চিকন চিকন স্বাস্থ্যকর সবুজ লতার মাচাং। হৃষ্টপুষ্ট, দুষ্টু-কুষ্টু-লতার লতানো খেলা দেখে মনটা কেমন জানি আর্দ্র হয়ে ওঠে। ঠিক তখনই আম্মার কথা মনে পড়ে যায়। মায়া মায়া মলিন শাড়ির ভেতর দিয়ে, তার মসৃণ কোমল হাতের ডগা দিয়ে, মা খুব যত্ন করে একটা একটা করলা ছিঁড়তো। টকটকে সবুজ করলা। এর মাঝে থাকতো দু’একটা ঈষৎ লাল-সবুজ করলা। করলাগুলো এতই উজ্জ্বল ছিল যে, স্মৃতিতে ধরা পড়লে মন কেমন কেমন হয়ে ওঠে। এখন তো মাটিতে ইউরিয়া মেশানো। কেমিক্যালে গলানো, চুবানো। বন্ধ্যা করে, বলদা করে ফার্মের কুরার মতো ফুলিয়ে ফালিয়ে সবজি খাওয়া। ফল খাওয়া। বল খাওয়া। মল খাওয়া। তল খাওয়া। কোথাও কোথাও আবার বিচি ছাড়া। বাজা আর খোঁজা বানিয়ে যাচ্ছে, তাই করে খাওয়া আর কি!
দখিনা দুয়ার দিয়ে, নিজের আবাস থেকে এক চিলতে শুকনা সবুজ দেখলেই রাকিলের মনটা আঁইঢাঁই করে। কেমন করা একটা বৈরাগী সুর ওঠে। তালগোল পাকিয়ে ফেলার মতো। আসলে সবুজ-শ্যামল রূপেরও যে একটা গাঢ় টনটনে সৌন্দর্য আছে, অন্ধকারেরও যে আলাদা একটা ঘন-রূপ আছে, ভাবলে সত্যি অবাক হতে হয়। মাঝেমধ্যে এসব তরল অথচ গাঢ় স্মৃতির কথা রাকিলের মনে পড়ে যায়।
রাকিলের বাচ্চাটা ভীষণ দুষ্টু হয়েছে। বাবা-মা দু’জনই কর্মসূত্রে শহরে। বাচ্চার দেখ-ভালের ব্যাপারে দু’জনই খুব কেয়ারি। বিশেষ করে রাকিলের হাউজ-ওয়াইফ। সারাদিন চাকরি-বাকরি করে বাবা সবসময় পেরে উঠতে পারে না। খাওয়া-দাওয়া হাঁটা চলা কথা বলার প্র্যাকটিস থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই, যা মা করে না—ইদানীং একটা ব্যাপারে মা খুবই সচেতন। ছেলেকে ইংরেজি শেখানো। যদি সুযোগ থাকতো যে মায়ের পেট থেকেই ইংরেজি শেখানো যাবে; তাহলে দুনিয়ায় আসার আগেই বাচ্চাকে ঠিক ঠিক ইংরেজি শিখিয়ে ফেলতো। দুনিয়ার সব মানুষ ইংরেজিতে কথা বলা শিখছে। বাচ্চার কথা ফোটার আগেই মাম্মা মাম্মি বলছে। বাব্বা, ডেডি, ডেড বলছে। কথা শেখার আগেই ইংরেজিতে হাই, হ্যাললো মাম্মি, ডেড্ডি, হেল্প মি, কাম হিয়ার, ডুন্ট টাচ মিসহ মায়ের নাকে-মুখে ঘাম ছুটে যাচ্ছে। মা হয়তো পুরোটা পেরে ওঠে না। কিন্তু ডিভাইস ঘেঁটে বাচ্চার ইংলিশ কার্টুন ঘেঁটে যেখান থেকে যেভাবে পারে, পাগল পারা অবস্থা। না না হবে না। বাচ্চাকে ইংরেজি শিখতেই হবে। রক্ষা নাই। খুব খারাপ অবস্থা হয়ে যাবে কিন্তু। খুব বাজে অবস্থা হয়ে যাবে।
