তারা সব মুখের বাঁদিকে, মুখের বাঁদিকে, লুপ্ত চোয়াল। ডানদিকে মুখের রঙ ক্যাট-কেটে সাদা। নীরক্ত যেন। শরীরের মাঝখান থেকে মুখের সাযুজ্যে একই রকম ডানদিক, দৃশ্যমান। বাঁদিক, উপচ্ছায়ার অন্তর্গত আঁধার। তাই খানিক দৃষ্টির অন্তর্গত। তবে ক্ষীণ। ওদের হাসি ভরা মুখ। তাতে যেন তাচ্ছিল্যের সুর। গমগমে সে জায়গা। একটা ঘর। অনেক বড়। হলঘরের মত। কখনো কথার ঝোঁকা। কম্পমান দেয়াল। এত উচ্চকিত। খুব খুশি। কারণ, হলটার মাঝখানে একটা আবলুস কাঠের হাতলওলা চেয়ার। সে চেয়ারে গণেশ। দেবতা না। মানুষ।
গণেশ জোয়ারদার। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। মাথা জোড়া টাক। বেঁটে। মোটা। ড্যাবাড্যাবা চোখ। দড়ির গোছা তার হাত-পায়ের ভেতর। মুখে একটা বড় ডেলা। লুকো-প্লাস্টের আড়ালে। অর্থাৎ, সে বন্দি।
গণেশ জোয়ারদারের বিচার। অপরাধ অজ্ঞাত। তবে, তার বিচার। কারণহীন। কিন্তু, বিচার। একতরফা। সপক্ষে উকিল অনুপস্থিত। গণতন্ত্রের শেষ পর্যায়। বা, গণতন্ত্র লাশকাটা ঘরে। কারণ, সবকিছু একতরফা।
বড়মানুষ। নামজাদা মানুষ। কোনো রাজনৈতিক নেতা। জোয়ারদার মহাশয় একেবারেই না। ছাপোষা গেরস্থ। বউ-বাচ্চা বুড়ো বাবা-মা। মা বাপ মরা বিয়ের যুগ্যি ভাগনি। আর সে। সোনাপট্টির সাধারণ কারিগর। এখন হঠাৎ বন্দি। ও বিচার।
তারা সব, ওই সব বাঁদিক প্রায় লুপ্ত। এমন মানুষ। মানুষ অথবা গুন্ডা। কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক। এখন তাদের ভাব-ভঙ্গি সেই একই রকম। মস্তান।
মস্তির সুরে চটুল বাজনা। কোমরের দুলুনি। হাতে তালি। মাঝে মাঝে উদ্ভট চিৎকার। কারো বা কোনো পার্টির জয়ধ্বনি।
কিন্তু, গণেশ জোয়ারদার, সে কখনো কোনো রাজনীতির সমর্থক, বাম অথবা ডান, এমনটা না। তবু সে বন্দি। ও তার বিচার।
দুই ঘণ্টা পার। একইরকম। চটুল বাজনা। কোমরের দুলুনি। হাতে তালি।
হঠাৎ সব স্তব্ধ। বাজনা দুলুনি। উচ্চকিত স্বর। পিন-পতন নিস্তব্ধতা।
তাঁর আগমন। সর্বোচ্চ নেতার। ডানদিক সবুজ। বাঁদিক অন্ধকার। তবে ক্ষীণ হলুদ আভা। সাড়ে ছ’ ফুট। দাঁতের ঝোরা বাহির।
স্যার। এই যে আমাদের…
হুঁ।
বিচারের অপেক্ষা।
হুঁ।
প্রাণদণ্ড?
ন্-না।
তবে স্যার?
বন্দুক।
গুলি। বোমা। গ্যাস। জল-কামান।
উঁহু।
বারুদ ঠাসা কামান?
ন্-না। বন্দুক।
কী মজা! গণেশ জোয়ারদার চাঁদমারি।
ভ্যাপ! চুপ।
চুপ। সকলে চুপ। নিশ্চুপ। হলঘরের সিলিং-এর নিচে দেয়াল ঘড়ি। তার শব্দ। টিক টিক। বাকি নিঃঝুম।
বন্দুক।
বন্দুক তবে। আধুনিক। স্বয়ংক্রিয়।
ধুস। রিভলবার। ছ ঘোড়ার। ছটা বুলেট।
তাই। তাই সই।
প্রাণকণ্ঠায়। এখুনি গুড়ুম। ছ-ছটা। ব্যস। গণেশ জোয়ারদার নিশ্চিন্ত। এরপর ডেড বডি হাপিস। ব্যস। তাই। অপেক্ষার অন্তিম লগ্ন।
হ্যাঁ। হ্যাঁ। হ্যাঁ। হ্যাঁ। ঘরময় হাসি। কাঁপা দেয়াল। স্থানচ্যুত ঘড়ি। মাটিতে উপুড়। আবার সব চুপ। নিশ্চুপ।
নেতার হাতে রিভলবার। ছ-ঘোড়ার।
এই বাচ্চো। এটা ছ ঘোড়ার লোডেড। তোমার মুক্তি।
হ্যাঁ। হ্যাঁ। মৃত্যু নিশ্চিত। ভয়হীন মুখ। বোধশূন্য। তাই ভয়শূন্য।
মুক্তি তোমার। শর্ত একটাই। ছটা প্রাণ নিকেশ। কোন ছটা প্রাণ? কোন ছটা? এই বাচ্চো। এই শালা। নাম?
গ-গ-
গণেশের বাঁধন মুক্ত। নেতার নির্দেশ। হাতে রিভলবার। ছ-ছটা প্রাণ। গুড়ুম। গুড়ুম-গুড়ুম। ব্যস। মুক্ত। কোন ছটা?
