নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। সারাদেশ শীতে কাঁপলেও রাজধানী ঢাকায় তেমন শীত ছিল না। কিন্তু গত দুদিনের ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে নগরে ঠাণ্ডা ঝেঁকে বসেছে। এরপরও এই আবহাওয়ার মধ্যে অফিস শেষ করে বাসা খুঁজতে বের হতে হলো। ডিসেম্বর মাসেই নতুন বাসায় উঠতে হবে। সাধারণত নতুন বাসায় উঠতে হলে মাসের প্রথম সপ্তাতেই কনফার্ম করতে হয়। দাদি মারা যাওয়ায় গ্রামের বাড়ি যেতে হয়েছিল। যাওয়ার আগে বেশ কয়েকটি বাসা দেখেছিলাম। কিন্তু পকেটের সঙ্গে মিলিয়ে কনফার্ম করতে পারিনি। এসেও যে কয়টি বাসা দেখেছি, এরমধ্যে যেগুলো পছন্দ হয়েছে, তা আবার বাজেটে কুলাচ্ছে না। তাই একরকম সিদ্ধান্ত নিয়েই নেমেছি আজ যে করেই হোক বাসা ঠিক করতে হবে।
বৃষ্টির ফোঁটা বড় না হলেও সারাদিনের টিপটিপে রাস্তায় ঝোলাগুড় মাখামখি অবস্থা। তার ওপর ছাতা নিয়ে বের হইনি। সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ভেবেছিলাম বৃষ্টি থেমে যাবে। অফিস থেকে বের হয়ে আমার স্ত্রী কনাকে ফোন দিলাম। সে একটি ছাতা এলো। কিন্তু এই সৌখিন ছাতায় দুজনের মাথা ঢাকা মুশকিল। যদিও এই বৃষ্টিকে আমি পাত্তা দিচ্ছিলাম না। এরপরও কনার পীড়াপীড়িতে ছাতার নিচে মাথা ঢুকিয়ে হাঁটতে লাগলাম। দেয়ালে সাঁটানো যেসব টু-লেট দেখছি, ফোন দেওয়ার পর ওপর প্রান্ত থেকে জানিয়ে দিচ্ছে, ভাড়া হয়ে গেছে। আর হবেই বা না কেন! আজ মাসের ১৯ তারিখ। খালি বাসা নিয়ে তো কোনো মালিক বসে থাকবে না।
দুটি বাসা দেখার পর একটি গলির মুখে দাঁড়ালাম। এখানে অনেক টু-লেট দেখা যাচ্ছে। অফিস থেকে হাঁটার দূরত্ব হলেও চিকন রাস্তার এই গলিতে এর আগে কখনো ঢোকা হয়নি। রাস্তার পাশে অ্যারো চিহ্ন দিয়ে গলির ভেতরে প্রবেশের যে দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে, সেখানে লেখা দেখলাম, ‘বনলতা লেন’। প্রথমে ভুল করে বনলতা সেন পড়েছিলাম। পরে দেখি বনলতা সেন নয়, বনলতা লেন। গলির ভেতর ঢুকে দেখি, যে বাসা দেখতে এসেছি তার পাশেই একটি মন্দির। গলির বিল্ডিংগুলো একটু পুরনো ধাচের। ভবনগুলো তোলার সময় এ গলির কেউ যেকোনো ইঞ্জিনিয়ারের স্মরণাপন্ন হয়নি, সেটা একবার চোখ বোলালেই বোঝা যায়। তিন তলার দক্ষিণ পাশের ফ্ল্যাট। আলো-বাতাস প্রবেশে খুব বেশি সমস্যা নেই। পাশের বাসাটি দোতলা হওয়ায় ব্যালকনি থেকে আকাশ দেখার সুযোগও থাকছে। বাসা দেখে বের হতে হতে কনা বললো, পাশে মন্দির। সারাক্ষণ শব্দ হবে। সহ্য করতে পারবা তো?