ছোট বেলায় আম পাড়া, জাম পাড়া, গাছের টেইল ভেঙে ভেঙে, দলা মেরে মেরে খাওয়া এই ফলও আবার কিনে খেতে হয় নাকি! আমরা তো ফল খাবো না।
কোথাও বেড়াতে গেলে টুকুন ঠিকমতো কারও সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পারে না। কারণ সবাই বলে বাংলাতে। অন্যদিকে সে বলে আধাকাঁচা ভাঙা বাংলাতে। মূলত ইংরেজিতেই সে কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এখন কী হবে! এদিকে ক্রিম ক্রিম, ছোট্ট ছোট্ট, দুষ্টু দুষ্টু, পুষ্ট পুষ্ট, মিষ্টি মিষ্টি ফুপাতো ভাইয়েরা, খালাতো ভাইয়েরা সবাইকে টুকুন কোনো জওয়াব দিতে পারে না। মাঝেমধ্যে সে দম ধরে থাকে। থম মেরে থাকে। মেজাজ খিটখিটে স্বভাব-ধরনের করে। এতে অন্য বাচ্চারাও মজা নেয়। যখন অন্যদের কথার সঙ্গে পেরেওঠে না, হঠাৎ কেমন করতে করতে সে মুখ লুকায়। এই অল্প বয়সে তার মধ্যে একটা হীনম্মন্যতা কাজ করছে? মাত্র সাড়ে চার কি পাঁচবছরের ছোট্ট বাচ্চা। মাত্রই স্কুলে দেওয়া হয়েছে। মাঝেমধ্যে টিচারদেরও ঘাম ছুটে যায় এই বাচ্চাকে সামলাতে। টিচাররা বাংলা শেখাতে চায়। সে বাংলায় স্বতস্ফূর্ত নয়। টিচাররা ইংরেজি শেখাতে চায়। ইংরেজিতেও সে স্বতর্স্ফূর্ত নয়। এরকম ভাঙা ভাঙা বাংলা। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি। ভাঙা ভাঙা গলা। ভাঙা ভাঙা তার চাহনি।
ইদানিং আরও কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। আত্মীয় স্বজন। অনেকে আঞ্চলিক টিউনেও কথা বলে। কিন্তু টুকুন তো পারার প্রশ্নই আসে না। রাকিলের বাপের বাড়ি থেকে শুরু করে শহরের আপন কারও বাসায় গেলেই শুধু নয়, গ্রামের বাড়ি বেড়াতে এলেও কিছুদিন পরপর তার স্বাস্থ্যের অবস্থা বারোটা বেজে যায়। শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। বাড়ি থেকে শহরে এলে এই স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে টুকুনের মাকে অধিক পরিশ্রম করতে হয়। অনেক কাড়খড় পোড়াতে হয়। মা খুব ক্লান্ত হয়ে যায়। বেড়াতে গেলেই বাচ্চার মেজাজ হয়ে আসে আরও আরও খিটখিটে। মায়েরও যেন সেইম অবস্থা। কেন এমন অবস্থা? কোথাও বেড়াতে-টেড়াতে গেলে মনটা আরও রঙচাঙা কড়কড়ে হওয়ার কথা। এখন দেখি মাথার ব্যথা। মনের ব্যথা। সব মিলে নাকে মুখে বিরক্তিকর সর্দির মতো; লাল আনারের মতো ফ্রেশ ফ্রেশ কষ্ট তৈরি হয়। ফ্রেশ ফ্রেশ দুঃখ তৈরি হয়। দুঃখও বা কেমনে এরকম মিশ্র হয়। এত ফ্রেশ হয়!