এই শালা। যে ছটার জন্যে তোর জীবন হারাম। চল।
রাস্তায় গণেশ। বিকেলের আকাশ। পশ্চিমে খন্ড মেঘ। রোদে রাঙা। তার আগে এক পশলা বৃষ্টি। ধোওয়া পাতায় রোদের চিকমিক। যেন সোনা। সোনার কণা। অথচ, মাথার ভেতর এক ভয়ঙ্কর বোঝা। ছ-ছটা প্রাণ। কোন ছটা? জীবন জহান্নম। জীবন হারাম। সেই মানুষেরা। কারা? দ্বিধা। আচ্ছা, স্বপ্না? ওই যে কেশববাবুর মেয়ে। তখন সবে শাড়ি। তখনো দুই বিনুনি। তখন একটা গলি। রোদ মরে আসা বিকেল। কর্পোরেশনের বাতিদানের মগে মগে মিটমিটে আলোর ডুম। ওদিকে কোনো বাড়ির প্রাচীন ছাতে চামেলি। একটু বাতাস। তখন স্বপ্না। স্বপ্না ও গলি। স্বপ্নার বুকের কাছে বইয়ের ভার। তার মুখে বিচ্ছুরিত আলোর সম্ভার। স্বপ্না। স্বপ্না। স্বপ্না। রাত। দিন। দুপুর। বিকেল। সন্ধে। হ্যাঁ। গণেশ। আমি স্বপ্না। কিন্তু, তুমি। তুমি আমার স্বপ্ন। লেকের ধার। কলকাতার ফুটপাথ। ফুচকা। আলুকাবলি। গণেশ, একটা কাজ। একটু রোজগার। মাইরি। গ্যাস। হাঁড়ি-কড়া-খুন্তি। আমাদের ঘর। ওয়ার্ডরোব। বিছানা। ছোট্ট একটা ফ্রিজ। মাখা আটা। এই লেচি। লেচির পর রুটি। গরম রুটি। বেগুনভাজা। শালি! তোর বিয়েতে সানাই। তোর বিয়েতে বর। তোর বিয়েতে গাড়ি। তোর সুখের ঘর। আমার দুখের বাস। রাত্রিদিন ছটফট। ছটফট। এ দুখের কথা। এই দুঃখ বহন। তবে, তবে, তুই আমার শত্রু। না। এখন না। তারও আগে কেউ।
গদা। শালা। ঢ্যামনা। হেঁড়ে মাথা। ভুঁড়িদার। মোটা। গবগবে। তুই আমার মাথায়। হ্যাঁ। হঠাৎ। হঠাৎ চাঁটি। হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ হাসি। বুকের ভেতর রাগ। তবু সে সব সহ্য। তার পর। সেই আমাদের সবার স্নানের পুকুর। পাড়ার পুকুর। চারধারে তার বাঁশঝাড়। সবুজ সবুজ জল। একটা খেঁজুর গাছ। ওখান থেকে ঝাঁপ। ঝাঁপ। আর ঝাঁপ। আমরা সবাই। বছর ষোলো। গদা তুই। হঠাৎ। তোর চোখেতে খুনির ছায়া। আমার মাথা ঘাড়। তখন জলের ভেতর। তোর হাতের চাপ। দমবন্ধ। উ! জলের গহন গভীরে তখন মৃত্যু ছায়া। হঠাৎ মুক্তি। আর সব ছেলের দল। তারা সব। তারা সব গদার ওপর। ধাড়ি শুশুক। এমন গদা। জল তোলপাড়। জল তোলপাড়। তাই প্রথম খুন তোর।
গদার পুরোনো বাড়ি। এই রাস্তা থেকে দশ মিনিট। এই বয়সে। ছোটবেলায় পাঁচমিনিট।
সুতরাং, গদার সন্ধান। বিকেলের আলো শেষ। সন্ধের ছায়া। বাড়ির জানলার আলো রাস্তায়। গলিতে বাতিদানের আলো। তেমনই মিটমিট। এদিকে এখনো গা-ঘেঁষা পুরোনো পাড়ার বাড়ি। তাদের গায়ে গায়ে খোলা নর্দমার ধারে ধারে সন্ধ্যামালতির হলুদ, বেগুনি, সাদা ইত্যাদি রঙের পুষ্পনিচয়। এক মন উদাস করা গন্ধ।
গদা। গদারে। গদা। উচ্চকিত হাঁক।
একজন মাঝবয়সী লোক। চোখে চশমা। খিটখিটে চেহারা। পেটটা বড়। হাত-পা সরু সরু। মিহি গলা, আয়। অনেকদিন বাদে।
গদা?
হ্যাঁ। গদা।
সে কীরে, তুই গদা?
হ্যাঁ। সুগার যে।
অ। বিয়ে থা?
ওই একরকম। আয়।
ঘরের ভেতর গদা ও গণেশ। সাবেক কালের বাড়ির জীর্ণদশা। একটা টিউবলাইট। তার দুধার কালো। দেওয়ালের রঙের জৌলুস একেবারে ফিকে। একটা টিভি। ছবি চলমান। তবে শব্দশূন্য।
অন্য একটা ঘরের দিকে গদার স্বর, এই। আমার ছোটবেলার বন্ধু। এ ঘরে আবার, তোর সুগার?