বাসাটি আমারও তেমন পছন্দ হয়নি। কারণ যত সুবিধা তার থেকে অসুবিধাই বেশি। একে তো সরু রাস্তার গলি, এরওপর পুরনো বিল্ডিং। অন্তত পঁচিশ-ত্রিশ বছর হবে হয়তো। ছোট্ট দুটি রুম। টাইলস বসানো হয়নি। মোজাইকও না। প্লেন ফ্লোর। সামান্য জায়গা নিয়ে ড্রয়িং কাম ডাইনিং। ছয় চেয়ারের একটি ডাইনিং টেবিল রাখলে আর তেমন জায়গা থাকবে না। সোফা রাখার চিন্তা করা বৃথা। যেটুকু খালি জায়গা থাকবে, তাতে ফ্রিজ রাখলে আর খোলা জায়গা থাকবে না বললেই চলে। যদিও দুটি বাথরুম আছে। আর বারান্দা বলতে ছোট্ট স্পেসের একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা! সেখানে ইজি চেয়ার পাতার চিন্তা করা যাবে না। কনার একমাত্র শখ গাছ রাখার সুযোগ নেই। বড়জোর জামা-কাপড় শুকানোর কাজ করা যাবে। আর গলা বাড়িয়ে অতি কষ্টে একটু আকাশ দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে। কনার চোখ বলে দিচ্ছিল পছন্দের চেয়ে অপছন্দের পাল্লা ভারী। এরপরও স্ত্রীর অনিচ্ছাতেই বাসাটা নিলাম। সেটা যে কেবল নামের কারণেই, তা বলা যায় না। কারণ আমার যে রোজগার, তাতে এর বেশি ভাড়ার বাসা নেওয়া সম্ভব নয়। আর অফিসের এত কাছাকাছি এই বাজেটে বাসা খুঁজে পাওয়াও যাবে না। সেটা আমি যেমন জানি, তেমন কনাও জানে। সে কারণে অপছন্দের একটি বাসাকে পছন্দের করতে সেও আপত্তি করলো না।
এ পাড়ায় এসেছি মাস তিনেক হবে। সদ্য বিবাহিত দম্পতির বাসা অনেকটা মেস বাসার মতো হয়। গোছাতে গোছাতে একটু সময় লাগে। আমাদেরও তাই। চলতে-ফিরতে গলির মধ্যে একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়। দেখা হওয়া বলতে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া। অথবা কখনো বা বাসায় ঢোকার মুখে মন্দিরের বাম পাশে বসে সে গল্প করছে আর আমি হেঁটে যাচ্ছি। এই আর কি! কথা হয় না। দূর থেকে দেখি আর ভাবি, বনলতা লেন নামের এই বুঝি সার্থকতা। এ পাড়ার নাম বনলতা লেন কী কারণে হয়েছে, সেটা না জানলেও অন্তত এমন মায়াবী মুখ যে পাড়ায় থাকে, সে পাড়ার নাম বনলতা লেন হতেই পারে!
দাদা ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে। তাই সে আমাকে আর পড়তে দেবে না। অবশ্য আমারও আর আগ্রহ নেই। পড়ে কি করবো বলুন। ওই তো রমা দিদির মতো জুতার কারখানায় কাজ করতে হবে। আর জামাইয়ের ঘরে ভাত রান্না করতে হবে।
আরও মাস চারেক পর একদিন বনলতার সঙ্গে কথা হলো। সেদিন শরীর খারাপ থাকায় সন্ধ্যা নামার আগেই বাসায় ফিরছিলাম। সে মন্দিরের পাশে বসে ছিল। একা। এলোমেলা। হাতে পানির কলসি। মন্দিরের সামনে থাকা চাপ কল থেকে পানি নিতে এসেছে। সরু রাস্তায় তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। সে আমাকে পথ ছেড়ে দিতে উঠে দাঁড়ালো। আমি যেন অনেক দিন থেকে তাকে খুঁজছি একটু কথা বলার জন্য!
-তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
-নাইনে।
-নাম কী তোমার?
-বনলতা।
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, বনলতা?
