন টেকানো দায় হয়ে পড়তো। পর্ণা মির্জা নামের এক ধনির দুলালী তার সুরের মোহজালে আটকা পড়ে, জীবনের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয় তাকে। কমলের বাঁশি তাকে এতই মোহিত করেছে যে, প্রতিরাতে সে জানালার ফাঁকে আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে থাকতো। কখনো কখনো ছুটে আসতো চুপিসারে। এভাবেই দুজনের প্রণয় ঘটে। বাঁশিবাদককে সে জীবনসঙ্গী করে নেয়।
পর্ণা যেন সৌভাগ্যের দেবী টাইনিক ফরচুনারের রূপ নিয়েই এ বাড়িতে ঢুকেছে। তার আগমনের পর সংসারের বাঁক পরিবর্তন হয়ে গেলো। পুরো সংসারটাকে একাই সামলে রাখালো সে। মা তাকে সাহায্য করতে চাইলেও তাকে বিশ্রামে পাঠিয়ে নিজেই সবকিছু গোছিয়ে নিতো। ফলে বাড়িতে তার আলাদা কদর ছিল। সারাদিনের ক্লান্তি তার নিমিষেই হারিয়ে যেতো রাতে যখন কমল বাঁশিতে সুর তুলতো।
কার্তিক-অগ্রহায়ণের দিকে উত্তরের বিলটা সোনার ধানে একাকার হয়ে যেতো। ধান তুলতে চাষার দল আনন্দে মেতে উঠতো। পুরো গ্রামে নেমন্তন্নের ফোয়ারা বইতো। ক্ষণিকের জন্যে শিল্পী হয়ে যাওয়া কৃষকে চোখে-মুখে ভেসে উঠতো অপার্থিব হাসির রেখা।
খোকনদের জমিনগুলোতে যখন ফসলের বান পড়তো। পর্ণা সারারাত জেগে জেগে কমলের সঙ্গে ধান মাড়াতো। কত রকমের হাসি-তামাশায় যে মেতে ওঠতো তারা! খোকনকে দেখলেই দুজন চনমনে হয়ে উঠতো। শখের বশে খোকন ধান মাড়াতে চাইলেও ভাই তাতে বাধ সাধতো। অসুখ-বিসুখ করার ভয়ে তাকে কাজ থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করতো। এমন শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনকে মনে মনে প্রত্যাখান করতো খোকন। নির্ভয়ে উড়ে বেড়ানো ঘাস ফড়িংটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতো- উড়ক্কু ফড়িংটা কত মুক্ত, বন্ধনহীন! ইচ্ছে মতো দাপিয়ে বেড়াতে পারে। এদিকে তার জীবনটা নানারকম বাধা বিপত্তিতে ঠাসা। এরচে’ ভালো হতো যদি সে ঘাসফড়িং হয়ে জন্মাতো। তার প্রাণচাঞ্চল্যকে কেউ রোখতে পরতো না তখন।
—আহা! ছোডু মানুষ। থাহুক না এইখানে। আমনে চুপ কইরা থাহেন তো। আহো ছোডু ভাই। আমার কাছে আহো। তার মুখের ভাষা আঁচ করতে পেরে, ঘামিয়ে যাওয়া শরীরখানা আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে ভাবি খোকনকে কাছে ডাকতো। তার স্বাধীনতাবোধকে উৎসাহিত করতো। মাথায় গামছা পেছানো কমল হেসে হেসে সায় দিতো। আপত্তি তুলতো না। এভাবেই চলছিলো তাদের জীবনের গতিধারা।