না।
ভালো। তুই সুখি। আবার ও ঘরে বাহিত শব্দ, চা দুকাপ। বিস্কুট। আমার প্রাণের বন্ধু।
শালা! প্রাণের বন্ধু। মাজাকি। কোমরের কাছে প্যান্টের ভেতর জামার নিচে তোমার মৃত্যু পরোয়ানা। গণেশের বুক জুড়ে অমন কথার ভার।
বাইরে সন্ধের দাপট। ভেতরে সেই এক অদ্ভুত বিষাদ। এই ঘর। সাবেকি। পুরোনো। জীর্ণ। শুধু টিভিতে ছবি। চলমান। শব্দহীন।
টিভিতে চোখ। একপাল মানুষ। কোনো বিদেশ সম্ভবত। কারণ অতবড় চাতাল। লক্ষ লক্ষ মানুষ। ভালো চেহারার। তবে কঠিন চোয়াল। জেহাদি সব। ওদিকে ট্যাঙ্ক। সৈন্য। উত্তেজনা। ইট পাটকেল। বোমা।
কোথায়? প্রশ্ন গণেশের।
দুস।
কেন এরা।
ধুর।
চা। গদার বউ। আটপৌরে। বয়সের চিহ্ন দু চারটে চুলে আর ভাঙামুখে। তার হাত জোড়।
হাতজোড়। প্রত্যুত্তর।
ওর তো কীযে সুগার। শরীরটা।
হ্যাঁ। খড়মাটি সাফ। শুধু কাঠামো। গণেশ প্রসন্ন। এমন চারুবাক সে কবে। আশ্চর্য! নিজের ওপর আস্থা। প্রত্যয়পূর্ণ প্রস্তুতির সূত্রপাত।
গদা এবার, আর কটা মাত্র দিন। হতাশ স্বর, তার পর…
বউয়ের অভিমানী চোখ টিভিতে, শব্দ কই?
দুর! শালা হল্লাগুল্লা।
কিসের?
বদল। বদলা। আরও ভালো যদি। আরও ভালো। কিংবা, তলানিতে সব। আবার সিঁড়ি।
আরে গদা, তুই শালা দার্শনিক?
কপালে চর্বি। সে বেটা মাথামোটা। এখন সাফ। জীবন এরকমই। তবে বড় বোঝা।
এই। এসব কথা একদম না। তোমার ছেলে। তোমার মেয়ে। আমি। আমরা। এই আমাদের জীবন। আর তুমি শুধু। তোমার ভয়। মরণ ভয়।
কতদিন পরে গণেশ আমার বাড়িতে। একটু ময়দার লুচি। জলখাবার।
ন-ন্না। না। পেট ভর্তি।
উঁ! পেট ভর্তি। চুপ। একেবারে চুপ। কই। কাপটা? বেশ আহ্লাদিরে বউটা।
ও।
আবার ঘরের সেই আলোময় বিষাদ। সামনে গদা। কোমরে রিভলবার। শব্দের রাশ যদি এ ঘরে তখন না হয় গুড়ুম। তার পর গণেশ। সেই প্রথম খুনের খুনি। একটা নিকেশ।
টিভির সাউন্ডটা।
অ। রিমোটে গদার আঙুল।
শব্দ। উত্তাল দুনিয়ার সেই চবুতরা। জীবনের কী ব্যাপক আয়োজন। মৃত্যুভয়হীন মানুষ। আর গণেশ পিঁপড়ে। কিংবা খরগোশ। তখন সেই নেতার মুখ। নেতা। আরে? টিভিতে? ওই লোকটা। ওর অপসারণ? এত মানুষ! এত সাহস! দুর শালা।
এই গদা। গদারে।
উঁ।
এই আমার হাতে।
রিভলবার। অ। গুলিভরা?
হুঁ।
কী কাজ?
ঘোড়াটা…
হুঁ। ঘোড়াটায় তোর আঙুল। বন্দুকের নল। টিভির দিকে। এই শালা। ওটা আমার স্বর্গত শ্বশুরের।
আমার টার্গেট।
ওই। ওই লোকটা?
না।
তবে?
তুই।
বেশ আনন্দ। বেশ। নিজে নিজে যদি ধর, এই ধর, এই মৃত্যু – তবে। কাপুরুষ। ছ্যা। ছ্যা। ছ্যা। নারে, তুই সত্যিই আমার বড় বন্ধু। ছাঁটাই মাল। হ্যাঁ। আমি। ছাঁটাই। মিথ্যে স্তোকবাক্য। হাঁড়ির হাল।
গদার হাতের ভেতর গণেশের হাত। চোখ জোড়া আকুতি। মৃত্যুর প্রার্থনা।
বউ ময়দায় বিপন্ন। ফিসফিস। শালা টাইম কিলিং ফ্যাক্টর। ওই লেচি। লুচি। হলুদ ছাড়া আলুর চচ্চরি।
বাটিচচ্চরি।
ইয়েস। তার আগেই গুড়ুম প্লিজ।
না। বজ্রকণ্ঠ। এবং, মুহূর্তে গদার বাড়ি ও গলি পেছনে। সামনে আলোকোজ্জ্বল চওড়া সরণি। কত মানুষ। গাড়ি-ঘোড়া। জীবন প্রাণবন্ত। গণেশের কোমরে জামার আড়ালে ছ ঘোড়ার রিভলবার। ফুললি লোডেড।
অকরুণ। নিষ্ঠুর। এই রিভলবার। তবু কেন যে গদা’র নিস্তার। আর একবার। একবার চেষ্টা। বা, ভালো বাংলায় প্রয়াস। নিষ্ঠুরতার সাক্ষী গণেশ জীবনে একবার। স্মৃতির অতল তলানিতে সে সত্য। তাকে পুনরাবিষ্কার। সেই দাড়ি ভরা মুখ। কালো। এক চোখ ছোট। বেঁটে মানুষ। তার বাড়ি গাছগাছালির ভেতর। মাটির দোতলা। চারদিকে জঙ্গল। শুধু যতিচিহ্নের মত ক’টা বাড়ি। সে দোতলা বাড়ির দেওয়ালে বন্দুক। তখন রোদ্দুর। এক ভরা সকাল।
বন্দুক?
আমার ঠাকুরদার। জার্মান মেক।
কেমন? চালু?
হুঁ।
গুলি ভরা?
না।
তবে?