-হুম বনলতা।
আমি চমকে উঠলাম। জীবননানন্দ দাশের বনলতার পর এই নাম যে অন্য কারও হতে পারে, সে চিন্তা কখনো মাথায়ই আসেনি। যেন দুনিয়ার সকল বনলতার জীবনানন্দ দাশ কবলা করে নিয়েছেন। আর কোনো বনলতা কারও হতে পারে না। সেরকমই বিশ্বাস গেঁথে গেছে অন্যান্য বাংলা ভাষাভাষীর মতো আমারও। কিন্তু নতুন এক বনলতা যখন সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, আমি বনলতা, তখন একটু ঝাঁকুনি তো লাগবেই। মুহূর্তেই সামলে নেই আমি। টিপ্পনি কাটার ঢঙে বলি, তোমার নামেই বুঝি এ গলির নাম!
সে মোটেও বিচলিত হয় না। আগের মতোই মিষ্টি করে হাসে।
আমি একটু থেমে আবার বলি। ঠিক বলি না আমার অনুমতি ছাড়াই যেন বাক্যাটা মুখ ফসকে বের হয়ে যায়, তুমি কি জানো তুমি অনেক সুন্দর?
বনলতা কিছুই বলে না। মাথা নিচু করে ক্ষাণিক হাসে। একটু বিরতি দিয়ে বলে, আপনিও অনেক সুন্দর।
আমি হাসলাম না। গম্ভীর হলাম। একথা বনলতাই যে প্রথম বললো তা নয়। একথা আমি অনেক বার শুনেছি। আবার একথাও শুনেছি যে দেখতে সুন্দর ছেলেরা সুপুরুষ হয় না। তারা আসলে হাফ লেডিস। তবে আমার ধারণা আমার মতো বনলতাকেও নিশ্চয়ই অনেক ছেলে একথা বলেছে। এই বয়সেই তাকে অনেকে প্রেমপত্র দিয়েছে।
-তুমি আমাকে চিনো?
-নাম জানি না। তবে চিনি।
-কিভাবে?
-আমাদের শোয়ার ঘর থেকে আপনাদের ব্যালকনি দেখা যায়।
এবার আমি হাসলাম। তারপর বললাম, আমার নাম কিশোর?
বনলতা অপেক্ষা না করে বললো, আপনি মুসলমান?
-আমার নামে তাই মনে হয়?
-না। আমি খেয়াল করেছি।
-কী খেয়াল করেছ?
-হিন্দু হলে তা আপনাকে মন্দিরে দেখতাম।
আমি পরিচিত মানুষের মতো হাসলাম। কারণ এ পাড়ায় মুসলমান পরিবার খুব কম। হাতেগোনা। দুইটি বাড়িতে পাঁচ-ছয়টি পরিবার হয়তো থাকে। গলির মাথায় যেখান থেকে হিন্দুদের বাড়ি শুরু হয়েছে, তার একটু আগে একটি জামে মসজিদ। আর মসজিদের সামনে সবই মুসলমান বসতি। কিন্তু গলির মধ্যে আমরা পাঁচ-ছয়টি পরিবার ছাড়া আর কোনো মুসলমান নেই। এ বাড়িটাও এক হিন্দু পরিবারের ছিল। তারা দেশ ত্যাগ করার আগে এক মুসলমানের কাছে বিক্রি করেছিল। কিন্তু বাড়ির বর্তমান মালিক এখানে থাকে না। বাড়ির নেমপ্লেট পাল্টিয়ে পাটোয়ারী মঞ্জিল করা হয়েছে। সে হয়তো আমার বাসার পাশের মন্দির আমাকে কখনো দেখেনি।
আমি প্রশংসার স্বরে বললাম, বাহ। তোমার গোয়েন্দাজ্ঞান তো খুব ভালো।
বনলতা হেসে বলল, আপনি যে দিন এ পাড়ায় বাসা নিয়েছেন, সেদিন থেকেই আপনাকে আমি চিনি। তখন আরেকটু শুকনো ছিলেন।
বিয়ের পর নাকি সবারই ওজন বেড়ে যায়। আমার বউয়ের ওজন না বাড়লেও আমার যে ওজন বেড়েছে এটা ইদানীং পুরনো শার্ট-প্যান্ট পরতে গিয়ে বেশ বুঝতে পারছি।
-হু গত দেড় বছরে বারো কেজি ওজন বেড়েছে। তুমি তো তখন ছোট্ট ছিলা।
-ছোট্ট কই তখন এইটে পড়তাম। বলে বনলতা হাসলো। আমিও হাসলাম।
বনলতার ধারণা ক্লাস এইটে উঠলে মেয়েরা বড় হয়ে যায়। হয়তো হয়। আমি বললাম, মানে এখন ক্লাস নাইন!