গ্রামে যে কোনো পালা-পার্বণে কমলের ডাক পড়তো। তার বাঁশি বাজানো কিংবা গানের অংশ থাকতো। তাকে ছাড়া যেন অনুষ্ঠানই জমে না। যাত্রাদলের সঙ্গে কখনো-কখনো দুই-একটা অভিনয়ের পার্টেও থাকতো তার সরব উপস্থিতি। ‘ভ্রমর কইও গিয়া..’ রাধারামনের এ গানটা যখন কমল বাঁশিতে তুলতো, পুরো অনুষ্ঠানে নেমে আসতে অদ্ভুত নীরবতা। পরের দিন দোকানপাটে মানুষজন কমলের বহুমাত্রিক প্রতিভার তারিফ করতো গ্রীবা ফুলিয়ে।
কাছের কোথাও অনুষ্ঠান পড়লে ভাবির হাত ধরে খোকনও অনুষ্ঠানে যোগ দিতো। দূরে হলে ভাইয়ের নিষেধাজ্ঞা জারি থাকতো। তারপরও ভাবিকে ম্যানেজ করে সে অনুষ্ঠান দেখতে ছুটতো। ‘মোরা পঙ্খি মারি, পঙ্খি ধরি, পঙ্খি বেইচা খাই..’—এই গান খোকনের খুব প্রিয় ছিল। কতবার যে সে যাত্রাদলের মুখে এই গান শুনে আনন্দে হাততালি দিয়েছে, সে কথা আজও ভুলতে পারেনি।
বৃদ্ধ মা কোনো কিছুতেই বাধা হয়ে দাঁড়াতেন না। মাঝেমধ্যে কেবল সতর্ক হয়ে চলার উপদেশ দিতেন। কমলকে এত বেশি বাঁশি বাজাতে না করতেন। এতে বিপদ হতে পারে বলে নানা রকম পৌরাণিক গল্প জুড়ে বসতেন। মায়ের উপদেশ কমল কানেও মাখেনি। হয়তো বা সে কারণেই তার জীবনে একটা সময় মায়ের দেওয়া ভবিষ্যদ্বাণীই সত্যি হয়ে ধরা দিলো। ভাইয়ের সঙ্গে থেকে থেকে খোকন বাঁশি বাজানো কাজটা অনেক আগেই আয়ত্ত করে ফেলেছে। মায়ের বারণ ও লেখাপড়ার ঝামেলা থাকায় সেটা ছিল একেবারেই সীমাবদ্ধ।
মায়ের অধিকতর বকাঝকা এবং স্ত্রীর প্রতি অবহেলা হয় ভেবে কমল একসময় বাঁশি বাজানো কমিয়ে দেয় কিন্তু নিয়তির অনাকাঙ্ক্ষিত বৈরী হাওয়া আবার তাকে বাঁশির দিকে ঠেলে দেয়। বাঁশি আবার নতুন করে জাগিয়ে তোলে তাকে। মা ও মাটির সঙ্গে মিশে থাকা সুর যেন তাকে ছেড়ে যেতে চাইছে না।
সে বছর দক্ষিণের বিলে ফসলের জোয়ার এলো। সোনালি ধানের শীষে টিয়ে পাখির মেহেদি-রাঙা ঠোঁট ডুবিয়ে নবান্নের গান গাওয়ার দৃশ্যটাও বাড়তে শুরু করলো। ফসল তোলার আগে-আগে এবার যাত্রা অনুষ্ঠান কতো বড় হবে, কাকে কাকে অতিথি আনবে—সে জল্পনা-কল্পনা এখন থেকেই শুরু করেছে মানুষ। কমল এবার খুবই ব্যস্ত। একদিকে ঘরে অসুস্থ মা, অন্যদিকে সোনালি ফসলের হাতছানি। এমন দিনে বদল-খাটা মানুষও পাওয়া মুশকিল। সবার ঘরেই ফসল উঠতে শুরু করেছে। শত ব্যস্ততার মাঝে দিন দুনিয়ার অন্য খোঁজ রাখার ফুরসত কই?
ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। একসময় নাকে-মুখে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগলো। ধীরে ধীরে ঢলে পড়লো মাটির উদরে।
রাতভর ফসল মাড়ানোর কাজ চালছে। দুজন বদল-খাটার লোকও পাওয়া গেলো। ধানের আঁটির চক্করের ওপর দিয়ে গরু-মাড়াই চলছে। খোকন ভাবির সঙ্গে ধানের আঁটি এগিয়ে দিতে ব্যস্ত। কামলঅদের কাজে সহায়তা করছে কমল। মশামাছি, পোকা মাকড়ের উপদ্রব উপেক্ষা করে চলছে মাড়াইয়ের কাজ। ফাঁকে ফাঁকে কৌতুক, রম্যকাহিনী, হাসি-ঠাট্টার ভেতর দিয়ে উঠোনটিকে জাগ্রত করে রেখলো সবাই।
হঠাৎ করেই পর্ণা চিৎকার দিয়ে ওঠলো—সাপ! সাপ! বাঁচাও! সাপ!
কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে মাটিতে ঢলে পড়লো। ধীরে ধীরে শ্বেতশুভ্র শরীর নীলাভ-বর্ণ ধারণ করলো। জাতি সাপের দংশনে সমাহিত হয়ে গেলো একটি নবান্নের গল্প, তছরুপ হয়ে গেলো একটি ফসল উপাখ্যান। অঘ্রাণের রাত বিষণ্ন করে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে সাপটাও অদৃশ্য হয়ে গেলো।
পর্ণার মৃত্যুর পর কমলের বাঁশি বাজানোর নেশা যেন পেশায় পরিণত হলো। এভাবেই একদিন তার মা-ও পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। ঢিলে-ঢালাভাবে চলে দুই-ভাইয়ের সংসার। ধানী জমিনগুলো বর্গাচাষিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বছরের খাদ্য নিয়ে আর ভাবতে হয় না। খুঁটিনাটি সমস্যা ছাড়া খাপছাড়া সংসার ভালোই চলছিলো। স্বামী পরিত্যক্তা ফুপু রান্নাবান্নার দিকটি দেখেন।
শুধু জীবনের প্রয়োজনে সারাদিন ছোটখাটো কাজকর্ম সারে, সন্ধের পর বাঁশি হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় কমল। ফেরার টাইম-টেবিল থাকে না। কোনো দিন ফেরে। কোনোদিন ফেরে না। মাঠেই বাঁশি বাজাতে বাজাতে ঘুমিয়ে পড়ে। পর্ণার মৃত্যু-ঘটনা তার জীবনে যে রেখাপাত করেছে তার রেশ আর দূর হলো না।
ধবল জ্যোৎস্নায় যখন সারা পৃথিবী উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তো তখন বাঁশিতে ভীষণ করুণ সুর তুলে প্রকৃতিকে কাঁদিয়ে তুলতো কমল। সবুজপাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা নিশাচর পাখি নিশ্চুপে দীর্ঘশ্বাস ফেলতো। হারিয়ে ফেলতো ডানা মেলার শক্তি।
খোকন বহুবার ভাইয়ের কাছে গিয়ে দেখেছে জ্যোৎস্নার ফকফকে আলোয় অনর্গল তার চোখ গলে পানি ঝরছে। চোখের পানিতে প্রকৃতি যেন স্যাঁতসেতে হয়ে উঠছে। ছোট ভাইয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে কখনো চোখ মুছতে মুছতে বাড়িতে ফিরতো। কখনো বা উদাস আকাশের নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে বলতো—‘খোকন। ভাই আমার, যা দুয়ার আঁইটে ঘুমাইয়া থাক। শরীলডা ভালা ঠেকছে না। ঘুম না আইলে পড় গিয়া। নইলে পরীক্ষাত কী দিবি। তোর ভাবির লগে দেহা না কইরা বাড়িত যাইয়া কি করুম। তুই যা।’