চালু।
শুধু গুলি…
হ্যাঁ।
এবার সে বন্দুকে প্রাণ প্রতিষ্ঠা। আর, লোকটার চোখেমুখে নিষ্ঠুর উন্মাদনা। এই সাতসকালে যদি গণেশকে। না অতটা নিষ্ঠুর কি?
সে লোকটার চোখদুটো তখন কেমন অমানবিক। পৃথিবীর আর সব নির্ণয় কর্তাদের মতো।
কাঠের সিঁড়িতে ধুপধাপ। দোতলা থেকে একতলার উদ্দেশ্যে।
সেই জঙ্গলঘেরা জমির এই স্থান। মাটি এখানে লাল। এক লাল উঠান। বন্দুকের বাঁট কাঁধের গোড়ায়। নল জঙ্গলমুখি এক গাছের দিকে। তাক। গণেশ তখন ভেতরে ভেতরে সেই ছোটবেলার রামায়ণ, মা নিষাদ…
গুড়ুম। ঝটপট। ঝটপট পতন। ছটফট, মৃত্যু যন্ত্রণার।
নীল রঙের এক পাখি। রক্তমাখা। ভুঁয়ে।
এ পাখি?
এর মাংস। বেশ টেস্টি। আজ দুপুরে ভোজ।
কাতর পাখিটার এখনো প্রাণ। এখনো তার শরীর। সে শরীরের উষ্ঞতা। গণেশের জলভরা চোখ। মাথায় রোদ্দুর। চাঁদিফাটা।
গদার চেয়ে অসহায় সেই পাখি। লোকটার বাঁচার শর্ত তো তেমন না। অথচ, গণেশ জোয়ারদার–এই এখন এই সন্ধে পার রাত্তির। শত সহস্র মানুষের কোলাহল মুখর জীবনে নিঃসঙ্গ এক মানুষ। ছ ছটা গুলি। ছ ছটা খুন। তবে মুক্ত। নিশ্চয়ই আড়ালে আবডালে ওরা। ওই সব বাঁ চোয়াল লুপ্ত। বাঁদিকের শরীরে উপচ্ছায়ার আঁধার। ওই ওরা।
ডাইনে বাঁয়ে। সামনে পেছনে। উর্ধ্বে আকাশ। নিচে ফুটপাথ। সবেতেই গণেশের চোখ। আকাশ আজ মেঘ ভরা। লুপ্ত তারা ও চাঁদ। বোধহয় এখন লুচি-বাটিচচ্চরি বউটা। গদার বউ। তার সঙ্গে গদার বাতচিত–অনেকটা এরকম। অবশ্য আন্দাজ।
কই?
কে?
তোমার ছোটবেলার বন্ধু?
নেই।
ও মা! বিস্ময়।
তবে আর কী।
এ বাবা! আমি যে লুচি…
এ মহাজন কিসের জন্যে?
তুমি। বাটিচচ্চরি। আমি কি পাগল? উঁ! ভরাভর্তি সুগার। ওনার বাটিচচ্চরি। আহ্লাদ।
সেসব কথার পরে আরও কথা। কথা বার্তা। কত কথা। গদার মুখে কথার উৎসব। যদিও বুকের ভেতর এক ভয়ের নির্মাণ। ওই যে ছোটবেলার বন্ধু। তার হাতে রিভলবার। কেন? ও কি পাগল?
বউয়ের কাছে সে সংবাদ, সে তথ্য, অজানা। অজানা কী? না, কথার ঢেউয়ে হঠাৎ ভাসমান?
ওমা?
হ্যাঁ। তবে আর।
পুলিশে এখনই খবর।
দুর! পুলিস। পুলিসের কাছে পাগলের প্রলাপ। শালাদের এমন প্যাঁচ কথার। শেষে আমি শালা হাজতে।
কিন্তু, ও যদি আবার…
ক্ল্যাক। একটা শব্দ। মুখে।
ব্যাপারটা সিরিয়াস।
এখন পান্তা। বাসি। টিভির খবরের মত। ব্রেকিং নিউজ। পরে সারাদিনে লাপাতা।
সঙ্গে সঙ্গে পুলিসে একটা ফোন। বাছাধন বামাল সমেত।
ধূর!
বন্ধু। বন্ধু। বন্ধু। চিরকাল বন্ধু। বন্ধুর হাতে রিভলবার। বোধহয় সন্ত্রাসবাদি।
না। সন্ত্রাসবাদি না। ও ভীতু। ভীতু না। থুরি। নিষ্ঠুর না। আমি নিষ্ঠুর।
কই? তুমি তো ভ্যাবলা।
এখন আমার রোগ। এই শালা সর্বনেশে। চিনি। শুয়োরের বাচ্চা। হারামির হাত বাকসো। আমি গদা। আমি সেই অমিতপরাক্রমশালী গদা। ইস্কুল জীবনে আমি ত্রাস।
ওসব গপ্পকথা। কথার ফুলঝুরি। ভ্যাবলা।
আমার পাস্ট ফর্ম…
পাস্ট ফর্ম। উঁ! তুমি ভ্যাদা। হাঁদা গঙ্গারাম। ঢ্যামনা।
এই মুখ খিস্তি…
আবার গর্জন? বিছানায় ইঁদুর। একটু সুখ। টাকা না গয়না না। একটু সুখ। কেলানে। হাঁদা। হাঁদা গঙ্গারাম। ভ্যাদা।
সেইজন্যেই তো।
সেইজন্যেই তো, মানে?
আমার প্রার্থনা।
কিসের?
মৃত্যুর।
অ।
আমি মৃত্যুপ্রার্থী।
তো আমার কী। মৃত্যুপ্রার্থী তো মৃত্যুপ্রার্থী। হুঁফ। মৃত্যুপ্রার্থী। তুমি তো মরাই। মরা। ধ্বজভঙ্গ।
এই।
আবার হুঙ্কার। মৃত্যুপ্রার্থী, তো গুটোনো লেজ কেন? বন্ধুর হাতে তো বন্দুক। ওর কাছে, আর ও যখন খুনের উদ্দেশ্যে, তখন কি তুমি কনেবউ। শালা। ঢ্যামনা। আমার হাড়-জুড়ানি তুমি, কখনো? সারা জীবন, এই গোটা জীবন একেবারে ছারখার। এই একটা গাণ্ডু। এর জন্যে উ!
