অপার অবসরের দিন। দুশ্চিন্তা ছাড়া করার কিছু নেই, শুয়ে বসে থাকেন বাবা, আর হুটহাট ঘুমিয়ে যান। আবার দেখা যায়, ঘুমের চিন্তায় ঘুমই আসছে না। বার তো ঠিক থাকেই না, সময়ের হিসাবেও তালগোল। ঘুম ভাঙতেই চিন্তা হয়, সন্ধ্যা হচ্ছে না কি ভোর?
অবেলার ঘুমটা আজ ভাঙলো খটাং একটা শব্দে। একটা ঘুমঘুম আর একটা চমকানো চোখে বাবা অনুসরণ করলেন শব্দটাকে। সেদিকে এক পর্দানশীন জানালা। তার নিচে হা করে ছিল ক্ষুধার্ত এক ইঁদুরধরা কল, খাবার পেয়েই মুখ বুজেছে। ইঁদুরটাকে দেখেও অবশ্য ক্ষুধার্তই লাগছে। নাকি নিজে ক্ষুধার্ত বলেই ক্ষুধার ছড়াছড়ি দেখছেন বাবা?
চাকরিটাও গেলো, মারিও এলো। জমানো টাকা লকডাউনের প্রথম দু’মাসেই শেষ। ছেলে-মেয়ের সঞ্চয় ধার নিয়েছিলেন উচ্চসুদে, শেষ। বউয়ের আঁচলের গিঁটে হয়তো আছে কিছু। কিন্তু তা দিয়ে আর কত? দিনে দিনে পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে।
ঘরে-খিদে-বাইরে-জীবাণুর এই যাঁতার ঘূর্ণিও মনে হচ্ছে থামবে না সহসা। দেখতে শুনতে বড়ভাইয়ের মতো হৃষ্টপুষ্ট না যে, ত্রাণচুরির সুযোগ পাবেন; আবার ছোটটার মতো দুস্থও না যে, ত্রাণ দেবে লোকে। তাহলে? সন্তানের পাতে ভাত দিতে না পারার যন্ত্রণা নিয়েই কি মরতে হবে? আঁধার ঘনায় মুখে, ম্যাজিকবাল্বের আলোতেও কাটে না তা। কাটানোর একটা উপায় খুঁজতেই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন পথে।
বউবাচ্চার জন্য মরণপণ করে সে ঢুকে পড়েছিল যন্ত্রটায়। ঢুকেই পড়েছে যন্ত্রণায়। সেটা দূর করার জন্য তাকে এখন চুবিয়ে ধরতে হবে পানিতে। সে জন্য যেতে হবে বাথরুমে। সেটা রয়েছে দরজার ওপাশে। সেদিকেই ছুটলেন বাবা। কিন্তু বেরুতে পারলেন না।
মোড়ের মাথায় বটগাছ, তার ছায়ায় এক ট্রাক। সামনে ভিড় করে আছে পরিচিত-অপরিচিত লোক। তর সইছে না তাদের, সবাই চাইছে আগে নিতে। সামলাতে না পেরে রাগ ঝাড়ছে বিতরণকারী দল। ফিরে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে। হুমকিটা যদি সত্যি হয়ে যায়? সত্যিই যদি ওরা ত্রাণ না দিয়ে ফিরে যায়? ভয় পাচ্ছিল লোকেরা। তবে সে ভয় চুকে গেছে। চোখে এখন তাদের লুট শুরুর চাহনি। অবস্থা বেগতিক দেখে বাবাই নেমে পড়লেন সামাল দিতে। মহল্লার লোকজন তাকে মানে, নির্বিঘ্ন হলো বিতরণ। তা, পাততে পারবেন না জেনেই তো এই হাত লাগানো, যদি বিনিময়ে কিছু জোটে। কিন্তু স্বেচ্ছাশ্রম তো স্বেচ্ছাশ্রমই, তার আবার বিনিময় কী? ফিরতে হলো খালি হাতেই। সঙ্গে ফিরলো পুরনো কাশির রোগ। রাগে তখন ফেটে পড়লো সন্তানেরা। এত বেআক্কেল কেন বাবা? জীবনের চেয়ে কি তার সুখটান বড়? ‘এখন তোমার কারণে যদি আমরাও আক্রান্ত হই?’ শুনে তিনি হাসেন। হাসতে হাসতে কাশেন। কাশির তোড়ে শুয়ে পড়তে হয়। শুতেই বোঝেন জোর বেড়েছে খিদের।
আচ্ছা, খিদেও তো একটা ভাইরাস, পেটের তাহলে লকডাউন হয় না কেন?