খোকন বিশ্বাসের বুকে অতীতের স্মৃতিগুলো আগুনের ফুলকির মতো লাফিয়ে এসে সবকিছু ছত্রখান করে দিচ্ছে। ভাবির মুখটা চোখে ভাসলে ভেতরটা কেমন মোচাড় দিয়ে ওঠে। এই দুর্বিষহ গরমে তার গায়ের ঘামাচি খুঁটে দেয়ার মতো কেউই পৃথিবীতে অবশিষ্ট নেই এখন। পর্ণা ভাবি আজ দুর্বাঘাসের তলে কী নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে! জোনাকির ক্ষীণ আলোয় সে ঘাস মাথা ঠুকে শোকবার্তা পাঠায়। চোখ মুছতে মুছতে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় খোকন। ভাবি বেঁচে থাকলে এ পূর্ণিমা ফুল হতো, এখন তা বিষাক্ত কাঁটায় ঘেরা।
পূর্ণিমার দ্বিতীয় রাত। ধারুয়া চাঁদ ধারকর্র্য করা কোনো আলোই আড়ালে রাখেনি। বৃষ্টির স্ফটিকের মতো গাছের পাতায় জ্যোৎস্নার প্রতিবিম্ব ভেসে উঠেছে। বিকেলে একপশলা বৃষ্টি হওয়ায় প্রকৃতি সেরেছে গোছল। এখন মনপ্রাণ উজাড় করে সজীবতা ছড়ায়। জগতময় বকের ডানার মতো ধবধবে আলোর প্রাবল্য। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে খোকন বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিয়ে ভাবে—আগামী কাল ভাবির ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। ঘরোয়াভাবে হলেও ছোটখাটো একটা আয়োজন করা দরকার। দিনের বেলায় ভাইয়ের সঙ্গে এই ব্যাপারে আলোচনা করা উচিত ছিল। এখন উনি বাঁশি নিয়ে ব্যস্ত। কাছে গিয়ে পাত্তা পাওয়া যাবে না। ভাবতে ভাবতেই চোখ বন্ধ হয়ে এলো। ততক্ষণে দক্ষিণ-বিলের পাশে ঢিবির মতো উঁচু জায়গায় বসে মনের মাধুরী মিশিয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে কমল; ঘর থেকে স্পষ্ট শোনা যায় সুরের উচ্ছলতা।
বুকের ভেতরে পাথর চাপা দিয়ে এক মনে বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে কমল। মনে এখন পর্ণার ছবি ভেসে উঠেছে। ফেলে আসা স্মৃতির রশ্মি দিয়েছে ক্লান্তিহীন বাঁশি বাজানোর শক্তি। খেয়াল-খুশি মতো বাঁশি বাজিয়ে চলছে সে। চোখের কোণে বেদনাশ্রু। বুকে পুরোনো দিনের বিরহ-আখ্যান।
হঠাৎ ঘটে গেলো অবিশ্বাস্য এক ঘটনা! বাঁশির সুরে কোত্থকে যেন নেমে এলো অনিন্দ্যসুন্দরী এক নারী! ধবধবে আলোর সরপোশে পুরো পৃথিবী হতবিহ্বল হয়ে গেলো। নাচতে শুরু করলো। নিখুঁত নাচের মুদ্রায় আসন্ন দুর্যোগের ইঙ্গিত পেলো কমল। মায়ের কাছে শুনেছে—বাঁশির সুর সুন্দর ও আবেগী হলে আকাশ থেকে নেমে আসে পরী, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে পানখ। সেই পরী যদি নাচতে থাকে তবে তার নাচ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত বাঁশি না বাজালে বাঁশিওয়ালার মৃত্যু অনিবার্য। এই পরী সকালে ফজরের আজান না শোনা পর্যন্ত নাচতেই থাকবে। সাপের গল্প তো সবারই জানা।
এই রমণী কি তাহলে পরী! কমল জানে না। তবে সাপখোপ নয়, এটা নিশ্চিত। ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো। বাঁশির সুর তাল হারিয়ে ফেললো। কুলিয়ে উঠতে পারছে না সে। থেমে গেলে মৃত্যু অনিবার্য, তাকে যে বাঁচতেই হবে। সে মরে গেলে ছোট ভাই খোকন কার কাছে আশ্রয় নেবে, কে দেখবে তাকে?