ঠিক। সব ঠিক। একটুও ভুল না। সব ঠিক। গণেশের কী ঘেন্না। প্রায় ওর পায়ের ওপর আমার মৃত্যু প্রার্থনা। কিন্তু, এই আমি আমার আবিষ্কার। আমি আবিষ্কারক।
কিসব ভ্যান্তারা মাইরি। সরাসরি কোনোদিন কিছু না। জিলিপীর প্যাঁচ।
গণেশ কাপুরুষ। ভীতু। এসব না। তাই গুলির খর্চা, এই আমার ওপর, তার কাছে মিসইউজ। বাজে ব্যাপার।
কোথায় সে এখন?
কোথায়? শ্রী হরি মধুসূদন। তাঁর জ্ঞাত।
এই লুচি আর বাটি চচ্চরি…
তুমি।
হুঁ, আমি! অম্বলে ঠাসা। জল পর্যন্ত অচল। একটা ভালো ডাক্তার পর্যন্ত। নির্মুরূদে। কপাল। সব কপাল। ওই যেদিন চিতায়। সত্যি। কী পোড়া কপাল।
টিভিটা।
সিরিয়াল।
না। খবর।
খবর? দুনিয়াদারি? কেন? এই চারদেয়ালে বন্দি। কিসের দুনিয়াদারি।
আমার এখন খবর। খবর বেশ উত্তেজক। সমস্ত শিরা উপশিরায় এক জঘন্য প্রতিক্রিয়ার দোসর। টান টান উত্তেজনা। রাগ। প্রতিহিংসা।
উত্তেজনা তোমার বারণ। তোমার না সুগার?
সিরিয়ালে কী? ওইসব সাধ-আহ্লাদ-ন্যাকামো। আর, বিজ্ঞাপনের ফুলঝুরি।
খবর, ছিঃ! শুধু মারামারি কাটাকাটি। পৃথিবী যেন বদলোকেদের বাসা।
সে ভালোমানুষ।
কে?
সে বীরপুরুষ।
কে?
সে কাপুরুষ প্রাণের প্রতি অকরুণ।
কে?
ভাবনার পাখসাট। বেশ। এ এক নির্মাণ। রাত্রি স্তব্ধতায় মুখর।
এক বেলা অবেলার এই প্রান্তিক সময়ে এক বাড়ি। আগে চকমিলান। এখন তার গায়ে অশ্বথ। বৃষ্টির পরে ধোয়া পাতা। গলির ডেরায় সোনার রোদ। তখন স্মৃতির পুনরুজ্জীবন। স্বপ্না। সে কতকাল আগের কথা। এখনো জীবন্ত। প্রাণবন্ত এক বিষাদ। বাড়িটার গায়ে গ্যারাজ। এক পাশে। জং ধরা শাটার। বন্ধ। জং মানে এই ঝাঁপির ভেতরে হাঁ হাঁ মাঠ। বাড়িটা দোতলা। গায়ে গায়ে প্রাচীনত্ব। রাজমিস্ত্রির অনুপস্থিত দীর্ঘদিন। অথচ, স্বপ্না। তার সঙ্গে শেষ কথা। স্বপ্নার চোখে আঠা আঠা জল। সেসময় সন্ধের নীল অন্ধকার। মাথার ওপরে পাতা ভরা গাছ। সামনে এক পুকুর। তখন চেনা-অচেনার ধন্দ ও দ্বন্দ্ব উপস্থিত।
ক্ষমা।
হুঁ।
বাড়ির জোর?
হ্যাঁ। ঠিক তাই।
এই বিয়েতে মত…
তোমার ব্যাপার।
গাড়ি। বাড়ি। বড় চাকরি। সুদর্শন?
বাড়িতে সবার খোশমেজাজ।
অ।
সুখী, বাবা-মা?
ঠাকমা। দাদু। আমার পুঁচকে ভাই।
তাই!
হ্যাঁ।
বেশ।
একটা চুমু।
না।
তুমি বিস্মরণের বস্তু না।
আবলুস কাঠের দরজা। যেন গাম্ভীর্যের স্মারক। এককালে পালিশ। এখন জায়গায় জায়গায় কালচে ছোপ। গরিবিয়ানার নিদর্শন কি? ডান হাতে ওপরের দিকের বাটামে একটা বৈদ্যুতিক দোর-ঘণ্টি। ছ্যাতলার দাগ। আরও নিরীক্ষণ। জানলার কপাট। দেওয়াল। পারিপার্শ্ব। সমস্ত কিছুতেই কালগ্রাসী জরার সতর্কীকরণ। এই স্বপ্না কি জীবিত? না মৃত? স্বপ্নার সেই শ্বশুরবাড়ি। মানে, এই বাড়ি। তার অতীত ও বর্তমানে সাযুজ্য শুধু তার আকার বা আয়তনে। এছাড়া এমন এক ঘন বিষাদ। ওদিকে আকাশ। সে এখন ব্যাপক কালো। আলোর দ্যুতির ওপর তার করাল থাবা। বৃষ্টির আগে। এই সময়ে অন্তঃপুরে যারা, তাদের কানের ভেতর দোর-ঘণ্টির আর্ত অসহায় নিবেদন।
কে? স্বপ্নার গলা।
আমি।
কে আমি?
আমি গণেশ।
গণেশ? সে কে?
রিভলবারে হাত।
আমি গণেশ।
ও, রতন পাখিরা লেনের?
কেন?