প্রশ্নটা মাথায় নিয়ে ঘুমিয়েছিলেন। উঠেই দেখছেন ইঁদুরধরা কলের ভেতর ছটফট করছে উত্তরটা।
বেশ ক’দিন হলো ওদের উৎপাত বেড়েছে। এমনিতেই টানাটানি, তলানিতে যা একটু আছে, তাও যদি ইঁদুরে বাঁদরে খায়, চলবে কেমন করে? বিষ দিয়ে ইঁদুর মারতে কেমন যেন নিষ্ঠুর লাগে। খুঁজে খুঁজে পুরনো কলটাই তাই ঠিক করেছেন। কিন্তু ইঁদুররাও চালাক এখন, চারপাশ ঘুরে যা পায় নিয়ে পালায়, ফাঁদের দিকে তাকায়ও না। তবে এই ইঁদুরটা হয়তো বাবা, নইলে বাবাদের মতোই বোকা। বউবাচ্চার জন্য মরণপণ করে সে ঢুকে পড়েছিল যন্ত্রটায়। ঢুকেই পড়েছে যন্ত্রণায়। সেটা দূর করার জন্য তাকে এখন চুবিয়ে ধরতে হবে পানিতে। সে জন্য যেতে হবে বাথরুমে। সেটা রয়েছে দরজার ওপাশে। সেদিকেই ছুটলেন বাবা। কিন্তু বেরুতে পারলেন না।
সেখানে তখন দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়া। ইতস্তত এক হাত তার এগিয়ে আসে দরজার দিকে। হাতলটা ধরে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর ফিরে যায় কাঁপতে কাঁপতে।
একে-ওকে ডাকলেন। রাগে রাগে দরজা ধাক্কালেন। ভয়ে ভয়ে আকুতি জানালেন। কিছুতেই খুললো না বন্ধ দুয়ার। মায়ের আঙুলে নিশ্চয়ই এখন তসবির ঘুঁটি, মুখে বিড়বিড়। বউটা হয়তো ঘর গোছাচ্ছে বা দুশ্চিন্তা করছে কিংবা দুর্যোগবিরোধী দোয়া শেখাচ্ছে সন্তানদের। সন্তানেরা হয়তো নাক সিঁটকিয়ে শিখছে সেসব। নইলে ব্যস্ত আছে ফেসবুকে। ডুবে আছে বিজ্ঞান-ধর্ম আর চীন-আমেরিকা তর্কে। তর্ক মুখে নিয়েই একবার তারা এগিয়ে এলো বাবার দরজায়। শুনিয়ে গেলো রায়। যেহেতু আর নিরাপদ নন তাদের জন্য, বাবাকে এখন থেকে বন্দিই থাকতে হবে। শুনে বাবার খিদে চাগান দিলো আবার। আর লাগলো কাশি। আর বুকের ব্যথা বাড়লো। বেশিক্ষণ তাই দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। থপ করে বসে পড়লেন মেঝেয়। পড়ে গেলো ইঁদুরধরা কলটাও। ভেতরে তার অস্থির ছুটোছুটি।
ছুটন্ত ছায়াটা নেচে বেড়াচ্ছে সামনে দাঁড়ানো ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎই নিজেকে ইঁদুর মনে হলো। আতঙ্কিত চোখে আয়নাবন্দি বাবা দেখলেন সঙ্গী ইঁদুরটার শ্বাসকষ্ট। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তারও। মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আসবে। বুকে একটু তেল মালিশ করা দরকার। মায়ের মুখটা দেখা দরকার। ইচ্ছে করে বাচ্চাদের কাছে পেতেও।
হাঁচড় পাঁচড় করে বাবা তাই এগিয়ে যান দরজায়। ধাক্কান, চিৎকার করেন। কিন্তু, না, লাভ হয় না কোনো।
কী মনে করে যেন তখন তিনি মুক্ত করতে চান ইঁদুরটাকে। তাও পারেন না। যন্ত্রটায় উল্টো আটকে যায় আঙুল তার। তীব্র ব্যথার গোঙানি বের হয় মুখ দিয়ে। বুকে শ্বাসের ঘাটতি থাকায় যদিও শব্দটা হয় চাপা, তবু সেটা পৌঁছে যায় দরজার ওপারে। সেখানে তখন দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়া। ইতস্তত এক হাত তার এগিয়ে আসে দরজার দিকে। হাতলটা ধরে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর ফিরে যায় কাঁপতে কাঁপতে।