সে লাজুক হেসে জবাব দিলো, না। ক্লাস এইট।
আমি না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলাম, মানে?
সে বিবিসির বাংলা সংবাদ পাঠিকার মতন দ্রুত গতিতে জবাব দিলো, মানে আমি ক্লাস এইটের পর আর পড়িনি। আমাদের বাসার কেউ ক্লাসে এইটের বেশি পড়েনি। আমার দাদা ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে। তাই সে আমাকে আর পড়তে দেবে না। অবশ্য আমারও আর আগ্রহ নেই। পড়ে কি করবো বলুন। ওই তো রমা দিদির মতো জুতার কারখানায় কাজ করতে হবে। আর জামাইয়ের ঘরে ভাত রান্না করতে হবে।
আর দূরে সবুজ শাড়ি পরা কনা দাঁড়িয়ে হাসছে। তার স্থির, শান্ত-স্নিগ্ধ চোখ বলছে, এ পাড়ায় কোনো বনলতা থাকে না!
আমি চুপচাপ শুনছিলাম। যেন এসব কথা শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি, তেমন হাসি হাসি মুখ করলাম। কিন্তু আসলে তা নয়। আমার বিষয়টি নিয়ে খারাপ লাগলো। একটু নয় অনেকখানি খারপ লাগলো। মনে মনে ভাবলাম, এ রকম একটি সুন্দরী মেয়ে পড়বে না! নাহ্ তা হয় না। কিন্তু আমার হয়েই যেন কেউ একজন জবাব দিয়ে দেয়, বনলতা না পড়লে আমার কী! না আমার কিছু না। আর না পড়লেও বনলতারা তো বনলতাই থেকে যায়। যেন বনলতাদের কোনো শিক্ষার দরকার নেই।
এসব কথা ভাবছিলাম ঠিক কিন্তু কিছু বললাম না। কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই নিজের অজান্তেই নিজের দুঃখ দুঃখ মুখটা ঢাকার জন্য কথাটা চলে এলো। বললাম, তোমার দিদি কোথায় থাকেন?
যেন সে কোথায় থাকে সেটা জানা আমার জন্য অনেক প্রয়োজনীয় কিছু। মুহূর্তেই বনলতার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেলো। সে কোনো প্রকার ভনিতা না করে বললো, রমাদি বেঁচে নেই।
এ বিষয় আমার রাজ্যের কৌতূহল থাকা সত্ত্বেও আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেলাম না। মনে হলো আজ আর বনলতার আকাশ পরিষ্কার হবে না। পরে আবার কথা হবে ভেবে আমি চল এলাম। একবারও পেছনে তাকাইনি। ইচ্ছা করলেও নিজেকে থামিয়ে রেখেছি। কারণ পেছনে ফিরলেই যদি বনলতার করুণ মুখটি দেখতে হয়। আমি বনলতার করুণ মুখ দেখতে চাই না। উচ্ছল জোয়ারে ভরা নদীর মতন দেখতে চাই। কিন্তু যা তাড়াতে চাই, তাই যেন মনের মধ্যে শক্ত করে বসে থাকে। তেমন মনের মধ্যে গেঁথে থাকলো বনলতার করুণ মুখ। যেখানেই যাই, যা-ই করি, বনলতার মলিন মুখটি আয়নার মতো আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আর আমার সমস্ত খুশিকে বিদ্রূপ করে।
এরপর বহুদিন চলে গেছে। কোভিডের ভীতিও কেটে গেছে মানুষের মন থেকে। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে সবাই। আমারও নিয়ম করে অফিসে যেতে হচ্ছে। অফিস আর পারিবারিক ঝামেলায় প্রায় ভুলেই যেতে বসেছিলাম বনলতাকে। আবার অফিসফেরত সন্ধ্যায় গলির মুখে বনলতার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। চোখের নিচে করুণ কালি লেপ্টে আছে তার। ওরকম মুখের মধ্যে কালো কিছুতেই মানায় না। আমার যেন কত বছরের চেনা-জানা আপন মানুষ, তেমন করে জানতে চাইলাম, তোমার কী হয়েছে? আমার ভেতরের তীব্র দহন তার কাছে কতটা গুরুত্ব পেলো, সেটা তার নির্লিপ্ত চোখ-মুখ দেখে আন্দাজ করা গেলো না। স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলো, কিচ্ছু হয়নি। আপনাকে আর দেখি না যে!
আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, সকাল সকাল অফিসে যাই যে। আবার ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়।
-জানালাটা বন্ধ করে রাখেন কেন?
-কই!
আমি মনে করতে পারি না। আসলেই কি জানালা বন্ধ থাকে? থাকতে পারে। কনার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর থেকে আমার রুটিন জীবন ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। যদিও অফিসিয়ালি এখনো ছাড়াছাড়ি হয়নি। কিন্তু যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এটা আর ঠিক হবে না। আর কনাও যে আমার কাছে আর ফিরবে না, সেটা আমি নিশ্চিত। বহুদিন নিজের কাছে অচেনা ছিলাম। কভিডের কারণে চাকরিটাও চলে গেলো। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে একরকম বেঁচে ছিলাম। আবার ঢাকায় ফিরে অনেক কষ্টে একটা চাকরি জোগাড় করলাম। অফিস থেকে এই বাসাটা বেশ দূরে। তাও কী এক মায়ায় এই বাসায়ই রয়ে গেলাম। এখনো নিজেকে চেনার চেষ্টা করে যাচ্ছি। নিজের কাছে আবার আগের মতো সহজ হওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু যা যায়, তা কি আর কখনো ফিরে আসে? আসে না।
আমি কি বনলতার মধ্যে কনাকে খুঁজতেছি?
সেদিন আর বনলতার সঙ্গে বেশি কথা হলো না। সে কি আমার তাড়ার কারণে? না কি বনলতার অনাগ্রহ? না নিজেকে নিয়ে পালানো, বুঝতে পারিনি। কিন্তু বারবারই মনে হচ্ছিল আমি বনলতার সামনে ভেঙে যাচ্ছি। স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছি না। তবু ছুটছি। দৌড়ে পালাচ্ছি। নিজের থেকে। বনলতার থেকে।
এরপর বহুদিন পার হয়ে গেছে। আবার একদিন বনলতার সঙ্গে দেখা হলো। ছিন্নভিন্ন মুখে আমার বেডরুমে দাঁড়িয়ে আছে। যেন খুব পরিচিত এমন ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো, আপনার মুখ দেখা যাচ্ছে না কেন? আমি চমকে উঠলাম। আমার মুখ দেখা যাচ্ছে না! প্রশ্ন করলাম, কই আমি তো তোমার দিকেই তাকিয়ে আছি। সে আবার সহজ গলায় উত্তর করলো, আপনারও তো মুখই নেই। আমি ড্রিম লাইটের আবছা আলো-আঁধারিতে বেডরুমের আয়নায় তাকালাম, বুঝতে পারলাম আমার চোখও নেই। তাহলে বনলতাকে দেখছি কিভাবে? অসহ্য লাগলো। নিজেকে না দেখতে পারার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠছিলাম। আমার অসহায়ত্ব দেখে বনলত হাসতে লাগলো। ঠিক যেন ক্লাস এইটে পড়া বনলতা। অবিকল সেই হাসি! কিন্তু চারপাশে বনলতাকে খুঁজে পেলাম না। শূন্য থেকে সে বললো, এদিকে তাকান। এই যে আমি। আমি ওপরে তাকিয়ে দেখলাম, সিলিং ফ্যানে ঝুলছি আমি। আমার পাশে ঝুলছে বনলতার মুখ। আর দূরে সবুজ শাড়ি পরা কনা দাঁড়িয়ে হাসছে। তার স্থির, শান্ত-স্নিগ্ধ চোখ বলছে, এ পাড়ায় কোনো বনলতা থাকে না!