দরকার।
দরজার দেওয়াল অদৃশ্য। এই স্বপ্না? তার সেই পিঠের ওপর একরাশ চুল। কালো। কোঁকড়ানো। পাছা অব্দি। সেই পান পাতা গমের রঙ মুখ। তার গজ দাঁত। সেই দাঁতের হাসি। তারা সব কোথায়?
চেনা? চেনা? সংশয় স্বপ্নার।
হুঁ।
কী ব্যাপার? এতদিন বাদে?
এমনি।
ও।
বাইরে উপুরঝুম বৃষ্টি। এইমাত্র। কথার ফাঁকে।
অ। না। না, ভেতরে প্লিজ। ভেতরে। স্বপ্না’র সবিনয় অনুরোধ।
তবে তাই।
দরজার ওপারে ঢাকা বারান্দা। ছোট। তার ওপরে ঘর। বসবার। সোফায় স্বপ্নার বর। অমা! কোঁকড়া চুল। কোথায়? এখন হালকা। ফিরফিরে। কাঁচা পাকা।
আমার দাদা। মানে জ্ঞাতিদাদা।
অ। নমস্কার।
নমস্কার।
এদিকে?
একটা কাজে।
অ।
একটু চা? স্বপ্নার অনুরোধ।
হ্যাঁ। ছোট।
চিনি?
হ্যাঁ। হ্যাঁ। চিনি।
দুধ?
হ্যাঁ।
মুহূর্তে স্বপ্না রান্নাঘরে। জানলার সার্শির ওপারে বৃষ্টির রঙ সাদা।
আজ ছুটি?
লোকটার হাতে টিভির রিমোট। নিরুত্তর।
সেই স্মার্তভাব। সেই লম্বা, স্বাস্থ্যবান, সুপুরুষ। কালের প্রলয়। কাল। মহাকাল। কোল-কুঁজো টাইপ। এ সময়। ঝোলা চামড়া। কপালে দাগ। গভীর রেখা। চোখের ভেতরে কোথাও যেন এক আর্ত, সন্ত্রস্ত, এক লজ্জা। কেন?
টিভিতে বিদেশের এক শহর। শিল্পনগরী। শ্মশান। ধারাভাষ্যকারের অভিনয়। যেন কত ব্যথিত। মর্মাহত। শালা!
আজ বেবার না?
আমার রোজ রোববার।
মানে?
এই যে দুপুরে লুঙি পরিধান। এই ধুলোভরা সোফার ওপর।
কেন?
ওই যে টিভির ছবি।
হুঁ। টিভির ছবি। কিন্তু…
বিশ্বায়ণ। শহরটা মরুভুমি। অথচ একসময়। সেখানে সারা বিশ্বের লোক। কী গর্ব তখন। কী মহিমা! বান-চোত। সরি।
স্বপ্নার হাতে চা। তার শাড়িটা বেশ পুরোনো। কতদিনের। জংলা রঙ। শ্যাওলা শ্যাওলা কালার। ব্লাউজটা হলুদ। রঙ ফিকে। অনেকদিনের। চায়ের কাপগুলো। আগেকার। বনেদি। সাবেকি সময়ের। চায়ের রঙ, মোটামুটি পাড়ার গুমটির দোকানের। বান-চোত।
স্বপ্নার কলকণ্ঠ, এই, গণেশদা এই প্রথম। এই প্রথম আমাদের বাড়িতে।
আরে বাবা। লৌকিকতা মাইনাস। গণেশের পাল্টা কথা।
হুঁফ! লৌকিকতা মাইনাস। আমার বাড়ি। তুমি অতিথি।
লোকটার মুখে একচিলতে হাসি। সদানন্দ’র সিঙাড়া। এই শেষদুপুরে–গরম। খাসা। অভূতপূর্ব স্বাদ। আমি…
হ্যাঁ। হ্যাঁ। হ্যাঁ। ভারি ভালো তবে। তাই-ই। ওটাই বেস্ট।
লোকটা ভেতর ঘরে।
বাইরে কিন্তু প্রবল বৃষ্টি।
তাতে কী। তাবলে, তুমি আজ প্রথমবার।
সে ঠিক। কিন্তু এমন উপুরঝুম বৃষ্টিতে…
সারাদিন তো বাড়িতে। তবু এক কাপ চা। একটু আনাজপাতি।
কিছু মানুষ গেরস্থ। সংখ্যায় কম। ম্যাকসিমাম অলবড্ডে। বাইরের জগতে সদালাপী। বা, খিস্তিবাজ। বাড়িতে রামগড়ুরের ছানা। বা, ধনেখালির জমিদার।
লোকটার শ্যাওলা রঙের ট্রাউজারস। প্রাক্তন কর্পোরেট অফিস কর্মী। সব জামা-ই ফুলহাতা। এখন বোতল-সবুজ ফুলহাতা। হাতে বড় ছাতা। আর নাইলনের এক চিলতে কালোকিস্টি ব্যাগ।
সিঙাড়া তবে? গম্বুজের ভেতর ভারী গলার স্বর যেমন।
আর মিষ্টি?
হ্যাঁ। হ্যাঁ। মিষ্টি।
বাইরে বজ্রপাতের আওয়াজ। মুষলধারা বৃষ্টির শব্দ।
এর মধ্যে লোকটা। তার মাথায় বড় ছাতা। বাইরের দরজা খোলা। হাট। ভদ্রতা দরজা পর্যন্ত। বৃষ্টির ভেতর লোকটা ছুন্নি। ভ্যানিশ। যেন অনন্তযাত্রা। গণেশের হাত বন্দুকে। সে যেন হত্যাকারীর ভূমিকায়। অন্তত, মনে মনে।
সেন্টার টেবিল। তার ওপারে সোফায়। পুরোনো সোফা। অ্যান্টিক ভ্যালুর দাবিদার। সেখানে স্বপ্না। খানিক কাত। ডান হাত সোফার পেছনে। তখন স্বপ্নার কান। গলা। হাত। শূন্য। অতীত। সে সালঙ্কারা ছবি। সেই যৌবন মধ্যাহ্নের দ্যুতি সেইসব স্বর্ণালঙ্কারে। চারুপমা সে মুখ। নিষ্পাপ। যেন এই লোকটা। তার বর্তমান স্বামী। জীবনে প্রথম পুরুষ।
তোমার গয়নাগুলো?