রাত্রি দ্বিপ্রহরে ঠেকলো। উপায়ান্তর না পেয়ে বাধ্য হয়ে সে সুরে না ছেড়ে বুদ্ধি আঁটলো। কমল জানে, খোকন দারুণ বাঁশি বাজাতে পারে। যে করেই হোক তাকে এখানে আনতে হবে। দুই ভাই পালাক্রমে বাঁশি না বাজালে পরী নাস্তানাবুদ হবে না।
নিজেই গান বানিয়ে বাঁশিতে সে সুর তুললো—‘খোকন আমার প্রাণের ভাই আয় রে/ পরীর ক্ষুধা মেটানো বড় দায় রে..।’ ইত্যাদি ভাষায়, সে নিজের অপারগতা প্রকাশ করে বাঁশিতে সুর তুললো। সুরে সুরে ছোট ভাই খোকন বিশ্বাসকে ডাকতে আরম্ভ করলো।
গভীররাতে খোকনের ঘুম কেটে গেলো। কমলের বেপরোয়া বাঁশির সুর শুনে অবাক হলো। সন্দেহ জন্মালো মনে। এমন একরোখাভাবে, উল্টা-পাল্টা সুরে ভাই কখনো বাঁশি বাজায় না। সবসময় তার বাঁশির মধ্যে একধরনের শালীনতা বিরাজ করে। বারবার অদ্ভুত সুরটা কানে এসে বাড়ি খেতে লাগলো:
খোকন আমার প্রাণের ভাই আয় রে
পরীর ক্ষুধা মেটানো বড় দায় রে
বাঁশের বাঁশির সুর তুলে ধর ভাই
নইলে যে আজ বাঁচার উপায় নাই।
সুরটা পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। মায়ের মুখে শোনা গল্পগুলো হঠাৎ ভয় সঞ্চার করলো। সত্যি সত্যিই কি ভাই বিপদে পড়েছে!
আলমারি থেকে বাঁশিটা নামিয়ে খোকন বেরিয়ে পড়লো। দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ ও ঝকঝকে চন্দ্রকিরণ ভেদ করে সে দ্রুতপায়ে হাঁটতে লাগলো বাঁশির সুর অনুসরণ করে।
খোকন এই দৃশ্য দেখার জন্যে প্রস্তুত ছিলো না। হতবাক হয়ে গেলো। তবে সাহস হারায়নি। সবিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে, কমলের সামনে নৃত্যরত শাদা ধবধবে এক মানবী। বিচলিত হলে ভাইকে বাঁচানো যাবে না। দ্বিধান্বিত না হয়ে নতুন করে খোকন বাঁশিতে সুর তুললো। ভাই আশ্বস্ত হয়ে বাঁশি নামিয়ে নিলো।
চারদিকে রুপোর মুদ্রার মতো চকচকে আলোর ঝলকানি। বৃক্ষগুলো অসাড় দাঁড়িয়ে আছে ভূতের মতো। পৃথিবীর কোনো প্রাণী বোধ হয় জেগে নেই। শেয়ালের হুককা হুয়া উলুধ্বনিও নির্বাসিত। মনপ্রাণ উজাড় করে বাঁশি বাজাচ্ছে খোকন বিশ্বাস। অসাধারণ এই সুরের লোবান এতদিন কোথায় যে ছিলো খোকন নিজেও জানে না। বিচিত্র পোশাকধারী নারীর নাচের তাপমাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। নাচের দোলনে পুরো প্রকৃতি হতবিহ্বল হয়ে গেলো। নাচের কসরত দেখার জন্যে মূলত খোকন বাঁশি বাজায় না, বাঁশির প্রতিটি ফুৎকারে লুকিয়ে আছে ভাইকে উদ্ধারের মৌনপ্রত্যয়। খোকনের সুরের দ্যোতনায় কিম্ভূত নারীটা যখন নাচনের উদ্দামতা খুঁজে পেলো তখন কমল বিশ্বাসের শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করলো। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। একসময় নাকে-মুখে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগলো। ধীরে ধীরে ঢলে পড়লো মাটির উদরে।
বাঁশির সুরে সুরে আমি ভিক্ষা করি না, ভাইরে খুঁইজা ফিরি। কে জানে বিজ্ঞের ধাঁচে কথা বলা খোকন বিশ্বাসের জীবনের অন্তিম ঢেউগুলো কোন তীরে গিয়ে আচড়ে পড়ে!