শেষমেষ একজন সাইক্রিয়াটিস্ট্রের কাছে গেলো রাকিলের পরিবার। শহরের নাম করা মকদুম সাহেবই সেই সাইক্রিয়াটিস্ট। তিনি জামিনের ব্যাপারটা বুঝতে চান। তার ফ্যামিলি বুঝতে চায়। তিনি বুঝতে পারলেন, ছোট্ট বাচ্চাটিকে ঘিরে এই টুকুন বয়সে বাবা মায়ের মধ্যে প্রত্যাশাজনিত অসুখ তৈরি হয়েছে। অবস্থা এমন হতে হতে বড় ধরনের ডিজ-অর্ডার, হ্যালুসিনেশন বা সিজোফ্রেনিয়া, এই টাইপসের মনের অসুখ হচ্ছে টুকুনের বাবা মায়ের! দু’জনই নিজেদের অপূরণীয়-স্বপ্নের সকল ঘাটতি, নিজেদের প্রত্যাশার সকল চাপ খুব দ্রুত বাচ্চার ওপর চাপিয়ে দেওয়া শুরু করেছেন।
বর্তমানে জামিনের বয়স প্রায় তেরো বছরের কাছাকাছি। এই বয়সেও সে বড় ধরনের সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আর ভাষা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বড় হচ্ছে। বিশেষ করে ভাষা—কারণ ভাষা মানে নিজের ভাষা। ভাষা মানে মাতৃভাষা। মাতৃভাষা মানে মায়ের ভাষা। আর মায়ের ভাষা মানে জানে প্রাণে মনে পিওর আঞ্চলিক ভাষা। যে আঞ্চলিক ভাষা ঠিকঠাক আয়ত্ত আনতে পারলো না। মানে সে একটি মৃত্তিকালগ্ন জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। যেহেতু এটাও একটা ভাষা। আবার জাতীয় ভাষা রাষ্ট্রভাষা? শুদ্ধভাবে তাও ঠিকঠাক বলতে না পারা—সে এই ভাষার মধুরসের ছইদানিও ধরতে পারলো না, মানে সেও রাষ্ট্রীয়ভাবে তথা জাতীয়ভাবে একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো! এভাবে যেহেতু সে লোকাল ভাষা, জাতীয় ভাষা কোনোটাই ঠিকভাবে আয়ত্ত করতে পারেনি। তো সে কিভাবে ভালো ইংরেজি ভাষা জানবে। সেটাই এখন দুর্ভাবনার বিষয়। এদিকটাতেও কি ফাঁকি হতে যাচ্ছে? যে নিজের দেশ, ইতিহাস, ঐতিহ্যসহ একটি সংস্কৃতির উত্তরাধিকার; এই মাটির জল হাওয়ায় যার বেড়ে ওঠা—যার পায়ের মাটি শক্ত নয়। শুধু ভাষা হিসেবে ইংরেজিতে কথা বলা কিছুটা আয়ত্ত করতে পেরেছে। কিন্তু শারীরিক এবং মানসিকভাবে এই টুকুনও এরকম-আর বড় হতে পারেনি। তার শরীর আর স্বাস্থ্য কোনোটাই আর শক্ত সবল করে ফিরছে না।
ভাষা-প্রতিবন্ধিতাও যে একটা বড় ধরনের অভিশাপ হতে পারে। নিজের ভাষার ভেতরে না থেকে স্রোতের বিপরীতে চলতে চাওয়ার চেষ্টা একজন মানুষকে শারীরিক-মানসিক-পারিবারিক-সামাজিকভাবে-ও কতভাবে যে পঙ্গু করে ফেলতে পারে। এটাও তার একটা উদাহরণ হতে পারে! মোট কথা বাচ্চা যদি তার নিজের ঘরে পর্যাপ্ত পরিবেশ না পায় তাহলে হাজারো টিচার গুলিয়ে খাইয়ে দিলেও কাজ হবে না।
আমাদের ভাষা আন্দোলনের কথা বলতে পারি। উর্দুর হাত থেকে যে ভাষার জন্য লড়াই করেছি আমরা। আসলে ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কালচার এগুলা হচ্ছে মানুষের মজ্জাগত রস। আট কুটুরি নয় দরোজার মতো। যেখান ক্ষীরের মতো হাজার অনুভূতির রস বের হয়। এই রস মনের মধ্যে স্বচ্ছ ও সজীব থাকলে শরীর ও মনেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। এই ভাষাই যদি নদীর মতো প্রবহমান বা স্বতস্ফূর্ত না থাকে। সে মানুষ মনের দিক থেকে আধা মরা। কারণ মুখের গতি মানে ভাষার গতি। ভাষার গতি মানে স্বতস্ফূর্ত সম্পর্কের গতি। ভাষার গতি মানে শরীর ও মনের সজীবতার গতি। আসলে মানুষকে ধর্মান্তরিত করা যায়। তাকে ভাষান্তরিত করা যায় না। ভাষা একজন মানুষকে তার সংস্কৃতি কে থেকে সচল ও সবল রাখে। পোস্ট রাখে। পোক্ত রাখে। আত্মবিশ্বাসী রাখে। টুকুনের ব্যাপারটাও এরকম বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে কি! কারণ ভাষার সঙ্গে শরীর মন খাওয়া দাওয়া চলা ফেরা আনন্দ হাসি কান্না ভাব প্রকাশের অনেকগুলো প্রাকৃতিক উপায়ও কিন্তু এখানে জড়িত। এই প্রতিবন্ধকতার কারণে, মানুষের সঙ্গে মিশতে না পারার কারণে, তার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন অনেকেই তাকে ভুল বোঝে। তার পরিবারকে ভুল বোঝে—বাংলা মাধ্যম। ন্যাশনাল কারিকুলাম। কেমব্রিজ কারিকুলাম। ইংরেজি ভার্সনসহ আত্মীয়দের মধ্যে সব মাধ্যমের পড়ুয়া ছেলেপুলে—চাচাতো ভাই, মামাতো ভাই, ফুফাতো ভাই রয়েছে। তাদের তো অমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তাহলে টুকুনের ব্যাপারে কেন আজ এই অবস্থা! ঘাটতিটা কোথায়! তাহলে এর পেছনে কি পরিবারের কোনো অসংলগ্নতাই দায়ী? কোথাও অতিরিক্ত কোনো বাড়াবাড়ি হয়েছে বা হচ্ছে?