ভ্যানিশ।
মানে?
ভ্যানিশ।
এখন?
কালকের দিনটা কেমন…
মানে?
প্রত্যুষ মানে ভয়।
প্রত্যুষ কে?
প্রত্যুষ–ঊষাকালের পূর্বলগ্ন।
আর রাত?
নিশিথ রাত্রি। অন্ধ যাত্রী। হা হা হা হাসি। উদ্দাম।
ঘরের এক কোনায় উঁচুতে পলেস্তারা। তার কিছু টুকরো। সাদা চূণ। হঠাৎ, শ্যাওলার মত কালো দাগ ছোপের মার্বেল মেঝের ওপর।
হাসিতে বিপর্যয়?
কান্নায় কী সুখ?
বাড়িটা মর্টগেজ। তার সংকট কাল আসন্ন।
তারপর?
ওই যে নিশিথ রাত্রি। অন্ধ যাত্রী। ফুটপাথ। বা, ঝুপড়ি। বস্তি।
এত খারাপ?
টাই কোট-প্যান্ট মানে মরণ। মৃত্যু।
ওই যে শহরটা। টিভিতে। ওই বিশাল দেশের। স্বপ্নের। স্বপ্নের দেশের। কেমন হাঁড়ির হাল। যেন শ্মশান। ওই মানুষগুলো? এই আমার বরের মতো। এখন নির্বীর্য। ইমপোটেন্ট। এরকম কত শহর। কত কলকারখানা। কত মানুষ। এক অন্ধকার। গাঢ়। নিঃসীম অন্ধকার।
তোমার ভাষা সাহিত্যের ভাষা।
কবিতার ছলে আমাদের সেই সব সন্ধে। তোমার ভাষায় কবিনী। কারণ সিধে দুটো লাইন তোমার কখনো না। বারেবারে লাইনচ্যুত।
সে জন্যে কম টীকা-টিপ্পনী। বাব্বা!
আজ এতদিন বাদে। পুরাতন প্রেম?
না।
গণেশের শার্টের প্রান্ত কোমরের ওপর। এই মুহূর্তে।
বন্দুক! বিস্ময় স্বপ্নার।
হ্যাঁ।
কেমন?
গণেশের হাতে ধরা। ট্রিগারে আঙুল।
গুলি ভরা?
লোডেড। ফুললি লোডেড।
বা! বেশ সুন্দর। মুখে নলের ওপর আর একটা গোল মতো। কী ওটা?
নিস্তব্ধ। নির্জন। নিরালায়। এ এক শব্দহীন মৃত্যুর আয়োজন। জাস্ট ফিজ্ৎস। সাইলেন্সার।
তোমার হাতে কেন?
তোমার মৃত্যুর পরোয়ানা।
বা! ঈশ্বরের অস্তিত্বে এতকাল সন্দিহান। এত দোলাচল। এখন। না।
কেন?
মৃত্যু আমাদের উদ্ধার। আমাদের এই প্রতিদিনকার নিষ্কর্মা আলসেমির ওপর যবনিকা। তুমি মৃত্যুদূত না। দেবদূত।
আর সোফায় না স্বপ্না। বরং দ্রুত এপারে। গণেশের গায়ের কাছে। তার ত্বকের ম-ম গন্ধ। বন্দুকটা স্বস্থানে। আগের মতো। শার্টের প্রান্তের আড়ালে।
স্বপ্নার বাহুবন্ধনে গণেশ।
এ কী?
সেই চুমু। অতীতের সেই দায়। কী পরম ভালোবাসা।
গণেশের আলিঙ্গনে স্বপ্নার সমস্ত শরীর।
স্বপ্নার ব্লাউজ সোফার কিনারে। ব্রা অন্যদিকে। মেঝেয়। শাড়ি পায়ের নিচে। শায়াও।
মৃত্যর আগে। আমার পাওনা। আদর। এই ঋণ শোধ তোমার। আমার বাসনা।
বাইরে অনন্ত অবিরাম বৃষ্টির ধারা। ভেতরে, আধো অন্ধকারে নগ্ন স্বপ্না। প্রাণবন্ত ভালোবাসার উষ্ণ সন্ধান।
স্তব্ধ বৃষ্টি। আকাশ কালো। এখনো। রাত্রির গাঢ় অন্ধকার। নিঃসীম। কট কট ব্যাংয়ের ডাক। নিস্তব্ধজারিত এই সময়ে। কখনো কখনো। তবে, তারা যেন এই নিস্তব্ধতার দোসর।
দু’ দুটো গুলি নিখরচা। এখনো তারা সেই ছয়ের ভেতর। মুক্তি কোথায়? মুক্তি? একা গণেশ। এক ভুশূণ্ডী মাঠের ওপর। জলে-কাদায়।
এ সময় মনে স্বপ্নার বিচরণ। এত কাল পরেও তার মধ্যে প্রেম সজীব। কিন্তু, আবার নানা প্রশ্ন মাথায়। যদি পলেস্তারা খসা স্যাঁতসেতে দেওয়ালের বদলে রঙে ঝলমল ঘরগুলো, তবে? গ্যারাজের শাটারে রূপালি রঙ, এখনো? স্বপ্নার গা ভর্তি গয়না, তখন? কে তবে গণেশ জোয়ারদার। হ্যাঁট। বন্ধ দরজা। পরিচয়কে অস্বীকার। কে গণেশ? ধুর! স্মৃতির সরণীর বাতিস্তম্ভগুলো নিষ্প্রদীপ। তার কাছে শুধু বর্তমান। তেমন যদি। তখন এই গুলির খরচা।
এখনো ছ-ছটা গুলি। দুর! বাবা।