সুরেলা বাঁশির বুকে ঠোঁট রেখেই ভাইয়ের দুরাবস্থা লক্ষ্ করলো সে। ঠিক থাকতে পারলো না। ‘ভাইজান, ভাইজান।’ বলে বাঁশি বন্ধ করে চিৎকার হাঁকতে লাগলো। আচমকা পরী নাচ থামিয়ে চোখ রাঙিয়ে উঠলো এবং কমলকে ঝাপটে ধরে উড়তে শুরু করলো। খোকন চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগলো। ভাইকে মুক্তি দিতে পরীর কাছে মিনতি করে কাঁদতে লাগলো। একগুঁয়ে পরী তাকে পাত্তাই দিলো না। তাকে নিয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে লাগলো। নিরুপায় হয়ে খোকন আবার বাঁশিতে ফুৎকার দিলো। বড়ই দরদভরা সেই সুর!
হঠাৎ কমলকে ওপর থেকে ছেড়ে দিলো সে। কমল ধীরে ধীরে ভূপৃষ্ঠের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই পড়া তার জন্য কতটুকু সঙ্গত? খোকন বাঁশি থামিয়ে ভাইকে ধরতে গেলে পরীটা আবার ছোঁ মেরে তাকে নিয়ে ওপরের দিকে উঠে গেলো। এই ফাঁকে ঝাঁজালো একটা আলোর ছটা খোকনের চোখে এসে হুল ফোটালো। তারপর পৃথিবীটা কেমন পাল্টে গেলো।
ঝাঁজালো আলোর সরপোশে যখন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো তখন কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরী তার ভাইকে নিয়ে লাপাত্তা। একটা চোখও নষ্ট হয়ে গেলো। বাকিটাও নষ্টের পথে। চোখের গ্লানি নিয়ে সে জীবনের প্রতিটি পথ মাড়িয়ে চলছে। একটা চোখে ক্ষীণ আলোর উপস্থিতি থাকায় প্রাণে বাঁচা গেলো।
একের পর এক আপনজন হারিয়ে খোকন বিশ্বাসের জীবনে নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ। সবকিছু হারিয়েও যখন বড় ভাই কমলকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখলো তখন তার ভাই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হারিয়ে যাওয়া তাকে নির্বিকার করে দিলো। বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠের মতো বাবার উদার বুক, স্নেহময়ী মায়ের আঁচল, ছায়াশীতল ভাবির কোমল পরশ, বটবৃক্ষের মতো ভাইয়ের আশ্রয়—সব, সব কিছু সে হারিয়ে ফেলেছে। পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকার মূল্য কী?
মৃত্যুর কাছে হার মেনে সবাই চলে গেলেও বড় ভাই কমল তো এখনো বেঁচে আছে। কোথাও না কোথাও সে এখনো ঠিকই আছে। ছেলেবেলায় দাদুর কাছে পরীর গল্প শুনতে তার বড়ই ভালো লাগতো। তখন পরীদের সে মনে করতো দরদি মনের জাতি। তাদেরও নাকি বসবাসের জন্য পরীস্থান নামের একটা সুরম্য ও সংরক্ষিত এলাকা আছে। ওখানে তারা মানুষের মতোই স্বাভাবিক জীবন যাপন করে।
দাদুর বর্ণিত সেই পরিস্থান খোকন বিশ্বাসের পক্ষে খুঁজে বের করা অসম্ভব। আদৌ পরীস্থান বলে কিছু আছে কিনা সে জানে না। তারপরও শেষ চেষ্টা করে যাবে-এই প্রত্যয় নিয়ে পথে নেমেছে সে।