আসলে সব দিকেই রাজনীতি। ভাষাও এক ধরনের রাজনীতি। শক্তিশালী ভাষার ভাত পাতে যাও, তাও রাজনীতি। ভাষায় নুন দাও। ভাষায় চুন দাও। ভাষায় আদর দাও। ভাষায় ভালোবাসা দাও। ভাষায় সোহাগ দাও। ভাষায় অন্তর-মন সবই দাও—সব দিকেই রাজনীতি। কথা হচ্ছে নিজের ভাষাটা ঠিকঠাক আয়ত্ত করে এই ভাষা-রাজনীতিকে মোকাবিলা করতে পারা। এই ভাষা-রাজনীতিকে কেন্দ্র করেও ঘুরছে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কনীতি—অর্থনীতি সমাজনীতি—কথা হচ্ছে দু’জনই তাদের ভবিষ্যৎ জেনারেশনকে বড় করতে চায়। পড়াশোনা করিয়ে আকাশের মতো উদার তথা বিশাল করতে চায়। হ্যাঁ। ছেলে বড় হবে। ইংরেজিতে ধেই ধেই করে কথা বলবে। বেশি বেশি করে টাকা কামাবে। শেষ বয়সে বাবা-মায়ের হাল ধরবে।
রাকিল আর রাকিলের স্ত্রী, সত্যি বলতে তারা অসহায়। ডানে বাঁয়ে প্রতিদিন ওপরে উল্লিখিত এরকম বিচ্ছিন্নতাসহ প্রতিদিন একদলা বিজ্ঞাপন খেয়ে তারা ঘুমোতে যায়। অবচেতনে বিজ্ঞাপন মাথায় নিয়ে ঘুম থেকে ওঠে। আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনের শত শত খাবার-খাওয়ার পাশাপাশি, এরা মলিন শুকনো চিপা-চাপাওয়ালা চীনা কমলাও বেশ খায়। আপেল খায়। লাল লাল রসে ভরা টসটসা মলিন! ফলখায়। দেশি টসটসা পেয়ারা, বড়ই, বাঙি, জামরুল, আমলকি, আমড়া, রোগ সারানি ত্রি-ফলাসহ মজার দেশি ফল ছুঁয়েও দেখতে চায় না। কিনতে গেলে কেন যেন ইগোতে লেগে যায়! ছোট বেলায় আম পাড়া, জাম পাড়া, গাছের টেইল ভেঙে ভেঙে, দলা মেরে মেরে খাওয়া এই ফলও আবার কিনে খেতে হয় নাকি! আমরা তো ফল খাবো না। আমরা তো খাবো ফ্রুটস। আমরা খাবো বোতলে ভরা ফ্রুটো!
হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে ওঠে, অসুস্থ বাচ্চাকে জড়িয়ে দম-ফাটানো আচমকা-চিৎকার করতে করতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দেওয়া শুরু করেছে রাকিল।
এই সব চেতন-অবচেতন ঘিরেই মা-বাবা-ছেলেকে প্রতিদিন বলে ওঠে, তাকে অনেক অনেক বড় বানাতে হবে। দেশের বাইরে পাঠাতে হবে। বেশি বেশি টাকা ইনকাম করতে হবে। পরিবার বলেন। সমাজ বলেন। ধর্ম বলেন, কর্ম বলেন। সব মর্মের কুঠরিতে বাস করছে টাকা! টাকা আছে সব আছে। টাকা আছে সম্পর্ক আছে। টাকা আছে তুমি আছ। টাকা আছে আমি আছি। টাকা নাই দুনিয়া নাই। টাকা নাই বাবু নাই। টাকা নাই বউ নাই। টাকা নাই জামাই নাই। সবাই চেতনে-অবচেতনে লাগামহীন টাকা-ঘোড়ার পেছনে টগবগিয়ে ছুটে চলেছে।
রাকিল চাকরিজীবী মানুষ। সারাদিন চাকরি-বাকরি করে মনোযোগ দিয়ে বাচ্চাকে একটু সময় দেবে; তাও ঠিকঠাক হয়ে ওঠে না। রাকিল সত্যি গা-ঝাড়া দিয়ে উঠলো। ছেলেকে তো বাঁচাতে হবে। তার স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে হবে। তারে সুস্থ সুন্দর পরিবেশ দিতে হবে। তারে তার মুখোশপরা বাবা-মায়ের চেহারা খুলে আসল বাবা মার চেহারা দেখাতে হবে! তাকে তার দাদা-দাদু, নানা-নানু, ফুপা-ফুফু, চাচা-চাচি, ভাই স্বজন আত্মীয়দের চেনাতে হবে। এর আগে তো তাকে তার নিজের ভাষা জানতে হবে। নিজের শেকড় চিনতে হবে। তারপর তাকে জাতীয় হইতে হবে। তারপর তাকে আন্তর্জাতিক হইতে হবে। এ রকম শত শত, হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি বৈপরিত্য,অনুযোগ আর অভিমান নিয়ে রাকিল-প্রায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে আছে।
রাকিলের, হঠাৎ করে মায়ের কোমল হাতের দুরুস কুরার কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে ধবধবে সাদা ভাতের সঙ্গে লাল সালুনের কথা। খাওয়া শেষেও হাতের পাঁচ আঙুল দিয়ে, বাসন চটকিয়ে লেহ্য-পেয়-চুষ্য-চর্বনের কথা। হাত ধোয়ার পরও হাতে লেগে থাকতো অমৃতঘ্রাণ। এই ঘ্রাণের গন্ধে পুরো একটা বছর। যুগকে যুগ। শত শত বছর। লক্ষ লক্ষ বছর। কোটি কোটি বছর কাটিয়ে ফেলা যায়—আহা কী স্বাদের দেশি রান্না! সুগন্ধে পুড়ো পাড়া যেন ম ম করতো। মায়ের এই কিসের জাদুকরি হাত।
ইদানিং রাকিনের পেটের ঠিক বাঁ দিকে কিসের একটা ছুরি বিঁধে আছে। এখন এই ছুরিটা তো উপড়াতে হবে। একটু এদিক সেদিক হলেই দমের গাড়ি ফুঁ করে উড়াল দেবে। ছুরিটি যেখানে বিঁধেছে, সেখান থেকেই বেরুচ্ছে ক্যানসার উৎপাদনকারী গেঁজার মতো নানান ধরনের গেঁজা। কোষের পিটে বাড়তি কোষ জন্মানোর মতন। চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগানোর মতন! কোনো অসুখ-বিসুখ হলেই-মায়ের মলিন আঁচলধোয়া নরম ভেষজ লতার দাবডানি-মাখা ওষুধের কথা মনে পড়ে যায়। যা খুবই স্বাস্থ্যকর। যেখানে কোনো সাইড ইফেক্ট ছিল না।
হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে ওঠে, অসুস্থ বাচ্চাকে জড়িয়ে দম-ফাটানো আচমকা-চিৎকার করতে করতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দেওয়া শুরু করেছে রাকিল। কী হয়েছে? কী হয়েছে? কেন হয়েছে! বলো? বলো! কী সমস্যা? সমস্যা কী! কেন হয়েছে! কিছু হয়েছে তো। হ্যাঁ, হয়েছে। হ্যাঁ, বড় ধরনের কিছু একটা হয়েছে।