এ এক আশ্চর্য। মৃত্যুভয় আপাতত স্থগিত। জীবনের কামনা বাসনার উত্তুঙ্গ দিনগুলোয় শরীর না মন, এই দোলাচল। এক আদর্শবোধ। প্রেম কেবল মনের। শরীর তখন। বিয়ের পর সব। প্লিজ। একটা চুমুতেও দ্বিধা। আর আজ। স্বপ্না মৃত্যুর মুখোমুখি। মৃত্যুর জন্যে নিবিড় প্রার্থনা। সে যেন জীবনের শেষ প্রহরে। তাই, ভালোবাসার মানুষের কাছে নিঃশর্ত সমর্পণ। কতকাল পরে গণেশ জোয়ারদারের কাছে নারী শরীর সজীব কিছু। বউয়ের সঙ্গে মাখামাখি নিরামিষ। কবে যেন সে জীবন্ত লাশ। কেবল শ্বাসে-প্রশ্বাসে। অম্বলে, বদহজমে, ক্যালসিয়ামহীন গা মরমরে ব্যথায়। বিছানায়। তখনো কথা কাটাকাটি। নিরমুরূদে গণেশ। তার পিতৃ-মাতৃ ভক্তির নির্মম উপহাস। তবু, তার মৃত্যু–একটা গুলি। বাজে খরচ। ছ-জন। ছটা গুলি।
মনের ভেতরে এখন, স্বপ্নার প্রেম ও নগ্ন শরীর, তাদের অবলুপ্তি। এখন শুধু ছ-ছটা গুলি। শত্রু কই? শত্রু?
ঝোড়ো হাওয়া। মেঘের দল পরাজিত সৈনিক। দুদ্দাড় পিছু হটার সংকল্প। সেসব জায়গায়, ওই পলাতক মেঘেরা মাটির চুম্বন প্রার্থী। পোড়ামাটি নীতি। আর এখানে ঝকঝকে আকাশ। আজ কি পূর্ণিমা? এক বিরাট রূপোলি চাঁদ। তার জ্যোৎস্নার ফিনিক। সর্বত্র। সব যেন এক অসামান্য বিভার প্রভাবে এক রূপকথার দেশ। মৃত্যুহীন। এক আনন্দনিকেতন। একঘেয়ে জীবনের বাইরে এ আর এক জীবন। কিন্তু, মৃত্যু গ্রন্থিত। যদি বন্দুকের নল নিজের বুকের ওপর। একটা গুলি। জাস্ট একটা গুলি। তবে, এই অসামান্য সৌন্দর্য, এই অপরূপ, কান্তিময়, রাত–এরা চিরতরে গায়েব। তখন, না আলো। না অন্ধকার। জীবনবিমুখ গদা, মৃত্যুপ্রার্থী। তার শরীর রোগ জীর্ণ। তার চপলা বউ। আজকের এই জ্যোৎস্নায় ওরা যদি ছাতে। শুধু জ্যোৎস্নার আবেগে যদি ওরা সেইসব নবীন দিনের, সেই প্রাণবন্ত উচ্ছল-উদ্দাম জীবনের ক্ষণিকমুহূর্তে, তবে গদার কাছে জীবন আবার এক চিত্তবিনোদন। তার টকিং মেশিন বউ। তার কলোচ্ছ্বাস যেন এই মাঠের ওপর, বা বাতাসের স্তরে স্তরে।
স্বপ্নার বাড়ির জানলার ময়লা কাচের শার্সির ওপর ওই জ্যোৎস্না। তখন তার স্বামী সোফায়। এক কাপ দুধ ছাড়া কফি আর সিগারেটের মৌতাতে। স্বপ্না এক হাফ-সোফায়।
তার কাছে স্মৃতির সরণী মূর্ত। সেই ময়দানের ঘাসের সজীব গন্ধ। সন্ধের হ্যাঁলোজেন আলোক মালা। তাদের নিষ্প্রভ দ্যুতি। সাজে সাজা ভিক্টোরিয়ার ধারে মরকুটে ঘোড়া-টানা রথ। গণেশ ও স্বপ্না একদিন। ঝিরঝিরে বৃষ্টির সন্ধেয়। ওই গাড়িতে। ওই গাড়ির সন্ধে। ওই বৃষ্টি। ও ঝোড়ো হাওয়া। সেই স্বপ্নার লতির ওপর ভেজা কুন্তল। তা’র ভ্রূ-এর ওপর ধরা বৃষ্টির ফোঁটা। এই ফোঁটাগুলোর স্বর্ণ-নির্মাণ। এইসব। তখন সে গণেশের কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ, মৃত্যুর প্রার্থনাকাতর রমণীকে গণেশের উপহার। ভরা-ভর্তি প্রেম। সে প্রেম দেহজ। আর তখনই উপলব্ধি দেহ ছাড়া প্রেম একপ্রকার নিঃসঙ্গ এক শালিক। একা। ছাতের কার্নিসে। একা।
জ্যোৎস্নার আলোময় প্রান্তরের ধারে গভীর ছায়ায় কত গাছ। মহীরুহ সব। এক ভরা ভর্তি আঁধার সেই মাঠময় আলোর নিচে। সেদিকে দৃষ্টি। বিস্ফারিত চোখ। ওরা। সেই বাঁদিক লুপ্ত। ডানদিক আলোময়। তারা। গুটিসুটি। ছজন।
উদ্দাম হাসির সঙ্গে জ্যোৎস্নার আলোর ভেতর হলুদ আগুনের অস্থির দৌড়।
মুক্ত গণেশ।
মন্তব্য