যেই বাঁশি বাজাতে গিয়ে বড় ভাই হারিয়ে গেছে, সেই বাঁশি হাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো খোকন। গ্রামে-গঞ্জে, পথে-ঘাটে বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে সে ভাইকে খুঁজে বেড়ায়। লাভ হয় না। তবু খোঁজে। তার বাঁশির সুর শুনে মুগ্ধ হয়ে মানুষ যৎকিঞ্চিত যে অর্থ দান করে-তাতেই তার জীবন চলে যায়। এভাবেই একদিন গ্রামের পর গ্রাম, মাঠের পর মাঠ, পথের পর পথ পেছনে ফেলে বাঁশি বাজাতে বাজাতে নিজের অজান্তেই অচেনা শহরে ঢুকে পড়েছে সে। তারপর ভুলে গেছে বাড়ি ফেরার পথ। বুকের ওপর চেপে বসা স্মৃতির পাথরখণ্ডটা ধীরে ধীরে ভারী হতে থাকে। সদনছাড়া খোকন বিশ্বাস এ শহরে টোকাইদের সহযোগিতায় ঝুপরি গেড়ে রেল স্টেশনের পাশে মাথা-রাখার ঠাঁই খুঁজে নেয়। হয়তো বা এদ্দিনে গ্রামের সব ফসলী জমিজমাও ভূমিদস্যুর দখলে চলে গেছে। স্বামী পরিত্যক্তা ফুপুও হয়তো নাই হয়ে গেছে সেই কবে। কিছুই জানে না সে।
উদ্বাস্তু খোকন বিশ্বাসকে শহরের প্রতিটি মানুষ অন্ধ-ভিক্ষুক নামে জানে। কেউ তার নাম জানে না। দয়া-দাক্ষিণ্য দেখিয়ে যে যা পারে ভিক্ষুক হিসেবে তাকে দান করে। খোকন প্রত্যাখ্যান করে না বরং জীবন বাঁচাতে সানন্দে গ্রহণ করে।
তার দৃঢ়বিশ্বাস, সাধারণ মানুষ যেভাবে তাকে ভিক্ষুক ভেবে বাঁশির সুর শুনে মুগ্ধ হয়ে অর্থদান করে। হয়তো পরীও এসে ভাইকে এভাবে দান করে যাবে একদিন। তখন নির্লজ্জ পরীর ওপর কোনোরূপ রাগ অভিমান না দেখিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরবে সে। নতুনভাবে জীবন সাজানোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠবে তারা। বয়সের সঙ্গেসঙ্গে তার ইচ্ছাশক্তিও বেড়েই চলেছে।
‘বউ কথা কও’ পাখির সুরকে পুঁজি করে বাঁশিকেই আপন করে নিয়েছে সে। তার ভাষ্যমতে—‘বউ কথা কও’ কিংবা ‘ভাই কথা কও’ বলে বলে যে পাখিটা বনে-জঙ্গলে কেঁদে কেঁদে বেড়ায়, আমিও তার মতোন বাঁশির সুরে সুরে ভাইরে খুঁইজা খুঁইজা ফিরি। চাওয়া-পাওয়ার হিসাব ওই পাখির লগেই ভাগ করে নেই।
খোকন বাঁশিয়ালের ধারণা, ‘বউ কথা কও কিংবা ভাই কথা কও’ সুরে যে পাখি ডেকে ওঠে এবং দুঃখী মানুষের মন কাঁপিয়ে দেয়—সেই পাখিটাও হয়তো একদিন কোনো আপনজনকে এভাবে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যেতে দেখেছে। তাই জীবনের একমাত্র সঙ্গী হিসেবে ওই সুরটাকে সে বেছে নিয়েছে। আমরা তার সুর শুনে একেকজন একেক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করি। প্রকৃতপক্ষে তার পূর্বাপর কাহিনী সবার অজানা।
সে প্রেরণা থেকেই হয়তো খোকন বিশ্বাস অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে মানুষের কাছে বলে বেড়ায়—ওই পাখির মতোন আমিও বাঁশির সুরে সুরে ভাইরে আজীবন খুঁইজা খুঁইজা বেড়ামু। বাঁশির সুরে সুরে আমি ভিক্ষা করি না, ভাইরে খুঁইজা ফিরি। কে জানে বিজ্ঞের ধাঁচে কথা বলা খোকন বিশ্বাসের জীবনের অন্তিম ঢেউগুলো কোন তীরে গিয়ে আচড়ে পড়ে!